ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৫
জান্নাত চৌধুরী
বিকাল পাঁচটা , ক্লান্ত শরীর টাকে কোনো মতে টেনেটুনে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন চেয়ারম্যান সাহেব। বাড়িতে ডুকেই বসার ঘরে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে লোকটা। গ্রীষ্মের আগমনী হচ্ছে ,শীত শীত ঠান্ডা আবহাওয়া পেরিয়ে চারদিকে এক ভ্যাবসা গরম। সূর্য যেন মাথার উপর দাঁড়িয়ে মগজ গলিয়ে দেবার উপক্রম।
অরুনিমা পানির গ্লাস হাতে এসে দাঁড়ায় চেয়ারম্যানের সামনে।ঘামে ভিজে যাওয়া পাঞ্জাবি খুলে সোফায় উপর রাখেন তিনি।
বিদ্যুৎ নেই এই , গরম এলেই এই এক সমস্যা বিদ্যুৎ থাকেনা ঠিক মতো। একটু যে বসে ফ্যানের বাতাসে শরীর শীতল করবে উপায়ান্তর নেই। অরুনিমার হাত থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে প্রশ্ন করেন—
– ফারহান বাড়ি এসেছে ?
অরুনিমা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। চেয়ারম্যান পানি পান করে বলে।
– ডাকো তোমার ওই কুলাঙ্গার কে , আজ হয় ওই কুলাঙ্গার থাকবে এই বাড়িতে, না হয় আমি। আমার এতো কষ্টের তৈরি নাম জোশ সব ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে তোমার গুনধর ছেলে।
অরুনিমা দুই ভ্রু কুঁচকে একসাথে করে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থাকন চেয়ারম্যানের দিকে। চেয়ারম্যান বকবক করেই চলছে তবে ,মোক্ষম জায়গায় পেরেক পুঁতে অরুনিমা বলে ওঠে।
– অজাতের বংশের ছেলে কুলাঙ্গার না হয়ে, ভালো হবে তা কি করে হয় ? এবার না হবে সেয়ানে সেয়ানে রাজনীতি ! তা বলুন শুনি আমার কুলাঙ্গার খানা কি করছে ।
– অরু।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাগী চোখে অরুনিমা দিকে তাকায় চেয়ারম্যান। তবে তাতে থুরি পাত্তা দেবে , খানদানি বংশের মেয়ে সে। অরুনিমা পানি গ্লাস টি টেবিলে ওপর রেখে কড়া গলায় বলে।
– বংশ পরম্পরায় আপনাকেও আমার শশুর বাপ কুলাঙ্গার বলেই সম্বোধন করতো।শুশুর বাপ বেঁচে থাকতে খুব গুনি কাজ করেছেন বলে , আমার মনে পড়ছে না। কোন গুনে যে এলাকার লোক আপনাকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করে ,তা আমি আজো ঠাওড়ে নিতে পাড়ি নি।
চেয়ারম্যান কিছু টা দমে গেলেও , তা প্রকাশ করেনা। জমিদার বংশের ছেলে তিনি নারীর কাছে তর্কে হারবেন না। এসব তাদের মানায় না ,কন্ঠ ছোট করে বলে –
– তার মানে তুমি কি বলতে চাইছো ? আমার কি এই নাম ডাক ধার করে এনেছি ,নাকি কেউ আমাকে দোয়া করে দিয়েছে।
অরুনিমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে – আপনার কোনো নাম ডাক নেই! যা আছে ক্ষমতার বরাই ? ওসব নিয়ে আপতত মুখ খুলতে চাইছি না। বলুন শুনি আমার ছেলে কি করছে ?
চেয়ারম্যান সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে অরুনিমার চোখে চোখ রেখে বলে – ” আগে ডাকো তোমার মানিক কে !
অরুনিমা হাক ছেড়ে ডাকে রেণুর মাকে। বাড়ির বাকি কাজের লোক গুলো ছুটিতে। রুইসুলের পরীক্ষা চলছে ,
রেণুর শাড়ির আঁচল এসে দাঁড়িয়ে বলে –
– গিন্নি মা !
অরুনিমা রেণুর মা কে কড়া গলায় আদেশ স্বরে বলে –
– জলদি গিয়ে ছোট নবাব কে নিচে আসতে বলো। বউরানী কেউ বলবে।
রেণু মা মাথা ঝাঁকিয়ে চলে যায় সিঁড়ি দিকে। অরুনিমা রাগে কটমট করে তাকিয়ে আছে চেয়ারম্যান দিকে। চেয়ারম্যান একটুও পাত্তা দেয় না সেদিকে।তা যেন অরুনিমার রাগ আরো বাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
“আপনি কি আমায় এড়িয়ে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান সাহেব ?
এই হয়েছে মহিলাদের এক সমস্যা। রাগ দেখালে তারা উল্টো আরো রেগে যায়, ধমক দিলে কেঁদে বুক ভাসায় , আবার যদি চুপ হয় যাও ,তাতেও এক সমস্যা। শালার নারীর জাত এদের না আগে যেতে হয়, না পড়ে। তাহলে যাবো টা কোথায় — চেয়ারম্যান মনে মনে কথাগুলো ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে এগিয়ে এসে হাত ধরে অরুনিমার। চোখ টলমল করছে , চেয়ারম্যান হাত ধরতেই ঠোট উল্টায় অরুনিমা। অথচ বয়স বাড়ছে দুজনের ,এ বয়স কি তাদের প্রেমের বয়স?
নাহ ! তবে কি ?
প্রেমের কোনো বয়স হয় না। নারীরা তার প্রিয় মানুষের কাছে বরাবরই বাচ্চা – আদুরে সাজতে চায়।
চেয়ারম্যান হাত রাখে অরুনিমার মাথায় শান্ত স্বরে বলে –
গিন্নি বয়স হচ্ছে , ছেলে বড় হয়েছে বিয়ে-সাদি দিয়েছি। আজো এই বাচ্চামী করলে চলবে বলো?
অরুনিমা মাথা থেকে হাত সরিয়ে দেয় চেয়ারম্যানের। অভিমান হয়েছে তার, ভারি অভিমানি হয়েছে সে। চেয়ারম্যান এবার হাত শক্ত করে ধরে তার।
– অরু !
অরুনিমা উত্তর করেনা। এই মূহুর্তে সে একদম কথা বলতে চাইছে না। চেয়ারম্যান কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বলে –
“মনে কি পড়ে সে পুরোনো দিনে কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তোমার আমার প্রথম দেখা। সেবার আমি আইন বিভাগের ছাত্র ছিলাম, তুমিও ছিলে বাংলা বিভাগের ছাত্রী।
শরতের নীল আকাশে সাদা স্বচ্ছ মেঘের মেলা, কাশফুলের সেই সাদার মাঝে তুমি পরি এসেছিলের আমার হিয়ার মাঝে।অস্থির হয়েছিল মোর হৃদয় ,তোমার পোটল চেড়া
দু চোখের মায়ায় পড়ে।
ওগো নারী তোমার মায়ায় জ্বলেছি ,পুরেছি শেষে কয়লা হয়ে সোনার দামে বিক্রি হচ্ছি।
আমি আজো তোমায় ভালোবাসি।
আমার ঘরওয়ালি , আমার রমনী। ”
ফিক করে এসে ওঠে অরুনিমা। চেয়ারম্যান নিষ্পল দৃষ্টি তাকিয়ে দেখে সেই হাসি। কেটে গেছে কত বছর তবুও যেন এই নারীর প্রতি অনিহা আসবে না। অরুনিমা হাসি থামিয়ে চোখ চোখ রেখে বলে-
বুড়ো হয়ে গেলেন , তবে আজো কবিতার ছন্দ বাঁধতে শিখলেন না। বড্ড বেসুরে আপনি চেয়ারম্যান সাহেব , আর কবে শিখবেন?
চেয়ারম্যান কিছু সরে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুঝে বলে, এ জীবনে আর কবিতা লেখা হবে বলে মনে হয় না গিন্নি , বয়স তো পেরিয়ে গেলো। বাকিটা জীবন নাহয় এই ছন্দহীন কবিতা শুনেই কাটাও।
বেশ কিছু সময় ধরেই বিছানা ছেড়ে উঠার জন্য ছটফট করছে ইফরাহ। তবে আর হচ্ছে না , পুরুষালীর শক্ত হাতে বাঁধন ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়া আদতেও সহজ না।
আরাধ্য ঘুমাচ্ছে , তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে লোকটা । গায়ে জ্বর এসেছে , হাতের রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে।
জ্বরে ঘোড়ে বেশ কয়েকবার আবল তাবল বলেছে। ইফরাহ বেশ কয়েকবার কান পেয়ে শুনতে গিয়েও কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি।
জ্বরে মুখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছে লোকটার , বেশ মায়া হচ্ছে ইফরাহ। চেহারা টা কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে- ইফরাহ কিছু সময় তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আবারো ছাড়াতে চায় নিজেকে ,
হাঠৎ দরজার শব্দ হচ্ছে ,বেশ কয়েকবার থেমে থেমে কড়া পড়ছে , ইফরাহ উপায়ান্তর না পেয়ে ডাকতে থাকে আরাধ্য কে –
– এই যে শুনছেন , ছাড়ুন আমাকে। দরজায় কেউ এসেছে , ডাকছে। শুনছেন ?
আরাধ্য নড়ে না। ইফরাহ ছটফট করছে , এদিকে দরজায় শব্দ হয়েই চলছে। বেশ কিছু সময় অতিক্রম হতে , সে আবারো ডাকে আরাধ্য কে
সরুন দোয়া করে , হাতের ব্যাথা আর জ্বর দু’টোই বেশ কাহিল করেছে আরাধ্য শরীর। ইফরাহর ডাক কানে আসতেই ঘুম ঘুম চোখ তাকয় সে –
– কি হয়েছে ?
” দরজার ডাক পড়েছে , হয়তো কোনো প্রয়োজন ছাড়ুন দোয়া করে ।
ইফরাহর কন্ঠে আকুতি, “ মনে হচ্ছে বাঘের কাছে প্রাণের ভিক্ষা চাইছে ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে আরাধ্যের। কেউ তাকে ভয় পাবে ,তার কাছে আকুতি করবে এইটাই তো যে চায়। আরাধ্য বাঁকা হেসে ছেড়ে দেয় ইফরাহকে।
– বউরানী শুনছেন ?
দরজা থেকে কারো গলার আওয়াজ আসছে, আরাধ্য অতি কষ্টে উঠে বসে। ইফরাহ পড়নের কাপড় টেনেটুনে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। দরজা খুলেতে রেণুর মা বলতে থাকে –
“বউরানী চেয়ারম্যান সাহেব আপনার আর ছোট নবাবরে এখনি নিচে যাইতে কইলো। আরাধ্য গেঞ্জি টানতে উঠে এস দাঁড়ায় দরজার কাছে ঘুম ঘুম রেশে হাই তুলছে। ইফরাহ একবার সেদিকে তাকিয়ে আবারো তাকায় রেণুর মার মুখের দিকে। আরাধ্য হাই তুলা হতেই ভার কন্ঠে বলে –
“কি হয়েছে চাচি ?
বাড়িত কি ডাকাত পড়ছে নাকি ?
রেণুর মা মা নিচু করে উত্তর করে- ” আপনেরে চেয়ারম্যান সাহেব ডাকছে ছোট নবাব”।
আরাধ্য চমকায় না। ঘাড় ঘুরিয়ে একটু তাকায় ইফরাহর দিকে। তারপর বলে –
– চলুন আপনার চেয়ারম্যান সাহেবে সাথে দেখা করে আসি!
আরাধ্য রেণুর মা কে পাশ কাটিয়ে চলে যায় । এইদিকে রেণুরমা উল্টো ঘুরে যাবে, ঠিক এমন সময় আবারো তাকায় ইফরাহর দিকে। মাথা নিচু করে বলে –
-গিন্নি মা আপনারেও যাইতে কইছে বউরানী!
ইফরাহ অবাক চোখে কিছুসময় তাকিয়ে থাকে রেণুর মার যাওয়ার দিকে।
”
বিকাল সাড়ে পাঁচটায় । দেয়ালের ঝুলতে থাকা বড় ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে জানান দিচ্ছে সময়ের উপস্থিতি।
আরাধ্য ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেশ ভাব নিয়ে এসে দাঁড়ায় বসার ঘরে। চেয়ারম্যান সাদা লুঙ্গি আর এক সেন্ডোগেঞ্জি পড়ে সোফায় গা হেলিয়ে বসা।
– আব্বাজান ডেকেছেন ?
চেয়ারম্যান শ্বাস নিলো ,ঠোঁট কামড়ে তাকলো আরাধ্যের দিকে।ঘুম হতে উঠে এসেছে তা যেন মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চোখের কোণা লাল হয়ে আছে। কপালের এক কোণে কাঁটার দাগ। হাতের কোনুইয়ে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত।
চেয়ারম্যান কিছু সময় খুতিয়ে খুতিয়ে দেখলেন আরাধ্যের ঢং চং। মুখের দাড়ি ঘন হয়েছে চুলগুলো এলোমেলো চোখে এসে পড়েছে। সব যেনো রাগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয় তার –
-এ তোমার কেমন সাজ , দিন দিন একটা বন মানুষ হয়ে উঠছো খেয়াল আছে ?
আরাধ্য জিহ্বা দিয়ে মারি ঠেলে বলে -” পকেট আপতত গোড়ের মাঠ। চুল দাড়ি কাটার পয়সা নেই ,যদি একটু টাকা পয়সা দিতেন তবে নাহয়, শ্যামল নাপিতকে দিয়ে কাটিয়ে নিতাম।”
চেয়ারম্যান রাগি চোখে তাকায় আরাধ্যের দিকে আরাধ্য থুরি পাত্তা দেয় ওইসব। রেণুর সিঁড়ি দিয়ে নিচে আসতেই চেঁচিয়ে ওঠে আরাধ্য –
– চাচি চিনি ছাড়া এক কাপ চা জলদি দিয়ে যান !
অরুনিমা দুই বাপ ছেলের কথা আগা মাথা বুঝতে চাইছে , তবে না পেরে চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্যে বলে ,
– কিসের বিচার বসিয়েছেন তাই বলুন, ফারহান কি করেছে?
চেয়ারম্যান একবার অরুনিমা দিকে তাকিয়ে কিছুসময় পর তার থেকে কিছু হাত দূরে দাঁড়ানো আরাধ্যের দিকে তাকায় –
– আজ বিচারে গিয়েছিলে ?
– হ্যাঁ
আরাধ্যের সরল স্বীকারোক্তিতে রাগের তেজ আরো খানিকটা বেড়ে যায় চেয়ারম্যানের। দাঁতে দাঁত খিচে বলেন-
– খন্দকারের দলের ছেলেদের পিটিয়ে এসেছে ?
উফফ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। আরাধ্য ডানে – বামে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘাড় ফুটিয়ে নিয়ে গিয়ে বসে চেয়ারম্যানের পাশের সোফায়।
– আরাধ্য আমি কিছু বলছি তোমাকে?
সোফায় হেলান দিয়ে এক পায়ের উপর ওপর পা রাখে আরাধ্য, আয়েশি ভঙ্গিতে বসেছে। এবার তার উত্তর করার পালা , দু হাতে লম্বা চুলগুলো বেক ব্রাশ করে বলে –
“খবর কানে গিয়েছে বলেই না বিচারে বসিয়েছেন। ওসব কথা নাহয় বাদ দিলাম , আমি মেরেছি তার প্রমাণ কিহ ?
চেয়ারম্যান অস্পষ্ট দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন , এই ছেলের সাথে তর্ক করা মানে অনেক ধৈর্য্যের পরীক্ষা। চোখ বুঝে নিজেকে কন্ট্রোলে এনে আবারো বলেন ,
-কি চাইছো তুমি আরাধ্য ! রাজনীতির মাঠে আমাকে হেনস্তা করতে ? নাকী প্রতিপক্ষের সামনে মাথা নত করতে।
আরাধ্য একদম শান্ত , কোনো প্রকার রাগের আভাস নেই। বৃষ্টি আসার আগ মূহুর্ত যেমন শান্ত থাকে প্রকৃতি, এইসময় টাও ঠিক সেইরকম। ইফরাহ সিঁড়ির এক কোণায় দাঁড়িয়ে সব শুনছে। ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান আরাধ্য সব কথাই সে শুনেছে আরাধ্য আগের মতো থেকেই বলে ,
– আমি চাই এই বংশে ধ্বংস তা যখন হচ্ছে না ,আপতত নিশ্চিন্তে থাকুন এবারো চেয়ারম্যান আপনি হবেন।
বাপ ছেলের কথার মাঝেই সাদা ক্রিম কালারের এক ফতুয়া আর সাদাতে দাগ টানা এক লুঙ্গি পড়ে অন্দরমহলে দরজা দিয়ে প্রবেশ করে মাতব্বর সাহেব। লোকটার চেহারায় এক বিষন্নতা কাজ করছে।
চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। রেণুর মা এক কাপ চা এনে দেয় আরাধ্যের হাতে। আরাধ্য চায়ে কাপ হাতে নিয়ে এক নজর মাতব্বরের দিকে দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে।
মাতব্বর সাহেব আসতেই চেয়ারম্যান শান্ত গলায় বলে
-আরে শরীফ আইছো যে কি খবর তা কও তো শুনি ?
মাতব্বরের গলা ধরা , চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। সব কিছুই কেমন অস্বাভাবিক। চেয়ারম্যান সামনে আসতেই হুহু করে কেঁদে ওঠে লোকটা।
ভরকে যায় উপস্থিত সকলে , আরাধ্য শুনছে কি শুনছে না কে জানে? মনের সুখ সুখের চা পান করছে সে। ইফরাহর কপালে গাঢ় ভাজের দেখা মিলছে – মাতব্বর কে চিনে না এমন কেউ নেই। তবে মানুষ টা কাঁদছেন কেনো ভীষণ চিন্তার বিষয়!
চেয়ারম্যান আড়চোখে একবার আরাধ্য কে দেখে মাতব্বর কে প্রশ্ন করে
– কি হয়েছে শরীফ ,কানবার লাগছো কেন ?
ডানহাতে চোখ কচলে চোখের পানি মুছে মাতব্বর , রেণুর মা এক গ্লাস পানি এনে দেয় তার হাতে। ঠান্ডা পানি ঢকঢক করে পান করে ধরা গলায় মাতব্বর বলে ,
– আমার বাজান , আমার চয়ন রে খুইজা পাইনা চেয়ারম্যান সাহেব। পোলারে রানীশংকৈল পাঠাই ছিলাম , আমার ছোট শালিকা বাড়ি। কিন্তু পোলা আমার ওইহানে যায় নাই ! আইচ ৩দিন হইলো আমার পোলার খোঁজ নাই।
চায়ে কাপে শেষ চুমুক দিয়েই বেশ বড় এক ঢেকুর তুলে আরাধ্য। ইফরাহর কেমন খটকা লাগে, চিনি ছাড়া তেতো চা একটা মানুষ এতো তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারে। এ কি আদতেও সম্ভব?
চেয়ারম্যান মাতব্বরের কথা শুনে সন্দিহান চোখে আরাধ্যের দিকে তাকতেই বেক্কলের মতো এক দাঁত কেলানি হাসি দেয় আরাধ্য।
মাতব্বর আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ে , গলা জড়িয়ে আসছে তার। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় আবারো বলে –
– আমার পোলাডারে খুঁইজা দেন চেয়ারম্যান সাহেব। আমি সারা জীবনের গোলামি খাটমু। দোয়া করেন চেয়ারম্যান সাহেব !
-” তোমার কি কাউরে সন্দেহ হয় শরীফ। মানে তোমাগো কি কোনো শত্রু আছে?
মাতব্বর স্থির হয়ে কিছু সময় ভেবে বলে ” আমি তো আপনার লগে কাজ করি। আমার আবার শত্রু কই ? আর পোলাডা তো ছোট নবাবের কামের লোক। ছোট নবাব বলতে পোলা আমার অজ্ঞান। আমাগো কোনো শত্রু নাই চেয়ারম্যান সাহেব।
– শান্ত হও শরীফ , সামনে নির্বাচন। গ্রামের পরিস্থিতি ভালো না ! তুমি ফিরা যাও আমি খবর লাগামু দেহি পোলা কই তোমার। মালিক রে স্বরণ করো।
আরাধ্যে এইসব ন্যাকামি বিরক্ত লাগছে। মাতব্বর আর চেয়ারম্যানের কথার মাঝেই উঠা দাড়ায় সে ,
“ আমি তবে উঠি আব্বাজান, আপনি বরং মাতব্বর চাঁচার সমস্যা সমাধান করুন?
কারো উত্তরের আশা না করেই সিঁড়ি দিকে পা বাড়ায় আরাধ্য। তার ছোট মোটো কচি বউটারে দেখেই খিটখিটে মেজাজ টা খুশি হয়ে গেলো তার। ইফরাহ একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। হালকা কিছুটা ঝুঁকে যেতেই ইফরাহ্ সরিয়ে নেয় নিজের মুখ। আরাধ্য হালকা কিছুটা হাসে তবে ঠোট গলিয়ে বাহিরে বেড়োয় না সেই হাসি!
আরো কিছুটা ঝুঁকে একদম ইফরাহর কানের কাছে এসে বলে –
“ ঝামেলাতে যত মাথা না ঘামিয়ে থাকবে, তত শান্তি। কেনো এই ছোট মাথায় এতো পেরেশানি নিচ্ছো বউ। ছোট মানুষ, ছোট মাথা – দেখো এই টুকু মাথা সাথে ঘন চুলের বাহার। এতো অল্প বয়সে টাকলা হতে চাইছো ?
ইফরাহ এতো হেলালি ভালো লাগেনা না। সে একবার আরাধ্যের লাল চোখের দিকে তাকিয়ে , দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।
-ঘরে এসো !
সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে যায় আরাধ্য। ইফরাহ দাড়ায় না দু হাতে শাড়ি কিছুটা উপরে তুলে। দ্রুত আরাধ্য পিছু নেয়।
“
ঘরে এসেই গোসলখানার ঢুকে গিয়েছে আরাধ্য। ইফরাহ এসে বিছানা গুছিয়ে তুলে দিয়েছে। আলমারি থেকে আরাধ্যের জন্য কাচা একটা শার্ট সাথে জিন্সের বের করে বিছানা উপর সাজিয়ে রেখেছে।
মিনিট দশেক পর সাদা রঙের এক তোলায়ে প্যাঁচিয়ে গোসলখানা হতে বেড়িয়ে আসে আরাধ্য। ইফরাহ বেলকোনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
“সন্ধ্যার আগ মূহুর্তের সময় টা তার বরাবই প্রিয় তার কাছে। নীল স্বচ্ছ আকাশে সূর্যের লাল আভা কেমন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই সুন্দর উপভোগ করতে বেশ লাগে তার। সূর্য নিবে মানেই পরবর্তী এক দিনের সুচনা।
গাছের দুই একটা পাতা নড়ছে। পাখিরা মুক্ত আকাশে এদিকি ওদিক ছুটে চলেছে। কি সুন্দর না –
গায়ে পোশাক জড়িয়ে ভেজা চুলে তোয়ালে বুলাতে বুলাতে বেলকনিতে এসে দাড়ায় আরধ্য।সূর্য মুখ লুকাতে চলেছে, গাছের ফাঁক ফোকড়ে তার একটু আবাস মিলছে এই আর কি ?
-আমার কথা ভাবছো বুঝি ?
ইফরাহ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আরাধ্যের দিকে। আসছে থেকে লোকটাকে কালো শার্টেই বেশি দেখে এসেছে, বরাবরই মতো বেশ সুদর্শন লাগে। তবে আজ ইফরাহ ইচ্ছা করেই এস কালারে এক শার্ট বের করেছে। পুরো আলমারিতে ভিন্ন রকমের তিনটে শার্ট। বাকি তো সব কালো –
আরাধ্য ভেজা তোয়ালে ইফরাহর মুখে ছুড়ে দিতেই ধ্যান কাটে তার। একে ভেজা তোয়ালে, তার মাঝে এক বিশ্রী গন্ধ, গা গুলিয়ে আছে।
-সারাদিন কি এতো ভাবো বলো তো মেয়ে ? আমায় নিয়ে তো ভাবছো না, তবে ভাবছো টা ? বিয়ের আগে কোনো নাগর জুটিয়েছিলে নাকি। তার কথাই ভাবছো নিশ্চয়ই , ভাবো- ভাবো,কি আর করার তোমার কপাল খারাপ !
-“ আপনার কেন মনে হলো আমি নাগরের কথা ভাবছি?
বেশ খুশি হলো আরাধ্য , কিছুটা ঝুঁকে এসে উৎসাহিত কন্ঠে বলে “ তবে কি আমার কথা ভাবছিলে?
-“ নিজেকে বুঝি এতো ভাগ্যবান মনে হয় আপনার?
-কানের নিচে ঠাটিয়ে একটা দেই , দিবো? এতো ত্যাড়ামি মাড়াবে না আমার সাথে বুঝলে !
ইফরাহ চোখ বুজে নিজেকে শান্ত রাখে , লোকটা তার স্বামী
এই কথা মাথায় রেখেই বলে “ আপনি বেড়োবেন বলছিলেন। কোথায় যাবেন জানতে পারি ?
রেলিংয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঘড়ি ঠিকি করছিলো আরাধ্য। সেদিকেই মনোযোগ রেখে উত্তর করে ইফরাহ প্রশ্নের –
-কাজ আছে ?
-“ইফরাহ দ্রুত প্রশ্ন করে বসে “ কি কাজ”?
আরাধ্য মুখ উঠালো ইফরাহর কৌতুহলী মুখের দিকে তাকিয়ে বলে— “রয়ে সয়ে খাও ডার্লিং ! বেশি খেলে তো এবার ডায়বিয়া হয়ে যাবে ।
ইফরাহ কাচুমাচু মুখ করে উল্টো ঘুরে যায় “ দিনের আলো মূর্ছা গেছে। আজান পড়েছে চারপাশে ,
আরাধ্য ঘাড় কাত করে অভিমানি মেয়ের মুখের দিকে তাকালো ,
ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৪
-“ ভাব ধরছো ? ও তোমরা মেয়েরা একটু ধরবেই তাতে আবার আমি জেলাসি হবো না।
-কথা শেষ হয়েছে আপনার ?
আরাধ্য চমৎকার করে হাসলো , ছেলেটা আসলে গালে টোল পড়ে ,আজো তাই হয়েছে। এই হাসি দেখলে নিশ্চয়ই ইফরাহর বুকে এক কালবৈশাখী ঝড় উঠতো। পুরুষের হাসি বরাবরই ভীষণ সুন্দর। ঘড়ির কাটা সাতটা ছুঁই ছুঁই বেড়িয়ে যেতে হবে তাকে।
আরাধ্য আর কথা বাড়ালো না। অভিমানি মেয়েটার অভিমান ভাঙাতেও এক চুল চেষ্টা না করেই বেড়িয়ে গেলো সে।
