ডার্কসাইড পর্ব ১৩
জাবিন ফোরকান
আজ প্রথম আসমানের পেন্টহাউজের দুইতলায় উঠেছে রোযা।এমন নয় যে আসমান কখনো তাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।কিন্তু কখনোই দানবটির নিজস্ব ডেরায় পদার্পণের ইচ্ছা এর পূর্বে রোযার হয়নি।একই ছাদের তলায় বসবাস করলেও নিজেদের অভ্যন্তরীণ সীমানা কোনোদিন অতিক্রম করেনি আসমান কিংবা সে।শুধুমাত্র কিচেন এবং হলঘরেই সাক্ষাৎ হতো।তবুও কম কথার মানুষ আসমান অধিকাংশ সময়ই রোযার উপস্থিতির পরোয়া করতোনা।
নিচতলা ঠিক যতটা আলোয় উদ্ভাসিত দুই তলা তার দ্বিগুণ পরিমাণ অন্ধকারাচ্ছন্ন।প্রতিদিন নিয়ম করে কাচের দেয়ালের ভারী পর্দা সরিয়ে দেয় রোযা।
তাতে সূর্যরশ্মি এবং হাওয়ার চলাচল অবাধ হলঘরে।কিন্ত দুই তলা কেমন যেনো আবদ্ধ। দেয়ালের বর্ণও ফ্যাকাশে।একটি জানালারও পর্দা সরানো হয়নি।তাতে কেমন গুমোট হয়ে রয়েছে চারিপাশ।এখানে পা রাখতেই অদ্ভুত এক চাপ অনুভূত হলো রোযার বুকে।করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হলো যেন মানুষের বাসস্থানে নয় বরং কোনো পরাশক্তির আস্তানায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে সে।আসমানের রুমটা ঠিক কোনদিকে তাও জানা নেই তার।অলিগলির মতন করিডোরগুলোর গন্তব্য কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা কল্পনা করে রোযা শিউরে উঠলো।কোনো এক গুপ্তকক্ষে সে নিজেকে আবিষ্কার করবেনা তো যেখানে মানুষদের ব*ন্দী করে অত্যা*চার করা হয়?এক কথায় যাকে বলে—টর্চা*রসেল!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আসমানের বাড়িতে টর্চা*রসেল আবিষ্কৃত হলে মোটেও অবাক হবেনা রোযা।
মাথা ঝাঁকিয়ে মস্তিষ্ক থেকে অশুভ চিন্তাসমূহ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে এগিয়ে গেলো সে।এতদূর এসে পিছিয়ে পড়ার কোনো মানে হয়না। ভরদুপুরেও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকা করিডোর ধরে আরো একটু অগ্রসর হওয়ার পর মৃদু এক সঙ্গীতের মূর্ছনা কর্ণগোচর হলো রোযার।যেন বহুদূর থেকে কোনো বাদকদল সুরের মোহো বিলিয়ে এগিয়ে আসছে ক্রমে ক্রমে।গানটির শব্দগুচ্ছ বোঝা সম্ভব হচ্ছে।পপ সম্রাট আযম খানের অনবদ্য সৃষ্টি।
~সারা রাত জেগে জেগে
কত কথা আমি ভাবি
পাঁপড়ি কেনো বোঝেনা
তাই ঘুম আসেনা~
আসমানের সঙ্গীতের নির্বাচন শুনে রোযা কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে রইলো।সে কখনো ভাবেনি যে আসমান নব্বই দশকের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।সবকিছু তো বাদই।আসমান যে গানও শুনতে পারে তা কল্পনা করেই রোযার অদ্ভুত লাগছে।তার দানবীয় সত্তার সঙ্গে সঙ্গীতের মতন একটি মাধুর্যপূর্ণ শিল্প মানানসই নয়।
এই ভরদুপুরে গান বাজিয়ে কি আদও কিছু অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছে আসমান?অবশ্য তার ডেরায় বর্তমানে মধ্যরাত চলছে, সেক্ষেত্রে করতেও পারে।একটি নিঃশ্বাস ফেলে রোযা চুপচাপ অনুমানের উপর ভর করে এগোলো,সঙ্গীতের সুর যেখান থেকে ভেসে আসছে সেদিকে।কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে সুবিশাল এক কক্ষে আবিষ্কার করলো সে।
রুমটিকে রোযার কোনো ফুটবল খেলার ময়দান ব্যাতিত ভিন্ন কিছু মনে হলোনা, এতটাই দৈর্ঘ্য প্রস্থের অধিকারী তা।তবে সজ্জিত পরিপাটি আসবাব ঘোষণা করে দিলো যে এটি একটি মানুষের বসবাসযোগ্য স্থান।কক্ষটির বাম দিকের দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে বিছানা। ইন্টেরিয়রের সঙ্গে মিল রেখে সাদা কালো বেডশিট কভারে আবৃত তা।কিছুটা পাশে দেয়ালজুড়ে অগণিত তাক।সেসব তাকজুড়ে রয়েছে দেশী বিদেশী বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের সংগ্রহ।প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করে সঙ্গে নিয়ে আসা ট্রেখানা সোফাসেটের সামনে রাখা ছোট টি টেবিলে রেখে রোযা এগিয়ে গেলো বইয়ের সাম্রাজ্যের পানে।মুগ্ধ নয়নে সে হাত বোলাতে থাকলো একের পর এক বইয়ের মলাটজুড়ে।বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে জন কিটস কিংবা গী দ্যা মোপাসা; কোনো সাহিত্যিকের লেখনীর অভাব নেই এখানে।ইটালিয়ান, আরবী, জাপানিজ, এমন সব ভাষার বইও রয়েছে যা রোযার অজ্ঞাত।
বইয়ের তাক বাদেও ক্লোজেট রয়েছে।তার পাশে ট্রিপল মনিটরের ডেস্কটপ সেট।সি পি ইউর স্বচ্ছ বডির ভেতরে মৃদু আভায় জ্বলছে নিভছে লাল নীল বাতিগুচ্ছ।কখনো কখনো আবার রং পরিবর্তন করে হয়ে যাচ্ছে বেগুনী কিংবা হলুদ।সামনে গেমিং চেয়ারখানায় ঝুলছে একটি টি শার্ট।জয়স্টিক পড়ে রয়েছে সেই চেয়ারের মোলায়েম কুশনের সঙ্গে।
বিছানার পাশের দেয়ালটি সম্পূর্ণ মিরর গ্লাসে তৈরী।ধূসর পর্দায় ঘেরা,শুধুমাত্র একটুখানি ফাঁক যার ভেতর দিয়ে ভেতরে দিবাকর উকি দিতে সক্ষম হচ্ছে। উল্টোদিকে একটি স্লাইডিং ডোর,খুব সম্ভবত বাথরুম কিংবা ট্যারেসে যাওয়ার রাস্তা।রুমটিতে আরো কিছু জিনিস রয়েছে।তবে রোযার সম্পূর্ণ মনোযোগ ধরে রাখলো বইভর্তি তাকগুলোই।দুই আঙ্গুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে দেখতে থাকলো।মাঝখানের বিভিন্ন তাকে বই বাদেও রয়েছে ছোট ছোট বিদেশী ফুলের চারা সম্বলিত উদ্ভিদ কিংবা সৌন্দর্য্যবর্ধক অ্যাকুরিয়াম যাতে তিরতির করে সাঁতার কেটে চলেছে একজোড়া গোল্ডফিশ।
তবে একটিমাত্র জিনিস রোযার নজর কাড়লো।ঠিক মাঝ বরাবর তাকে, অর্থাৎ উপর নিচ বাম কিংবা ডান যেদিক থেকেই হিসাব করা হোক না কেনো একদম মধ্যখানে পড়বে এমন তাকটিতে একটি পুতুল রাখা।কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের সমান উচ্চতার একটি টেডি বিয়ার।কালো পশমে আবৃত মখমলি শরীরে যুক্ত রয়েছে ডাগর ডাগর নীলচে চোখ।যেন একবুক অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছে।বাচ্চাদের খেলনা হিসাবে লাল,গোলাপী,হলুদ, সাদা এমনকি সবুজ বর্ণের টেডিও রোযা দেখেছে কিন্তু কালো!রংটাকে অশুভ হিসাবে গণ্য করা হয়।এই বর্ণের পুতুল বিনা কারণেই অস্বস্তিদায়ক হতে পারে।টেডি বিয়ারটিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শিকারী প্রাণীর মতন তাকিয়ে নীরবে পরিদর্শন করছে সবকিছু।
ব্ল্যাক প্যান্থার! হ্যাঁ,কিছুটা ওই প্রাণীর প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই টেডি বিয়ারের মাঝে। অমোঘ এক আকর্ষণে রোযা পুতুলটি ছুঁয়ে দিলো।নিজের হাতে নিয়ে আঙুল বোলালো মসৃণ রোমশ শরীরে।
ঠক করে মৃদু একটা শব্দে কিছুটা চমকে উঠে ঘুরে তাকালো রোযা।রুমের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আসমান।পাশের টেবিলে একটি পানির বোতল রেখেছে, তারই শব্দ হয়েছে।বর্তমানে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রোযার দিকে।না চাইতেও আসমানের সর্বাঙ্গ অবলোকনে বাধ্য হলো রোযা। হাতাবিহীন গেঞ্জী এবং থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে। ঘাড়ে ঝুলছে একটি সাদা তোয়ালে।
বাহু এবং পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ উন্মুক্ত থাকায় নজরে পড়ছে তার অস্বাভাবিক ধরনের শুভ্রতা।সেই শুভ্রতার মাঝে চিকচিক করছে ঘামের ফোঁটা।কপালে লেপ্টানো সিক্ত চুল এবং শারীরিক কাঠামোতে আটসাঁট হয়ে থাকা বস্ত্র ঘোষণা করে দিচ্ছে শরীরচর্চা করছিল সে।আসমানের অপর হাতে ছোট্ট একটি ব্লুটুথ ডিভাইস যা সঙ্গীতের ধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছিল।সেটিও টেবিলে রেখে আসমান ফিরল রোযার দিকে।
এক সেকেন্ড,দুই সেকেন্ড…. তিন সেকেন্ডের মাথায় আসমান রীতিমত তরঙ্গের গতিতে পৌঁছলো রোযার কাছে।এক ঝটকায় তার হাত থেকে কেড়ে নিলো টেডি বিয়ারটি।আসমানের গাঢ় কাজলকালো নয়নে রোযা বিতৃষ্ণা খেয়াল করলো,তার সঙ্গে চরম এক ক্রোধ! এই ক্রোধ ঠিক কিসের জন্য?বিনা অনুমতিতে তার কক্ষে প্রবেশের জন্য?নাকি তার জিনিস স্পর্শের জন্য?
– আ…আমি…
রোযা বলতেও পারলোনা।এর আগেই আসমানের বাম হাত সহসাই চেপে ধরলো তার কন্ঠ!দেয়ালের তাকে সজোরে ধাক্কা খেলো রোযা। ধপাধপ ফ্লোরে আছড়ে পড়লো কয়েকটি বই।আসমানের এমন আচরণে রোযা পুরোই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে।তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে আসমান নিজেও নিজের মাঝে নেই।যেন কোনো অশরীরী ভর করেছে তার উপর।নিঃশ্বাস নেয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে রোযার জন্য।দুই হাতে আসমানের হাত আঁকড়ে ধরে সে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলো।
– আ… আক..
উচ্চারণ করতে গেলেই আরো শক্ত হয়ে চেপে বসছে আসমানের হাত।সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিতে চাইছে সে রোযাকে।ভ্রু কুঁচকে বহু কষ্টে রোযা রীতিমত ধমকের সুরে বলে উঠলো,
– আসমান!
সহসাই থমকে গেলো আসমান।তার নয়নমাঝের কৃষ্ণগহ্বর বিলীন হয়ে তাতে ভর করলো কিঞ্চিৎ বিস্ময়।ছেড়ে দিলো সে রোযাকে।তাকের গায়ে হেলান দিয়ে কাশতে থাকলো রোযা।অপরদিকে দূরে সরে গেলো আসমান।তার ডান হাতে শক্তভাবে সে ধরে রেখেছে টেডি বিয়ারটি।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আসমানের দিকে তাকালো রোযা। ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে সে।শরীর এখনো অক্সিজেনের চাহিদা পুষিয়ে উঠতে পারেনি।চোখ মেলে আপাদমস্তক রোযাকে একবার পর্যবেক্ষণ করলো আসমান।তার দৃষ্টি থামলো রোযার গলায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকা লালচে বর্ণের আঙুলের চিহ্নের দিকে।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে উল্টো ঘুরে গেলো সে। টেডি বিয়ারটি নিজের বুকে তুলে ধরে রাখলো।তার এমন অদ্ভুত আচরণে রোযা রীতিমত বুঝতেই পারছেনা কি বলবে কিংবা কি করবে।আসমানকে হঠাৎ করেই বড্ড ভয় পাচ্ছে সে।দীর্ঘ একটি মুহূর্ত নীরবতার মাঝে কাটলো।ঠিক নীরবতা বলা উচিত নয় অবশ্য।কারণ,
~তুমি আমি কেনো দূরে দূরে
খুঁজে বেড়াই ঘুরে ঘুরে
মন কি যে চায়
কারে শুধু বেদনায়
পাঁপড়ি কেনো বোঝেনা
তাই ঘুম আসেনা~
ব্লুটুথ স্পিকার থেমে নেই।মূর্ছনায় সে মাতোয়ারা করে তুলেছে সমগ্র পরিবেশ।রোযা চোখ বুজে দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে নিজেকে শান্ত করলো।তারপর বললো,
– আমি দুঃখিত।বিনা অনুমতিতে আপনার রুমে আসার জন্য।
আসমান তখনো পিছন ঘুরেই দাঁড়িয়ে আছে।সামান্যতম নড়লোনা সে।রোযা মেঝেতে পড়ে থাকা বইগুলো সাবধানে তুলে সালাম করে তাকে গুছিয়ে রাখতে রাখতে জানালো,
– আপনার খাবার নিয়ে এসেছিলাম।যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে চলে আসলেন।
এবারও কোনো উত্তর করলোনা আসমান।রোযা আড়চোখে দেখলো টেডি বিয়ারটির দিকে চেয়ে আছে সে।অদ্ভুত এক বন্ধন রয়েছে তার এবং এই পুতুলটির মাঝে।অনুধাবনে বেগ পেতে হলোনা রোযাকে।হয়ত সেই কারণেই রোযা সেটি স্পর্শ করায় অমন প্রতিক্রিয়া করেছিল।
– আ…আমি যাচ্ছি।আপনি…খেয়ে নেবেন।
দ্রুত উচ্চারণ করে রোযা চলে যেতে উদ্যত হচ্ছিলো।কিন্তু সে রুমের বাইরে পা রাখার আগেই আসমানের কন্ঠস্বর ধ্বনিত হলো,
– দাঁড়ান।
থমকে গেলো রোযা।মাথা কাত করে চাইলো পিছনে।আসমান তার দিকে ফিরে ইশারায় সোফায় বসতে বললো।একটি ঢোক গিলে আজ্ঞা পালন করলো রোযা।আরামদায়ক গদির সোফায় বসে আসমানের কর্মকাণ্ড দেখতে লাগলো।প্রথমে তাকের কাছে ফিরে গিয়ে টেডি বিয়ারটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিলো সে।তারপর উল্টো ঘুরে গেলো কক্ষের অন্যপ্রান্তে।এখানে যে একটি মিনিফ্রীজ রয়েছে তা প্রথমে খেয়াল করেনি রোযা।কিন্তু তাহলে আসমান নিচে কেনো গেলো পানি আনতে?পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে?হবে হয়ত। মিনিফ্রীজ খুলে ভেতর থেকে একটা আইসপ্যাক বের করলো আসমান।তারপর ফিরে এলো রোযার কাছে।আলতো করে জিনিসটা সে ছুঁয়ে দিলো তার গলায়।রোযার একটি হাতের তর্জনী ছুঁয়ে তুলে সেটি আইসপ্যাকে ঠেকিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নিলো।ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থাকল রোযা।
কিছু না বলেই রোযার বিপরীতে সোফায় বসলো সে।হেলান দিয়ে একপাশের কাচের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলো একদৃষ্টে। এই ছেলের কি সরি বলতে বাঁধছে নাকি?তার আচরণে স্পষ্ট যে সে পরোয়া করে, তাই রোযাকে বরফ লাগাতে দিয়েছে কিন্তু ক্ষমা চাইতে পারছেনা।ব্যাপারটা রোযার কাছে কিছুটা উপভোগ্য ঠেকলো।
– এস ও আর আর ওয়াই… শব্দগুলো একসঙ্গে উচ্চারণ করলে শোনায় ‘সরি’।
রোযার বক্তব্য শুনে আসমান মাথা ঘুরিয়ে চাইলো।তার দৃষ্টি সরু হয়ে এলো।যেন বুঝতে চাইছে রোযা তার সঙ্গে রসিকতা করছে কিনা।তার এমন অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা বেমালুম ভুলে রোযা ফিক করে হেসে উঠলো। আইসপ্যাকটি থপ করে পড়লো তার কোলে।সেটি পুনরায় তুলে হাসতে হাসতে গলায় চেপে ধরলো রোযা।তার দিকে তাকিয়ে আসমান নিজের হাঁটুর উপর পা তুলে দিয়ে বুকের উপর উভয় বাহু ভাঁজ করে রেখে বসল।
– আই সি…সো ইউ লাইক বিইং চোকড!
সহসাই থমকে গেলো রোযা।তার হাসি মিলিয়ে চেহারায় ভর করলো লালিমা।আসমান কথাটি ঠিক কি অর্থে বলেছে তা তার জানা নেই,কিন্তু সে নিজে যে অর্থ মিলিয়েছে তা অতি উচ্চ পর্যায়ের অপ্রীতিকর ব্যাপার!আসমান এমন একটা কথা বলতে পারলো?তাও তাকে?
– আস্তাগফিরুল্লাহ….
– গলা চে*পে ধরার পরেও আপনি বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে হাসছিলেন।ভালো লাগলো কিনা জিজ্ঞেস করতেই এখন আস্তাগফিরুল্লাহ?
আসমানের কন্ঠ অত্যন্ত নির্বিকার শোনাচ্ছে যার দরুণ অতিরিক্ত লজ্জাবোধ করছে রোযা।এই ধরনের কোনো কথা কিভাবে কেউ এতটা বেপরোয়াভাবে বলতে পারে তা সে ভেবে পাচ্ছেনা।অস্বস্তি সহ্য হলোনা রোযার। আইসপ্যাকটা আসমানের দিকে ছুঁড়ে দিয়েই সে তড়িৎ কন্ঠে বললো,
– একটা ছোট্ট সরি বললেই হতো!এত নাটক কেনো করতে হয় বুঝিনা বাপু! পুতুলটা শুধু ধরেছি খেয়ে তো ফেলিনি!
এক হাতে আইসপ্যাকটা ক্যাচ ধরে মুঠো পাকিয়ে আসমান বিড়বিড় করলো,
– আর কখনো ধরবেন না।
– কেনো?ওটাতে কি আপনার প্রাণভোমরা বসবাস করে? রূপকথার গল্পের ডাইনী রাক্ষ*সদের মতন?
স্বভাবতই এই প্রশ্নের জবাব আসমান করলোনা।তার দৃষ্টি পুনরায় এক অশুভ ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়লো।
– আপনার সাথে একটু রসিকতাও করা যায়না দেখছি।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলো রোযা।তাতে আসমান তার দিকে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
– আমি কি কমেডিয়ান যে আমার সঙ্গে রসিকতা করবেন?
– খোদা!আমার ভুল হয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দিন।সরি আমি বলছি আপনাকে!খুশি?
উত্তর না দিয়ে একই ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো আসমান।অপরদিকে নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে রোযা মাথা ঝাঁকালো।এই ছেলের সঙ্গে কথা বলা যু*দ্ধে ঢাল তলোয়ারবিহীন লড়াই করার সমান।
– সে যাক।আপনাকে আরেকটি কথা বলার ছিল।ধন্যবাদ।
আসমান আগ্রহবোধ না করে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু ধন্যবাদ শব্দটি উচ্চারিত হতেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইলো রোযার দিকে।
– ফর চোকিং ইউ?
দ্বিতীয় দফায় লজ্জায় টকটকে হয়ে উঠল রোযা।তার অধরজোড়া একে অপরের সঙ্গে চেপে বসলো, মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো দুটি হাত।কিছুটা কাপতে কাপতে সে আসমানের মুখের উপর জবাব দিলো,
– ফর সেভিং মি ইডিয়ট!
মাস্কের আড়ালে আসমানের চোখের নিচের অংশ কিছুটা উপরে ভেসে উঠলো।সে কি হাসছে?নিশ্চিত হতে পারলোনা রোযা।এই ছেলে রসিকতা পছন্দ করেনা বলে নিজেই রোযার সঙ্গে রসিকতা করতে শুরু করেছে।কিন্তু তাই বলে সে হাসবে?আসমান হাসবে?অসম্ভব!রোযা নিশ্চয়ই উত্তেজনায় অধিক কল্পনা করছে।বহু কষ্টে নিজেকে প্রশান্ত করে রোযা বললো,
– গতকাল রাতে আমাকে রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ।এবং….আমার দাদুকেও এখানে এনে রাখার ব্যবস্থার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।আমি আপনার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
রোযার রাশভারী কন্ঠে উভয়ের মধ্যকার বিনোদনের পরিবেশ বদলে তাতে বাস্তবতা ভর করলো।আসমান কিছুক্ষণ নীরব থাকলো।পরক্ষণে প্রশ্ন করলো,
– আপনি তাহলে কলগার্ল নন?
উত্তরে ডানে বামে মাথা নাড়লো রোযা।তার দৃষ্টি বর্তমানে মেঝের দিকে।আসমান স্থির নজরে তাকে অবলোকন করতে থাকলো।সত্যি বলতে তার কোনো ধারণাই ছিলনা যে রোযা বাধ্য হয়ে এমন এক উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে।শুরু থেকেই সে রোযাকে ভেবে এসেছে অভিজ্ঞ একজন দে*হব্যবসায়ী হিসাবে।তাই নিজের কাজে ব্যবহার করেছিল অবাধভাবে।কিন্তু মেয়েটিকে কাছাকাছি বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণের পর তার মনে হয়েছে আদতে এসব ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা খুব একটা নেই বললেই চলে।তার উপর যখন তার দাদুর ব্যাপারটা উন্মোচিত হয় তখন আসমান সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হয় নিজের ধারণা সম্পর্কে। রোযার বক্তব্য তার ধারণাকে আরো অধিক নিশ্চায়িত করলো।
– সে….সেদিনই প্রথম আমি… মিস্টার আলাউদ্দিনের কাছে গিয়েছিলাম।কিছু হওয়ার আগেই আপনি…
ইতস্তত করলো রোযা।
– আমাকে আগে বলেননি কেনো?
– আমার টাকার দরকার ছিল…. দাদুর জন্য।
– কতদিন ধরে অসুস্থ উনি?
– দেড় বছর।
– কোন স্টেজ?
– ফোর্থ….
ক্যান্সারের শেষ স্টেজ।অর্থাৎ ইউনূস রহমানের বাঁচার আশা নেই বললেই চলে।এরপরও তার জন্য রোযার এতটা সংগ্রাম?আপনজনের জন্য মানুষ কত কীই না করতে সক্ষম!
সিক্ত হয়ে উঠছিল রোযার চোখ।মাথা ঝাঁকিয়ে সে আঙুল দিয়ে অত্যন্ত দ্রুত তা মুছে নিয়ে বললো,
– আমি জানি।আমি আপনাকে যতটুকু সাহায্য করছি তার বিনিময়ে এতকিছু লাভ যুক্তিযুক্ত নয়।তাই আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনার জন্য সবকিছু করার।সবশেষে একটা অনুরোধ থাকবে আপনার নিকট।
আসমান কিছু না বলে শুধু রোযার কথা শুনে গেলো।
– আমার দাদুকে প্লীজ বুঝতে দেবেন না যে আমার আপনার সম্পর্কটা…একটা চুক্তি।আমি চাই দাদু আমাকে সুখী হতে দেখুক।এই ভেবে শান্তি পাক যে আমি ভালো আছি।
– সেটা করতে হলে আমাকে আপনি বলা বন্ধ করতে হবে আপনার।
চোখ পিটপিট করে আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকলো রোযা।পুনরায় সোফায় হেলান দিয়ে আসমান সিলিংয়ের দিকে মুখ করে বললো,
– আপনার দাদু আপনাকে অনেক ভরসা করেন বোঝা যায়।আমরা তার সামনে একে অপরকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে দাবি করি আমাদের নাকি প্রেমের বিয়ে।একই বাড়িতে থাকি ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে।মানুষ মাত্রই প্রশ্ন করার কথা ছিল।আপনার দাদু এখনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি এর অর্থ একটাই।তিনি আপনাকে বিশ্বাস করেন,রীতিমত অন্ধবিশ্বাস।
বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো রোযা।আসমানের প্রত্যেকটি বাক্য সত্য।এই বিষয়ে ভালোমত চিন্তাভাবনা করার অবকাশ সে পায়নি।কিছুটা ইতস্তত করে অবশেষে রোযা বললো,
– তা…তাহলে এখন?
– আমাকে তুমি বলে ডাকো।আমিও তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করবো।
আসমানের কন্ঠে ‘তুমি’ সম্বোধনে রোযার হৃদয় এক মুহূর্তের জন্য উথলিত হয়ে উঠলো।নিজের অজান্তেই আলতো করে বুকের বাম পাশটা স্পর্শ করলো সে।চাইলো ভিন্নদিকে।
– ঠ…ঠিক আছে আমি আপনাকে… তোম…তোমাকে তুমি বলে ডাকবো।
– আর আলাদা থাকার ব্যাপারটা, তোমার দাদুর খেয়াল রাখার জন্য নিচতলায় থাকছো সেই হিসাবে চালানো সম্ভব না হলে দুইতলায় চলে এসো।এখানে আরেকটি বেডরুম আছে। উপরে উঠে কেউ দেখবেনা একই রুমে থাকছি কি না।
– আচ্ছা।
রোযার ঠোঁটে বিস্তর এক হাসি ফুটে উঠলো।তার অন্তর প্রফুল্লতায় ছেয়ে গিয়েছে।প্রথমত নিজের দাদুর জন্য একটা ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে।দ্বিতীয়ত…. এই প্রথমবার আসমানের সঙ্গে এত দীর্ঘক্ষণ জুড়ে আলাপচারিতা করা সম্ভব হয়েছে।ছেলেটা সাধারণত দুই এক শব্দ,খুব বেশিতে কয়েকটি বাক্য ছাড়া কিছুই উচ্চারণ করতে চায়না।কিন্তু আজ সে সত্যিই কথা বলেছে,রীতিমতো বিশ্লেষণমূলক কথা।
– আমি তাহলে গেলাম। বিরিয়ানী বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবেনা। খেয়ে নেবেন তাড়াতাড়ি।
আসমান ভ্রু উচু করে চাইতেই রোযা দ্রুত নিজেকে শুধরে নিলো,
– খেয়ে নিও তাড়াতাড়ি!
একটি শিরশিরে অনুভূতি শরীরে খেলে যেতেই রোযা পা বাড়ালো বেরোনোর উদ্দেশ্যে।কিন্তু দরজার সামনে থমকে গেলো।ফিরে চাইলো।আসমান তখনো সোফায় চুপটি করে বসে আছে।একটি হাত বুলিয়ে যাচ্ছে নিজের কিছুটা এলোমেলো হয়ে থাকা চুলের গুচ্ছে।
– একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে…তোমাকে?
আসমান মাথা কাত করে তাকালো।দৃষ্টিতে প্রশ্ন ঝুলছে।রোযা ঠোঁট কামড়ে অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি সবসময় মাস্ক পড়ে থাকো কেনো?
আসমানকে শান্তই দেখালো। আস্তে করে সে মাথা ঘুরিয়ে নিলো।রোযা ভাবলো সে জবাব দেবেনা।তাই কক্ষের বাইরে পা রাখলো যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
– কলংক ঢাকতে।
আসমানের কন্ঠ কর্ণগোচর হলো রোযার।তবুও সে থামলোনা।বাইরে চলে গেলো।পিছন ফিরেও আর তাকালোনা।সোজা হেঁটে চললো করিডোর ধরে, যান্ত্রিক রোবটের মতন।তার কানে বাজতে থাকলো একটিমাত্র শব্দ—কলংক!একবার নয়,বারংবার।
হোমকেয়ার হাসপাতালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আছেন বাদশাহ কায়সার।নিশ্চল তার অবয়ব,শংকিত তার অভিব্যক্তি।ফরমাল প্যান্টে উভয় হাত ঢুকিয়ে রেখেছেন যেন আশেপাশে দাঁড়ানো তার লোকেরা কিছুতেই তার অভ্যন্তরীণ কম্পন টের না পায়।নিজের দৃষ্টির সম্মুখের দৃশ্য তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।যেন কোনো অ্যাকশন সিনেমার স্টেজপ্লট তার সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
লণ্ডভণ্ড চারপাশ।দেয়াল থেকে শুরু করে মেঝে পর্যন্ত র*ক্তের নদী শুকিয়ে খা খা মরুভূমির মতন খটখটে হয়ে রয়েছে।তার মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোটা দশেক মৃ*তদে*হ।সিসিটিভি রুম এবং গাড়ি থেকে উদ্ধার করা দে*হগুলোও এখানে এনে রাখা হয়েছে।জায়গাটি বর্তমানে হাসপাতাল নয় বরং রায়েরবাজার বধ্যভূমি বলে মনে হচ্ছে।কে এই নারকীয় তা*ণ্ডবের স্রষ্টা?একটিমাত্র নামই বারবার ঘুরেফিরে আসছে বাদশাহ কায়সারের হৃদয়জুড়ে।আজকের পর আর কোনোপ্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই।
ফিরে এসেছে সে।
ফিরে এসেছে আসমান!
– স্যার?
আকাশের কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরলো বাদশাহ কায়সারের।আতঙ্কের দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরে চেয়ে থাকলেন ধূসর বর্ণের সুট পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা আকাশের দিকে।
– কেউই জীবিত নেই।সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করা হয়েছে। যন্ত্রাংশও নষ্ট হয়ে আছে। খু*ন ক*রতে যে হাতিয়ার ব্যবহার করেছে তাও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে।কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি।মেয়েটির দাদুকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।এক কথায়…
– অতি সূক্ষ্ম কাজ।বিন্দুমাত্র ভুলের অবকাশ নেই কোথাও। সমস্ত সূত্র প্রমাণ উধাও।জীবিত নেই কোনো প্রত্যক্ষদর্শী।
বাদশাহ কায়সার আনমনে বিড়বিড় করলেন।আকাশ সম্মতি জানিয়ে বললো,
– জ্বি স্যার।কাজের টেকনিকে মিল পাচ্ছেন নিশ্চয়ই।এতটা সূক্ষ্মভাবে মিশন শুধুমাত্র একজনের পক্ষেই সম্পন্ন করা সম্ভব ছিলো…
– আসমান!
উচ্চারণ করলেন বাদশাহ।তার চেহারা ছেয়ে গেলো বর্ষণের আগমুহূর্তে উদ্ভুত ঘন কালো মেঘপুঞ্জে।আকাশ শুধু তাকিয়ে থাকলো।কিছুই আর বলার কিংবা বোঝার মতন অবশিষ্ট নেই কারো।
বিশ মিনিটের মাথায় হোমকেয়ার হাসপাতাল থেকে নিজের মার্সিডিজ বেঞ্জে করে বেরিয়ে পড়লেন বাদশাহ কায়সার।তার পাশের সিটেই আকাশ। কোলের উপর একটি আইপ্যাড নিয়ে একদম নিষ্পলক নিশ্চুপ হয়ে সে বসে আছে।অদ্ভুত এক গুমোট পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে গাড়ির ভেতর।বাদশাহ নিজেও যথেষ্ট দ্বিধান্বিত হয়ে আছেন।গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের শহরের পানে চেয়ে ললাটে আঙুল ঠেকিয়ে তিনি ভাবতে থাকলেন।সবকিছুই তার কাছে বর্তমানে স্পষ্ট।আলাউদ্দিন, নাবিল এবং পরবর্তীতে সান্দ্রো….হিসাব বরাবর মিলে যাচ্ছে।
কেনো তাদের নৃ*শং*সভাবে খু*ন হতে হয়েছে সেই রহস্যের সমাধান আজ তার সামনে পানির মতন স্বচ্ছ হয়ে ধরা দিয়েছে।তার সঙ্গে এটিও নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, তার ছেলে দুর্ঘটনা নয় বরং হ*ত্যাকা*ণ্ডের শিকার!অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং য*ন্ত্রণাময় এক হ*ত্যা!পিতা হিসাবে সন্তানের অবস্থার কথা চিন্তা করেই তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গজুড়ে হিমশীতল শিহরন খেলে যাচ্ছে।না,আর কাউকে এমন পরিণতি বরণ করতে দেয়া যাবেনা।বেশ দীর্ঘ মুহূর্ত পার হলো নীরবে।আকাশ এবং বাদশাহ উভয়ই বর্তমানকে বিশ্বাস করে উঠতে বেগ পোহাচ্ছে।
গাড়ি যখন আলিশান ধানমন্ডির সড়কে পৌঁছলো তখন মুখ খুললেন বাদশাহ। দূর দিগন্তে চেয়ে তিনি আদেশ প্রদান করলেন,
– কল আ মিটিং, আই ওয়ান্ট এভরিওয়ান প্রেজেন্ট।আমাদের এক্সপার্টেস্ট টিমকে খবর দাও। হিটটিম, সাইবার টিম, সার্ভিলেন্স টিম, অ্যাস্যাসিন… প্রত্যেককে স্ট্রিক্ট অর্ডার দাও।যেকোনো মূল্যে আসমানের অবস্থান লোকেট করতে হবে!শিকারী আক্র*মণ করার আগেই আমাদের আক্র*মণ করতে হবে,নাহলে এ লড়াই জেতা অসম্ভব!
নিঃশব্দে তা শুনে গেলো আকাশ। সদা শান্ত তার হৃদয়মাঝেও আজ কালবৈশাখীর ঘূর্ণিঝড় উঠেছে।তোলপাড় ঘটিয়ে দিচ্ছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রবাহ, হৃদতীরে আছড়ে পড়ছে আতঙ্কের জোয়ার।
এতগুলো ক্ষমতাবান মানুষের রাতের ঘুম হারাম করতে একটিমাত্র মানুষের নামই যথেষ্ট।ওহ মানুষ তো নয়….কি*লিং মেশিন।
মারবেল ভবন।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা।কিছুক্ষণ আগেই দাদুকে খাবার এবং ঔষুধ সেবন করিয়ে তাকে বিশ্রামে রেখেছে রোযা।নবনিযুক্ত নার্স রয়েছে সঙ্গে।তার যথাযথ খেয়াল রাখে মেয়েটি।তবুও দাদুর যত্ন নিতে সর্বদাই অগ্রগণ্য থাকে রোযা।
এই মুহূর্তে ড্রেসিং রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অবয়ব মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে অবলোকন করে চলেছে সে।আসমানী রঙের গাউন পোশাকটি তার দৈহিক কাঠামো এবং চন্দন বর্ণের ত্বকের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে।একটি পার্লস বিডের চোকার গলায় এবং ছোট্ট দুটি পাথরের দুল দ্যুতি ছড়াচ্ছে কানের লতিতে।লম্বাটে চুলগুলো খোঁপা করে তাতে গুঁজে দেয়া হয়েছে সাদা গোলাপ।এই সম্পূর্ণ সাজের মূল কারিগর চারুলতা বর্তমানে তার গাউনের পিছনের ফিতা বাঁধতে ব্যাস্ত।
নিজেকে রীতিমত কোনো রূপকথার গল্পের রাজকন্যা অনুভূত হচ্ছে রোযার।কোন রাজকন্যা?সিন্ডারেলা?জেসমিন?কিংবা স্নো রূপাঞ্জেল?আপনমনে হাসলো রোযা।শাড়ি,কামিজ এসবের সঙ্গে সাজগোজের অভ্যাস তার রয়েছে।কিন্তু আজকের মতন চমৎকার তার নিজেকে কোনোদিন লাগেনি।
– হুম। পারফেক্ট।
বলে কয়েক কদম সরে দাঁড়িয়ে আয়নায় রোযাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো চারুলতা। পিছনে ঘুরে তার মুখোমুখি হলো রোযা।
– তোমাকে ধন্যবাদ চারু।
মুক্তোর মতন দাঁত দেখিয়ে হাসলো চারুলতা।রোযা সম্মোহিতের মতন চেয়ে থাকল।মেয়েটি আসলেই অত্যন্ত সুদর্শনা।রেড ওয়াইন বর্ণের বডিকন গাউনের সঙ্গে লালচে মিশ্রিত মসৃণ চুলে তার সৌন্দর্য্য আরো ব্যাপকভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে।সত্যিকার অর্থে রোযা নিশ্চিত যে সে এবং চারুলতা পাশাপাশি দাঁড়ালে তাকে চোখেই পড়বেনা।চারুলতা এতটাই আকর্ষণ কেড়ে নিতে সক্ষম।
নিজের হাতের ব্রিগেট ঘড়ির দিকে চেয়ে তাড়া দিলো চারুলতা।
– জলদি জলদি…
বলেই গটগট ধ্বনি তুলে চার ইঞ্চি লম্বা হিলে এগোলো চারুলতা। রোযাকেও গ্লাস হিল পড়াতে চেয়েছিল সে।কিন্তু হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার ভয়ে গাউনের নিচে কেউ দেখবেনা বলে ফ্ল্যাট বেছে নিয়েছে রোযা।
হলঘরে পৌঁছতেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটি চোখে পড়ল রোযার। কাউচের উপর বসে নিজের ফোন ঘাটছে আসমান।তার পরিধানে না চাইতেও রোযার দৃষ্টিপাত হলো। সোনালী শার্ট,কালো ক্রপসুট-প্যান্ট এবং চেলসি বুটস ফরমাল।সঙ্গে একটি কালো ব্লেজারও রয়েছে যেটি বর্তমানে কাউচের প্রান্তে দোল খাচ্ছে।অবশ্যই সে নিজের ফেস মাস্কের কথা ভোলেনি।
রোযা এবং চারুলতা একে অপরের দিকে তাকালো।আজকে সিটি ইউফোরিয়ার ইয়ারলি পার্টিতে আসমানের যাওয়ার কথা নয়।চারুর ভাষ্যমতে সে এসবে অংশগ্রহণ করেনা কখনোই।কিন্তু বর্তমানে তাকে এমন তৈরী হয়ে থাকতে লক্ষ্য করে উভয় রমণী দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে।
– ভাইয়া তুই কি কোথাও যাচ্ছিস?
চারুলতার কন্ঠে ফোন থেকে মুখ তুললো আসমান।সেটি পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালো।নিজের ব্লেজারটি তুলতে তুলতে মৃদু কন্ঠে উত্তর করলো।
– তোদের সাথে পার্টিতে।
– কিঃ? আই অ্যাম নট কমপ্লেইনিং বাট তুই হঠাৎ….
– বাবা ফোন করেছিল।যেতে বলেছে।
কিছুটা বিরক্তি নিয়েই আসমান জানালো।তারপর কাউকে কোনপ্রকার প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো।চারুলতা ভাইয়ের পিছু নিতেও রোযাও এগোলো।লিফটে পৌঁছতেই ছাব্বিশ তলায় নামলো চারুলতা,সে কিছু একটা ফেলে এসেছে নিজের ফ্ল্যাটে।আসমান এবং রোযাকে এগোতে বলে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে বলে পগারপার হলো।লিফটের দরজা বন্ধ হতেই সম্পূর্ণ একলা হয়ে পড়ল তারা।
ছাব্বিশ তলা থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতে কিছুটা সময় প্রয়োজন।অস্বস্তিতে পড়ে গেলো রোযা।নিজের অজান্তেই কিছুটা সংকুচিত হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো।তার একদম পাশেই আসমানের নির্বিকার উপস্থিতিও বিনা কারণে তার হৃদস্পন্দনের বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।লিফটের দেয়ালে তার অবয়বের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।ফরমাল পার্টিতে যোগদানের কারণে জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করে চুল সেট করেছে আসমান।এমন রূপে তাকে প্রথমবার দেখায় রোযা নিজের সম্মোহনী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারছেনা।অবাধ্য অন্তর শুধু অবলোকন করতে চায়।সরাসরি তাকানোর দুঃসাহস অবশ্য তার কোনোদিন হবেনা।
হঠাৎ করেই আসমান নড়ে উঠলো।নিজের ব্লেজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি ছোট্ট মখমলে আবৃত বক্স বের করলো।সেটা খুলে বাড়িয়ে ধরলো রোযার দিকে।হতচকিত হয়ে রোযা খেয়াল করলো বক্সের ভেতর একটি সিলভার বর্ণের আংটি,যার উপরটা গাছের লতার ডিজাইনে ফুলের সাহায্যে পেঁচিয়ে তৈরি করা হয়েছে।অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজ। ধাতুটি খুব সম্ভবত প্লাটিনাম।রোযা দৃষ্টি উঁচু করে আসমানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। আসমান তাকে এটা কেনো দিয়েছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা।
– পড়ে নাও। রেমান পরিবারের বউ খালি হাতে পার্টিতে গেলে আজেবাজে কথা উঠবে।
– ওহ।
ছোট্ট করে উচ্চারণ করে আংটিটা তুললো রোযা।সঙ্গে সঙ্গে আসমান খালি বক্সটি পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।বাম হাতের অনামিকায় আংটিটা পড়তে পড়তে লিফটের থেমে গেলো। উনিশতলা। কেউ থামিয়েছে নিশ্চয়ই।দরজা খুলতেই দেখা গেলো এক রমণী দাঁড়িয়ে আছে।তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে নিচে হাঁটতে গিয়ে।বিবাহিত নারী, স্বামী একজন বিজনেসম্যান। দেড় বছর বয়সী একটি বাচ্চা আছে যার নাম রুহি।চারুলতার সঙ্গে খাতিরের দৌলতে পরিচিত হওয়া হয়েছে।আসমান এবং রোযাকে দেখে চওড়া হাসি দিলো রমণী।তার কোলে ছোট্ট রুহি।
– পার্টিতে যাচ্ছেন মিস্টার নীল?
কথা না বলে মাথা নেড়ে সায় দিলো আসমান।রুহিকে এগিয়ে দিয়ে রমণী বললো,
– ওহ আরিয়া…ওকে একটু নিয়ে যাবে?আসলে আমার একটা অনলাইন মিটিং চলছে,একটু দেরী হবে পার্টিতে যেতে।রুহির পাপা নিচে গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছে।একটু হেল্প করবে প্লীজ?
– অব…অবশ্যই।
বলে রুহিকে কোলে নিলো রোযা।রমণী নিজের সন্তানকে চুমু খেয়ে বিড়বিড় করলো,
– বাই মামণি, হ্যাভ ফান উইথ পাপা, আই উইল বি দেয়ার সুন।
আসমান লিফটের বোতাম চাপায় দরজা বন্ধ হয়ে পুনরায় লিফট নামতে শুরু করলো।রোযা রুহির দিকে মনোযোগ দিলো।সত্যিকার অর্থে বাচ্চাদের সঙ্গে সে মোটেও অভ্যস্থ হতে পারেনা।বুঝতেই পারেনা কিভাবে আচরণ করবে।কোনো বাচ্চাকে কোলে নেয়া থেকে সর্বদা বিরত থাকে,নিলেই কাদতে শুরু করে।রুহির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটলো না।লিফট পনেরো তলায় পৌঁছতে পৌঁছতেই রীতিমত পুতুলের মতন দেখতে মেয়েটির চেহারা বিকৃত হয়ে এলো।কান্নার দমক উঠলো সহসাই।
– আ…না না বাবু…কাঁদে না..তোমার বাবা নিচেই আছে আরেকটু…
কান্নায় মুহূর্তেই মুখরিত হয়ে উঠল আবদ্ধ লিফট।রোযা সর্বাত্মক চেষ্টা করলো,পিঠ চাপড়ে দিয়ে, গানের সুর ধরে….কিছুতেই লাভ হচ্ছেনা।কেঁদেই চলেছে মেয়েটি।রোযার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আপ্রাণ, চুল টেনে ধরে খামচেও দিচ্ছে।ঠিক তখনি খানিক রক্ষাকর্তার ভূমিকায়ই আবির্ভূত হলো আসমান।নিজের দুবাহু বাড়িয়ে শান্ত কন্ঠে সে আবেদন জানালো,
– আমাকে দাও।
রোযা থমকে রইলো।আসমান…এবং বাচ্চা?ব্যাপারটা কুমিরের শিয়ালের কাছে নিজের সন্তানদের পড়তে পাঠানোর গল্পের মতন হয়ে গেলনা?রোযা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে খেয়াল করে কিছুটা বিরক্ত হলো আসমান। নিজেই রুহির হাত ছাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো। ডান হাত ধরে বাম হাত রাখলো পিঠের উপর,আগলে নিলো বুকে।এদিক ওদিক দোল খেতে থাকলো।চার সেকেন্ডের মাথায় সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে গেলো রুহি।হতবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই থাকলো রোযা।
– উম… হু ইজ আ গুড গার্ল?রুহি ইজ আ গুড গার্ল। হু ইজ আ প্রিন্সেস?রুহি ইজ আ প্রিন্সেস….
এমন মোলায়েম কন্ঠস্বর আসমানের গলা থেকে বের হচ্ছে তা বিশ্বাসই করতে পারলোনা রোযা।কোথায় সেই ভারিক্কী,গম্ভীর এবং বজ্রশক্ত কন্ঠ!আর কোথায় এই শিশুসুলভ স্নেহপূর্ণ মায়াবী কন্ঠ!মানুষটিকে না দেখে শুধুমাত্র কন্ঠস্বর শুনে রোযা কোনোদিন আন্দাজও করতে সক্ষম হতনা যে উভয়ই একজন।
রুহি শান্ত হয়েছে।রীতিমত খিলখিল করে হাসছে।আসমানের কলার নিজের ছোট ছোট আঙুলে আঁকড়ে ধরে বাচ্চা কন্ঠে ‘আবাবাবা’ উচ্চারণ করে যাচ্ছে।আসমান বাচ্চাটির কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘষে দিচ্ছে,আবার কখনো দোল খাওয়াচ্ছে।দৃশ্যটির দিকে রোযা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো।নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠল অদ্ভুত এক হাসি।এমন কিছু পুরুষ রয়েছে যারা বাচ্চাদের খুব পছন্দ করে।যেমন রোযার দাদু ইউনূস রহমান।কিন্তু আসমানকে সেরকম কেউ হিসাবে কল্পনা করেনি রোযা।এই ছেলে বারংবার তাকে হতবাক করে।তার দ্বারা আর যাই হোক, বাচ্চা সামলানো আশা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার।
পার্টির জন্য একটা সাদা বাটারফ্লাই ফ্রক পরিহিত রুহি এবং তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকা আসমানকে দেখে রোযা অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করলো হৃদয়ে।আসমানের দৃষ্টির কাঠিন্য দূরীভূত হয়েছে তখনি যখন সে রুহিকে কোলে নিয়েছে।বর্তমানে সবথেকে তীক্ষ্ণ অসহনীয় ওই নয়নে রয়েছে উষ্ণতা এবং মুগ্ধতা।
– তুমি এত ভালো বাচ্চা সাম…
বাক্যটি সম্পূর্ণ উচ্চারণ করার আগেই রোযা অনুভব করলো লিফট একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠেছে। উজ্জ্বল বাতিগুলো কয়েকবার জ্বলে নিভে ধপ করে বন্ধ হয়ে গেলো।তার আগে রোযার নজর গেলো স্ক্রিনে, নবম তলায় রয়েছে তারা।সম্পূর্ণ কালিগোলা আধারে লিফট ঢেকে যেতেই রোযা আতঙ্কে দেয়ালের সঙ্গে লেপ্টে গেলো।
ক্যাচ!!
ডার্কসাইড পর্ব ১২
প্রচণ্ড জোরে একটি ধাতব শব্দ হলো।লিফট কি পড়ে যাচ্ছে? রোযার হৃদযন্ত্র থমকে পড়লো।আন্দাজে সে হাত বাড়ালো আশেপাশে,
– আ… আসমান..!
সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাতে শক্ত সামর্থ্য আঙুলের ছোঁয়া পেল সে।তার হাত আঁকড়ে ধরে কাছে টেনে নেয়া হলো সহসাই।নিজেকে আসমানের উষ্ণ বুকে আবিষ্কার করলো রোযা,তার পাশেই রুহি।
– হুশ… সব ঠিক আছে।
আসমানের কন্ঠ ছাপিয়ে কর্কশ আর্তনাদ শোনা গেলো ধাতুর,যেন বলতে চাইছে….না কিছুই ঠিক নেই!
