ছায়াস্পর্শ পর্ব ৭
জান্নাত চৌধুরী
বেলা ১২ টা …
সকাল বেলায় শীত, শীত ছিলো তবে বেলা বাড়তেই , বাতাসের গতি যেন দক্ষিণ দিক থেকে বইতে শুরু করেছে।
মোবাইলে বাজতে থাকা এলার্মের শব্দে নাক কুঁচকে নেয় আরাধ্য। একহাত হাতরে মোবাইল খুঁজে কোনোমতে বন্ধ করে সেই শব্দ। উল্টো ঘুরে মাথার উপরে এক বালিশ রাখে , মাথা তার নিচে রেখেই আবারো ঘুমে ডুব দিতে চায় সে। তবে তা আর হলো কই …
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবারো বেজে উঠল তেচড়া এলার্ম। এলার্ম তো নয় যেন পুলিশের গাড়ির সাইরেন, পুরো ঘর কাঁপিয়ে তুলছে ওটা। রাগে রিরি করছে আরাধ্যের শরীর , মাথা হতে বালিশ সরিয়ে বিছানায় অযন্তে পড়ে থাকা ফোনে দিকে তাকায় সে “এখনো কাপছে।” কোনো কথা ছাড়াই এক হাতে তুলে ঠিক দেয়াল বরাবর ছুড়ে ফেলে ওটাকে। মূহুর্তেই যেন দুই টুকরো হয়ে যায় ফোন ..
-এইসব ফালতু যান্ত্রিক জিনিস কোন ন*টির ছেলে বানিয়েছে রে। পুরো ডিস্টার্ব ।
ঘুম আর হলো কই ! ঝিমাতে, ঝিমাতে ঘুম ছেড়ে ওঠে বসে সে। সময় কত তা দেখার আর বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই তার
বিছানায় একপাশে কাঠের পাশিতে রাখা তোয়ালে তুলে নেয় কাধে। দুহাতে দুপাশ হতে মাথায় দুটো বাড়ি মারে।
আহ !
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হালকা ব্যথা অনুভব হলেও পরমুহূর্তেই ঘুম যেন ঘরের জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। আরাধ্য উঠে দাড়ায় পা বাড়ায় ওয়াসরুমে দিকে….!!
লম্বা সময় গোসল দিয়ে বেড়িয়ে আসে সে , ঘরের ড্রেসিং এর সামনে এসে তোয়ালে দিয়ে চুল গুলো মুছতে থাকে। খালি গায়ে ফোটা ফোটা পানি বুক বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে পড়ছে । চুল গুলো মুছা হতেই ভেজা তোয়ালে ছুড়ে মারে বিছানার উপর আরাধ্য। এলোমেলো চুল গুলো দু-একবার হাত দিয়ে বেক ব্রাশ করে নিয়ে হাতে তুলে নেয় পছন্দের পারফিউম । ওটাকে গায়ে কয়েক বার স্প্রে করেই রেখে দেয়, এবার এগিয়ে যায় কাবাডের দিকে।
পছন্দসই ঘি রঙের এক শার্ট হাতরে বের করে জড়িয়ে নেয় গায়ে। ট্রাউজারের সাথে শার্ট , খুব বাজে এক কম্বিনেশন। তাতে আরাধ্যের কি? সেকি কারো ধার ধারে নাকি ,
পুরো তৈরি হাওয়া শেষ ! সে আর দেরি না করে দ্রুত বেড়িয়ে যায় ঘর ছেড়ে। রাতে মা* ল চড়ে গিয়েছিলো ঘরে কিভাবে পৌছে গেছে, এখন সে কথাও মনে নেই তার। গান গাইছে সে আর হাঁটছে …
আমার ভাঙ্গা ঘরে ,ভাঙ্গা চালা
ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে।
অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে
হাত বাড়াইয়া ডাকে,
হাত ইশারায় ডাকে ,
কিন্তু মুখে বলে না ।।
আমার কাছে আইলে বন্ধু
আমারে পাইবা না।
সিঁড়ির কাছে আসতেই পথ আঁটকে দেয় অরুনিমা।
গান থেমে যায় , আরাধ্যে চোখ দুটো স্থির হয় সামনে দাঁড়ানো তার মা জননীর উপরে! মুসকি হাসে সে ….
আটপৌরে শাড়ি পরিহিত অরুনিমা মাথায় আঁচল টেনে ছেলে সামনে ঠায় দাড়ানো , বয়স হলেও চেহারায় নেই তার কোনো ছাপ। গায়ের রংটাও বেশ ফর্সা। ভারি দাম্ভিক এক মহিলা তিনি, আঁচলে ঝুলছে রুপার ব্যাচ ঝুলানো চাবির রিং। আরাধ্য এগিয়ে আসে একদম মায়ের কাছাকাছি। ডান হাতে মাকে ঘুড়িয়ে সিঁড়ি দিকে মুখ করার ,অরুনিমা বাধ্য হয়ে ঘুরে সেদিকে। আরাধ্য হাঁটছে মাকে ধরে , এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে নামছে তারা
“শুনলাম গ্রামের কোন মাইয়ার পিরিতে ভীষণ মজেছে আমার ছেলে , তারে নাকি নিকা করবার পায়তারা করছে।
সিঁড়ির শেষ ধাপ মাড়িয়ে আরাধ্যের সাথেই নিচে নামে অরুনিমা। মায়ের দিক ঘুরে কপালে এক আলতো ভালোবাসার পরশ ছুঁইয়ে দেয় সে।
—কিছুটা ঠিক শুনেছেন তবে , আপনার শুনাতে মেল্লা গোলমাল আছে মা জননী।
– কি ভুল ?
— বিয়ের পায়তারা নয় আম্মা , বিয়ে করবোই আগামী সাত দিনের মধ্যে।
-সাতদিন নয় ছোট নবাব , বিয়া আইজ হবে।
কারো কন্ঠে দুজনের কথার ব্যঘাত ঘটে ! আরাধ্য তাকায় সদর দরজার দিকে অরুনিমাও তার ব্যতিক্রম নয়। মাতব্বর এগিয়ে আসছে মুখে সে চিরোচেনা এক বেক্কল হাসি। আরাধ্য কে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় অরুনিমা।
“মাতব্বর সাহেব আপনি ?
-আগ্গে গিন্নি মা , ছোট নবাবের বিয়া খবর নিয়া আইছি।
অন্দরমহলে শোরগোল শুনেই নিচে আসছিলো মানহা হঠাৎ মাঝ সিঁড়িতেই থেমে যায় তার পা।
-মাইয়া রাজি হইছে ছোট নবাব” নিকা করবার চায় আপনারে ?
ঠোট বাঁকিয়ে কিছুটা হাসে আরাধ্য , এগিয়ে গিয়ে গা এলিয়ে বসে ঘরের এক কোনে থাকা বেতের সোফায়।
—তা আর দেরি কিসের ? আয়োজন শুরু করুন !
-একটা সমস্যা আছে ছোট নবাব !
চট করে সোজা হয়ে বসে আরাধ্য , চোখ দুটো ছোট ছোট করে সন্দিহান চোখে তাকায় মাতব্বরের দিকে। ” কিহ সমস্যা ?
-মাইয়া কইছে আজ রাইতেই নিকা হইবো।
আরাধ্য চমকায় দ্রুত হাত রাখে নিজের বুকে, উহহহ… বুকে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তার। দুহাতে বুক চেপে বড় বড় নিঃশ্বাস টানছে সে , অরুনিমা এগিয়ে আসতে চায় ছেলের দিকে তবে তার আগেই হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় আরাধ্য।
মানহা দাড়ানো সিঁড়ির উপরে ,চোখে পানি চিকচিক করছে তার। প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয় জমছে মনে। শক্তি হীন হয়ে এক পা এক পা করে নামছে সে সিঁড়ি দিয়ে।
—কি বললেন চাচা ছেমরি আজকাই বিয়া করবো ?
আরাধ্যের প্রশ্নে শুষ্ক ঢোক গিলে মাতব্বর। কোনোমতে ডানে বামে মা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝায় ।
-থাক থাক আর বলিয়েন না আপতত আমার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে, এতো শক নিতে পারবো না।
—”তাহলে ছোট নবাব বিয়ে টা ?”
বুক থেকে হাত সরিয়ে আঙ্গুল কামড়ে ভাব নিয়ে বেশ কিছু সময় পড়ে থাকে আরাধ্য থাকে। অরুনিমা ছেলে ভাব ভঙ্গিতে বেশ বিরক্ত হয়। তবুও যেন দাঁতে দাঁত কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মানহা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় অরুনিমার পাশে সেও হয়তো আরাধ্যের উত্তরের অপেক্ষায়। বেশ অনেক সময় গড়ায় এখনো নিশ্চুপ আরাধ্য, থেকে-থেকে হিসেব কষছে হাতের মাঝে।
হবে , হবে !
সকলের যখন ধৈর্য্যের সীমানা পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে , ঠিক তখনি চেঁচিয়ে ওঠে আরাধ্য। ভ্রুতে হালকা ভাজ ফেলে ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অরুনিমা … ” কি হবে ”
“এই বউ দিয়েই আমার উন্নতি হবে মা , দেখছো বউ কত হিসাবি স্বামীর খরচ বাঁচাতে আজকেই বিয়ে করতে রাজি সে !
অরুনিমা মুখের কথা গলা অবধি এসে আটকে যায়। কত কিছুই বলতে চায় সে , তবে আরাধ্য তার কথায় থুরি পাত্তা দিবে ফোস করে এক নিঃশ্বাস টেনে বলে , ” এখন কি চাইছো
—বিয়া হবে আম্মা ,আমার পাখির কথা মতো আজকেই বিয়া হবে।
– ভেবে বলছো ?”
—একদম ! প্রস্তুতি নেন আপনারা বউমা আসবে ঘরে , আমার রানী আসছে। তার বিন্দুমাত্র অযন্ত এই
“ফারহান ফাইয়াজ আরাধ্য” মেনে নিবে না আম্মা।
-মাতব্বর চাচা তরজর শুরু করুন , পুরো এলাকায় খবর দিন।
মাতব্বর কথা বাড়ায় না মাথা নাড়িয়ে কর্ণিশ জানিয়ে স্থান ত্যাগ করেন তিনি।
গভীর নিস্তব্ধতা যেন শ্বাস ফেলছে হাসপাতালের করিডোরে ।
মেইন রোড থেকে বেশ কিছুটা দুরে হাসপাতাল হওয়ায় গাড়ির শব্দ তেমন একটা কানে বাজে না। ৩০২ নাম্বারে কেবিনে শুয়ে আছে মেঘা। আজ প্রায় দুদিন হয় ভর্তি করা হয়েছে তাকে। পরিবার বলতে, বাপ -মা আর ছোট ভাই। শরীর তার পুরোপুরি দুর্বল, মুখে শব্দ নেই। তবে চোখে কি এক অদ্ভুত আতঙ্ক। চোখ বন্ধ করতে চায় না সে। বারবার চমকে উঠছে।
তার দায়িত্বে পড়েছে ডাক্তার লুবনার উপর , শহর থেকে এই হাসপাতালে বেশি হয়নি। তার দায়িত্বেই চিকিৎসা হচ্ছে মেঘার। লুবনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে গাইনি বিভাগে পড়ালেখা করছে। এইতো কিছুদিন আগেই ইন্টার্নশিপ শেষ হয়েছে মেয়েটার। তারপরেই এই হাসপাতাল জয়েন্ট, অতি তুখর বুদ্ধিমত্তার এক নারী।
কেভিনে ঢুকেই মেঘার মেডিকেল রিপোর্ট খুলে দেখে সে।
ব্লাড প্রেশার অস্বাভাবিক কম
পালস হার অনিয়মিত
চোখের পুতলায় প্রসারিত ভীতি
লুবনা রিপোর্ট থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় মেঘার দিকে শরীরে জোরালো আঘাতের দাগ, ঘাড়ের কাছটায় বেশ কয়েকটা কামড়ের দাগ ,এক পাশে স্যালাইন ঝুলছে। ঠোঁটে বেশ কিছু জায়গা কালো হয়ে আছে। চোখের নিচে গাঢ় কালশিটে দাগ , ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে।
লুবনার দুচোখ বুজে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে তোলে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে মেঘার সামনে বসে সে। মেঘার চোখে কোণে হালকা পানি , এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উপরের ফ্যান ঘোরা দেখছে সে। লুবনা কিছু বলতে নিবে হঠাৎ
হঠাৎ কেবিনে প্রবেশ করে আসলাম মোল্লা।পড়নে পুলিশের ইউনিফর্ম তার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল।সায়েম আর বাদল, দুজনই অতিরিক্ত সতর্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে চারপাশে।
আসলাম গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
আসতে পারি ডাক্তার ?
লুবনা বেশ বিরক্ত হয়, ভেতরে প্রবেশ করে তারপর পারমিশন চাইছে হাহ্ । তবে নিজেকে শান্ত রেখেই সৌজন্যের হাসি দিয়ে বলে
“জি অফিসার আসুন ,- কথাটুকু বলেই ভিকটিমের স্টেবিলিটি চেক করে সে । আসলাম মোল্লা কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে বেশ চিন্তিত কন্ঠে
—“ডক্টর, এই মেয়েটির কী অবস্থা?”
লুবনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। ঠোঁট শক্ত করে গলা নামিয়ে বললেন—
“শারীরিকভাবে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত। মাথার পেছনে ভারী কিছু দিয়ে মারা হয়েছে। তবে এখন স্টেবিল আছে। ব্রেইন ড্যামেজের সম্ভাবনা আপাতত নেই।”
আসলাম মোল্লা মুখ কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ডাক্তারের হাত থেকে ফাইলটা নিতে, নিতে বলল—
“অপরাধির আলামত কিছু পেয়েছেন?”
আঘাতের ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, কোনো একসময় আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল মেয়েটা। আর আমাদের কাজ হলো , রোগীর চিকিৎসা করা তদন্ত করা নয় নিশ্চয়ই , তবুও বলে রাখা ভালো মেয়েটা শরীরে প্রবেশকৃত বীর্য একাধিক পুরুষের। মানে তাকে ঘন ধর্ষণ করা হয়েছে।
-কি বলেন ?
-রিপোর্টে তো তাই এসেছে।
—ডাঃ আপনি কিছু মনে না করলে আমি একান্তে কিছু সময় ভিকটিমের সাথে কথা বলতে চাইছি!
লুবনা কথা বাড়ায় নাহ। আড়চোখে একবার মেঘার দিকে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করেন তিনি। আসলাম মোল্লা হাফ ছেড়ে সামনের চেয়ারে গিয়ে বসেন! বেশ ভালো ভাবেই পর্যবেক্ষণ করেন তিনি মেয়েটাকে। হাতে রানিং স্যালাইন , আশেপাশে কোনো কিছুতেই যেন খেয়াল নেই তার ।
এই মেয়ে ?
তিনি গম্ভীর কন্ঠে ডাকেন মেঘাকে। তবে সেই ডাক আদেও মেয়েটির কানে গিয়েছে কিনা কে জানে বেশ কিছু সময় যায়। মেঘার তরফ হতে কোনো উত্তর আসেনা। আসলাম মোল্লা হালকা কিছুটা ঝুঁকে এসে আবারো ডাকে ।
এই মেয়ে আমাকে শুনছো তুমি ?
ঘাড়টা কিছুটা কাত করে মেঘা , আসলামের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে সে , কিছুটা পিছিয়ে আসে আসলাম।
-তুমি কি বলবে সেদিন রাতে কি হয়েছিল তোমার সাথে , কারা কারা ছিলো।
” ওর কিছু বলার নাই সাহেব , আমাগো কারো ব্যপারে কোনো অভিযোগ নাই।
দরজার কাছ হতে ভেসে আসছে শব্দ , আসলাম মোল্লা ঘুরে তাকায় দরজার দিকে। একজন বয়স্ক মহিলা মাথায় ঘোমটা টেনে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকেছেন । তার পাশেই এক বয়স্ক লোক পড়নে সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। তাদের দুজনের মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে নয় কি দশ বছরের এক ছেলে।
বয়স্ক লোকটি ছোট ছেলেটির হাত ধরে এগিয়ে আসছে বেডে কাছে।
আসলাম মোল্লা আন্দাজ করে এরাই মেয়েটার পরিবারের লোক , তবুও সে নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করে … ” কারা আপনারা ?
আমি মামুন আকন্দ , ওইডা আমার বউ জাহানারা । আর এই যে এইডা আমার পোলা জিহাদ আকন্দ আর ওইযে বিছানায় শুইয়ে আছে , ওইডা আমার মাইয়া।
কথাগুলো বলেই শুষ্ক ঢোক গিলে মামুন আকন্দ। কিছু সময় নিস্তব্ধ থেকে আবারো বলে ,
-“আমাগো কোনো অভিযোগ নাই সাহেব , আমার মাইয়া বাইচা আছে এই অনেক। আমাগো কোনো বিচারের দরকার নাই ! সব আমাগো ভাগ্য সাহেব সব ভাগ্য ।
আসলাম মোল্লা মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও মুখে তার বিহঃপ্রকাশ একদম নেই তিনি কন্ঠ গম্ভীর রেখে আরো কড়া ভাবে প্রশ্ন করেন।
“আপনারা কি ভয় পাচ্ছেন ? ”
– না নাহ সাহেব ভয় পাইতাম কে রে ?
“আপনাদের কি কেউ ভয় দেখিয়েছে ? আর দেখালেও সে কে বলুন আমার ব্যবস্থা নিবো!
মামুন আকন্দ এবারেও সময় নেয় , বেশ খানিক সময় তাকিয়ে থাকে মেয়ের নিস্তেজ মুখের পানে। এদিকে পাশে গুটিসুটি হয়ে আছেন তার স্ত্রী ! মেয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে ভেজা ভেজা কন্ঠে তিনি লোকটি বলেন…
– না সাহেব কেউ ভয় দেখায় নাই ! আমার মাইয়ার চরিত্রে দোষ ছিলো। তাই এমন হইছে আমরা কোনো কেস করবার চাইনা সাহেব।
—” যা বলছেন ভেবে বলছেন আপনারা , পরবর্তীতে আবার কোনো ঝামেলা করবেন না তোহ ! ”
– না সাহেব !
আসলাম মোল্লা আর কোথা বাড়ায় না। মেঘার পরিবারের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান তিনি।
এদিকে আরো দুই কেবিনের রাউন্ড দিয়ে, মেঘার কেবিন ক্রস করছিলেন লুবনা হঠাৎ পুলিশ আর মেঘার পরিবারের কথপোকথনে থেমে গিয়েছিলো সে । আসলাম মোল্লা বিদায় নিতেই কেবিনে প্রবেশ করলেন তিনি।
ছোট বাচ্চা ছেলেটি , বাবার লোকটির হাত ছেড়ে দৌড়ে বেডের একদম কাছে এসে দাড়ায় ,..
-আপা ও আপা ! তোর কি ভীষণ অসুখ করছে আপা ?
চোখের কোণ বেয়ে পানি পড়ে মামুন আকন্দের । সাথে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে মেঘার মা। লুবনা এসে দাঁড়ায় ভঙ্গুর মানুষ গুলো কাছাকাছি ।
” —আপনাদের কি উচিত ছিলোনা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। আপনার মেয়ের সম্মান হানি হয়েছে তার বিচার চাওয়া। তা না করে আপনারা কিনা ..
-কার কাছে বিচার দিমু ওই যে পুলিশ দেখছেন, ওরা হইতেছে বড়লোক গো জন্যে। আমাগো মতো গরিবের জন্য এই সমাজে আইন নাই। আর কইলেন সম্মানের কথা তাই না, গরিবের তো কোনো ইজ্জত নাই।
কেঁদে কেঁদে কথা বলছেন মামুন আকন্দ। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে লুবনা। কিছু সময় স্থির দাঁড়িয়ে থেকে , ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় মেঘার মায়ের কাছে… মেয়ের বয়সী এক মেয়েকে পেয়ে ডুকড়ে কেঁদে ওঠে জাহানারা।
-আম্মাগো আমার মাইয়ারে সুস্থ কইরা দেও আম্মা। ওই জানোয়ার গুলো ছিরে খাইছে আমার মাইয়ারে! আল্লাহ গজব ফালায় না কে অমানুষ গুলো উপর।
শক্ত ধাঁচের লুবনাও যেন এই আহাজারিতে ভেঙে পড়তে চাইছে। গলা ধরে আসছে , নিজেকে শান্ত করে হাত রাখে অসহায় মায়ের মাথায়।
-শান্ত হন চাচি ভেঙে পড়লে চলবে না ! আপনারা ভেঙে পড়লে মেঘার কি হবে বলেন !
লুবনাকে আরো শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে জাহানারা। ভাঙ্গা গলায় বলে…
-“আমার মাইয়ার ভীষণ কষ্ট হইছে তাই না আম্মা। আমার সহজ সরল মাইয়ার এতো সর্বনাশ কেন হইলো আম্মা।”
নিশ্চুপ থাকে লুবনা কিছু বলার মতো কথা খুজে পাচ্ছেনা। বেশগাঢ় এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অন্তত হত।
গোধূলি বেলা। আকাশে লালচে আভা মেখে আছে, সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে সোনালি এক কোমল আলো, যেন প্রকৃতি নিজেই নিঃশ্বাস নিয়ে ক্লান্ত দুপুরটাকে বিদায় জানাচ্ছে। হাওয়ায় একটা থমথমে নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে পাখির ডাকে তা খানিকটা নড়ে ওঠে।
গ্রামের মাটির পথ ধুলায় মোড়ানো, তার ওপর আলোর ছায়া পড়ে তৈরি করেছে এক স্বপ্নময় দিগন্ত।
বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বসানো হয়েছে ইফরাহ্কে। পড়নে কাঁচা হলুদের কোমল রঙের শাড়ি, লম্বা চুল খোপা করা, মাথায় পাতলা ঘোমটা। মেয়েটি চুপচাপ বসে আছে,
উঠানে বসে গ্রামের মা-চাচিরা হাতে হলুদ বাটছে। তাদের হাসি আর ফিসফাসে উঠানটা গমগম করছে।
এই তো সন্ধ্যা পেরোলেই বিয়ে। উঠানে হলুদের গন্ধ, বারান্দায় জমে থাকা মেয়েলি কিছিমের আনন্দ।
পাশের বাড়ির আমেনা চাচি এসে ইফরাহ্র পাশে বসে, হাত রাখে তার মাথায়
— “কাল থেকে তুই তো আর আমাদের থাকবি না মা!”
ইফরাহ্ নির্বাঘ কোনো উত্তর করে না। ঠিক যেমন অনুভূতি শুন্য হলে মানুষে কোনো কিছুর শখ থাকে না। তেমন এত এত খুশির মাঝেও ইফরাহ্র মনের ভেতর কোথাও যেন একটা ভারী মেঘ জমেছে। অকারণে বুকটা ধড়ফড় করছে । চোখ তুলে সূর্যের শেষ আলোটুকুর দিকে তাকায় সে। আলোটা যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে । এইতো আর কিছু সময় , তারপর সব ফেলে নতুন জীবনের পা পড়বে , তার শৈশব, তার ঘর, তার চেনা সব ছেড়ে পাড়ি জমাবে নতুন ঠিকানায়।
এতো এতো ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কানে আসে মা চাচির গাওয়া গ্রাম্য বিয়ে গীত
ছায়াস্পর্শ পর্ব ৬
“কাধ হেলানী দিয়া নাচ রে গোলাপি ,
কোল হেলানী দিয়া নাচ রে গোলাপি।
গোলাপি মোর দুধের সর,
কেমনে যাবে পড়ের ঘর।।”
গীত বলতে-বলতে কুলো হাতে এগিয়ে আসছে ইফরাহ্র মা- চাচিরা। ধান- দুব্বো , হলুদের বাটি সব সাজিয়ে রাখা হয় ইফরাহ্র সামনে।
সর্বপ্রথম গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা হলুদ লাগায় ইফরাহ্র গায়ে তার পর একে একে সকলেই লাগায়।
