ডার্কসাইড পর্ব ১৪

ডার্কসাইড পর্ব ১৪
জাবিন ফোরকান

ডিং করে শব্দ হতেই লিফটের দরজা খুলে গেলো।বাইরে বেরোলো আসমান এবং রোযা।সামনেই ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা এবং টেকনিশিয়ানদের ভিড়।যার মধ্যে রুহির বাবাও রয়েছে।তিনি দ্রুত এগিয়ে আসমানের কাছ থেকে নিজের কন্যাসন্তানকে কোলে তুলে নিলেন।অপরদিকে হিল পরিহিত অবস্থায়ও উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে এলো চারুলতা।আসমানের কাধ আঁকড়ে ধরে অত্যন্ত চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,

– তুই ঠিক আছিস?
কিছু উচ্চারণ না করে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল আসমান।একটি নিঃশ্বাস ফেললো চারুলতা।
– থ্যাংক গড!আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম যখন শুনলাম একটা লিফটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তোরা দুইজনই ঠিক আছিস দেখে ভালো লাগছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছুক্ষণ আগেই নিজের ফ্ল্যাট থেকে হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বেরোবার পর চারুলতা টেকনিশিয়ান টিমের দুইজনকে ছোটাছুটি করতে দেখে।সেখান থেকেই জানতে পারে ভবনের মোট তিনটি লিফটের মধ্যে একটি হঠাৎ ত্রুটিজনিত কারণে গড়বড় করছে।দ্রুতই রিপোর্ট পেয়ে কাজে নেমে পড়েছে টিম।তখনি অপর লিফট ধরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছুটে আসে চারুলতা।জানতে পারে আসমান এবং রোযা যে লিফটে ছিল সেটাতেই কোনো সমস্যা হয়েছে।অসহনীয় অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে পাক্কা দশ মিনিট পর।আসমানকে সুস্থ সবলভাবে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চারুলতা।
রোযা তখনো একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে।অন্ধকারাচ্ছন্ন দশ মিনিটে প্রতিটা মুহূর্তে তার মনে হয়েছে এই বুঝি লিফট ছিঁড়ে পড়ে!কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য আসমানের পাশে থাকায় যতটা আতঙ্কিত অনুভব করার কথা ততটা সে করেনি।এমনকি রুহি পর্যন্ত এক ফোঁটা কাদেনি।আসমানের কোলেই কুইকুই করে গিয়েছে সে।ব্যাপারটা কাকতালীয় না আসমানের উপস্থিতির প্রভাব তা জানা নেই রোযার।

– বেশি ভয় পেয়েছ?
চারুলতার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরলো রোযার।মেয়েটি ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে,যেন আশ্বাস প্রদান করতে চাইছে।রোযা একটা ঢোক গিলে বিড়বিড় করলো,
– অতটা না।
– চিন্তা করোনা।ভাইয়া থাকতে আর যাই হোক কারো কোনোদিন ক্ষতি হয়না।
ক্ষতি হয়না?সে নিজেই করে ক্ষতিগুলো!—কথাটা রোযার অন্তর থেকে নির্গত হলোনা।চারুলতা কিংবা তার পরিবার হয়ত আসমানের আসল রূপ সম্পর্কে জানেনা কিংবা জানে?কে জানে! উফ!এত রহস্যের জট সে আর সহ্য করতে পারছেনা!

লিফটের কাহিনীর সমাপ্তি ঘটলো টেকনিশিয়ান এবং মেইনটেনেন্স টিমের কয়েকজন সদস্যের শাস্তির মধ্য দিয়ে।যদিও তাদের খুব একটা দোষ ছিলোনা।কিন্তু ভবনে বসবাসরত উচ্চবিত্ত মানুষগুলোর নিজেদের নিরাপত্তার পরোয়া বিষয়টিকে ঘোলাটে করে তুললো।জল অবশ্য খুব বেশিদূর গড়ালোনা পার্টির কারণে।আজকের দিনটায় সবাই ব্যস্ত।
সিটি ইউফোরিয়ার একদম মধ্যখানে অবস্থিত কনভেনশন হলে পার্টির আয়োজন।কোনো ভবন থেকেই খুব বেশি দূরত্বে নয় সেটি।তবুও চারদিক ঘিরে থাকা চৌরাস্তা বেয়ে একের পর এক অতি মূল্যবান গাড়ি আনাগোনা করছে।নিজেদের আভিজাত্য প্রদর্শনে কেউ বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজী নয়। রেমান পরিবারও সেথায় পৌঁছলো নিজেদের বি এম ডব্লিউতে করে।এটি মূলত চারুলতার ব্যবহারের জন্য।আসমান বেশিরভাগ নিজের পোর্শে রেসিং মডেল ব্যবহার করে।কিন্তু আজ সে নিজেই চারুলতার গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে গেলো।ভেতর থেকে নেমে সামনে তাকিয়ে রোযার মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে বুঝি অস্কারের রেড কার্পেটে এসে পৌঁছেছে! শুধু এখানে কোনো পাপারাজ্জিদের প্রবেশাধিকার নেই এই যা পার্থক্য।

চারুলতা সামনে সামনে এবং পিছনে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করলো আসমান – রোযা।অভ্যন্তরের দৃশ্য রোযার রীতিমত চক্ষু চড়কগাছ করে তুললো।ছাদটা ভীষণ উঁচু।সম্পূর্ণ ছাদজুড়ে রয়েছে গোল্ডেন মিরর সম্বলিত ইন্টেরিয়র ডিজাইন।পার্টির থিম গোল্ডেনকে কেন্দ্র করেই চারিপাশের সাজসজ্জার আয়োজন।সত্যি বলতে অতিরিক্ত কিছুই নেই।জায়গাটি যেভাবে তৈরী করা হয়েছে তাতেই আভিজাত্যের ছোঁয়া রয়েছে।জায়গায় জায়গায় উঁচু হয়ে উঠা থামজুড়ে জড়িয়ে রয়েছে সোনালী লতা,সেই লতার ফাঁকে ফাঁকে আবার সাপের পেঁচানো শরীর।বর্ণের কারণে ব্যাপারটি ভয়ংকর নয় বরং দর্শনীয় লাগছে। কাচের দেয়ালজুড়ে ঝুলছে সোনালী রেশমি পর্দা।মেঝেতে এবং টেবিলে রাখা রয়েছে প্রাচীন যুগের লণ্ঠনের মতন দেখতে অ্যান্টিক ধাঁচের বাতি যা মৃদু মন্থর এবং আরামদায়ক আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে।পার্টি হলেও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ।লাইভ অর্কেস্ট্রা বেজে চলেছে মোহনীয় সুরে।প্রত্যেক পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা টেবিলের ব্যবস্থা রয়েছে।সঙ্গে রয়েছে বার কাউন্টার, ফুড কাউন্টার এবং ডান্সফ্লোরের ব্যবস্থা।অতিথীগণের কেউ কেউ নিজেদের নির্দিষ্ট আসনে আবার কেউ কেউ পছন্দের ড্রিঙ্কস হাতে আশেপাশে হেঁটে হেঁটে সামাজিকতায় লিপ্ত হচ্ছে।

রেমান পরিবারের জন্য নির্ধারিত মধ্যখানের একটি টেবিলে বসলো আসমান।সে সামাজিকতায় আগ্রহী নয়।নিজের ফোন বের করে কানে গুঁজে নিলো এয়ারবাড।অপরদিকে চারুলতা রোযাকে টেনে নিয়ে গেলো বাকিদের সঙ্গে পরিচয় করাতে।ঝকঝকে শাড়ী কিংবা গাউন পরিহিত অবস্থায় অন্যান্য অভিজাত ঘরের মেয়েরা উপস্থিত রয়েছে। চারুলতা যে তাদের মাঝে সম্মানীয় সেটা উপস্থিতিতেই বোঝা সম্ভব হলো।
– আরে মিস রেমান যে…লুকিং গর্জিয়াস!
– অ্যায অলওয়েজ…ইউ আর ভেরি এলিগ্যান্ট।
মৃদু হেসে একে একে প্রশংসার বর্ষণে সিক্ত হতে থাকলো চারুলতা।পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখে গেলো রোযা।তার ঠোঁটেও হাসি ছড়িয়ে পড়েছে কিছুটা।অবশেষে যেন মানুষ তার উপরেও কিছুটা মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পেলো।সকলকে রোযার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে চারুলতা তার বাহু ধরে সামনে নিয়ে এলো।

– পরিচয় করানো হয়নি।আরিয়া রেমান,আমার ভাবী।
– আ…আসসালামু আলাইকুম।
সালামের জবাব না দিয়ে একে অপরের মাঝে অদ্ভুত দৃষ্টি বিনিময় করলো সবাই।যেন সালামের বিষয়টা ব্যাকডেটেড লেগেছে তাদের কাছে।অস্বস্তিতে পড়ে গেলো রোযা।শুধুমাত্র একজন মধ্যবয়স্ক অফওয়াইট জামদানী পরিহিত মহিলা ঠোঁট থেকে শরবতের গ্লাস সরিয়ে বললো,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– সো দ্যা রিউমার ইজ ট্রু?মিস্টার নীল গট ম্যারিড?
রাখঢাকের বালাই নেই।সকলেই রোযা এবং চারুলতার সামনেই গুজব সত্য নিয়ে আলাপচারিতা শুরু করে দিলো।চারুলতা খানিক বিরক্তবোধ করে বললো,

– আমার মনে হয়না এতটা অবাক হওয়ার মতন কোনো ঘটনা ঘটেছে যে এভাবে ফিসফিস করতে হবে সবার।
– কিছুটা অবাককরা ঘটনাই বটে চারু। ইউ নো ইওর ব্রাদার….উনি… ওয়েল… অদ্ভুত?মানুষের সঙ্গে মিশতেই চায়না। ওনার চেহারাও কেউ দেখেনি কোনোদিন।
– পর্দাশীল পুরুষ!
পাশ থেকে একজন বলে উঠতেই সকলে হাসাহাসিতে মেতে উঠলো।ব্যাপারটায় বিব্রতবোধ করলো রোযা।কিন্তু এদের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার পরিণাম নিশ্চয়ই সুখকর হবেনা।

– ওনাকে বিয়ে করতে কেউ রাজী হয়েছে তাতেই তো অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি!
– ঠিক বলেছ…হাহা!নিশ্চয়ই গরীব ঘরের কোনো মেয়ে তুলে এনেছে….
রোযার উভয় হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।সরাসরি তাকে কেউ কিছুই বলছেনা কিন্তু শুনিয়ে শুনিয়ে এমন কথা বলার অর্থ কি?প্রচণ্ড ইচ্ছা সত্ত্বেও জোরপূর্বক সে নিজেকে বিরত রাখলো।পার্টিতে হাঙ্গামা বাঁধালে তা আসমান কিংবা রেমান পরিবারের সম্মানহানি ঘটাবে।কিন্তু চুপ থাকলোনা চারু।বুকের উপর দুবাহু ভাঁজ করে আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে এগোলো।

– মিস রাইসা…আমার ভাইয়া পর্দাশীল হোক বা না হোক তাতে তোমার এত মাথাব্যথা হওয়ার কারণ দেখিনা।আর যাই হোক ,সে অন্তত কারো বেহায়া ভাইয়ের মতন যার তার মেয়ের দিকে নজর দিয়ে বেড়ায়না।
রাইসা নামক মেয়েটির চেহারা সহসাই টকটকে হয়ে উঠল ক্রোধে।চারুলতা তার ভাইকে ইঙ্গিত করেই কথা বলেছে,যে বেশ কিছুদিন যাবত চারুলতার পিছনে হন্যে হয়ে পরে রয়েছে।ব্যাপারটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট।তাছাড়া ছেলেটির চরিত্রও খুব একটা ভালো নয় যার দরুন বারবার চারুলতার কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে সে।তবুও এমন লোকের বোন হয়ে আসমানকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবে বিষয়টি অবশ্যই মেনে নেয়নি চারুলতা।তার কথায় রাইসা আর কোনো কথাই উচ্চারণ করতে সক্ষম হলোনা। আরো একটু এগোলো চারুলতা।তার ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি।যা একইসাথে মনোমুগ্ধকর এবং ক্রুর।

– মুখে কুলুপ আটলে যে? অন্তরে জ্বলছে বুঝি?পর্দাশীল পুরুষকে খুব পছন্দ হয়েছিল না?
– চারু!এবার কিন্তু তুমি বেশি বেশি করছো!
– করছি বুঝি?
মিছিমিছি বিস্ময়ের ভান ধরলো চারুলতা।পরক্ষণেই মুচকি হেসে বললো,
– লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।একজন মেয়ে একজন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হতেই পারে,স্বাভাবিক ব্যাপার।মেয়ে হয়ে মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হলে সেটা অস্বাভাবিক হয়ে যেতো।

– তুমি কি বলতে চাইছো চারু?
– এটাই যে তোমার বাবা মিস্টার শিকদার আমার বাবার কাছে ভাইয়ার জন্য তোমার সম্বন্ধ পাঠিয়েছিল আর ভাইয়া সেটাকে তৎক্ষণাৎ রিজেক্ট করে দিয়েছিল, সেটা তো আমি কখনো কাউকে বলিনি! উপস!স্লিপ অব টাং!
প্রত্যেকের দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ ঘুরে গেলো রাইসার দিকে।কিছুই বলতে পারলোনা মেয়েটি।হাতে ধরা গ্লাসে চেপে বসলো তার আঙ্গুল,থরথর করে কাঁপতে থাকলো সর্বাঙ্গ।চারুলতা বিন্দুমাত্র পরোয়া করলোনা।উল্টো ঘুরে পিছনে চেয়ে বললো,

– পিপীলিকার পাখা গজায় ম*রিবার তরে।প্রবাদটি ভুলে যেওনা।ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করেনি, আরিয়াকে করেছে,তার ভালো লেগেছে করেছে এবং সে সুখে আছে।হিংসা বিদ্বেষ বাদ দিয়ে ভালো মানুষ হও।জল আজকে এতদূর গড়াতো না,যদি না তুমি ভাইয়াকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা সব সমাজে ছড়াতে।সময় থাকতে ভালো হয়ে যাও,তোমার পয়সার অভাব নেই।
এটুকুই।রোযার হাত ধরে গটগট করে হেঁটে চলে আসলো চারুলতা।অপরদিকে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো বাকি সবাই।
– বিচ!
অশ্রাব্য একটি ইংরেজী শব্দ ভেসে এলো রাইসার পক্ষ থেকে।তাতে চওড়া হলো চারুলতার হাসি।পিছন ফিরে চোখ টিপে সে জানালো,
– আ ব্যাড বিচ!

চারুলতার এমন আচরণে রোযা হতবাক হয়ে গিয়েছে।মেয়েটিকে শুরু থেকেই কিছুটা অদ্ভুত লাগতো তার।আজ রীতিমত তার প্রতি শ্রদ্ধা হচ্ছে। নির্ভীক,অকুতোভয় এক সত্তা সে।যে নিজের আপনজনদের জন্য লড়াইয়ে প্রস্তুত সর্বদা।না চাইতেও রোযার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।প্রথমবারের মতন চারুলতাকে তার অস্বস্তি লাগার বদলে ভালো লাগলো।
হনহন করে হেঁটে বারের দিকে এগোলো চারুলতা।পিছু নিচ্ছিল রোযাও কিন্তু হাত তুলে তাকে সে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি কোথায় যাচ্ছো?
– তোমার সাথে।
– না! আমার সাথে কেনো যাবে?
– তাহলে?
কপাল চাপড়ালো চারুলতা।পরক্ষণে রোযার কাঁধে হাত রেখে তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে আঙুল তুলে নির্দেশ করলো,
– ঐযে দেখো,সবাই কাপল ড্যান্স করছে।
– তো?

বোকার মতন প্রশ্ন করে বসলো রোযা।পরক্ষণেই চারুলতার ইঙ্গিত ধরতে পারলো সে।বিস্মিত দৃষ্টিতে ফিরে চাইতেই এক তীর্যক হাসি তাকে উপহার দিলো চারু।
– ভাইয়াকে টেনে হিঁচড়ে হলেও নিয়ে যাও।একেবারে রাইসার সামনে সামনে নাচবে ঠিক আছে?সবাই যেন দেখতে পায়…. হাউ হ্যাপি হি ইজ।
রোযার পিঠ চাপড়ে শুভকামনা জানিয়ে উল্টো পথ ধরলো চারুলতা।অপরদিকে একলা দাঁড়িয়ে একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো রোযা।আসমান আর কাপল ড্যান্স?মাথা খারাপ?
নিজের অবাধ্য হৃদয়ের কাছে হার মেনে টেবিলের সামনে উপস্থিত হলো রোযা।আসমান যথারীতি চেয়ারে বসে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।ব্লেজার খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে রেখেছে।রোযার উপস্থিতি অনুভব করা সত্ত্বেও চোখ তুলে তাকালোনা।রোযা বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো,চলেও যেতে নিলো কিন্তু শেষে আবার কি ভেবে ফিরে এলো।আসমানের কান থেকে এয়ারবাড খুলেই দ্রুতকন্ঠে আবেদন জানালো,

– চলো কাপল ড্যান্স করি!
দ্রুত উচ্চারণ করার কারণ যেন মস্তিষ্ক অতিরিক্ত ভাবনা চিন্তার সময় না পায়।তার কথা শুনে জগতের সবচেয়ে নির্বিকার শূন্য দৃষ্টিতে চাইলো আসমান।হাতে তখনো ফোন ধরা তার।
– সবাই করছে আমাদেরও করা উচিত।আসো। কতক্ষন একা একা এভাবে বসে থাকবে?লোকে এমনিতেও অনেক কথা বলছে।

জোরপূর্বক সাহস সঞ্চয় করে রোযা নিজের ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিলো আসমানের দিকে।পিশাচটির অভিব্যক্তিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটলোনা।দৃষ্টি নামিয়ে চাইলো রোযার বাড়ানো হাতের দিকে।পরমুহুর্তে পাল্টা নিজের হাত এগিয়ে দিলো।হতবিহ্বল হয়ে পড়ল রোযা।তার হাত ধরার বদলে নিজের হাত বাড়িয়ে ধরেছে!সত্যি?অসম্ভব!এ নিশ্চয়ই কল্পনা!তার হৃদয় মুহূর্তেই সিক্ত হয়ে উঠল অদৃশ্যমান এক আবেগে।অনুভূতির প্রজাপতিরা পাখনা মেলে উড়াল দিলো সর্বাঙ্গজুড়ে। চেহারায়ও ভর করলো সেই সুখবোধের বর্ণ।
পুলকিত হৃদয়ে সম্মোহনী ভঙ্গিতে রোযা যেই না নিজের হাত আসমানের হাতে রাখতে যাচ্ছিল ঠিক তখনি পুনরায় তার আশার প্রতি মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে আসমান নিজের হাতটি ঝাঁকিয়ে রোযার চিন্তা শুধরে দিলো,

– এয়ারবাড!
এক মুহুর্ত বরফখন্ড হয়ে থাকলো রোযা।তারপরই তার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র ক্রোধের অনুভূতি।এক হাতে আসমানের হাত পাকড়াও করে অপর হাতের এয়ারবাড সশব্দে থাপ্পড় দেয়ার ভঙ্গিতে থপ করে রাখলো সে।রাগান্বিত ভঙ্গিতে তার ভ্রু এবং নাক কুঞ্চিত হয়ে থাকলো।
– ইডিয়ট!
উল্টো ঘুরল রোযা।পিছনে তাকানো ছাড়াই গটগট করে হেঁটে চলে গেলো ফুড কাউন্টারের দিকে।কি ঠেকা পড়েছে তার ওই দানবের সঙ্গে নাচানাচি করতে? নেহাৎ চারুলতা অনুরোধ করলো বলে।নাহলে কে যায় ওইরকম নাখাস্তা রিজেকশন খেতে?এর থেকে চকলেট ফাউন্টেনে কেক ডুবিয়ে খাওয়া উত্তম!খাবারের থেকে বড় কোনো ঔষধ দুনিয়ায় নেই।ভেবে একদফা ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।
কয়েক পলক রোযার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে পরবর্তীতে ফোনে মনোযোগ দিলো আসমান।পুনরায় এয়ারবাড দিলো কানে।নিজেও অনুধাবন করলোনা ঠিক কখন মাস্কের আড়ালে থাকা তার অধরে খুবই ক্ষীণ একটি হাসির ধারা খেলে গিয়েছে।

বারে বসে মুহিতোতে চুমুক দিচ্ছিলো চারুলতা।ঠিক তখনি তার পাশের চেয়ার দখল করে বসলো আসিফ।রাইসার বড়ো ভাই,আসিফ শিকদার।সহসাই বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল চারুর চেহারা।নিশ্চয়ই নিজের অপমানের বদলা নিতে ভাইকে লেলিয়ে দিয়েছে রাইসা।নিজের গ্লাস হাতে উঠে আসতে চাইলেই আসিফের হাত চারুলতার কাউন্টারের উপর রাখা হাতে চেপে বসলো।
– কোথায় যাচ্ছো ডার্লিং?

থমকালো চারুলতা।ঘুরে তাকালো আসিফের দিকে। বাঁকা হাসি ঝুলছে তার কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটে।লিপস্টিক ব্যবহার করে রাঙানো হয়েছে তা, আসল বর্ণ কালচে।হবে নাই বা কেনো?সিগারেট, অ্যালকোহল,ড্রা*গ….দুনিয়ার কোনো জিনিসই বাকি রাখেনি সেবন থেকে।তাইতো স্বাভাবিক দেখাতে প্রসাধনীর সাহায্য নিতে হয়।
– তুমি কি নেড়ি কুকুর আসিফ?বোন লেলিয়ে দিলেই লেজ নাড়িয়ে চলে আসতে হবে?
চারুলতার প্রশ্নে হতচকিত হয়ে পড়লো আসিফ।এক মুহুর্ত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল চারুলতার পানে।ক্রমেই তার অধরে হাসিটুকুর পুনরুৎপত্তি ঘটলো।

– লেলিয়ে দেবে কেনো?আমি স্বইচ্ছায় এসেছি।বিকজ ইউ আর লুকিং সেক্সী টুনাইট!
সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে চারুলতা উঠে পড়ল।
– তোমার ফ্লার্টিংয়ে অজ্ঞান হওয়ার মতন আরো অনেক মেয়ে আছে পার্টিতে।আমাকে রেহাই দাও।
– কোথায় যাচ্ছো বেবি?
বলে সহসাই পিছন থেকে চারুলতার কোমর জড়িয়ে ধরলো আসিফ।মাথা ঠেকালো তার মেরুদন্ড বরাবর।গাউনের উপরেও চারুলতা স্পষ্ট নিজের পিঠে তার ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করলো।সমস্ত শরীর জুড়ে তার কম্পন খেলে গেলো।সাই করে উল্টো ঘুরে চারু তীব্র কন্ঠে বললো,

– বিহেইভ ইওরসেল্ফ শিকদার!
– হোয়াট ইফ আই ডোন্ট রেমান?
উঠে দাঁড়ালো আসিফ।এক ঝটকায় চারুলতাকে কাছে টেনে নিলো।মিশিয়ে নিলো নিজের শরীরের সঙ্গে।মানবিকতা বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করলো চারু। দাঁতে দাঁত ঘষে উচ্চারণ করলো,
– আসিফ ভুলে যেওনা এটা একটা সামাজিক পার্টি, কোনো ডিস্কো ক্লাব নয়!আর আমিও একজন নারী কোনো স্ট্রিপার নই!

– তাহলে চলো ডিস্কোক্লাব?নাহলে…আমার অ্যাপার্টমেন্টে? একসাথে রাত কাটাই…ট্রাস্ট মি… আই অ্যাম রিয়েলি গুড…
বিড়বিড় করে চারুলতার বুকে হাত ছোঁয়ালো আসিফ।ধৈর্যের সীমা সহসাই অতিক্রান্ত হলো চারুর।দ্বিতীয় চিন্তা ছাড়াই নিজের ডান হাত উত্তোলিত করে সশব্দে আসিফের গালে চড় বসালো সে।এতটাই জোর ছিল তার আ*ঘা*তে যে আসিফ রীতিমত ছিটকে পড়ল চেয়ারের উপর।পার্টির অর্কেস্ট্রা থেমে গেলো।সকলের দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে পড়ল নাটকীয় দৃশ্যপটে।

– কাপুরুষ!
বলে উঠে পা তুলে আসিফের তলপেট বরাবর নিজের হিল দিয়ে চাপ দিলো চারুলতা।ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো সে,কিন্তু চারুর মাঝে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
– আমাকে কি অবলা নারী মনে হয় তোর যে চুপচাপ সয়ে যাবো?বারবার ভুলে যাস কেনো এই নারীর পেট থেকেই তোর জন্ম?

ফুড কাউন্টারে দাঁড়িয়ে স্যান্ডউইচে কামড় বসাতে থাকা রোযা দৃশ্যটি খেয়াল করে খাবার রেখে দ্রুত ছুটলো বারের দিকে।ততক্ষণে চারুলতা নিজের পা সরিয়ে নিয়েছে।রাগ প্রশমিত করে সে চলে যেতে উদ্যত হচ্ছিল কিন্তু নাছোড়বান্দা আসিফ উঠে দাঁড়িয়ে তার চুল টেনে ধরলো পিছন থেকে।
– বড্ড বেশি দেমাগ তোর!সবার সামনে আমাকে অপদস্থ করে পার পেয়ে যাবি ভেবেছিস? তোকে একটা উচিত শিক্ষা আজ দিতেই হবে!

হাত তুলতে উদ্যত হচ্ছিলো আসিফ।কিন্তু এর আগেই অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটলো। চারুলতার সামনে আবির্ভূত হলো আসমান, তাতে আসিফের চড়টি চারুর বদলে আ*ঘা*ত হানলো আসমানের চেহারায়।মুহূর্তেই পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেল চারপাশ।নির্বিকার আসমান।আসিফের চড়ে তার খুব একটা এসেছে কিংবা গিয়েছে বলে মনে হলোনা।পর্বতের ন্যায় অটল সে, হিমালয়ের ন্যায় হিমশীতল স্থির।তার প্রজ্জ্বলিত নয়নজুড়ে কৃষ্ণগহ্বরের উৎপত্তি।
আসিফ কয়েক পা পিছিয়ে গেলো আসমানের দৃষ্টি লক্ষ্য করে।ছেলেটির উপস্থিতি কেমন যেন অশুভ।যার কারণে তাকে ঘাটাতে চায়না কেউই।এজন্যই এই ঝামেলার মাঝেও কেউ হস্তক্ষেপ করছেনা।আসমান পিছনে ফিরলো। চারুলতা বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আসমান শান্ত অথচ শক্তিশালী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

– কি হয়েছে?
– আপনার বোন আমাকে অপমান করেছে!
উত্তরটা দিলো আসিফ। গায়ে মাখলোনা আসমান, তার দৃষ্টি শুধুমাত্র চারুলতার উপর আপতিত।এক মুহুর্ত সময় নিলো চারু,জানালো,
– আমাকে অশ্লীল কথা বলেছে, তারপর খারাপভাবে স্পর্শ করেছে।
– শুধু একটু ছুঁয়েই তো দিয়েছি তার জন্য এত নাট… আক!!

বাক্যটি সম্পূর্ণ করার সময় কিংবা সুযোগ কোনোটাই লাভ করলোনা আসিফ।আসমানের হাত বিদ্যুৎ গতিতে পাকড়াও করলো তার কন্ঠ, চে*পে ধরে মুহূর্তের মাঝে তার শরীর তুলে ধরলো শূন্যে। তারপরই ওই অবস্থায়ই আছ”ড়ে ফেললো কাউন্টারের উপর।তখনো আসিফের গ্রীবাদেশ মুক্ত হয়নি আসমানের কবল থেকে।
এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরেছে অতিথিদের।শিকদার পরিবারের কয়েকজন বডিগার্ড বাহির থেকে ছুটে এলো রাইসার ডাকে।আসমানকে ঘিরে ফেলল চারপাশ থেকে।তবুও তাকে একরত্তি টলাতে সক্ষম হলোনা।আসিফের গ*লা চে*পে ধ*রে আছে সে কাউন্টারের সঙ্গে।ছেলেটা ছটফট করছে,নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু সুস্থির আসমান।তাকে বাগে আনতে বডিগার্ডদের একজন আ*ঘা*ত করলো ঘা*ড় বরাবর,তাতে নিজের হাতের বাঁধনে ঢিল দিলো আসমান।তড়িৎ গতিতে নিজেকে ছাড়িয়ে আসমানকে একটি খালি কাচের বোতল দিয়ে মা*র*তে উদ্যত হচ্ছিল ক্রোধে উন্মাদ আসিফ। তা দৃষ্টিগোচর হতেই নিজেকে আর দূরে রাখতে সক্ষম হলোনা রোযা।দ্বিতীয়বার চিন্তাও করলোনা তার নাক গলানো আদও উচিত হবে কিনা।তার পা তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেনে নিলো কুরুক্ষেত্রের মাঝে।

– এক্সকিউজ মি!
জোরপূর্বক ভিড়ের মধ্যিখানে নিজেকে ঢোকালো রোযা।আসমান এবং আসিফ ও তার বডিগার্ডদের মাঝে ঢাল হয়ে দাঁড়ালো যেন।আসমানকে ঠেলে কিছুটা পিছনে সরিয়ে দিয়ে সামনে এক হাত তুলে থামার ভঙ্গি করে কঠোর কন্ঠে বললো,
– এটা একটা সামাজিক জায়গা,বক্সিং রিং নয়।নিজের শক্তি জাহির করবার কোনো প্রয়োজন নেই।
– আপনি মাঝখানে বাধ সাধেন কেনো? সরে যান।এটা শিকদার আর রেমান পরিবারের ব্যাপার।
– রেমান পরিবারের সদস্য হিসাবে মাঝখানে দাঁড়ানোর এবং এই দাঙ্গা থামানোর অধিকার অবশ্যই আমার রয়েছে!
আসিফের প্রশ্নের কড়া জবাব দিলো রোযা।তাতে কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকলো পরিবেশ।তারপরই রোযা পুনরায় বললো,

– আপনি যা করেছেন একদম ঠিক করেননি।একজন নারীকে কখনো অনুমতিবিহীন স্পর্শ করা উচিত নয়। আপনি চারুলতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন।সবকিছুর অবসান ঘটবে।অযথা আগুনে ঘি ঢালবেন না।
– ওহ! এখন আমার তোর কাছ থেকে শিখতে হবে যে কি করবো আর কি না করবো?
এগিয়ে এলো আসিফ।রোযার বুকে হাত রেখে জোরে ধাক্কা দিলো।ভারসাম্য হারিয়ে পিছিয়ে গেলো রোযা।
– দেখুন আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন!
– করবো!কি করবি?

আবারো ধাক্কা দিলো আসিফ,অতঃপর আরো একবার।চতুর্থবার দেয়ার পূর্বেই তার হাতটি খপ করে ধরে ফেললো আসমান, অপর হাতে রোযাকে নিজের পিছনে ঠেলে এগিয়ে গেলো সামনে।আসিফের হাতখানা মুহূর্তের মাঝেই মুচ*ড়ে দিল সে, কটকট করে শব্দ হলো আঙুলের হা*ড় ভা*ঙার!সম্পূর্ণ কুঁকড়ে গেলো আসিফ,আসমান দৃঢ় কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– ইউ ডেয়ার টু টাচ্ মাই ওয়াইফ অ্যান্ড সিস্টার!
– আহ!

চিৎকারের ধ্বনির সঙ্গে তাল মেলালো হাড়ের গুঞ্জন।ফট করে বেঁ*কে গে*লো আসিফের ডান হাতটি, ঝুলতে থাকলো কনুই বরাবর।আতঙ্কিত চেহারায় নির্বোধের মতন চেয়ে থাকলো আসিফ।তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।শরীর আর নিতে পারছেনা।কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধপাস করে সে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
অশরীরী দৃশ্যটির পানে বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো সকলে।সকলের পায়ে যেন শিকড় গজিয়েছে।সামান্যতম নড়চড় করার সুযোগ দিচ্ছেনা বিস্মিত মস্তিষ্ক। বডিগার্ডরা পর্যন্ত আসমানের দিকে এগোনোর দুঃসাহস প্রদর্শন করছেনা।ঊর্ধ্বশ্বাসে দৃশ্যপটে ছুটে এলো রাইসা।নিজের বড়ো ভাইয়ের করুণ দশা লক্ষ্য করে উচ্চ কন্ঠে আদেশ ছুড়লো,

– কল অ্যাম্বুলনেন্স!
বডিগার্ডদের একজন ফোন করতে করতে রাইসা আসমানের দিকে ফিরলো।অন্যরা তাকে ঘিরে ধরলো।
– ম্যাম প্লীজ ঝামেলায় জড়াবেন না…
গার্ডদের চোখ রাঙানি দিয়ে উপেক্ষা করে গটগট করে হেঁটে আসমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো রাইসা।মেয়েটির চেহারাজুড়ে ক্রোধের শিখা জ্বলছে।দৃষ্টিতে ঘৃণার অতল গভীর সমুদ্র।অনুভূতির তাড়নায় ঠোঁটজোড়া কাপছে তিরতির করে।
– ইউ বাস্টার্ড..!

নিজের দুর্বল হাতেই আসমানের বুকে ঘু*ষি বসালো সে। টললোনা আসমান,প্রতিরোধ করার চেষ্টাও করলোনা।একের পর এক আ*ঘা*ত আসতে থাকলো তার উপর,কিন্তু কোনো নারীকে পাল্টা আ*ঘা*ত করতে ইচ্ছুক নয় সে।
– কি মনে করেন আপনি নিজেকে?সর্বেসর্বা?ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পার পেয়ে যাবেন?
নিশ্চুপ আসমান।নিশ্চুপ প্রত্যেকে।রাইসার গাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।চিৎকার করে করে সে কথা বলছে।
– আপনি আদতে একটা দানব!ভয়ংকর দানব!মুখোশের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখেন যেন কেউ টের না পায় কতটা পৈশাচিক সত্তার অধিকারী আপনি! আপনার এই মুখোশ…
আসমান সহসাই নিজের মাস্কে হাত দিলো।কিন্তু পরিস্থিতির উত্তেজনায় তার মতন সদা সচেতন ব্যক্তিরও এক সেকেন্ড দেরী হয়ে গেলো।রাইসা এক টানে ছিঁড়ে ফেলল তার মুখের মাস্ক,ছুঁড়ে ফেলল দূরে।
– আমার ভাইয়ের কিছু হলে আপনাকে…..

বিদ্যুৎস্পৃ*ষ্ট হওয়ার মতন করে ঝাঁকুনি খেয়ে থমকে গেলো রাইসা।বি*স্ফা*রিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো নিজের উন্মুক্ত করা দৃশ্যের পানে।শুধুমাত্র সেই নয়, বরং উপস্থিত প্রত্যেক অতিথি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো।এক পরাবাস্তব দৃশ্যের দিকে যা কোনোদিন নিজের চোখে অবলোকন করার কল্পনাও কেউ করেনি।
সম্পূর্ণ দৃশ্যমান আসমানের চেহারা।শুভ্র ত্বকে আচ্ছাদিত চেহারায় শিশুসুলভ মায়া।সৃষ্টিকর্তার অতি যত্নে সৃষ্টি ভাস্কর্যের ন্যায় মুখাবয়ব এতটাই মাধুর্য্যপূর্ণ যে তা হতে দৃষ্টি ফেরানো দায়। সবই অত্যন্ত আকর্ষণীয় যতক্ষণ না পরাশক্তি এতে হস্তক্ষেপ করে।পুষ্ট ঠোঁটজোড়ার দুইপাশের চোয়াল বেয়ে চলে গেছে দুইটি গাঢ় সেলাইয়ের দাগ।যেন তার মুখটা চি*রে পুনরায় সেলাই করে দেয়া হয়েছে,যার চিরস্থায়ী চিহ্ন রয়ে গিয়েছে।কাঠের পুতুলের মতন লাগছে দেখতে, যার কলকাঠি নাড়লেই মুখ নেড়ে কথা বলতে আরম্ভ করবে।

বরফখন্ডে পরিণত হওয়া রোযা নিজের থমকে যাওয়া হৃদযন্ত্রের অবাধ্য ব্যাকুলতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো ভূতুড়ে দৃশ্যটির দিকে।কি হয়েছে আসমানের সঙ্গে?সম্পূর্ণ ছিঁ*ড়ে ফে*লা হয়েছিল তার ঠোঁটের দুপাশ!পৈ*শাচিক এক দগদগে চিহ্নের উৎপত্তি ঘটিয়েছে তা তার চোয়ালজুড়ে যার দিকে তাকালে শরীর শিরশির করে উঠে।দানবীয় সত্তার জন্য এক দানবীয় অবয়ব….. মানবহৃদয়মাত্রই ভয়ে কিংবা ঘৃণায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য।

হলোও তাই।নির্বাক দর্শক সব একে একে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।কেউ উল্টো ঘুরে গেলো, আর কেউবা মুখ চেপে ধরে নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করলো।অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তাতে আসমানের মাঝে কোনপ্রকার প্রভাব দেখা গেলোনা।সে নিজের চেহারা আবৃত করার আর কোনো চেষ্টাই করলোনা।তার দৃষ্টিতে শুধুমাত্র শীতলতা ছাড়া আর কিছুই প্রদর্শিত হলোনা।

রোযার মনে হলো সে তার পায়ের জোর হারিয়ে ফেলছে।এই কি তাহলে সেই কলংক? একে কি আদও কলংক বলা যায়?ঠিক যেমন চাঁদের শরীরের কলংক থাকে তেমনি আসমানের চেহারাকেও বিকৃত কলংকে ছেয়ে ফেলেছে কোনো এক পৈশা*চিকতার নিদর্শন।সবথেকে দুঃখজনক ব্যাপার হলো,এ নিদর্শন ক্ষণস্থায়ী নয় বরং আজীবনের।

মারবেল ভবনের সামনে বি এম ডব্লিউ এসে থামতেই ভেতর থেকে নেমে পড়লো চারুলতা।পার্টি আজ ক্যানসেল হয়ে গিয়েছে অপ্রীতিকর ঘটনার পর।আসিফকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।এর পরপরই সেই স্থান পরিত্যাগ করেছে রেমান পরিবার।আসমানের চেহারা এবং কার্যকলাপ নিয়ে তীব্র গুঞ্জনের মাঝে অবস্থান করে চারুলতার সমস্ত শরীর এখনো পর্যন্ত ঝনঝন করছে তীব্র এক আক্রোশে।যদি তার ক্ষমতা থাকতো তাহলে হয়ত সে প্রত্যেকের দৃষ্টি হরণ করে নিত মুহূর্তের জন্য!আসমান কেনো রাইসাকে বাঁধা দেয়নি?কি এত দরকার ছিলো সুপুরুষ সাজার?প্রশ্নগুলো সে চাইলেও কোনোদিন করতে পারবেনা।তার পিছন পিছন রোযা নামতেই পুনরায় গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো আসমান।তার দিকে ফিরে তাকালো চারুলতা এবং রোযা উভয়ে।

আসমানকে কোনো যান্ত্রিক মেশিন ছাড়া ভিন্ন কিছু মনে হচ্ছেনা।তার চেহারা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত।তাতে চোখ পড়লেই বিভৎসতা নজরে আসছে।বিন্দুমাত্র খেদ নেই।আপন দুনিয়ায় বিলীন সে।স্টিয়ারিংয়ে এক হাত দিয়ে অপর হাত জানালায় ঝুলিয়ে কোনো এক অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে উদ্যত সে।
– কোথায় যাচ্ছিস?

চারুর বিষাদপূর্ণ প্রশ্নের কোনো জবাব প্রদান করলোনা আসমান।গিয়ারে হাত রাখলো।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে হাত বোলালো চারুলতা।কিন্তু অতর্কিতে তাকে অবাক করে দিয়ে গাড়ীর প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে ভেতরে চেপে বসলো রোযা। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো আসমান এবং চারুলতা উভয়ে।রোযার দৃষ্টি রইলো সামনের দিকে, কারো দিকেই নজর দিতে সে ইচ্ছুক নয়।চেহারায় অদ্ভুত এক কাঠিন্য তার।
শেষমেষ তাকে কিছুই বললোনা আসমান। গিয়ার টেনে এক হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এগোলো।গাড়ির পিছনের কাচের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল চারুলতা।তার কণ্ঠে দলা পাকিয়ে এলো কান্না।

দ্রুতই সিটি ইউফোরিয়ার গেট পেরিয়ে রাতের শহুরে সড়কে এসে পড়ল গাড়ি।অসহনীয় নিস্তব্ধতা গাড়ীর ভেতরে।একবারের জন্যও আসমানের দিকে দৃষ্টিপাত করছেনা রোযা, আসমানও না।নৈঃশব্দ্য প্রহরে একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে ট্রাফিকের গুঞ্জন চৌচির করে দিচ্ছে সেই নৈঃশব্দ্য।অদ্ভুত হলেও সত্য মুহূর্তটি দীর্ঘস্থায়ী হলো আড়াই ঘণ্টা!আসমানের নিরুদ্দেশের যাত্রা থামলো সুবিস্তৃত মহাসড়কের একপাশে।গাড়ি থেকে নেমে গেলো সে একটি শব্দ উচ্চারণ ছাড়াই।রোযা ঠাঁয় বসে রইলো।
রাস্তার দুইপাশজুড়ে বিস্তৃত ক্ষেত।রাত্রির আভায় দূর দিগন্ত ছাওয়া গাছের ছায়া বাতাসে দোল খাচ্ছে।গগনে ছড়িয়ে তারকারাজি।মিটমিট করে জ্বলছে নিভছে আপন লয়ে।যতদূর দৃষ্টি যায় জনজীবনের চিহ্ন নেই।আছে এই রাত,রাতের তারারা এবং শীতল বায়ুর প্রবাহ।

গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো আসমান।পকেট থেকে বের করলো একটি লাইটার। প্রথমবারের মতন আসমানকে ধূমপান করতে দেখলো রোযা।দিগন্তের দিকে চেয়ে ঠোঁটে সিগারেট পুরে স্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সে।
সিটবেল্ট খুলে বেরিয়ে এলো রোযা।মৃদু শব্দে গাড়ির দরজা বন্ধ করে এগোলো।জায়গা করে নিলো ঠিক আসমানের পাশেই, বুকে দুহাত গুটিয়ে চেয়ে থাকল যেদিকে চেয়ে আছে আসমান।এক নজর তাকে দেখে পুনরায় সিগারেটে মনোযোগ দিলো সে।নিস্তব্ধতা ভালোই লাগছে।বায়ুর এলোমেলো আবহ এবং রাত্রির মায়া, প্রকৃতির মায়াজালে নিজেকে হারিয়ে ফেলা।খুব মন্দ নয়।

– তোমার ভয় করছেনা?
প্রশ্ন শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো রোযা। আধখাওয়া সিগারেট দুই আঙুলে ধরে তখন দিগন্তের পানে আবদ্ধ আসমান।সোজাসাপ্টা জবাব দিলো রোযা।
– করছে।
আসমানের চেহারায় সন্তুষ্টি ফুটে উঠলো।যাক,রোযা অন্তত শান্তনা দিয়ে মিথ্যা কথা বলেনি।যদি বলতো যে না তার ভয় করছেনা,তখনি আসমান নিজেকে গুটিয়ে নিতো। কারো করুণা কিংবা সহমর্মিতায় এলার্জী আছে তার।
– তুমি দেখতে বি*ভৎস।
– একদম পিশাচের মতন।
রোযার কথায় যুক্ত করলো আসমান।সম্মতি জানালো রোযা।

– মাস্ক পড়ে থাকাই ভালো।কেউ এই কদর্যতা দেখতে পারবেনা।
– এক্সাটলি!
মাথা দোলালো আসমান।
– কিন্তু আমি দেখতে চাই।
সিগারেট ঠোঁটে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে স্থির হয়ে গেলো আসমান।মাথা হেলিয়ে তাকালো রোযার দিকে।মেয়েটি এই প্রথম সরাসরি তাকালো তার পানে।দৃষ্টিতে কোনপ্রকার ভয়,আতঙ্ক,ঘৃণা কিংবা করুণা নেই।আছে শুধু অদ্ভুত এক মমত্ববোধ।যেন জগতের সবথেকে সুন্দর বস্তুটির দিকে চেয়ে আছে সে।এহেন চমৎকারকে অবলোকন করেও পরিতৃপ্ত তার হৃদয়।

– চাঁদেরও কলংক আছে।তবুও সাহিত্যিকেরা রমণীদের তুলনা করে চাঁদের সঙ্গে। প্রেমিকেরা প্রেয়সীদের নিকট ওয়াদা করে ওই চাঁদের টুকরো এনে দেবার।শিশুরা বড় হয় মায়ের মুখে চাঁদমামার গল্প শুনে।কেনো জানো?
প্রথমবারের মতন রোযার উপর থেকে হাজার চাইলেও নিজের দৃষ্টি সরাতে পারলোনা আসমান।অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তিতে সে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে মেয়েটির মুখায়বে,তার কণ্ঠস্বরের জাদুতে।নিজের কম্পিত হাত তুলে ধরলো রোযা।আলতো করে ছুঁয়ে দিলো আসমানের ঠোঁটের পাশের দাগে উদ্ভাসিত ত্বক।তার বৃদ্ধাঙ্গুলি ধীরে ধীরে বয়ে চললো সেই কলংকের দাগের উপর।রোযার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো,অধর ভেসে উঠলো হাসিতে।

ডার্কসাইড পর্ব ১৩

– কারণ সেই কলংক ছাপিয়ে জোছনা ছড়িয়ে চাঁদ ভালোবাসা বিলায়।অন্তরে আনে প্রশান্তি,দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। চাঁদ সুন্দর… প্রচণ্ড সুন্দর…..
আসমানের আঙুল থেকে সিগারেটটি পরে গেলো মাটিতে।রোযা থেমে নেই,তার হাতের আঙুল আঁকিবুঁকি কে*টে চলেছে আসমানের কপোলজুড়ে। কোনোপ্রকার বাধা দিলোনা আসমান, বুজে আসলো তার চোখের পাতা,নিজেকে বিলিয়ে দিলো রোযার স্পর্শের অনুভূতিতে।

ডার্কসাইড পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here