ডার্কসাইড পর্ব ৩
জাবিন ফোরকান
– আসমান… দ্যা কি*লিং মেশিন।
নিজের পিতা বাদশাহ কায়সারের কন্ঠে উচ্চারিত নাম এবং তার সম্বোধন শুনে কয়েক মুহূর্ত তব্ধা খেয়ে বসে রইলো নাবিল।তার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি একবার পিতা এবং পরেরবার আপতিত হলো তার ঠিক পিছনেই সামরিক স্ট্রেট ভঙ্গিতে শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে।
পুরুষের বদলে হৃদয়ে ছেলে শব্দটি উত্থাপিত হওয়ার কারণ তার চেহারা।শারীরিক কাঠামো সুগঠিত সুঠাম হওয়া সত্ত্বেও তার মুখমন্ডল যেন শিশুসুলভ মায়ায় আচ্ছাদিত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফর্সা তার দৈহিক বর্ণ। সাধারণত পুরুষ মানুষদের ত্বক এতটা ঔজ্জ্বল্যের অধিকারী হয়না। অন্তত এই উপমহাদেশের পুরুষরা সচরাচর এমন বর্ণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে অভ্যস্থ নয়। তার ত্বকের শ্বেত ভাবটি অদ্ভুত এক আবহের প্রকাশ ঘটায়। অনুভূতিহীন পাথরকঠিন তীক্ষ্ণ চেহারা, তার মাঝে প্রজ্জ্বলিত পটলচেরা আঁখিজোড়া, অত্যন্ত গভীর যার দৃষ্টিশক্তি।
ঠিক যেন সদ্য কফিন থেকে বেরিয়ে আসা কোনো র*ক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার—
নিজের ব্যাক্ষায় নিজেই স্তম্ভিত হয়ে রইলো নাবিল।সে কি এইমাত্র ছেলেটিকে ভ্যাম্পায়ারের সাথে তুলনা করলো? কিন্তু তারই বা দোষ কোথায়? বিদেশী সিনেমাতে ভ্যাম্পায়ারের চরিত্রের যেমন দৈহিক প্রদর্শন ঘটানো হয়, তার সঙ্গে এই ছেলেটির অবয়বের খুব একটা পার্থক্য নেই বললেই চলে। চোখ দুটো পর্যন্ত বিনা কারণে অদ্ভুত এক র*ক্তপিপাসু অনুভূতির জাহির করছে।
– আসমান?
নিজের ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দন্ডায়মান ছেলেটিকে পুনরায় মনোযোগী ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো নাবিল। বাদশাহ কায়সার নিজের কনিষ্ঠ সন্তানের হাবভাবে কিছুটা আশাহত অনুভব করলেন যেন।একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,
– আদিল চৌধুরীর বিষয়টি ও সামলাবে।
– বাবা!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাক্যটি শুনেই রীতিমত আতকে উঠলো নাবিল। আদিল চৌধুরী তার পিতা বাদশাহ কায়সারের একজন ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী।এই লোক নিজের লাভের খাতিরে যেকোনো পন্থা অবলম্বনে প্রস্তুত তা ভালো হোক কিংবা মন্দ।কিছুদিন আগেই একটি পার্টিতে নারীতে মত্ত হয়ে উশৃঙ্খল আচরণ করা নাবিলের কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি আয়ত্ব করে নানাভাবে হু*মকি ধাম*কি প্রদান করছে আদিল চৌধুরী।তাই নিয়ে চিন্তিত গোটা কায়সার পরিবার।অধিক বিচলিত অবশ্যই নাবিল, কারণ তার পিতা তাকে আগেই হুশিয়ারি দিয়েছিলেন যে এবার গড়বড় হলে কোম্পানিতে উচ্চপদ লাভের বাসনা তাকে ত্যাগ করতে হবে।
কিন্তু এমন একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার,যেটি সম্পর্কে শুধুমাত্র পারিবারিক সদস্য বাদে আর কাউকেই বিশ্বাস করতে সক্ষম হচ্ছেনা কায়সার পরিবার; সেখানে এই ছেলেটির সামনে সবকিছু অবলীলায় স্বীকার করার অর্থ কি?নিজের পুত্রের দ্বিধান্বিত দৃষ্টি লক্ষ্য করে মখমলি সোফায় হেলান দিলেন বাদশাহ।অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
– ইউ ডোন্ট নো হিম অ্যান্ড ডোন্ট নিড টু। বাট হি উইল ডু হিজ জব পার্ফেক্টলি ওয়েল। সো, কোঅপারেট।
বলেই উঠে পড়লেন কে বি সাম্রাজ্যের অধিপতি বাদশাহ কায়সার। ধীর পদক্ষেপে চললেন কক্ষের বাইরে।তখনি দন্ডায়মান হলো নাবিল।
– কিন্তু বাবা একে কিভাবে বিশ্বাস করবো?
থমকালেন বাদশাহ।উল্টো ঘুরে নাবিলের উদ্দেশ্যে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।তার শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ফাঁক হলো সহসাই।
– কোনো পালিত কুকুর কখনোই মনিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনা।
তার গম্ভীর কণ্ঠের বাক্যটি শুনতেই আসমানের দিকে চাইলো নাবিল। ছেলেটিকে এক প্রকার কুকুরের সঙ্গেই তুলনা করেছেন বাদশাহ!তবুও তার শূন্য চেহারার মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটলোনা।একদম স্থির দন্ডায়মান সে, দৃষ্টি পর্যন্ত একই দিকে আপতিত।যেন শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি কোনো ভাস্কর্য।
– চিন্তা করোনা। ওর কাজের পারিশ্রমিক মিলিয়নের সমতুল্য। কাজে কোনপ্রকার হেরফের হবেনা।
এটুকু বলেই বাদশাহ কায়সার কক্ষ ত্যাগ করলেন।অপরদিকে তার রেখে যাওয়া কি*লিং মেশিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকলো নাবিল।
কালো লেদার জ্যাকেট এবং ডেনিম জিন্স পরিহিত জন্তুটির সামনে নাবিলের নিজেকে অসহায় মনে হতে থাকলো।আসমান কোনোপ্রকার নড়চড় পর্যন্ত করছেনা।তবুও তার অস্তিত্বের এক শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে, যা নির্দিষ্ট সীমানায় অবস্থানরত অপর অস্তিত্বকে আঙুল হেলানো ব্যাতিতই দুস্থে পরিণত করতে পারে। একটি ঢোক গিললো নাবিল, নিজের বুকে দুবাহু ভাঁজ করে রেখে খানিক কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– সো…. তুমি কি আদিল চৌধুরীকে এই দুনিয়া থেকে সরাতে পারবে?
– জ্বি।
একটিমাত্র শব্দই শুধুমাত্র সেদিন উচ্চারণ করেছিল আসমান।
ঠিক তার পরেরদিন সারা দেশের ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হলো একটি খবর,
“ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অকাল মৃ*ত্যুবরণ করেছেন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘চৌধুরী ইন্ক’ এর কর্ণধার আদিল চৌধুরী।”
নিজের বেডরুমের টিভিতে খবরটি দেখে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নাবিল।অবশেষে সে রক্ষা পেয়েছে।কে বি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে লাগতে আসলে এই পরিণতিই হয়!কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবেনা এটি স্বাভাবিক মৃ*ত্যু নয় বরং হ*ত্যাকান্ড!
অতঃপর নাবিলের আর কোনোপ্রকার সন্দেহই রইলোনা কেনো তার পিতা আসমানকে কি*লিং মেশিন বলে সম্বোধন করে অভ্যস্থ।
আসমানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সেই দিন স্মরণ করতে বাধ্য হলো নাবিল। এই নির্জন অরণ্যের মাঝে, অন্ধকারের দানের আবহে, পালানোর পথ হারিয়ে পুনরায় মুখোমুখি সে তার পিতার কি*লিং মেশিনের সঙ্গে! একটি মাত্র নির্দেশে যে নিজেকে র*ক্তস্নাত করতে দ্বিতীয়বার ভাবার প্রয়োজনবোধ করতোনা। নাবিলের আদেশে সে মৃ*ত্যুদূত হয়ে আবির্ভূত হয়েছে কত শত মানুষের জীবনে!তবে আজ সেই মৃ*ত্যুদূত, সেই বাধ্য পালিত কুকুর নিজের মনিবকে নিঃশেষ করতেও দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেনা।
– আসমান….তুই… বেঁচে আছিস!
নাবিলের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে কোনোপ্রকার অনুভূতি প্রদর্শিত হলোনা আসমানের মাঝে।ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এলো, অপরদিকে তার এমন শিকারী ভঙ্গিতে অগ্রসর হওয়া লক্ষ্য করে নিজের অজান্তেই পিছিয়ে পড়লো নাবিল। এতক্ষণ আঁধারে সে খেয়ালই করেনি আসমানের কোমরের বেল্টে ঝুলন্ত একটি লম্বা নাইলনের দড়ি।সেটা এক টান দিয়ে খুলে আসমান নিজের হাতে পেঁচাতে আরম্ভ করলো, এবং নাবিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা তার বহাল রইলো। একটি শক্ত ঢোক গিলে নাবিল কাপতে কাপতে বিড়বিড় করলো,
– দে…. দেখ আসমান… আম…আমাকে ছেড়ে দে… তুই যত টাকা চাইবি আমি দিয়ে দেবো! বল কত চাই তোর?এক কোটি?দুই কোটি? না… দশ কোটি!তোকে আমি দশ কোটি দেবো!
– টাকা?
আসমানের নিগূঢ় কন্ঠস্বরটি যেন বজ্রধ্বনির ন্যায় আবর্তিত হলো।তাতে নিজের শরীরের সমস্ত জোর হারিয়ে ধপাস করে মাটিতেই বসে পড়ল নাবিল।দুই হাত জোড় করে সে ঝুকলো।যেন দেবতার নিকট মাথা ঠু*কে ম*রছে কোনো অনুসারী, নিজ অন্যায়ের ক্ষমা প্রার্থনা করছে।
– প্লীজ, আমাকে মাফ করে দে!আমাকে ছেড়ে দে আসমান…. দয়া কর…!
গাছের গুঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রোযা এমন দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে রইলো।ক্ষমতাধর নাবিল কায়সার কিনা ক্ষমা ভিক্ষা চাইছে কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তির নিকট?ব্যাপারটা ঠিক কেমন হলো?এখানে সত্যিকার ক্ষমতাধর আসলে কে?
নাবিলকে উপেক্ষা করে মাটিতে ঝুকলো আসমান।লাল জ্যাকেটটি তুলে নিয়ে হালকা ঝেড়ে সেটা ছুঁড়ে দিলো রোযার উদ্দেশ্যে। পোশাকটি পাকড়াও করলো রোযা।তার দিকে দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে গাছের গুড়ি থেকে সরে যাওয়ার নীরব নির্দেশ দিলো আসমান।বিনা তর্কে সেই আজ্ঞা পালন করলো রোযা। জ্যাকেটটি গায়ে চড়িয়ে যেই না সে দূরে সরে যেতে উদ্যত হলো ঠিক তখনি তার পা আঁকড়ে ধরলো নাবিল।
– সুমি!
থতমত খেয়ে গেলো রোযা।নাবিল বোধ হয় ধারণা করেছে যে সে কোনোভাবে আসমানের সঙ্গে যুক্ত।তাই কাদোকাদো হয়ে সে আর্জি পেশ করল,
– সুমি প্লীজ,তুমি ওকে বোঝাও!ও যেন আমাকে না মা*রে…
– আমাকে ছাড়ুন!
কঠোর কন্ঠে বলার চেষ্টা করে জোরপূর্বক নিজের পা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো রোযা।কিন্তু নাবিল ক্রমশ আরো শক্তভাবে তাকে ধরে বসলো।
– না সুমি…তুমি ওকে বলো…তুমি বললে ও আমাকে ছেড়ে দেবে!
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রোযা।এই নাবিল কায়সার হয়ত অনুধাবনও করতে পারছেনা এখন দুনিয়াবি কোনো শক্তিই নেই যে এই আসমান নামক দানবকে ঠেকাতে সক্ষম।তার অনুরোধে নাবিলকে ছেড়ে দেয়ার কোনো প্রশ্নই উত্থাপিত হয়না।
– ছেড়ে দিন!
পুনরায় নিজেকে ছাড়াতে চাইলো রোযা কিন্তু শক্তভাবে ধরে রেখেছে নাবিল। খানিক অসহায় দৃষ্টিতে রোযা তাকালো কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে নাটক উপভোগ করতে থাকা আসমানের দিকে।নীরবে সাহায্যের আবেদন জানালো রোযা।কিন্তু তাকে হতবাক করে দিয়ে উল্টো ঘুরে গেলো আসমান।হাঁটতে আরম্ভ করলো নিজের টুলবক্সের দিকে।
– কিক হিম!
অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত শব্দদুটি শুনতে বেগ পোহাতে হলোনা রোযাকে।আসমান তাকে সাহায্য করবেনা, সে চাইছে রোযা যেকোনো মূল্যে নিজেকে নিজে মুক্ত করুক।ব্যাপারটা কি এমন কিছু? সেসব ভাবার সময় আপাতত নেই।নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে রোযা দেহের সর্বশক্তি দিয়ে লা*থি হাঁকিয়ে বসলো নাবিলের বুক বরাবর।তাতে উগড়ে দিলো নিজের হৃদয়ে জমানো সমস্ত ক্রোধ এবং ঘৃণা। ভারী হাইকিং বুটের সোলে অনুভূত ঝটকায় নাবিল ছিটকে গিয়ে আছ*ড়ে পড়ল গাছের গুঁড়িতে।তৎক্ষণাৎ সরে গেলো রোযা।তার বুক এখনো দুরুদুরু করে কাপছে।
রোযা দূরে সরে দাঁড়াতেই এগোলো আসমান।হাতের নাইলনের দড়িটি ব্যবহার করে মুহূর্তেই নাবিলকে শক্তভাবে বেঁধে ফেলল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে।কই মাছের মতন কিলবিল করতে থাকা নাবিলের মুখ বন্ধ রাখতে গুঁজে দিলো ভাজকৃত কাপড়ের দণ্ড।এখন নাবিল কায়সারের অসহায় দৃষ্টি এবং মৃদু গোঙানি ছাড়া আর কিছুই সহ্য করতে হবেনা আসমানকে।সে টুলবক্সের দিকে হাত বাড়াতেই আতঙ্কিত রোযা ঢিবির দিকে সরে গেলো।এই পিশাচ কতটা নির্দয় নির্মম হতে পারে তা সে চাক্ষুষ অবলোকন করেছে। আরো একবার তা উপলব্ধি করে নিজের মনুষ্যত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে ইচ্ছুক নয় সে।
ঢিবির কাছে যেতেই অদ্ভুত একটা বিষয় নজরে পড়ল রোযার। ঢিবির অপরপাশে মাটিতে বস্তার মতন কিছু একটা পড়ে রয়েছে।আকারে বৃহৎ এবং জীবন্ত! রোযা কিছুটা কাছে গিয়ে ঝুঁকতেই হলদেটে বর্ণের উপর বৃত্তাকার কালো চিহ্ন অবলোকন করে স্তব্ধ হয়ে রইলো।
চিতাবাঘ!
অতিরিক্ত আতঙ্কে ভারসাম্য হারিয়ে ঢিবির সঙ্গে ধাক্কা খেলো রোযা।তার কন্ঠ থেকে নির্গত হতে চলা যন্ত্রণাধ্বনি সে অনতিবিলম্বে মুখে হাতচাপা দিয়ে ঠেকালো। চিতাবাঘটি ঘুমে আচ্ছন্ন! রোযার মাথা সহসাই চক্কর দিতে আরম্ভ করলো।শরীরে বয়ে যেতে থাকলো ভূকম্পন। সাজেকের আশেপাশের অরণ্য এলাকায় চিতাবাঘ, বন্য শূকরসহ কিছু হিং*স্র প্রাণীর বসবাস রয়েছে এমন তথ্য রোযা এখানে আসার আগেই ইন্টারনেট থেকে উদঘাটন করেছিল।কিন্তু বনবিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত এলাকা, বিশেষ করে লোকালয়ে কিছুতেই এমন প্রাণীর উপস্থিতি থাকার কথা নয়।
চিতাবাঘটিও অদ্ভুত।কোনো শিকারী প্রাণীর এমন নিদ্রাচ্ছন্ন হওয়ার কথা নয়।তারা বহু দুর থেকেও অন্য প্রাণীর নড়াচড়া কিংবা উপস্থিতি অনুভব করতে পারদর্শী।তবে কি আসলে চিতাটি ঘুমাচ্ছে না, বরং তাকে কোনো ঔষধ প্রয়োগ করে এমন করে রাখা হয়েছে।কে করেছে এমন?
আসমান!
তৎক্ষণাৎ নামটি নিজ হৃদয়ে উত্থাপিত হলো রোযার।একদম! ওই মানসিক বিকারগ্রস্ত দানব ব্যাতিত আর কেই বা এমন বিপজ্জনক কাজ করতে যাবে?কিন্তু চিতাবাঘ দিয়ে সে কি করবে?অদ্ভুত এক ধারণা ফুলের কলির মতন প্রস্ফুটিত হলো রোযার অন্তরে।তবে কি….! নৃশং*সতার সর্বোচ্চ পর্যায় আজ ভেদ করবে আসমান? ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে রোযা ঢিবির অপরপাশে সরে গেলো।তার দৃষ্টি ঘুরপাক খেতে লাগলো কিছুটা দূরে খাঁচায় আবদ্ধ পাখির ন্যায় ছটফট করতে থাকা নাবিল এবং ঢিবির বিপরীত পাশে মাটিতে নিশ্চল হয়ে থাকা চিতাবাঘটির মাঝে।
নাবিল নিজের সম্পূর্ণ জোর হারিয়ে যেন নেতিয়ে পড়েছে।সে খুব ভালোমতই জানে, মৃ*ত্যুদেবতার হাত থেকে যদিও বা নিস্তার পাওয়া সম্ভব, আসমানের থেকে নয়! টুলবক্স থেকে হাতুড়িটি তুলে নিয়ে নাবিলের দিকে চেয়ে মাটিতে বসে পড়লো আসমান। কোনোপ্রকার কথাবার্তা ছাড়াই খপ করে ধরলো নাবিলের ডান হাতটি।একটি পাথরের উপর সেটি স্থাপন করলো।
– এই আঙুলগুলো কতকিছু যে স্পর্শ করেছে তার হিসাব নেই।
আসমানের কন্ঠটি শোনালো হিং*স্র জানো*য়ারের মৃদু গর্জনের মত।নাবিলের সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকলো।কিন্তু হাজার চাইতেও সে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হলোনা।নিজের আঙুল গুটিয়ে নেয়ার পূর্বেই আসমানের হাতুড়ি সজো*রে আ*ঘাত হা*ন*লো তার উপর!
মটমট করে শব্দ হতে আরম্ভ করলো।একের পর এক।তার সঙ্গে সঙ্গীতের ন্যায় তাল মিলিয়ে বাজতে থাকলো গোঙানি।আর্তনাদ এবং হাহাকার হয়ে পড়ল ম্রিয়মাণ,অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল সমস্ত চেহারা।
মিনিট দুইয়ের মাথায় নিজের ডান হাতের আর কোনো অস্তিত্ব অনুভব করতে পারলোনা নাবিল।নিজের দৃষ্টিকে সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।তার কব্জি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত অঙ্গটি বর্তমানে একদলা র*ক্তা*ক্ত মাং*সপি*ন্ড ব্যাতিত ভিন্ন কিছু নয়! মিনিট চারের মাথায় নাবিলের ডান হাতও বরণ করলো একই পরিণতি।
য*ন্ত্রণার অনুভূতি এতটাই তীব্র যে সেই মরমবেদনাটুকুও অনুভূত হচ্ছেনা এখন নাবিলের।তার শরীর শুধু কাপছে,যেন জ্বর উঠেছে।ঘাম এবং র*ক্তে গোসল সেরেছে যেন। দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।এ কি অ*ত্যাচার?এর তুলনায় মৃ*ত্যুও কম যন্ত্রণাদায়ক!
নির্বিকার আসমান নাবিলের আধখোলা চোখের দিকে তাকালো।তার পরনের মাস্কে এবং সাদা শার্টে বর্তমানে ছিটকে ওঠা ছোপ ছোপ র*ক্তে*র ফোঁটা শোভা পাচ্ছে। একটিমাত্র ফোঁটা কপাল থেকে তীর্যকভাবে গড়িয়ে নামছে তার ঘন ভ্রুতে।নাবিলের দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হওয়া দৃশ্যটি যেন স্বয়ং নরকরাজকে প্রদর্শন করছে।
– শুনেছি… খেলার সঙ্গীকে সিগারেটের আঁচে পো*ড়াতে খুব পছন্দ করতেন!
আসমানের হিমশীতল কন্ঠে নাবিলের হৃদযন্ত্র রীতিমত কাজ করা যেন বন্ধ করে দিলো। নারীতে মত্ত হয়ে উপভোগের সময় সে প্রায়শই মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে এই কাজটি করতো!হাতের সিগারেট চে*পে ধরতো নিজের পছন্দমত অ*ঙ্গে! তাতে নারী যতই ছটফট করুক না কেনো, খেলনা তো খেলনাই!পরোয়া করতোনা নাবিল। কারণ হয়ত সে একজন স্যাডিস্ট।অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার নেশা তাকে সর্বদাই পেয়ে বসে।
নাবিল চিন্তায় মগ্ন হয়ে যেতেই আসমানের হাতে জ্ব*লে উঠলো সিগারেট। তা সে নিজের ঠোঁটে পুরলো না।চাইলো নাবিলের দিকে।হতবিহ্বল নাবিল জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকলো।ঠিকরে বেরোতে লাগলো তার অশ্রু।
– টেস্ট ইওর ওউন মেডিসিন!
নির্বিকার চিত্তে সিগারেটের জ্ব*লন্ত প্রান্ত নাবিলের গ্রীবাদেশে চেপে ধরলো আসমান। কুঁকড়ে গেলো নাবিল।ধীরে ধীরে গ্রীবাদেশ বেয়ে তা উঠতে থাকলো ঊর্ধ্বে। গাল, ঘাড়, বুক….কোনকিছুই বাদ রইলোনা। নাবিলের গোঙানি বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও সৃষ্টি করতে সক্ষম হলোনা আসমানের পাথর হৃদয়ে।এতটাই বেপরোয়া মনোভাবে সে পা*শবিক কাজগুলো করছে যে তাকে দেখলে মনেই হবেনা সেও একজন মানুষ!
ওহ!মানুষ তো নয়…বাদশাহ কায়সার পূর্বেই বলেছিলেন, আসমান একটা মেশিন।
সেই মেশিনের হাতে ধীরে ধীরে উঠে এলো রেঞ্জার। থে*ত*লে গে*লো নাবিলের উভয় পা।তারপর এলো স্ক্রু ড্রাইভার।নাবিল হারালো নিজের বাম চোখের দৃষ্টি।মাটিতে পড়ে থাকা পাথরও বাদ পড়লনা।ভা*ঙ*লো নাবিলের পাঁ*জর এবং মা*থা*র খু*লি।একের পর এক…নৃশং*সতা।
অবশেষে আসমান যখন নিজের লীলাখেলায় ক্ষান্ত দিলো তখন নাবিল কায়সার বলে সম্বোধন করার মতন মানুষটি আর অবশিষ্ট নেই।রয়েছে শুধুমাত্র র*ক্তা*ক্ত একটি কদাকার অবয়ব। চিত্রশিল্পী যেমনভাবে নিজের সৃষ্ট চিত্রের পানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,এর সৌন্দর্য অবলোকন করে, ঠিক তেমনভাবেই সন্তুষ্ট চিত্তে নিজের কর্ম প্রাণ এবং নয়ন উভয় ভরে দেখে নিলো আসমান।
এবার সমাপ্তির পালা। নিজের পকেট থেকে একটা শিশি বের করলো আসমান।সেটার সমস্ত তরল উপুড় করে ঢাললো নাবিলের শরীরে।নাবিল এখন নড়াচড়াও করছেনা।তার মুখ থেকে কাপড় টেনে বের করে ফেলা সত্ত্বেও কোনোপ্রকার শব্দ উচ্চারণের শক্তি অবশিষ্ট রইলোনা।দড়ি খুলতেই শরীর লুটিয়ে পড়লো র*ক্ত শোষণে ভিজে ওঠা মাটিতে।ফুসফুস দুর্বলভাবে এখনো সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে জীবন রক্ষার।
ভালোই।যতক্ষণ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকবে, ততই য*ন্ত্রণা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে!
খালি শিশিটি পকেটে ভরে উল্টো ঘুরল আসমান।তার কন্ঠস্বর নির্জন অরণ্যমাঝে প্রতিধ্বনিত হলো।
– গুডবাই। প্রার্থনা করি যেন জাহান্নামেও আপনার জায়গা না হয়!
এটুকুই।র*ক্তা*ক্ত টুলবক্স তুলে ঢিবির কাছে চলে এলো আসমান।খেয়াল করলো ঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে এবং কানে হাতচাপা দিয়ে কাপছে রোযা।আসমানের উপস্থিতি টের পেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে সে মাথা তুলে তাকালো।
– আপ…আপনি…ওটা কি ছিলো?
এক মুহুর্ত চুপ থাকলো আসমান।তারপর জানালো,
– ফেরোমন।হিং*স্র জন্তু জানো*য়ারকে আকৃষ্ট করার জন্য।
স্তব্ধ হয়ে থাকলো রোযা।একবার বর্তমানে নিদ্রা হতে জেগে উঠতে থাকা চিতাবাঘের দিকে চাইলো।কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে নাবিলের অবশিষ্টাংশের দিকে তাকাতে সক্ষম হলোনা। বিস্ময়ের সীমা বহু পূর্বেই পেরিয়েছে তার।এক নতুন পর্যায়ে সে পৌঁছলো যখন দেখলো আসমান একদম শান্ত ভঙ্গিতে চিতাবাঘের কাছে গিয়ে জন্তুটির শরীরে কয়েকটি চাপড় দিলো।তাতে মৃদু গর্জন করে উঠতে আরম্ভ করলো পশুটি।
– আমাদের এখন যাওয়া উচিত।
এই দানবের কার্যক্রম লক্ষ্য করে রোযার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে সম্পূর্ণ। এ কে, কেনো এরকম করছে, কি উদ্দেশ্য, সে আসলেই সুস্থ সবল কিনা, তার মস্তিষ্কে সমস্যা রয়েছে কিনা, কিংবা সে আদও মানুষ কিনা এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবার মতন ইচ্ছাও আর রোযার মধ্যে অবশিষ্ট রইলোনা।
হাঁটতে আরম্ভ করলো সে।পিছন পিছন আসমান।একটু পরেই চিতাবাঘের গর্জনধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠল গোটা অরণ্য।তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রবাহিত হলো নাবিল কায়সারের সর্বশেষ চিৎকার।
একবার দৃশ্যটির দিকে ফিরে তাকাতে চাইলেও পিঠে আসমানের আলতো ধাক্কা অনুভব করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলো রোযা।কিছুদূর অগ্রসর হয়ে সে না পারতে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি নাবিল কায়সারের সঙ্গে যা যা করলেন তা পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে ধরা পড়বেনা?
দূর গগনের দৃষ্টি ফেলে র*ক্তস্না*ত দানবটি প্রশান্ত কন্ঠে ব্যক্ত করলো,
– চিতাবাঘের ভোজের পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা নিয়ে কোনোদিন পোস্ট মর্টেম করতে রাজী হবেনা কে বি গ্রুপ। করলেও, আই ডোন্ট কেয়ার ইফ দে রিয়ালাইজ।
প্রথমবার এই পিশাচের কন্ঠে এত লম্বা কিছু বাক্য শুনল রোযা।কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে মানুষের কোলাহলের আওয়াজ আসতে থাকলো।তখনি আসমান থমকে পড়লো।
– উদ্ধারকারী দল চলে এসেছে। আপনি যান, তাদের যা বলার বলবেন। আগামীকাল সাজেক থেকে যাওয়ার আগে একজন আপনার রিসোর্ট রুমে যাবে।
এটুকু বলেই উল্টো ঘুরল আসমান।চলে যেতে আরম্ভ করলো ভিন্নপথে। রোযা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ না আসমানের র*ক্তা*ক্ত অবয়ব অরণ্যের মাঝে আড়াল হয়ে গেলো।
“ আমার পাঁচ লাখ টাকা?”—
প্রশ্নটি হাজার চাইলেও উচ্চারণ করতে সক্ষম হলোনা রোযা।
পরদিন।
দূর্বল শরীরে বিছানায় শুয়ে আছে রোযা।গতকাল রাত থেকে তিনবার বমি হয়েছে।শরীর কয়েকদিনের এত ধকল এ উত্তেজনা সইতে পারছেনা।
গতকাল অরণ্যে একটি উদ্ধারকারী দল খুঁজে বের করেছিল রোযাকে।কিন্তু ততক্ষণে নাবিলের যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। রোযাও আসমানের শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য প্রদান করে। কংলাক পাহাড় থেকে ফিরবার সময় পথ হারিয়ে তারা অরণ্যে আটকে পড়েছিল।তখন একটি চিতাবাঘ তাদের উপর আ*ক্র*মণ করে।প্রাণ বাঁচিয়ে কোনোরকমে রোযা পালাতে সক্ষম হলেও নাবিল আটকে পড়েছিল।তার দে*হের খ*ন্ড বিখ*ণ্ড অং*শ উদ্ধার করা হয়েছে। রোযাকে রিসোর্টে নিয়ে আসা হয়েছে খুঁজে পাওয়ার পরপরই।বর্তমানে এর বেশি কিছু সম্পর্কে অবগত নয় রোযা।
আসমান নামক পিশাচের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিল রোযা। পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে সে আসমানকে নাবিলের হ*ত্যা*কাণ্ডে সাহায্য করতে রাজী হয়েছিল।ভাবতেই সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো রোযার।এক মাস আগেও সে ভাবতে পারেনি তার জীবন এমন এক মোড় নেবে।
কক্ষের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠতে বাধ্য হলো রোযা।দরজা খুলতেই রিসোর্টের একজন স্টাফকে দেখতে পেলো। প্রফুল্লতায় পূর্ণ তার চেহারা। রোযা কোনোপ্রকার প্রশ্ন করার আগেই সে একটি খাম বাড়িয়ে দিলো রোযার নিকট।তারপর অযথাই হেসে কোনো কিছু না বলেই চলে গেলো।হতবাক রোযা দরজা আটকে খাম নিয়ে বসলো বিছানায়। সেটি খুলতেই ভেতর থেকে একটা মোটা টাকার বান্ডিল থপ করে বিছানায় পড়ল। তার সঙ্গে একটা ছোট্ট কার্ড।
ডার্কসাইড পর্ব ২
“ ধন্যবাদ।”
শুধুমাত্র একটি শব্দ।নেই প্রেরকের নাম কিংবা ঠিকানা। রোযা একবার টাকা আরেকবার কার্ডটির দিকে তাকালো।তারপর মুখ তুলে বাইরের মেঘে ঢাকা বিস্তৃত আকাশপানে চেয়ে রইলো।
