ডার্কসাইড পর্ব ২৮
জাবিন ফোরকান
কে বি গ্রুপ আসলে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান? নাকি সন্ত্রাসী সংগঠন?
উত্তর…..দুটোই।
ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে কে বি গ্রুপ শুধুমাত্র একটি ব্যবসাকেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির লোভে ধীরে ধীরে কালো জগতের আঁধারে নিজেদের শিকড় বিস্তৃত করতে শুরু করে।কিছুটা সফলতা লাভ কে বি অধিপতিদের আকাশচুম্বী চাহিদা কোনোদিন পূরণ করতে সক্ষম হয়নি।শুধুমাত্র ক্ষমতা নয়,ক্ষমতার কেন্দ্রের রাজসিংহাসনের প্রয়োজন ছিল তাদের।
তাই এমন পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম।ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে যতটা না ব্যবসায়িক মস্তিষ্কের সুচারু চালে বধ করা হয়,তার থেকেও অধিক দমন করা হয় পিছনে কলকাঠি নেড়ে কিংবা জীবননাশ করে।সেখান থেকেই ধীরে ধীরে হিটটিম,সাইবার টিম, অ্যাসাসিন বাহিনীর উৎপত্তি।ক্ষমতার জোর এতটাই প্রভাবশালী হলো তাতে যে স্বয়ং সরকারের মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণও পরোক্ষভাবে চলতে থাকলো কে বি গ্রুপের নির্দেশে।মুষ্টিবদ্ধ হয়ে পড়ল প্রভাব প্রতিপত্তি।যা আজকের দুর্বার, দুর্ভেদ্য এবং ক্ষমতাশালী কে বি গ্রুপের মূলভিত্তি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাদের ব্যবসা শুধুমাত্র ইন্ডাস্ট্রি আর কর্পোরেশনে সীমাবদ্ধ নেই।অবৈধ অ*স্ত্র থেকে আরম্ভ করে ড্রা*গ পাচার, মানি লন্ডারিংয়ের মতন বিষয়গুলোতেও পরোক্ষ অবদান রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের।নাহলে সম্পদের এই বিরাট পর্বত কোনোদিন তৈরি হতো না।তাদের এই অন্ধকার দিক সম্বন্ধে হাতে গোণা কিছু মানুষই জ্ঞাত।কর্তৃপক্ষ অর্থের কাছে হাতের পুতুলমাত্র।কে বি গ্রুপকে রুখবার কেউ নেই! যারা রুখতে চেয়েছিল,সেই রেমান গ্রুপের অস্তিত্বও বিলীন করে দিয়েছে কে বি অচিরেই।
এই অদম্য কে বি গ্রুপ এবং তাদের সৃষ্ট মার*ণাস্ত্র আসমান।উভয়ের তাণ্ডবলীলায় তটস্থ সকলে।কি*লিং মেশিনের দিন ফুরিয়ে এসেছে আচমকাই। তা কিছুটা হলেও কে বি গ্রুপের দুর্ভেদ্য দেয়ালে চির ধরিয়েছে।প্রভাব কার অধিক ছিল আদতে?কে বি অধিপতি নাকি তার মেশিনের?মনিবের থেকেও ক্রীতদাসের ভয় যখন হৃদয়কে অধিক কাপায় তখনি মনিব বুঝতে পারে,তলোয়ারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সে;যেকোনো মুহূর্তে নিজেই তার রোষানলে পতিত হবে।
ঠিক এমন কিছুই ঘটছে বর্তমানে বাদশাহ কায়সারের সঙ্গে।
চট্টগ্রামের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।লাগেজ সংগ্রহ করে টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে বাইরের সড়কে নামতেই দেশের মাটির সুঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকলো।ধোঁয়ায় ভরপুর বায়ু,মাত্রাতিরিক্ত কোলাহল, যানবাহনের ক্রমাগত শব্দদূষণ।তবুও এই অতি পরিচিত জায়গা যে হৃদয়ের খুব আপন!নিজের জন্মভূমি।
কে বি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এখনো এক সপ্তাহ বাকি রয়েছে।আসমান এবং চিত্রলেখা আগেভাগেই এসেছে,কাউকে না জানিয়ে।কারণ?দেশটাকে একটু ঘুরে দেখতে চায় চিত্র।নিজের সন্তানকে পরিচিত করাতে চায় তার শেকড়ের সঙ্গে। অমত করেনি আসমান।যতই বিদেশে সুখে শান্তিতে থাকুক না কেনো, এই দেশের প্রতি কিছুটা হলেও টান তার রয়েছে। নাড়ির টান কখনো ছিন্ন করা সম্ভব নয়।হোটেল এবং ক্যাব আগে থেকেই বুক করা ছিলো।বাইরের সড়কে অপেক্ষা করছে বোর্ড হাতে, দেখা যাচ্ছে। চিত্রলেখা এগোতেই আসমান অনুসরণ করলো।তার এক হাতে লাগেজ, অন্যহাতে রাজকন্যা মেঘ।বাবার জ্যাকেটের কলার আঁকড়ে ধরে মহা বিস্মিত দৃষ্টিতে সে চারপাশ অবলোকন করছে।
ক্যাবে উঠে হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ হলো। ব্যাকসিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো চিত্র।নিজের সানগ্লাস খুলে নিলো।
– উফ, এই জ্যাম, ভিড়, তারে মোড়ানো দেশটাকে মিস করেছি।
– সব খারাপ দিকগুলোই মিস করেছ দেখছি।ভালো কিছু নেই?
আসমানের প্রশ্নে হাসলো চিত্র।কনুইয়ের গুতো দিয়ে জানালো,
– ভালো খারাপ পৃথিবীর অধিকাংশ বস্তুতেই রয়েছে।আমার দেশ তো আমার দেশই, হোক সে যেমন তেমন।এই মাটি আমার,এই মানুষগুলো আমার আপন।এটুকুই দেশকে ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট।
– তোমার জন্ম ইতালিতে হয়নি?
– অবশ্যই নয়।দুই মাস বয়স থাকাকালীন ফরিদপুরের এক এতিমখানা থেকে দত্তক নিয়েছিলেন ড্যাড আমাদের।
কথাটি সমুজ্জ্বলভাবেই বললো চিত্র,সামান্যতম খেদ নেই অনুভূতিতে।বিলাল রেমান চিরকুমার একজন মানুষ,জীবনে কোনোদিন বিয়ে করেননি, চিত্র এবং চারু তার দত্তক নেয়া যমজ সন্তান।এই তথ্যটি বাইরের মানুষদের জন্য সম্পূর্ণ অজানা হলেও পরিবারের সকলে জ্ঞাত।নিজের সন্তানদের আঁধারে রাখেননি তিনি কোনোদিন।কিন্তু তাতে পিতা সন্তানদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি।
আসমানের কোলে কুইকুই করে চলেছে মেঘ।তাকে নিজের বুকে ঠেকিয়ে ঘাড় পর্যন্ত গড়ানো মসৃণ কুচবরণ চুলে হাত বুলিয়ে দিলো আসমান।চিত্র পাশ থেকে বললো,
– চুল বেড়ে যাচ্ছে। ছেটে ফেলতে হবে।
কথাটি মেঘ বুঝতে পারলো কিনা কে জানে!মুখ বিকৃত করে এমন ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকালো যে আসমান এবং চিত্র উভয়ে হেসে উঠলো।
– উহু, একদম না।আমার প্রিন্সেস রূপাঞ্জেলের চুলের উপর কোনো অত্যাচার সহ্য করা হবেনা।আমরা টিম লম্বা চুল,তাইনা মামণি?
– আ…আহ…
আসমানের গলা আঁকড়ে খিলখিলে হাসির ধ্বনি তুললো মেঘ।
– হ্যাঁ করো করো।বাপ মেয়েতে মিলে আমাকে অতিষ্ঠ করো আরো।পৃথিবীতে ভালো মানুষের কদর নেই।যত্তোসব!
মুখ ভেংচে মিছিমিছি রাগের ভান করে জানালায় তাকালো চিত্র।তাতে আসমান ঝুঁকে টুপ করে তার গালে স্নেহের চিহ্ন এঁকে বললো,
– আমরা তোমায় ভালোবাসি বলেই তো অতিষ্ঠ করি, মাই কুইন!
– ঢং!
রাগ করে থাকতে পারলোনা চিত্র,ফিক করে হেসে ফেললো। ক্যাবের ড্রাইভার ক্ষণে ক্ষণে আয়নায় দৃষ্টি ফেললো।পিছনের সিটে বসা পরিবারটির খুনসুঁটি বেশ মনোমুগ্ধকর ঠেকছে তার কাছে।আহ,কি গোছানো একটি সংসার!খোদা যেন তাদের আজীবন এমন মায়ায় জড়িয়ে রাখেন—স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন দোয়া আসে অন্তর থেকে।
কিছুক্ষণ বাদেই বড়সড় জ্যামে আটকালো গাড়ি।প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষা এবং গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা মেঘকে আসমান বাইরে নিয়ে গেলো।ফুটপাতে হাঁটতে থাকলো যেন খুব বেশি কষ্ট না হয় মেয়ের।ঠিক তখনি এক বৃদ্ধ বয়সের ফেরিওয়ালা হেঁটে গেলো পাশ দিয়ে, আসমানকে দেখে থামলো।ঘর্মাক্ত অঙ্গ মুছে বললো,
– সাহেব…পুতুল নিবেন আফনার কইন্যার জন্য?
আসমান উত্তর করার আগেই মেঘের ক্ষীপ্র হাত টেনে ধরলো লাঠিতে ঝুলতে থাকা তিনটি পুতুলের একটি।কালো রঙের টেডি বিয়ার,নীলচে চোখ।মৃদু হেসে বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা জানালো,
– এইডা কেউ নিতে চায়না,কালো দেইখ্যা কেউ পছন্দ করেনা।আফনার মাইয়া মাশাআল্লাহ,আল্লায় দিলে একদম পরীর লাহান।
– দাম কত এটার?
– একশো বিশ টাকা।দেখতে কালো হইলেও কোয়ালিটিতে সবচাইতে ভালা।আমার নিজের নাতনী চাইছিল,দেইনাই এই দামী জিনিস।
হাসলেন বৃদ্ধ,কিন্তু তার শুষ্ক হাসির মাঝারে লোকায়িত হাহাকার স্পষ্ট টের পাওয়া গেলো।সে পুতুলটি খুলে মেঘের হাতে ধরিয়ে দিলো।আসমান নিজের ওয়ালেট বের করতেই মেঘ নিজে টাকা দেবে বলে উৎসাহী হয়ে পড়ল।হেসে তাকে সুযোগ দিতেই এক মুঠোয় দুটো এক হাজার টাকার নোট টেনে নিলো,বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলার চেষ্টা করলো,
– আই… আ!
– আরে আরে করেন কি করেন কি?আমার কাছে ভাঙতি নাই এত।
– আপনি রেখে দিন, চাচা।
ফ্যালফ্যাল করে আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকলো বৃদ্ধ।আসমান পুনরায় বললো,
– আমার মেয়ের হাতে উঠেছে যখন,আপনি রাখুন।বিনিময়ে ওকে একটুখানি দোয়া করে দেবেন।
– না না সাহেব,আমি ক্যামনে…
– যে দুটো পুতুল বাকি আছে, সে দুটো আপনার নাতনীকে দেবেন,আমার মেয়ের তরফ থেকে তার জন্য উপহার।
বৃদ্ধের নয়ন বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নামলো। তা মুছে টাকা নিয়ে ঝুঁকলেন তিনি,মেঘের কপালে চুমু দিলেন।আসমান কোনো বাঁধা দিলোনা,মৃদু হাসি নিয়ে চেয়ে রইলো।
– দোয়া করি,খুব সুখী হোক আপনার কইন্যা,খুব সুখী হন আফনে আর আফনার পরিবার।আল্লাহ যেন আপনারে ভালো রাখে,দুঃখ কষ্ট দিলেও যেন সুখের উছিলায় তা মুইছা দেয়।
সালাম দিয়ে বিদায় নিলো বৃদ্ধ।চেয়ে রইলো আসমান, তার বুকে প্রশান্তি ভর করেছে।তখনি গাড়ি থেকে ডাক আসলো চিত্রর,
– কই?মেয়েকে নিয়ে হারিয়ে গেলে নাকি? জ্যাম এই ছাড়লো বলে।
হেসে মেঘকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো আসমান।সদ্য কেনা পুতুলটা তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে বোঝা গেলো, চিত্রকেও টেনে নিতে দিলোনা। আপনমনেই সেটা জড়িয়ে আসমানের কোলে বসে খেলছে সে। পিতা মাতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো।
২১ শে সেপ্টেম্বর।
আজ কে বি গ্রুপের আয়োজনে ঢাকার অন্যতম বিখ্যাত কনভেনশন হলে আয়োজন করা হয়েছে পার্টির। নামীদামী সব মানুষজন থেকে শুরু করে সেলিব্রিটিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।বাদ পড়েনি মন্ত্রী আমলাগণও।পুরো শহরই যেন সেই নিয়ে মেতে রয়েছে।
গতকাল রাতেই ঢাকায় এসেছে আসমান এবং চিত্রলেখা।গত এক সপ্তাহ তারা কাটিয়েছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে।সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজার,শ্রীমঙ্গল,কুয়াকাটা….ইত্যাদি সব স্থানে প্রকৃতির সনে মেলবন্ধনে পার করেছে স্বর্গীয় সময়।সন্ধ্যা ছয়টার সময় উভয়ই প্রস্তুত হয়ে রওনা দিয়েছে কনভেনশন হলের উদ্দেশ্যে।গাড়িতে বসে একদফা নিহাদের সঙ্গে কথা সারলো আসমান।বেচারা এখানে উপস্থিত নেই।আসমানের সঙ্গে দেখা করার প্রবল ইচ্ছা তাকে ধামাচাপা দিতে হয়েছে মিশনের কারণে।পাকিস্তানের লাহোরে রয়েছে সে বর্তমানে। হুট করে বাংলাদেশে আসাও সম্ভব নয়।তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বিলাল রেমানের সঙ্গে কথা হলো।তিনি আজ সকালেই মাত্র দেশে এসেছেন এক বিজনেস ডিলের উদ্দেশ্যে, কয়েকটা দিন থাকবেন মাত্র, অতঃপর পাড়ি জমাবেন ইতালিতে।তার সঙ্গে এসেছে চারুলতাও।
চারুলতা মেয়েটাকে একটু এড়িয়ে চলে আসমান।কারণ?সে আন্দাজ করতে পারছে মেয়েটির তার প্রতি শুধুমাত্র একজন বড় ভাইয়ের অনুভূতি ছাড়াও ভিন্ন কিছু রয়েছে।যদিও নিজের অনুভূতি লোকাতে সে পারদর্শী,কিন্তু আসমান মাঝে মাঝে টের পায়।বিশেষ করে বিয়ের পরপরই যখনো সে এবং চিত্রলেখা আলাদা থাকতে শুরু করেনি তখন তার আচরণ এবং দৃষ্টিতে কিছু অনুভব করেছিল।তবে তাকে এই নিয়ে কোনোদিন কিছু বলেনি চারু।আসমান জানে, বলবেও না।নিজের আপুর সুখের জন্য সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।যেহেতু সে নিজেই নিজের তরফ থেকে সাবধান হয়ে গিয়েছে,তাই আসমান ব্যাপারটি নিয়ে খুব বেশি জলঘোলা করেনি।চারুলতা জানেও না সে এই বিষয়টি সম্পর্কে আন্দাজ করেছে।
কনভেনশন হলে পৌঁছতে সাতটা বাজলো।প্রাইভেট এন্ট্রি পথ ব্যবহার করে ভেতরে প্রবেশ করলো আসমানের গাড়ি।নিজেদের পারিবারিক সম্পর্কযুক্ত সদস্যদের জন্য তিনতলায় আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছে।উপস্থিত স্টাফ তাদের সেখানেই নিয়ে গেলো।ইতোমধ্যে পার্টি শুরু হয়ে গিয়েছে পুরোদমে।নিচের ফ্লোর থেকে উদ্দাম মিউজিক এবং মানুষের কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে।কিন্তু সেই আনন্দ উল্লাসে যোগদান করতে ইচ্ছুক নয় আসমান।সে বাদশাহ কায়সারের সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবে, এমনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
করিডোর পেরিয়ে কক্ষের দিকে যাওয়ার সময়েই খানিকটা দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্যবশত উল্টোদিক থেকে বাদশাহ কায়সার এবং তার দুইজন গার্ডকে হেঁটে আসতে লক্ষ্য করা গেলো।আসমান নিজের স্থানে দাঁড়িয়ে পড়ল, চিত্রও। বাদশাহর দৃষ্টি উভয়ের উপর আপতিত হতেই আসমান হাত বাড়িয়ে চিত্রর হাতখানা শক্তভাবে ধরলো,হালকা চেপে যেন আশ্বাস প্রদান করলো।দৃশ্যটি খেয়াল করে কে বি অধিপতি এগোলেন।আসমানের দিকে তার নয়নজোড়া পতিত হলো।অনুভূতিহীন দানবকে আজ পুরোদস্তুর এক মানুষ বলে অনুভূত হচ্ছে তার।এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা নিজের জীবদ্দশায় উপলব্ধি করবেন বাদশাহ তা আজ থেকে কিছু বছর আগেও কখনো কল্পনা করেননি।
– বদলে গিয়েছে ভীষণ।
তার বাক্যের উত্তরে নিঃশব্দ রইলো আসমান।অপরদিকে গুরুজন হিসাবে ঝুঁকে তাকে সালাম করলো চিত্রলেখা।
– ওহ,এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।আমার প্রার্থনা তোমাদের সাথেই আছে।
চিত্র উঠে দাঁড়াতেই তার কোলে নড়চড় করতে থাকা মেঘের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন বাদশাহ।অদ্ভুত হলেও সত্য যার নয়নে নির্বিকার অভিব্যক্তির বদলে এক স্নেহযুক্ত মায়া ফুটে উঠল। হাত বাড়ালেন তিনি, আসমান সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া ব্যাতিত অধিক কিছু করলেন না বাদশাহ।বললেন,
– চমৎকার।শি ইয আ লিটল ফ্লাওয়ার।
– থ্যাংক ইউ।
জবাব দিয়ে চিত্রলেখা মেঘকে নিজের বুকে আরো শক্তভাবে আগলে নিলো।এক নজর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন বাদশাহ,অতঃপর বিড়বিড় করলেন,
– আমার কথা রাখার জন্য ধন্যবাদ।
– আমি তাহলে আসলাম।
আসমান বলতেই তার দিকে তাকিয়ে বাদশাহ হাসলেন।
– এত তাড়া কিসের?অনুষ্ঠানে এসেছ,এভাবেই চলে যাবে?তাছাড়া তোমার সঙ্গে কথাও এখনো হয়নি।
– একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হতো।
– অবশ্যই,অবশ্যই।ভেতরে যাও, বসো,একটু কিছু মুখে দাও।আমি নিচ থেকে আসছি,ছোট্ট একটা মিটিং করবো।এরপর তুমি আজীবনের জন্য মুক্ত।
আসমান কিছু বলতে যাচ্ছিলো।কিন্তু বাদশাহ সেই সুযোগ প্রদান না করে স্টাফকে নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে গেলেন।অগত্যা একটি নিঃশ্বাস ফেলে অগ্রসর হলো তারা।
উপরতলার প্রাইভেট রুমে মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক কম।গুমোট আবদ্ধ পরিবেশ।টকটকে লাল এবং নিগূঢ় কালো রঙের থিমে সাজসজ্জা করা হয়েছে। গোথিক স্টাইলে ওয়াইন রেডে আচ্ছাদিত সোফাসেটগুলোতে বসে একে অপরের সঙ্গে আলাপে মত্ত সকলে।একপাশে ফুড কাউন্টার, তার উপর চকলেট ফাউন্টেন ভীষণ দৃষ্টি কাড়ছে। গ্রামোফোনে বেজে চলা ইউরোপীয় মিউজিকের মৃদু ধ্বনি মূর্ছিত করেছে সময়।কয়েকজন ওয়েটার ড্রিঙ্কস নিয়ে পায়চারি করে চলেছে।
উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে অধিকাংশকেই চিনতে পারলো আসমান।বাদশাহ কায়সারের কাছের লোক হিসাবে খবরাখবর রাখা হয়েছে বিস্তর।প্রথম সোফায় বসা আলাউদ্দিন,হিট টিমের অ*স্ত্রের মূল যোগানদাতা।এপাশে আছে পুত্র নাবিল কায়সার, যার সঙ্গী মিনিস্টারের সন্তান রায়হান।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেটে মনোযোগী সাইফ।সাইফের পরিচয়টা একটু ঘোলাটে।কালো জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সে,কে বি গ্রুপের সঙ্গে দহরম মহরম তাই ভালোই।তারা ছাড়াও কক্ষে অন্যান্য রমণী উপস্থিত রয়েছে।বাদশাহ কায়সারের বড়ো এবং মেজো মেয়ে, তাদের স্বামীরাও।এই মানুষগুলো কায়সার পরিবারের অন্যদের থেকে আলাদা,নিতান্তই সাধারণ মানুষ হিসাবে তাদের চালিয়ে দেয়া সম্ভব।
আসমান ভেতরে প্রবেশ করতেই সকলের দৃষ্টি আপতিত হলো তার গোটা পরিবারের উপর।বিস্ময়ে কারো কারো চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা,কেউ আবার নির্বিকার, নাবিলের মতন।বান্দা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে এক মুহূর্ত চেয়েই।মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকে একদম এক পাশের সোফায় বসলো আসমান।চেনা পরিচিত কয়েকজন তার কাছে এলো,কিছু কথা বলে আবার বিদায় নিলো। বাদশাহর বড়ো কন্যা এগোলো, চিত্রলেখার পাশে বসে রাজ্যের গল্প করতে থাকলো যেন তারা কতদিনের সখী।মেঘকেও আদর করতে ছাড়লোনা।বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আসমানের ফোনে একটা মেসেজ এলো।
“ তিন তলার সাত নম্বর কেবিনে এসো।তোমার অপেক্ষা করছি।”
পাশ থেকে চিত্র তা দেখলো।আসমান ফোন পকেটস্থ করে উঠলো,
– চলো…
– আমার যাওয়ার দরকার আছে?তুমি যাও।আমি এখানেই অপেক্ষা করছি,আপুর সাথে।
একবার চারিপাশে তাকালো আসমান।অনেক মানুষই রয়েছে এখানে।বাদশাহ কায়সারের বড়ো কন্যা মুখ বাড়িয়ে হেসে বললো,
– আরে যাও যাও তুমি,আমি আছি ওর সঙ্গে।
– ঠিক আছে।
ঝুকলো আসমান, চিত্রলেখা এবং মেঘ উভয়ের কপালে আদর ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে বললো,
– আমি দ্রুতই চলে আসবো।
মৃদু হাসলো চিত্র।মেঘ বাবার স্যুট খামচে ধরলো, কিছুতেই যেতে দিতে রাজী নয়।তাকে কিছুটা জোর খাটিয়েই ছাড়িয়ে নিতে হলো।তারপর উল্টো ঘুরে শেষ একবার পিছনে তাকিয়ে রুমের বাইরে অদৃশ্য হলো আসমান।
প্রায় বিশ মিনিট পর ধীরে ধীরে রুম থেকে মানুষ কমে আসতে থাকলো।সকলেই নিচের ফ্লোরে নেমে যাচ্ছে, কোনো এক চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতুল্য অভিনেতা এসেছেন,তাকেই দেখার তোড়জোড়।নেহায়েত বেরসিক মানুষ বাদে সকলেই ছুটে গিয়েছে পর্দার মানুষটাকে বাস্তবে দেখার আশায়।বাদশাহ কায়সারের বড়ো কন্যা চিত্রর সাথে গল্পেই মত্ত। রেমান এবং কায়সার পরিবারের কোন্দলের বিষয় নিয়ে তার মাঝে কোনো বিভেদ দেখা গেলোনা।স্বাভাবিক মানুষই সে।কথাবার্তায় যতটুকু বোঝা গেলো,আসমানের নতুন জীবন শুরুতে সে বেশ খুশিই হয়েছে।বারবার মেঘের দিকে তাকাচ্ছিল মুগ্ধ দৃষ্টিতে,বিয়ে অনেক বছর আগে হলেও এখনো সন্তানের মুখ দেখা হয়নি।তাই হয়ত এমন টান।
– তারপর আমি…
তার কথার মাঝখানেই স্বামী এলো,কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। চিত্রর দিকে তাকিয়ে হেসে সে বললো,
– আমি একটু আসছি কেমন?
– ঠিক আছে আপু।
– ওয়েটার,ওনাকে একটা অরেঞ্জ জুস দাও।
নির্দেশ প্রদান করে স্বামীর সঙ্গে রুমের বাইরে চলে গেলো সে।এতক্ষণ সে থাকায় এখানে ঠাঁয় বসেছিল।কিন্তু এখন আর সেই ইচ্ছা হচ্ছে না।আশেপাশে যে কয়জন উপস্থিত আছে,সকলেই পুরুষ।কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে হৃদয়ে।জুসে গোটাকয়েক চুমুক দিয়েই তাই উঠে পড়লো চিত্র নিজেও, মেঘকে কোলে নিয়ে পা বাড়ালো দরজার উদ্দেশ্যে।ফোন বেজে উঠল রিংটোনের শব্দে, তা তুলে কানে ধরলো।বিলাল রেমান ফোন করেছেন,
– তোমরা কতদূর?
– হ্যাঁ ড্যাড।এইতো কিছুক্ষণ পরেই…
বলতে বলতে বেরোনোর পথেই চিত্র অতর্কিতে মুখোমুখি হলো একজনের।খয়েরী স্যুটে আচ্ছাদিত ইটালিয়ানের ঠোঁটে তীর্যক হাসি ফুটলো তাকে লক্ষ্য করেই।
– ওয়েল ওয়েল ওয়েল… উই মিট অ্যাগেইন সুইটহার্ট!
– সান্দ্রো!
এটুকুই বলার সুযোগ হলো।এক ঝটকায় নিজের ফোন হাতছাড়া হলো চিত্রর।মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেলো তা।মস্তিষ্কে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো তার। তড়িৎ গতিতে বাইরে ছুট লাগাতে গেলেই পিছন থেকে হ্যাঁচকা টান খেলো।
– টু স্লো…. কিটেন!
নাবিল কায়সার!সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে পড়লো চিত্র।সে কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া করার আগেই সান্দ্রোর ক্ষীপ্রতায় আটকে গেলো রুমের দরজা।সম্পূর্ণ আবদ্ধ হয়ে পড়লো কক্ষ।নিজের হৃদস্পন্দন আর অনুভব করতে পারছেনা চিত্র,সে ফাঁদে পড়ে গেছে! মেঘকে বুকে চেপে পিছাতে থাকলো।রুমে বন্দী সে এবং গুটিকতক পুরুষ।কি হতে চলেছে তার সঙ্গে?নিশ্চয়ই ভালো কিছু নয়।
সান্দ্রো বাঁকা হেসে ইটালিয়ানে কি যেন বিড়বিড় করলো, যার অর্থ চিত্র ব্যাতিত কেউ বুঝলোনা।
– আমি তো মেসেজ পেয়েছিলাম খাসা একটা মাল আছে, তাই একটু দেখতে এলাম।এ তো মাল নয় সাক্ষাৎ পরী দেখছি!আহ…ভাগ্য তোমাকে আমার দুয়ারেই আনলো তাহলে শেষমেষ?
শরীর শিরশির করে উঠলো চিত্রর।এখানে প্রত্যেকেই নেশায় বুদ হয়ে রয়েছে।নয়নের ঘোলাটে দৃষ্টি আর জড়ানো কথাই সব ঘোষণা করে দিচ্ছে।সাহস না হারিয়ে জোরপূর্বক চিৎকার করে তাদের ভড়কে দেয়ার চেষ্টা চালালো সে।
– খবরদার বলছি!আমাকে কিছু করার পরিণাম ভালো হবেনা!
– কেনো গো বুলবুলি?আমরা তোমাকে খুব সুখ দেবো, চিন্তা করোনা। দ্যা মোর, দ্যা গ্রেটার এক্সপেরিয়েন্স।
– আসমান যদি জানতে পারে তাহলে আপনাদের একটাকেও জীবিত ছাড়বেনা!
চিত্রর দিকে এগোতে গিয়েও আসমানের নাম শুনে থমকে গেলো নাবিল।স্পষ্টত তাকে ভাবতে লক্ষ্য করা গেলো।চিত্র তাকে আরও ভড়কে দেয়ার আগেই অবশ্য আলাউদ্দিন অতর্কিতে পিছন থেকে চুল টেনে ধরলো তার।ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো সে।
– মেয়েমানুষ এত অবাধ্যতা কিসের হ্যাঁ?সারারাত আছে নাকি আমাদের কাছে?
– আমাকে ছাড়ুন বলছি…
– ছাড়বো না,কি করবি রেমানের গুষ্টি?
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো মেঘ।যেন নিজের মায়ের বিপদটুকু সে আন্দাজ করতে পেরেছে।তাতে ভ্রু কুঁচকে ফেললো নাবিল।
– এই জিনিসটা তো বিপদ!
– ওটাকে টেবিলে ফালা।
– না!আমার মেঘ…
আঁকড়ে ধরলো মেঘকে চিত্র।নাবিল এবং আলাউদ্দিনের মতন দুইজন শক্তিশালী পুরুষের সঙ্গে সে ঠিক পেরে উঠলোনা। ধস্তাধস্তিতে ছিঁড়ল তার পরিধানের বস্ত্র,খামচির দাগ পড়লো সুদর্শনা চেহারায়।তবুও নিজের সন্তানকে ছাড়তে রাজী নয়।চিৎকার করে কেঁদে চলেছে অবুঝ শিশু। আঁকড়ে রেখেছে মায়ের বুক।রুমের একমাত্র নিশ্চল সত্তার দিকে তাকালো চিত্র।সাইফ,তখনো ওই একইভাবে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ধূমপান করে চলেছে।সাহায্যের আশায় তাকালেও পুরুষটি নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।বোঝা গেলো, কোনো সাহায্যই লাভ সম্ভব নয়।
জোর করে মেঘকে চিত্রর কাছ থেকে ছাড়িয়ে ফুড স্টলের টেবিলের উপর রাখা হলো।
– তোরা কি আদও মানুষ?একেকটা জানোয়ার!
কেঁদে উঠে চিৎকার করতেই চিত্রর মুখ চেপে ধরলো সান্দ্রো। আছড়ে ফেললো তাকে সোফায়।এক টানে ছিঁড়ে ফেললো তার কাপড়।ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগলো চিত্রর নয়ন বেয়ে।তবুও হার মানতে রাজী নয় সে। সান্দ্রোর তলপেটে হাঁটু দিয়ে আ*ঘাত করে উঠলো চিত্র, নিজের পরনের হিল জুতা খেলে সজোরে ছুঁড়ে দিলো নাবিল আর আলাউদ্দিনের উপর।
ছুট লাগালো ফুড স্টলের দিকে।কিন্তু পৌঁছানোর আগেই তার গোড়ালি চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে মাটিতে ফেললো নাবিল।চড়চড় করে উঠে এলো চিত্রর উপর, চে*পে ধরলো কন্ঠ।
– শালী,বেশি তেজ না তোর?এই তেজ মেটাচ্ছি আমি!
পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালালো নাবিল, তারপর উত্তপ্ত সেই শিখা ছুঁইয়ে দিলো চিত্রের চিবুকে।য*ন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো,চোখ ঠিকরে উপচে নো অশ্রু তার।কিন্তু তাতে কি জন্তুর মনে মায়া হয়?পুরুষ নামক ন*রপিশাচগুলো তাতে আরো অধিক উত্তেজিত হয়!চিবুকে কালো দাগ ফেলে এগোলো গলায়, ধীরে ধীরে উন্মুক্ত বুকে… এরপর?সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাস্যময়ী নারীদেহের উপর ক্ষুধার্ত পশুর মতন হা*মলে পড়লো নাবিল,তার দলে যোগ দিলো আলাউদ্দিন।মহাভোজে মত্ত শিকারীগণ।
সম্ভ্রম হরণ?উহু, ঘটনাটিকে শুধুমাত্র এটুকুতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।এক অমানবিক উপাখ্যানের রচনা। বিকৃত মানসিকতার সর্বোচ্চ স্তর।পুরুষ নামক জাতির সর্বকালের কুখ্যাত সেই লালসার প্রদর্শন।যতটা বিভৎসভাবে করা সম্ভব,যেন পরাশক্তিরাও এহেন কদর্যতা লক্ষ্য করে ভয় পেয়ে যায়!
আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হলো একজন মায়ের আর্তনাদে, রাতের তারারাও নিজেদের আভা বুজিয়ে নত হলো এক নারীর দুর্বিষহ আবেদনের কাছে।এই কি ছিল প্রাপ্য?এই কি পরিণতি এই সৌন্দর্যের?সত্যিকার অর্থে সৌন্দর্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।মানবিকতা মানেই চারিত্রিক লালসার কাছে সর্বদা মুখ থুবড়ে পড়ে।
ক্রমশ নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি লোপ পেলো চিত্রর।আত্মরক্ষার কিছু বিন্যাসে সে পারদর্শী হলেও কিছুই প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না এই হায়েনার দলের সঙ্গে।শক্তির পার্থক্য। অরেঞ্জ জুসের সাথে কিছু মিশ্রিত করে খাওয়ানো হয়েছে তাকে।শরীর তাই লড়াইয়ের বাসনা ত্যাগ করেছে,অবশ হয়েছে প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।উপভোগে সুবিধা তাতে। চিত্রলেখা যে মুহূর্তে এই রুমে পা রেখেছে,ঠিক ওই মুহূর্ত থেকেই রচনা হয়েছে এই ষড়যন্ত্র।
টেবিলের উপর ক্রন্দনরত মেঘের চিৎকার ভেসে আসছে কানে,সহস্র চেষ্টা সত্ত্বেও চিত্রর মাঝে বিন্দুমাত্র শক্তি এলোনা ওঠার।সমস্ত শরীর তার র*ক্তা*ক্ত হয়েছে। কাম*ড়ে, ব্লে*ডের ঘর্ষণে, সিগারেটের ছেঁকাতে… যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে নিজেদের নৃশং*সতা জাহির করেছে। অ্যালেকোহল এবং লাস্যময়ী নারীদেহ সকলের মাঝে লোকায়িত দানবটিকে উন্মুক্ত করেছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দ্বিধা করছেনা কেউই। চিত্রর দুটি পা আঁকড়ে ধরলো দুজন,দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ায় আর দেখতেও পেলোনা সে কারা। সোজোর টানে চি*রে এলো অভ্যন্তর!যন্ত্রণা? আর অনুভূতই হচ্ছেনা!
রুমের একপাশে দাঁড়িয়ে রঙ্গলীলা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সাইফ।অংশ নেয়ার থেকে দেখতেই বেশি ভালো লাগে তার।তাইতো দেখছে নীরবে।কিন্তু বাচ্চাটা শান্তি দিচ্ছে না।টেবিলে গড়াগড়ি দিয়ে আ*ছড়ে পড়েছে শক্ত মেঝেতে।মাথা ফে*টে র*ক্ত যাচ্ছে।চিৎকারে টেকা দায়।একটি নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো সাইফ।টেবিল থেকে তুলে নিলো ফল কাটার ছু*রি।হাঁটু মুড়ে বসলো কাদতে কাদতে হাত পা ছুঁড়তে থাকা মেঘের সামনে।ঠিক তখনি অতর্কিতে দরজাটা খুলে গেলো।বাইরে থেকে লকের চাবি হাতে উঁকি দিলো গাঢ় কালো মেকআপে সজ্জিত রাফা এবং পাশে রায়হান।এক মুহূর্তের জন্য অভ্যন্তরের দৃশ্য উভয়কে বিস্মিত করে দিলো।
সোফার এদিকটায় মেঝেতে বিবস্ত্র ক্ষ*ত বিক্ষ*ত চিত্র।তার চারপাশে ঘিরে আছে তিন তিনটি ন*রপিশাচ।বিপরীত পাশে মেঝেতে ক্রন্দনরত র*ক্তস্নাত শিশু এবং তার ঘা*তক সাইফ।এক নজর ভোজের দিকে তাকালো রায়হান, বাকা হাসি হেসে মুহূর্তেই নিজের শার্টের কলার ঢিলে করতে করতে এগিয়ে গেলো।
– তোমরা সবাই মজা নিচ্ছো আমাকে বাদেই? এ কেমন কথা?
– প্লীজ জয়েন!
রাফা তাকিয়ে থাকলো।প্রায় জ্ঞানহীন চিত্রর সঙ্গে তার এক পলক চোখাচোখি হলো।একজন রমণী হয়ে অপর এক রমণীকে এই অবস্থায় সে ফেলে যাবে না নিশ্চয়ই?
হায় চিত্র!তুই যে বড্ড সরল এ নিষ্পাপ!
ক্রুর হেসে বলে উঠলো মস্তিষ্ক।রাফার ঠোঁটে বিস্তৃত হাসি দেখা গেলো।মাথা কাত করে সে বললো,
– ওয়ান্ডারফুল!প্লীজ কন্টিনিউ!
দরজা পুনরায় আটকে দিলো সে। চিত্রর শুকিয়ে আসা চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে নামলো।ঝাপসা নয়ন পরমুহুর্তেই দৃষ্টিপাত করলো তার নয়নের মণির উপর।সাইফ এক হাতে গ*লা চে*পে তুলে ধরেছে মেঘকে,টকটকে লাল হয়ে আসা চেহারায় কেঁদে চলেছে ছোট্ট নিষ্পাপ সত্তা।বিন্দুমাত্র দয়া হলোনা স্বয়ং শয়তানের!তীব্র গতিতে নেমে এলো ছু*রি…অতঃপর?
ধপ করে মেঝেতে এলিয়ে পড়লো মেঘের ছোট্ট প্রাণহীন দে*হ।দৃশ্যটি অবলোকন করলো জন্মদাত্রী।শুধুমাত্র মেঘ নয়,তার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও প্রাণপাখি হারালো সে। বুজে এলো চোখের পাতা।তার আগে দেখলো র*ক্তা*ক্ত ছু*রি হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে সাইফ, খুলে নিচ্ছে নিজের পোশাক। ওইটুকুই।
বদ্ধ দৃষ্টির মাঝে শুধু শুভ্র ওই মুখচ্ছবি এবং তার কোলে খিলখিল করে হাসতে থাকা রাজকন্যার অবয়ব ভেসে উঠলো চিত্রলেখার।শেষ নিঃশ্বাস টানার পূর্বে বিড়বিড় করলো,
– আমাকে ক্ষমা করে দিও….. আসমান।
তার প্রার্থনা জানোয়ারগুলো শুনতে পেলোনা।শুনবে কিভাবে?আপন জগতে ব্যাস্ত তারা। ব্যাস্ত চরম অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায় প্রদর্শনে।
স্বয়ং নরকও যেন ভ্রু কুচকে সেদিন প্রার্থনা করল, এদের জায়গা দেয়ার মতন অপবিত্র যেন সে কোনোদিন না হয়!
বাদশাহ কায়সারের সঙ্গে আলাপ শেষ করে হন্তদন্ত করে বেরোলো আসমান।সত্যি বলতে,মানুষটি তেমন কিছুই চায়নি।শুধুমাত্র নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কিছু ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা সম্পর্কে পরামর্শ চেয়েছে।আসমান যতটুকু পেরেছে দিয়েছে।সম্পূর্ণ সময় তার অস্বস্তিতে কেটেছে কোনো এক অজানা কারণে।দ্রুত চিত্রর কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন।বিলাল রেমান বেশ কয়েকবার তাকে ফোন দিয়েছে, টের পায়নি ফোন দূরে সাইলেন্ট থাকার কারণেই।বাদশাহ কায়সারের অপেক্ষা করতে করতে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে চিত্রকে মেসেজ করছিল,ওই মুহূর্তে তিনি আসায় সেটা বেখেয়ালে টেবিলে রেখেই দূরের সোফায় বসে পড়েছিল।কেনো ফোন করেছেন বিলাল এতবার?চিন্তা করে দ্রুত কলব্যাক করতে যেতেই তার পথ আটকে দাঁড়ালো কালো গাউন পরিহিত এক রমণী।তাকে দেখেই আসমানের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
– হুম….ভুলে গেছ আমাকে?
এই রমণীকে ভোলা সম্ভব?কোনোদিন নয়,সে যা যা করেছে তাতে তার রাফা কায়সার নামটা আসমান মৃ*ত্যুর আগপর্যন্ত ভুলতে পারবেনা।যদিও চিত্রর শান্তনায় সেই গ্লানি তার অনেকখানি কমে এসেছে।তবুও, এই মুখটি দেখলেই তার অস্বস্তি হয়।
– আমার একটু তাড়া আছে রাফা ম্যাম,আপনি প্লীজ…
– আই মিসড ইউ। সো মাচ!
তাকে রীতিমত উপেক্ষা করেই এগিয়ে এসে সহসাই জড়িয়ে ধরলো রাফা।নিজের মুখ গুজলো আসমানের বুকে।দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করলো।
– আই মিসড দিস সেন্ট….
বিদ্যুৎ খেলে গেলো আসমানের সর্বাঙ্গে।এক ঝটকায় সে রাফাকে দূরে সরালো,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো বহুকষ্টে।
– ডোন্ট টাচ্ মি….প্লীজ।
– ডোন্ট ইউ লাইক ইট?
রাফার দৃষ্টিতে নিজের ধারালো দৃষ্টি মেলালো আসমান,তারপর কঠোর কন্ঠে ঘোষণা করলো।
– আই অনলি লাইক টু বি টাচড বায় মাই ওয়াইফ।
রাফাকে তর্কের কোনোপ্রকার সুযোগ না দিয়েই সে রীতিমত ছুট লাগালো। বাঁধা প্রদান না করে তীর্যক হাসি নিয়ে তার চলে যাওয়া পথের পানে তাকিয়ে থাকলো রাফা।যাক,গিয়ে দেখুক,একটু বুঝুক নিজের অবস্থান!
চিত্রকে যেখানে রেখে গিয়েছিল সে রুমের কাছে এসেই দরজা বন্ধ দেখে আসমান হতবিহ্বল হয়ে পড়ল।ব্যাপার কি?আশেপাশে তাকালো, কেউই নেই।এমন তো হওয়ার কথা নয়!সবথেকে অশুভ চিন্তাটাই তার মাথায় এলো সর্বপ্রথম।এজন্যই বিলাল রেমান এতবার কল দেননি তো? চট করে ঝুঁকে জুতোর সোলের ভেতর থেকে ছোট্ট একটি ফলাযুক্ত ছু*রি বের করলো আসমান,এখানে অ*স্ত্র নিয়ে আসা সম্ভব ছিলোনা।কিন্তু একেবারেই বেহুদা আসতে নারাজ ছিল সে।তাই এটুকু ব্যবস্থা।যদিও দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় অভ্যাস হারিয়েছে। তী*ক্ষ্ণ ফলাটি লকে ঢুকিয়ে সে কয়েকবার মোচড় দিলো। তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হলো।মৃদু ক্যাচ ধ্বনি তুলে দরজা খুলে যেতেই ভেতরে ঢুকলো। প্রথম দর্শনে নিজের চোখকে নিজের বিশ্বাস করে উঠতে পারলোনা সে কয়েক সেকেন্ড।
সবে ভোজ সম্পন্ন করে সোফায় এলিয়ে রয়েছে হায়েনার দল।মেঝেতে র*ক্তগঙ্গায় ভাসছে আসমানের অর্ধাঙ্গিনী, অতি ভালোবাসার প্রেয়সীর বি*ভৎস মৃ*তদে*হ। অপর পাশে গঙ্গা তৈরি না হলেও রক্তিম জমাটের পুকুরে পাথর হয়ে থাকা ফ্যাকাশে বর্ণের ছোট্ট রাজকন্যা।আসমানের পৃথিবী এক ঝটকায় গুঁড়িয়ে গেলো।কাপতে থাকলো তার সর্বাঙ্গ!এ নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন? এক্ষুণি ঘুম থেকে উঠবে সে,দেখতে পাবে চিত্রর পাশে শুয়ে আছে সে,ক্রিবে নিদ্রাচ্ছন্ন মেঘ।তাইনা?
হাঁটু ভেঙে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল আসমান।যখন কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরেও দুঃস্বপ্ন কাটলোনা,তখন তীব্র প্রকম্পনে শরীর তার ঝটকা খেতে থাকলো অদ্ভুতভাবে।হামাগুড়ি দিয়ে সে এগিয়ে গেলো, অপ্রকৃতস্থর ন্যায়।এক হাতে তুললো নিজের রাজকন্যার র*ক্তা*ক্ত দে*হ।
– মেঘ…. মামণি আমার….
পুতুল যেন।বিন্দুমাত্র নড়চড় নেই। ঝাঁকির সঙ্গে ছোট ছোট হাত দুখানা দুলছে এদিক সেদিক।মাথাটা বাকা হয়ে ঝুলছে নিচের দিকে। ধীরগতিতে দৃষ্টি ফেরালো আসমান পাশে,তার ভালোবাসার ধ্বংসস্তুপমাত্র পড়ে আছে সামনে।কিছুই অবশিষ্ট নেই,কিছু না!একটি মাং*সপি*ণ্ড শুধু। অঙ্গ প্রত্যঙ্গও খু*লে এ*সেছে।এক হাতে মেঘকে জড়িয়ে চিত্রর কাছে এগোলো। ঝুকলো।হায়েনার দলের উপস্থিতির কোনো পরোয়া নেই তার নিকট।সে বিলীন আপন জগতে।কপালে কপাল ছোঁয়ালো,
– চিত্র…আমার পৃথিবী… চোখ খোলো.. আমি এসেছি।
খুলবেনা।তার চিত্র চোখ খুলবে না আর কোনোদিন।কেন খুলবে?কুলাঙ্গার স্বামীকে বরণের উদ্দেশ্যে?যে স্বামী জীবিত থাকার পরেও,উপস্থিত থাকার পরেও তাকে এমন নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করতে হলো তার উদ্দেশ্যে?
তার বুকের উপর মেঘের দে*হটি স্থাপন করে সরে গেলো আসমান।একফোঁটা জল গড়ালোনা তার নয়ন বেয়ে।উল্টো অধরে ফুটলো হাসি।হাসতে থাকলো সে, পাগলের মতন।সেই হাসির শব্দে এলিয়ে পড়া হায়েনাদের শরীরে কম্পন খেলে গেলো।এ কেমন হাসি?কিসের হাসি?
হাসতে হাসতেই দৃষ্টি তুলে হায়েনাদলের দিকে তাকালো আসমান।হিমশীতল শিহরণ বয়ে গেলো প্রত্যেকের শিরদাঁড়া জুড়ে।নেশা কেটে গিয়েছে।কোন তাণ্ডবলীলার সূত্রপাত ঘটিয়েছে যেন মাত্রই অনুভব করেছে।তাদের চাইতেও ভ*য়ংকর দানবের জন্ম দিয়েছে আজ নিজেদের অজান্তেই।যার নিঃস্বতার অশরীরী হাসি আমন্ত্রণ জানিয়েছে পরাশক্তিদের।
ডার্কসাইড পর্ব ২৭
একদল সশ*স্ত্র লোক সহসাই প্রবেশ করলো রুমের ভেতরে।নেতৃত্বে রাফা কায়সার।ফিরেও তাকালোনা আসমান শুধু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো নিজের পায়ে।তাকে দাঁড়াতে দেখে ভড়কে গিয়ে গার্ডরা বিনা কারণেই পিছিয়ে গেলো।লক্ষ্য করে আবারও হাসলো আসমান।
বাঁধ ভেঙেছে আজ চাঁদের হাসি।রচিত হতে চলেছে তার কলঙ্কের মহাউপাখ্যান।
