ছায়াস্পর্শ পর্ব ৩

ছায়াস্পর্শ পর্ব ৩
জান্নাত চৌধুরী

গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা একটা স্কুল ভবন, পেছনে বাঁশঝাড়, পাশেই ধানক্ষেত, সামনের দিকে এক চওড়া খোলা মাঠ, যেটার চারপাশে-ধূলো বালুতে ঘেরা মাটির ছড়ানো রাস্তা।
ভবনের গায়ে সাদা রঙ, তবে প্রতি বছরের বৃষ্টিতে এখন সেটা ধূসর ছোপ ছোপ হয়ে গেছে। দেয়ালে লেখা আছে— “শিক্ষাই শক্তি, জ্ঞানে মুক্তি” আর নিচে লাল রঙে জং ধরা বোর্ড—
স্থাপিতঃ ১৯৭৮”
স্কুল ভবনের দুপাশে উঁচু উঁচু সিঁড়ি, একটা সিঁড়ি ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য, আরেকটা দোতলায় শিক্ষক কক্ষের দিকে যায়।

প্রথম তলার একপাশে অফিস কক্ষ, হেডস্যারের চেয়ার এখনো কাঠের পুরনো, বাইরে একটা টিনের আলমারিতে ছাত্র-ছাত্রীর রেজিস্টার বই গাদাগাদি করে রাখা। স্কুলের মাঠটা বর্ষায় কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে, শুকনো মৌসুমে সেটা আবার ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠ হয়ে যায়। মাঠের একপাশে পুরনো আমগাছ, অন্যপাশে ছোট একটা ঘেরা বাগান যেখানে দোলনচাঁপা, রজনীগন্ধার গাছ। শিক্ষিকা মিস লায়লার শখে লা যেগানো।
সময় ফুরিয়েছে টিনের ধাতব ঘন্টা বেজে উঠেছে ছুটির ঘোষণা জানিয়ে দিয়ে।
ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে ক্লাস এইট, নাইন, টেন-এর ছেলেমেয়েরা।মেয়েদের স্কুলড্রেসে হালকা ময়লা ছোপ , নীল জামা,সাদা সালোয়ার , সাদা ওড়না ,ব্লেট । ছেলেরা কেউ সাইকেল ঠেলে, কেউ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছে,
মোড়ের সেই বটগাছের পথ ধরেই হেটে বাড়ি ফিরছে সকলে । আরাধ্য তখনো সিগারেটে টান দিতেই মগ্ন। একের পর এক ছেলে-মেয়ে ফিরছে নিজ গন্তব্যে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আরে ওইটা ইসমাইল চাচার মাইয়া না , কি জিনিস একখান ভাইরে পুরোই খাটি সোনা। উফফ একবার যদি পাইতাম এমন একখান খাসা জিনিস ভাই।
সাইড থেকে আসা অনিকের দেওয়া আওয়াজে কিছুটা ভ্রু কুঁচকে আসে আরাধ্যের। ঠোঁটে থাকা সিগারেট ধীর ধীরে নামিয়ে নেয় সে।
—হো মামা পুরো তিন এলাকায় এমন একখান জব্বর জিনিস খুঁজে পাওয়া দায়। দেখ দেখ , কি নাক , কি ঠোঁট উফফ একবারে গোলাপের পাপড়ির মতো টকটক করছে মামা ইসস …কথা শেষে নিচের ঠোট কিছু কামড়ে ধরে রিফাত।
এবার যেন হাতে থাকা সিগারেট ছুড়ে ফেলে উঠে বসে আরাধ্য। পাশে থাকা ছেলেগুলো নজর ফলো করে সামনে তাকায় সে।

ওই যে গুটি গুটি পায়ে সামনে হেটে আসছে এক পরির বাচ্চা।
পায়ে ধুলো মাখা স্যান্ডেল, পড়নে নীল স্কুল ড্রেস হাতে থাকা কয়েকটি ব‌ই বুকের মাঝে চিপে ধরে মাথা নিচু করে হাটছে সে। যেমন গাঁয়ের রং তেমন তার চুল। ফর্সা কিশোরীর কালো লম্বা চুলগুলো বেনুনিতে গেথে সামনে এনে ফেলা। চোখে যেন নেশা ধরে যায় আরাধ্যের।
অল্প অল্প করে এগিয়ে আসছে মেয়েটি। পায়ের নিচে শুকনো পাতা মচমচে শব্দ করে ভেঙে পড়ছে, আর সে শব্দটাও যেন তার মতই লাজুক। মাথা নিচু করে চোখ মাটিতে রেখে হাটছে সে যেন পৃথিবীর কোনও কিছু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। হাটার তালে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে চুলের বেনুনি, আর তার উপস্থিতিতে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে পড়ছে একটু একটু করে।

“এই মেয়ে!”
এইতো নিচু মাথায় পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সে।আরাধ্যের এক হাত দূরত্বে। কিন্তু পেছন থেকে আসা অনিকের কণ্ঠ যেন সময় থামিয়ে দিল পা জোড়া এক মুহূর্তে থেমে যায় তার।
মাথাটা ধীরে ধীরে আরও নিচু হয়ে যায়। একটা জেগে ওঠে এক অজানা সঙ্কোচ । চারপাশে একটু নিঃস্তব্ধতা ,আরাধ্যর চোখে পড়ে, মেয়েটির আঙুলগুলো আরও শক্ত করে চেপে ধরছে বইয়ের কোণা।
—এই মেয়ে এইদিকে আয় ,

অনিকের গম্ভীর, কাঠখুট্টে গলার ডাকে মাথাটা হালকা উঁচু করে সামনে দাঁড়ানো ছেলে গুলোর দিকে তাকায় মেয়েটি। সবার চেহারা পর্যবেক্ষণ করে চোখ জোড়া থেমে যায় আরাধ্যের উপর কিছু সময় তাকিয়ে আবারো নজর নামে
মেয়েটি একটু কেঁপে ওঠে। কাঁধটা সামান্য কুঁচকে আসে, যেন শব্দটা তার গায়ে গিয়ে লাগে। বইগুলো বুকের মাঝে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। যেন সেই বইগুলোই একমাত্র ঢাল তার।
চোখ নামিয়ে নেয় তবে পায়ের শব্দে বোঝা যায় ,সে এবার অনিচ্ছা নিয়ে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে ওদিকেই।
চুলের বেনিগুলো আর দোল খায় না, বাতাস থেমে গেছে, যেন প্রকৃতি পর্যন্ত নিঃশব্দ হয়ে গেছে এই অনাহূত মুহূর্তে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সে। ভয়, সংসয় সব কিছু যেন আঁকড়ে নিয়েছে তাকে। মেয়েটি এগিয়ে এসে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়।

মুখে বিকৃত হাসি রেখে অনিক হাত বাড়িয়ে ছুতে যায় মেয়েটির লম্বা বেনুনী। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই কিছু টা চমকে চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় মেয়েটি।
অতিক্রম হয় বেশ কিছু সময় তবে শরীরের কোন ছোঁয়া অনুভব হয় না ভেবেই চোখ খুলে সে। তবে চোখ খুলে সামনের দৃশ্য নজরে আসতেই ভয় যেন আরো দুধাপ এগিয়ে এসে আঁকড়ে ঝ
ধরে তাকে
অনিকের বাড়ানোর হাতটা আরাধ্যে মুষ্টিতে আবদ্ধ ! যন্ত্রণায় প্রায় জড়োসড়ো হয়ে গেছে ছেলেটি তবে আরাধ্য যেন এখনো সামনের নাবালিকা মেয়েটিকে দেখতেই ব্যস্ত।
ভাই ,ভাই কি করছেন
ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে ডাকতে থাকে অনিক। সে ডাক আরাধ্য কানে পৌছালো কি না কে জানে। এদিকে অনিকের বেহাল দশায় রিতিমত ভয়ে কাঁপছে রিফাত সহ বাকি দুজন। সকলে ভয়ে এক পাশে জোড়সোর হয়ে কাঁপছে
ভা…
হুসস!

—এই মেয়ে।
আরাধ্যের ডাকে যেন ধ্যান ভাঙ্গে মেয়েটির। মায়াবী চোখ জোড়ায় যেন মূহুর্তে ভয় এসে জমা হয়। গলা ধরে আসছে , চোখের কণা চিকচিক করছে তার।
অনিকের হাত ঝটকা দিয়ে ছেড়ে, মেয়েটির দিকে দৃষ্টি রেখেই এক এক করে এগোতে থাকে আরাধ্য। ভয় যেন এবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় মেয়েটিকে । আরো দ্বিগুন শক্ত করে চেপে ধরে ব‌ইয়ের কণা।
—এই মেয়ে নাম কি ?
মেয়েটি ঠোট কাঁপছে। গলা জড়িয়ে আসছে তবে কন্ঠ যেন ধারালো কোনো ব্লেড। আরাধ্য তাকিয়ে থাকে মুখ পানে ঠোঁটে তার অদ্ভুত এক হাসি। হঠাৎ দমকা হাওয়া মতো ঠান্ডা মিষ্টি এক কন্ঠ ভেসে আসে তার কানে
ইফরাহ্ জান্নাত ।

—কি কি ?
ইফরাহ্ ।
—ইফরাহ্ জান্নাত।
তা তোর বাপে এতো কঠিন নাম কেন রাখছে যাতে গ্রামের পোলাগো দাঁত খুইলা পড়ে।
আব্বায় না মা রাখছে ।
কোন ক্লাস ?
দশম।
বাচ্চা মাইয়া ! তা বলি আমারে চিনোস কে আমি ?
উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায় ইফরাহ্।‌মানে সে চিনে।
‘ কি বোবার মতো মাথা নাচিয়ে চলছিস চিনিস নাকি না মুখে বল!
শুষ্ক ঢোক গিলে ইফরাহ্। জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নেয় সে। আরাধ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে
—আ আপনি চেয়ারম্যান কাকার বখাটে ছেলে। শুনেছি সেনাবাহিনী ফেরত গোলমাল।
বাহ ! তা ভালোই তো খরব রয়েছে আমার নামে। তোর সাহস বলি হারি মেয়ে আমার সামনেই আমার বদনাম “ভেরি ইন্টারেস্টিং”

বদনাম নয় সত্যি বলছি ! এখন দোয়া করে পথ ছাড়ুন…
যদি না ছাড়ি!
দোহাই লাগে ছোট নবাব পথ ছাড়ুন । লোকে মন্দ বলবে ।
হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে আরাধ্য। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কাকগুলোও আচমকা ডানা ঝাপটায়। যেন সেই হাসিতে শিউরে উঠল চারপাশের বাতাসও।
—”লোকে মন্দ বলবে!”—
আঙুল তুলে কিছু ভাবার ভঙ্গি করে সে । ইফরাহ্ তখনো চুপচাপ দাড়ানো আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করছে আরাধ্যর কর্মকাণ্ড। এদিক সেদিক তাকিয়ে ঠোট কামড়ে বলতে থাকে
—তুই তো দেখি লোকের ভীষণ খেয়াল করিস। সমাজে ভীষণ ভয় বুঝি।
ইফরাহ্ চোখ নামিয়ে রাখে। ঠোঁট চেপে ধরে যেন ভেতর থেকে কিছু বেরিয়ে না যায়। তার বুকের ভেতরে কেবল শব্দ হচ্ছে ধুক ধুক ধুক।
আরাধ্য হালকা ঝুকে আসতেই ছিটকে সরে বেশ কিছু দূরে সরে যায় সে
—আহা সুন্দরী নড়ে না ,আমি তো ছুঁবো না।

‘ নির্লজ্জ পুরুষ।
এবারো যেন বেশ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে আরাধ্য। তবে এবার আর ভয় পায় না ইফরাহ্ মুখে মুখে তাকিয়ে দেখছে সেই হাসি। হয়তো ভাবছে লোকটা কি তবে পাগল
ছোট নবাব আসবো —
পেছন থেকে ভেসে আসা কারঝ ডাকে লুকায়িত স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে আরাধ্য। উল্টে ঘুরতেই সামনে চোখে পড়ে বাড়ির রেণুর মা। তিনি প্রায় ছয় বছরের পুরনো কাজের লোক এই ঈর বাড়ির চুপচাপ, বিনয়ী, আর এমন এক নারী যাঁর মুখে কথার চেয়ে চোখেই যেন জমে থাকে হাজার গল্প।
আহা খালা দিলেন তো আমার স্বপ্নের ১৪, টা বাজাইয়া বাস্তবে ব‌উ না পাই স্বপ্নে তো বিয়াটা হ‌ইতে দিবেন তো নাকি।
আগ্গে ছোট নবাব , ইয়ে মানে

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২

‘ কি মানে মানে করছো , কি হয়েছে ?
আপনার গ গরম পানি গোসল খানায় রাখা হয়েছে। আপনি গোসলে যান।
—হয়েছে বলা এইবার বিদায় হয়ে, আমারে ধন্য করো।
আগ্গে ছোট নবাব ।
রণুর মা নিঃশব্দে কর্ণিশ জানিয়ে, আধ ছেড়া স্বস্তার শাড়ির আচল ঘারে ঠেলে চলে যায়
সে আমার না হলে, মীর বাড়ির কবরস্থানে
নতুন দুটো কবর হবে।
বলেই বাকা হাসে আরাধ্য ,অদ্ভুত সেই হাসি। এই মূহুর্তে যেন ভয়ংকর হয়েছে তার রূপ। ডান হাতে চুল গুলো টেনে কাধে থাকা গামছা হাতে নেড়ে সেও স্থান ত্যাগ করে

ছায়াস্পর্শ পর্ব ৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here