ছায়াস্পর্শ পর্ব ২
জান্নাত চৌধুরী
ভোরের কুয়াশা তখনো ঠিক মতো সরেনি। গ্রামের গলি দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তিনজন চার লোক, সাদা পাঞ্জাবি, মুখ গম্ভীর, চোখে ঠান্ডা নিষ্ঠুরতা। তাদের পেছনে হাঁটছে গ্রামের মাতব্বর ,দেখতে অর্ধ বয়স্ক মতন , দাঁড়িতে পাক ধরেছে , মাথা ভর্তি বিশাল টাক। চেয়ারম্যানের ডান হাত বললেই চলে
গ্রামের একেবারে ঠিক শেষ মাথায়, জলকাদা ভরা সরু একটা রাস্তার শেষে দাঁড়িয়ে আছে একটা আধা টিন, আধা বেড়ার তৈরি ছোট্ট এক বাড়ি । লম্বা টিনের এক ঘরের মাঝ বরাবর বাঁশে বেড়ায় লাগিয়ে দুভাগ করা ।চারপাশেও বাঁশের বেড়ায় মোড়ানো । বাড়ির সামনে এক বহু পুরনো আম গাছ ।
ভোরের আলো এখনো ঠিকভাবে মেলেনি। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় লোকগুলো সকলের কোমরে গুজা লাঠি।ভাঙ্গা বেড়ার দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে মাতব্বর । একে বাকিরাও ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতরে ।
শীত শীত আবহাওয়া। ভোর তখনো ভালো করে জাগেনি। বাতাসে ঠাণ্ডা শিহরণ ,যেন গায়ের প্রতিটি লোম শিউরে উঠে ।
আধ ভাঙ্গা এক চকিতে পুরনো এক ছেঁড়া কাঁথার নিচে পাশাপাশি শুয়ে আছে ইসমাইল শেখ আর জহুরা বেগম।ঘুমে বিভোর তারা। ছেড়া কাঁথাটাই দু’জনের গায়ে যেন যাপনের শেষ আশ্রয়।
হঠাৎ…বাহির থেকে আসে এক গলা চেঁচামিচি, জুতোর ঘষা, কাঁটা বেতের ঠকাস ঠকাস শব্দে ঘুমের মধ্যে একপাশে গড়িয়ে পড়ে জহুরা। চোখ আধা বন্ধ, তবে মুখেচযম বিরক্তি।
ইসমাইল শেখ বাড়িত আছো ?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
খাপছাড়া মোটা আর ঝাঁঝালো গলার ডাকে যেন টিনে চালে কাক বসবার জোড় নেই । জহুরা আধো ঘুমে চোখ মেলে তাকায়, নাক কুঁচকে একবার তাকায় ঘুমন্ত ইসমাইলের দিকে
বিছানা ছেড়ে আধো ঘুমে টলমল পায়ে এগোয় দরজার দিকে।
গায়ে পড়া জোড়া দেয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ডেকে দরজার খিল খুলে
আরে মাতব্বর সাহেব আপনে , এত্তো সকালে কোনো দরকার নি ?
উঠোনে দাঁড়ানো মাতব্বর , পানের গুলি চিবিয়ে মুখ ভর্তি পিচ মাটিতে ছুড়ে ফেলে , ডান হাতের আঙ্গুলে গাল ঠেলে আবারো পান চিবোতে চিবোতে বলতে লাগে
তোমার সোয়ামি কই জহুরা । ওরে বাইরে আইতে কও চেয়ারম্যানের ডাক পড়েছে !
বাহিরে এতো কথার শোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে যায় ইসমাইলের। লুঙ্গির কাছা ঠিক করে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়
কি খবর মাতব্বর সাহেব ?
– ছোট নবাবের আদেশ তোমারে লইয়া যাইতে কইছে ।
মনের মাঝে হঠাৎ ধুক ওঠে ইসমাইলের । ভয় যেন জেকে বসেছে মনে । শুষ্ক ঢোক গিলে পিছনের ঘরের দিকে তাকায় সে । দরজা লাগানো । আবারো তাকায় স্ত্রী মুখ পানে ।
কোন আকামের সামীল হইছেন আপনে । ছোট নবাবে কেন আপনেরে ডাইকা পাঠাইছে ।
আহ জহুরা শান্ত হও । মাইয়ারা ঘুমায় ,
‘ছোট নবাবের নজর পড়েছে তোমার সতিনের মাইয়ার উপর জহুরা। নিকা করবার চায় ওই মাইয়ারে , তয় মাইয়া রাজি না । শান্তি চাইলে মাইয়ারে বুঝাও জহুরা । তোমাগো কপাল ফিরবো ।
মাতব্বরের কথা শুনেই রাগে কটমট করে স্বামীর দিকে তাকায় জহুরা বেগম । যেন এই মূহুর্তে ছিড়ে ফেলতে পারলে মনে ভীষণ শান্তি লাগতো তার।
এইডা তো খুশির খবর মাতব্বর সাহেব ।ওই মুখ পুরী তো দেখি সাত কপাল নিয়া জন্মাইছে । যার তাগিদে ছোট নবাবের মতো মানি লোক ওরে বিবাহ করবার চাইছে । আপনি নবাব রে গিয়া কন জলদি বিয়ার আয়োজন করবার । আমরা সবাই রাজি এই বিবাহে।
আবারো গাল ভর্তি পানের পিচ হালকা ভেজা উঠানে ফেলে মাতব্বর । জহুরার দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বলে
তুমি পারবা মাইয়রে বুঝাইতে ?
পারুম না মানে , মাইয়া বিয়া করবো সাথে মাইয়ার ঘাড়ের বিয়া বসবো আপনি জলদি আয়োজন করতে কন
জহুরা !
ইসমাইলের তেজি কন্ঠে দেওয়া ধমকে যেন বিন্দু পরিমাণ নড়ে না জহুরা বেগম । নিজের কথার উপর অটল থেকে চোখ রাঙ্গায় ইসমাইল কে
“আপনে চুপ থাকেন । আমি যা কইছি তাই হইবো , আপনের ওই অলক্ষী মাইয়ারে যে ছোট নবাবের মনে ধরছে এতেই শুকরিয়া করেন।
—মাইয়ার মতের বাইরে আমি বিয়া দিবার পারুম না । আমার বাচ্চা মাইয়া খুব ডারায় ছোট নবাব রে !
এই যে কইলেন বাচ্চা মাইয়া , বাচ্চা মাইয়ার আবার মতের কি আছে ? আমরা যা কমু তাই মানবো ।
মাতব্বর সাহেব আপনে এখন আসেন আর ছোট নবাব রে গিয়া কন বিবাহের সময় ঠিক করতে ।
কথা দিতাছো তাইলে !
হো।
আইচ্ছা আজ তাহলে আসি ইসমাইল শেখ । নিজের ভালো চাইলে , বিয়াতে বেগড়া না দিয়া আমদ করো।
উল্টো ঘুরে বেড়িয়ে যায় মাতব্বর তার পিছন পিছন সকল লাঠিয়াল লোক গুলো । তাদের যাওয়ার পানে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে ইসমাইল গেট পেরোতেই নজর ঘুরায় সে । ছলছল চোখে জহুরা বেগমের দিকে তাকিয়ে কন্ঠ খাদে এনে বলে
—আমার মাইয়ার এত বড় সর্বনাশ কইরো না জহুরা , আল্লাহ নারাজ হইবো। আমার নিষ্পাপ মাইয়ার জীবন নরকে ঠেলে দিলো না
নরক না আপনার মাইয়া রাজরানী হইবো । সমাজে আমাগো একটু সম্মান বাড়বো বুঝছেন আপনি , এই বিয়া হইবো।
চেয়ারম্যানের বাড়ির প্রধান ফটকে পা রাখতেই ভয়ে এক পিছিয়ে যায় মাতব্বর , গেটের কাছের বকুল গাছের নিচে থাকা কুকুর হঠাৎ ডেকে ওঠাতে ভয়ে সিটিয়ে যায় সে , না জানি কখন ছিঁড়ে খায় তাকে দেখেই কতো হিংস্র লাগছে । কুকুরে ডাকে গেটে কাছে এগিয়ে আসে চেয়ারম্যান বাড়ির বাগানের মালি , হাফেজ মিয়া ।
লাঠি দিয়ে কিছুটা দূরে তাড়িয়ে দেয় কুটরটিকে । মুখে হালকা হাসি টেনে মাতব্বরের উদ্দেশ্য বলে
—ভেতরে আহেন মাতব্বর সাহেব , কুকরে আপনের কিচ্ছু করতো না। আসলে পশু কি আর কখনো পশুরে খায় বলেন । হেয় আপনেরে চিনবার পাড়ে নাই যে আপনিও তার মতোই ।
হাফেজ মিয়া তুমি কি কোনো ভাবে আমারে হেনস্থা করলে ?
—তওবা তওবা মাতব্বর সাহেব আপনেরে হেনস্থা আমার মতো এক মিসকিন করতে পারে বলেন তো । আসলে আমি কইছি আপনেরে কুকুর টা চিনবার পারে না তাই ভয় দেখাইছে । তা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে আইছেন বুঝি ?
‘তার কৈফিয়ত কি তোমারে দিবো , ছোটলোক কোথাকার সরে দাঁড়াও আমারে যেতে দাও।
রাগে গজগজ করতে করতে বাড়ির ভেতরে ডুকে পড়ে মাতব্বর সাহেব। কি যেন বিড়বিড় করছে সে , বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করতেই তার চোখে আসে বাড়ির পুরনো কয়েকজন কাজের লোক দুজন পুরুষ, একজন মহিলা।
মাতব্বর এগিয়ে যায় সামনের । কন্ঠ কিছুটা নরম নাটকীয় ভঙ্গিতে এনে মৃষ্টি সরে ডাকে
“ওগো কুলসুমের মা তোমার শরীর ভালা তো ?
কোমড়ে কাপড় পেঁচিয়ে টেবিলে খাবার রাখছিলেন মহিলাটি মাতব্বরে দিকে চোখ পড়তেই নাক ছিটকে নেয় সে । তবে মাতব্বর নিজেও বেশি ঘাটায় না তাকে বিশ্রী এক ড়াসি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যা সে ।
ঠাঁয় গিয়ে দাড়ায় চেয়ারম্যানের ঘরের দরজার সামনে গলা খানিক নামিয়ে বলে—
“চেয়ারম্যান সাহেব… খবর আছে…
কিসের খবর ?
হঠাৎ পিছনে কারো গম্ভীর কন্ঠে বরকে যায় মাতব্বর । মিইয়ে যাওয়ার মতো ছোট ছোট চোখ করে উল্টো ঘুরে সে ।
সামনে দাঁড়ানো আরাধ্য দিকে একনজর তাকিয়ে মাথা নিচে নামিয়ে নেয় সে ।
মাত্রই ঘুম ছেড়ে উঠে ব্রাশ, হাতে ঘরের বাহিরে এসেছিলো সে। পড়ে এখনো রাতের জামাকাপাড় । কালো ট্রাউজারের উপর সাদা সেন্ডোগেঞ্জি বুকের যতটুকু স্থান উন্মুক্ত ঠিক পুরো পুরোটা জুড়েই কালো লোমে ভরপুর । ব্রাশ দাঁতের মাড়িতে ঠেলে হাতে থাকা সাদা তোয়ালে কাধে উপর ফেলে আবারো প্রশ্ন ছুড়ে সে
কি হলো বলুন কি খবর ?
‘ আস আসলে ছোট নবাব , ইসমাইলের শেখে বউ ওই মাইয়ারে আপনার লগে বিয়া দিতে রাজি হইছে ।তয় ইসমাইল বেটা এখনো বেগড়া দেয় !
বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেন মাতব্বর চাচা , আপনাগো বউমা ঘরে আইবো । পুরো গ্রাম দাওয়াত দেও উৎসব হইবো উৎসব ।
আরাধ্য হাতের ইশারা পেতেই স্থান ত্যাগ করে মাতব্বর । বাঁকা হাসে আরাধ্য ঠোঁট বা গালে অসম্ভব সুন্দর টল ফুটে তার ।
“রক্তকমলিনী ”
নিরেট ঠান্ডা গলায় উচ্চারিত শব্দটি যেন দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আবারো ঘুরে আসে আরাধ্যে মুখে মূহুর্তে ডুব দেয় পুরনো স্মৃতিতে ।
সময়টা বসন্তের শুরু। গাছে গাছে নতুন পাতার কোমল জৌলুশ, ফুলের গন্ধে ভরপুর হাওয়ায় যেন ভেসে আছে কোনো পুরনো প্রেমের স্মৃতি। শিমুল গাছের ডালে বসে কোকিল ডাকছে একটানা মনে গেঁথে দেওয়া সেই সুর, যেন কারো নাম ধরে ডাকছে সে…
প্রায় বিকেল চারটে। সূর্যের আলো নরম হয়ে এসেছে,
ছায়া বড় হতে শুরু করেছে গাছের গোড়ায়। পথের ধারে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো বাতাসে নড়ে উঠে। চারপাশ বেশ স্নিগ্ধ ঠিক যেন রূপকথার মতো ।
সেবছর মাত্রই সেনাবাহিনীর চাকরির পালা একবারে চুকিয়ে গ্রামের মাটিতে পা পড়ছে ছোট নবাবের। আর্মি কাটিং চুল গুলোর সাথে হলুদে ফর্সা গায়ের গড়ন । পেটানো বডি , সাথে মুখের সেই গাম্ভীর্য , এক কথায় সিনেমার হিরোকেও হার মানায় সে ।
ছায়াস্পর্শ পর্ব ১
প্রায় বিকেল চারটা। রোদ ম্লান হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
গ্রামের কাঁচা মাটির রাস্তায় বটগাছের ছায়ায় আধবৃত্ত হয়ে বসেছে পাঁচ-ছয়জন যুবক। মাঝখানে, এক কাঠের পিড়িতে একহাতে ভর দিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে আছে আরাধ্যে।
ঠোঁটের কোণে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়া উঠছে আলস্যে। চোখ দুটো আধা বোজা—পাশে থাকা ছেলেগুলো হাসছে, ঠাট্টা করছে, গাঁজার ধোঁয়ায় আড়ষ্ট বাতাস।
