ঠকেছি গল্পের লিংক || সুমাইয়া আফরিন ঐশী

ঠকেছি পর্ব ১
সুমাইয়া আফরিন ঐশী

প্রেগনেন্সির নয় মাসের উঁচু পেট নিয়ে প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে পা রাখতেই সতীনের মুখোমুখি হলাম আমি।
এখানে এসে লোকমুখে জানতে পারলাম, আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী আমি। আমার আগেও সে একটি বিয়ে করেছে। ইভেন এখনো তার প্রথম স্ত্রী রয়েছে। প্রথম সংসারে তার পাঁচ বছরের একটি মেয়েও আছে।
অথচ আমাদের বিয়ের আগে ঘুণাক্ষরেও সেসব টের পাইনি আমি। এসব কিচ্ছুটি স্বীকার করেনি সে। হয়তো এই সত্য কখনো জানাও হতো না, যদি আমি আজ নিজ থেকে তার খোঁজে না আসতাম। মানুষটা নিখুঁতভাবে ঠকিয়েছে আমাদের দু’জন নারীকে। আমার সতীনও জানে না, আমি তার স্বামীর আরেকটি স্ত্রী। অচেনা আমাকে দেখে সে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কে আপনি?”
“আমি যদি বলি আমি আপনার স্বামীর আরেকটি স্ত্রী, আপনার সতীন আমি। কী, বিশ্বাস করবেন আপনি?”
আমার কথায় সে প্রচণ্ড রকমের রেগে গেল। অচেনা এক মেয়ের মুখে স্বামীকে নিয়ে এমন কথা শুনলে রাগটাই স্বাভাবিক!
নারী তার স্বামীকে নিয়ে ভাগাভাগি কোনো কালেই সহ্য করতে পারেনি। আমিও পারছি না, আমার সতীনও পারবে না। সে আমার দিকে অ গ্নি চোখে তাকিয়ে বলল,
“এই মেয়ে! কী সব ফা/লতু কথা বলছিস তুই? এক্ষুনি বের হ তুই আমার বাসা থেকে।”
আমি কোনো ফা/লতু কথা বলছি না। তার সাথে রিলেশন করেই আমার বিয়ে হয়েছিল। আমি শহরের মেয়ে। আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই ছিল তার ফ্ল্যাট। সে ওখানেই চাকরি করত, ফ্ল্যাটে একাই থাকত। ওখানের সবাই জানত, সে অবিবাহিত। মা-বাবা গ্রামে থাকে—এ কথাও তার মুখের বলা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমাদের পাশাপাশি বাসা হওয়ার সুবাদে তার সাথে টুকটাক কথা হতো। দেখা হলেই প্রতিবার সে আগ্রহ নিয়ে আগে আগে কথা বলত। তার কথা বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ! আমার ভালো লাগত। যে কেউ, যে কোনো মেয়েরই ভালো লাগবে তাকে। দেখতে শুনতে ভালো, শিক্ষিত যুবক।
এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই সে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিল আমায়। আমি তখন অমত করলাম। তবে, ধীরে ধীরে আমিও বুঝে গেলাম, আমি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।
এরপর আমাদের প্রেম হলো। আমি যেটাকে ভালোবাসা বা প্রেম ভাবতাম, আসলে ওটার নাম ছিল পর/কীয়া। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি আমি তার চালাকি। সে বুঝতেও দেয়নি।
প্রেম হওয়ার ছয় মাসের মাথায়ই সে আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেল। আমার বাবা নেই। আমরা শুধু দুই বোন। আমার বিয়ের ব্যাপারে সে মায়ের সাথে সরাসরি কথা বলল। মা প্রথম প্রথম রাজি হননি। তবুও সে হাল ছাড়েনি।

এরপর বিভিন্ন কৌশলে আমার মাকেও রাজি করাল।
ছেলে ভালো চাকরি করে, দেখতে শুনতেও ভালো। তাই আমার পরিবার আর অমত করেনি। মা বললেন,
“তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে তোমার অভিভাবকদের নিয়ে আসতে হবে। তাদের মতামতেরও প্রয়োজন আছে।”
এরপর সে তার বাবা-মাকে গ্রাম থেকে আসতে বলল। তারাও আমাকে পছন্দ করলেন। এভাবেই বিয়েটা হলো আমাদের।
বিয়ের পরপরই তারা গ্রামে চলে গেল। আমরা দু’জন শহরে থাকতাম। মাঝেমধ্যে সে ছুটিতে গ্রামে যেত, কিন্তু আমাকে কখনো নিয়ে যেত না। আমি যেতে চাইলে বলত,

“তোমার অনার্স শেষ হলেই একেবারে ধুমধাম করে তুলে নিতে চাইছে, আব্বা-আম্মা।”
আমিও মেনে নিলাম। উনি যে কয়দিন ছুটিতে থাকত, সবসময় ব্যস্ত থাকত। তখন খুব একটা কথা হতো না আমাদের। হলেও দিনের বেলা টুকটাক হতো।
হবেই তো!আজ বুঝলাম সে কারণ!
সে গ্রামের কথা বলে চলে যেত তার প্রথম স্ত্রী আর সন্তানের কাছে। তারা-ও তো এসব জানে না। আর আমিও তো সরল ছিলাম। সে যা বুঝাতো, তাই বুঝতাম। কখনো সন্দেহ করতাম না। আর আমার এই সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সে আমাকে নিখুঁত ভাবে ঠকিয়েছে। তবুও আমি টের পাইনি।
বিয়ের ছয় মাস যেতেই আমি বাচ্চা কন্সিভ করি। এরপরও দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। আমার প্রেগনেন্সির আট মাস হতেই হঠাৎ সে গ্রামের কথা বলে বাসা থেকে বের হলো।
এরপর মানুষটা হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে গেল। আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ, মোবাইল বন্ধ। অসুস্থ শরীরে স্বামীর চিন্তায় আমি শেষ। কী হলো মানুষটার? কোথায় আছে?

এই প্রথমবার তার দেওয়া গ্রামের ঠিকানায় গেলাম, আমি আর মা। সেই ঠিকানা ছিল ভুয়া। আসলে সেখানে তাদের কেউ থাকে না। পরে শুনতে পাই, আমাদের বিয়েতে যারা তার বাবা-মা হয়ে এসেছিল, তারা আসলে তার কেউ না।
এতো এতো সত্যের মুখোমুখি হয়ে, আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি।
তবুও শেষটা দেখতে তার খোঁজ করলাম। আমার কাছে তার ভোটার আইডি কার্ডের একটা ফটোকপি ছিল। সেখান থেকে তার আসল ঠিকানা খুঁজে বের করি। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলাম মানুষটাকে।
এখানে এসে শুনতে পেলাম আরেক সত্য। যা শুনে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। যে মানুষটাকে এতোটা বিশ্বাস করলাম, এতোটা ভালোবাসলাম, সেই মানুষটা আমাকে এভাবে ঠকালো?
কী হবে আমার? কী হবে আমার এই অনাগত সন্তানের?
আমি নিজেকে তবুও যথাসম্ভব সামলে নিলাম। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও লড়তে হবে আমাকে। আমি একটু শক্ত হয়ে তাকে বললাম,

“আমি সত্যি বলছি, আপা। এটা আমারও স্বামীর ঘর, এখানে আমারও অধিকার রয়েছে।”
আমার কথা শুনে সে (সতীন) হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আমাকে একটা থা/প্পড় দিয়ে অকথ্য গা/লি -গা লাজ করতে লাগল। আমাদের কথা শুনে সেখানে উপস্থিত হলো আমার স্বামী, মাহিম। তার কোলে তার মেয়ে। মেয়েটা দেখতে খুব মিষ্টি। আমার সতীনও সুন্দরী।
কতো সুন্দর সুখী পরিবার ছিল তার! সে পরিবার রেখেও আমার জীবনটা নষ্ট করল।
আমার নিজেকে আজ বড় অসহায় লাগছে। মানুষটা আমায় এভাবে ঠকালো? মস্তিষ্ক কেমন শূন্য শূন্য লাগছে আমার। কান্না পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাঁদতে পারছি না আমি।
আমাকে নিজের বাড়িতে দেখে মাহিমের মাথায় যেন বা জ পড়ল। অবাক হয়ে বলল,

“তনয়া, তুমি এখানে?”
“হ্যাঁ, আমি। আমি না আসলে তো কখনো জানতেই পারতাম না এসব। তুমি আমায় এভাবে ঠকালে কেন, মাহিম? তুমি বিবাহিত, তোমার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে—এ কথা কেন আমায় বলোনি? বউ থাকতে এরপরও কেন বিয়ে করলে আমায়?”
“সত্যি যখন শুনেই ফেলছো, তাহলে আর মিথ্যে বলে লাভ কী? তুমি আমার মোহ ছিলে, তনয়া। ওসময় আমার স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য হয়েছিলো। তাই আমি রাগের বশে বিয়ে করে ফেলি তোমায়। মোহ কেটে গেছে এখন আর আমি তোমাকে চাই না। তুমি এখানে না আসলেও আমি তোমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিতাম। তুমি এখান থেকে চলে যাও, তনয়া। লোক জানাজানি হলে আমার সমস্যা হবে। মেয়ে আছে আমার, তার ভবিষ্যৎ আছে। তুমি পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও!”

গড়গড় করে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলল মাহিম। যা শুনে তার প্রতি অগাধ ভালোবাসাটা আর আমার রইল না। আমি অবাক হয়ে শুধু আওড়ালাম,
“ছি, মাহিম! তুমি এতোটা নিচ! এভাবে, এতো জঘন্যভাবে কেন ঠকালে আমায়? আরেহ্! তুমি তোমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে, আমার অনাগত সন্তানের কথা ভাবলে না? আমার পেটে যে রয়েছে, সে-ও তো তোমার সন্তান।”

সকল সত্যের মুখোমুখি হয়ে গ র্জে উঠল আমার সতীন। বি শ্রী ভাষায় গা-লি-গা/লাজ করছে আমায়। তার স্বামীর কোনো দোষ নেই, সব দোষ মেয়ে আমার। আমি নাকি ভুলিয়ে-বালিয়ে নিজের শরীর দেখিয়ে বিয়ে করেছি তাকে।
হাহ্! আমার স্বামী নির্বাক। আমার সতীন তার সামনে থেকেই ঘাড় ধা ক্কা দিয়ে বের করে দিলো আমায়। আমি তবু নিজের সন্তানটার কথা ভেবে, ভিক্ষুকের মতো ওদের হাত-পায়ে ধরে একটু আশ্রয় চাইলাম। কিন্তু ওরা আমায় এতটুকু আশ্রয় দিলো না।

ওর বাবা ভাবল না, আমার সন্তানটার কথা। রাস্তায় বের করে দিলো আমায়। সাথে আমার স্বামী বলে দিলো,
“সন্তান যেহেতু আমার, তার দায়িত্ব না হয় আমিই নিলাম। তবে তোমার দায়িত্ব আমি নিতে পারলাম না। আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসি। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যেহেতু ডিভোর্স কিংবা তালাক হয় না, তাই তোমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব। সাথে কাবিনের টাকাটাও। আর কখনো তুমি এখানে আসবে না। এরপরও ঝামেলা করলে, কিছুই করতে পারবে না তুমি। এক্ষুনি চলে যাও তুমি, আমার বাড়ি থেকে।”
আহ্! কত সহজেই মানুষটা বলে দিলো এসব। আরেহ্, তুই যখন এতোটাই ভালোবাসিস তোর বউকে, তাহলে তাকে রেখেও আমায় কেন বিয়ে করলি? কেন এতো নাটক করলি আমার সাথে? তোর মোহকে প্রাধান্য দিতে, নষ্ট করলি আমার জীবনটা।

আহ্ পুরুষ! মেয়েদের জীবনটা পুতুলের থেকেও সহজলভ্য মনে করিস তোরা। এতো এতো অন্যায় করেও এই পুরুষগুলোর মধ্যে সামান্যতম অনুশোচনা নেই। তাদের জীবনে নারীর অভাব হয় না। তারা ঠিকই সুখে থাকে।
এদের খপ্পরে পড়ে শান্তি-সুখ পায় না বোকা নারীগুলো।
একটা মানুষকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে আমার জায়গা হলো শেষমেশ রাস্তায়। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমি, মানুষটা এতোটা বাজে ভাবে ঠকিয়েছে আমায়। আমার মনে হচ্ছে, এটা কোনো দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভেঙে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আগের মতো। কিন্তু না, এটা বাস্তব। আর কিছুই ঠিক হবে না আমাদের।

হয়তো বাচ্চাটা জন্ম নেওয়ার সাথেই সাথেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। আহ্! মানুষটার কী নিখুঁত অভিনয় ছিল। তার অভিনয়কে ভালোবাসা ভেবে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম তাকে। বিনিময়ে হাতছানি দিয়ে এতদিন দুঃখ ডাকছিলাম।
ঠকে গেলাম আজ বিশ্বাসের কাছে, ভালোবাসার কাছে।
আহা! এ কী নিদারুণ যন্ত্রণা!
এবার কী হবে আমার? কে দেখবে আমার বাচ্চাটাকে? আমি নিজেকে কীভাবে সামলাবো?

ঠকেছি পর্ব ২