ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৯

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৯
জান্নাত চৌধুরী

রাতের শেষ প্রহর বাহিরে হালকা হিমেল হওয়া। কালো রঙের এক ‌বাইকে চড়ে ছুটে চলেছে দুজন যুবক। পরনে বেশ ধারী কালো পোশাক।
কিছুদূর গিয়ে বর্ডার এরিয়া ঠিক কিছুটা ‌ দূরে থেমে যায় বাইকটা। এক এক করে নেমে দাঁড়ায় যুবক দুটি, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারেই কাঙ্ক্ষিত জিনিস তাদের অপেক্ষায়।
আশেপাশে চারদিকে খেয়াল করে এগিয়ে যায় তারকাটারি জঙ্গলের কাছে। অপর প্রান্ত হতে বেশ সাবধানে তারকাটার পেরিয়ে আসে নিলয়। হাতে বেশ ‌ বড় এক বাক্স।

যুবক দুটো এগিয়ে যায় নিলয়ের কাছে , বক্সের ওজন বেশ ভারী। নিলয় টেনেটুনে এনে মাটিতে রেখে ,চাকু জাতীয় কিছু দিয়ে প্যাঁচানো প্যাকিং কেটে দেয়। যুবক দুটি খুব তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় বাক্সের মাঝে কাঙ্খিত জিনিস দেখে ঠোঁটে ফুটে উঠে এক দুষ্কর হাসি।
হঠাৎ দূর হতে চোখে পড়া টর্চের আলোতে ভরকে যায় তারা। দ্রুত বাক্সের মুখ বন্ধ করে শুষ্ক ঢোক গিলে নিলয়। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সাদা আলো
কালো পোশাক ধারী যুবক দুটি দ্রুত বাক্স তুলে হাতে নিতেই এক ছুটে স্থান ত্যাগ করে নিলয়। আরো কাছে চলে আসছে আলো , ‌ সাথে ভারী বুটের শব্দ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ক্যাম্পিং এ থাকা বর্ডার গার্ড হয়তো সাড়া পেয়েছে। কানে আসছে পরপর কয়েকটি পায়ের শব্দ অন্ধকার হতে ছুটতে শুরু করে যুবক দুটি। তাদের থেকেই কিছু দূরে এগিয়ে আসছে বিজিবির সশস্ত্র টহল বাহিনী।
যুবক দুটি বাইকের কাছে এসেই চরে বসে তাতে। দ্রুত গিয়ার ফেলে স্টার্ট দেয় বাইকটি। তবে বেরিয়ে যেতে নেবে ঠিক এমন সময় বিকট গুলির শব্দে থেমে যায় প্রকৃতি। ব্রেক চেপে ধরে চালক।
পিছনে বসা যুবকের গুলি লেগেছে তবে সেদিকে সে পাত্তা না দিয়ে চেঁচিয়ে বলে-
মরবি নাকি বে ! দ্রুত স্টার্ট ঠুক বেটা ..!!
চালক শুষ্ক ঢোক গিলে আবারও স্টার্ট দিতেই, ঝড়ের ব্যাগে চলতে শুরু করে বাইক টি !
খানিক বাদে সীমান্ত এলাকা পেরিয়ে জনবহুল এলাকায় ‌ ঢুকে যায় তারা। আঘাতপ্রাপ্ত যুবকের রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এক হাতে বাক্স চেপে অপর হাত ঝুলিয়ে রেখেছে সে ।

রাতে কালো আঁধারী ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। অন্ধকারের ভারী আবরণ যেন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব ‌ দিগন্তে হালকা আভা ফুটে উঠেছে।
মসজিদের নামাজ শেষে তাসবিহ পড়তে পড়তে নদীর পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল ‘‌ খাঁ’ পারার ইমাম ‌ নাঈমুল ইসলাম।
“লা ইলাহা” পড়তে পড়তে হঠাৎ চোখ আটকে যায় সাদা কাপড়ে প্যাঁচানো এক বস্তুর ওপর। ইমাম সাহেব দূর হতে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে হাতের তাজবীহ গোনা বন্ধ করে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে ‌ চমকে ওঠেন তিনি প্যাঁচানো কাপড়ে রক্তের ছাপ।

ইমাম সাহেব হাতের তাজবিহ জুব্বার পকেটে রেখে দ্রুত এগিয়ে সাদা কাপড় সরাতে পিলে চমকে ওঠেন। বাকরুদ্ধ হয়ে যান, গলা কাঁপতে থাকে তার। শুষ্ক ঢক গিলে আশেপাশে তাকিয়ে লোকজনের অস্তিত্ব দেখেন।
ইমাম ভয়ে ভয়ে চোখে তাকিয়ে থাকেন লাশের পানে। চোখ উপরে নেওয়া হয়েছে , চেহারা দেখে বুঝবার উপায় নেই মানুষটা কে! গলায় ছুরির দাগ , গালের মাংস জলে তেলতেলে হয়ে আছে। ওপরে নেওয়া চোখের মনি কোঠা হা হয়ে আছে , রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তা থেকে।
না এসব যেন আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। ইমাম দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে-
-ইয়া রব এত ভয়ঙ্কর মৃত্যু যেন কোন শত্রুরও না হয় মালিক!
কথা শেষ করে নদীর দিকে তাকাতে দেখে মাঝে ঘাটে ফিরে এসে তরী বাধছে। ইমাম নজর সেদিকে যেতে ডেকে ওঠেন তিনি।

-এই আকরাম ভাই -আকরাম ভাই, এদিকে আসো ।
মাঝি নৌকা পারে রেখে ইমামে ডাকে এগিয়ে আসতেই ‌ ভয়ে শিটিয়ে যায় সে
-এইডা কার লাশ ইমাম সাহেব ?
মাঝির প্রশ্নে ইমাম লাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলেন-
-চিনবার উপায় খান তো নাই! মুখ ঠিক থাকলেও না হয় খবর পাওয়া যাইত।
মাঝি ইমামের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁপা কাঁপাগলায় বলে-
-এইতো ‌ পুলিশ কেস ইমাম সাহেব চলেন পালাই।
বেশ আবাঅ হয় ইমাম লাশের থেকে বৃষ্টিসরে আকরামের দিকে তাকিয়ে বলে-
-এসব কি কও আকরাম? পুলিশের ভয় কি এখন লাশ থুইয়া পালানো লাগবে? পদাফনের কাজ আছে!
মাঝি গলার গামছা খান দুই হাতে টেনে ধরে বলে-

-আমরা চাইলেও এই লাশ আফন করতে পারমু না ইমাম সাহেব। পুলিশ আইলে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ হইয়া যাইবো মালিক না করে আমরা যদি ফাইসা যাই।
ধমকে ওঠেন ইমাম- “ ‌ বেক্কলের মত কথা কবার লাগছো কেন মাঝি ? আমাগো ধরবো কেন পুলিশ, এলাকার লোকজনরে খবর দাও , না জানি কোন মায়ের বুক খালি করছে কোন হারামজাদায় ‌। আল্লাহ যেন তাকে জাহান্নামে ও ঠাঁই না দেয়!

-আপনি আমার অহংকার হবেন ছোট নবাব?
কিছুটা অহংকারী হতে চাই।
ইফরাহর কথায় তার গালে হাত রাখে আরাধ্য। বেশ নেশাত্মক এক কণ্ঠে বলে-
-অহংকার যে পতনের মুল রক্তকমলিনী!
আরাধ্যের সেই হাতের উপর নিজের নরম তুলতুলে হাতখান রেখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে

-হোক না তাতে কি? অহংকার করতে চাই;
আমি ভীষণ স্বার্থলোভী‌ , এতটাই স্বার্থলোভী যে সুখ খুঁজতে আপনাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছি। হবেন আবার অহংকার?
হঠাৎ কিছু একটা শব্দ পেতে ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করে উঠে বসে রয় কিছু সময়। ঘড়ির কাটায় সকাল ৮ টায় ঘন্টা পড়লোপ্রলো। ইফরাহ সেদিকে একবার তাকিয়ে পুরোক্ষণেই , ‌ স্বপ্নের কথা ভাবতে লাগলো।
হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি? এখন তো ভোররাত্রি নয় তবে
এসব আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝে ই ‌ খট করে দরজা খুলে ভেতরে আসে আরাধ্য। কপাল পুঁচকে তাকায় ইফরাহ। লোকটা কখন বেরিয়েছে? সে ভাবনা খেলে যায় তার মাথায় পুরো ঘর চোখ বুলিয়ে নেয় একবার।
আরাধ্য ঘরে ঢুকেই গায়ে জড়ানো শর্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে ‌ ঘরের এক কোণে। হাতের উপরি ভাগের মাংসে সাদা ব্যান্ডেজ টা নজরে পড়তেই ‌ ট্রাউজারের পকেট হতে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায় আরাধ্য।

ইফরাহ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে, বিছানা ছেড়ে উঠে গোসলখানায় গিয়ে চোখে মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে আবারো ফিরে আসে। এলোমেলো চুল ভর্তি মাথায় কাপড় টেনে এগিয়ে যায় বেলকুনির দিকে –
নিকোটিনের কালো ধোঁয়া উড়িয়ে বেলকনির দোল খাওয়ার চেয়ারে বসে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে আরাধ্য।‌ ‌ সাদা ব্যান্ডেজে রক্ত লেগে আছে। উদাম শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম চেহারায় এক বিষন্নতা। চুলগুলো এলোমেলো ইফরাহ বেলকনি গ্রিলের সাথে পিঠ লাগিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলে-
-কখন বেরিয়েছিলেন?
সিগারেটের লম্বা একটা লম্ব দিয়ে শুন্যে ধোয়া ছুড়ে আরাধ্য। ইফরাহ তার এমন ব্যবহারের চোখ বুজে নিঃশ্বাস ছাড়ে নিজেকে শান্ত রেখে আবারো-
-হাতে লেগেছে কি করে?

“-চুরি করতে গিয়ে”!
আরাধ্যের প্রতিউত্তরে চোখ ছোট ছোট করে নেয় ইফরাহ। কিছু সময় চুপ থাকে‌ সে । আরাধ্য ঠোঁটের কোনে সিগারেট চেপে ধরে তার দিকে তাকিয়ে বলে-
-জ্যামে পড়লে কেন, এদিকে এসো?
শুষ্ক ঢক গিলে মেয়েটা । দু’পা বাড়িয়ে আরাধ্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় সে। লোকটার ঝলসে যাওয়া কালো ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ধোয়া বেড়োচ্ছে‌। গলার উচু হার উঠানামা করছে। না চাইতেও ইফরাহর দৃষ্টি স্থির হয় তাতে।

গলা নিয়ে ঝুঁতে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে তার। হঠাৎ ধ্যানমগ্ন হাতে আরাধ্য টান দিয়ে বলে –
-আমায় নিয়ে চিন্তিত তুমি রক্তকমলিনী। কষ্ট লাগছে, হ্যা”!
উত্তর করে না ইফরাহ।এক হাতের মুষ্টিতে ইফরাহর হাত রেখে , ‌ ঠোঁটের সিগারেট অন্য হাতে নিয়ে একদম ছুড়ে ফেলে ‌ আরাধ্য। মাথাটা হালকা ঝাঁকিয়ে চোখে পড়া চুল গুলো সরাতে চেষ্টা করে সে। তবে বেয়াদব চুল সরে না।

এর মাঝে এক আশ্চর্য কাজ করে বসে ইফরাহ। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় আরাধ্যের চুল ‌ আঙ্গুলের ফাঁকে চুল নিয়ে উপরে দিকে তুলে।
তার এহেন কান্ডে ঠোঁট কিছুটা বাকিয়ে হাসে আরাধ্য। উপভোগ করে নারীর যত্ন। চুল উঠানো শেষ হতে, হাত নামিয়ে নেয় ইফরাহ। খেয়াল করে আরাধ্য এক ভ্রু উচিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে-
আকর্ষিক কোন প্রকার সংকেত ছাড়াই এক ঝটকা টানে তাকে কোলে বসিয়ে নেয় আরাধ্য। হতভম্ব ইফরাহ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথার আঁচল ফেলে তোর ঘাড়ে মুখ ডোবায় আরাধ্য।
কেপে উঠে কিশোর কিশোরী শরীরটা। আরাধ্য ঘাড়ে নাক ডোলে হাস্কি স্বরে বলে –

-শরীরে কি মাখছো ব‌‌উ ? কেমন এক মিস্টি সুভাস। এতো দেশি মদের থেকেও ফাস্ট নেশা চড়িয়ে দিচ্ছে।
কথার মাঝেই ‌ আহত হাতের চেপে ধরে ইফরাহর কোমড়ের এক অংশ। ব্যথায় চোখে খিচে নেয় ইফরাহ। চোখের কোনায় পানি চলে এসেছে মুখ চিপে ফুঁপে উঠছে সে।
আরাধ্য মুখ তুলে বলে-

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৮

-আমায় ভীষণ ঘেন্না হয় বুঝি ? আমি ছুতে গেলেই যে কেঁদে বুক ভাসাও।
জবাব করে না ইহরা ঠোঁট চিপে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করতেছি পুশ করে নিঃশ্বাস ছাড়িয়া তাও তো হাতে টেনে ধরে নিজের চুল। তাজা রক্তে আবারো ভিজে ওঠে সাদা ব্যান্ডেজ।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here