ডার্কসাইড পর্ব ৩৫

ডার্কসাইড পর্ব ৩৫
জাবিন ফোরকান

আট বছরের শিশুটির হাঁটুর পিছনের অংশ র*ক্তাক্ত।রক্তিম প্রবাহ গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে নিচে,উভয় পায়ের পাতার চারিপাশে সৃষ্টি করেছে অশরীরী ধারার পুকুর।তার মাঝে টানটান শিরদাঁড়ায় দন্ডায়মান শিশুটি।উন্মুক্ত উরুতে পড়ছে একের পর এক চা*বুকের আ*ঘাত।দৃষ্টি ঠিকরে আসতে চাইছে অশ্রু, দাঁতে ঠোঁট কামড়ে আটকে রেখেছে তা।এতটাই জোর প্রয়োগ করতে হচ্ছে যে অধরের কোণেও জমাট বেঁধেছে র*ক্তবিন্দু।তবুও নিটল থাকা প্রয়োজন তার। মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে উভয় হাত।

ঠিক এমন মুহূর্তেই নজরে এলো মানুষটিকে। পাথরকাঠিন্য খচিত দৃষ্টি,থমথমে মুখাবয়ব,অভিজাত দেহ আবৃত মূল্যবান পরিচ্ছদে।দুইজন কালো পোশাকধারী বডিগার্ডের অনুসরণে সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন বাদশাহ কায়সার।নির্বিকার দৃষ্টিপাত ঘটালেন বিপরীত প্রান্তে দন্ডায়মান শিশু আসমানের পানে।
নিজের সন্তানকে র*ক্তাক্ত দেখলে কোনো পিতা স্থির থাকতে পারে?পারে….বাদশাহ কায়সার পারেন।যন্ত্রণা গ্রহণ করতে শেখো,এই বেদনা তোমার শক্তি, এই অন্তরাগ্নি তোমার শিক্ষা।তার বক্তব্য সন্তানের উদ্দেশ্যে।
আসমান নিজেকে স্থির রাখতে পারলোনা,তার অশ্রু উপচে পড়লো। তিরতির করে কাঁপতে থাকা অধরে ফিসফিস কন্ঠে উচ্চারণ করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– বাবা…
– এক সপ্তাহ ধরেও ফিগার ফিফটিন আয়ত্ব করতে পারেনি।প্রতিবার অজুহাত।তাই এই শাস্তি।
প্রশিক্ষকের বক্তব্যে বাদশাহর দৃষ্টিতে সামান্যতম পরিবর্তন ঘটলোনা।এগিয়ে এলেন,হাত বাড়ালেন।কিছুটা হতচকিত হয়ে প্রশিক্ষক নিজের চা*বুকটি তুলে দিলেন কায়সার অধিপতির হাতে।ফিরলেন বাদশাহ,কঠোর কন্ঠে আদেশ করলেন,
– স্ট্রিপ।
এক মুহুর্ত নিজেকে শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস হলোনা আসমানের।কিন্তু পরক্ষণেই অজানা শক্তির জোরে পরিধানের হাতাবিহীন টি শার্টটি তুলে উন্মুক্ত করলো ঊর্ধ্বাঙ্গ। শিশুদেহী শুভ্র ত্বকে উদ্ভাসিত হলো এক মায়াবী অবয়ব।ওই শুভ্রতার পিঠে অতর্কিতে আছড়ে পড়লো চা*বুকরূপী ঘূর্ণিঝড়।একের পর এক… অশ্রু গড়াতে থাকলো,মৃদু ফোপানি এবং থরথর করে কম্পিত হতে থাকা র*ক্তা*ক্ত অঙ্গ।

– দিনদিন দূর্বল হয়ে যাচ্ছ।তোমাকে অলসতা দেখাতে গড়ে তুলছিনা।
একটা সময় হাঁটু ভেঙে আসলো,ধপ করে উবু হয়ে চার হাত পায়ে মেঝেতে বসে পড়ল আসমান।তবুও থামলেন না বাদশাহ,কোনো কারণে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে আছেন,যার সবটুকু আগ্রাসন উপচে দিচ্ছেন আপন হাতিয়ারে।প্রশিক্ষক এগোলেন,থামতে বাধ্য করলেন বাদশাহকে।
– আর নয়,আগামীকাল প্র্যাকটিস করতে পারবেনা তাহলে।
ক্ষান্ত দিলেন বাদশাহ।নিজের স্যুটের কলার ঠিকঠাক করলেন। পকেট থেকে হাজার পঁয়ত্রিশ মূল্যের রুমালটি বের করে কপালে জমা কয়েক ফোঁটা ঘাম মুছে নিলেন।অতঃপর সামনে এগোলেন।উবু হয়ে প্রকম্পিত হতে থাকা শিশুটি বর্তমানে সম্পূর্ণ স্থির।বসে আছে,অশ্রুমাখা নয়নে।বাদশাহ হাঁটু ভাঁজ করে তার মুখোমুখি হলেন,একটি হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন কোমল কপোল।

– ঠিকমত চর্চা করবে তো এরপর থেকে?
সম্মতি জানালো আসমান।নিঃশব্দে। বৃদ্ধাঙ্গুলিতে তার অশ্রুধারা মুছে বাদশাহ বিড়বিড় করলেন,
– গুড।আর আরেকটা কথা।
মাথা তুলে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো শিশু আসমান। পিতার অনুভূতিশূন্য নয়নে তার কোমলমতী বুকে শিহরণ খেলে গেলো।
– বাবা নয়।কল মি মাস্টার।
এই বাক্যে শিশুর অন্তর গুড়িয়ে গেলো, আবেগাশ্রু বিদায় নিলো এক লহমায়।এক অপার শীতলতায় আচ্ছাদিত হলো কৃষ্ণগহ্বর।সন্তুষ্ট হলেন বাদশাহ, উঠে দাঁড়ালেন।
– মনে থাকবে?
– জ্বি মাস্টার।

এক পলক ক্রীতদাসের ভগ্ন অবয়বে দৃষ্টি ফেলে উল্টো ঘুরলেন বাদশাহ, বডিগার্ডদের অনুসরণে বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে।পিছনে ফেলে গেলেন এক বিধ্বস্ত শিশুকে।
এই শিশুর কোমল হৃদয়ই পরবর্তীতে পরিণত হয়েছিল পাথরে।মানুষ থেকে রূপান্তরিত হয়েছিল সে মেশিনে। ১৩ বছর বয়সে এই মেশিন জীবনের প্রথম জীবননা*শ ঘটিয়েছিল প্রভুর নির্দেশে।অতঃপর….
জন্ম নিয়েছিল কে বি গ্রুপের এযাবৎকালের সবথেকে বিধ্বংসী হাতিয়ার,কি*লিং মেশিন আসমান—
আজ এই মেশিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই সুদূর অতীত বড্ড স্মরণে আসছে বাদশাহর।ঠিক ওই দিনটির ন্যায় টলটলে আবেদন নিয়ে তার সম্মুখে দন্ডায়মান প্রাপ্তবয়স্ক আসমান।যার প্রশ্নটি একই রয়ে গিয়েছে,বাবা ডাকার অধিকার কেনো হরণ করা হয়েছে তার কাছ থেকে?উত্তর কি এর?
সকলে বাকরুদ্ধ চেয়ে রয়েছে। কে বি অধিপতির নির্দেশ ব্যতীত কিছু করা উচিত হবেনা।দৃশ্যটির অদ্ভুত বিষাদের জালে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে প্রত্যেকটি মানব অন্তর।র*ক্তস্নাত দানব আসমান এগোলো,এক পদক্ষেপ।চাইলো পিতার প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে।

– নাবিল, রাফা ওদের কত আদর করতেন আপনি।কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিতেন নিজের ছেলেকে,আমি জিমে পুশ আপ করতে করতে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখতাম।আমাকে একটু আদর করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো মাস্টার?
প্রত্যেকটি প্রশ্ন আজ জবাবহীন হয়ে তীক্ষ্ণ আ*ঘাত হানছে বাদশাহর বুকে।মৃ*ত্যুর পূর্বমুহূর্তে মানুষ নিজের সারাজীবনে সংঘটিত কর্ম অনুধাবন করেন,অতঃপর অনুশোচনা। বাদশাহর বর্তমানে তাই হচ্ছে কি?অনুশোচনা?এই সন্তানকে স্নেহ থেকে বঞ্চিত করার আফসোস?
– যেদিন চোখের সামনে ওরা আমার সবকিছু লুটে নিলো,আমাকে নিঃস্ব করে অমানিশায় ঠেলে দিলো, সেদিনও আমি আপনার দিকে একটুখানি আশা নিয়ে চেয়েছিলাম মাস্টার।ভেবেছিলাম,এবার হয়ত মাস্টার আমায় বুঝবে,আমায় আগলে নেবে।কিন্তু কি হলো?আপনি নাবিল কায়সারকে বেছে নিলেন মাস্টার!
আসমানের অশ্রু কপোল গড়িয়ে তার বক্ষ সিক্ত করে তুলছে ক্রমশ।অশ্রু র*ক্ত আজ মিলেমিশে একাকার।অবরুদ্ধ সকলে এই মেশিনের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশে।

– আসমান কায়সার হয়ে জন্ম নেয়াটাই কি আমার অপরাধ ছিলো মাস্টার?
– শাট আপ!ডোন্ট কল মি মাস্টার!
হায়রে ভাগ্যের পরিহাস!সে হাসছে কুটিকুটি,কি দারুণ জীবনখেল খেলছে সে।যে “মাস্টার” শব্দটি হাতিয়ারের মস্তিষ্কে গেঁ*থে দিয়েছিলেন কে বি অধিপতি, আজ সেই শব্দটি শুনতেই তার কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে প্রচণ্ড।
দূরে দন্ডায়মান আকাশের নীরব ইশারায় গার্ডরা এগোলো সহসাই,অ*স্ত্র উঁচু করে।কিন্তু এক লহমায় তড়িৎ গতিতে একজনের ঘাড় ধরে মেঝেতে আছ*ড়ে ফেললো নিহাদ, অপরজন তাকে নিশা*না করতে গেলে বনবন করে ছুটে আসা একটি ধাতব দন্ডের ঝটকায় ছিটকে গেলো তার পি*স্ত*ল।ঝট করে ফিরে তাকিয়ে সে আবিষ্কার করলো সুদর্শনাকে। পরনের খয়েরী শার্টের হাতা গুটিয়ে প্রস্তুত চারুলতা,উভয় হাতে দুইটি লম্বাটে ধাতব দণ্ড,যা মূলত তাদের অত্যা*চার করার উদ্দেশ্যেই সংরক্ষিত ছিল।সকলের অবরুদ্ধতার সুযোগ নিয়ে নিহাদ তাকে এবং বিলালকে উন্মুক্ত করেছে ক্ষণিক আগেই।বসে থাকেনি চারু,বাগরে নিয়েছে সামনে যা পেয়েছে তাই।

– নাইস সেইভ পেত্নী।
নিহাদের হাসির ঝলকে চারু একটি নিঃশ্বাস ফেলে চোখ উল্টে এগোলো।মারমুখী ভঙ্গিতেও তার লাস্যময়ীতা নজরকাড়া।মৃদু হেসে গার্ডের উদ্দেশ্যে চেয়ে খোলা চুলে ঢেউ খেলিয়ে চারু ঘোষণা করলো,
– ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট, কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট হোল্ডার হেয়ার।
ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো গার্ড।এই রমণীকে আঘা*ত করবে কি?তার দিকে তাকিয়েই সম্মোহিত হয়ে পড়ছে।সুযোগ ভালোমতই গ্রহণ করলো চারুলতা।বিড়ালের মতন প্রতিক্রিয়ায় লাফিয়ে উঠলো ঘাড়ে, ধা*রালো নখ এবং দণ্ডে গ্রীবা আবদ্ধ করে ছিটকে গার্ডকে ফেললো মেঝেতে।
এগোলো আরো তিনজন।কিন্তু মধ্যিখানে ঢাল হয়ে দাঁড়ালো নিহাদ।নিজের পি*স্ত*ল থেকে গু*লি ছুঁড়ে নিশানাভেদ করলো বরাবর।দুইজন লুটিয়ে পড়লেও অপরজন ছুটলো চারুলতার উদ্দেশ্যে।একটি দণ্ড পাকড়াও করে ক্ষীপ্র গতিতে ঘুরে তার পা বরাবর সজোর আঘা*তে মেঝেতে ফেলে চড়ে বসলো চারু, মুঠো পাকিয়ে এক ঘু*ষিতে র*ক্তপাত ঘটালো গার্ডের গালে। তা দেখে নিজের গাল চেপে ধরে আর্তনাদধ্বনি তুললো নিহাদ,

– আউচ!
তার দিকে বিরক্তিময় দৃষ্টি ফেলে চারুলতা উঠতে গেলেই তার কোমর টেনে মেঝেতে ফেলা হলো পিছন থেকে।এর বেশি অবশ্য কিছুই সম্ভব হলোনা।নিহাদের শক্তিশালী লা*থিতে গার্ডের গাট্টাগোট্টা শরীরও উড়ে গিয়ে পড়ল দূরে।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চারুলতা জিজ্ঞেস করলো,
– দশ প্যাকেট প্রোটিন পাউডার গুলে খেয়েছ নাকি?
– এইসব হচ্ছে ডিমের শক্তি।
নিজের বাইসেপ্স দেখিয়ে হাসলো নিহাদ,খুব ভাব নিচ্ছে। বিরস মুখে চারুলতা উঠলো,
– ইশ!ভাব কত!
– একটা ছোট্ট থ্যাংক ইউ বললেও তো হয়। অবশ্য কাকে কি বলছি? চুন্নিদের কাছ থেকে থ্যাংক ইউ না, ঘাড় ম*টকানো আশা করা উচিত।
চারুলতা জোর চাপে নিহাদের পা চেপে ধরলো মেঝেতে।যন্ত্রণায় কুচকে গেলো তার চেহারা।

– শাখচুন্নি!
– নির্লজ্জ জলহস্তী!
চারুলতার ঘাড় চেপে ধরলো নিহাদ,ভরকে গেল সে।এক ঝটকায় নিচে নামালো,চারু ভাবলো এই বুঝি নিহাদের কিল টা খেলো পিঠের উপর!কিন্তু না, পিছনে গু*লি তা*ক করা লোকটাকে দুইটি বু*লেটে ধরাশায়ী করে চারুলতাকে ছাড়লো সে।ঠিক ওই মুহূর্তেই নিহাদের পিছনে উপস্থিত হওয়া গার্ডকে হাতের একটি দণ্ড দি*য়ে মা*থা বরাবর জো*র আ*ঘাত হে*নে মাটিতে শোয়ালো চারুলতা।হাঁপাতে হাঁপাতে উভয়ে তাকালো একে অপরের দিকে।হাসি লেগে রয়েছে উভয়ের অধরে।কিন্তু শব্দ বেরোলো,

– ডাইনি!
– পাঠা!
ঠিক তখনি দরজার মুখে দৃশ্যমান হলো মেশিন বাহিনী, অ্যা*সল্ট রাই*ফেল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সকলে,যু*দ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে।তাদের জন্য নির্ধারিত মিশন তারা শেষ করেছে।নিহাদ ফিরলো পিছনে,তার পিঠে পিঠ ঠেকালো চারুলতা।একজনের হাতে উত্তোলিত পি*স্তল,অপরজনের হাতে লম্বাটে একটি দণ্ড। ঠোঁটজুড়ে তীর্যক হাসি।প্রস্তুত তারা সমাপ্তি রচনায়।আপন আপন প্রতিশোধ বাসনা অন্তরজুড়ে।
– লেটস ধুম মাচালে।
– উইথ প্লেজার।

মুহূর্তের মাঝেই নতুন এক কুরুক্ষেত্রের রচনা হলো কে বি কোম্পানির মূল ভবনের বেইজমেন্টে।
ধীরে ধীরে বাদশাহ কায়সারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো আসমান।আশেপাশের কর্মকাণ্ডে তার যথারীতি কোনো মনোযোগ নেই।নিহাদের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে,ব্যাপারটি সে সামলে নেবে।বর্তমানে তার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত মনিবের পানে।পিছিয়ে যেতে যেতে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন বাদশাহ।উন্মুক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন, নয়নজুড়ে তার আক্ষেপ। ঝুঁকলো আসমান,উত্তোলিত হলো তার হাত, দুই আঙ্গুলের বন্ধনীতে ঝুলছে লম্বাটে নলযুক্ত রিভ*লভার।
– ভয় পাচ্ছেন….মাস্টার?
দৃশ্যমানভাবে কম্পিত হলো বাদশাহ কায়সারের সমস্ত শরীর। ক্ষীপ্র গতিতে তার চিবুক চেপে ধরলো আসমান, ঝুঁকে ধা*রালো দৃষ্টি মেলালো।ওই কলঙ্ক উদ্ভাসিত চেহারায় ফুটলো তীব্র এক আক্রোশ। দাঁতে দাঁত চেপে আসমান শুধালের,

– আমার মায়ের অ্যা*ক্সিডেন্ট কি আদও কোনো দুর্ঘটনা ছিল মাস্টার?নাকি পরিকল্পিত হ*ত্যাকান্ড?
হৃদস্পন্দন থমকে গেলো মনিবের,সম্পূর্ণ। ধোঁয়াশায় চেয়ে রইলেন,যাতে টলটলে অশ্রু।কোনো শব্দ নির্গমন করা অসম্ভব তার পক্ষে।এই ছিল তাহলে তার ভাগ্যের করুণ পরিণতি?নিজের সন্তানের হাতে মৃ*ত্যু! দয়া পাবেন না তিনি,তার যোগ্যও নন।
আসমানের নয়নজুড়ে যে নীরব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তার উপর থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছেন না বাদশাহ।সম্মোহিতের ন্যায় নিজের সৃষ্ট ধ্বং*সপতির উদ্দেশ্যে চেয়ে শুধুমাত্র একটি বাক্যই উচ্চারণ করলেন,
– আমাকে ক্ষমা করে দিও।

কুঞ্চিত হলো মেশিনের অধর,পরিহাসের হাসিতে।ওই হাসির মাঝেও যেন একপ্রকার মাধুর্য রয়েছে।অজান্তেই হাত বাড়ালেন বাদশাহ,ছুঁয়ে দিলেন অধরের দুপাশের কলঙ্কের দাগ।সামান্য কাপলো আসমান, তথাপি সরিয়ে দিলোনা।তার শুভ্রতায় ঘেরা বি*কৃত শিশুসুলভ চেহারার মাঝে চেয়ে বাদশাহ ডুবে গেলেন আপন চিন্তায়।যদি তিনি ভিন্ন হতেন,যদি আসমানকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের বদলে সন্তানের মর্যাদা দিতেন তবে বর্তমানটা কেমন হতো?
তার সন্তান হিসাবে বেড়ে উঠতো আসমান,প্রতিষ্ঠিত হতো সমাজে, কে বি গ্রুপের অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়াতো বাদশাহ কায়সারের পাশে,ধূর্ত এবং দক্ষ কোম্পানি প্রধান হিসাবে পরিচিতি লাভ করতো আসমান কায়সার!

তাকে টেক্কা দেয়ার ক্ষমতা থাকতো কার?নতজানু হতো সকলে ওই কঠোরতার সামনে।সুখের একটি জীবন হতো।সংসার গড়তো।তার অসুস্থ মস্তিষ্কের সন্তানগুলোর মতন বেপরোয়া হতো না কখনোই,পিতার সামনে দাঁড়াতো তার ঢাল হয়ে। পুত্র,বউ এবং নাতি নাতনীদের মাঝে একটি সুখকর জীবন লাভ করতেন বাদশাহ।থাকতো না কোনো দুশ্চিন্তা,কোনো গ্লানি,কোনো আফসোস।শুধুমাত্র পারিবারিক সুখ এবং সন্তানের মুখের হাসি।যথেষ্ট।
এই যথেষ্টটুকু লাভ উত্তাল সমুদ্রের মাঝে এক দানা শুকনো খটখটে বালু খুঁজে পাওয়ার মতোই অসম্ভব।এক সম্ভাবনাময় আসমান কায়সারকে বাদশাহ নিজ হাতে রূপান্তর করেছেন মানবীয় দানব কি*লিং মেশিন আসমানে।এই আফসোস ব্রহ্মান্ডের সমাপ্তি পর্যন্ত মিটবার নয়।

জাগতিক ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে সর্বহারা হয়েছেন বাদশাহ।তিনি লুণ্ঠিত এক সত্তা,যার জীবন অতিবাহিত হয়েছে শুধুমাত্র সম্পদ এবং ক্ষমতার পিছনে ছুটে।কালো সম্পদের পাহাড় গড়তে,প্রভাব বিস্তার করতে নিজের অংশকে পালিত কুকুরের মতন ব্যবহারেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি।সৃষ্টিকর্তা যথাযথ পরিণতিই লিখেছেন তার ভাগ্যে।আপন হাতে সৃষ্ট প্রলয়ের হাতে ধ্বংস।

আসমানের গাল থেকে হাত সরিয়ে তার রিভ*লভার সম্বলিত হাতটা নিজের কপালে ঠেকালেন বাদশাহ।অশ্রু বেয়ে তার দাড়ি ভিজিয়ে তুলছে,বক্ষের স্যুটেও দাগ পড়ছে সিক্ততার।জড়ানো কন্ঠে উচ্চারণ করলেন অধিপতি,
– কি*ল মি।তোমার হাতেই হোক আমার পাপের বিনাশ।
একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো আসমানের অধর হতে, ধীরে ধীরে ট্রি*গারে চাপলো আঙুল। অব্যক্ত প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টি তখনো আপতিত বাদশাহর নয়নে।
– হাজার হোক জন্মদাতা আপনি,যন্ত্রণা দিতে পারিনা। বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধাচরণ করেও তাই সহজ মৃ*ত্যু দান করবো,অত্যন্ত সহজ মৃ*ত্যু।
ঢোক গিললেন বাদশাহ, প্রস্তুতিস্বরুপ।

– একটি অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করবে?
প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে উঁচু হলো আসমানের ভ্রুজোড়া।
– আমাকে একবার বাবা বলে ডাকবে?শুধুমাত্র একবার।
এক মুহুর্ত নির্বিকারতা,পরক্ষণেই উদ্ভাসিত হলো অধরজোড়া,বিস্তৃত হাসিতে।অসম্ভব চমৎকার ওই হাসি, যার কলরলে বাদশাহর বক্ষ এক উষ্ণ আবেশে পরিপূর্ণ হলো।এটুকুই…. তার পাওনার চাইতেও অধিক কিছু।আসমান হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
– না….মাস্টার!
মৃ*ত্যুদূতকে যেন সামনে দন্ডায়মান দেখতে পাচ্ছেন বাদশাহ, বুজে নিলেন চোখের পাতা।ওই“মাস্টার” শব্দটিই তার এই পার্থিব জীবনে শোনা অন্তিম শব্দ।তার কর্মফল।অতঃপর…..
থপ!

মৃদু এক ধ্বনি।ক*পাল ফু*ড়ে বে*রিয়ে গেলো ধাতব বু*লেট,বেরিয়ে এলো র*ক্তমিশ্রিত ম*গজ।খানিকটা ছিটকে উঠলো চারিপাশে।বাদশাহ কায়সারের নিথর শরীর একটি ঝটকা খেয়ে হেলে পড়লো পিছনে, আজীবনের জন্য স্থবির হয়ে গেলো তার কলুষিত অস্তিত্ব।
সমাপ্তি।এক অভিশপ্ত অধ্যায়ের অন্তিম মুহুর্ত।

দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকলো আসমান, একদৃষ্টে।নমিত হলো তার অ*স্ত্র,মনিবের র*ক্ত ভৃত্যের অঙ্গজুড়ে।ইচ্ছা হলো এই কদর্যতাকে ঘষে নিঃশেষ করে দিতে।কিন্তু তার পূর্বেই অদ্ভুত আবেশ জড়িয়ে গেলো শরীরজুড়ে।দমকে দমকে কাপতে থাকলো।মধুর সমাপ্তি!তার সঙ্গে এ কিসের অনুভূতি?আনন্দ?দুঃখ? বিষাদ? হার?পরাজয়?নাকি আফসোসের?ঠাওর করতে পারলোনা আসমান।তীব্রতা অনুভব করলো শুধু,অনুভূতির তীব্রতা।
ধপ করে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো।হাতের অ*স্ত্র লুণ্ঠিত হলো মেঝেতে।উভয় বাহু মেঝেতে ঠেকিয়ে উবু হয়ে ঝুঁকলো,বক্ষের গভীরতম অংশ হতে নির্গত হলো এক অমানবিক হুংকার।

– আআআআআআআ!!!
এক লহমায় থমকে গেলো জগৎ।নিহাদ,চারুলতা, মেশিন বাহিনী,জিত হাসিল করেছে তারা।ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারিপাশে প্রা*ণহীন শরীরসমূহ।তবুও স্থির তারা,সামান্যতম নড়চড়ের অবকাশ নেই।প্রত্যেকের দৃষ্টি আবদ্ধ ওই নিষ্ঠুর দৃশ্যপটে।যেখানে পরাজিত সৈনিকের ভঙ্গিতে হাহাকারে লিপ্ত ভাগ্যের ফাঁদে বন্দী হওয়া এক অভিশপ্ত সত্তা। নয়ন ফেরানো দায়,ওই আর্তনাদের নিগূঢ়তা কাপন খেলিয়ে দেয় অন্তর থেকে অন্তরে।ঝাপসা হয় দৃষ্টি,অজান্তেই।অশ্রু নির্গমন,এক করুণ বিষাদসাক্ষী।
কাদঁছে আসমান।
নিজেকে উজাড় করে কাদঁছে।

পরোয়া নেই কোনোকিছুর। চাঁদের যন্ত্রণা আজ বাঁধ ভেঙেছে।উন্মুক্ত করেছে অনুভূতির কারাগার।কাপছে তার সর্বাঙ্গ, টলেছে হিমালয়।ভস্মীভূত হয়েছে বরফের দেয়াল।হিম হতে উপচে পড়ছে বারিধারা।জোয়ার তুলেছে,অনুভূতির সীমা ভাসিয়ে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো একটি সত্তা,সকলের ভরসা তার অভিমুখে।আসমানের পাশে এসে থমকালেন বিলাল রেমান। আস্তে করে বসলেন মেঝেতে।চিৎকার করে ক্রন্দনরত সন্তানের পিঠে ঠেকালেন এক ভরসার হাত।আবেগ জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করলেন,
– বেইবি… ডোন্ট ক্রাই।আমি আছি,এইযে আমি তোমার পাশে।
মুখ তুললো আসমান, কাদতে কাদতে তাকালো পিতৃসুলভ বিশ্বাসের পর্বতের মাঝে।হাসার প্রচেষ্টা করলেন বাদশাহ, ঝুঁকে কপালে স্নেহ আকলেন।নিজের উষ্ণতায় আবৃত করতে চাইলেন অমানিশাকে।

– কেঁদোনা মাই বয়।ইউ ডিড ওয়েল।সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে,সবকিছু।
– বাবা!
ডেকে উঠে নিজের কপাল বিলাল রেমানের উরুতে ছোঁয়ালো আসমান,শক্তভাবে তাকে মুড়িয়ে নিলেন বিলাল নিজ মাঝে।যেন জাগতিক সকল হু*মকি থেকে আড়াল করে নিলেন।দৃশ্যটি অবলোকনে হার মানলো নিহাদের অশ্রুও,অজান্তেই পাশে দাঁড়ানো চারুর কাঁধে মাথা গুঁজলো,শক্তিশালী পুরুষ সে,অশ্রু নির্গমন দেখতে দিতে চায়না।তাকে হতবাক করে দিয়ে চারুলতাও নিজের অশ্রুমাখা হাসির সঙ্গে হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়, শান্তনাস্বরুপ।একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো নিহাদ,পরিতৃপ্তির।অবশেষে সমাপ্তি।

দিবাকর নিজের রশ্মি ধরিত্রীর বুকে ছড়িয়ে ঘোষণা করেছে এক নব্য দিনের সূচনা।নতুন আবহ,নতুন সময় এবং এক নব অধ্যায়।শীতের নভেম্বরের পঞ্চম দিনটি নগরবাসীকে এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী করলো।ধ্বংসের মাঝেও এক পশলা প্রশান্তির আবহ যেন ছড়ালো চারিপাশে।

দাউদাউ আ*গুনে জ্ব*লছে কে বি সাম্রাজ্য।গ্রাউন্ড ফ্লোরে সূত্রপাত ঘটা অগ্নির আচমকা বিস্তরণ ঘটেছে সমস্যা কোম্পানি বিল্ডিং জুড়ে। অভিজাত এলাকার আশেপাশের মানুষজন ফিরে ফিরে দেখছে ধ্বংসস্তুপ।কিছুতেই বুঝতে সক্ষম হচ্ছেনা আদতে কি ঘটছে। অগ্নি নির্বাপক বাহিনীকে খবর দেয়া হয়েছে।খুব দ্রুত জরুরী সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।অদূরে প্রচণ্ড শব্দে সতর্কবাণী ঘোষণা করে বিপসংকেত প্রদানকারী অ্যালার্ম বেজে চলেছে।
কে বি কোম্পানির মূলভবনের রুফটপে উঠে এলো রেমান পরিবার এবং মেশিনবাহিনী।ঈষৎ উদ্বিগ্ন চারুলতা বেষ্টনীর মাঝেও নিজের পিতার বাহু আঁকড়ে ধরে রেখেছে।কে বি বিল্ডিং থেকে বেরোনোর সকল পথ বন্ধ।নিচের তিনটি তলা পর্যন্ত ছড়িয়েছে আ*গুন।চতুর্থ এলিভেটর ব্যবহার করে তারা পৌঁছেছে এখানে। রুফটপে রয়েছে বিস্তৃত হেলিপ্যাড।যার উপর থেকে সামনের নগরীকে দেখায় পিপীলিকার ন্যায়।শীতের হিম বায়ুপ্রবাহ অনুভব করতে করতে চারুলতা বিলালকে শুধালো,

– ড্যাড।আমরা যাবো কিভাবে?
– নো টেনশন বেইবি।আমি আছি তো?
হাসিমুখে জানালেন বিলাল।ঠিক তখনি অদূর থেকে ডানা মেলে উড়তে থাকা এক পাখির মতন দেখা মিললো ছোট্ট বস্তুর,অতি দ্রুত অগ্রসর হয়ে নিকটে পৌঁছাচ্ছে আকাশযান।একটি হেলিকপ্টার,চারিপাশে বায়ুর ঘূর্ণিপাক এবং ইঞ্জিনের প্রগাঢ় গুঞ্জন তুলে সেটি ল্যান্ড করলো হেলিপ্যাডে।কপ্টারের ধাতব কালো বর্ণের শরীরজুড়ে অঙ্কিত ইংরেজি “ আর (R) ” অক্ষরটি।দরজা খুলেই ভেতর থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক স্যালুট ঠুকে জানালো,
– স্যার,গেট ইন প্লীজ।এই বিল্ডিং খুব বেশিক্ষণ টিকবে না।
সম্মতি জানিয়ে সন্তানদের উদ্দেশ্যে ফিরলেন বিলাল। চারুলতাকে তুলে দিলেন ভেতরে সবার প্রথমে।ফিরলেন আসমানের আশায়।পুনরায় পাথররূপ ধারণ করা আসমান পাশের নিহাদের দিকে চেয়ে বললো,
– তুমি যাও।আমি বাকিদের নিয়ে আসছি।
– না না।তুমি আগে যাও আসমান ভাই।আমি আছি ওদের সাথে,আরেকটা কপ্টার আসছে চিন্তা নেই।
– তোমাকে ফেলে আমি যাবোনা।

– উফ!তোমার যত দরদ এখনি দেখানো দরকার? ধুরু… ওঠো তো! নাহলে কোলে তুলে জোর করে তুলবো!
আসমানকে প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে ঠেলে ঠেলে কপ্টারের কাছে নিয়ে গেলো নিহাদ,বিলাল রেমান উঠে হাত বাড়ালেন,সেটা ধরে ভেতরে উঠতে একপ্রকার বাধ্যই হলো আসমান।তবুও ঘুরে তাকালো নিহাদের উদ্দেশ্যে,হাত নাড়লো ছেলেটি হাসিমুখে।পিছনে তার গোটা বাহিনী স্যালুট ঠুকলো নীরবে।যু*দ্ধ জয়ের পরমুহূর্তে কমান্ডোকে দেয়া লাল সালামের ন্যায়।না চাইতেও দৃশ্যটি অবলোকন করে পরিপূর্ণ অনুভব করলো আসমান।
বায়ুঘূর্ণি তুলে হেলিকপ্টার চালু হলো,উত্তোলিত হলো সুবিস্তৃত গগনে।নিচের রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নজরে পড়ছে।তার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক সারি জ্বীপ।আশেপাশের কিছু কিছু উৎসুক জনতার দৃষ্টি রেমান গ্রুপের হেলিকপ্টারজুড়ে।জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলো আসমান,যতক্ষণ না দ্বিতীয় কপ্টারটি নিহাদ এবং তার গোটা বাহিনীকে সুরক্ষিত করলো।তারপর অনুসরণ করলো তাদের।আকাশগঙ্গা বেয়ে যখন দুটো হেলিকপ্টার অদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে,তখন ঘন ঘন বি*স্ফো*রণে প্রকম্পিত হচ্ছে চারিপাশ।কে বি বিল্ডিং হেলে পড়ছে,পুরোদস্তুর কর্মযজ্ঞ চলছে সমগ্র অঞ্চল ঘিরে।

দূর থেকে কে বি সাম্রাজ্যের ভয়াল পতনের দৃশ্য নয়নভরে উপভোগ করলো আসমান,অভ্যন্তরে অনুভূত হলো তার একঝাঁক শূন্যতা।
সিটি ইউফোরিয়ার নিজস্ব হেলিপ্যাড রয়েছে।যার দরুণ পৌঁছতে বেগ পেতে হলোনা।মারবেল ভবনের পেন্টহাউজে ঢুকেই কারো সঙ্গে কোনপ্রকার বাক্য বিনিময় না করে আসমান নিজের ঘরে চলে গেলো।আধ ঘণ্টা বাদেই বেরিয়ে এলো,পোশাক বদলেছে।র*ক্তাক্ত অবয়বের পরিবর্তে মানবিক ঠেকছে তাকে।বিলাল রেমান সকলের জন্য কফি তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন,কিন্তু আসমানকে কোথাও বেরাতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

– এই সময়ে কোথায় যাচ্ছো?অনেক ধকল গিয়েছে।বিশ্রাম নাও।
– গোরস্থানে যাচ্ছি,আম্মুর কবরের কাছে।
থমকালেন বিলাল,একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলেন।যদিও উত্তর জানেন,তথাপি জিজ্ঞেস করলেন,
– কেনো?
– শান্তির খোঁজে।
এটুকুই। পেন্টহাউজের দরজা খুলে বাইরে আড়াল হয়ে গেলো আসমান।তার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিলাল,গাড়ির চাবি পর্যন্ত নিয়ে যায়নি।কি পরিকল্পনা তার?যদিও প্রদর্শন করছেনা,কিন্তু তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন যে ভেতর থেকে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে ছেলেটি।সে কি আদও একটু প্রশান্তি পাবে?যেন পায়,খোদার কাছে চোখ বুজে অনবরত তাই প্রার্থনা করে গেলেন বিলাল।

গোধূলী লগ্ন।স্নিগ্ধ দীপ্তিস্নাত ধরিত্রীর বুকে হিমেল বায়ুর প্রবাহ।তিরতির করে কাঁপতে থাকা বৃক্ষলতা।এর মাঝে নির্জন সড়ক বেয়ে হেঁটে চলা রোযা।তার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ চিন্তায়।আজ সকাল থেকেই মোটামুটি উত্তাল গোটা দেশ।কে বি ইন্ডাস্ট্রিজের মূল ভবনে অগ্নি দুর্ঘ*টনা নিয়ে উন্মত্ত মিডিয়া।যদিও এই মুহূর্তে আ*গুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে,তবে বর্তমানে শুধুমাত্র এর ধ্বংসস্তুপমাত্র দন্ডায়মান।আনুমানিক ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকারও উপরে ধরা হয়েছে প্রাথমিকভাবে।এত বড় ধাক্কা কে বি গ্রুপ সামাল দিতে পারবে কিনা এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা জারি রয়েছে।কে বি অধিপতি বাদশাহ কায়সার,কিংবা কায়সার পরিবারের অন্য কোনো সদস্য সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনো সামনে আসেনি।আজ সারাদিন ক্যাফেতে কাজ করতে করতে এইসব খবরেই ডুবে ছিল রোযা।

ফলাও করে যা প্রচারিত হচ্ছে,এবং এই মুদ্রার ঠিক বিপরীত প্রান্তে যে দৃশ্যপট রয়েছে তা সম্পর্কে রোযা অবহিত।কে বি গ্রুপের এই পতনের মূল কারিগর কে তা তার সমস্ত অন্তরাত্মা জানে।প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে, আবার এক অজানা আতঙ্ক।ঠিক আছে তো তার আসমান?সবকিছুর ইতি কি আদও ঘটেছে কে বি গ্রুপের পতনের মাধ্যমে?দুশ্চিন্তার দোলাচল তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছে অচিরেই।খুব ইচ্ছা হচ্ছে এই মুহূর্তে পুরুষটির পাশে থাকার,কিন্তু উপায় নেই।সকল বন্ধন যে তাদের ছিন্ন!
কিন্তু আর কতটুকুই বা করতে পারে সে?সারাদিনের কর্মব্যাস্ততা শেষে নীড়ে ফেরার তাড়া রোযার।প্রশান্তির জন্য নয়,বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। স্থানটিকে নীড় বলাও কি শ্রেয়? নীড়ে ফেরে মানুষ পরিতৃপ্তির আশায়, রোযা ফিরছে অস্তিত্ব গোঁজার প্রেরণায়। নীড় বলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুটিই যে তার নিকট নেই।

—একটি পরিবার।
ভাবনার দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল রোযা।কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে আনমনে নয়ন তুলে সামনে তাকিয়ে তার হৃদস্পন্দন থমকে গেলো।অতর্কিতে থমকে পড়লো পদযুগল।প্রসারিত দৃষ্টি মেলে চাইলো সামনে। হাওয়ার পালের মাঝারে হাত দশেক দূরে দন্ডায়মান শীতলতার মূর্ত প্রতীক।সর্বাঙ্গ আবৃত কালো বর্ণের পরিচ্ছদে।মুখের মাস্কটি বিলীন হয়েছে। গোধূলীর আভা প্রতিফলিত হয়ে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে বিভীষিকা।কলঙ্কের চিহ্ন ভাসমান অঙ্গজুড়ে।তবুও ভ্রুক্ষেপ নেই। বায়ুপ্রবাহে এলোমেলো হয়ে আসা চুলে সে তাকিয়ে রয়েছে সামনে,একদৃষ্টে।
বুকের ভেতর এক নিগূঢ় টান অনুভব করলো রোযা।ওই কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে টলটল করছে অশ্রুরেখা!নিজেকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলোনা।তার কি দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে?এই প্রথম পাথরে মানবিক অনুভূতি লক্ষ্য করে রোযার হৃদমাঝারে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় উঠলো।

আসমান কাদঁছে!
চিন্তায় চিন্তায় অতিপ্রাকৃত কিছু কল্পনা করছে না তো রোযা?আসমান?তাও ক্রন্দনরত? এও কি সম্ভব?
অশ্রু গড়িয়ে নামতে দিচ্ছে না আসমান,তবে যেকোনো মুহূর্তে বাঁধ ভাঙবে জোয়ারে।নাকের অংশখানি কুঞ্চিত হয়ে রয়েছে আবেগ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায়।নিথর অবয়বে সে চেয়ে আছে রোযার দিকে।যেন কিছু বলতে চায়।কিন্তু পারছেনা নিজের অনুভূতিহীনতার দুর্বোধ্য দেয়াল ভেদ করে সামনে এগোতে।
অনুভূতির ঢেউ জলোচ্ছ্বাস হয়ে আছড়ে পড়ল রোযার অন্তরের বালুচরে।অতি প্রিয় মানুষটির অশ্রুরেখা তার নয়নকেও সংক্রমিত করেছে মরম বেদনায়।জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো।দূরত্ব ঘুচিয়ে মুখোমুখি হলো দ্বিধান্বিত হিমালয়ের। প্রাণভরে অবলোকন করলো বহুদিন বাদে দেখা তার মুখাবয়ব। চাঁদের কলঙ্ক তাকে এর সৌন্দর্য্য উপলব্ধি হতে বিরত রাখলো না।বুকের ভেতর যে টান অনুভূত হচ্ছে তা উপেক্ষা করা দায়।
– কি হয়েছে?

আবেগে ম্রিয়মাণ কণ্ঠের প্রশ্নে নৈঃশব্দ্য বজায় রাখলো আসমান।চেয়ে থাকলো রোযার নয়নপানে,যেন একটুখানি প্রশান্তি খুঁজছে।এক মুহুর্ত সময় লাগলো সবকিছু উপলব্ধিতে।কে বি গ্রুপের পতন,আসমানের যাত্রার ইতি এবং বর্তমানে তার এমন আবেগে জড়ানো উপস্থিতি। পাথরকেও উন্মাতাল করে ছেড়েছে এই বাস্তবতার ভার।
দ্বিতীয়বার প্রশ্ন উত্থাপন করলোনা রোযা।হ্যান্ডব্যাগটি কাঁধে টেনে দুবাহু মেলে ধরলো,নীরব আমন্ত্রণ জানালো প্রলয়কে, নিজের নিরুদ্বেগ আলিঙ্গনে।
– একটু জড়িয়ে ধরি?

এক মুহুর্ত চেয়ে থাকলো আসমান,কেমন যেন চিনচিন তরঙ্গ খেলে গেলো তার বুকে,পরক্ষণেই সকল দ্বিধার জাল ছিন্ন করে এগিয়ে গেলো।নিজেকে বিলিয়ে দিলো উষ্ণতার বাহুডোরে। আবেগাশ্রু তার টপটপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকলো।ক্রমাগত আরো শক্তভাবে রোযাকে আঁকড়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজলো সে।অভ্যন্তরের আগ্নেয়গিরি যেন তার হঠাৎ হিমবাহের স্রোতধারায় প্রশমিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

আসমানের বলিষ্ঠ অবয়ব নিজের মাঝে সুরক্ষিত করে নিয়ে তার মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে থাকলো রোযা।অনুভব করতে পারলো তার কাঁধ সিক্ত হচ্ছে বারিধারায়,মৃদু ক্রন্দনধ্বনির উদগীরণ বাজছে কর্ণগুহরে।নিজের অশ্রুপাত ঘটলো অজান্তেই,কপোল ভিজিয়ে নেমে গেলো তা নিচে।শীতল বাতাস উভয়ের অস্তিত্বকে মুড়িয়ে নিলো আবেগের চাদরে। গোধূলী বেলার আবহ আপন মাধুর্যের প্রতিফলন ঘটালো মিশ্রিত অবয়বে।
একটিমাত্র আলিঙ্গন,প্রগাঢ় অনুভূতির নিঃশব্দ বিনিময়।যেন সকল বিষাদ,যন্ত্রণা,বেদনাকে ধুয়েমুছে পরিবদল করলো নিরেট ভরসায়।

– সব ঠিক হয়ে যাবে আসমান।আমার অস্তিত্ব তোমার প্রয়োজনে।
হৃদমাঝারে এক গভীর আবেশের প্রলেপ মাখালো এহেন বিশ্বাসবাণী।নিজের অজান্তেই এতটা গভীরতায় রোযার মাঝে নিজেকে বিলীন করলো আসমান যে শুধুমাত্র এই রমণীর প্রশান্তিময় উপস্থিতি ব্যতিত সকল বিষাদস্মৃতি ক্ষণিকের জন্য বিদায় নিলো তার স্মৃতির পাতা থেকে।নিজের উষ্ণতা বিলিয়ে গেলো রোযা,আসমানের মাথা থেকে পিঠ ভাসিয়ে চললো আদরের প্রবাহ।

ডার্কসাইড পর্ব ৩৪

– কেঁদোনা চাঁদ।
গোধূলী লগ্নে নীড়ে ফেরা বকপাখির দল কলকাকলিতে পরিপূর্ণতা দান করলো এই চিত্রিত দৃশ্যের অংকনপটে।

ডার্কসাইড পর্ব ৩৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here