ঠকেছি পর্ব ৩

ঠকেছি পর্ব ৩
সুমাইয়া আফরিন ঐশী

আমায় নিয়ে আজ সন্ধ্যায় সালিশ বসেছে। এখানকার স্থানীয়রা এলাকার চেয়ারম্যানকে খবর দিয়েছে। আমি এখন বসে আছি চেয়ারম্যানের ক্লাবে। আমাকে ঘিরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাঝখানে আমি, অন্য এক পাশে মাহিম ও তার প্রথম স্ত্রী, কন্যা। ওরা দু’জনই আমার দিকে বিরাশ মুখে তাকিয়ে আছে। মাহিম একটু পরপর আমার দিকে র/ক্তিম চোখে তাকাচ্ছে। ওরা হয়তো ভাবতেই পারেনি, আমি এমন কিছু করব। আমি নীরবে হাসলাম। সবকিছু কি এতই সহজ? এক চুলও ছাড় দেব না আমি। তুমি শুধু নারীর ভালোবাসাটাই দেখেছ, মাহিম…তার মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার তোপ দেখোনি। আমি তার সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেব তোমাকে।
এরমধ্যে চেয়ারম্যান সাহেব অচেনা আমাকে কিয়ৎক্ষণ আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে শুধালেন,

“এই মেয়ে, কে তুমি? কী চাও?”
“আমি মাহিমের দ্বিতীয় স্ত্রী। আমি মাহিমের শাস্তি চাই।”
আচমকা, উপস্থিত সবাই কেমন কেমনে করে তাকাল আমার দিকে! স্ত্রী হয়ে স্বামীর শাস্তি চাওয়া হয়তো অদ্ভুত শোনাল তাদের কাছে। আমি আবারও হাসলাম। চেয়ারম্যান কিয়ৎক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন। এরপর আবারও বললেন,
“তুমি যে নিজেকে মাহিমের স্ত্রী দাবি করছ, তার প্রমাণ কী? তোমাকে তো আমরা কেউই চিনি না, জানি না, কখনো দেখিনি। হুট করে তুমি কীভাবে মাহিমের স্ত্রী হয়ে গেলে? আমাদের জানাশোনা মতে, মাহিম এ কাজ করতেই পারে না। তুমি কে? সত্যি করে বলো। তুমি মাহিমকে ফাঁ/সাতে চাইছ? উদ্দেশ্য কী তোমার?”
আমি এবার শব্দ করেই হাসলাম। এ হাসিতে রয়েছে কেবল ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য। চেয়ারম্যান সাহেব কঠিন স্বরে ধমকে উঠলেন আমায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই মেয়ে, হাসছ কেন?”
“হাসছি এই ভেবে, একটা মানুষ কতটা নিখুঁত অভিনয় করতে পারে!”
আমি থামলাম। চেয়ারম্যানের পাশে বসা এক মুরব্বি বিরক্ত হলেন আমার আচরণে। তিনি বললেন,
“খোলাসা করে বলো সবটা।”
আমি হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলাম। নরম হয়ে বসলে ওরা আমাকে দুর্বল ভাববে। আমি নিজেকে যথাযথ শক্ত খোলসে আবদ্ধ করে মাহিমের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললাম,
“ওই যে জানো/য়ারটাকে দেখছেন না, ও একটা প্রতারক, ভণ্ড। ও আমার স্বামী, এটা ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে আজ। আমি ওর স্ত্রী, অথচ আপনারা এক এলাকার হয়েও আমাকে চিনেন না, কারণ আমাকে চিনতে দেওয়া হয়নি। তারপরও আপনাদের প্রমাণ চাই, তাই না?

শুনুন তবে, আমি মাহিমের স্ত্রী—এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমার পেটের অনাগত সন্তান। আপনাদের সন্দেহ থাকলে ডিএনএ টেস্ট করুন। আমাদের কাবিননামাও চেক করতে পারেন। আমি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত!”
মুহূর্তেই টানটান উত্তেজনায় সবাই নড়েচড়ে উঠল। মাহিম এতগুলো মানুষের সামনে বেশ অপমানিত বোধ করল। সে খেঁকিয়ে ধমকে উঠল আমায়,
“তনয়া, মুখ সামলে কথা বলো।”
“মুখ সামলে কথা বলার মতো অতোটাও সম্মানিত কেউ তুই নস। তুই একটা নিরীহ মেয়ের সঙ্গে যা করেছিস, এরপর তোকে মানুষ বলতেও ঘৃণা হয় আমার। অ্যাকচুয়েলি, এটা কোনো মানুষের কাজ হতেই পারে না। তুই রাস্তার কুকুরটার থেকেও নিকৃ/ষ্ট। তোর মুখোশের আড়ালের চরিত্রটা আরও জঘ/ন্য!”
মাহিম ক্রোধে চোটপাট দেখিয়ে আমার দিকে তেড়ে এল। আমার সতীনও ঝংকার তুলল। ওদের সবাইকে থামিয়ে দিলেন চেয়ারম্যান সাহেব। বললেন,

“থামো তোমরা, চুপ করো সবাই। তোমরা নিজেরা নিজেরাই যদি সব বিচার-আচার করে নাও, তাহলে আমাদের ডাকা হলো কেন? এরপর তুমি বলো মাহিম, তনয়া মেয়েটা কি সত্যিই তোমার স্ত্রী? উনি যা বলছেন তা কি সত্যি? নয়তো আমরা অন্য প্রমাণগুলো দেখতে বাধ্য হব।”
মাহিম চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর যেন গলার স্বর বদলে, চাপা রাগে বলল,
“তার আর দরকার হবে না, চেয়ারম্যান সাহেব। তনয়া যা বলছে, সত্যি বলছে। তাকে আমি বিয়ে করেছিলাম, কিন্তু তার সঙ্গে আমি আর সংসার করতে চাই না।”
“কেন চাও না?”

“কারণ, ওর সঙ্গে আমার ভণিভোনার মিল নেই। ও একটা বে শ্যা মহিলা। স্বভাব-চরিত্র মোটেও ভালো না। ও ছিল আমার জীবনে করা একটি ভুল। আমি সে ভুল এখন বুঝতে পেরেছি, তাই ওরে আমি এক্ষুনি ত্যাগ করতে চাই।
আমি আমার প্রথম স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। এরমাঝে দ্বিতীয় কোনো অধ্যায় আমি চাই না।”
নিজেকে নিয়ে মাহিমের বলা বি শ্রী ভাষা শুনে আমি ছিলাম কিয়ৎক্ষণ বাক্যহারা। পরে আবার নিজেকে বুঝিয়ে নিলাম—যে মানুষ এত জঘন্য কাজও করতে পারে, সে সবকিছুই বলতে পারে। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট হচ্ছে তার চরিত্র। যখন এক পক্ষের কাছে আগ্রহ শেষ হয়ে সম্পর্ক বিচ্ছেদের দিকে এগোয়, তখন অন্য পক্ষের চরিত্রটাকেই ছাড়াছাড়ির মোক্ষম কারণ হিসেবে দেখায়। আমাদের ক্ষেত্রেও মাহিম তাই করল। আমি নীরব থাকলাম। এখানকার পরিস্থিতিও বেশ গরম হলো। সালিশ প্রধান কী বলে, আমি তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করলাম।
হঠাৎ, চেয়ারম্যান সাহেবকে আমার সতীন ডাকল। বলল,

“ভাইজান, একটু এদিকে আসুন। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা রয়েছে। যেহেতু আমার হাসবেন্ড একটা ভুল করেই ফেলছে, এর একটা সমাধান করা দরকার।”
চেয়ারম্যান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ওই মহিলার সঙ্গে কিছুটা দূরে গিয়ে কী যেন যুক্তি-পরামর্শ করলেন। তারা ফিরলেন বেশ কিছুক্ষণ পর। ওখান থেকে এসেই চেয়ারম্যানের কথার ধরণ পাল্টে গেল।
“দেখুন, মাহিম যেহেতু আপনাকে রাখতে চায় না, সেহেতু আমাদের কিছু করার নেই। আপনি বাড়ি ফিরে যান।”
আমিও সঙ্গে সঙ্গে কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলাম,
“আমিও তার সঙ্গে সংসার করতে আগ্রহী নই, চেয়ারম্যান সাহেব। আমি শুধু আমার পাওনাটা চাই আর তার উপযুক্ত শাস্তি চাই। নয়তো ব্যাপারটা ভালো হবে না!”

চেয়ারম্যান সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চাপা স্বরে বললেন,
“কী ভালো হবে না? শুনি, বলুন? আপনি অন্য জায়গা থেকে এসে, সরাসরি আমাদের এলাকার ছেলেকে হু/মকি দিচ্ছেন। কিসের জোরে? খুব ক্ষমতা আপনার? আপনি কোনো কিছু পাবেন না। আপনার কি দোষ ছিল না? মাহিম দোষ করলে আপনিও তার সমান দোষী। একজন বিবাহিত পুরুষকে ভুলিয়ে-ফুঁসলিয়ে বিয়ে করে, নিজেকে এখন আপনি কী সতী প্রমাণ করতে চান? আপনার আগেও ওর স্ত্রী আছে, এক মেয়ে আছে—এটা আমরা সবাই জানি। তাদের প্রতি আপনি কী অবিচার করেননি?
এখন মাহিম আপনাকে রাখবে না, আপনিও তার সঙ্গে থাকবেন না। এর একটাই সমাধান—আপনি স্বসম্মানে এখান থেকে চলে যান। এর মধ্যে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এখন বেশি বাড়াবাড়ি করলে ব্যাপারটা ভালো হবে না।”

চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে যেন নীরবে হু/মকি দিলেন। আমি আশ্চর্য হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। মনেমনে সত্যিই কিছুটা ভয় হচ্ছিল আমার। যতো যাই হোক, অচেনা শহরে আমি একা দাঁড়িয়ে। আমার পরিচিত কিংবা আপনজন পাশে কেউ নেই যে আমি সেই জোরে কথা বলব। তবুও, মনের জোরে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম আমি। তখন ওখানকার একজন বৃদ্ধ লোক আমাকে চোখের ইশারায় থামতে বললেন। তিনি এখানকার মেম্বার। লোকটিকে বেশ সৎ মনে হলো। জগতে সবাই খারাপ হয় না! কত শত খারাপের ভিড়েও কিছু ভালো লোক সব জায়গায় থাকে। ওই লোকটাই আমাকে একফাঁকে সংকেত দিলেন,
“চেয়ারম্যান সাহেব মাহিমদের আত্মীয়। তুমি তার কাছে সঠিক বিচার পাইবা না, মা। এখান থেকে তুমি বুদ্ধি করে চলে যাও আর থানায় যেও।”

আমি সে ইশারা বুঝতে সক্ষম হয়ে চুপ রইলাম। ভয় পাওয়ার নাটকটাও করলাম। পরে সিদ্ধান্ত হলো, আমি এখন এখান থেকে সোজা বাসায় চলে যাব। আমিও মেনে নিলাম তাদের কথা।
মাহিম ও তার স্ত্রী অনেকক্ষণ পর বিজয়ীর হাসি হাসল। আমিও তা সরু চোখে দেখে নিলাম। ওদের উদ্দেশ্যে কেবল বললাম,

“আমায় ঠকিয়ে আপনারা আজ হাসছেন? বিশ্বাস করুন, আপনাদের এই হাসিটা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে রইবে না। কারণ, আপনাদের রব আমারও। আর রব তার কোনো বান্দাকেই ঠকায় না!
দেখবেন, আপনাদের এই সুখ অচিরেই দুঃখে পরিণত হবে।
আপনাদের দেওয়া যন্ত্রণাগুলো যে আমার রুহ অবধি পৌঁছে গেছে। আমার রুহের হায় আপনাদের ভালো থাকতে দেবে না, কখনোই না!”

আমি আর ওখানে দাঁড়ালাম না, ওদের প্রত্যুত্তর করার সুযোগও দিলাম না। ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাকে এরপর ওখান থেকে চেয়ারম্যানের লোকজন বাসের টিকিট কেটে বাসেও উঠিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর বাস ছাড়ল, তবেই ওরা চলে গেল। আমি কিছুটা দূরে গিয়ে বাস থেকে নেমে গেলাম, আমার শহরে আর গেলাম না। একজন রিকশাওয়ালা মামার সাহায্যে আমি ওখানকার থানায় গেলাম। গোপনে মাহিমদের নামে কেস করলাম।

আজ রাতটাতে আমার আর কোথাও যাওয়া হলো না। সারারাত থানায় থাকতে হলো। অসুস্থ শরীরে বসে থাকা যায় আর কতক্ষণ! আমার অস্থিরতা দেখে ওখানকার ডিউটিরত একজন পুলিশ আমাকে একটা কম্বল বিছিয়ে, জেলখানার ভেতরে শোয়ার জায়গা করে দিলেন। সঙ্গে কিছু খাবার ও পানিও এনে দিলেন। আমি ওদের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে রইলাম। এখানকার থানার ওসিটাও ভালো। তার নিদর্শনেই এসব দেওয়া হয়েছে। গর্ভবতী মায়েদের প্রতি তাদের যতটুকু দয়া হলো, এর কানাকড়িও আমার স্বামী আমাকে দেখায়নি। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। ওর কথা আর ভাবলাম না। শুয়ে পড়লাম জেলখানার বিছানাটায়। সারাদিন পর একটু শোয়ার জায়গা পেয়ে আমার শরীরটাও একেবারে ছেড়ে দিলো, আর আমিও কখন জানি ঘুমিয়ে গেলাম। আমার সেই ঘুম ভাঙে সকালে, মায়ের ডাকে। মা এসেছে, তার সঙ্গে এসেছে রিধান ভাই। উনি আমার বড় খালার একমাত্র ছেলে। বিদেশ থেকে পড়ে কিছুদিন হলো দেশে ফিরেছে।

মা আমাকে দেখে কতক্ষণ কান্নাকাটি করলেও রিধান ভাই সারাটাক্ষণই ছিলো নিশ্চুপ। আমিও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাইনি। বেশ অনেক বছর পর তার সঙ্গে আমার দেখা, তবুও আমাদের এখন অবধি কথা হয়নি। আমারও কথা বলার মন-মানসিকতা হয়নি। আচমকা, রিধান ভাই আমাকে বললো,
“তনু, ভাত খাবি?”
পরিচিত সেই সুর। উনার মুখটাও বেশ হাসিহাসি। ফর্সা মুখটাতে সুখ সুখ!

ঠকেছি পর্ব ২

আচমকা, তার এমন কথাতে রাগেরা আমার মাথায় তল্লিতল্লা চেপে বসলো। উনি কি সাত-সকালে এখানে এসেছে আমাকে ভাত খাওয়াতে? আমার কি এখন ভাত খাওয়ার মানসিকতা আছে? কথাবার্তা ছাড়াই এগুলো কেমন কথা? উনার খেতে ইচ্ছে হলে খাবে, আমাকে কেন বলবে? আমার যে কি হলো! আমি হঠাৎ এতক্ষণের সব রাগ উগলে দিলাম, রিধান ভাইকে। কঠিন স্বরে খেঁকিয়ে উঠলাম আচমকা। বললাম,

ঠকেছি পর্ব ৪