ছায়াস্পর্শ পর্ব ৪
জান্নাত চৌধুরী
সময়টা প্রায় বেলা ১১টা।
অন্দরমহলের ঘন নীরবতা ভেদ করে মাঝেমাঝে বাতাসে খটখটে একটা জানালার পাত খোলার শব্দ কানে আসে। কাঠের তৈরি এক খানদানি চেয়ারে বসে আছেন চেয়ারম্যান। চওড়া হাতল, পিঠে পাটাতনের গাঢ় খোদাই আর নিচে চার কোণায় সিংহের মুখ ঠিক যেন রাজকীয় এক ভাব।
হাতে চায়ের কাপটা ঠোঁটে নিয়ে লম্বা এক চুমুক দেন তিনি। গরম ভাপ তার গোঁফ ছুঁয়ে যেতেই কাপটা শব্দ করে রাখেন পাশে টেবিলে।তারপর ধীর ভঙ্গিতে খুলে নেন খবরের কাগজ।।
প্রথম পাতা শেষে দ্বিতীয় পাতা উল্টাতেই চোখ চলে যায় উপরের একটা শিরোনামে। শিরোনামটা বেশ বড় অক্ষরে ছাপা
“অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ , অভিযুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য।”
চেয়ারম্যান দৃষ্টি থেমে যান।চোখজোড়া ধীরে ধীরে ছায়াঘন হয়ে ওঠে। পত্রিকার পাতায় ছাপা কালো অক্ষর যেন চোখে জ্বলজ্বল করেছে
ঘটনাস্থল?…
পঞ্চগড় , ডাঙ্গাপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম শিমুলবাড়ি।
চেয়ারম্যানের চোখের পাতা একবার ঢাকে, আবার ধীরে খুলে যায়।
মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকেন তিনি—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“গত পরশু রাতে ডাঙ্গাপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম শিমুলবাড়ি গ্রামে এক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় মাদকাসক্ত তিনজন দুর্বৃত্ত। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, যার বিরুদ্ধে পূর্বেও একাধিক অভিযোগ থাকলেও প্রশাসন কার্যত নিশ্চুপ ছিল।”
চেয়ারম্যানের আঙুল হঠাৎ করে শক্ত করে চেপে বসে কাগজটার উপর। সেই প্রভাবশালী পরিবারের নামটা স্পষ্ট লেখা না থাকলেও তিনি হয়তো জানেন সব । একটু বেশি ভালো করেই জানেন।
নিজের বুকের পাঁজরের নিচে যেন হঠাৎ শীতল একটা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে।তিনি আবারও ধীরে ধীরে আবার পড়েন বাকি অংশ
“অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে পরিবারটিকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কিশোরীর বাবা।…”
চেয়ারম্যান চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। চোখের সামনের কাগজটা হালকা উঁচু করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে কাগজে ছাপানো মেয়েটার চিত্র , রক্তাক্ত মুখ, ছেঁড়া জামা, এলোমেলো চুল।
পত্রিকায় নজর রেখেই চেয়ারম্যান আবারো চুমুক দেন চায়ের কাপে। এইবার চুমুকটা যেন একটু ভারি সাথে বেশ দীর্ঘ,
কাপের ভেতরের তরল যতটা না শরীর গরম করছে, তার চেয়েও বেশি গলায় জমে থাকা কোনো এক কাঁটা ধুয়ে ফেলতে চাইছেন তিনি।
চেয়ারম্যানের চোখ এখনও কাগজে ছাপানো লাইন গুলোতে নজর বুলিয়ে চলছে
“…মেয়েটির পরিবার বর্তমানে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ।”
হঠাৎ সদর দরজা থেকে ভেসে আসে কারো পায়ের শব্দ। পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ারম্যান দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন সেদিকে।
পায়ে বুট , পড়নে পুলিশের পোশাক। ঠকঠক শব্দে ভিতরে প্রবেশ করছে স্থানীয় থানার অফিসার আসলাম মোল্লা।পা ফেলার আগেই তার পেটের ভুড়ি যেন চার কদম এগিয়ে রেখেছে তাকে।
ঘামে চকচকে মুখ, হাতে ধরা একটা পুরোনো নীল ফাইল।
চেয়ারম্যান বসে বসে দেখছেন তার আসার গতি।
আসসালামু আলাইকুম, চেয়ারম্যান সাহেব,
লম্বা এক সালাম দিতে দিতে একদম নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে আসলাম মোল্লা, মুখে হাসি, কিন্তু চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় যা আছে পুরোটাই হিসাবের গন্ধ।
চেয়ারম্যান ধীরে মাথা কাত করেন, আসলামের গলাটা শুনেও কিছু বলেন না, শুধু ঠোঁটের নিচে জমে থাকা সেই চায়ের তিক্ততা যেন আরেকবার গিলে ফেলেন। পত্রিকার ভাঁজ তার সামনে এখনও খোলা—
আসলাম মোল্লা গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে কিছুটা চেয়ারম্যানে মনোযোগ তার দিকে টেনে নেয়
একটু জরুরি কথা ছিল চেয়ারম্যান সাহেব , ব্যাপার টা নিশ্চয়ই আপনার কানে ইতোমধ্যে এসেছে।
চেয়ারম্যানের চেহারা গম্ভীর , কন্ঠে ভার নিয়ে ধীরে বলেন
বলে ফেলো !
আসলাম মোল্লা এবার গলা একটু নামিয়ে, কাঁধ সামান্য ঝুঁকিয়ে নেয় ঠুক ঠুক পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পাশের কাঠের সোফার নরম গদিতে। এদিক ওদিকে নজর বুলিয়ে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়েনম্র
পাশের গ্রামের খবর নিশ্চয়ই আপনার কানে এসেছে, চেয়ারম্যান সাহেব?”
চেয়ারম্যান কোনো উত্তর দেন না। শুধু ধীরে চোখ তুলে তাকান আসলামের চোখে। ভরকে যায় আসলাম থতমত খেয়ে শার্টের কলার টেনে দৃষ্টি দেয় নিচে
কোন ব্যাপার টা ?
আসলাম একটু ইতস্তত করে। তার ভুঁড়ি এবার আর আগ বাড়িয়ে আসে না, পেছনে টান পড়ে যেন। সে ফাইলের পাতা খুলে, একটা কাগজ দেখিয়ে বলে—
“ভিকটিমের পরিবার থানায় গিয়েছিল। কনস্টেবলের কাছে কেস লিখাতে। মেয়েটার অবস্থা খারাপ, লোকজন ভয় পাইতেছে কেস করতে। কিন্ত পত্রিকা তো সব ফাঁস করে দিছে।”
রেণুর মা দুকাপ চা দিয়া যাও।
আসলামের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে , রন্ধন ঘরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাক ছাড়েন চেয়ারম্যান। খবরের কাগজ পাশে রেখে সোজা হয়ে বসেন
আসলাম এবার একটা ফাঁকা ঢোক গিলে নিয়ে বলে
চে ..চেয়ারম্যান সাহেব মিডিয়া পেছনে লাগছে , উর্দ্ধতন অফিসাররা চাপ দিতেছে। তদন্তে নাম যদি বেরিয়ে আসে বুঝতেই পারতেছেন… আপনাদের পরিবারের
বাকিটা বলার আগেই হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় চেয়ারম্যান, হালকা ঝুকে চোখ বুলায় নীল ফাইলটার দিকে। মাথা সামান্য একদিকে উঁচু করে বলেন
“আমার ছেলের নাম তো এখনও কেউ বলেনি । সে যে দোষী তার প্রামাণ কিহ ?
আসলাম হেসে ওঠে একটা শূন্য হাসি, যেন আধা কেজি তেল গড়িয়ে পড়ছে মুখে,
তা মনে হয়না কেউ মুখ খুলবে বলে , তবে মাইয়ার বাপ টা ভিষণ লাফরা করছে।
অন্দরমহলে যেন বাতাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, কেমন ঘুপ ধরা একটা পরিবেশ, বাড়ির বাহির হতে কবুতরের পাখা ঝাপটানো শব্দ ভেসে আসে
চেয়ারম্যান এবার চেয়ারে গা এলিয়ে বসে! বেশ আয়েসি হয়ে বসে হাত বুলায় লম্বা দাড়িতে চোখ তার ঘন ছায়ায় ভরে যায়।
কন্ঠ টা হালকা খাদে নামিয়ে বলেন,
ভিকটিমের মুখ বন্ধ করতে পরিবারে কে টাকা দেও। যা চায় সব দাও তবুও যেন মুখ বন্ধ থাকে।
কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব যদি মাইয়া না মানে তখন, যদি নিজে আদালতে ….
মেয়েটা মুখ খুলবে না।
সিঁড়ির দিক থেকে ভেসে আসে এক গম্ভীর কন্ঠ। আসলাম মোল্লা কেঁপে ওঠে সামান্য, মুহূর্তেই তাকায় সেদিকে। চোখে পড়ে সিঁড়ির বাঁকে ধীরে ধীরে নামছে আরাধ্য
গায়ে হালকা মেরুন রঙের শার্ট, সাথে জিন্স বুকের দুটো বোতাম খোলা। যার ফাঁক গলে চোখে পড়ে তার বুকে গজিয়ে ওঠা ঘন কালো লোম। চুলগুলো আর্মি কাট হলেও এখন বেশ বড় হয়ে উঠেছে সাথে রুক্ষ আর এলোমেলো।
হাতে একটা চাবির রিং, সেটা সে ঘুরাতে ঘুরাতে নামছে , ঠিক চক্রের মতো ঘুরছে ধাতব শব্দ। তার প্রতিটি পা যেন মাপা ছন্দে সিঁড়ি ছুঁয়ে নামছে, আর সাথে আসছে এক অদৃশ্য ভয়ের তরঙ্গ।
-ছোট নবাব…”
আসলাম মোল্লা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। মুখে একটা শুকনো হাসি কিন্তু গলায় রুক্ষতা, চোখে লালচে দুশ্চিন্তা। চেয়ারম্যান এখনো বসা । পাশে থাকা খবরের কাগজ আবারো হাতে তুলে নেয় , তবে তার চোখ এখন আর পড়ছে না অক্ষরে, বরং আড়চোখে তিনি পরখ করছেন আসলাম মোল্লার মুখে ভাসমান উদ্বিগ্নতা।
আরাধ্য এসে দাঁড়ায় টেবিলের কাছে ঠিক চেয়ারম্যানের পেছনের। সে একবারও তাকায় না চেয়ারম্যানের দিকে , হয়তো প্রয়োজন বোধ করে না। তার পুরো নজর আসলাম মোল্লার উপর। ঠোঁটে ম্লান হাসি টেনে বলে…
-মেয়েটা মুখ খুলবে না ।
এই কথাটা যেন ঘরের বাতাসকে হঠাৎ ভারী করে তোলে। আসলাম মোল্লা শুষ্ক ঢোক গিলে । চেয়ারম্যান পত্রিকা থেকে মুখ না তুলে ধীরে বলেন—
”ইতরামি কমাও আরাধ্য , সামনে নির্বাচন এখন ছোট একটু ঝামেলা মানেই প্রতিপক্ষের কাছে , লুঙ্গির কাছা খুলে যাওয়া। উল্টো পাল্টা সব বন্ধ রাখো কিছুদিন।
আরাধ্য তাকায় বাবার দিকে , ঠোট বাঁকিয়ে কিছুটা হাসে সে , হাতে থাকা চাবির রিং ঘুরাতে ঘারতে আটকে দেয় মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।
“””বাথরুমের চাপ এলে যেমন চেপে রাখা দায় ,তেমনি মাথায় মা * ল চড়ে গেলে নিজেকে সামলানো দায়। আমার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র আশা করছি এর থেকে ভালো আর বুঝানো সম্ভব নয়।
অসভ্য !
“””””সভ্য সমাজে দুই একটা অসভ্য থাকলে তবেই সমাজ উন্নতির শীর্ষে ওঠে আব্বাজান। সবাই যদি সাধু থাকে এই যে , কাকুর মতো পুলিশ গন তো ভাত না পেয়ে মরবে তাইনা ।
লজ্জায় মাথা কিছুটা নিচু করে নেয় আসলাম , মনে রাগ লাগলেও প্রকাশ যেন ঘোর অন্যায় জানের ভয় কার না আছে।
-“আসছি আমি।”
চেয়ারম্যানের উত্তরের অপেক্ষা না করে গটগট করে বেড়িয়ে যেতে নেয় আরাধ্য হঠাৎ চেয়ারম্যানের বলা কিছু কথা যেন পা বেঁধে দেয় তার।
“আইজ তোমার আম্মা ফিরবে ৫টার ট্রেনে সাথে তোমার রাহেলা খালার মেয়ে মানহা আসবে। দয়া করে স্টেশন থেকে তাদের বাড়ি নিয়ে এসো। যদিও আমিই যেতাম তবে আজ পরিষদের দরকারি কিছু কাজে আমাকে সেখানে যেতে হচ্ছে। আশা করছি তুমি এই ব্যাপারে অন্তত আমাকে নিরাশ করবে না।
মুখ ফুটে কোনো হ্যা বা না কিছুই বলে না আরাধ্য , দ্রুত পা ফেলে বেড়িয়ে যায় সে।
চারদিকে হালকা বাতাস থাকলেও, দুপুরের সূর্য যেন মাথায় চড়ে বসেছে।
তবু সময়টা টিফিন পিরিয়ড
বিশাল বড় গাছের ঘন পাতার ছায়ায় গোল হয়ে বসে আসর জমিয়েছে এক ঝাঁক শিক্ষার্থী। কেউ গল্প করছে, কেউ টিফিনের বাক্স খুলে খাচ্ছে, আবার কেউ কেউ যেন “চিইইইই দম!” বলে দৌড়ের ওপর বৌ পালানো খেলায় মেতে উঠেছে।
সাথে হাসির হো হো আওয়াজ ভেসে আসছে চারদিক থেকে
এদিকে স্কুল ভবনের পাকা বারান্দায় ফ্লারে বসে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে আছে ইফরাহ্। হাতে ইংরেজি ব্যাকরণ, তার ঠিক পাশেই গল্পর রাজ্য তুলে এনেছে যুথি। মুখে যেন খই ফুটছে তার একের পর এক বকেই বলেছে মেয়েটা। ইফরাহ্ আদতেও তার গল্প শুছে কিনা কে জানে ,
এই মেয়ে!
হঠাৎ যুথি ধাক্কাতে বই থেকে মুখ তোলে ইফরাহ্। বইটা আধবোজা করূ হাতে রেখে সম্পূর্ণ দৃষ্টি দেয় যুথির দিকে
হ্যাঁ বল ?
‘জানোস পাশের গ্রামের এক মাইয়া রে নাকি কেডা ধর্ষণ কইরা। তালতালার পুকুর পাড়ে ফালাইয়া গেছে। মাইয়ার অবস্থা নাকি বেশি একখান ভালা না। বাঁচবো কি না সন্দেহ।
হঠাৎ কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায় ইফরাহ্। বুকের মাঝে কেমন ঝড় উঠেছে। আশেপাশে আসা কোনো শব্দ যেন মনোযোগ কাড়তে পাড়ছে না তার,
মানুষ এত আমানুষ কিভাবে হয় এটা যেন একদম ভেবে পায় না ইফরাহ্ মনে মনে ভীষণ ক্ষিপ্ত সে। মন থেকে দোয়া যেন ধর্ষকের কঠিন বিচার।
টিনে ধাতব বস্তুতে টোকা পড়ছে টিফিন পিরিয়ড শেষ। এক এক মাঠ ছেড়ে কমন রুমের উদ্দেশ্য হেটে আসছে মেয়েরা এইতো কিছুসময় পড়েই শাহনাজ ম্যামের ক্লাস। ঠিক সময়ে উপস্থিত না হলে পুরো সময়টাই বাহিরে এক পায়ে দার করিয়ে রাখবেন তিনি। ইফরাহ্ জলদি ওঠে কমন রুমের ব্যাগ হতে বই নিয়ে ১০ম শ্রেনী ক্লাস রুমে ঢুকে। প্রথম বেঞ্চে নিজে বসে পাশের সিটে তার পাশে ফাকা স্থানে বই রেখে যুথির জন্য জায়গা রাখে।
যুথি আসতেই নিজের বই হাতে তুলে তাকে বসার জায়গা করে দেয়। সহসাই হেসে ওঠে তারা।তবে এরি মাঝে ক্লাসে প্রবেশ করে ম্যাম। আজ তিনি আইসিটি ব্যাসিক ধরণা নিয়ে আলোচনা করবেন। এক এক করে প্রত্যেকে বই খোলে
সকলের মনোযোগ ম্যামের কথা সময় পেরোতে থাকে পাক্কা ৪০ মিনি পড় ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে যায় ম্যাম। সকলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে , মেয়েরা এক এক আবারো হাটা ধরে কমন রুমের দিকে।
ধারাবাহিক ভাবে একের পর এক ক্লাস শেষ করে মাত্রই ছুটির ঘন্টা পড়েছে এক এক বাড়ির ফেরার তাড়া সকলের, কার আগে কে বেড়েবো এই নিয়ে দরজায় তাড়াহুড়ো। যুথি ইফরাহ্ দুজনোই একসাথে বেড়োয় আজ তারা জোড়ায় জোড়াৎ বাডি ফিরবে।
স্কুল গেট পেরিয়ে কাচা মাটির পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন ।হাঁটার মাঝে প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে যেন বিন্দু পরিমাণ ভুল হয়না তাদের। এক এক করে ধান ক্ষেতের পথ পেড়িয়ে হাঁটতে থাকে তারা , বিভিন্ন গল্পে হাসতে হাসতে একজন অপরজনের গায়ে যেন দোল খাচ্ছে , মীরপাড়ায় পা পড়তেই হঠাৎ শান্ত এক কন্ঠে যেন পা থেমে যায় দুজনোর রক্তকমলিনী
পিছন থেকে ভেসে আসা ডাকেই যেন হাসি গায়েব হয় দুজনের, ইফরাহ্ কেমন ভয়ে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে।
রক্তকমলিনী আবারো সেই ডাক , ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরে যায় ইফরাহ্। এদিকে লিচু বাগানের পথের ধারে কালো রঙা বাইকের উপর কেমন শুয়ে রয়েছে আরাধ্য। হাত দিয়ে চোখ জোড়া ঢাকা , বাইকে আয়নার উপর কালো রঙ্গা হেলমেট ঝুলছে ইফরাহ্ তাকিয়ে রয় মুখ ফুটে কোনো উত্তর আসে না তারদিক থেকে , সময় কত অতিবাহিত হলো জানা নেই। চোখ থেকে থাত নামিয়ে ইফরাহ্ দিকে ঘাড় হালকা কাত করে চেহারা পর্যবেক্ষণ করে। চুল গুলো আজ ভীষণ এলোমেলো , চেহারায় কেমন ক্লান্তির ছাপ। পায়ে বেশ ধুলো , হয়তো ধান ক্ষেতের পথ পাড়ি দিয়েছে পড়নে আজো পড়নে সেই স্কুল ড্রেস। চোখে কোণে কাজল হালকা লেপ্টে গিয়েছে। আরাধ্য বাইকে উঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ,
ইফরাহ্ ভয়ে কাপছে , মনের মাঝে ভয়েরা দোলা পাকিয়েছে তার চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নেয় এক হাতে বুকে সাথে বইগুলো চেপে ধরে। পিছনে সেই পুরনো তালতলার পুকুর। বিশাল বিশাল নারকেল গাছ যার ছায়া পড়ে পুকুরের নীল পানিতে। ঠিক মাঝ পুকুরে লাল ,সাদা শাপলার সমাহার।
যুথি ঠায় দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছে দুজনকে , ইফরাহ্ ভয় পাচ্ছে ভেবেই তার হাত শক্ত করে ধরতে নেয় সে। তবে ভেসে আসা শক্ত ধমক শুনেই থেমে যায় তার।
‘ ওকে ছুঁলে এই পুকুরে কাল নিশ্চিত তোর লাশ ভাসবে মেয়ে।
ভয় পেয়ে যায় যুথি । ইফরাহ্ দিকে বাড়ানো হাত সাটাম করে গুটিয়ে নেয় সে। একটু একটু কিছুটা পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে তার শরীর।
আরাধ্য এগিয়ে আসে একদম কাছে এসে দাঁড়ায় ইফরাহ্ মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্ব। আর একটু এগোলেই হয়তো গা ঘেষা হয়ে যাবে । ইফরাহ্ চোখ বন্ধ জামায় চেপে ধরা হাত আরো কিছুটা শক্ত করে চেপে ধরে সে চোখের পাতা কাপছে। আরাধ্য মুসকি হেসে ফুঁ দেয় তার চোখে পাতায়। আরো কিছুটা কেপে ওঠে ইফরাহ্
মিষ্টি গোলাপি ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে নাক ঠোঁটে মাঝ বরাবর একটা ছোট কালো তিল বেশ আকর্ষণীয়। আরাধ্য ছুঁতে গিয়েও আবার হাত ফিরিয়ে নেয়।
“এই মেয়ে চোখ খোল , দেখ আমাকে।
খিচে ধোরা চোখ জোড়া আস্তে আস্তে আগলা হতে থাকে চোখে পাতা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে ইফরাহ্ , মাথাটা হালা উঁচিয়ে চোখ রাখে আরাধ্য কালো মনির চোখ জোড়া। যে চোখ জোড়া এখন তার উপরেই নিবদ্ধ।
আরাধ্য নেশা চড়ে , সাদা মনি বিড়াল চোখ জোড়ায় যেন বশ করে তাকে। হরিণী চোখের মায়ায় সপেছে নিজেকে। আরাধ্য বেশ কিছু সময় নিয়ে মনে ভরে দেখে থাকে
‘ছো ….ছোট নবাব
ইফরাহ্ কাপা কাপা গলায় বলা কথায় যেন ধ্যান ভঙ্গ হয় আরাধ্য, ডান হাতে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে নেয় একবার। ”ইফরাহ্ ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকায় কেউ দেখলে যে ভীষণ সর্বনাশ হবে। গ্রামের লোকে কলঙ্ক দেবে। পুরো সমাজ এক ঘরে করবে তাদের , আরাধ্য বুঝে সব। ইফরাহ্ দিকে তাকিয়েই শান্ত কন্ঠে বলে
‘ পুরো সমাজ তোমার দাসত্ব খাটবে মেয়ে। যে সমাজ তোমার দিকে আঙুল তোলবে সে সমাজ কে তোমার পায়ে এনে ফেলবো।
তুমি রানী, এই মীর বংশের রানী ,আমার রানী!
ইফরাহ্ চোখ তাকিয়ে থাকে আরাধ্যের মুখ পানে, চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি বুক ছিড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে ভেতরের আর্তনাদ
‘ আমি চাই না এই অভিশপ্ত জীবন , চাই না আপনাকে দোহাই লাগে মুক্তি দেন। আমার পরিবার কে রেহাই দেন।
তবে হায় আফসোস কথাগুলো গলা অবধি এসেও আটকে বয়। মুখ ফোটেও বেড়োতে পারেনা। মলিন হাসে ইফরাহ্ , ক্ষমতার আর টাকার কাছে আজ ব্যর্থ সে ,
”’বিয়ের প্রস্তুতি নাও মেয়ে , কোনো না শুনছি না।
“আমার রূপ আমার সারা জীবনের পাপ।
আমি পাপী, আপনার মতো পাপী চেয়েছে আমাকে।
আমি পাপী,আমি নিঃস্ব।
ইফরাহ্র বলা কথাগুলোয় বাকা হাসে আরাধ্য , বিন্দু পরিমাণ রাগ লাগে না তার। শান্ত তার দৃষ্টি,
“তুমি ব্যর্থ তোমার রূপ লুকাতে , ব্যর্থ নিজেকে আমার থেকে আড়াল করতে।
চোখের কোণা বেয়ে টুপ করে একটা পানি গড়িয়ে পড়ে ইফরাহ্র ! তবে চোখ থেকে গাল বেয়ে মাটিতে পড়ার আগেই আঙ্গুল দিয়ে সেই পানি হাতে তুলে নিয়ে জিহ্বা দিয়ে চেটে নেয় আরাধ্য। নজর বুলায়। লালচে মুখ পানে ,
ছায়াস্পর্শ পর্ব ৩
-তোমার ওই লম্বা চুলগুলো যত্ন নাও মেয়ে,
যত্ন নাও ওই হরিণী চোখ জোড়ার।
চেহারায় যেন বিষণ্ণতা না থাকে।
আমার পৃথিবীতে পদার্পণ করবে নিজেকে গুছিয়ে রেখো।
কথাগুলো বলেই কিছুটা পিছিয়ে আসে আরাধ্য , যেতে দেয় তার রক্তকমলিনী কে। অনুমতি পেয়েই ছুটে বেড়িয়ে যায় ইফরাহ্। যুথিও ছুটতে থাকে তার পিছু। আরাধ্য ঠায় দাঁড়িয়ে তার মায়াবিনীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে
