ছায়াস্পর্শ পর্ব ৬

ছায়াস্পর্শ পর্ব ৬
জান্নাত চৌধুরী

প্রায় মধ্যরাতের আগমনে নিশিতে গ্রামের ধানক্ষেতের আড়াল থেকে বারবার ভেসে আসছে শেয়ালের হাঁকডাক। বাড়ির চারপাশ ঘিড়ে নিয়েছে ঝিঁঝিঁ পোকার গান… । পাকা দালানের টিনের চালায় থেকে থেকে টুপ টুপ করে বাড়ি খাচ্ছে গাছের শুকনো পাতা আর ডাল ।
বিছানায় পড়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে চয়ন। রাত গভীরের সাথে সাথে ক্ষত স্থানে ব্যাথাটা বেড়েছে দ্বিগুণ। এদিকে ধুমচে ওঠেছে জ্বর। অবস্থা প্রায় বেহুঁশ। জ্বরের ঘোড়ে বারবার এক নাম জোপছে সে
‘রূপমতী আমার রূপমতী।
নুরজাহান বেগম ছেলের পাশে বসা। একমাত্র ছেলের এই অবস্থায় যেন দিক শূন্য হয়ে পড়েছেন তিনি । তার পাশে বসে ঘুমে ঝিমাচ্ছে তার অল্প বয়সী মেয়ে সামান্তা। মাতব্বর সাহেব আজ বাড়ী ফিরেনি। কোন বিশেষ কাজে তিনি শহরে গিয়েছেন।

—আব্বা ! আব্বা রে ভীষণ কষ্ট হ‌ইতেছে তোর বাপ?
নুরজাহান বেগম ভীষণ কাঁদছেন, ছেলের এমতাবস্থা ভীষণ পুরাচ্ছে তাকে ..
-এই সামান্তা , এই মাইয়া।
ঘুমে ঢুলেই পড়ছিলো সামান্তা। মায়ের গলার আওয়াজ কানে আসতেই ছিটকে ঘুম থেকে ওঠে সে। দুহাতে দুচোখ কচলে তাকায় মায়ের দিকে।
-আম্মা কিছু বলবেন ?
মায়ের মুখ কাঁদো কাঁদো ,সামান্তা এগিয়ে এসে মায়ের গা ঘেঁষে বসে। দুহাতে চেপে ধরে মায়ের হাত, বেশ ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। কাঁপা কাঁপা গলায় আবারো মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে
—আম্মা কিছু লাগবে আপনার। আব্বা তো এখনো আসলো না আম্মা।
নুরজাহান বেগম তাকায় মেয়ের দিকে! চোখে পনি ছলছল‌ করছে ..
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে সামান্তার দিকে তাকিয়ে বলে ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—একখান বাটিতে ক‌ইরা ঠান্ডা পানি আর একখান সুতি কাপড় ছিড়া নিয়া আসো দেখি আম্মা। তোমার বাপজান আইতে ভোর হ‌ইবো। পোলাডা জ্বরে কষ্ট পাইতেছে , তার মধ্যে ঘাড়ে কাইটা গেছে। তুমি জলদি নিয়া আসো‌ সব জিনিস , কাপড় ভিজিয়ে মাথায় দিলে জ্বর কিছুটা ক‌ইমা আসবো। পরে তোমার আব্বায় আইলে নাসির ডাক্তার কে আইতে বলমু।
সামান্তা মায়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে দ্রুত বেড়িয়ে যায় ঘর ছেড়ে। এদিকে কেঁপে কেঁপে উঠছে চয়ন। শরীর তাপে পুড়ে যাচ্ছে… নুরজাহান বেগম বসা ছেড়ে উঠেন। বিছানার পাশেই থেকে একটি নকশি কাঁথা গায়ে তুলে দেন‌ ছেলের।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাটি ভর্তি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে সামান্তা। সাথে এক সুতি কাপড়ের টুকরো। নুরজাহান বেগম দ্রুত এগিয়ে সেগুলো হাতে নেন। জ্বরের ঘোরে বিলাপ বকছে চয়ন। পানিতে কাপড় ভিজিয়ে ছেলের মাথায় রাখেন তিনি। ছেলে তার কষ্ট পাচ্ছে, শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন
—এইযে আব্বা, ভালো হ‌ইয়া যাবো বাপ !
পরপর বেশ কয়েকবার পাল্টাপাল্টি কাপড় ভিজিয়ে চয়নের মাথায় রাখে নুরজাহান বেগম। রাত পেরোতে থাকে পানি পট্টি দেওয়ায় জ্বর বেশ নেমেছে চয়নের। বিলাপ বকাও বন্ধ হয়েছে , ঘুমোচ্ছে আপাতত।
চারদিকে ফরজের আযান পড়ছে ! দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে হয়তো মাতব্বর সাহেব বাড়ি ফিরেছেন। নুরজাহান বেগম একবার তাকায় বাহিরের পানে। কিছু সময় তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেন তার কোলের দিকে। সামান্তা ঘুমাচ্ছে , মেয়ের ঘুমের যেন ব্যঘাত না ঘটে এই ভেবে আলতো হাতে কোল থেকে নামিয়ে চয়নের পাশেই এক বালিশে সামান্তা কে শুইয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায় তিনি।

বার বার টোকা পড়ছে হয়তো আর কিছু দেরি হলে হয়তো এই মানুষটা দরজায় ভেঙে দিবে। নুরজাহান বেগম দ্রুত গিয়ে দরজা খুলেন।
বাহিরে ঝড়ো বাতাস, সাথে হালকা বৃষ্টি। ভেজা কাপড়ে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে ঢুকছে মাতব্বর। পড়নে এক সাদা ফতুয়া সাথে লুঙ্গি। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দরজা চাপিয়ে দেন নুরজাহান বেগম। আলনা থেকে গামছা এনে হাত বাড়িয়ে দেন স্বামীর দিকে। ভেজা শরীরের পানি মুছা হতেই, আবারো এক এক গেঞ্জি আর লুঙ্গি এগিয়ে দেন।
—মাইয়া পোলা খাইয়া ঘুমাইছে ?
পোশাক পরিবর্তন করতে করতে স্ত্রীর দিকে প্রশ্ন করে মাতব্বর। নুরজাহান বেগম উত্তর করেনা। বেশ অভিমান নিয়ে খাটে গিয়ে বসে সে। মাতব্বর তাকায় তার দিকে তবে, বেশি এক আমলে আনে না। পোশাক পরিবর্তন হতেই ভেজা কাপড় মাটিতে রেখেই স্ত্রীর পাশে গিয়া বসে।

—কি হ‌ইছে নুরবানু। তোমার মনে দেখি আষাঢ় মাসের মেঘ জমছে।
স্বামীর আশকারা পেয়েই হু হু করে কেঁদে ওঠে নুরজাহান বেগম। চোখ উপছে পানি পড়ছে। বিরক্ত হন মাতব্বর … “আরে ক‌ইবা তো নাকি হ‌ইছে টা কী এমনে মরা কান্না জুড়ছো কেন ?
—পোলাডার ভীষণ জ্বর হ‌ইছে আপনের কোনো খবর নাই। কী করে আপনের পোলা কোনো খোঁজ রাখেন না। আইজ কোপ খাইয়া বাড়ি আইছে !
মূহুর্তেই ক্ষিপ্ত বাঘের মতো গর্জে ওঠে মাতব্বর।এক হাতে চেপে ধরে স্ত্রী গলা। দাঁত দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন
—শা* লি তোরে পোলা মাইয়া মানুষ করবার দিছি। তোর পোলা মানুষের কোপ খাইয়া আইবো কে রে। আমি শরীফ জোয়াদ্দার এই এলাকা মাতব্বর ,আমার পোলা মানুষের হাতে কোপ খাইয়া বাড়ি ফিরছে। এই এলাকায় আমার মান সম্মান থাকবো রে!
মুখ দিয়ে শব্দ বেড়োচ্ছে না নুরজাহানের বেচারির চোখ লাল হ‌য়ে উঠছে। দুহাতে স্বামী শক্ত পুরুষালী হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সে .. । দম প্রায় যায়, যায় এমন সময় ছিকটে বিছানায় তাকে ছুঁড়ে মারে মাতব্বর।
ছাড়া পেয়েই দুহাতে গলা চেপে ধরে নুরজাহান বেগম। ঘনঘন শ্বাস টানছে এদিকে আবারো ভেসে আসে মাতব্বরের গলা….

—বয়স হ‌ইছে , তয় শরীরের রক্ত কিন্তু এখনো গরম। তোর পোলা মাইয়া সামলায় রাখবি ।নাহলে তিনটারে পাশের করতোয়া নদীতে ভাসানো হ‌ইবো ব‌ইলাম দিলাম।
কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে নুরজাহান বেগম চোখ থেকে পানির ঢল বেয়ে পড়ছে। মাতব্বর ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে নিশ্চয়ই চয়নের ঘরে গিয়েছেন।ছেলেকে যদি কিছূ করে অসুস্থ পোলাডা কিছূসময় হয় ঘুমাইছে। ‘ এসব ভেবেই দ্রুত ছুটে চয়নের ঘরে আসে নুরজাহান
মাতব্বর মাত্র ডুকেছে ছেলের ঘরে। বিছানায় একপাশে চয়ন ঘুমানো। একপাশে বালিশের গুটি শুটি মেরে শুয়ে আছে সামান্তা। মাতব্বর আরো এক পা বিছানার দিকে এগিয়ে নিবে ঠিক এমন সময় পায়ে টান পড়ে তার। চোখের দৃষ্টি নামিয়ে মাটির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে নুরজাহান বেগম।

—আল্লাহর দোহাই লাগে , পোলাডা মাত্র‌ই ঘুমাইছে ওরে কিছু ব‌ইলেন না।
স্বামীর পা ধরে ছেলের জন্য করুন মিনতি করছে নুরজাহান। মাতব্বর একবার স্ত্রী তো একবার বিছানায় ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকায়।
—পা ছাড়ো নুরজাহান। তোমার পোলারে কিছু বলমু না ,ওরে ডাকো শুনবার চাই কে করছে এমন। যেখানে তারে ছোট নবাবের খাস লোক হিসাবে রাখা হ‌ইছে ,এমন সাহস কার যে ছোট নবাবের লোকের গায়ে হাত দিয়াছে !
– সত্যি কন কিছু ক‌ইবেন না !
—ডাকো তারে!
পা ছেড়ে উঠে দাড়ায় নুরজাহান বেগম ,ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে ছেলে কপালে, শরীর ঠান্ডা। বেশ নরম স্বরে ডেকে ওঠে তাকে।
“বাপজান ওঠেন , বাপজান ” হালকা কিছুটা নড়ে ওঠলো চয়ন। ঘুমে কাত হয়ে ঘুরতে যাবে এমন সময় আবরো ডেকে ওঠেন নুরজাহান বেগম।

— বাপজান!
ঘুম আলগা হয়ে আসে ডান কাধে ব্যাথা চাইলে ও হাত তুলতে পারছেনা। বা হাতে কোনো মতে , দুচোখ কচলে নিয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। মাতব্বরের দিকে চোখ পড়তেই দ্রুত ওঠে বসতে চায় সে তবে তা আর হয়না, কাধে টন পড়ে।
নুরজাহান বেগম একবার স্বামী দিকে তাকিয়ে ছেলেকে ওঠে বসতে সাহায্য করে! ধীরে ধীরে উঠে বসে চয়ন , বিছানার বেশ কাছেই এগিয়ে আসে মাতব্বর। নুরজাহান বেগম তখনো দাড়ানো মাতব্বর সাহেব বেশ কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করে সকলের অবস্থা …

—মাইয়ারে নিয়া ঘরে যাও নুরজাহান ।
শুষ্ক ঢোক গিলে এক ছেলের দিকে তাকিয়ে ঘুমন্ত সামান্তার কাছে আসে নুরজাহান বেগম। পাঁজাকোলা করে বিছানা ছেড়ে ঘুমন্ত মেয়েকে তুলে নিয়ে বেড়িয়ে যান ঘর ছেড়ে। চয়ন আড়চোখে একবার তাকায় মায়ের যাওয়ার পানে। পরক্ষণেই চোখ ঘুরিয়ে আনে বাবার দিকে ।
মাতব্বর তখনো তাকানো‌ তার দিকে , কিছুসময় চয়নের দিকে তাকিয়ে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন তিনি।
– আ আব্বা কিছু বলবেন ?
চয়নের কন্ঠ কাঁপছে। গলা জড়িয়ে আসছে মাতব্বর ধপ করে বসে পড়ে ছেলের পাশে, চয়ন বসা থেকেই পিছিয়ে যা কিছুটা। মাতব্বর হেয়ালি না করেই প্রশ্ন করে
-কি করে হলো এমন ?
— আসলে আব্বা !

তোমারে ছোট নাবারে খাস লোক বানাইয়া রাখা হয়েছে। গ্রামে তোমার এক আলাদা সম্মান আছে। এই জোয়াদ্দার পরিবারের সম্মান আছে। এই গ্রামের কার এত টা কলিজা হ‌ইছে যে তোমার গায়ে হাত দিছে। কাল‌ই তার বিচার হ‌ইবো , চেয়ারম্যান সাহেব রে জানানো হ‌ইবো সব।
-আব্বা শান্ত হন আমারে কেউ মারে নাই।
ভ্রু জোড়া কুঁচকে নেয় মাতব্বর। সন্দিহান চোখে তাকায় ছেলের দিকে। চয়ন এক শুষ্ক ঢোক গিলে , ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বসে বাবার কাছে। কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বলে …
—আবা আমি নিকা করতে চাই !
বেশ আবাক হয় মাতব্বর, কিছু সময় তাকিয়ে থাকে চয়নের মুখের পানে … নিজেকে শান্ত রেখেই প্রশ্ন করেন তিনি
— কারে নিকা করবার চাও।
চয়ন চোখ কেমন লাল হতে থাকে একবার তাকায় হাতের ক্ষত স্থানের দিকে তা যেন এড়াতে পারে না মাতব্বরের চোখ।

ইসমাইল চাচার মাই…
হঠাৎ গালের উপর এক শক্ত হাতের থাপ্পর পড়তেই থেমে যায় চয়ন। উঠে দাড়ায় মাতব্বর দু’চোখে যেন আগুন ঝড়ছে তার। রাগান্বিত চোখেই চয়নের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন।
-“মরার ভীষণ শখ তাইনা ? পুরো এলাকা যেখানে জানে ওই মাইয়া গ্রামের অভিশাপ তার দিকে তাকালেও যেখানে চোখ উপরে নেওয়া হয় ,সেখানে তুমি কিনা নিকা করতে চাইছো।
কিছুটা থেমে যায় মাতব্বর , হালকা দম টেনে আবারো বলে।
-এক্ষত কি তবে ওই মাইয়ার হাতের ?
নিশ্চুপ থাকে চয়ন। মাথায় হাত দিয়া আবারো ধপ করে বিছানায় বসে পড়েন নি তিনি ” হে আল্লাহ এই কোন বিপদে ফেলছো তুমি ?

আব্বা আপনে এমন করছেন কেন ইফরাহ্ নিকা করবার চায় না ছোট নবাবরে।
—একদম চুপ ওই মাইয়ার নাম যেন তোর মুখে আর শুনি। আজ‌ই এই গ্রাম ছাইড়া রানীশংকৈল তোর খালার বাড়ি চ‌ইলা যাবি তুই …. ছোট নবাবের নিকা না হ‌ওয়া অবদ্ধি যেন ডাঙ্গাপাড়ায় পা না পড়ে তোর। সকাল হ‌ইলেই আমি যামু ইসমাইলের বাড়ি ওই মাইয়ার কাছে মাফ নিয়া লাগবো। কোনো কারণে যদি এই কথা ছোট নাবাবের কনে যায়’ ” আমাদের লাশ টাও কেউ খুঁইজা পাবো না দাফনের জন্য ।
কথাগুলো শেষ করেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় মাতব্বর।তবে ফেলে যায় চয়নের রাগান্বিত দুচোখ ….

সকাল ৮ টা আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় বসে ,বসেই এখনো ঝিমাচ্ছে ইফরাহ্। শরীলটা কেমন ম্যাচ ম্যাচ করছে তার বিছানা ছেড়ে উঠতে নিয়ে ও এখনো সেখানেই বসা সে । রাজ্যের ঘুম গুলো কি সব তখর চোখেই এসে পড়েছে। রাইসা কখন পাশ ছেড়ে উঠে গিয়েছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। দুই হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে তখনো ঘুমোচ্ছে সে।
হঠাৎ গায়ে পড়ে ঠান্ডা পানির ঝাপটা ইফরাহ্ হাটু থেকে মাথা তুলে। গা যেন শিরশির করে উঠছে তার। ঘরের পশ্চিমে টিন কেটে বানানো হয়েছে ছোট এক জানালা , তার পাল্লাটা মেলেনো। শীতল বাতাস ঢুকছে ঘরে। কেমন যেন শীত শীত ভাব , এর মাঝেই এই ঠান্ডা পানি।
ইফরাহ্ পিটপিট চোখে করে তাকায় সামনের দিকে। রাইসা দাড়ানো। ঘরে থাকা ছোট এক আয়নার মুখ দেখে চুলের পানি ঝাড়ছে সে। ইফরাহ্ তন্দ্রা লেগে যায় ,” এই মেয়ের কি ঠান্ডা লাগে না , এতো সকালে গোসল বাপরে বাপ ।”
নিজে নিজে কথাগুলো বলছিলো সে , এদিকে আয়নায় পড়া ইফরাহ্‌র প্রতিবিম্বে একা একা কথা বলার দৃশ্য দেখে মুসকি হাসে রাইসা। ভেজা চুল গুলো ঝাড়া শেষে চিরনী হাতে এগিয়ে আসে বিছানার কাছে‌…

—এই আপা
নাজানি কোন ভাবনায় ডুবে ছিলো ইফরাহ্। রাইসা হাত ধরে ঝাকি দিতেই চমকে ওঠেছে।
—কি কিছু বললি ?
রাইসা নাক কুঁচকায়, আপার সাথে দুষ্টুমিতে সে বেশ পাকা। হাতে থাকা চিরনী চুলে লাগিয়ে নেয়
-যাহ বাবা এত সময় থেকে এতো কিছু বললাম তার একখান কথাও তুই শুনোস নাই আপা। হায় মোর খোদা …
আহাজারি করতে থাকেই রাইসা। ইফরাহ্ দ্রুত গিয়ে মুখ চিপে ধরে তার ” প্লিজ বোন এমন করিস না।
আম্মা উঠেছে , বাহিরে উঠোনে রান্নার চুলা ,হয়তো সেখান থেকে কানে আসছে ঠুকঠাক শব্দ এসময় রাইসার আহাজারি বাইরে বেড়ানো মানেই শনি কে সাদরে ডেকে আনা।
রাঈসা টুক করে এক কামড় বসিয়ে দেয় ইফরাহ্ হাতে তালুতে।
“আহ মাগো’ কথাটুকু বলেই হাতে ফুঁ দিতে থাকে ইফরাহ্। এদিকে মুসকি হাসছে রাইসা।
-জানোস আপা কাল রাইতে আব্বারে বলছি তুই বিয়াতে রাজি।

আব্বায় খু…
কথার মাঝেই রাইসার খেয়াল হয় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে ইফরাহ্। সেও দ্রুত কদমে উঠে দাড়ায় তার সাথে। ইফরাহ্ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় জানালার কাছে। জানালার পার্ট আরো কিছুটা খুলে দিয়ে খিল দিয়ে দেয় তাতে। , ভোরে বৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতি আজ ভীষণ শান্ত ,শীতল হাওয়া এসে বাড়ি খাচ্ছে গায়ে। ইফরাহ্দের বাড়ির এইদিকটায় বেশ কিছুটা দূরে এক ছোটা ডোবা। কত কত লাল শাপলা ফুটেছে তাতে। সে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে তার পানে।
রাইসা এগিয়ে এসে ভেজা চুলেই মাথা এলিয়ে দেয় বোনের কাঁধে। কেন জানি আপা তার পরমানুষ হবে ভেবেই মনের কোণে মেঘ জমেছে।

-আম্মায় মেলা খুশি হ‌ইছে, তুই বিয়া করতে রাজি তাই। আইচ্ছা আপা “মীর বাড়ি”গিয়া আমারে ভুইলা যাবি ?
ছোট এইটুকু এক মনে বোনকে নিয়ে কত প্রশ্ন তার। ইফরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তবে কোনো উত্তর করে না। দৃষ্টি দিয়ে রাখে বাহিরের চাষ জমির দিকে, পুরো সবুজের সমারোহ।‌
ইফরাহ্ তাকিয়ে থাকে এই যে চাষ জমি! দৃষ্টি সীমানায় যা রয়েছে সব কিছুই তো মীর বাড়ির দখলে। চেয়ারম্যান চাঁচা বেশ দায়ালু কিনা অল্প কড়ে গ্রামের লোকজনদের চাষাবাদের জন্য দিয়েছেন সব জমি। তাদেরও কি কম দিয়েছেন নাকি।

এলাকার সবাই যেন চাচার নামে , দুঢোক পানি বেশি পান করে। গতবার নির্বাচনের আগেই তো এলাকায় কত টিউবওয়েল বসিয়েছেন তিনি। সেবার “হাসেম বনিকের” থেকে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে চাচা , সব যেন তার পাওনা। তবে পরবর্তীতে গুঞ্জন উঠেছিল , ছোট নবাব নাকি ক্ষমতার জোড়ে ছেলেপুলেদের দিয়ে ভোট চুরি করেছিলো। তবে তা তো আর প্রমাণিত নয়! এবারো হয়তো বিপুল ভোটে সে জয়ী হবে

এলাকায় চেয়ারম্যান চাচার যত বেশি নাম তার ছেলের ঠিক ততটাই বদনাম, তাতে অবশ্য চেয়ারম্যান চাচা কোনো কালেই মাথা ঘামায় নি। শুনেছিলাম মাঝের কয়েক বছর নাকি সে যোগ দিয়েছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তবে তার ভাত ও তার পেটে স্থানীয় হয়নি ,চাকরির গুল্লি মেরে আবারো ফিরেছে গ্রামে। কেনোই বা চাকরি গিয়েছে, আবার কেনোই বা ফিরেছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে এমন সাদ্ধী কার গ্রামে। এলাকায় বেশ বড় এক গ্যাং রয়েছে তার, ওই যে কাঁচা রাস্তায় প্রথম মোড়ের মাথায় এক বিশাল বটগাছ ওইখানেই তার আসর বসে। এলাকার যত বখাটে আছে সবার লিডার সে‌।

শুধুই অকাজ করে এমন কিন্তু নয় মাঝে মাঝে ভীষণ ভালো কাজ ও করে মানুষ টা। তবে ওই যে বলেনা যারে পছন্দ না তার সব চলন বাকা ইফরাহ্‌র কাছে আরাধ্য ঠিক তেমনি । তার করা ভালো কাজ গুলো সে কখনোই ধরে না।
এই আপা …..আপা
ভাবনায় ছেদ পড়েছে রাইসার ডাকে। বাহির হতেও কেমন শোরগোল ভেসে আসছে। হয়তো কেউ এসেছে , ইফরাহ্ প্রশ্ন চাহনিতে তাকায় রাইসার চোখে।
রাইসা বোন কে ছেড়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। ইফরাহ্ তখনো দাড়ানো জানালার কাছে, আম্মার গলা ভেসে আসছে …
-তোমার মাইয়া যখন নিজে রাজি তুমি কেন অমত করছো ?
গলায় থাকা সাদা রঙের ওড়না তুলে মাথায় দেয় ইফরাহ্ সামনে আসা ছোট ছোট চুলগুলো ঠেলে ওড়না ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে হেঁটে বাহিরের দিকে আসে সে।
মাতব্বর চাচা এসেছেন , বারান্দায় অতি পুরনো কাঠের এক বেঞ্চ বসতে দেওয়া হয়েছে। সামনে বাটিতে মুড়ি রাখা হয়তো আম্মা খেতে দিয়েছেন। এক মুঠো মুড়ি মুখে ঢুকিয়ে চিবোতে চিবোতে তিনি বলেন।
—শোন ইসমাইল দ্বিমত দিয়া লাভ নাই। ছোট নবারের নজর হ‌ইতে তোমার মাইয়ার মুক্তি নাই। মাইয়া রাজি না হ‌ইলেও রাজি করাও…

কাঠের দরজা পেরিয়ে , বাহিরে এসে দাঁড়ায় ইফরাহ্ মাথা নিচু করে ঠিক একদম ইসমাইল আর মাতব্বর মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায় সে। দৃষ্টি তার মাটির দিকে তাকানো
-আমি ছোট নবাব রে নিকা করতে রাজি আব্বা ।
“আলহামদুলিল্লাহ ” উঠান থেকে ভেসে আসে জহুরা বেগমের গলা ভাতের মার গালাচ্ছিলেন তিনি। ইফরাহ্‌র জবাবে হাতের কাজ ফেলেই ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে মুখে টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে নেন।
“শুকরিয়া সোনা” এইতো ভালো মাইয়া আমার। দেখিস রাজরানী হবি তুই।
মলিন হাসে ইফরাহ্। ইসমাইল শেখ একদম নিশ্চুপ বসা আরো এক মুঠো মুড়ি মুখে ঢুকিয়ে কাঁচা মরিচে এক কামড় দেয় মাতব্বর।
এদিকে ইফরাহ্ কে ছেড়ে জহুরা বেগম খুশিতে বলেন
“আগামী এক সপ্তাহের মাঝেই তাহলে বিয়ার আয়োজন করা কি বলেন মাতব্বর সাহেব। ”
মুখের অবশিষ্ট মুড়ি শেষ করেই , একগ্লাস পানি পুরোটা শেষ করেন তিনি।

—তোমরা যেমনটা চাও !
—এক সপ্তাহ না আইজ হ‌ইবো বিয়া , আপনারা বিয়ার আয়োজন করুন!
মাতব্বরের কথা শেষ হ‌ওয়ার আগেই , ইফরাহ্ বলা কথা যেন উপস্থিত সকলের মাঝেই বাজ পড়ার মতো। জহুরা বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে তাকায় তার দিকে দুকাধে ঝাকি দিয়ে বলেন
-এই মাইয়া কি বলস এইসব , ? আইজকা কেমনে হ‌ইবো বিয়া।
ইফরাহ্ উত্তর করে না মায়ের কথার। সে জহুরা বেগমের থেকে নজর সরিয়ে মাতব্বরের দিকে তাকায় ” চাচা আপনি গিয়া ছোট নবাব রে বলেন বিয়া আইজ হ‌ইবো।
মাতব্বরের ঠিক রবোটের মতো ডানে বামে মাথা নারায়। আর কোনো কথা বাড়ায় না ইফরাহ্ কারো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে সে।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ৫

ফতুয়ার পকেটে থাকা পানের খিলি মুখে ঢুকিয়ে চিবোতে থাকেন তিনি।
আমি তাইলে এখন আসি ইসমাইলের, খবরটা গিয়া চেয়ারম্যান বাড়ি পৌঁছায় দেই। তোমরা প্রস্তুত হ‌ও

ছায়াস্পর্শ পর্ব ৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here