ছায়াস্পর্শ পর্ব ৮
জান্নাত চৌধুরী
দিনের আলো মূর্ছা গিয়েছে, সন্ধ্যার রাতের আগমনী ঘটছে ধীরে-ধীরে। করতোয়া নদীর বুকে সূর্য এখন বিদায় নিচ্ছে, তার শেষ আলোর ঝলক নদীর জলে হেলে পড়েছে!
এদিকে দিনের বিদায় বর্তা নিয়ে অন্ধকার গিলে নিচ্ছে নদীর পানি। ধীরে পানি ঘোলাটে রং কেমন কালোতে পরিণত হতে থাকে দুরের ফাকা স্থানে বেদের তাবু চোখে পড়ছে। আজ বুঝি বেদে পাড়ায় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে গান বাজছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন যুবক , নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আছে। বয়স্ক মতোন একজন বসে বসে পান চিবোচ্ছে হাঠাৎ কানে ভেসে আসে মাঝির ডাক।
– মহাজন
” আরে মা* ল আইছে জলদি হাত লাগান” .. বলেই দ্রুত পায়ে উঠে দাড়ায় রেজা। বয়স কতই বা হবে পঁচিশ কি ছাব্বিশ … তার ডাকেই বাকিরাও এগিয়ে যায়, নৌকা টেনে পাড়ে এনে ঘাটি দেয়। বয়স্ক মতন লোকটা তখনো বসে পান চিবোচ্ছে ,ডান পাশে পানের পিচ ফেলে আঙ্গুল দিয়ে গাল ঠেলে!
বাকিরা এক-এক করে নৌকা থেকে বাক্স নামাতে থাকে , প্রায় ২৮টা বাক্স নামানো শেষ হতেই রেজা বাক্স চেকিং করতে হাতে এক ছুরি নিয়া পেকেজিং কাটতে থাকে …
বাক্স খোলা হতেই চোখ জোড়া কপালে ওঠে তার। ফাঁকা বাক্স দেখেই গলা শুকিয়ে আসে তার কাঁপা কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“মহাজন সর্বনাশ হইয়া গেছে জলদি আহেন ”
মাত্র একটা পান শেষ করে অপর পানের খিলি মুখে দিতে নিয়েছিলো লোকটি তবে রেজার ডাকে তা আর মুখে দেওয়া হলো না দ্রুত বসা থেকে উঠে লুঙ্গির গোছা ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়ায় সে। চোখে মুখে ঘোর লেগে আছে,
-কি হইছে রে শা *লা তোগো জ্বালায় জীবনডা আমার পুরোই আমবাগান হয়ে গিয়েছে। মা*ল চেকিং করতেও আমার কিসের প্রয়োজন এত।
রেজা শুষ্ক ঢোক গিলে ভয়ার্ত চোখে তাকায় মহাজনের দিকে ,
-বাক্স ফাঁকা মহাজন ভেতরে কিছুই নাই নাই …
-এই হালার পুত , পাতা খাইছোস বেডা? মা*ল থাকবো না কে রে। বাক্স ভর্তি মাছ আইবো মালিকে বইলা দিচে। আর মাছের নিতে আইবো রত্ন।
– উপরওয়ালা সত্যি মহাজন ,পুরো বাক্স ফাঁকা মাছ নাই !
চারপাশে একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে আসে। যে কয়জন বাক্স নামাচ্ছিলো তারা থমকে গিয়ে তাকিয়ে থাকে। করতোয়া নদীর বাতাসটাও যেনো হঠাৎ থেমে গেছে। মহাজনের চোখে আগুন ঝরছে ,চোয়াল শক্ত করেই হেঁচকা টানে সরিয়ে দেয় রেজাকে
-এই বান্দির পুত সর দেহি …. কথাগুলো বলেই বাক্সের দিকে তাকায় মহাজন!
রাগে শরীর রি রি করছে তার । পড়নের পাঞ্জাবির বুকের বোতাম খুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে সে।
– হায় সর্বনাশ , এহন মালিকের কাছে কি জবাব দিমু। মালিক তো শেষ কইরা ফালাইবো!
মাথায় হাত বুলাতে থাকে তিনি , হঠাৎ তার চোখ গিয়ে মাঝির উপর পড়তেই রেজা গিয়ে চেপে ধরে মাঝির গলার গামছা।
হেংলা পাতলা এক লোক পড়নে এক সাদা স্যান্ড গেঞ্জি সাথে লুঙ্গি। গলায় ঝুলানো কালো আর সাদার দাগ কাটা এক গামছা রোজা গিয়ে চেপে ধরতেই হাত জোড় করে মাঝি …
-কি হইছে মহাজন ? আমি কি করছি?
মহাজন এগিয়ে আসে মাঝির কাছে , শক্ত হাতে চেপে ধরে মাঝির গলা!
-এই শালা ছোটলোকের বাচ্চা মা* ল কই লুকাছোস?
মহাজনের মুখ থেকে কয়েক ফোঁটা থুথু ছিটকে পড়ে মাঝির মুখে। শ্বাসনালীর ধরে আসছে দম পাচ্ছে না সে .. কাঁপা কাঁপা হাতে মহাজনের হাত ছাড়াতে চায় সে! লাভ হয়না বেশ কষ্টে গলা হতে
বেড়িয়ে আসে দুটো লাইন
-আমি কি.. কিছু জানিনা মহাজন। আমি খালি মা*ল নৌকায় তুলছি আর ল ..লগে নিয়া আইছি!
-আরো শক্ত হয় মহাজনের হাতের বাঁধন। মালিকে এতো টাকার মাল তুই ছাড়া কে সরাইবো। জলদি মুখ খোল না হলে কাল সকালে তোর লাশ বাসবো নদীর পানিতে ।
মুখ দিয়ে কথা বেড়েচ্ছে না মাঝির নিঃশ্বাস আটকে আসছে প্রাণ বুঝি যায় যায়! এমন সময় হাতের বাঁধন আলগা করে মহাজন।
ছাড়া পেয়েই মহাজনের পায়ে পড়ে যায় মাঝি।
-কসম খোদার ! আমি কিছু জানিনা মহাজন! আমি মাল চুড়ি করি নাই মহাজন.
ঝাড়া দিয়ে নিজের পা সরিয়ে নেয় মহাজন। মাঝি ছিটকে পড়ে বালুর উপড়ে ।ক্ষিপ্ত নজরে মাঝিরে ভস্ম করেছেন তিনি
-একদম কাঁদুনি গাইতে আইবিনা , হাসেম। সব কিছু তোর হেফাজতে আসার কথা তয় বাক্স ফাঁকা করে রে?
মাটিতে বসেই কাদঁতে থাকে মাঝি। দুহাতে জোড় করে আবারো ফিরে আসে মহাজনের কাছে
– বিশ্বাস করে..
এই রেজা , এইডার একটা ব্যবস্থা কইরা জলদি আয় মালিকের কাছে খবর পৌঁছাতে হইবো আমি যাই।
রেজা ঘাড় কাত করে একবার তাকায় মাঝির দিকে, ঠিক তার পর মূহুর্তে তাকায় মহাজনের দিকে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলে
আপনি আহেন মহাজন আমি এইডারে দেইখা নিতেছি
-এই আমার নয়া কুঁড়াল খান কইরে লইয়া আয়?
লুঙ্গির কাছা কিছুটা ঝেড়ে নিয়ে বিদায় নেয় মহাজন , রেজা ঘাড়টা ডানে বামে মুচড়ে এগিয়ে যায় মাঝির দিকে।
-এই বাটেক আমার নয়া কুঁড়াল খান নিয়া আয় রে বাপ।
মাঝির একদম কাছাকাছি চলে এসেছে রেজা। বেশি দুরত্ব নেই দুজনের মাঝে.. বেশ কিছু সময় স্থির থেকে ডান পাশে হাত বাড়াতেই বেশ ধারালো এক কুড়াল এগিয়ে দেয় বাকেট।
– চাচা
বেশ ঘোর লাগানো এক স্বরে ডেকে ওঠে রেজা। ভয়ে সিটিয়ে যায় মাঝি। এক মূহুর্ত দেরি না করে দ্রুত পায়ে পড়ে রেজার
-আব্বা আমি এই জিবনে মুখ খুলমু না , আল্লাহ দোহাই লাগে আমারে ছাইড়া দেও , ঘরে আমার এক যুবতি মাইয়া আছে,আমার বউ আছে, আমি তাগো নিয়া এই গ্রাম ছাইড়া যামু বাবা। এই জীবনে আর এই ভাঙ্গাপড়ার মুখ মারাইতাম না বাপ। মাফ কইরা দেও বাপ।
বেশ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে রোজা রাতের কালো আঁধারে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে তার হঠাৎ হাঁসির মাঝে ধারালো কুঁড়াল ঢুকিয়ে দে মাঝির মাথা বরাবর গগন বিদারি এক চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে রাতের শান্ত পরিবেশ। হঠাৎ থেমে যায় বেদে পল্লির গান পুরো বেদে পল্লি অন্ধাকারে ছেয়ে যায় …
বেশ অনেক আগেই প্রাণ ত্যাগ করছে মাঝি ! হাতের কুড়াল বাকেটের দিকে এগিয়ে দিয়ে হাত নদীর পানিতে ধুয়ে আসে রেজা
– এর মাথা পুতে রাখা হোক উত্তরে কাটাবাড়ি জঙ্গল .. আর দেহের পাথর বেঁধে নদীতে ফেলবি। সাবধান কাজে গাফিলতি হলে পরবর্তী নিশানা কে হবে বলা মুস্কিল।
বাকেট স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে , রেজা এগিয়ে গিয়ে তার শার্টের উপর হাত মুছে , কাজ শেষ কর আমি যাই ছোট নবাবের বিয়ার আয়োজন আজ..
রাতের প্রায় নয়টা ….
বউ সাজানো হচ্ছে ইফরাহ্ কে। লাল টুকটুকে শাড়ি পাঠানো হয়েছে মীর বাড়ি থেকে! সাথে বেশ ভাড়ি ভাড়ি সোনার গহনা। এতো গহনা ইফরাহ্ কোনো কালেই দেখে নি। কোনো কাল কেন এ জিবনে সোনা হাতে ছুয়ে দেখেনি সে। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে গহনা বিলাসিতা বলে কি ।
যুথি , রাইসা সাথে গ্রামের কিছু মেয়ে মিলে সাজিয়ে দিচ্ছে ইফরাহ্কে। সাজ গোজ তার কোনো কালেই ভালো লাগতো না , বেশ সাদা মাটা চলা মেয়েটা নাকি আজ এত ভারি সাজে সাজবে। বেনারসিটাও বেশ দামি … কেমন জ্বলজ্বল করে। ইতোমধ্যে শাড়ি পড়ানো শেষ হয়েছে। ইফরাহ্ লম্বা গোছের চুলগুলো বউখোপা করে তাতে বাড়ির গাছের ফুটা গোলাপের মালা লাগিয়ে দেয় যুথি বেশ বিরক্ত লাগে ইফরাহ্র।
এবার পালা গহনা পড়ানো একে একে পাঁচ গহনার বাক্স খুলে রাইসা। স্বর্ণ কেমন ঝিলিক মারছে! চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে
” কি সুন্দর” রাইসা বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে এক এক করে সব গহনা পড়িয়ে দেয় ইফরাহ্র শরীরে দুটো হার , হাতে চুরি , মাথার টিকলি সব পড়ানো শেষ।
-হায় কি সুন্দর লাগছে তোকে সোনাই ! রূপ যেন আর এই ভাঙ্গা ঘরে ধরছে না আপা
অবজ্ঞার এক হাসি হাসে ইফরাহ্ একবার আসেপাশে চোখ বুলিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। যুথি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে নেয় তাকে
-আইজ থেকে আর দেখা হবে না সই! আইচ্ছা ছোট নবাব কি তোরে পরীক্ষা দিতে দিবো না।
-আরে বিয়া হইলে কিসের পড়ালেখা যুথি আপা। সোনাই আপা অত বড় বাড়ির বউ হইবো তোমার কি মনে হয়, মীর বাড়ির লোক আপারে পড়াইবো। এমনিতেও আমাগো গ্রামের মাইয়ারা বেশি পড়ে না।
মনটা আরো খারাপ হয় যায় যুথি তার খেলার সাথি, স্কুলের সাথির আজ বিয়ে। ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার , বাহিরে শোরগোল উঠেছে কানে আসছে চাচিদের কথা
-এই বর আসছে ,বর আসছে ….
বর আসছে, এই কথা কানে আসতেই এক এক করে ঘর ফাঁকা করে চলে যায় গ্রামের মেয়েরা। পাশে বসে রয় রাইসা আর যুথি…
ইফরাহ্র মুখ শুকনো কেমন অনুভূতি শুন্য লাগছে মেয়েটাকে যুথি কিছু সময় তাকিয়ে থাকে ইফরাহ্ মুখে দিকে…
-এই যুথি আপা, আপা.. বর চলে এসেছে যাবে না !
রাইসার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে যুথির , নিজেকে সামলে নিয়ে তাকায় রাইসার দিকে।
-চলো না আপা বর এসেছে এখানে সোনাই আপাকে তো সাজানো শেষ আমরা বরং ছোট নবাব কে দেখি চলো!
মুসকি হাসে যুথি , রাইসার দিকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বলে …
-তুই যা আমি বরং এখানেই আছি!
একটুও দেরি করে না রাইসা এক ছুটে বেড়িয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
বর এসেছে একে একে সকলে ভীর করছে উঠানে .. কিছু একটা নিয়ে গসিব হচ্ছে! রাইসা ভীর ঠেলে একটু সামনে এসে দাড়াতেই চোখ জোড়া কপালে…
উঠানে চকি পাতানো হয়েছে তার উপরেই বসানো হয়েছে আরাধ্য কে চেয়ারম্যান চাচা এসেছেন তবে তিনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন এক মুন্সি মতোন দেখতে লোকের সাথে , সাথে মসজিদে ইমাম সাহেবও আছেন । আব্বাজান তাদের পাশেই দাঁড়ানো ,
-এই দেখ দেখ ছোট নবাব শার্ট পড়ে বিয়েতে এসেছে।
পাশ থেকে হেমলতার কথা কানে আসতেই চেয়ারম্যানের থেকে নজর সরায় রাইসা। হেমলতা হলো যুথি আপার ছোট বোন ভীষণ হিংসুটে। এইযে ছোট নবাবের দিকে কেমনে নজর দিচ্ছে ডানে বামে ঠোট মোচকায় রাইস!
তবে ছোট নবারে এই সাজ একদম পছন্দ হয়নি তার।বিয়েতে বর পাঞ্জাবি- পায়জামা পড়ে ,মুখে রুমাল দিয়ে সেজেগুজে আসে আর এই মানুষ কিনা কালো রঙের এক শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে এসেছে। আরাধ্যের পা থেকে মাথা অবদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে রাইসা হঠাৎ চোখ আটকে যায় আরাধ্যর হাতের সাদা ব্যান্ডেজে ,যার বাহিরে এখনো তাজা রক্ত লেগে আজ। নাক সিঁটকায় রাইসা ছোট নবাব কি মারামারি করছে , তাই তার এই সাজ। রাইসার ছোট মাথায় হিসাব কেমন গোলমাল লাগছে …
-তাহলে বিয়ে পড়ানো শুরু করি কি বলো ইসমাইল?
– আপনি যা ভালো মনে করে চেয়ারম্যান সাহেব।
ইসমাইলের কথায় আনন্দিত হয়ে কাজির কে নিয়ে আরাধ্যের কাছে এসে বসেন চেয়ারম্যান সাহেব। এমনি ভ্যাঁপসা এক গরম ছুটেছে। শীত পেরিয়ে হালকা গরমের এক আভাস আসছে , সাথে এতো মানুষের ভীড় রাগে মুখ থেকে শ ” খানেক গালাগালি বেড়িয়ে আসছে আরাধ্যের হঠাৎ সকলের মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে সে …
-আমার শালিকা কোথায়, এই শালি ?
ভিমরী খেয়ে যায় সকলে , হতভম্ব হয়ে যায় চেয়ারম্যান। রাইসা ভীরের মাঝেই দাড়ানো ছিলো আরাধ্যের ডাক কানে আসতেই কাঁপা কাঁপা পায়ে ভীর ঠেলে আরাধ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সে।
একদম চকি কাছে এসে , শাতীল কন্ঠে বলে .. কিছু বলবেন ছোট নবাব।
ভ্রু জোড়া কুঁচকে নেয় আরাধ্য তবে বেশি ঘাটায় না কিছু।
-বর এসেছে সেবা যত্ন কবে করবে শালি এইযে গরমে আমার শরীর ঘামছে এইটা এখন ঘামার কথা … জলদি বাতাস দাও আমাকে।
আরাধ্যের কথামতো মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় রাইসা। দ্রুত গিয়ে ঘর হতে হাত পাখা এনে বাতা দিতে থাকে আরাধ্য কে। এদিকে হাত পাখার শীতল বাতাস পেয়ে ঠান্ডা হতে থাকে আরাধ্যের শরীর
-কি কাজি সাহেব জলদি বিয়ে পড়ান।
আরাধ্যে কথায় কাজি দ্রুত হাত চালাতে থাকে আশেপাশে মানুষ সবাই নিশ্চুপ। কার সাধ্যি ছোট নবাব কে নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
বেশ কিছু সময় পর কাজি জিজ্ঞেস করে চেয়ারম্যান সাহেব কাবিনটা? আরাধ্য ভ্রু জোড়া কুচকে তাকায় কাজির দিকে। চেয়ারম্যান কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে বলে ওঠে
-আমার জান ডা লেইখা দেন ! জীবন একটা , এই জীবনে বউ একটাই। জীবন থাকলে বউ আমার থাকবোই
বেশ বড় বড় দুটো চোখ করে আরাধ্যের দিকে তাকায় কাজি। উঠনে উপস্থিত সকলের একি অবস্থা। বেশ কিছু সময় নিরবতা থাকার পর কাজি আবারো বলে ওঠে
-আ আসলে ছোট নবাব কাবিনে টাকা লিখতে হয় মানে দেনা পাওনা যেইটা শোধ কইরা বউয়ে নিকট যাইতে হয়।
– তাহলে পাঁচশ লেখুন।
সহসাই কাশি উঠে চেয়ারম্যানের , ইসমাইল শেখ এগিয়ে আসতে নিয়ে হাত দিয়ে থামিয়ে দেন তিনি। কাশি থামতেই কটমট
করতে- করতে তাকায় আরাধ্যেদের দিকে গ্রামের সবাই মুখ চেপে হাসছে
-ওর কথা বাদ দেন কাজি সাহেব লাখ খানিক লেখেন , সম্পূর্ণটা পরিষদ করেই আমরা বউ নিয়া রওনা হবো
চেয়ারম্যানের কথা মতোই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। কাগজ লেখা শেষে তা এগিয়ে দেয় আরাধ্যের দিকে, কাজির হাতের কলম এগিয়ে দিয়ে, সাক্ষর করতে বলে তাকে
আরাধ্য কথা বাড়ায় না ভদ্রেশ্বর ছেলের মতো কলম নিয়ে সাক্ষর করে সে।
এবার ইসলামী শরীয়তে বিয়ে পরানোর পালা .. এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেব এগিয়ে আসেন। আরাধ্যের মুখোমুখি হয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করেন তিনি।
সময় এসেছে কবুল বলার। ইমাম সাহেব আরাধ্যের দিকে তাকিয়ে বলে “আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে বলেন কবুল
চেঁচিয়ে ওঠে আরাধ্য উত্তেজিত কন্ঠে বলে, ” রাজি না থাকলে কি এখানে মুরি কিনতে এসেছি। থতমত খেয়ে যায় ইমাম সাহেব
কপাঁকাঁপা গলায় বলে ,” আ আসলে ছোট নবা…
বাকি কথার বলার আগে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় আরাধ্য , ” বুঝে গেছি কি বলবে। এইটাই তো! যে এভাবে বিয়ে পড়ানো হয় , তা থাক আমি রাজি বিয়েতে
আলহামদুলিল্লাহ কবুল , কবুল , কবুল ..
ইমাম সাহেব ফিসফিস করে বলে আলহামদুলিল্লাহ , সাথে সাথে চারপাশ থেকে ভেসে আসে আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনি।
-এই শা* লি হাতে কি জোর নেই , জোড়ে বাতাস দেও।
চমকে ওঠে রাইসা একটু হাত ঢিলে হয়ে এসেছিলো তার, তবে আরাধ্যের ধমকে আবারো সতেজ হয়ে ওঠে সে,
কাজি সাহেব উঠে দাড়ান হাতের রেজিস্ট্রার খাতা নিয়ে এগিয়ে যায় ইফরাহ্ ঘরের
ইফরাহ্ কোলে মাথা রেখে কিছু সময় শুয়ে ছিলো যুথি। বন্ধুত্ব জিবনের ইতি ঘটবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়া। গ্রামের এই মাথা ,ওই মাথা এক সাথে ঘুরে বেড়ানো ,বড় বাগান থেকে লুকিয়ে আম চুরি। একে একে সব দিনগুলো হারিয়ে ,ব্রাক স্কুল পেড়িয়ে যখন হাই স্কুলে গন্ডিতে পা পড়ছে। সেদিন হতেই জিবন যেন নতুন মোড় পেয়ে যায়।
দেখতে দেখতে হাই স্কুল জীবন প্রায় শেষের পথে , এতো বছরের চলাফেরায় মেশানো কত স্মৃতি জড়ানো। ইফরাহ্ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যুথির মাথায় এমন সময় ঘরে ঢুকে পড়ে ইফরাহ্র মা। জহুরা বেগম দ্রুত তারা দেয় মেয়েদের
-কাজি সাহেব আর চেয়ারম্যান সাহেব আসতেছে জলদি প্রস্তুত হও তোরা।
যুথি দ্রুত উঠে যায় ইফরাহ্র কোল থেকে .. মাথায় ওড়না টেনে বসে তার পাশে। এক এক করে কাজি ,ইমাম সাহেব , চেয়ারম্যান সকলেই ঘরের প্রবেশ করে।
সর্বপ্রথম রেজিস্ট্রার এগিয়ে দেয় কাজি.. ইফরাহ্ আশেপাশে না তাকিয়ে কলম হাতে তুলে নেয়। কলমের দিকে তাকিয়ে গাঢ় এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।
বেশ কিছুটা সময় নিয়ে রেজিস্ট্রারে সাক্ষর করে সে।ইমাম সাহেব এগিয়ে আসেন বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে ইফরাহ্র। যুথি হাত রাখে তার কাঁধে, ডান হাত তুলে যুথির হাতে হাত রাখে সে। কানে আসছে ইমাম সাহেব বলা শেষ লাইন
বলো মা কবুল ..
ছায়াস্পর্শ পর্ব ৭
ছলছল চোখে মায়ের চোখের দিকে একবার তাকায় ইফরাহ্। মহিলা বেশ খুশি, কষ্টের মাঝেও ঠোঁটে খেলে যায় এক তাচ্ছিল্যের হাসি হঠাৎ চোখ চলে ঘরের দরজার দিকে, কাঠের দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আরাধ্য। ঠোঁটে গলিয়ে পড়ছে অদ্ভুত এক হাসি ইফরাহ্ তাকিয়ে থাকে আরাধ্যের চোখে .. মনের অজান্তে মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসে কবুল , কবুল ,কবুল।
মুসকি এক হাসি দিয়ে দরজা ছেড়ে চলে যায় সে। পুরো ঘর জুড়ে আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনি উচ্চারিত হয়, টুপ করে চোখ হতে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে ইফরাহ্র। জীবন নতুন মোড় দিয়েছে তাকে। ভাগ্যের পরিহাস ..
