ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৭

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৭
জান্নাত চৌধুরী

বেলা 11 টা। চেয়ারম্যান সাহেব সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে বাড়ির দক্ষিণা ফোনে ছোট বাগানখানায় সযত্নে চারা গাছ গুলোতে পানি ঢালছে ।বাগান বিলাস চেয়ারম্যানের বরাবরই ভীষণ প্রিয়। তবে এতো এতো ফুলের মাঝে ওই লাল টুকটুকে রানী গোলাপ খানাই তাকে ভীষণ টানে। চেয়ারম্যান বারবারই মুগ্ধ হয় তার রূপে।
আজও বাগানে দুটো গাছে বেশ বড় বড় চারটে গোলাপ ফুটেছে। চেয়ারম্যান হাতের পানি পাইপ সবুজ ঘাসের উপর ফেলে, হাত বাড়িয়ে ছিরে নেয় সবচেয়ে বড় গোলাপটা।
বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চোখ বুঝে কারো এক নিঃশ্বাসে শুকে নেয় গোলাপের ঘ্রাণ টুকু। অতিক্রম হয় কয়েক সেকেন্ড, হঠাৎ

-চেয়ারম্যান সাহেব আসবো?
হঠাৎ ভাঙ্গা এক রুক্ষ কন্ঠে চোখ খুলেন চেয়ারম্যান। আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চোখ পড়ে আসলাম মোল্লার উপর।
চেয়ারম্যান হাতের ফুলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলেন-
-কি গো অফিসার খবর ভালো তো ?
আসলাম মোল্লা এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন চেয়ারম্যানের সামনে মুখটা শুকনো লাগছে চোখ জোড়ায় কেমন দুশ্চিন্তা। চেয়ারম্যান সেদিকে একনজর দেখে ফুলের গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন-
-কি সমস্যা রাতে কি ঘুমাও না?
আসলাম মোল্লা শুষ্ক এক ঢোক দিলে বলে-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“থানায় নতুন অফিসার আইছে চেয়ারম্যান সাহেব, কেস কিন্তু জন্ডিস। উপরমহল থেকে নতুন তদন্ত কমিটি নামাইছে।
চেয়ারম্যান হাতের উপর থেকে নজর সরায়। এবার পুরোপুরি ভাবেই শান্ত দৃষ্টিতে আসলাম মোল্লার দিকে তাকাতেই পর পর কয়েকবার শুষ্ক ঢোক গিলে আসলাম। চেয়ারম্যান হঠাৎ ফিক করে হেসে বলে-
-আরে অফিসার ভয় পাও কে রে? আইন কর্তা রয়েছে একজন যাইবো আরেকজন আইবো এই তো নিয়ম। চিন্তা কইরো না তুমি।
আসলাম মোল্লা অবাক কন্ঠে কিছু বলবে তার আগেই চেয়ারম্যান বলে-
-রক্ষক যখন ভক্ষক হয় নীতি কথা তখন গোবরে ফোঁটা পদ্ম ফুলের মত হইয়া যায়।
আসলাম জিব্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে-
ছোট নবাবরে একটু সামলে….

বাকি কথা বলার আগেই থামিয়ে দেয় চেয়ারম্যান সাহেব। গোলাপের গায়ে একবার ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলে-
পোলা আমার নিজের ভালো নিজে বুঝে অফিসার। হ্যায় হইছে জিওল মাছ বুঝলা, ধরবার গেলেই পিছলা যাইবো!
ফাকফোকর দিয়া ঠিক বারাইয়া যাইবো। তুমি এত চিন্তা কইরো না।
-কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব
“নতুন অফিসার কই থেকে আইছে?”
-ঢাকা থেকে আইছে চেয়ারম্যান সাহেব!
আসলামের কথায় চেয়ারম্যান কিছুটা হেসে বলে –
বেশ বেশ যা হইবো পরে দেখা যাইবো এখন তুমি আসো দেখি!
আসলাম কথা না বাড়িয়ে চলে যায়, চেয়ারম্যান ফুলের দিকে তাকিয়ে আবারো বাঁকা হেসে –
-নেশাখোর যেমন নেশা না করলে ঠিক থাকে না ! তেমনি রক্ত পিশাচু রক্ত না খাইলে বাঁচে না। নেশা নেশা রক্তের নেশা , লাল রক্তের নেশা । লাল রঙের নেশা …
কথাগুলো বলে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করেন চেয়ারম্যান। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রায় বদ্ধ উন্মাদ নয়তো, গারোদের কোন পাগল ছাড়া পেয়েছে। তার চোখে মুখে এক পৈশাচিক সত্বা।

দুপুরের করার রোদ সাথে অসহ্যকর এক গরম। ধরণীতে যেন আজ তাপমাত্রা দ্বিগুণ বেড়েছে। একটুস খানি ছায়া পেতেই পুরনো আম গাছে তলায় বসে পাথর খেলছে রাইসা আর নীলা।
দুজনের মাঝেই খেলার ফাঁকে বেশ কয়েকবার তর্ক বেধেছে
পরক্ষণেই সব মিটিয়ে আবারো খেলায় মনোযোগ তারা। হঠাৎ খেলার মাঝেই রাইসার চোখ চলে যায় ধান খেতের আইল বরাবর, হালকা ধূসর গেঞ্জির সাথে কালো রঙের লুঙ্গি পরিহিত এক যুবকের দিকে।
কানে ফোন আর এক হাতে লুঙ্গি উঁচু করে বকবক করতে করতে আইল দিয়ে আসছে সে।
রাইসা হাতের পাথর মাটিতে রেখে চোখ ছোট ছোট করে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে যুবকটি। আরো কিছুটা কাছে আসতেই ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবার চেষ্টা করে রাইসা।
হঠাৎ করেই তার ঠোঁটে ফোটে ওঠে কুটিল হাসি। মনে পড়ে যায় সেদিনের বাগানের সব কথা , রেজার বলা প্রতিটা কথা।
একদেনে ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে রেজা রাইসা দ্রুত হাতে মাটিতে থাকা পাথরগুলো ওড়নায় বেঁধে নেই। এতে বেশ অবাক হয়ে নীলা ব্যস্ত সুরে বলে

-এই রাইসা খেলবি না পাথর বাঁধছিস কেন?
রাইসা দ্রুত বসা থেকে উঠে বলে-
আজ আর খেলব না রে নীলু, তুই বাড়ি যা।
নীলা হাতের মাটি জামাতে মুছে দাড়িয়ে রাইসার দিকে তাকাতেই , হি হি করে দাঁত কপাটি বের করে হাসে রাইসা।
নীলা কিছু না বলেই চলে যায় সেখান থেকে, রেজা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে রাইসা গলায় ঝুলানো ওড়না কোমরে প্যাচ কাটিয়ে দ্রুত গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করে।
ক্ষেতের একদম শেষ সীমানায় এসে ফোন কাটে রেজা। লুঙ্গি এক হাতে আর এক হাতে ফোন ধরে আম গাছের কাছে আসতেই হঠাৎ মাথার ওপর পাথর জাতীয় কিছু পড়তেই ব্যথায় চোখ মুখ খিচে নেয় সে। তবে একসাথে পরপর ৩ টা পাথর পড়তেই মাথার বেহাল দশায় দুহাতে মাথা চেপে মাটিতে বসে পড়ে বেচারা। অতিক্রম হয় কিছু সময়
ঝকড়া গাছের পাতার আড়ালে নিজেকে লুকালেন কাক পক্ষির ও খুঁজে পাবে না। রেজা গাছের দিকে তাকাতেই পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নেয় রাইসা ,তবে লাভ হয় না তার আগে ওড়নার কিছু অংশ চোখে পড়ে যায় তার। মাথা থেকে হাত নামিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে।
গাছের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে-

-এই ভর দুপুরে লাল কাপড়ে কোন বাড়ির পেত্নী গাছে চড়ে বসেছে ,দেখি তার চাঁদ মুখখানা খানিকটা দেখি।
রাইসা খানিকটা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাতেই দেখে তার দিকে টকটক করে তাকিয়ে রয়েছে রেজা। দাঁত দিয়ে জিভে কামড় কেটে চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে বলে-
-এই যা ধরা খেয়ে গেলাম এবার নিশ্চয়ই এই বেটা আমারে আজ তো চিবিয়ে খাবে।
রেজা রাগে দাঁত কটমট করে চিবিয়ে বলে –
“এই অসভ্য মেয়ে তুমি নিচে নামবে নাকি আমি উঠবো গাছের উপরে?”
রাইসার মুখটা ভেজে বিড়ালের মত করে গাছের গুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে-
-আপনি খানিকটা সরে দাঁড়ান আমি নামছি, আপনাকে আর কষ্ট করে গাছের উপরে উঠতে হবে না। পড়েছেন তো লুঙ্গি কখন জানি খুলে আবার বাতাসে উড়ে গিয়ে টিনের চালে পড়ে। তাই আমি নামছি দূরে সরে দাঁড়ান বলছি।
রেজা ভ্রু কুচকে মাথা নিচু করে নিজের লুঙ্গির দিকে তাকিয়ে আবারো রাগি চোখে তাকায় রাইসার দিকে
-কি অসভ্য মেয়ে রে বাবা, সামান্যতম লজ্জাবোধ নেই।

মনে মনে কথাগুলো বলেই রাগি চোখে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
রাইসা গাছের ডাল ধরে খানিকটা ঝুলে যায় ,তারপর ধীরে ধীরে গাছ বেয়ে নিচে নামতেই খপ করে তার হাত ধরে ফেলে রেজা। পালাবার উপায়ান্তর নেই, মাটিতে নেমেই চোখ মুখ বন্ধ করে ভৌ এক দৌড় দেবে বলেই গাছের ওপর এত সময় বসে বুদ্ধি এটেছিলো সে। তবে রেজা যেন তার বাঁড়া ভাতে মুঠো পুরে ছাই ঢেলে দিয়েছে।
বেশ ভরকে যায় রাইসা, শুষ্ক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে –
-এ এ কি আপনি হাত ধরছেন কেন ছাড়ুন? বলছি দিন দুপুরে মেয়েদের হাত ধরছেন লজ্জা করে না।
রেজা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে –
“কেন লজ্জা করবে শুনি? আমি কি কাপড় খুলে রাস্তায় ড্যান্স করছি যে আমার লজ্জা করবে!
-যাহ বাবা কাপড় খুলে নাচার কথা কখন বললাম?আমি তো বলেছি রাস্তাঘাটে মেয়েদের হাত ধরেছেন আপনার লজ্জা করছে না।

“দিন দুপুরে গাছে চড়ে বেড়াতে তোমার লজ্জা করে না? গেছো মেয়ে একটা!
রাইসা বেশ কিছুক্ষন হাত মোচড়া মোচড়ি করে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে‌। তবে কোন দিকে কোন উপায় হচ্ছে না তার, তবুও চেষ্টার কোনো কমতি নেই।শেষবারের মতো আরো দুটো মোচড় দিয়ে বলে –
-গাছে ‌ চড়তে লজ্জার প্রয়োজন নাই শিখনের দরকার আছে. যাই হোক আপনি আমার হাত ছাড়ুন নয়তো আমি এখন চেঁচিয়ে পুরো গ্রাম জড়ো করব।
রাইসার কথায় রেজা কিছুটা অবাক হওয়ার মতো করে বলে-
-ও আল্লাহ তাই তুমি বুঝি ?লোক জড়ো করবে, তা বদনামটা কার হবে শুনি, আমার না তোমার? লোকে বলবে ইসমাইল শেখের মেয়ে দিন দুপুরে পর পুরুষের লগে ঢলাঢলি করছে
রাইসা কপাল কুঁচকে বলে- ‌ অসভ্য লোক কি বলছেন টা কি? আমি কখন আপনার লগে ডলাডলি করলাম। আপনি তো আমার হাত ধরেছেন!
“ছেড়ে দেব আগে বল পাথর মেরেছ কেন?”

-আমি মারিনি গাছে চড়ে ছিলাম আম পারতে, তবে পাথর কোথা থেকে পড়েছে আমি কিভাবে বলবো!
রেজা হাতের বাঁধন আরো কিছুটা শক্ত করে বলে- ‌ তুমি তো দেখছি অভদ্রের সাথে মিথ্যাবাদী ।
-মুখ সামলে কথা বলুন ,ভুলে যাবেন না আমি কিন্তু ছোট নবাবের শালী! আর শালী মানে কিন্তু আধি ঘর‌ওয়ালি। আপনি ছোট নবাবের অর্ধেক ব‌উয়ের সাথে এভাবে কথা বলছেন, ছোট নবাব জানলে নিশ্চয়ই আপনাকে পুরস্কৃত করবে না তাই ভদ্রভাবে কথা বলুন আর আমার হাত ছাড়ুন!
রেজা তোর হাতের দিকে একবার তাকিয়ে পরক্ষণে তাকায় রাইসার।মেয়েটা বয়সে তুলনায় বেশি পাকনা, কথাও বলতে পারে দারুন। সে কিছু সময় মায়া ভর্তি কাজল টানা চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে-
-ভালো হয়ে যাও মেয়ে, ভালো হতে পয়সা লাগে না!

কথা শেষ করে রেজা রাইসার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। টানা টানা চোখ দুটো যেন বেশ সুন্দর। মায়াবী চোখ জুড়ায় যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে রেজার, হঠাৎ হাতে ব্যথা অনুভব করতেই নজর সরে যায় তার। হাতের দিকে তাকাতে খেয়াল হয় রাইসা কামড়ে দিয়েছে হাতে।
দ্রুত রাইসার হাত ছেড়ে নিজের হাত ঝাড়তে শুরু করে সে। কামড়ের দাগ বসে লাল হয়ে গিয়েছে রেজার। নিজের হাত বেশ কয়েকবার ঝেড়ে আবারো বলে ওঠে –
-এই মেয়ে মাংস খাস না কত বছর হলো! যে আমার হাতের মাংসের স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তোর।
রাইসা জিভ দিয়ে ভেংচি কেটে বলে- “ ‌ গরিবের ঘরে আবার মাংস, দু’বেলা ডাল ভাত পায় এই বেশি। তবে, মাংসের স্বাদ এত নোনতা কেন জনাব !
রেজা হাতে ফু দিতে দিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে-

-ইয়া মালিক এই অসভ্য মেয়ে রে একটু সভ্যতা ‌ শেখার তৌফিক দান করুন!
রেজার ব্যথাতুর মুখটা দেখে মুচকি মুচকি হাসে রাইসা। আঙুল দিয়ে ‌চুলের ঝুটিতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে-
-শুনুন জনাব শকুনের দোয়ায় যেমন গরু মরে না। তেমনি আপনার দোয়াতেও আমি কখনোই ভালো হবো না।
কথাটা শেষ করেই নাকের উপর আঙ্গুল রেখে ভেঙ্গচি ‌ কাটে রাইসা। রেজা রাগ যেন আরো দুই গুণ বেড়ে যায় , রাইসার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে বলে
‌ -আরে বান্দরনি চিংড়ি, তোর উপরে ঠাডা পড়ুক। পিটিয়ে তোর ছাল বাল সব তুলে দিলে একাই ভালো হবি! বেয়াদব মেয়ে।
রেজার কথায় পাত্তা না দি‌য়েই ‌তাকে ফেলেই বাড়ির দিকে পা বাড়ায় রাইসা। তবে তার যাওয়া আর হয়ে ওঠে না পেছনে রেজার ডাকে আবারো থমকে যায় সে-

-ব‌উরানীর বইগুলো নিয়ে এসো ,ছোট নবাবের হুকুম রয়েছে বউরানির সকল বইগুলো নিয়ে যেতে হবে! এবার অন্তত কোন ফাজলামি করো না!
ঠিক যেভাবে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে ছিল রাইসা, রেজার কথায় দ্রুত খুশি হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে –

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৬

-আপাই স্কুলে যাইবো, ছোট নবাব লেখাপড়া করাইবো আপারে। আপনি আপার বই নিতে আইসেন?
রাইসার খুশি খুশি মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের ব্যথা ভুলতে বসেছে রেজা। তার করা এতগুলো প্রশ্নে শুধু একবার ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাই সে।তাতেই খুশিতে গদগদ রাইসা দ্রুত ছুটে যায় বাড়ির দিকে , সাথে বলে যায়-
-আপনি এখানে দাঁড়ান আমি এক্ষুনি আপার ব‌ই নিয়া আইতাছি।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here