ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৪
জান্নাত চৌধুরী
দোতলার ঘরগুলো বেশ ছোট ছোট হয়তো আরাধ্যের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরের অর্ধেক মিলে হবে একটা করে রুম। ইফরাহ এদিক ওদিক উকি দিয়ে হাটছে , আসলে সে মানহা কে খুঁজে চলছে। এক এক করে প্রায় সব ঘরগুলো ইতোমধ্যে খুঁজে ফেলেছে বাকি রয়েছে দোতলার শেষ মাথার একঘর এবার পালা তাতেই উঁকি দেওয়ার।
ঘরের দরজা ভাজানোই ছিলো হালকা ছুঁয়ে দিতেই খুলে যায়। ইফরাহ এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় ঘরের ভিতরে। মানহা ঘরে নেই ,পুরো ঘর ফাঁকা। ইফরাহ পুরো ঘরে নজর বুলায় সব সুন্দর করে গুছানো। কথায় আছে , মেয়েরা ঘরের সৌন্দর্য্য। তারা থাকলে ঘর পরিপাটি থাকাটা স্বাভাবিক। গোসলখানায় পানির শব্দ হচ্ছে। ইফরাহ কান পেতে শুনে কিছুটা সময়-
মানহা গোসলে ঢুকেছে আপতত এইখানে না থাকাই ভালো। পরে আসা যাবে ভেবেই দরজার দিকে পা বাড়ায় সে । তবে যাওয়া হয়ে ওঠে না। চোখ জোড়া আঁটকে যায় বিছানায় অযন্তে পড়ে থাকা ডাইরির ওপর।
ইফরাহ দিক পাল্টায় , দরজা দিকে না গিয়ে এগিয়ে যায় সুন্দর লাল ডাইরির দিকে। বিছানার একদম কাছে এসে দাড়ায় সে.. ডাইরির ভেতরে এক কলম রাখা যার অর্ধেকাংশ বাহিরেই রয়েছে। ইফরাহ কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে হাতে নেয় ডাইরি।
অপেক্ষা না করে কমলের অর্ধেকাংশ ধরে উল্টিয়ে দিতেই, কিছু লেখা উন্মুক্ত হয়ে যায় তার সামনে। ইফরাহ ছোট ছোট চোখ করে পড়তে থাকে থাকে লাইনগুলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কি অদ্ভুত
আপনার আমার প্রেম হয়নি —হবেও না।
অথচ আমি মরেছি আপনার মায়ায় ,
কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি।
আর পারবোও না — তাতে কি ?
আপনি নাহয় আমার জীবনের , ওই দূর আকাশের চাঁদ হয়েই
থেকে গেলেন। ছুঁতে না পারি দেখতো তো পারবো।
পূর্ণচন্দ্রীমার নিয়ন আলো গাঁয়ে মেখে নিজেকে বুঝিয়ে নিবো।
আপনি আমার অপ্রাপ্তিতে গড়ে ওঠা নীরব ভালোবাসা।
থেমে যায় ইফরাহ। গোসলখানার দরজায় শব্দ হচ্ছে, পানির শব্দটাও থেমে গিয়েছে। সে দ্রুত হাতে ডাইরিতে কলম ঢুকিয়ে রেখে দেয় যথা স্থানে।
মানহার গোসল শেষ ,টিয়া রঙের এক গোল চুড়িদার পড়েছে মেয়েটা, বেশ মায়াবতী লাগছে। ইফরাহ এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ঘরের মাঝখানে। মানহা ভেজা চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বলে –
– বাবা মীর বাড়ির বউরানী হঠাৎ আমার কাছে , কাহিনী কি?
কিছু টা জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে ইফরাহ। সরে গিয়ে দাঁড়ায় মানহার মুখোমুখি তারপর ধীর কন্ঠে বলে-
– মনে হলো একটু আসি ।
– বেশ ভালো করেছো, বসো।
ইফরাহ কথা বলে না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মানহার দিকে। শ্যামাঙ্গিণীর চোখ দুটো ভর্তি মায়া।হালকা কোঁকড়ানো কোমড় অবদ্ধি ভেজা চুলোগুতে গামছা দিয়ে হাত বুলোচ্ছে মেয়েটার।
মানহা ভেজা গামছা নিয়ে বেলকনিতে মেলে দিয়ে আবারো এসে দাঁড়ায় ইফরাহর কাছে। কিছু একটা নিয়ে ভাবছে ইফরাহ , মানহা শরীর হাত ছোঁয়াতেই চমকে ওঠে সে।
– বউরানী ।
– কিছু বললে বুবু !
স্তব্ধ হয়ে যায় মানহা ইফরাহর হালকা বয়স। মানহার থেকেও বয়সে বেশ ছোট মেয়েটা। মানহা কিছুসময় চুপ থেকে মানহার ডাকটা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছে।
– ছাদে যাবে বুবু ?
মানহা ঘোর থেকে বেড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে – ” আমায় তুমি ববু বলছো বউরানী ।
– কেন তোমার বুঝি খারাপ লেগেছে ?
মানহা মাথা ডানে বামে মাথা ঝাঁকায়। যার অর্থ তার খারাপ লাগে নি। ইফরাহ এগিয়ে এসে হাত ধরে মানহার বুঝদার মেয়ের মতো বলে –
-তুমি আমার বয়সে মেলা বড় ববু। আর বড়দের তো সম্মান দিতে হবে তাইনা ? এখন থাক ওসব ছাদে যাবে –
বুকে জমানো চাঁপা কষ্টগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে নিংড়ে বের করে মানহা বলে
– এই দুপড়ে ছাদে কেন? রোদ দেখছো এই সুন্দর রূপ যদি জ্বলে যায় তবে ছোট নবাবের মন পাবে কেমনে শুনি।
তাচ্ছিল্যে হাসো খেলে যায় ইফরাহর ঠোঁটে। কিছু না বলে সে , কিছুটা ঘুরে এগিয়ে গিয়ে মানহার পড়ার টেবিলে সামনের কাঠের চেয়ার টেনে বসে।
– চুপ করে গেলে যে ?
– যে ভালোবাসায় রূপের প্রাধান্য বেশি , তাতে আদতেও ভালোবাসার ছিটে ফোটা আছে বুবু?
ইফরাহর করা প্রশ্নে, মুখ কালো করে নেয় মানহা – ইফরাহ বাকা হাসে।
– ভালোবাসা নারীর রূপ দেখে নয়। মন থেকে অনুভব করার জিনিস।
” বউরানী”
দরজায় থেকে ডাক পড়েছে। ইফরাহ মানহার থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকায় রেণুর মা এসেছে। মানহা এগিয়ে যায় দরজার কাছে নরম স্বরে
– কিছু কইবা চাচি ?
রেণুর মা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলে ” বলমু গো মানহা আপামনি , ছোট নবাব আইয়া পড়ছে বউরানীর ডাক পড়ছে খাবার টেবিলে।
মানহার বুকের মাঝে আবারো শুরু হয় এক অশান্ত ঝড় দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে ভিতরটাকে। ইফরাহ বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায় মাথার কাপড়টা কিছুটা টেন দরজার কাছে এসে তাকায় রেণুর মার দিকে। মাথাটা হালকা নিচু করে বলে –
– আপনি যান আমরা আসছি !
রেণু মা সম্মতি জানিয়ে জায়গা ত্যাগ করে। ইফরাহ মানহার মুখের দিকে তাকায়
যাকেই ভালোবাসবে
সেই মানুষটাই উড়াল দিবে—
দুরের ওই নীল রঙের আকাশটা ছুতে।
আর তুমি থেকে যাবে শেকড় গেঁথে , অপেক্ষার বৃক্ষ হয়ে!
মানহা মনযোগ দিয়ে শুনছিলো কথাগুলো। ইফরাহ আর দাড়ায় না, কোনোমতে কথা গুলো শেষ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় সে।
খাবার টেবিলে বসে পানি ভর্তি গ্লাস ঘুড়িয়ে চলছে আরাধ্য। অরুনিমা প্লেটে প্লেটে খাড়ার বাড়ছে। রেজা চুপচাপ বসে বসে আঙ্গুল টুকছে।
দুজনের সামনেই রয়েছে ধোয়া ওঠা গরম ভাত। রেণুর মা এক এক করে তরকারির বাটি এনে রাখছে টেবিলে। ইফরাহ সিঁড়ি নামতেই আরাধ্য উঠে গিয়ে পথ আটকায় তার।
– এইযে বউ , স্বামী বাড়ি এসেছে তুমি চেংড়ি কই গেছিলা পাড়া ঘুরতে শুনি?
আরাধ্যকে পাশ কাটিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় ইফরাহ । আরাধ চোখ পিটপিট করে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে
– যাহ শালা বউ আমারেই পাত্তা দিলো নাহ।
নিজেকে আরো কিছু বোকা দিয়ে সেও ইফরাহর পিছু পিছু এসে আবারো বসে চেয়ারে চেঁচিয়ে বলে ” আম্মা খাওন দেও ‘ ।
অরুনিমা ছেলের প্লেটে মুরগির রান দিতে দিতে বলে –
– হাতে মাথায় কেমনে ব্যথা পাইছো বাপ জান ?
মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা ভাত মুখে তুলে আরাধ্য। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে – সব কিছু ঠিক না হলে আবার জানাবের খাওয়া চলে না। মুখের ভাত শেষ করে বলে –
বাড়ির লবণ কি ফুরাইয়া গেছে আম্মা ?
রেজার প্লেটে তরকারি দিচ্ছিল অরুনিমা , ছেলের এহেন হেয়ালি তার অচেনা নয়। তিনি বেশ অভ্যস্ত এসবে –
এই যেমন : তরকারিতে লবণ কম হইলে বলে — বাড়ির লবণ কি ফুরাইয়া গেছে আম্মা। আবার বেশি হলে বলে আইজ বুঝি চিনি ভাইবা লবণ দিয়া দিছেন তাইনা আম্মা? তরকারি যদি অতি স্বাদ হয় তবুও এই ছেলে মুখে প্রশংসা আশা করা ভুল। বাকি দুটো নিজে বললেও শেষেরটা সে কোনো কালেই বলেনা। বরং অরুনিমা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে তরকারি কেমন হইছে বাপজান?
তখন ছেলে তার মুখ ফুটে বলে – কে রান্না করছে আম্মা? আহ আমার তো তরকারির সাথে রাঁধুনীর হাত সহ চেটে খেতে ইচ্ছে করছে। অরুনিমা তখন চিন্তায় পড়ে যায় ছেলে তার প্রসংসা করলো না বদনাম।
রেজার প্লেটে মুরগির দ্বিতীয় রান টি তুলে দিয়ে হাক ছাড়ে
অরুনিমা।
– রেণু মা রান্নাঘর থেইকা লবণে ডিব্বা নিয়া আইসো।
দুজনকে খাবার বেড়ে দিয়ে টেবিলে এক চেয়ার টেনে বসে অরুনিমা। তার পাশেই একটা ফাঁকা চেয়ার কিছুটা ঠেলে দিয়ে তাতে ইফরাহ কে বসতে ইশারা করে। ইফরাহ প্রথমে বুঝতে না পরলেও পরে ঠিকি বুঝে।
অরুনিমা এক প্লেটে ভাত তুলে। পাশ হতে মাংসের বাটি হতে মাংস তুলে নেয় প্লেটে। লাউ দিয়ে মাছ রান্না করেছে- মাছের মাথাটা তুলে নেয় একই প্লেটে। ইফরাহ বসেছে অরুনিমা পাশে।
বাম হাত দিয়ে ডান হাতে থাকা চুড়িটা কিছুটা মোচড়ে হাতের উপর দিকে ঠেলে দিয়ে ভাত মাখতে শুরু করে অরুনিমা।
রেণুর মা লবণের ডিব্বা নিয়ে এসছে। আরাধ্যের দিকে ডিব্বা এগিয়ে দিতেই সে বলে-
-লাগবে না চাচি , এমনিতেই মিষ্টি ভেবে নোনতা বিস্কুট কিনেছি। যার স্বাদ মুখে লেগে আছে। আপাতত তরকারিতে লবণ কম হলেও
মুখে স্বাদের তফাৎ হয় না। আপনি বরং শামসির পুত কে লবণ দিন। বেচারার ভবিষ্যত সামনে !
আরাধ্যের বলা কথায় খুকখুক করে কেশে ওঠে রেজা। আসলে কোন কথায় ছোট নবাব কি ঢুকালো , ব্যাপারটা তার চতুর মাথাও বুঝতে অস্বীকার করছে। আরাধ্য সামনের পানির গ্লাস রেজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে –
– আরে.. আরে আস্তে বেটা । দম এতো ছোটো হলে চলবে ? দম বাড়াও।
দ্রুত পানির গ্লাস হাতে তুলে ঢকঢক করে পুরোটাই খেয়ে ফেলে আরাধ্য। কাশি কমে গিয়েছে , এখন শান্তি তবে এখানে বেশি সময় থাকলে তার শান্তির বারোটা পেরিয়ে বারো দুকোনে চব্বিশ হয়ে যাবে।
অরুনিমা ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে ধরে ইফরাহর মুখের সামনে। ইফরাহ এতো সময় আরাধ্য করা প্রতিটি কাহিনী শান্ত চোখে দেখছিলো। তবে এবার যেন বেশ শকড খায় সে ,অরুনিমা তাকে খাইয়ে দিবে এ যেন নিহাতি কল্পনা। মাথাটা হালকা ঘুড়িয়ে অরুনিমার দিকে তাকতেই চোখ দিয়ে খেতে ইশারা করেন তিনি।
ইফরাহর চোখে পানি চুপচুপ করছে। ঝাঁপসা হয়ে আসছে চোখের মনি।কোনো মতে কান্না আটকিয়ে খাবার মুখে নেয় সে।
সকলেই চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। মানহা এসেছে , অরুনিমা ইফরাহ কে খাইয়ে দিচ্ছে হাহ! ব্যপারটা তার বেশি ভালো লেগেছে বলে মনে হয় না। মুখে হাসি নেই – আরাধ্যের পাশে একটা চেয়ার খালিই আছে। মানহা এগিয়ে গিয়ে বসে , আরাধ্য হাতে ব্যান্ডেজ দেখে ভীষণ কষ্ট লাগে তার , নরম গলায় মাথা নিচু করে বলে
– আপনার হাতে কি করে লেগেছে আরাধ্য ভাই ?
আরাধ্য খাবার খাওয়া প্রায় শেষ, প্লেটের এক অংশে অবশিষ্ট আছে রানের হাড্ডি। আরাধ্য হাড্ডি হাতে তুলে নিয়ে মানহার দিকে ঘুরে তাকায়। মানহা মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রাখে মানুষটির। কালো মনির ঘন পাপড়ির চোখজোড়া অন্যরকম এক সৌন্দর্য্য। আরাধ্য হাড্ডির মাথায় কামড় দিতে গিয়ে মানহার দিকে তাকিয়ে বলে
– খাবি ?
মানহা ডানে বামে মাথা নাড়ায় ,মানে সে খাবে না। আরাধ্য ঘটায় না তাকে। হাড্ডিতে কামড় দিয়ে বলে
– হয়েছে কি গ্রামে অনেক ভালো মুরগি চোরের আমদানি রপ্তানি হচ্ছে। তা আমি যেহেতু মুরগির প্রেমিক, কি করে আমার জিনিস রপ্তানি করতে দেই , কহেক তো মাই টুনটুনি। তাই একটু ” চাটকি পিসিং” করতে গিয়ে হাতে লেগেছে।
– তুমি মারামারি করেছো আরাধ্য ভাই ?
– বোকা চেংড়ি , মারামারি কি রে ? ওসব কি আমি পারি নাকি- আমি পারি আদর – যত্ন আর সোহাগ করতে তাই করেছি।
মানহা ফিক করে হেসে দিয়ে কৌতুহলী হয়ে বলে ” তোমার আদরে নিশ্চয়ই তাদের শান্তি লেগেছে।
– ওইটা আর বলতে। গুনে গুনে আধাঘণ্টা ধরে আদর করেছে ছোট নবাব।
রেজার খাওয়া শেষ প্লেটে হাত ধুতে গিয়ে মানহার প্রশ্নের উত্তর দেয় সে। মানহা মুসকি হেসে আবারো আরাধ্য কে বলে
– অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে, ভীষণ লেগেছে, ঔষধ – পাতি কিছু কি এনেছো।
– এতো ভাবিস না ঠিক আছি খাবার খা ।
ইফরাহ এতো সময় চুপচাপ খাচ্ছিলো আশেপাশের সব কথাই তার কানে এসেছে তবে সে নিজের মতো। ভাতের শেষ লোকমা ইফরাহ কে খাইয়ে একই প্লেটে ভাত নেয় অরুনিমা। রেণু মা এক প্লেট ভাত এনে রাখে মানহার সামনে।
আরাধ্যের খাওয়া শেষ। চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবে হঠাৎ কিছু মনে করে থেমে যায় সে – রেজা দিকে তাকিয়ে বলে ,
– ওই শামসির পুত , আইজকা আমার শশুর বাড়ি যাবি বেটা। আমার বউয়ের বইগুলো আনানোর ব্যবস্থা করবি। বউ আমার শিক্ষিত নাহলে আবার গ্রামের লোকে কইবে , মীর বাড়ির
বউরানী মেট্রিক পাস টাও করতে পারেনি।
রেজা আড়চোখে একবার ইফরাহর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। তারপর গলা খাদে নামিয়ে বলে
” এইডা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছোট নবাব শুনেছি বউরানী সাইন্সের ছাত্রী। মেধা ভালো আশা করি ভালো কিছই হবে ! ”
– আহ তাই নাকি , বউ আমার সাইন্সের ছাত্রী ? বেশ ভালোই তো- পদার্থ,রসায়ন না পাড়লেও চলবে বায়োলজি ভালো জানো তো নাকি সোনা ?
ইফরাহ উত্তর করে না। সকলের সামনে এমন উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর সে কখনোই করবে না। চুপচাপ পানি খেয়ে উঠে দাড়ায় সে –
আরাধ্য বাঁকা হাসে, ইফরাহ রাগ আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে ,
– আমি ঘরে যাচ্ছি বউ। জলদি এসো দুপুরের খাওয়া শেষে তোমাকে জড়িয়ে একটা কম্বল জোড়ানো ঘুম দিতে চাই পিও।
উপস্থিত সকলেই প্রায় মুখ চিপে হাসছে। আরাধ্য এগিয়ে যায় সিঁড়ি দিকে। ছেলের এইসব লাগাম ছাড়া কথাতে অরুনিমা মাঝে মাঝে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায় এই ছেলে কার মতো হয়েছে ?
ইফরাহ ঠায় দাঁড়ানো রয়েছে। মানহা। খাওয়া বাদ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে টিটকারী কেটে বলে।
– বউরানীর মনে চাইছে ছোট নবাব তাকে কোলে করে নিয়ে যাক। লাজ লজ্জা একটু ভেতরে আনো মেয়ে । স্বামী ডেকেছে এইখানে সং হয়ে না থেকে ঘরে যাও।
আরাধ্য ঘরে এসে চিতফটাং হয়ে শুয়ে পড়েছে, চোখ দু’টো বড় বড় করে স্লিলিংয়ের গায়ে তারা গুনছে। দিনের বেলায় তারা ছ্যাহ – কি সব কথা। আরাধ্য চোখ বুজে গাঢ় এক নিঃশ্বাস টানে। মনে মনে হয়তো নতুন ফন্দি আটছে , মানুষটার চুপ থাকাও ভয়ংকর এক লক্ষণ।
হাতে ব্যথা বেড়েছে, গায়ে জ্বর চলে এসেছে কিছুটা ।আরাধ্য কিছু সময় পর আবারো চোখ খুলে। না তার তেজস্ক্রিয় বউয়ের এখনো ঘরে আসার সময় হয় নি। এই মেয়েটা তাকে এক দন্ড শান্তি দিচ্ছে না। মেয়েটা জেনে বুঝেই এমন করছে ওই যে বুঝে গেছে না – নাগিনের শীতল শরীর জড়িয়ে না ধরলে আমার চোখে ঘুম আসবে না। হাতে ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে তেছড়া গলায় বলে –
– একটুই তো লেগেছে ভাই । একটু খানি চামড়া ছুলে গেছে তাতেই শালা তুমি ব্যথায় তো বাঁদর নাচ নাচতে চাইছো। উহু এতো সহজে তো আমি কাবু হবো না, সে তুমি যতই কনকন করো।
হাত থেকে চোখ সরিয়ে আবারো দরজার দিকে তাকায় আরাধ্য ইফরাহ এখনো নাই, সে জিহ্বা দিয়ে মাড়ি ঠেলে বলে ” এবার তো দেখছি সাপুড়ে হয়ে ঘরে বিন রাখতে হবে। যেনো বিন বাজালে আমার নাগিন বউ সব ফেলে আসে। ”
আরাধ্যর ধৈর্য্য কুলায় না জিন্সের পকেটে হতে টেনেটুনে এক সিগারেটের প্যাকেট বের করে সে। সযত্নে প্যাকেটের মাথা খুলে একটা সিগারেট নিয়ে রাখে ঠোঁটের কোণে। বাম হাতে দুই পকেট হাতরে খুজে বের করে লাইটার।
সিগারেটে আগুন দিতেই বিকট এক গন্ধে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঘরে। মুখ ভর্তি ধোঁয়া টেনে শূন্যে ছুঁড়ে গুনগুনিয়ে গান ধরে আরাধ্য –
ব্রিজের তলায় নরম মাটি !
কাগজ দিয়া বানাইয়া পাটি
রাজার বেসে বইসা থাকি ,
রানী পাশে নাই ।
যে রাজার রানী নাই
সে রাজায় গাঁজা খায়।
যে রাজার রানী নাই
সেই রাজায় ঝিমায়।
গানের মাঝে কিছুটা হেঁসে ওঠে সে। নষ্ট পুরুষের ,নষ্ট মস্তিষ্কের- বিকৃত গান। আরাধ্য ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে। খাটের পাশিতে হেলান দিয়ে বালিশ তুলে নেয় কোলে-
ভয়ংকর কিছু ঘুরছে তার মাথায় যার পূর্বাভাস আরাধ্যের বাঁকা হাসি।
ইফরাহ ঘরে এসেছে। হাতের বাটিতে কিছুটা একটা এনেছে। আরাধ্য ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে তার আসার পানে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। ছোট ছোট কদম ফেলে একদম বিছানার কছে এসে দাঁড়ায় সে। চোখ রাখে আরাধ্য চোখে। লোকটার চোখ দুটো যতটাই শান্ত ততটাই নিষ্পল। ইফরাহ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে নিজেকে দৃষ্টি ঘুড়িয়ে নিতেই আরাধ্য ডেকে ওঠে –
– রক্তকমলিনী
ইফরাহ চোখে বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে! কিছু সময়চুপ থাকলে, আবারো ভেসে আসে আরাধ্য মায়াবী এক ডাক।
” রক্তকমলিনী ”
ইফরাহ তাকায় লোকটার মুখের দিকে তবে হঠাৎ হেসে ওঠে আরাধ্য।
– বাহ রাগলে বুঝি মেয়েদের সুন্দর লাগে , নাকি তোমারেই লাগে আমি শালা মাঝে- মাঝে বুঝে উঠতে পারিনা।
“আপনার জন্য গরম পানি এনেছি। একটু সরে বসুন হাতের কাটা পরিষ্কার করে ঔষধ লাগাতে হবে।”
– মায়া করছো দেখছি। বাহ কপালে নিশ্চয়ই উন্নতি আসছে বুঝলে ? আজকাল দেখছো না, কি সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।
ইফরাহ কথা না বলেই আরাধ্যের থেকে কিছুটা দুরত্ব রেখেই বসে পড়ে তার সামনে।বাটিতে কিছুটা কুসুম গরম পানি আছে আর তাতেই ছোট একটা কাপড়ের টুকরা ভিজানো।বেশ দক্ষ হাতে আরাধ্যের হাতে ব্যান্ডেজ খুলে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জায়গায় গরম পানিতে ভেজানো কাপড়ে আলতে হাতে পরিষ্কার করে সে। আরধ্য পুরো সময়টাই চুপ করে দেখছে মেয়েটা কে। ইফরাহ কাজ শেষ – সাইড টেবিল হতে একটা নাপা বের করে আরাধ্যের হাতে দিয়ে বলে ,
“খেয়ে নিন ? ”
এত সময় চুপ থাকলেও এবার আরাধ্য প্রতিবাদ করে বলে
” ওইসব সাপের বিষ আমি খাইনা। শত্রু বলে যত্নের নামে বিষ দিয়ে মারতে চাইছো বউ? ছ্যাহ !
ইফরাহ বেশ বড় বড় চোখ করে তাকায়” আরাধ্য নাক কুঁচকে নিয়ে বলে –
– ছ্যাহ! আজকাল এক হাঁটুর বয়সী মেয়ে আমাকে চোখ রাঙাচ্ছে। কতটা খারাপ দিন দিলে মাবুদ।
ইফরাহ চোখা বুঝে নিজেকে শান্ত করে ,তবে চোখ খুলে হাতে থাকা নাপা নিজের মুখেই পুরে ঢকঢক করে পানি খেয়ে আরাধ্যের দিকে তাকিয়ে বলে
– খেয়ে নিলাম , আপনার নসিব ভালো হলে তবে জ্বর ভালো হয়ে যাবে ।নয়তো দোয়া করবো তীব্র থেকে তীব্র জ্বর আপনার শরীর দখল করুক।তাতে যদি পাপ গুলো একটু কমে।
পানির গ্লাস বেড সাইড টেবিলে রেখে ইফরাহ উঠতে চায় বিছানা ছেড়ে তবে আগে তাকে বিছানায় ফেলে শাড়ির আঁচল সরিয়ে তার মুখ ডুবিয়ে দেয় আরাধ্য।
ঘটনা এত দ্রুত হয়েছে যে। নিজেকে সামলে নিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ইফরাহ। কনুইয়ের ক্ষত স্থান হতে আবারো তাজা রক্ত বেরিয়ে আসে আরাধ্যের। সেদিকে কে খেয়াল দেয় –
– কাছে এসেছো , পাশে বসছো। নিজের মর্জি মতো কাজ করেছো, বাধা দেইনি। এখন আমি আমার কাজ করবো একটুও বাঁধা দিবে না মেয়ে।।
আরাধ্যে খসখসে হাতে চেপে ধরে ইফরাহর কোমড় । ইফরাহ নরম পেটে মুখ ডুবিয়ে কিছু সময় মেয়েটার শরীরের ঘ্রাণ নেয় সে। ইফরাহর ধৈর্য্য কুলিয়ে উঠছে না। এযেন ভীষণ অত্যাচার হচ্ছে তার উপর। আরাধ্য বেশ কিছু সময় চুপ থেক টেনে ধরে ইফরাহ কোমড়ে থাকা কালো সুতার ধাগাটা। চামড়ায় টান পড়তে ব্যথায় চোখ খিছে নেয় ইফরাহ! পেটের উপর হালকা করে নাক ঘুষে মুখ তুলে আরাধ্য বলে –
“এই যে রক্তকমলীনি কোমড়ে সুতাটা খুলে ফেলি বউ? ”
ইফরাহ ধপ করে চোখ খুলে ফেলে। রাগ লাগছে তার- এই মানুষটা সুতোর পিছনে কেন পড়ে আছে আল্লাহ মালিক জানে। দাঁতে দাঁত কটমট করে ইফরাহ্ বলে-
” কেন ওটা আপনার বাড়ির কোন কাজে বাঁধা দিয়েছে?”
দুষ্টু হাসে আরাধ্য , সুতা দিকের একবার তাকায় পরক্ষণেই তাকায় ইফরাহর মুখে দিকে ” বাড়ির কাজ বাধা না দিলেও আমার কাজে দিচ্ছে। ”
ইফরাহ ছটফট করছে। পালাতে চাইছে আরাধ্যের থেকে, তবে এই মানুষের থেকে পালানো কি কখনো সম্ভব? একদম নয়। ইফরাহ হালকা ঝাড়ি দেয় আরাধ্যকে ” সরে ঘুমান আপনি ”
“ও বউউউউ খুলতে দেও না! ”
– একদম নয় দূরে যান।
এক চোখ বন্ধ করে জিহ্বা দিয়ে মারি ঠেলে আরাধ্য। খানিক সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে বলে
” এ্যাহ নাগিন! তোমার কি মনে হয় , তুমি মানা করলে বুঝি আমি শুনবো ? উহু একদম নয়। ওসব বাল’ছেড়া কথা আমাকে বলতে এসো না তো!! খুলবো বলেছি মানেই … বিসমিল্লাহ ! ”
আরাধ্য কথা শুনেনা কোনোমতে নিজের কথা শেষ করে দাত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে দেয় ইফরাহর কোমড়ের ধাগা। যুদ্ধ জয় করেছে সে। পিটপিট চোখ তুলে তাকায় ইফরাহ দিকে মেয়েটার চোখ টলমল করছে।
রক্তকমলিনী কাঁদছো তুমি ?
ইফরাহ কথা বলে না আরাধ্য উপর জমে থাকা ঘৃণা যেন আরো বৃদ্ধি পেয়ে যায় তার। ফট করে মাথাটা ডান দিকে ঘুরিয়ে নেয় সে।
ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৩
তাতে আরাধ্যের কি? সে তো ভালো কাজ করছে। জিনিস টা বড্ড সস্তা। জিন্সের পকেট হতে- বেশ চ্যাপ্ট চেন জাতীয় এক কোমর বন্ধনী বের করে খুব যত্নে তার রক্তকমলিনীর কোমড়ে পড়িয়ে দেয়।
উফফ এখন ভীষণ শান্তি লাগছে তার। জায়গার জিনিস জায়গায় পড়িয়েছে সে। ফর্সা দেহে সোনালী জিনিস বরাবরই ঝলক দেয়। যদি তা হয় স্বর্ণে তবে যেন আর কথাই নেই। বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে আরাধ্য আবারো মুখ ডুবিয়ে দেয় ইফরাহর পেটে।
