ডার্কসাইড পর্ব ১৫
জাবিন ফোরকান
চার হাত-পাই আবদ্ধ হয়ে আছে।সহস্র প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে মুক্ত করা অসম্ভব।থেকে থেকে চিনচিন করে উঠছে বুক।মুখের ভিতর ঢু*কে গিয়েছে চার ইঞ্চি হিল।জুতোর বিদঘুটে স্বাদ জিহ্বায় ঠেকছে।গা গুলিয়ে উঠছে।ঠোঁটের পাশ গড়িয়ে নামছে লালা।কিন্তু নিস্তার নেই কোনো। চাপা গোঙানি ব্যাতিত কোনোকিছুই করা সম্ভবপর হচ্ছেনা।
রমণীর কুটিল এবং তৃপ্তিভর মুখশ্রী ঝাপসা দৃষ্টিতে চোখে পড়লো।টকটকে লাল ঠোঁটজোড়ায় এক পা*শবিক বাসনা। হিলের অংশ গভীরে ঢুকলো, নিঃশ্বাস আটকে এলো সম্পূর্ণ।
– হোয়াট আ প্রিটি লিটল ফেইস ইউ হ্যাভ…
ফিসফিস কন্ঠস্বর।সজোরে একটি টান,তারপর আরো একটি।হিলের ডগা এদিক সেদিক মোচড় দিচ্ছে।দেহের ত্বক সহ্য করতে পারছেনা।কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হাল ছেড়ে দিলো।চিরচির করে ফেঁ*ড়ে গে*লো ঠোঁটের একপাশ…অল্প একটু।তাতেও মোচড় বন্ধ না হওয়ায় ক্রমশই দীর্ঘ হলো তা।র*ক্তে*র নদী প্রবাহিত হয়ে চলে গেলো কন্ঠনালীতেও।
যন্ত্রণা? যন্ত্রণারাও অনুভূত হতে ভয় পেয়ে গিয়েছে যেন।আর্তনাদ এবং হাহাকার হারিয়েছে কণ্ঠের র*ক্তে। অনুভুতিরা বিলিয়েছে নরকমাঝে।থমকে গিয়েছে হৃদস্পন্দন। মৃ*ত্যুদূতও দাঁড়িয়ে দোরগোড়ায়,তবুও তার পদক্ষেপ স্থির।নাহ…যথেষ্ট নয়, আরো চাই যন্ত্রণা!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চোখ মেলতেই কালো সিলিং নজরে এলো।তাতে অফহোয়াইট বর্ণের ডিজাইন।উভয় রং পেঁচিয়ে সর্পিলাকৃতির উদ্ভব ঘটিয়েছে।বুকের ভেতর হৃদযন্ত্র ক্ষীপ্র গতিতে অক্সিজেন ছড়াতে ব্যাস্ত।দুঃস্বপ্নের পর শরীরের কোষের কর্মকাণ্ড বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত চাহিদা মেটানো প্রয়োজন।
বিছানায় উঠে বসলো আসমান। পরনের হাফহাতা টি শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে শরীরের সঙ্গে।দেহের উপর থেকে ব্ল্যাংকেট সরিয়ে দিলো।তাতে এসির শীতল বায়ু হুহু করে প্রবেশ করতে থাকলো অঙ্গ প্রত্যঙ্গে।কেমন একটা শিরশিরে ভাব খেলে গেলো সমস্ত শরীরে। এসির বাতাসের কারণে নাকি স্বপ্নের কারণে ভাবার চেষ্টা করলোনা আসমান। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার হাত উঠে এলো চেহারায়,ছুঁয়ে দিলো ঠোঁটের পাশের গাঢ় সেলাইয়ের দাগের জায়গাটা।আলতো করে সে অনুভব করলো নিজেকে, নিজের যন্ত্রণাকে।তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছুর দূরিভন ঘটালো।বিছানা থেকে উঠতে উঠতে দেয়ালঘড়িতে দেখলো সকাল সাড়ে আটটা বাজে।
ফ্রেশ হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে কিচেনে পরিচিত দৃশ্যটি নজরে পড়লো।চুলার ধারে রোযা।সিরামিকের পাত্রে ধীরে ধীরে চামচ নেড়ে চলেছে।গরম বাষ্প উঠছে,তার সঙ্গে পেটে মোচড় দেয়ার মতন এক সুঘ্রাণ।আসমান কিচেনে গেলো নিজের জন্য কিছুটা প্রোটিন শেক বানাতে।তাকে প্রবেশ করতে দেখেই রোযা বিস্তর হেসে বললো,
– গুড মর্নিং।
উত্তরে শুধু মাথা দোলালো আসমান।চলে গেলো কেবিনেটের কাছে। ফ্লাস্কে কিছুটা বরফ,পানি এবং প্রোটিন পাউডার নিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে তাকালো রোযার দিকে।একটা হলুদাভ বর্ণের লম্বা ফ্রক পরনে।একই ধাঁচের পায়জামা,যার নিমাংশে গোলাকার মুক্তার মতন দেখতে পাথর বসানো।চুলগুলো একটি কাঠি দিয়ে খোঁপা করে নিয়েছে।ছোট ছোট চুলসব সেই খোঁপা ছাড়িয়ে কপালের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে।আসমান তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রোযা তার দিকে ঘুরলো।একটি চামচ বাড়িয়ে ধরে তার নিচে নিজের অপর হাত ধরে বললো,
– দেখো তো একটু লবণ ঠিক আছে কিনা।আমার কাছে বেশি মনে হচ্ছে।
চামচের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো আসমান।মাস্কের অন্তরালে তার ঠোঁটজোড়া একে অপরের সঙ্গে চেপে বসলো।
– তাড়াতাড়ি! দাদুর খাবার দিতে হবে।
তাড়া দিলো রোযা।এক মুহুর্ত কি যেন চিন্তা করে শেষমেষ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আসমান নিজের মাস্ক নিচে নামালো এক আঙুলে।কাজটি করার সময় তার দৃষ্টি আবদ্ধ রইলো রোযার নয়নমাঝে।কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ঘৃণা,সংকোচ কিংবা ভয়ের দেখা পাওয়া গেলোনা। অতি স্বাভাবিক তা, যেন এমন দৃশ্য প্রতিদিন অবলোকন করে অভ্যস্থ সে।
সামনে ঝুঁকে রোযার হাতের চামচ থেকে খেয়ে নিলো আসমান।মাস্ক পুনরায় উঠাতে গিয়ে খেয়াল করলো মেয়েটির অধরের হাসিটি বিস্তৃত হয়েছে।যার দরুণ মুখ ঢাকার প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দিলো সে। আস্তে করে বললো,
– লবণ ঠিক আছে।
– ওহ।তাহলে তো হলোই।
পুনরায় পাত্রের চিকেন স্যুপ নাড়তে মনোযোগ দিলো রোযা।তার পাশেই একজন দানবীয় সত্তার অধিকারী মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে তার কোনো পরোয়া রয়েছে বলে মনে হলোনা। হুট করেই গতকাল রাতের দৃশ্যটি আসমানের সম্মুখে ভেসে উঠলো প্রতিচ্ছবি হয়ে।মহাসড়কের ধারে,রাত্রির চাদরে,তারকার আচ্ছাদনে… কিভাবে অবিচলিত ছুঁয়ে দিয়েছিল তার কলংক এই মেয়েটি।বহুদিন বাদে আসমান কাউকে নিজেকে এতটা নিগূঢ়ভাবে স্পর্শ করতে দিয়েছিল। অস্বীকার করার জো নেই, ভালো লেগেছিল তার।ভীষণ ভালো।হৃদয়ের পাথর দরজায় যেন মৃদু এক করাঘাত করে গিয়েছে সেই কোমল স্পর্শ। আরো একবার তা অনুভবের বাসনা জেঁকে বসেছিল অবাধ্য অন্তরজুড়ে।কিন্তু নিজের মর্জির নিয়ন্ত্রক আসমান খুব সহজেই লাগাম দিতে পেরেছে অপ্রয়োজনীয় সকল অনুভূতিতে।
নার্সের আগমনে সহসাই নিজের মাস্ক তুলে পুনরায় মুখ ঢেকে ফেললো আসমান।রোযা একটি ট্রেতে নিজের দাদুর খাবার বেড়ে দিলো।নার্স তা নিয়ে আড়াল হয়ে যেতেই টেবিলে নিজেদের খাবার সাজাতে আরম্ভ করলো সে।
– আসো খাবে।
– আমি রুমে গিয়ে খাবো।
বাটিতে স্যুপ নিয়ে তার পাশে সদ্য টোস্ট করা পাউরুটির টুকরো সাজিয়ে রোযা জানালো,
– আজকে আমার সাথে খেয়ে দেখো।ভালো লাগবে।
আসমান জবাব দিলোনা কোনো।হাতের ফ্লাস্কে তার আঙ্গুলগুলো চেপে বসেছে।রোযা পিছনে ঘুরে তার হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললো,
– কই আসো?
সাথে সাথে এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিলো আসমান।তার নয়নে অকস্মাৎ ফুটে ওঠা বিতৃষ্ণা রোযার চিত্তে চির ধরিয়ে দিলো।
– একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছেনা?
বজ্রকণ্ঠের ধ্বনি কর্ণপাত হতেই হৃদয়ের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠলো।দৃষ্টি সরিয়ে নিলো রোযা, গুটিয়ে নিলো হাতখানা।একটু বেশীই অধিকার ফলিয়ে ফেললো সে?
– আমি করুণা পছন্দ করিনা।
বাক্যটি রোযার অন্তরে বিধলো মৃদু আলোড়নে।উল্টো ঘুরল আসমান।চুপচাপ এগোলো কিচেনের বাইরের দিকে।তার পিছনে স্থির দন্ডায়মান রোযা।
– আমি তোমাকে করুণা করছিনা।
কর্ণগোচর হলেও আসমান ফিরে তাকালোনা।সোজা চলে গেলো সিঁড়ির কাছে। একে একে ধাপ বেয়ে উপরে উঠার সময় হঠাৎই পকেটে থাকা ফোনটি ভাইব্রেট করে উঠলো।এক হাতে বের করে ফোন রিসিভ করে কানে দিলো সে।নিজে থেকে কিছুই বললোনা।ওপাশের কথা শেষ হতেই যথারীতি ফোন কেটে পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে আড়াল হয়ে গেলো নিজ আস্তানায়।
একলা দাঁড়িয়ে থাকলো রোযা।কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
পাগলের মতন হাসছে নিহাদ।তার উৎফুল্ল কণ্ঠের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে আবদ্ধ দেয়ালজুড়ে।হাতের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ঝুলছে ভেপ।সেটা ঠোঁটে ছোঁয়ানোর প্রচেষ্টার অব্যাহতি চলছে।তার এমন বেপরোয়া অবয়বের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনে বসা মানুষটি।কিছুটা দূরেই দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে থাকা আকাশ ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে, পুনরায় দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কি যেন ভাবছে।
– নাইস জোকস মিস্টার মাহিন।
ম্রিয়মাণ হয়ে এলো নিহাদের হাসি, তবে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি।তার চেহারাজুড়ে এমন এক উচ্ছলতা যেন ভীষণ বিনোদিত হয়েছে।
– আসমান ভাইয়ের খবর বের করতে আমার পেট খুঁচিয়ে কি লাভ?
অপরপ্রান্তে বসে থাকা মাহিন নামক লোকটি কিছুটা কর্কশ কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– তুমি খুব ভালো করেই জানো নিহাদ কেনো তোমাকে সন্দেহ করা হচ্ছে।আসমান বেঁচে থাকবে, আর ওর সম্পর্কে তুমি একটুও জানবেনা এমনটা আমি কেনো কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবেনা।
– পাগল ছাগল বিশ্বাস অবিশ্বাস করিয়ে না করিয়ে কি লাভ আমার?
নিহাদের প্রশ্নে আকাশ এবং মাহিন দুইজনের মাথাই চক্কর দিয়ে উঠলো।তার প্রশ্নটির ধাঁচ মেলাতে পারছেনা,কেমন ধাঁধায় পরে গেছে।তাদের চেহারায় দ্বিধা লক্ষ্য করে পুনরায় হেসে উঠলো নিহাদ।ভেপ ঠোঁটে ছোঁয়ালো।
– উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাদের সময় নষ্ট করার পাঁয়তারা করোনা।তুমি যদি কিছু জেনে থাকো তাহলে এক্ষুনি বলো।নাহলে তোমাকে…
– ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।সে তো কবেই মুছে গিয়েছে এই অন্তর থেকে।
ধোঁয়া বায়ুতে ফুস করে ছেড়ে তারপর বিড়বিড় করলো নিহাদ।তার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলেও তাতে কাঁচকলা হয়েছে তার।হঠাৎ আকাশ এগোলো।নিজের ফরমাল প্যান্টের পকেটে উভয় হাত ঢুকিয়ে নিহাদের দিকে চাইলো নিষ্পলক নয়নে।
– সেদিন হোমকেয়ার হসপিটালে ওই ছেলের সাথে তুমিও ছিলে নিহাদ।সাহায্য করেছ তাকে।
– উপস! ধরা পড়ে গেলাম নাকি?
খিলখিল করে হাসতে থাকলো নিহাদ।যে হাসির ধ্বনি বিরক্তি ধরিয়ে দেয় শরীরে।নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশ নিজেকে স্থির রাখলো।পরক্ষণে নিহাদের অবিচলিত চেহারায় দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে জানালো,
– একবার সাবধান করেছি।গোলাম হয়ে প্রভুর দিকে অ*স্ত্র তোলার পরিণাম ভালো হবেনা।
– আমি আমার প্রভুর দিকে শুধু অ*স্ত্র কেনো কখনো নজর তুলেও তাকাইনা। অকৃতজ্ঞ কুত্তা না এই নিহাদ।
নিহাদের হঠাৎ ভারিক্কি কন্ঠস্বর বুকে কেমন কাপন ধরিয়ে দেয়।অদ্ভুত এক শক্তি আছে তাতে,অনুভবের শক্তি।আকাশ এক নজর মেঝের দিকে তাকালো।তার যান্ত্রিক ভঙ্গিতেও প্রকাশ পেলো এক চিলতে হাসি।
– তোমার এই প্রভু…আসমান ভাই নিশ্চয়ই?
জবাব দিলোনা নিহাদ।ভেপ পুরলো ঠোঁটে।চেয়ে থাকল সিলিংয়ের দিকে। মাহিন ঝট করে উঠে দাঁড়ালো।টেবিলে একটা চাপড় দিয়ে উচ্চকন্ঠে বলে উঠলো,
– তুই আসলেই একটা কুত্তা নিহাদ।দেখি তোর প্রভু তোকে বাঁচাতে আসে নাকি!তার জন্য জান কো*রবান হবে তোর!
টু শব্দও করলোনা নিহাদ।আধ ঘণ্টার মাথায় সে আবদ্ধ হলো একটি চেয়ারে।একের পর এক বেধড়ক মা*রে তার সর্বাঙ্গ র*ক্তস্নাত হয়ে উঠল।তবুও অধর থেকে উৎফুল্ল হাসির বিলুপ্তি ঘটলোনা।বরং যন্ত্রণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো প্রফুল্লতার পরিমাণ। ট*র্চারসেলে তাকে ট*র্চারের কাজে লিপ্ত কে বি গ্রুপের সৈনিকেরাও এমন নিটল হাস্যোজ্জ্বল অবয়বে ভীত। তাদেরই নেতা সে,প্রজা হয়ে রাজার শরীরে আ*ঘা*ত হা*নতে একটু হলেও বাঁধছে তাদের।
– মিনহাজ, থামলি কেনো? মা*র মা*র… কি বলেছিলাম মনে আছে? ঘাড়ের দিকে মা*রলে বেশি ব্যথা লাগে… আরেকটা সেনসিটিভ স্পট হচ্ছে হাত পায়ের আঙুল…
মিনহাজ নামক সৈনিকের হাত কাপতে থাকলো।সহস্র প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নিহাদের শরীরে আ*ঘা*ত করার সাহস পেলোনা।
– আরে ব্যাটা তোরা ভয় পেলে হবে?বাদশাহর আরও একজন লিডারের দি এন্ড করার শখ হয়েছে। তোরাই তো সৈন্য সামন্ত…. তোরা না করলে কে করবে?রাফার বাপ?
সঙ্গে সঙ্গে আ*ঘা*তটা এলো মাথা বরাবর।ঝুলে পড়লো নিহাদ।স্পষ্ট অনুভব করলো কপাল বেয়ে গড়াতে থাকা উষ্ম তরল।টপটপ করে পড়ছে তার বুটজুতোর উপর।দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।হাসিটা ক্রমেই মলিন হয়ে পড়ছে।সেই ঝাপসা পটে ভেসে উঠলো অতীতের চিত্রগুলো……..
চট্টগ্রামের মুরাদপুর অঞ্চল। ফুটওভার ব্রীজের নিচ দিয়ে বয়ে চলা ব্যাস্ত সড়ক। মুড়ির টিনের মতন লোকাল বাসগুলো হাকডাক হাঁকিয়ে ধুমধুমার হর্ণ বাজিয়ে নিজেদের গন্তব্যে চলেছে।রেষারেষি লেগেছে এক ড্রাইভারের সঙ্গে অন্য ড্রাইভারের।অশ্রাব্য গালাগাল ভেসে আসছে ক্ষণে ক্ষণে।তবুও পরোয়া নেই ব্যাস্ত জীবনে ছোটাছুটি করতে থাকা শহরবাসীর।কারো আছে কলেজ, কারো ভার্সিটি, কারো অফিস কারো বা ঘরে ফেরার তাড়া।সড়কের ধারে থাকা বিরিয়ানীর দোকানগুলো মুখর হয়ে রয়েছে মধ্যবিত্ত থেকে আরম্ভ করে সামর্থ্যবান লোকেদের ভিড়ে।খুব কমই নিম্নবিত্তদের পদচারণা এদিকে চোখে পরে।সাধারণ কুলি মজুর রিকশাওয়ালারা নিজেদের দুপুরের খাবারের জন্য ভিড় করে ভাতের হোটেলে। বিরিয়ানীর সামর্থ্য তাদের নেই।
হাজীর বিরিয়ানীর দোকানটির সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর বয়সের ছেলেটি।পরিধানে মলিন শার্ট এবং ছেড়া থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।হাতে একটা পলিথিন। যাতে একটুখানি ভাত আর পেঁয়াজ মরিচ। ডাগর ডাগর চোখজোড়া চেয়ে রয়েছে বিরিয়ানীর দিকে। প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পরিবেশনের জন্য। কাচের দরজা দিয়ে চোখে পড়ছে ভেতরের মানুষগুলোর প্রফুল্ল বাক্য বিনিময় এবং খাবারের স্বাদ আস্বাদন।
লিকলিকে পা জোড়া একটু এগোয়, পরে আবার কি যেন ভেবে থমকে পড়ে।মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে হাত।দরকার হলে খু*নখারাবি করবে তবুও ভিক্ষা নয়।এমন এক অন্তর্জ্বালা বক্ষজুড়ে। ইট ভাঙতে ভাঙতে কালো হয়ে আসা হাতে মুখ মুছে নেয়,সেই কালিতে চেহারা হয় মলিন।কপালের ক্ষ*ত চিনচিন করে উঠে।যন্ত্রণায় মুখ কুচকে আসে।গত রাতে গলির মোড়ে তিনটাকে একাই শুইয়ে দিয়েছিল।কত বড় দুঃসাহস তার ফুটপাত দখল করতে আসে!আজকে আসলে আরো কয়েক ঘা দেবে।এমন পণ চিত্তে।
পিছিয়ে এলো সহসাই। বিরিয়ানীর সুঘ্রাণ পেটে মোচড় দিচ্ছে।উল্টো ঘুরে যেইনা ভিন্ন পথে পা বাড়াবে অমনি ধাক্কা খেল শক্ত সামর্থ্য পুরুষালী দেহের সঙ্গে।
– কোন সুদা…
কপাল ডলতে ডলতেও সামনের দৃশ্য দেখে থেমে গেলো। চোখজোড়ায় ফুটে উঠল কিঞ্চিৎ বিস্মিত এক দৃষ্টি।সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক।পরিধানে ফুলহাতা টি শার্ট আর জিন্স।চেহারায় শুভ্র বর্ণের মাস্ক।মাথায় সানক্যাপ,চোখ আড়াল নীলচে সানগ্লাসে।পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো।কিন্তু কন্ঠস্বরটি থমকাতে বাধ্য করলো।
– বিরিয়ানী খাবে?
অগ্নিদৃষ্টিতে পিছনে চাইলো কিশোর।
– টেয়া দিবি না আঁরে? [ ভিক্ষা দিবেন?]
বুঝা গেলো যে যুবক চট্টগ্রামের ভাষা বুঝতে পারে।
– আমি এক প্লেট সম্পূর্ণ খেতে পারিনা।একজন সঙ্গী থাকলে ভালো হয়।
– ওডো আঁই তর তালতো বইন লাগি নারে? মশকারী গরিবার জাগা ন ফর আঁর? এত্তর গোওর, এব্বাসন বিরানি হাই শেষ গরিন্ন ফারোর! [আমি কি আপনার তালতো বোন হই?মশকারি করার জায়গা পান না?এত্ত বড় বেটা এক প্লেট বিরিয়ানী খেয়ে শেষ করতে পারেননা?]
উত্তর এলোনা।যুবকের হাত চেপে বসলো তার কাঁধে।নির্দ্বিধায়।একবারও ভাবেনি এ তো নোংরা,ছুঁয়ে দিলে যদি অপবিত্র হয়ে যাই?এই বিষয়টি বি*দ্ধ হলো কিশোর হৃদয়ে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুক্ষণের মাঝেই নিজেকে আবিষ্কার করলো রেস্টুরেন্টের টেবিলে।আশেপাশের খদ্দেরগণ চেয়ে চেয়ে দেখছে।শুধুমাত্র ময়লা পোশাক পরে থাকা তাকেই নয়, বরং তার বিপরীত প্রান্তে বসে থাকা কিছুটা অভিজাত যুবকের দিকেও।মাস্ক খুলে রেখেছে সে।তাতে তার অতিরিক্ত শুভ্র ত্বক নজরে পড়ছে।এত ফর্সা পুরুষমানুষ বাপের জন্মে দেখেনি কিশোর।তাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।
– কীরে বদ্দা অঁনে ডুবাইঅলা নে? [আপনি কি বিদেশী?]
যুবকের কোমল অধরে ক্ষীণ এক হাসির রেখা ফুটলো।মাথা কাত করে জানালো,
– মেলানিনের অভাব।
– মেইল্লোনি তোর বউ না রে? ইতিত্তুন কী অইয়্যে দে? রসে ন কুড়কুড়ায়? রস বেজ্ঞিন ফরি গেইয়্যুই নেকি?
[মেলানিন?আপনার বউ নাকি?তার পিরিতির অভাব?]
হাসিখানা বিস্তৃত হলো।অল্প একটু দেখা গেলো দাঁতের অংশও।তার কথায় মজা পেয়েছে বোঝা গেলো।মাথা নাড়লো সে,মেলানিন কি জানা আছে।
– ওই রঞ্জক না?ত্বকের রং সৃষ্টি করে?
– হুম।পড়ালেখা করো তাহলে।
জিভে কামড় দিলো অজান্তে।যতই রংবাজি মাস্তানি করুক,পেটের খাবার বাদ দিয়ে হলেও স্কুলটা এখনো চালু রেখেছে।কেনো রেখেছে জানেনা।পড়ালেখা করে কি হবে তাও জানেনা।সাহেব হওয়ার ইচ্ছা নেই।তবুও পড়তে মন চায়।জ্ঞান তাকে টানে ভীষণভাবে।আর যাই হোক বাপ মায়ের মতন কখনো নিজের শরীরে অশিক্ষিত ট্যাগটা লাগাতে চায়না।
বিরিয়ানী চলে এলো।এক প্লেটই।চামচ হাতে তুলে নিলো যুবক।অপরদিকে ভদ্রতার বালাই ঘুচিয়ে গপাগপ গিলতে আরম্ভ করলো সে।কতদিন পর এই বিরিয়ানীর স্বাদ জিহ্বায় ঠেকলো!
– নাম কি?
এক চামচ মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো যুবক।মুখভর্তি বিরিয়ানী নিয়েই জবাব দিলো সে,
– নিহাদ।
গুণে গুণে তিন চামচ খেলো যুবক।সম্পূর্ণ প্লেট সাবার করলো নিহাদই।এক গ্লাস কোকে চিবুক ডুবিয়ে আড়চোখে দেখলো যুবককে।মানিব্যাগ বের করে বিল দিচ্ছে।নিহাদের দিকে ফিরলো।
– ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে?
– অঁনে ফরাইবান না? [আপনি পড়াবেন?]
– হুম।
– কিল্লাই?দুইন্নেত আইস্যুন দে শুক্কুরে শুক্কুরে আষ্টদিন ন অয় এইজু, আঁর বাপ নে অনে? [ক্যান? দুনিয়াতে আসছেন আটদিন হয়নি, আব্বা লাগেন আমার?]
– বড়ভাই।
উঠে পড়ল চেয়ার থেকে,বের করলো একটি কার্ড।নিহাদের দিকে বাড়িয়ে রেখে দিলো।
– কালকে সকাল ছয়টা ত্রিশে এই ঠিকানায় এসো।ঢাকায় নিয়ে যাবো।
আর কিছুই না বলে যুবক বাইরের দিকে এগোলো।অবাক চেয়ে রইলো নিহাদ।কার্ডের ঠিকানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে পরক্ষণে চেহারা বিকৃত করে বলে উঠলো,
– ওডা ফাইয়্যুস দে কী? আঁরে কিল্লাই ফন্না ফরাইবাল্লাই ঢ্যাং ঢ্যাং গরি ঘরত আঁ ফইরগে দে?[মগের মুল্লুক পাইছেন?পড়াবেন ক্যান আমাকে?]
যুবক পিছন ঘুরলনা। হাটা জারি রেখেছে।নিহাদ দ্রুত উঠে পিছু নিতেই তার কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো,
– কর্ম করলে ফল মেলে।গুন্ডাবাজি ভালোই জানো।
নিজের জায়গায় সম্পূর্ণ স্থির হয়ে পড়ল নিহাদ। একটুও আর নড়তে সক্ষম হলোনা।শুধু তাকিয়ে দেখলো রহস্যময় যুবকটিকে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যেতে।
সিদ্ধান্তে অটল ছিল।কিছুতেই অজানা অচেনা কোনো মানুষের দ্বারস্থ হবেনা।কেনো হবে?দিনতো যাচ্ছে বেশ মরিচভাত খেয়ে,ভাগ্য ভালো থাকলে কিছুটা ডালও জোটে।কি দরকার এই একলা পেটের?পেটের হয়ত দরকার নেই কিন্তু অন্তরের দরকার।আপনজন হিসাবে ভাববার মতন একটা মানুষ। যার ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া সম্ভব দুর্যোগের দিনগুলোতে।নিজের প্রয়োজন নয়,বরং আকাঙ্ক্ষাই নিহাদকে ভোরভোর টেনে নিলো আগ্রাবাদের তিনতারকা এক হোটেলের সামনে।ঘুমিয়ে পড়া শহর গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে সবেমাত্র।এর মাঝে হোটেলের সামনের সড়কে দাড় করানো এক মার্সিডিজ গাড়ি।অমোঘ এক আকর্ষণে পায়ে পায়ে হেঁটে নিহাদ পৌঁছেছিল তার পাশে।জানালায় মুখ বাড়িয়ে ভেতরে বসা ফর্সা শিশুসুলভ মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলেছিল,
– এ ডুবাইঅলা বদ্দা…. আঁই চিটাইঙ্গা ফুয়া, মেডিত ফরিলে লোয়া। আঁর ফুয়ারে তেড়িবেড়ি গইত্তো আইলে ঠ্যাং ভাঙ্গি আঁতোত ধরাই দিয়্যুম। [ দুবাইয়ের ভাই, আমি চট্টগ্রামের ছেলে, লোহার মতন।আমার সাথে তেড়িবেড়ি করলে পা ভে*ঙে হাতে ধরাই দিবো।]
হাতের রোলেক্স মডেলে সময় বলছে রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ।তেঁতুল গাছটির গুড়ির সাথে নিঃশব্দ অবস্থান আসমানের।সম্পূর্ণ কালো বর্ণের পোশাকে আবৃত শরীরে একেবারে মিশে গিয়েছে গাঢ় অন্ধকারের সাথে।শুধুমাত্র বিনিদ্র দৃষ্টিজোড়া তীক্ষ্ণ নজর রাখছে সামনের একতলা ভবনটিতে। আধঘণ্টা সময় ঐভাবেই স্থির থাকতে হলো তাকে।হঠাৎ পকেটে ভাইব্রেট করে উঠলো ফোন।দ্রুত তা কানে তুললো,
– ভাইয়া?কোথায় তুই?
জবাব নেই।নীরব দৃষ্টি অনঢ় লক্ষ্যে। স্বভাবে বুঝে গেলো চারুলতা যে আসমান কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আছে।
– আরিয়ার দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন একটু।আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম।
– ডক্টর উইলস্টোনের কাছে?
– হ্যাঁ।চিন্তা করিস না।আপাতত সব ঠিক আছে।বাসায় নিয়ে এসেছি।আর আরিয়া কিছুটা কেঁদেছিল।
আসমানের কপালে দুটো ভাঁজ পড়ল।
– এখন?
চারুলতা ফোন রাখতে উদ্যত হচ্ছিল।আসমানের প্রশ্ন সে আশা করেনি।কারো প্রতি উদ্বিগ্ন প্রকাশে সে তড়িৎকর্মা নয়।
– এখন ঠিক আছে।ঘুমিয়েছে।আমি আছি এখানে চিন্তা করিস না।
– চিন্তা করছি না।
উচ্চারণ করেই ফোন কেটে দিলো আসমান।সুইচড অফ করলো,অতঃপর পকেটে ভরলো।তার দৃষ্টি এবং মনোযোগ পুনরায় কেন্দ্রীভূত হলো।
আর দশ মিনিটের ভেতরেই দুটো গাড়ি বের হয়ে গেলো ভবনের গেট দিয়ে। সড়কপথে আঁধারে মিলিয়ে গেলো দ্রুতই।অপেক্ষা করলোনা আসমান।এগোলো, গাছের গুঁড়ির ধার বেয়ে। সামনের বারান্দার মতন দাওয়ায় পৌঁছতে সময় লাগলোনা তার।যেন স্বয়ং নৈঃশব্দ্য সে।এতটাই নিঃশব্দ তার চলন।খানিক শিকারী প্রাণীর মতন।উঠে এলো দাওয়ায়।দুজন ঘোরাফেরা করছে এদিক সেদিক।একজন অপরপ্রান্তে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে।আরেকজন তার দিকেই এগোচ্ছে,এখনো দেখতে পায়নি। রেলিং টপকিয়ে দেয়ালের আড়াল হলো আসমান।অপেক্ষা করলো গুণে গুণে বারো সেকেন্ড।হিসাব আগেই নজর রেখে সেরেছিল মস্তিষ্কে।গার্ড এইপাশে পৌঁছতেই বিড়ালের মতন ঝাঁপিয়ে পড়লো।
প্রথমে পাকড়াও করলো মুখ, ঘাড়ের ধমনী বরাবর ব*সিয়ে দি*লো হিডেন ব্লে*ড।ফিনকি দিয়ে র*ক্ত ছোটার আগেই টেনে সরিয়ে দেয়ালের আড়ালে হেলান দিয়ে রাখলো বর্তমানে নিথর শরীরটিকে।এবার অপরজনের পালা।সঙ্গীকে না দেখতে পেয়ে স্বভাবতই এগোলো দ্বিতীয় ভুক্তভোগী। একই প্রক্রিয়ায় ধরাশায়ী হলো সে।এখনো পর্যন্ত সবকিছুই আন্দাজের বাহিরে।খুব বেশিক্ষণ থাকবেনা।
দ্রুত এগোলো আসমান।চুপিসারে নমনীয় শরীর আঁধারে মিশিয়ে রেখে ঢুকে পড়ল ভবনের ভেতরে।খুব ভালোমত চেনা তার এই জায়গা।রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গিয়েছে এই আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের গাঠনিক কাঠামো।কোনো নকশার প্রয়োজন নেই।
ভেতরের দুজন গার্ডকে পাকড়াও করলো।একজনের বরাবর গ*লা*য় গা*থলো লম্বাটে ব্লে*ড।অদ্ভুত মৃদু গোঙানি শুনে আরেকজন তেড়ে আসতেই ঘাড় বরাবর প্রশিক্ষিত আ*ঘা*তে ধপ করে মেঝেতে পড়লো।কোনো ঝুঁকি নিলোনা আসমান।দুই হাতে ঘাড় আটকে একবার ডান,আরেকবার বাম দিকে মোচড় দিলো। মটমট করে আওয়াজ উঠলো, তারপরই লীলাখেলা সাঙ্গ।উভয়কে সোফার নিচে টেনে রেখে দ্রুত সিঁড়ির কাছে চলে এলো।ওপাশে বেজমেন্টের দরজা। আঁধারের মাঝেই নেমে গেলো তরতর করে।নিচে টিমটিমে আভার বাতির ব্যবস্থা রয়েছে।
সরু অলিগলির মতন পথ।তার দুপাশে কারাগারের ন্যায় খুপড়িঘর।একজনমাত্র তিন নম্বর সেলের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে।উৎকট ধোঁয়ার তামাটে গন্ধে পরিপূর্ণ আবদ্ধ ভারী পাতালবায়ু।আসমানের অবয়ব লক্ষ্য করলো সে মাদকীয় দৃষ্টিতে।
– কেডা রে? আবুইল্লা?
মাস্কের আড়ালে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালো আসমান।যাক।তাকে পরিচিত কেউ মনে করছে।কাজ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।বাকি অর্ধেক সে সম্পন্ন করলো অত্যন্ত দ্রুত।এগিয়ে গেলো, গার্ডের কাঁধে হাত রাখলো। বোটকা গন্ধটা মাস্কের ভেতর দিয়েও নাকে এলো।নেশায় বুদ হয়ে আছে। আরো ভালো!বন্ধুর মতন হাতখানা গার্ডের কাঁধে মুহূর্তেই রূপ নিলো বিষা*ক্ত সর্পিল স্পর্শে।
– আবুইল্লা….
বন্ধুর নাম শেষও করতে পারলোনা।সেলের শিকের উপর আছড়ে ফেলে নিজের পকেট থেকে নাইলনের দড়ি বের করলো আসমান।মুহূর্তে সাপের দেহের মতন তা পেঁ*চিয়ে গেলো গার্ডের ক*ন্ঠে,মুখে চেপে বসলো ব্ল্যাক রাবারগ্লাভস পরিহিত বলিষ্ঠ হাত।টু শব্দও সম্ভব হলোনা।শুধু চাপা গোঙানি।ছটফট করলো দে*হ, মিনিটখানেক।তারপর প্রাণপাখি মৃ*ত্যুদূতের সামনে মাথা নত করলো।এলিয়ে পড়লো মেঝেতে।
ত্রিশ সেকেন্ড সময় ব্যয় হলো চাবি বের করতে।সেলের দরজা খুলে ঢুকে ভেতরের চেয়ারে মাথা ঝুঁকিয়ে পরে থাকা র*ক্তসিক্ত অবয়ব নজরে পড়ল আসমানের।এগিয়ে গেলো।মাথাটা ধরে দেখলো বন্ধ চোখের পাপড়ি।দুই গালে হাত ঠেকিয়ে দ্রুতগতিতে চাপড় দিতে থাকল একটানা।
– নিহাদ?
– উম… হুম? আই সেইড আই ডোন্ট নো এনিথিং!ইউ…
চিৎকার করে উঠতে গেলেও থমকে গেলো নিহাদ।তার দৃষ্টি এখনো কিছুটা ঝাপসা।তবুও ওই কৃষ্ণগহ্বর উদ্ভাসিত দৃষ্টি চিনতে মোটেও ভুল হলোনা।র*ক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে আসা ঠোঁটেও হাসি ছড়িয়ে পড়ল নিহাদের।
– আসমান ভাই?
দ্রুত নিহাদের বিশেষ চেয়ারের লক খুলে ফেললো আসমান।ছাড়া পেয়ে দুর্বল শরীরেও লাফিয়ে উঠলো সে তাগড়া জোয়ানের মতন।উদ্যত হলো আসমানকে জড়িয়ে ধরতে,কিন্তু পরক্ষণে কি ভেবে নিজেকে দমালো।
– সরি ভাই।
আসমান কিছু বললোনা উত্তরে।উল্টো ঘুরে এগোলো সেলের বাইরে।
– হাঁটতে পারবে নাকি ঘাড়ে তুলবো?
– আই অ্যাম সিক্সটি কেজি প্লাস!
– আই ক্যান লিফট এইটি কেজি।
হাসলো নিহাদ।অজানা কারণে কিছুতেই নিজের হৃদয়ের প্রফুল্লতা দমাতে পারছেনা।উভয়ই অগ্রসর হচ্ছে।একটা সেলের সামনে থমকে পড়লো নিহাদ।তারপর তীর্যক হেসে আসমানকে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাই।যাওয়ার আগে একটা ধামাকা করলে কেমন হয়?
মুখফুটে কিছুই উচ্চারণ করলোনা আসমান।কিন্তু তার দৃষ্টির বাসনায় স্পষ্ট প্রকাশ পেলো আকাঙ্ক্ষা। ধ্বংসযজ্ঞের আকাঙ্ক্ষা!তেলের ড্রাম ফেলে তেল গড়িয়ে আনলো সে বাইরের করিডোর পর্যন্ত।আসমান পকেট থেকে বের করলো লাইটার।সেটা ফেলে দিলো প্রান্তে।তেলের পথ অনুসরণ করে অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে গেলো অগ্নিদেবতা।উভয় পুরুষ দ্রুত পদক্ষেপে উঠে এলো দুই তলায়।ঠিক তখনি…
বিকট প্রকম্পনে কেঁপে উঠল সমগ্র ভবন।উত্তাপ এবং দাউদাউ শিখায় জ্ব*লে উঠলো পাতালকক্ষ।যা ধ্বস নামালো ভবনের দেয়ালে দেয়ালে।সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য পদক্ষেপ।এগিয়ে আসছে দ্রুত।উত্তাপ সহ্য করা দায়। দৌঁড়ে বারান্দা পেরিয়ে বাইরের উঠানে এলো আসমান এবং নিহাদ।র*ক্ত ঘামে সিক্ত নিহাদ মুখ ঘষে তাকাতেই বৃক্ষের আড়ালে নিজের প্রিয় বাইকটি দেখতে পেলো।এক নজর তাকালো আসমানের দিকে।রীতিমত শিশুসুলভ উত্তেজনাকর দৃষ্টি।সড়কের চতুর্দিকে জমতে শুরু করেছে গুটিকতক বাইক এবং জীপ।নিজের বাইকটি দ্রুত গেটের সামনে আনলো নিহাদ।হেলমেট ছুড়লো আসমানের দিকে। এক হাতে ক্যাচ ধরে ছুটে গেলো আসমান।
ডার্কসাইড পর্ব ১৪
নিজের হেলমেটের উইন্ডো নামিয়ে পিছনে তাকালো নিহাদ।দ্রুত এগিয়ে আসছে গাড়ী।পাশে প্রজ্জ্বলিত কে বি গ্রুপের রাজত্বের ছোট্ট একটি অংশ।একনজর আসমান আরেক নজর গাড়িবহরের দিকে চেয়ে ঠোঁটের কোণ এবং বাম ভ্রু একইসঙ্গে উঁচু হয়ে উঠল নিহাদের,
– আই চিটাইঙ্গা ফুয়া, মেডিত ফরিলে লোয়া!ফাসেন ইওর সিটবেল্ট কুকুরছানারা!দ্যা রেইস বিগিনস নাউ!
