ছায়াস্পর্শ পর্ব ৯

ছায়াস্পর্শ পর্ব ৯
জান্নাত চৌধুরী

রাতের কালো আঁধারি ফুরিয়ে সকালের লাল আভা ফুটতে শুরু করছে। চারদিকে ফরজের আজান পড়ছে। ঘুম আলগা হয়ে আসছে ইফরাহ্‌র, কাল রাতে ভেজা শাড়িটা গায়েই শুকিয়েছে …
ওইযে রাতে রাগ করে বেড়িয়েছে আরাধ্য আর বাড়ি ফিরে নি।
আড়মোড়া ভেঙেও কিছু সময় শুয়ে পুরো ঘর পর্যবেক্ষণ করছে সে। তাদের দুটো ঘর মিলে যতটা হবে এই পুরো ঘরটাই ঠিক সেই সমান তবে ঘরের রংটা যেন কেমন ফ্যাকাশে। একে একে সব মসজিদের আযান শুরু হলো। ইফরাহর আর ঘুম হবে বলে মনে হয় না।

বিছানায় পড়ে থাকা শাড়ির আঁচলটা বুকে টেনে নরম কুশনের বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। ঘরের এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে খুঁজতে থাকে কিছু। বেশ অনেক সময় পর চোখে পড়ে এ বাড়ি থেকে বিয়াতে পাঠানো সেই সুটকেস টা। ইফরাহ এগিয়ে গিয়ে সুটকেস হতে এক হালকা লাল রঙের শাড়ি বেড়ে করে এগিয়ে যায় গোসলখানার দিকে।
বেশ কিছু সময় পর, লাল রঙের সেই শাড়ি পড়েছে। মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে গোসলখানা থেকে বেড়িয়ে আসে সে। বেশ স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় আয়নার সামনে…তোয়ালের বাহিরে থাকা দু’ একটা চুলের পানি যেন গাল পেড়িয়ে বুকে পড়ছে। এক টানে মাথায় প্যাঁচানো তোয়ালে খুলেতেই তার লম্বা চুলগুলো ঠিক সাপের মতো , প্রথমে পিঠ পেড়িয়ে কোমড় , তারপর ধীরে ধীরে একদম হাটুতে এসে থামে। ইফরাহ্ তোয়ালে দুই -তিনবার হাতে ঘুড়িয়ে নিয়ে ,ঝাড়া দিতে থাকে চুল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রায় অনেক সময় ধরেই চুলগুলো বেশ যত্নে মুছে নেয় সে। চিরনি করার‌ প্রয়োজন। আয়নার উপরের দিকে তাকাতেই কপালে গাঢ় এক ভাজ পড়ে তার। আরাধ্যের সেই চিরুনির গোডাউনে নজর পড়ছে।‌ ইফরাহ্ কিয়ৎ সময় স্তব্ধ থেকে নিজে- নিজেই বিরবির করে
– এতো গুলো চিরনি দিয়ে উনি কি করেন ?
পরক্ষনেই আবার কিছু একটা ভাবে।তবে কোনো কথা না বলেই, বেশ ফাঁকা দাঁতের এক চিরনি হাতে নিয়ে চুলের জট ভাঙ্গতে থাকে।

বেলকনি দিয়ে মৃদু বাতাস প্রবেশ করছে ঘরে। দরজার পর্দা টা কেমন নড়ে উঠছে। চুলের থেকে মনোযোগ সরে যায় ইফরাহর। হাতে থাকা চিরনি ড্রেসিংয়ের উপর রেখেই এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে।
দরজার একদম কাছাকাছি আসতেই এবার যেন পর্দাটা উড়ে এসে আঁচরে পড়ে একদম টিক ইফরাহ্ মুখের উপর। আলতো হাতে মুখ হতে পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে ,হাতে প্যাঁচিয়ে এক গিট মারে তাতে। বাইরে শীতল বাতাস ব‌ইছে। ভোরের এই মিষ্টি হিমেল হাওয়া যেন মন প্রাণ সব ঠান্ডা করে দেয়।
কিছুক্ষণ পরেই ভোরের স্নিগ্ধতার ফাঁক গলে দেখা দেয় লালচে সোনালি আভা , সূর্য উঠে এসেছে। ইফরাহ্ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, যেন নীরব সাক্ষী হয়ে নতুন এক দিনের জন্ম দেখছে।
হঠাৎ তার চোখ চলে যায় দূরের দিকে—ঘন গাছপালার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এক জরাজীর্ণ কুটিরে। ভোর হয়েছে তবুও সেখান থেকে ভেসে আসছে ম্লান অথচ স্পষ্ট লাল আলোর ঝলক। আলোটা স্থির নয়, যেন ধীরে ধীরে নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠছে।

মুহূর্তেই ইফরাহ্‌র দৃষ্টি বদলে যায়। শান্ত চাহনি গাঢ় হয়, ভ্রু কুঁচকে ওঠে। ঠান্ডা ভোরের বাতাসেও তার মনে হালকা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে। এক পা পেছনে সরে গিয়ে সে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থাকে ঘরের দিকে।
বেশ অদ্ভুত রকমের দেখতে ঘরটি তবে নজর কারা তার সৌন্দর্য্য।না তৈরি বাঁশের না ইট- সিমেন্টের তবে কিসের তৈরি প্রশ্ন যে মনে অন্তরালে থেকেই যায়।

দরজার শব্দ হয়েছে। ইফরাহ ঘুরে তাকায় ঘরের দিকে আরাধ্য বাড়ি ফিরেছে। বেশ ক্লান্ত লাগছে লোকটাকে , ইফরাহ বেলকনি থেকে এগিয়ে আসে ঘরের ভেতর। আরাধ্যের হাতে থাকা সাদা ব্যান্ডেজের গা থেকে ঝড়ছে নতুন তাজা রক্ত। কপালের এক কোণেও কেটে গিয়েছে কিছুটা। ইফরাহ বেশ নিক্ষুত পর্যবেক্ষণ করে তাকে !
ক্লান্ত শরীর টা কোনোমতে টেনেটুনে নিয়ে গিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে । কাল রাতের ফুল গুলো কেমন নেতিয়ে গিয়েছে.. আরাধ্য ঝুলানো ফুল হতে টান দিয়ে এক ফুল ছিয়ে নাকের কাছে এনে শুঁকতে থাকে। ইফরাহ কিছু বলে না লম্বা চুলগুলো হাত খোপা করে এগিয়ে গিয়ে সুটকেসে হাতে গিয়ে দাঁড়ায় ঘরে থাকা আলমারির কাছে।
আরাধ্য ঘাড় কিছু কাত করে তার করা প্রতিটি কান্ড খুতিয়ে খুতিয়ে দেখছে। ধৈর্য্য যে অবাধ্য হয়েছে, এই মেয়ের আশেপাশে থাকলেই কেমন হার্টবিট দ্রুত ওঠানামা করে।

এমনটা তো শা’ লা খুনের পালাতক আসমীর , পুলিশ দেখে হবার কথা। “অথচ এইটা কিনা ব‌উ দেখে তার হচ্ছে”
শাড়ির আঁচল কোমড়ে প্যাঁচিয়ে নিয়ে যেইনা আলমারির খুলতে যাবে ,ঠিক ওই মূহুর্তে মনে হয় হাওয়ায় ভাসছে ইফরাহ্। আরাধ্য ঝড়ের গতিতে ছুটে গিয়ে ছোট খাটো দেহ টাকে এনে বিছানার উপর ফেলে ‘তার উপর ছেড়ে দেয় শরীরের সমস্ত ভর।
খেপে ওঠে ইফরাহ্ রাগান্বিত কন্ঠে কিছু বলতে নিবে ঠিক তখনি মুখে ওপর আরাধ্যের হাত অনুভব হয় তার।
– উঁহু ব‌উ আপতত তোমার এই দেমাগি মুখটা বন্ধ রাখো। আমাকে একটু শান্তি অনুভব করতে দাও। শরীরে শক্তি পাচ্ছি না ..
মনে হচ্ছে তুমি কাছে থাকলে শক্তি মিলবে।

বেশ কিছু সময় অতিক্রম হয় ইফরাহ্ কিছু বলেনা। আরাধ্য একসময় ইফরাহর বুক হতে সরে ঠিক পেটের কাছে এসে মাথা রাখে।। একটু এদিক ওদিক সরার উপায়ান্তর নেই, এভাবে ঠিক কত সময় থাকা। বিরক্ত অনুভব হচ্ছে ইফরাহ “মানুষটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে —ডাকবো…
এসব ভেবেই শরীর টা কিছুটা নাড়িয়ে নেয় সে, তবে নাছোড়বান্দা মানুষটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে ইফরাহর কোমড়। ধুনুকের ন্যায় বাঁকানো কোমড়ে এক পুরুষ হাতের স্পর্শে বারবার কেপে উঠছে পঞ্চাদশী মেয়েটা।
-শুনছেন , আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
ইফরাহ পেট হতে শাড়ির অংশ সরিয়ে উন্মুক্ত অংশে নাক ঘোষে আরাধ্য। অপরদিকে লজ্জা যেন তলপেটে ঘোরপাক খাচ্ছে ইফরাহর। বারবার খামচে ধরছে বিছানার চাদর। এমন সময়
তার লজ্জা কে আরো একগুন বাড়িয়ে দিয়ে, টুক করে এক চুমু খেয়ে বসে আরাধ্য।
ধীরে ধীরে মুখ তোলে তাকায় তার বাচ্চা ব‌উয়ের দিকে। বিছানার চাদর খামছে, দুচোখ কেমন খিচে বন্ধ করে রয়েছে মেয়েটা।

– ওভাবে থেকো না ব‌উ , তবে যে রাতের সেই ফরজ কাজটা দিনের আলোতে করার ইচ্ছে জাগবে।
ফোট করে চোখে পাতা মেলে ইফরাহ‌। লজ্জায় কেমন নুইয়ে গিয়েছে সে। কোনোমতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ..
– আ আপ আপনি গিয়ে গোসল সেড়ে আসুন।
ইফরাহকে ছেড়ে মাত্র‌ই উঠে বসেছে আরাধ্য, এদিকে ইফরাহ্ বলা কথায় কপাল কুঁচকে তাকায় সে।
-কেনো ?
– শুনেছি বিয়ে পরেরদিন সকালে গোসল দিতে হয়। আমি দিয়েছি আপনিও যান।
দুষ্টু হাসে আরাধ্য ‘ আবারো কিছুটা ঝুকে যায় ইফরাহর উপর। সাথে ফিসফিসিয়ে বলে..

– শুধু গোসল দিতে হয় তা শুনেছো , কেনো গোসল দিতে হয় এটা শুনো নি। আচ্ছা মানলাম গোসল দিতে হবে , তবে তার আগে না হয় গোসলের কাজটা করা যাক। কি বলো হবে নাকি ?
কথাগুলো বলেই চোখ টিপে দেয় আরাধ্য।ইফরাহ কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না! মেয়েটা উন্মুক্ত পেট শাড়ির আঁচলে ঢেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে। কথা এড়াতে প্রশ্ন ছুড়ে ..
– কোথায় গিয়েছিলেন আপনি ,রাতেও তো বেশ সুস্থ ছিলেন তবে মাথায় চোট পেলেন কি করে ?
– এইতো একদিন হলো বিয়ে হয়েছে, এখনি নজরদারি করছো। এইটা কিন্তু একদম ঠিক নয় ব‌উ । মানুষ ঠিকি বলে , বাঙ্গালী মেয়েরা ব‌উ নয় সিসি ক্যামেরা হয়।
হায় কপাল ,

আয়ুশ ক‌ইরা বাপে আমায় ,করাইছিলো বিয়া।
ব‌উ আনতে গেছিলাম এক’ শ গাড়ি নিয়া।
এখন দিনে – রাতে দেখায় তার অসল চেহারা,
ব‌উ তো নয় যেন সিসি ক্যামেরা
– প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছেন ছোট নবাব ? ভয় হচ্ছে যদি সত্যি টা জেনে ফেলি ?
– বাহ ব‌উ তুমি তো দেখি পাক্কা গিন্নি হয়ে উঠছো ! ভালো- ভালো বেশ ভালো। এটাই তো চাই , তবে আপাতত ন্যায় বাদী বাদ দিয়ে ঘর সামলাও— কোথায় বাচ্চার-কাচ্চার প্লানিং করবে। তা না তুমি কি করো গোয়েন্দা সাজো। এইটা কিন্তু ঠিক না ব‌উ ! কথায় আছে , “পতি পরমের্শ্বর”
– ভুল! স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত
বাঁকা হাসে আরাধ্য ,তার বাচ্চা ব‌উ নাকি তার সাথেই তর্কে নেমেছে। এ্যাহ এইটুকুন একটা মেয়ে সে কিনা যুক্তি সাজাতে এসেছে।

– মানলে তবে ?
বেশ আবাক হয় ইফরাহ এই মানুষটা কোন কথার কি উত্তর করলো। আসলে কি হতে কি হলো ভাবতে গিয়েও থেমে যায় সে। অধিক সময় চুপ থেকেও উত্তর খুঁজে পায়না। দুজনের মাঝেই বেশ নিরবতা একজন তার ভাবনায় ডুবেছে অপরজন ভাবকন্যাকে দেখতে ব্যস্ত। আরাধ্যের কন্ঠে অদ্ভুত এক নেশা জমেছে।
– আমায় ভাঙ্গতে এসো না রক্তকমলিনী। আমায় ভাঙ্গলে পুরো সমাজে তোমার স্থান হবে নড়বরে। পুরো সমাজ পায়ে পিষে ছাড়বে এই পরিবার কে!
ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়ে ইফরাহ্ !শাড়ি ঠিক করে উঠে দাড়ায় বিছানা ছেড়ে। আলগা হ‌ওয়া চুলের খোঁপা আরো একবার খুলে হাত খোপা করে নিয়ে আবারো এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। আরাধ্য উঠে দাড়ায় পিছু নেয় ইফরাহর , আলমারির কাছে এসে পিছন হতে আবারো জড়িয়ে নেয় তাকে! ইফরাহ্ অনুভব করে মানুষটির ছোঁয়া সাথে বেশ কাট কাট গলায় বলে..

– কাঁটা গায়ে যেভাবে লবণ- মরিচ দিলে যন্ত্রণা হয়! তবুও মৃত্যু হয় না , আপনার এই অভিশপ্ত ভালোবাসা আমাকে ঠিক একইভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছে ছোট নবাব।
বেশ কিছু সময় স্থির থাকে আরাধ্য , আলগা হয়ে আসে হাত। বেশ কিছুটা দুরে সরিয়ে নেয় নিজেকে। তাচ্ছিল্যের এক হাসি খেলে যায় ইফরাহর ঠোঁটে…

আরাধ্য উল্টো ঘুরে এগিয়ে যায় আয়নার কাছে। সিল্কি চুলগুলো আয়নায় তাকিয়েই কয়েকবার বেক ব্রাশ করে। ইফরাহ্ মনোযোগী হয় নিজের কাজে। তবে আলমারির এক পার্ট খুলতেই চোখ ছানাবড়া। পুরো আলমারির ওগোছালো ! কোনো কিছুর ঠিক ঠিকানা নেই বেশ গাঢ় এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। এক এক করে গুছাতে থাকে। বেশ অনেক সময় ধরে এক এক করে সবকিছু গুছিয়ে পারো আলমারির ঠিক করে সে ।
আরাধ্য ভদ্র মানুষ , খাটের উপর বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে ব‌উয়ের কাজ দেখেছে। সব কাজ শেষ করেই কোমড় হতে শাড়ির আঁচল খোলে ইফরাহ্। আরাধ্য ঠোঁট উল্টায় … এদিক ওদিক তাকিয়ে
আধো আধো স্বরে বলে …

– ও ব‌উ একঠু এদিকে আসো না। টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে বিদায় হ‌ই।
-কোথায় যাবেন শুনি?
– যাহ বাবা এই না বললে গোসল দিতে হবে।
দাঁত দিয়ে জিহ্ব কাটে ইফরাহ। আরাধ্য মুসকি হাসে, মেয়েটা কি লজ্জা পেয়েছে , হয়তো পেয়েছে গাল দুটো কেমন টকটক লাল হয়ছে। ইসস পুরোই যেন টমেটো।
– ও ব‌উ শুনোনা টমেটোর চাটনি করো তো একদিন। বানাতে পারো তো নাকি ?
উপর নিচে মাথা নাড়ায় ইফরাহ। যার অর্থ সে পারে চাটনি বানাতে
– এই না হলে মীর বাড়ির গিন্নি! যেমন তোমার রূপের আগুন, তেমন তোমার গুনের বাহার । বাহ এতো দেখছি চাঁন কপাল আমার … যুগ যুগ বেঁচে থাকো ব‌উ।

কালকঠুরি ,
মাটির উপর থেকে সরু, পাকানো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। যতই নামো, ততই ঠান্ডা আর ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। সিঁড়ির দেওয়াল ভিজে কাদামাটির মতো, হাত রাখলেই আঙুলে লেগে থাকে স্যাঁতসেঁতে কাদা আর শ্যাওলার পিচ্ছিল স্তর। বাতাসে একটা পচা গন্ধ—যেন শত বছরের পুরনো রক্ত, ঘাম আর পচা মাংসের মিশ্রণ।
শেষ সিঁড়ি পার হতেই সামনে ভেসে ওঠে মাটির নিচের সেই কালকুঠুরি।দেয়ালগুলো কাচা মাটির তবে লেপে দেওয়া , উপরে পাতলা চুনের আস্তরণ ,সাথে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
একদিকে দেওয়ালে লোহার রিং পোঁতা যেখান থেকে ঝুলছে মরিচাধরা শিকল, কিছু শিকলের একপাশে হাড়গোড়ের মতো কিছু আটকে আছে।

মাটিতে অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছে এক যুবক! চারপাশে পঁচা মাংসের গন্ধে যেন‌ দম নিয়াও কষ্ট হয়ে উঠছে তার। চোখে বাঁধা কালো কাপড়, ফলে বুঝে ওঠা দায় সময়টা দিন নাকি রাত..
কয়েকঘণ্টা আগের কথা কিছুই মনে নাই তার। শুধু শরীরে রয়েছে মাইরের চিহ্ন, কি হয়েছে —কি ভুল করছে , কে ধরে এনেছে এসব কিছুই যেন বুঝতে পারছে না সে। এদিকে পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। কাঁপা কাঁপা গলায় কোনোমতে বলে
– পা , পানি কেউ আছেন? আল্লাহর দোহাই লাগে একটু পানি দেন !
আশেপাশে কারো সারা নেই হাতে বাঁধা মোটা রশিটাকে বারবার খুলতে চাইছে যুবকটি। শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে না পেড়েই শরীর ছেড়ে দেয় মাটিতে।
নেতিয়ে পড়া শরীরটা টেনে তুলতে চেষ্টার তাগাদা দেয় সে। রশিতে বাঁধা হাত-পা কাঁপছে, পিঠের মাংসপেশি টনটন করছে, কিন্তু শক্তি যেন বালির মতো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই—

ভেসে আসে খসখসে পায়ের শব্দ।
কেউ যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে মাটির ওপর ঘষটাতে ঘষটাতে।
আশার আলো যেন এক ঝলকে বুকের ভেতর ঢুকে যায় ছেলেটির।
গলা শুকনো, কিন্তু তবু যতটা জোর পায় বলে ওঠে—
— কে আছেন “ভাই… পানি… একটু পানি দেন… আমি—আমি পারতেছি না…”
পায়ের শব্দটা থেমে যায় একদম কাছে। তার বুক ধড়ফড় করছে। চোখে মুখে হালকা খুশির ঝলক

বেলা ৮টা , সকালের নস্তায় বাহারি রকমের খাবার সাজানো হয়েছে খাবার টেবিলে। অরুনিমা দাঁড়িয়ে বিচক্ষণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছে সব। মানহা টেবিলের এক চেয়ার বসা
বারবার আড়চোখে সিঁড়ি দিকে তাকাচ্ছে সে , হয়তো প্রিয় মানুষটির এক ঝলক দেখা মিলবার অপেক্ষা। তবে তা আর হচ্ছে কোথায় সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে তাদের নামার নাম নেই। বসার ঘরে খবরের কাগজে চোখ বলিয়ে, চা খাওয়া চেয়ারম্যানের পুরোনো দিনের স্বাভাব। নিজের পছন্দ স‌ই কাজ আগে শেষ করে তারপর তিনি নাস্তার টেবিলে বসবে।
ইতোমধ্যে তিনিও চলে এসেছেন .. আরাধ্য ইফরাহ্ নামার নাম গন্ধ নেই। অরুনিমা একবার সিঁড়ির দিকে চায়। পর মূহূর্তে হাক ছেড়ে ডাকে।

-এই রুইসুল , রুইসুল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অল্প বয়সী এক ছেলে ছুটে এসে , নতজানু হয়ে বলে ..
– জ্বি গিন্নি মা কিছু লাগবো ?
– ছোট নবাবের ঘরে খবর দাও। নতুন ব‌উয়ের জন্য খাবার টেবিলে সকলে অপেক্ষা করছে !
এক মূহুর্ত দেরি করে না রুইসুল দ্রুত পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে পড়নে সাদা এক স্যান্ড গেঞ্জি , সাথে লুঙ্গি। কাধে ঝুলানো গামছা টেনে এগিয়ে যায় সে ঘরের দিকে।
.
এদিকে পানি সাথে বেশ খানিক সময় যুদ্ধ করে অবশেষে লম্বা এক গোসলের পর ভেজা চুলগুলোতে তোয়ালে বুলাতে বুলাতে ঘরে ঢকে আরাধ্য। চোখ ছুঁই ছুঁই লম্বা চুলগুলো তোয়ালের বারি খেয়ে আবারো এসে পড়ছে চোখে। ইফরাহ্ শাড়ির লম্বা আঁচল টেনে মাথা ঢাকে। তবে আরাধ্য তার দিকে না তাকিয়েই খাটে গিয়ে বসে। ইফরাহ ঠায় দাঁড়ানো ঘরের মাঝ বরাবর।
খুব রাগ লাগে আরাধ্যে , মনে মনে সে নিজেকে শ ‘ খানেক গালিও ছুড়ে দিয়েছে। “মন শালাই তো সব নষ্টের মুল। নাহলে কে বিয়ে করে ভাই। আরাধ্য হাহ্ ওই তো শুধু মনটা বেইমানি করছে নাহলে এই জিবন সে বাপ্পারাজের মতোই কাটাতে চেয়েছিলো কি আর করার নিজের কষ্ট মনে চেপে নরম স্বরে ব‌উকে ডাকে
– এই যে রক্তকমলিনী, খালি দাঁড়িয়ে -দাঁড়িয়ে স্বামীকে চোখ দিয়ে গিলে খেলে চলবে। একটু সেবা যত্ন তো করতে হবে নাকি ..

শোন মেয়ে স্বামীর সেবা যত্ন করো —দোয়া করে দিবো। বছর বছর বাচ্চার মা হতে পারবে।
ইফরাহর ছোট মাথায় আরাধ্য এই ফাতরামি কথা ঢুকলো কিনা কে জানে। মানুষ টা ভীষণ অদ্ভুত ,তার কথা , তার সাজ .. এমনকি পোশাকটাও শুধু এক রঙের । পুরো আলমারির গুছিয়ে হাতে গোনা তিন টে শার্ট তিন রঙের, তাছাড়া বাকি সব কিছুই কালো।
মনে মনে ভেবেছে লোকটাকে প্রশ্ন করবে ,কালো কি তার প্রিয় রং ? তবে পরক্ষণেই মনে হয়েছে হবে হয়তো .. নাহলে কেউ কি কালো কাপড়ে আলমারি ভর্তি করে !
– এই যে ভাবনার রানী ! আপনার ধ্যানের রাজসোভাকে আপাতত মুলতুবি ঘোষণা দিয়ে এদিকে এসে। আমার মাথা মুছার কাজে মনোযোগ দিন।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ৮

ইফরাহ এগিয়ে এসে হাতে তোয়ালে তুলে নেয় তবে , সে হাত মাথা অবদ্ধি পৌছানোর আগেই দরজায় টোকা পড়ে। বিরক্তরে ‘চ ‘ সুচক শব্দ উচ্চারণ করে আরাধ্যে
-যা বাল একটু পিচ্চি ব‌উটার আদর খাবো! তাও যেন এই মীরজাফরদের ধনে মনে সহ্য হচ্ছে না। ছ্যাহ কোন সমাজে বাস করি , বিয়ে করেও ব‌উকে কাছে পাই না ..!!
ইফরাহ কি বলবে ,কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা ‘তোয়ালে হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। আরাধ্য উঠে দাড়ায় দাঁতে দাঁত চিপে এগিয়ে যায় দরজার দিকে …

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here