জনৈক প্রেমিক পর্ব ৬

জনৈক প্রেমিক পর্ব ৬
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

বাবা কি তবে সব জেনে গেছে! বাবা আবার বলল, ‘এ বাড়িতে থেকে দেওয়া কোনো জিনিস নেওয়ার দরকার নেই। গয়নাগাটিও না!’
আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যা’ বললাম।
বাবা হঠাৎ রুষ্ট কন্ঠে বললেন, ‘তোমার উচিৎ ছিল সেদিনই আমাকে সব জানানো। বোকার মতো মায়ের ওপর রাগ করে চলা আসাটা একদমই ঠিক হয়নি। তোমার মা নাহয় গ্রামের মানুষ! আশি দশকের চিন্তাভাবনা এখনো ভুলতে পারেনি। কিন্তু তোমার বাবা তো আর তেমনটা নয়! তাহলে কেন তুমি আমাকে না বলে এভাবে সেই লোকের সাথে চলে এলে যে তোমাকে বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে অপমানিত করেছে?’

বুঝতে পারলাম বাবা প্রচন্ড সিরিয়াস! কী জবাব দেবো খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। আমাকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে বাবা তার কন্ঠ থেকে রুষ্ট ভাবটা সরিয়ে নিল। ‘ঠিকাছে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন সেটা নিয়ে আর মন খারাপ করে থেকো না।’
আমি মাথা উঁচু করে বাবার দিকে তাকালাম, ‘স্যরি, বাবা!’
বাবা সামান্য হেসে আমার মাথায় হাত রাখলেন, ‘মানুষ মাত্রই ভুল!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাবা, ফুফা অনেকবার নিষেধ করা স্বত্তেও আমার শ্বাশুড়ি মা পুনরায় রান্না করলেন। পোলাও, মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা আর ইলিশ মাছ ভাজা। এতসব রান্না মা এত কম সময়ে কীভাবে করলেন কে জানে! সারাটাসময় মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে বেড়ে খাওয়ালেন। সবাইকেই অনেক জোরাজোরি করলেন এটা-সেটা নেওয়ার জন্য। বরাবরের মতো সাহায্য করতে গেলে মা আমাকে জোর করে খেতে বসিয়ে দিলেন।
খাওয়া শেষে দই আর মিষ্টিও পরিবেশনা করা হল।

ব্যাগ গোছানোর সময় আমার শ্বাশুড়ি মা আর শ্রেয়ার জন্য আমার খারাপ লাগতে লাগল। শ্রাবণ যেমনই হোক, ওনার মা আর ছোটো বোন মোটেও ওনার মতো নয়। শ্রেয়া ভীষণ মিশুক। আর মা প্রচন্ড মমতাময়ী। এ দুদিন আমার মোটেও মনে হয়নি আমি একটা অচেনা, অজানা পরিবারে বউ হয়ে এসেছি। মা কেমন করে সারাটাক্ষনই আমার খেয়াল রেখেছেন!
এ বাড়ি থেকে চলে যাবার পর মা’কে আর শ্রেয়াকে অনেক মিস করব নিশ্চিত!

ব্যাগ গোছাচ্ছি তখন রিহা এসে বলল, ‘সব গুছিয়ে নিয়েছিস আপু?’
‘হ্যা এইতো হয়ে গেছে।’
রিহা আবার বলল, ‘বাবা সব জেনে গেছে আপু!’
আমি বললাম, ‘হুম। কিন্তু বাবা কীভাবে জানল?’
রিহা হাসতে হাসতে বলল, ‘মা নিজেই বলে দিয়েছে।’
আমি বিস্ময়ের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে গেলাম, ‘মা! মা’র কারনেই না এ বাড়িতে এলাম?’
রিহা বলল, ‘বিদায়ের সময় তুই তো মাকে বলে এলি না। তুই চলে আসার পর থেকে মা কিচ্ছু মুখে দেয়নি। সারাক্ষণ কাঁদে। ‘
‘কী বলিস!’

‘হ্যা। বাবা মা’কে স্বান্তনা দেয়, মেয়ে বিয়ে দিয়েছো বুকে পাথর দিয়ে তো থাকতে হবেই। এভাবে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে সারাদিন কাঁদলে চলবে! আর ওর শ্বাশুড়ি, ননদ দুজনেই ভালো মানুষ। দেখো আমাদের মেয়ে ভালো থাকবে।
তখনি মা চেঁচিয়ে উঠে, কেমনে ভালো থাকবো জামাইডা হইল মহা শয়তান!’
আমি উচ্চস্বরে হাসতে লাগলাম।
রিহা বলল, ‘হাসিস না আপু! এরপর বাবা জিজ্ঞেস করে, কেন সে কী করেছে?
তখনি মা গড়গড় করে সব বলে দেয় বাবাকে। সব শুনে বাবা রাগে একদম ফেটে পড়ে। মা’কে অনেকক্ষণ বকাবকি করে কেন বাবাকে জানালো না আর কেন তোকে যেতে দিলো!’
আমি বললাম, ‘তারপর?’

রিহা বলল, ‘বাবা প্ল্যান করেছে আজকে স্বাভাবিকভাবেই তোকে আর ওই লোককে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। নয়তো যদি তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তোকে যেতে না দেয়, আটকে রাখে!
কিন্তু আগামীকাল বাবা আর কিছুতেই ফিরতি পাঠাবে না তোকে। ‘
আমি বললাম, ‘বাহ! দারুন প্ল্যান!’
‘হুম। আচ্ছা আপু ওই লোক তোর গায়ে আবার হাত তোলেনি তো?’
আমি হাসলাম। রিহা হঠাৎ রেগে গেল। ‘এত হাসিস না তো আপু!’
‘তাহলে কী করব?’
‘আমার কথার উত্তর দে।’
আমি বললাম, ‘না। আর মারেনি।’

এখনি আমরা চলে যাবার জন্য রওনা দেবো। যাবার আগে আমার শ্বাশুড়ি মা’কে সালাম করে এলাম। মা বললেন, ‘এ কি! গয়নাগাটি কিছু পড়িসনি কেন?’
কী বাহানা দেবো বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘মা, এত রাত হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটের ব্যাপার। যদি রাস্তায় চোর-ডাকাতের খপ্পরে পড়ি! তাই আর রিস্ক নেইনি।’
‘ওহ! আচ্ছা ঠিকাছে! সাবধানে যাস মা!’ এরপরে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ ভালোয় ভালোয় ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসিস!’
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। যদিও মিথ্যে কথা। আমি তো আর ফিরবো না!
শ্রেয়ার সঙ্গেও কথা হলো। শ্রেয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভাবি, কাল সকাল সকালই ফিরে আসবে কিন্তু! আমি তোমাকে অনেক মিস করবো! আবার ছোটো বোনকে পেয়ে ননদকে ভুলে যেওনা!’
রিহা শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে মুখটাকে বাংলার প্যাঁচার মতো করে ফেলল। আমি হেসে বললাম, ‘আমিও তোমাকে অনেক মিস করবো শ্রেয়া!’

মাঝখান থেকে শ্রাবণ হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘তোর ভাবিকে ছাড় শ্রেয়া। কান্নাকাটি করিস না। কাল সকালেই তাকে এ বাড়িতে উপস্থিত পেয়ে যাবি!’
আমি মনে মনে ব্যঙ্গাত্মক হাসলাম।
বাবা, ফুফা আমার শ্বাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলেন।

বাবা বুদ্ধি করে গাড়িতে শ্রাবণকে তার আর ফুফার সাথে বসিয়েছেন। শ্রাবণ হয়তো মনে মনে বিষয়টাকে অদ্ভুত ভাবছেন! তারা বসেছেন একদম পেছনের সিটে। মাঝের সিটে আমি আর রিহা। আর সামনে ড্রাইভার একা।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দূরে অন্ধকার ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ল না। তবে কিছু রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলছে। গাড়ির সংখ্যা খুব কম। অনেক রাত হয়েছে বলে হয়তো।
শিরশিরিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। হাওয়াটাকে আরো ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য জানালা দিয়ে মাথা বের করলাম। সাথে সাথে শ্রাবণ চেঁচিয়ে উঠল। ‘জানালা দিয়ে মাথা বের করো না হৃদি! এটা রিস্কি!’
বাধ্য হয়ে গাড়ির ভেতর মাথা নিয়ে এলাম। মনে মনে বললাম, রিস্কি কীভাবে! রাস্তায় তো গাড়িই নেই তেমন! যত্তসব! কিন্তু মুখে কিছু বললাম না।

বলাই বাহুল্য ফিরতে ফিরতে গভীর রাত হয়ে গেল। শ্রাবণ মা’কে সালাম করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন মা?’
মা একবার আমার দিকে তাকায়। আরেকবার শ্রাবণের দিকে। এরপরে কোনোরকমে উত্তর দেয়, ‘ভালো।’
শ্রাবণকে আর জিজ্ঞেস করে না সে কেমন আছে। হয়তো আমার ভয়ে! ভাবছে আমি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই!
মা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। আমিও আর নিজের রাগ ধরে রাখতে পারি না! সব ভুলে যাই।
রাতে আমার ঘরে শ্রাবণের একা শোয়ার ব্যবস্থা করা হলো। মা আমাকে বলল, রিহার ঘরে রিহার সাথে ঘুমাতে। আমি রিহার সাথে ঘুমাতে গেলাম। শুয়েছি পাঁচ মিনিট হল। হুট করে টুং শব্দ করে মোবাইলে মেসেজ এল। আননোন নম্বর! লেখা,
‘তুমি কোথায় হৃদি?’

কে পাঠালো! প্রত্নর তো আর আমাকে মেসেজ পাঠানোর সাহস করার কথা না! এছাড়া ও তো আর আমাকে তুমি করে বলে না। কোনো ক্লাসমেটরাও তো না! তবে কি শ্রাবণ? রিপ্লাই করব কি করব না ভেবে করেই ফেললাম। ‘আপনি কে?’
রিপ্লাই এলো, ‘নিজের হাজবেন্ডের নম্বর চেনো না!’
ওহ শ্রাবণই তাহলে। আমি আর রিপ্লাই করলাম না। পুনরায় মেসেজ এল, ‘কী হল? বললেনা কোথায় তুমি?’
আমি কোথায় জেনে উনি কী করবেন! আর আজ এত মেসেজ কেন করছেন উনি! বিয়ের আগে কেন করলেন না! তখন যদি কথা হতো তাহলে ওনার রাগ স্বমন্ধে একটা ধারণা পেতাম। বিয়েটাই আর করতাম না তবে!
আবার মেসেজ এল, ‘তুমি কোথায় বলবে না কি শ্বাশুড়ি মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো?’
আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘রিহার ঘরে।’

জনৈক প্রেমিক পর্ব ৫

পুনরায় মেসেজ এল, ‘তুমি ও ঘরে কী করছো?’
‘ঘুমুচ্ছি।’ পাঠিয়ে মোবাইলটা অফ করে রাখলাম।
কিছুক্ষন পরেই দরজা খটখট করার আওয়াজ পেলাম। রিহা ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আওয়াজ পেয়ে ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে উঠল, ‘আপু বোধহয় মা এসেছে। একটু গিয়ে দেখনা!’
আমি দরজা খুলে দেখলাম বাইরে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। উনি এখানে কী করছেন!
‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’
উনি খপ করে আমার হাত ধরে বললেন, ‘চলো ঘুমোবে চলো!’
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘ঘুমোচ্ছিলামই। আপনিই এসে ডিস্টার্ব করলেন। আমার হাত ছাড়ুন!’
উনি আমার কথা ভ্রুক্ষেপই করলেন না। ‘এখানে কেন ঘুমোবো? চলো তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে!’
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘হাত ছেড়ে কথা বলুন! কেউ দেখলে কী ভাববে ভেবেছেন একবারো?’
শ্রাবণ হাসলেন, ‘কে কী ভাববে? তুমি আমার স্ত্রী।’

আমি উপহাস করে হাসলাম, ‘স্ত্রী! ‘
শ্রাবণ আচমকা কিছু না বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। আমি আবার বললাম, ‘আপনি যদি আমার হাত না ছাড়েন আমি কিন্তু চিৎকার করবো!’
শ্রাবণ হাসতে লাগল, ‘ঠিকাছে! করো।’
আমি সত্যি সত্যিই মা’কে চিৎকার করে ডাকলাম। আমার চিৎকার শুনে বাবা, মা দুজনেই ঘর থেকে বের হল। বাবা বললেন, ‘কী হয়েছে মা?’

ঘটনার আকস্মিকতায় শ্রাবণ হকচকিয়ে গেলেন। হয়তো উনি ভাবতেও পারেননি আমি সত্যিই চিৎকার দিয়ে বসব!
আমি বললাম, ‘বাবা, শ্রাবণ আমাকে জোর করে ওনার ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন!’
আমার কথা শুনে মা চোখ কপালে তুলে ফেলল। কিন্তু বাবার মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। বরং ঠান্ডা গলায় শ্রাবণকে বললেন, ‘ও যখন চাইছে না তোমার সঙ্গে যেতে তাহলে জোর করছো কেন? তোমার কোনো অধিকার নেই আমার মেয়েকে কোনো বিষয়ে জোর জবরদস্তি করার!’
শ্রাবণ যে বাবার কাছ থেকে এমন ব্যবহার মোটেও আশা করেননি সেটা ওনার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। অপমানে, লজ্জায় ওনার মুখ লাল হয়ে উঠল । উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে গটগট করে হেটে রুমে চলে গেলেন।

জনৈক প্রেমিক পর্ব ৭