ডার্কসাইড পর্ব ৩৬

ডার্কসাইড পর্ব ৩৬
জাবিন ফোরকান

কেনো এসেছে সে এই রমণীর দুয়ারে?সে তো একটুখানি প্রশান্তির খোঁজ করছিলো।গোরস্থানে মায়ের কবরের পাশে বসে অতিবাহিত করেছে সারাটা দিন।ক্রমশ বিষাদে পরিপূর্ণ হয়েছে অন্তর।তীব্র চাপ বক্ষজুড়ে।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়াও কেমন স্থবির।বিনা কারণেই থেমে থেমে কাপুনি শরীরজুড়ে। নীড়ে ফেরার তাড়নায় উঠে পড়েছিল।পা বাড়িয়েছিল সিটি ইউফোরিয়ার উদ্দেশ্যে।কিন্তু অবাধ্য এই হৃদয়ের মর্জি হয়ত ভিন্ন কিছুই ছিলো।নিজের অজান্তেই পথ ঘুরে এসে পৌঁছলো এই রমণীর সামনে,খুব ভালো করেই জানতো কখন কোন পথে হেঁটে বাসায় ফেরে সে।তার সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে কেঁপেছে এই পাথর হৃদয়ও।ওই স্নিগ্ধতায় ঘেরা অবয়ব অবলোকনের সঙ্গে সঙ্গে যেন দূরীভূত হয়েছে দুঃসহ স্মৃতিসমূহ।অন্তরের চাহিদা পূরণ হয়েছে আলিঙ্গনে।এই কি তবে প্রশান্তি?এর খোঁজই আসমান করে চলেছে আজীবন?

উত্তরহীন মস্তিষ্ক।হৃদয়ের বাসনার কাছে ক্ষণিকের পরাজয় ঘটেছে তার।
আমগাছে বেষ্টিত একটি বেঞ্চিতে বসে আছে রোযা।তার ঠিক পাশেই আসমান।স্থানটি সংকীর্ণ। যার দরুণ দূরে বসার সুযোগ নেই, একে অপরের বাহুতে মিশেই তাদের অবস্থান করতে হচ্ছে।আসমানের ক্রন্দন থামেনি,তবে গুঞ্জন থেমেছে।টলটলে চোখে নিঃশব্দে সে তাকিয়ে আছে নিজের কোলে রাখা হাতের দিকে।দুটো টিস্যু দিয়েছিল রোযা, তা ফুরিয়েছে।মন্ড পাকিয়ে মুঠোতে চেপে ধরে রেখেছে আসমান।কি হয়েছে তার নিজেও বলতে পারবেনা।নিজের ভেতর চেপে রাখা সবটুকু চাপ যেন অশ্রু হয়ে ঝরে যাচ্ছে নয়ন থেকে।চাইলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।রোযাও বুঝতে পারছেনা তার এমন হঠাৎ ভগ্নতার কারণ।কে বি গ্রুপের পতন ঘটেছে,আসমানের খুশি হওয়া উচিত।তবে এ কেমন বিষাদ? প্রিয়তমর যন্ত্রণা তার বুকেও প্রভাব ফেলছে তীব্রভাবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে একটি হাত বাড়ালো রোযা।আসমানের মাথায় রাখলো,আলতোভাবে বুলিয়ে দিলো আদরের স্পর্শ। ফুঁপিয়ে প্রশ্বাস টেনে আসমান ঝুকলো, আরো নিচে।স্পর্শ করতে দিলো রোযাকে, গভীরভাবে।
– কি হয়েছে চাঁদ?কেনো এতো কাদঁছো?বলবেনা আমায়?আঘাত পেয়েছ কি?
রোযার কণ্ঠের আবেগে আসমানের কেমন যেন অনুভূত হলো,ঠিকরে বেরোলো অশ্রু পুনরায়। তা ঠেকাতে চোখে হাতের উল্টোপিঠ ছোঁয়াতেই তাকে আটকে দিলো রোযা।জোরপূর্বক হাত সরিয়ে তাকে নিজের দিকে ঘোরালো।
– দেখি,এদিকে তাকাও,দেখো আমাকে।

নিজের ওড়নার প্রান্ত গুটিয়ে আসমানের অশ্রু সিক্ত কপোল মুছতে থাকলো রোযা,গভীর মনোযোগের সঙ্গে।তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো আসমান। বাঁধা প্রদান করলোনা স্পর্শে।তার সম্পূর্ণ চেহারা অতি যত্নে মুছে নিয়ে ব্যাগ থেকে একটি সার্জিক্যাল মাস্কের প্যাকেট বের করে নতুন মাস্ক চেহারায় পরিয়ে দিলো রোযা।অশ্রু নির্গমন বন্ধ হয়েছে।তবুও দৃষ্টি উদাসীন এবং অনুভূতিপূর্ণ।নিজের চোখেও অশ্রুফোঁটা অনুভব করলো রোযা।দুহাতে আলতোভাবে হৃদয়রাজের গাল চেপে শুধালো,

– কষ্ট পেয়েছ?
নিঃশব্দ আসমান।
– তুমি তো সফল হয়েছ।তবে কেনো এই বেদনা?
এবারেও নীরবতা। রোযা ঝুকলো,আসমানের নিকটবর্তী হয়ে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে ভগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– বাদশাহ কায়সারের পরিণতি?
– মৃ*ত্যু।

ছোট্ট শব্দটি অবশেষে উচ্চারণ করলো আসমান।একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো রোযা।তার প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে।আসমানের বিষাদের কারণটুকু সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা অনুধাবন করতে পারছে।অমানিশার এক মহাযাত্রার সমাপ্তি ঘটেছে।অন্তিম এই ধাপে তার অতীতের সকল স্মৃতি তাড়া করে বেরিয়েছে তাকে পাগলের মতন।নিশ্চয়ই চিত্রলেখা,মেঘের কথা স্মরণে এসেছে প্রচুর।সেই গ্লানিতে নিটল হিমালয়ও আজ টলতে বাধ্য হয়েছে।ভাগ্যকে দুষছে নিজের।কেন এমন হতে হলো?রোযার খুব ইচ্ছা হলো আরেকটিবার চাঁদকে নিজের মাঝে আগলে নিতে,জানাতে যে সে তার পাশে আছে।ইচ্ছা হচ্ছে ঝুঁকে ওই কপালে স্নেহের চুমু আঁকতে।অভিশপ্ত ললাট থেকে সকল অভিশাপ নিজের মাঝে শুষে নিতে।কিন্তু তা সম্ভব নেই।সেই অধিকার তার নেই।
কিছুক্ষণ ভাবলো রোযা।তারপর অতর্কিতে আসমানের একটি হাত পাকড়াও করলো।চেহারায় উৎফুল্ল অনুভব ফুটিয়ে বললো,

– চলো।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো আসমান।
– আমার বাসায়।আমার নতুন বাসা তো তুমি দেখনি।
– না।ভালো লাগছেনা।আমি পেন্টহাউজে ফিরবো।
জবাব আসলেও রোযা ইয়ত্তা দিলোনা।খানিকটা জোরেই আসমানকে বেঞ্চি থেকে টেনে তুলে জানালো,
– হুম,আজকে কিছুটা বাজার করতে হবে।বাজার থেকে সোজা বাসায় যাবো আমরা।
প্রতিবাদ করতে গেলেও পারলোনা আসমান।রোযা তাকে টেনে নিলো সড়কে।অন্যদিন যদিও হেঁটেই যায়, তবে আজ একটি রিকশায় উঠলো।মধ্যম ব্যাস্ত সড়ক বেয়ে রিকশা এগোতে এগোতে রোযা হাত তুলে আশেপাশে দেখাতে দেখাতে আসমানকে রাজ্যের কথা বলতে লাগলো।তার বিষাদ থেকে কিছুটা দূরে সরানোর প্রচেষ্টা।আসমান সম্পূর্ণ রাস্তা নীরব থাকলো, একমনে শুনে গেলো রোযার প্রতিটি অপ্রয়োজনীয় কথা।মেয়েটি কি করতে চাইছে তা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।তবুও,খারাপ লাগছেনা তার।
কিছুক্ষণ পর কাঁচা বাজারের সামনে নেমে রোযা কিছু সবজি কিনলো।তাজা তাজা সবজিতে পানি ছিটিয়ে চলেছে দোকানিগণ।একটি ঝুপড়ির সামনে থেমে রোযা জিজ্ঞেস করলো,

– লেবু কত করে?
– ৬০ ট্যাহা হালি।
ভ্রু কপালে তুললো রোযা।
– চলছে শীতকাল,এমনিতেই এই জিনিসের খুব একটা প্রয়োজন নেই।সামান্য দু ফোঁটা ভাতে দিলে ভালো লাগে খেতে,তাতেই এমন আগুন দাম!
– নিলে নেন না নিলে সরেন।
– ৩০ টাকা দেবো, হাফ ডজন দেবেন?
দোকানী এমন কটমট করে রোযার দিকে তাকালো যেন সে ভিনগ্রহের প্রাণী, হুট করে পৃথিবীতে এসে পড়েছে।

– কৌতুক করেন আফা?
– ওমা কৌতুক করবো কেনো?৩০ টাকা দেবো, হাফ ডজন লেবু দিন।
– ৩০ টাকায় ভিক্ষুকেও থু মারে।
– আমি মা*রিনা বাবা!দুই টাকা উপার্জন করতেই মাথার ঘাম পায়ে পড়ে সেখানে ৩০ টাকা!বড়ই দুঃখজনক।
– আফা আফনে অন্য কারো লগে মজা নেন, এইহান থেইক্যা সরেন।
– ২০০ টাকা দিচ্ছি,এক ডজন প্যাকেট করে দিন।
এগোলো আসমান।পকেটে হাত ভরলো।কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো রোযা।
– এই না,একদম না।তোমাকে এখন মানবতার ফেরিওয়ালা সাজতে হবেনা।দরকার হয় ভাতের সাথে বি*ষ মিশিয়ে খাবো তবুও এই লেবু খাবো না।তাহলেই দেখবে তরতর করে দাম পরে যাচ্ছে।
– আফার মাথার ইস্ক্রু কি ঢিলা ভাইজান?

আসমান স্থির চেয়ে রইলো বুঝতে পারছেনা কি করবে কিংবা বলবে।সত্যিকার অর্থে জীবনে এমন পরিস্থিতিতে সে খুব কমই পড়েছে।অন্তত দরদাম এড়িয়ে চলেছে যতটা সম্ভব। রোযা কটমট করে দোকানীর দিকে চেয়ে বললো,
– শুনেন ভাই।বাঙালি হলো লোভী জাতি, আমাদের জিহ্বা লম্বা বেশি।কোনো জিনিসের দ্বিগুণ দাম দিয়ে হলেও আমার কিনে খেতেই হবে।না খেলে লোভ মেটে না, পরিতৃপ্তি আসেনা।এই কারণেই ইলিশের কেজি ২ হাজার ছুঁইছুঁই।তাই বলে কি লোকে কিনে না?অবশ্যই কিনে।দুর্নীতি করে উপার্জন করে হলেও কিনে।কারণ আমাদের নোলা বেশি।মানুষ যেহেতু কিনছেই তাই দাম কখনো কমেনা।মাঝখান থেকে বঞ্চিত হয় দিন এনে দিন খাওয়া খেটেখাওয়া মানুষগুলো।
চেয়ে থাকলো দোকানী।শুধুমাত্র সেই নয়,বরং আশেপাশের কয়েকজনও তাকিয়ে আছে।আসমানের হুট করে ভীষণ হাসি পেলো।সে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো।অপরদিকে দোকানী দুহাত তুলে বললো,

– আফা মাফ চাই দোয়াও চাই।আফনে পরের বার নির্বাচনে দাঁড়ান।দেশটা ঠিক কইরা দেন।
– দিব দিব অবশ্যই দিব।আমাকে এত যোগ্য মনে করার জন্য ধন্যবাদ।
– আফারে আফা,নেন নেন,আফনে ৩০ দিয়া চারটা নিয়া যান।আমারে ছাড় দেন বাবারে বাবা! কোন মুসিবতের পাল্লায় পড়লাম!
দোকানী সত্যিই একটি পলিথিনে চারটা লেবু ভরে রোযার দিকে এগিয়ে দিলো।গুণে গুণে ত্রিশ টাকা দাম পরিশোধ করে রোযা তা ব্যাগে পুরলো,

– পরের সপ্তাহে দেখা হচ্ছে ভাই।
– আমার আল্লাহ,দরকার নাই আফা,আফনে সুখে থাকেন,ভালো থাকেন আর আমার কাছ থেকে দূরে থাকেন!
হাসলো রোযা।আসমানের বাহুতে নিজের বাহু গলিয়ে ফিরতি পথ ধরলো।তার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে অজান্তেই আসমানের অধর বিস্তৃত হলো।
– বুঝেছ?এইভাবে বাজার করতে হয়।
– ওহ আচ্ছা।
– তুমি তো পুরো ২০০ টাকা নিয়ে লাফিয়ে পড়ছিলে!কেনো?বেশি টাকা তোমার তাইনা?এই তোমার মতন মানুষগুলোর জন্যই দিন দিন জীবনযাত্রার মূল্য বাড়ছে।

– দেশ নিয়ে এত চিন্তিত হলে কবে থেকে?
থমকে পড়লো রোযা।আসমানের দিকে তাকালো।
– হুম,খুব বেশিদিন নয়।ইদানিং একটা রাজনৈতিক গল্প লিখছি,ধারাবাহিক সিরিজ।ভালোই পাঠক চাহিদা।তাই বোধ হয় এসব বেশি ভাবছি।
– তুমি আর রাজনীতি!
– হ্যাঁ।ভাবছি দোকানী ভাই ঠিকই বলেছে, নির্বাচনে দাঁড়ালে মন্দ হয়না।
– মার্কা কি নেবে?
– কি*লিং মেশিন থেকে সেলাই মেশিন।চব্বিশ ঘন্টায় এক দিন,সেলাই মেশিনে ভোট দিন!সেলাই মেশিনের চাকায়,দেশটা হবে দুবাই!

হাসলো আসমান,নিজেকে আটকাতে পারলোনা।তার খিলখিলে ধ্বনি প্রবাহিত হলো।বহু আকাঙ্ক্ষিত হাসির মাধুর্যে রোযা নিজেকে হারিয়ে ফেললো সম্পূর্ণ।অবলোকন করে নিলো প্রিয়তমর উৎফুল্ল আস্ফালন।
পাশ দিয়ে একটি অটোরিকশা যেতেই হাত তুলে থামালো রোযা।লোকাল হিসাবে ভেতরে চেপে বসলো।সে এবং আসমান ব্যতীত কোনো যাত্রী নেই এখনো। যানটি চালু হতেই রোযা ধীরকন্ঠে শুধালো,
– বাসার সবাই ভালো আছে? চারুলতা?বাবা….
থমকে গেলো,পরমুহুর্তে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
– সরি। আই মিন,মিস্টার রেমান।
– হুম,সবাই ভালো আছে।

নির্বিকারভাবে জবাব এলো আসমানের তরফ থেকে।রোযা তার পাশে বসে মাথা নেড়ে নিজের কোলের দিকে তাকালো,ওড়নার খুঁটে আঙুল পেঁচালো।জানতে ইচ্ছা হচ্ছে অনেক কিছুই।সে কেমন ছিল,কি হয়েছিল, সবকিছু আসলেই ঠিক আছে কিনা…. অনেক কিছু।কিন্তু কিছুই উচ্চারণ করা সম্ভব হলোনা।এক দুর্বোধ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে আসমান তাদের মাঝে।তাই বর্তমানে এসব আলাপের অধিকার নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে রোযা।

– আমরা…
হঠাৎ আসমানের নিজে থেকে উচ্চারণে রোযা ফিরে তাকালো।দৃষ্টি তার সামনেই।
– সিটি ইউফোরিয়ার ঠিকানা বদলাচ্ছি দ্রুতই।
– মানে?
এক মুহূর্তের জন্য ধক করে উঠলো রোযার বুক!আসমান কি দূরে সরে যাচ্ছে?
– ইতালি চলে যাচ্ছো?
নিজের অভ্যন্তরের ঘূর্ণিপাক চাপা দিয়ে জানতে চাইলো রোযা,তার কণ্ঠের অস্বাভাবিক কম্পন আসমানের নজর এড়ায়নি।মাথা নেড়ে সে বললো,

– না।গুলশানে।
– গুলশানে কেনো?
– রেমান পরিবারের পৈতৃক নিবাস সেখানে।এতদিন নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।কিন্তু বর্তমানে আর বাঁধা নেই। বাবার ইচ্ছা আমরা সেখানেই থাকি।
দৃশ্যমানভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রোযা।নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে তার।এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিল এই বুঝি চাঁদকে হারিয়ে ফেললো!ঠিক তখনি অটোরিকশা থামলো।নতুন যাত্রী উঠলো।
তেজস্বী শরীর এলিয়ে এক তাগড়া যুবক রোযার পাশেই বসে পড়ল।নির্বিকার ভঙ্গিতে ফুঁকতে থাকলো একটি সিগারেট।তার এতটাই কড়া তামাটে গন্ধ যে রোযার কাশি এসে পড়লো।সে কিঞ্চিৎ সরে বসতে চাইলো,কিন্তু ছোট সিটে তা সম্ভব হলোনা। ঝাঁকির সঙ্গে সঙ্গে যুবকের বেখেয়ালী কনুই ঠেকছে তার অঙ্গে,নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে?
– একটু সরে বসবেন প্লীজ?

নিজের কন্ঠস্বর সংযত রাখলো রোযা,যুবক তার দিকে এক নজর তাকালেও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আপন কাজে মনোযোগ দিলো।বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার।রোযা পুনরায় কিছু বলতে উদ্যত হচ্ছিল কিন্তু তার উরুতে স্থাপিত হলো একটি বলিষ্ঠ হাত। চট করে পাশে ফিরে আসমানকে দেখলো রোযা,ইশারায় তাকে উঠতে আদেশ করলো সে।আসন বদলে রোযাকে একপাশে দিয়ে নিজে মাঝখানে বসলো আসমান।তাতে যুবকের মুখে বিরক্তিকর কুঞ্চন সৃষ্টি হলো।
– এত নড়েন চড়েন ক্যান মিয়া?
তাকালো আসমান তার দিকে,নিগূঢ় দৃষ্টির শীতলতায় অজানা শিহরণ খেলে গেলো যুবকের অঙ্গজুড়ে।
– এটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।দয়া করে ভদ্রতা বজায় রাখুন।
বজ্রকণ্ঠের কঠোরতায় কাপলো যুবকের হৃদয়,একটি শক্ত ঢোক গিলে মুহূর্তেই সে পাশে ফিরলো।আঙুল থেকে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে আসনের একপাশে লেপ্টে গেলো।আসমান বুকে দুবাহু ভাঁজ করে রেখে স্থির দৃষ্টিতে পুনরায় ফিরলো সামনে।দৃশ্যটির দিকে একনজরে চেয়ে থাকল রোযা,নজর ফিরিয়ে বাইরের দিকে চাইতেই তার ঠোঁটজুড়ে এক স্নিগ্ধ হাসির ধারা খেলে গেলো।

বাসায় পৌঁছেই দ্রুত কাজে লেগে পড়লো রোযা।সকল বাজার সদাই গুছিয়ে রাখলো প্রথমে।আসমান তাকে কোনপ্রকার বিরক্ত না করে প্যান্টের পকেটে হাত ভরে চারিপাশে হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলো ছোট্ট নীড়টিকে। একটি বেডরুম,তার সঙ্গে লাগোয়া সরু বারান্দা।এদিকের ঘরটা কাজকর্ম এবং খাওয়াদাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।যেখানে রয়েছে দুইটি প্লাস্টিকের চেয়ার এবং টেবিল।একপাশে একটি তাক ঝোলানো,যাতে ছোটোখাটো কিছু জিনিস এবং তার সঙ্গে বইপুস্তক নজরে পড়ছে।একটি ফাইল তুললো আসমান,উল্টে দেখলো রোযার বিভিন্ন সার্টিফিকেটের ফটোকপি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফরম।আবার জায়গামতো তা রেখে দিয়ে উল্টো ঘুরতেই কিচেনে নজরে পড়লো রোযাকে।রান্না চড়িয়েছে একটিমাত্র চুলায়।কিছুক্ষণ পরেই এলো আসমানের কাছে।

– লেবুর শরবত করে দেবো?খাবে?
মাথা নাড়লো আসমান।খাবেনা।
– ঠিক আছে। ভাত আর ডালের চচ্চড়ি করছি।কিছুক্ষণের মাঝেই হয়ে যাবে।
খাবে কি খাবে না জিজ্ঞেস না করেই দ্রুত কাজে উধাও হলো রোযা।জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজন নেই তার।জানে,সারাদিন সামান্য পানিটুকুও হয়তো পেটে পড়েনি আসমানের।
রান্না সম্পন্ন হতে হতে রোযা দ্রুত গোসল সেরে আসলো।টেবিলে খাবার বেড়ে দিলো।তেমন আহামরি কিছু করা হয়নি,ভাত, ডাল এবং ডিমভাঁজা।প্লেটে ভাত বেড়ে নিতে নিতে চেয়ারে আনমনে বসে থাকা আসমান তার কার্যক্রমের দিকে চেয়ে রইল।নিজেকে শুধালো,কি করছে সে এখানে?তার তো এখানে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল না!কোনো উদ্দেশ্য ছিল না রোযার সঙ্গে সম্পূর্ণ সন্ধ্যাটা কাটিয়ে রাত্রি গভীর করবার।তবুও তার ঠিকানা অজান্তেই এসে থমকেছে এই ছোট্ট অথচ উষ্ণতায় পরিপূর্ণ নীড়ের মাঝে।কেনো?কি হয়েছে তার?কি করছে সে?কেনো করছে?
উফ্!এত প্রশ্ন কেনো তোর?যা হচ্ছে হতে দে,প্রশান্তি পাবি—

ক্রোধান্বিত হয়ে উত্তর করলো অন্তর।আসমান দমে গেল।অদ্ভুত দ্বিধা এবং দোলাচলে আসক্ত হলো।প্লেট এগিয়ে দিয়ে রোযা তার ধোঁয়াটে দৃষ্টির সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলো,
– কি মিস্টার?কোথায় হারিয়ে গেলেন? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– খেতে ইচ্ছা করছে না।আমার বাসায় যাওয়া উচিত।রাত হয়ে যাচ্ছে।
সত্যি সত্যি উঠে পড়লো আসমান।রোযা জোরপূর্বক তার হাত পাকড়াও করে ঠেকালো তাকে,বসিয়ে দিলো চেয়ারে।
– একদম চুপ!খালি যাই যাই করে!একটা ঘুষি দিয়ে নাকশা ফাটিয়ে দিবো,ইডিয়ট!
উভয় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হাসির দমক নিবারণ করলো আসমান।বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলো,“ইডিয়ট” শব্দটির অভাববোধ করছিল সে!তাকে নতমুখে ভাবতে লক্ষ্য করে রোযা একটি নিঃশ্বাস ফেললো।দ্বিতীয় চেয়ার টেনে প্লেট তুলে বসে পড়লো আসমানের মুখোমুখি।প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে এক টানে মাস্কটি খুলে ছুড়লো একপাশে,যেন ঘৃণিত বস্তু, চাঁদের সৌন্দর্য অবলোকনে বাঁধা দিচ্ছে তা,তাই আক্রোশ।তারপর ডিমভাঁজা এবং ঘন ডাল মিশিয়ে গ্রাস তৈরী করে আসমানের মুখের সামনে ধরলো,

– বড় করে মুখ খোলো…. আ!
ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকলো আসমান।
– কি হলো?অমন হ্যাবলার মতন তাকিয়ে আছো কেনো? ডালভাতই তো,গরুর গোবর মেশাইনি!
গোবরের কথা শুনে নাক কোচকালো আসমান,তাতে বিনোদিত হয়ে রোযা পুনরায় বললো,
– কতক্ষন ধরে গ্রাস তুলে আছি,খাবে?নাকি আমি নোংরা বলে আমার হাতে খেতে অস্বস্তি হচ্ছে?
সহসাই অজানা এক শিখা প্রজ্জ্বলিত হলো আসমানের গভীর কালো দৃষ্টিতে।ঝট করে রোযার কব্জি পাকড়াও করলো সে,এক টানে মুখে পুরলো সবটা।খিলখিল করে হাসতে গিয়েও মাঝপথে থমকে গেলো রোযা,অভ্যন্তর শিউরে উঠলো।আঙুলে আসমানের ঠোঁট এবং দাঁতের স্পর্শ ঠেকেছে।উত্তেজনায় বেখেয়ালি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু এই বিষয়টির কথা মাথায় আসেনি।

হৃদস্পন্দন সামলে আরেক গ্রাস তুললো,তারপর আরো এক গ্রাস।ক্রমশ রোযার হাতের কম্পন বাড়লো।নিঃশব্দ অনুভূতি স্পষ্টতই অনুভব করলো আসমান।মস্তিষ্ক এক কথা বলছে তাকে,কিন্তু হৃদয় আরেক কথা।দ্বিতীয়বার জয়ী হলো তার হৃদয়।অন্তিম গ্রাস আসমানের মুখে তুলে দিতেই দুই দাঁতের পাটির মাঝে আলতোভাবে তার তর্জনী আঁকড়ে ধরলো আসমান। ভ্রু কুঁচকে এলো রোযার,সম্পূর্ণ চেহারা ছেয়ে গেলো লালিমায়।কি হলো ওই মুহূর্তে কেউই বলতে পারবেনা।আসমান রোযার কব্জি ধরে ফেললো, হাতের তালুর ভাঁজে স্পর্শ করলো জিহ্বা।আলতো কিছু ছোঁয়া রোযার শরীরজুড়ে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ খেলিয়ে দিলো।বুকের মাঝে নিঃশ্বাস আটকে এলো তার,আসমানের ধোঁয়াটে দৃষ্টি এবং অভাবনীয় কার্যক্রম সর্বাঙ্গ উলোট পালট করে রেখে দিয়েছে।
এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিলো রোযা।তাতে যেন একটি ধাক্কা খেয়ে বাস্তবতায় ফিরলো আসমান।মিটমিট করে তাকালো,কি করছিলো সে এতক্ষণ?কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল?দ্রুত উঠে দাঁড়ালো রোযা।আমতা আমতা করে বিব্রত ভঙ্গিতে বললো,

– আম…আমি…প্লেট রেখে আসছি!
এক ছুট। রোযা কিচেনে ঢুকে পড়তেই নীরবতা ছেয়ে গেলো আসমানকে।এক গভীর আতঙ্ক গ্রাস করলো তাকে।এ কোন অগ্নিখেলায় মেতেছে সে?মাথা ঠিক আছে তার?একদম ঠিক নেই!দৃষ্টির সামনে তার বিপদ সংকেত ঝুলছে।চিৎকার করে মস্তিষ্ক বলে চলেছে,
—পলায়ন করো এক্ষুণি!প্রস্থান করো,অন্যথায় ধ্বংস!
এক হিমশীতল আবরণে নিজেকে আচ্ছাদিত করে উঠে পড়লো আসমান।রোযার ছুঁড়ে রাখা মাস্কটা তুলে মুখে পড়লো।

– আমি গেলাম।
এটুকুই উচ্চারণ করলো দ্রুত কন্ঠে।রোযার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করলোনা।হনহন করে হেঁটে এগোলো দরজার দিকে।হাতল ধরে বাইরে পা রাখতে গিয়েই টলে উঠলো তার শরীর।মাথা চেপে ধরলো একহাতে।বেশ অনেক্ষণ ধরেই মাথাটা ধরেছিল,তার সঙ্গে দূর্বলতা।তবে এবার সম্পূর্ণ নাড়িয়ে দিয়েছে তাকে।দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে পড়েছে। দরজার সাথে আসমান ঠেকালো নিজেকে,ভারসাম্য বজায় রাখলো নিজের হাত দেয়ালে ঠেকিয়ে।গভীর প্রশ্বাস গ্রহণ করলো।লাভ হলোনা।শরীর গুলিয়ে উঠলো।তবুও অবাধ্য পদক্ষেপে বাইরে পা রাখতেই তার জ্যাকেট আঁকড়ে ধরলো রোযা।জোর টানে পিছনে সরালো। ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে হাত রাখলো কপালে,অতঃপর কলার হটিয়ে ঘাড়ে।

– তোমার প্রচণ্ড জ্বর হয়েছে আসমান!
রোযার হাতখানা জোরের সঙ্গে সরিয়ে আসমান মাথা নাড়লো,
– ওসব কিছুনা।বাসায় পৌঁছে একটা ট্যাবলেট খেয়ে নেব,ঠিক হয়ে যাবে।
– কিচ্ছু ঠিক হবেনা!
পরোয়াহীন হয়ে আবারো বাইরের দিকে এগোতেই রোযা দুই হাতে তার কাঁধ খামচে ধরে পিছনে টেনে আনলো।সশব্দে দরজাটি বন্ধ করে রীতিমত চিৎকার তুললো,
– এই অবস্থায় তুমি কোত্থাও যাবে না আসমান! অনুরোধ জানাইনি,আদেশ করেছি আমি!
আদেশ?তাও আবার ধ্বংসাধিপতিকে? পরাশক্তিদের মহারাজকে?হাস্যকর নয় কি?

মোটেও হাস্যকর নয়।আসমানকে টানতে টানতে নিজের রুমে আনলো রোযা, ঠেলে দিলো বিছানায়। শীতকালে ব্যবহারের জন্য গত সপ্তাহে কেনা নতুন কম্বলটি ট্রাংক থেকে বের করে বিছানায় রাখলো। দ্রুতহাতে খুলে নিলো আসমানের পরিধানের জ্যাকেট।তারপর টি শার্ট। বাঁধা দেয়ায় প্রচেষ্টা চালালোনা আসমান।তার ভীষণ গা গুলোচ্ছে।খাবারের কারণে কি? চোখমুখ খিচে অন্তর্দহন সামলাচ্ছে সে।

রোযার সামনে ক্রমশই উন্মুক্ত হলো আসমানের শুভ্রতা।প্রশস্ত বুকে দৃষ্টিপাত ঘটতেই সে থমকে গেলো।চেপে এলো তার হৃদয়,হাহাকারে।আসমানের বুকজুড়ে কা*টাকাটি চিহ্ন,বিশেষ করে বাম কাঁধের নিচ থেকে একেবারে ডান কোমর পর্যন্ত বয়ে গিয়েছে কিঞ্চিৎ গভীর দগদগে শুষ্ক ক্ষ*ত।দৃষ্টি টলটলে হলো রোযার।আর কত কলঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে তার প্রিয়তম?ঠিক কতখানি যন্ত্রণা সে লাভ করেছে ভাগ্যের নিষ্ঠুর চক্রে?আদও কি তা কোনোদিন পরিমাপ করা সম্ভব?

অসামান্য এক ক্রোধ অনুভব করলো সে নিজের মাঝে।এই চিহ্নের স্রষ্টা সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ নেই।ওই রমণী যদি কোনোদিন রোযার সামনে এসে দাঁড়ায়,তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে রোযার জন্য।যে হাল সে তার চাঁদের করেছে,তার উপযুক্ত প্রতিদান ভোগ না করিয়ে তাকে ছাড়বেনা রোযা!কিন্তু এই মুহূর্তে আসমানের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

দ্রুত কাজগুলো করলো সে।বাসায় ফ্রিজ নেই।তাই চতুর্থ তলার আন্টির কাছ থেকে কিছু বরফ আনলো। তা পানিতে দিয়ে ঠান্ডা করে তন্নতন্ন করে খুঁজে নির্বাচন করা সবথেকে নরম কাপড়টি ভেজালো।আসমানের গ্রীবাদেশ,বক্ষ এবং উদর মুছে দিলো শীতল হওয়ার আশায়।থার্মোমিটার থাকলে ভালো হতো।কিন্তু তা নেই।অগত্যা যা আছে তাই ব্যবহার করা উচিত।আসমানের মাথায় একটি রুমাল দিয়ে জলপট্টি চেপে তার হাত টেনে ধরলো।মুছতে লাগলো আঙুলের ফাঁক।হাতটি যথারীতি শীতল,কোনো উষ্ণতা নেই।এই হাত ছুঁয়ে শারীরিক তাপমাত্রা আন্দাজ করা অসম্ভব,তাই রোযা আগে অনুধাবন করেনি ভেতরে ভেতরে কতটা অসুস্থতাবোধ করছিল।আসমান একদম নিশ্চুপ,শুধুমাত্র নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বুক ওঠানামা করে চলেছে।চোখজোড়া বন্ধ।কেমন বোধ করছে সে?প্রচণ্ড খারাপ নিশ্চয়ই।নাহলে এমন এলিয়ে যাওয়ার মানুষ আসমান নয়।দুরুদুরু বক্ষে আসমানের কব্জি মুছতে গিয়েই বিষয়টি আবিষ্কার করলো রোযা।

বাম হাতের কব্জি আবদ্ধ রেজিনের ব্রেসলেটে,যার প্রান্তে ঝুলছে অর্ধচন্দ্র।
সম্পূর্ণ স্থির হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো রোযা, কন্ঠ শুকিয়ে এলো তার। তিরতির কাপতে থাকলো সর্বাঙ্গ।সে কি ভুল দেখছে?ভ্রম হয়েছে তার?
মুঠোর মাঝে আসমানের লম্বাটে শিরা উপশিরাপূর্ণ আঙুলগুলো নড়ে উঠে জানান দিলো যেন,সে কিছুই ভুল দেখছে না।

বারান্দা বেয়ে পূর্বাহ্নের স্নিগ্ধ দীপ্তি চুঁইয়ে প্রবেশ করছে ভেতরে।আরামদায়ক এক উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছে সমস্ত শরীর হতে অন্তর পর্যন্ত।দীর্ঘ এক প্রশ্বাস গ্রহণ করে মিটমিট করে নয়নপল্লব মেলে তাকালো আসমান।ছোট্ট ঘরটির মলিনতায় আচ্ছাদিত শুভ্র সিলিং নজরে এলো সর্বপ্রথম।কয়েক সেকেন্ড সময় গ্রহণ করে মস্তিষ্ক আলসেমি ভেঙে জাগ্রত হতেই আবিষ্কার করলো একটি কম্বলে মুড়িয়ে রয়েছে সর্বাঙ্গ তার। নড়তে গেলো,কিন্তু বাঁধা পড়লো হাতের বাঁধনে।

চট করে পাশ ফিরে চাইতেই মুখায়বটি নজরে এলো।নিদ্রাচ্ছন্ন রোযা।মেঝেতেই বসে আছে,শুধুমাত্র মাথাটি ঠেকানো বিছানায়,ঠিক আসমানের হাতের কাছে,যেটি এই মুহূর্তে তার মুঠোয় আবদ্ধ শক্তভাবে।চমকালো আসমান।গত রাতের খুব বেশি স্মৃতি নেই তার। জ্বরের ঘোরে যন্ত্রণাবোধ হচ্ছিল,একবার বমিও করেছে।রোযা মাঝরাতে তাকে দুটো পাউরুটি খাইয়ে এরপর ঔষধ দিয়েছিল।এরপর আবার শুয়ে পড়েছে।চোখ বোজার পর আর কিছু স্মরণে নেই।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে নিজের কপালে হাত ছোঁয়ালো আসমান।খানিকটা উষ্ণ।যদিও নিজের তাপমাত্রা নিজে মাপা দুঃসাধ্য,তবুও ঠাওর করে নিলো জ্বর নেমে এসেছে। শরীরও ফুরফুরে অনুভূত হচ্ছে। অতর্কিতেই টের পেলো এর কারণ। শরীরে কম্বল থাকলেও তার টি শার্ট, জ্যাকেট ভাঁজ করা বিছানার পাশের আলনাখানার তাকে।শরীর মুছিয়ে দিয়েছিল রোযা, এজন্যই হয়ত এমন সুস্থতাবোধ।

আনমনে ঘুরে আবারও রমণীতে দৃষ্টিপাত ঘটালো।ক্লান্তি খচিত তার অঙ্গজুড়ে।সারাটা রাত জাগ্রত ছিল আসমানের সেবায়।হয়ত সকালের দিকেই ঘুমিয়েছে।তাকে জাগানোর ইচ্ছা হলোনা।কিন্তু যে অবস্থায় ঘুমাচ্ছে তাতে শরীর ব্যথা হবে পরবর্তীতে কোনো সন্দেহ নেই।ঘুমন্ত মুখশ্রী অবলোকন করে গেলো আসমান।মনে হলো যেন এর আগে রোযাকে কখনো এমন নিগূঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি,তাও এতটা কাছ থেকে।আহামরি চোখ ধাঁধানো সুন্দরী?উহুম, রোযাকে সেই শ্রেণীতে ফেলা যাবেনা কোনো আঙ্গিকে।নেহায়েত স্বাভাবিক তার রমণীসুলভ সৌন্দর্য্য,উজ্জ্বল চেহারাজুড়ে খচিত নিষ্পাপ মায়াবী স্নিগ্ধতা।তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ কঠোরতার মিশেল।চেহারার একটি বস্তু আকর্ষণীয় ঠেকলো আসমানের নিকট।বদ্ধ চোখের পাতায় সংযুক্ত লম্বাটে ঘন পাপড়ি, তিরতির করে কাপছে শিশিরভেজা ঘাসের মতন।ললাটে এলোমেলো ছড়ানো কেশরাশি।

বিনুনি পাকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল,কিন্তু পরিশ্রমে অগোছালো হয়েছে।
অদ্ভুত এক টান অনুভব করলো আসমান। সয়ংক্রিয়ভাবে তার উন্মুক্ত হাতটি উত্তোলিত হলো, আঙুলগুলো ছুঁয়ে গেলো রোযার কপালে।চুলের গুচ্ছ সরিয়ে মুক্তি দিলো ললাটকে,তাতে বৃদ্ধাঙ্গুলির সাহায্যে আঁকিবুঁকি কেটে চললো আনমনে। ভ্রু কুঁচকে এলো রোযার,তাতে দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো।কিন্তু ঘুম ভাঙলোনা মেয়েটির।বরং মুঠোয় থাকা আসমানের হাতটি আরো কাছে টেনে তাতে কপোল ছোঁয়ালো, যেন আরামদায়ক বালিশ তা।অতঃপর পুনরায় পাড়ি জমালো নিদ্রারাজ্যে।সম্পূর্ণ স্থির হয়ে পড়লো আসমান।হাতের তালুতে রোযার ত্বকের স্পর্শ এবং চাপে তার হৃদয় আবেশিত হয়ে পড়ছে ক্রমশ।একটি শক্ত ঢোক তার গ্রীবায় ঢেউ খেলিয়ে নেমে গেলো উদরে।হাত গুটিয়ে নেয়ার ইচ্ছা,কিন্তু রোযার নিদ্রাভঙ্গ হবে তাতে।সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।ভাবতে ভাবতে কখন যে তার হাতটি রোযার কপোল ছুঁয়ে দিতে থাকলো অতি স্নেহের সঙ্গে,টেরটুকুও পেলোনা।

—তুই কি করছিস আসমান?ভুলে গেছিস এই ধরিত্রীর বুকে তুই এক অভিশাপ?অযোগ্য কাপুরুষ তুই।যেই তোর জীবনে জড়িয়েছে সেই অচিরে হারিয়েছে আপন অস্তিত্ব।এরপরও এমন বেহায়াপনার দুঃসাহস কিভাবে হয় তোর অন্তরের?
এক তীব্র উপলব্ধি খেলে গেলো আসমানের সর্বাঙ্গজুড়ে।পরাজিত হলো অনুভূতির দল।জয়লাভ করলো অনুভূতিহীনতা।পরম শীতলতায় আচ্ছন্ন হলো হৃদয়,দুয়ার দিলো অন্তরের। নির্বিকারতা ছেয়ে গেলো অস্তিত্বে,অনুসরণে কঠোরতা।
এক টানে রোযার কাছ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো আসমান।খানিক বেপরোয়াভাবেই।নিদ্রাভঙ্গ হলো রোযার।উঠে পড়ল ধড়ফড় করে,

– ক…কি হয়েছে?তুমি…ঠিক আছো আসমান?কোনো সমস্যা?কষ্ট হচ্ছে কোথাও?
রোযা সত্যিই ভড়কে গিয়েছে,হৃদস্পন্দন সীমা ছাড়িয়েছে।শুকনো ঢোক গিলে সে তাকালো বিছানায় উঠে বসা আসমানের দিকে। অনুভূতিশূন্য তার দৃষ্টি।গতকালের দূর্বলতা অদৃশ্য হয়েছে।পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে নিটল হিমালয়।
– আসমান?
– আমি ঠিক আছি।
মৃদু শুষ্ক কন্ঠে জবাব এলো।রোযা উঠে দাঁড়ালো।হাত বাড়ালো সম্মুখে,
– দেখি জ্বরটা পড়েছে কিনা….

পারলোনা রোযা স্পর্শ করতে।আসমান জোর ঝটকায় সরিয়ে দিলো তার হাত,খানিক অধিক জোর পরে গেলো অজান্তেই,রোযার সমস্ত হাত ঝিনঝিন করে উঠলো। সেটি বুকে টেনে নিয়ে হতচকিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো রোযা।
আসমান ভ্রুক্ষেপটুকু পর্যন্ত করলোনা।কম্বল সরিয়ে উঠে পড়ল।হনহন করে ঢুকলো বাথরুমে।রোযা থ হয়ে রইলো।তার মেজাজের এমন হঠাৎ পরিবর্তন ভাবাচ্ছে।নিজেকে কিছুক্ষণ বুঝিয়ে বেসিন থেকে মুখহাত ধুয়ে চুলায় কড়াই চরালো।আলুভাজা করার উদ্দেশ্যে আলুর ফালি কে*টে নিতে নিতে আসমান সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে এসে পড়লো।

– আমি যাচ্ছি।গতকাল রাতের জন্য ধন্যবাদ।ভালো থেকো।
এটুকুই। দরজার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।রোযা হুড়মুড় করে উঠে পড়ল।ছুটলো আসমানের কাছে।
– তুমি আসলেই সুস্থ আছো?সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো ভেবেছিলাম।একটু অপেক্ষা করো, নাস্তা তৈরি করছি।খেয়ে এরপর একসাথে বের হই।
– না!
রান্নাঘরে ফিরতে যেয়েও থমকে গেলো রোযা।আসমানের কন্ঠে এতটা শীতলতা মিশ্রিত ছিল যে তা শরীরে শিহরন খেলিয়ে দিয়েছে।
– পরপুরুষের উদ্দেশ্যে এত মায়া বাঞ্ছনীয় নয় রোযা।
ঘুরলো আসমান,তৎক্ষণাৎ খপ করে তার হাত পাকড়াও করলো রমণী।মাথা কাত করে তাকাতেই তার স্নিগ্ধ চেহারায় যন্ত্রণা এবং ক্রোধের মিশ্রিত অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করা গেলো।
– পরপুরুষ?

ভ্রু খিঁচে আসমানের পরিধানের জ্যাকেটের হাতা গোটালো রোযা,হাতের পরিধানকৃত ব্রেসলেটটি কোমল দীপ্তিতে বিষদ মায়ার প্রজ্জ্বলন ঘটালো।কিছুটা হতচকিত হলো আসমান,চেয়ে থাকলো রোযার গভীর অভিব্যক্তির পানে।
– এটা তাহলে কি আসমান?তুমি কেনো পরনারীর দেয়া উপহার নিজের মাঝে ধারণ করে আছো?
রোযার হাতের মাঝে আসমানের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হলো,এতটা জোরের সঙ্গে যে শুভ্রতার মাঝে ফ্যাকাশে ভাব স্পষ্টতর ভাসলো।টলটলে অনুভব প্রস্ফুটিত হলো রোযার দৃষ্টিজুড়ে,অত্যন্ত আবেগ নিয়ে সে তাকালো নিজের চাঁদের উদ্দেশ্যে।দুঃসাহস অর্জন করে এগোলো,দুহাত রাখলো আসমানের কাঁধে।

– কেনো বারবার পালাতে চাইছো চাঁদ?তুমি নিজেও অনুধাবন করছো অন্তরের বাসনা।তারপরও কেনো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছো?কেনো এতটা কষ্ট দিচ্ছ আমাকে?নাহ,আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ বলে নয়, বরং তোমার অবস্থান ভেবেই আমার কষ্ট হচ্ছে, প্রচণ্ড কষ্ট।
কম্পিত হাত তুলে রোযা স্পর্শ করলো আসমানের কপোল,আলতোভাবে।যেন গভীর স্পর্শের অধিকার নেই।এটুকুই তাদের মাঝের সীমারেখা।
– গতকাল যখন তোমায় কাদতে দেখলাম।কি মনে হয়েছিল জানো?যেন আমার হৃদয় উ*গ*ড়ে কেউ টু*করো টু*করো করছে!যখন কোনোমতেই তোমার কান্না থামছিল না,তখন নিজের সামনে শুধু অন্ধকার দেখছিলাম,দিশাহারা পথিকের মতন।

মুহুর্তের জন্য আসমানের কৃষ্ণগহ্বরে অনুভূতির ক্ষীণ প্রবাহ লক্ষ্য করা গেলো।উৎসাহিত হয়ে রোযা আর একটু অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। করুণ আবেদন নিয়ে জানালো,
– আসমান,আমার চাঁদ!আমি কোনোদিন তোমাকে বদলাতে চাইনা,তুমি আমার অমানিশার চাঁদ,এই অমানিশার হাত ধরেই আমি আজীবন বাঁচতে চাই। দীপ্তির ছোঁয়া লাগবেনা গায়ে?ঠিক আছে।আমি মানিয়ে নেবো।শুধু তোমাকে নিজের পাশে চাই।আপন বলে পরিচয় দেয়ার মতন এই জগতে একটা মানুষ চাই।
– সেই স্থানে অন্য কাউকে বসানো যায়না?
বিন্দুমাত্র সময় নিলোনা রোযা উত্তর করতে।মাথা নাড়লো,

– যায়না আসমান,যায়না।আমার সবটুকু নিবেদন শুধুমাত্র তোমার প্রতি।তুমি বলো আমাদের দুনিয়া আলাদা,দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা আমরা।কিন্তু আমি বলি আমরা একদম এক।এই ধরিত্রীর বুকে অবহেলায় জন্ম নেয়া পাশাপাশি দুটো ঘাসফুলের মতন।যাদের নিজের র*ক্ত বলতে দুনিয়ায় কেউ নেই।এতিম,সর্বহারা, নিঃস্ব।শুধুমাত্র তোমাতেই আমার সবটুকু অনুভূতি জড়ানো।তোমার হাত ধরে আমি নির্দ্ধিধায় এগোতে পারবো,ভরসা করে কাঁধে মাথা রাখতে পারব।
– ভরসা?আমি রক্ষক নই ভক্ষক।
মৃদু হাসলো রোযা, অশ্রুসিক্ত নয়নে তা ঠেকলো অদ্ভুতুড়ে অপূর্ব।আসমানের দুহাত নিজের দু মুঠোয় আবদ্ধ করে রোযা জানালো,

– ভক্ষক?হতে পারো অন্যদের জন্য।কিন্তু আমার জন্য নও।তুমি আমার ভাগ্যাকাশের একফালি সুখের চাঁদ।যে নিজের জোছনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল আমার জীবনে।সবটুকু উজাড় করেছে আমার তরে।রক্ষা করে গেছে আমাকে,সম্মুখ কিংবা আড়াল থেকে।এরপরও তোমায় ভরসা করা উচিত নয় বলছো?
নিঃশব্দ আসমান।শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
– আসমান,আমাদের মাঝে যা যা হয়েছে তা কি ভুলে যাওয়া যায়না?নিজের জীবনকে আরেকটিবার সুযোগ দেয়া যায়না পরিপূর্ণতা লাভের?বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার নিবেদন কোনো করুণা নয়।
– কেন বারবার দূরে ঠেলার পরও বেহায়ার মতন কাছে আসতে চাও?
– আমার নিজের স্বার্থে।

আসমানের কৃষ্ণগহ্বরে নিজের তারকাখচিত দৃষ্টিপাত করলো রোযা,অত্যন্ত আবেগপূর্ণ কন্ঠে ব্যক্ত করলো,
– এ করুণা নয় আসমান,এ আমার স্বার্থ।আমরা কাকে নিজের জীবনে পাশে চাই জানো?যে আমাদের খুশি রাখতে পারে,যার পাশে নিজেকে নিরাপদ অনুভব করি,যাকে ভরসা করে এগিয়ে যেতে পারে।অনুভূতি মানেই স্বার্থপর।আপন চাহিদা পূরণে আমরা সকলে সচেষ্ট।তাকেই এই অন্তর সবটুকু নিংড়ে চায় যে আমাদের সুখে রাখতে পারে।অতএব,আমি নিজের সুখের কথাই ভাবছি।তুমি আমাকে সুখী করেছ চাঁদ।
চেয়ে রইলো আসমান,দীর্ঘক্ষণ।একবুক আশা নিয়ে বাকরুদ্ধ অপেক্ষা করলো রোযা।হয়ত এবার গলবে ওই হিমবাহ।তার প্রতি একটু হলেও আবেদন জন্মেছে পাথরমানবের অন্তরে।তাইনা?

রোযাকে আরো একবার মহাবোকা প্রমাণিত করে নিজের দুহাত সরিয়ে নিলো আসমান।
শীতল দৃষ্টি তার নয়নজুড়ে।ওই শোষণীয় গহ্বরে সামান্যতম অনুভূতির ছিটেফোঁটা নেই।এ যেন আসমান নয়।রোযার সামনে বর্তমানে দন্ডায়মান প্রথমবার দেখা সেই পরাশক্তিধর পিশাচ।এক মুহূর্তে বুঝে গেলো রোযা,কি হতে চলেছে।
প্রত্যাখ্যান,অত্যন্ত বাজেভাবে প্রত্যাখ্যান।
রোযার চিবুক চেপে ধরলো আসমান দুই আঙ্গুলে, জোরপূর্বক মুখ তুলে মেলালো নিজের অসহনীয় দৃষ্টি।
– আমি ব্যতিত কাউকে হৃদয় আসনে বসাতে পারবেনা?আমি তোমার সকল সুখের উৎস?তাহলে জেনে রাখো,আমার জন্য সেই সকল কিছুর একমাত্র অধিকারিণী চিত্রলেখা!
যে নামটি শ্রবণে সর্বদা আফসোস এবং বিষাদ অনুভূত হতো,আজ সে নামটি অত্যধিক যন্ত্রণা দিলো।রীতিমত শরীর কাপিয়ে যন্ত্রণা।নিজের দৃষ্টি ফেরাতে চাইলেও সম্ভব হলোনা আসমানের শক্ত বাঁধনের কারণে।অশ্রু টপটপ করে গড়াতে থাকলো রোযার গাল বেয়ে।

– আমি কিভাবে তার আসনে নতুন কাউকে বসাতে পারি রোযা?ভেবে দেখেছ কি একবারও?
কোনো উত্তর নেই এই প্রশ্নের।আসমানের সামনে পরাজিত হলো রোযার সকল অনুভূতি।অনুধাবন করতে পারছে সে বর্তমানে,যত জোরালোভাবে সে আসমানের নিকটবর্তী হতে চাইবে,তার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিতে আসমান তাকে দূরে ঠেলবে,সর্বদা।তার চিবুক ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা দূরে সরে দাঁড়ালো আসমান।
– অন্তিম বারের মতন বলছি রোযা,অমানিশার দুনিয়ায় অনুপ্রবেশ করতে যেও না।অভিশাপে গুঁড়িয়ে যাবে।
এতগুলো দিন ধরে নিজের ভেতর জমিয়ে রাখা অনুভূতির পারদ আজ সীমা ছাড়ালো।চুপ থাকা সম্ভব হলোনা রোযার পক্ষে।কাদতে কাদতে চিৎকার ছুড়লো,

– তাহলে কেনো?কেনো এসেছিলে আমার দুয়ারে?ভালোই তো ছিলাম আমি,নিরাশ হয়ে,শুধুমাত্র স্মৃতি নিয়ে বেঁচে।কেনো ওই অশ্রু সজল নয়নে সামনে আসলে?কেনো আলিঙ্গন করতে দিলে?আমাকে কি মনে হয়?পুতুল?যখন যেমন ইচ্ছা তেমন খেলে যাবে আর আমি চুপচাপ সহ্য করে যাবো?
আসমান নিজের কপালে তর্জনী ছুঁয়ে দিলো, যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা।পাল্টা চিৎকার করতে ইচ্ছুক নয় সে।রোযা এগোলো,তার জ্যাকেটের কলার আঁকড়ে ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলতে লাগলো,
– জবাব দাও!নিশ্চুপ কেনো?কেনো এসেছিলে আমার কাছে?কিসের জন্য?কে বি গ্রুপের পতন হয়েছে, বাদশাহ কায়সারকে হ*ত্যা করেছ।তাতে আমার কি?কেনো আমাকে পুনরায় আশান্বিত করলে? কেনোই বা এখন সব অনুভূতি অস্বিকার করলে?বলো….যদি আমার জন্য বিন্দুমাত্র পরোয়া না থেকে থাকে তবে কেনো নিজের কব্জিতে জড়ালে আমার আবেগ অনুভূতি জড়ানো উপহার?

এক ক্রোধ তরঙ্গ খেলে গেলো আসমানের সর্বাঙ্গে।বাম হাতের কব্জিতে তাকালো।সব আগ্রাসন এই জড়বস্তুকে ঘিরে।
– যত সব নষ্টের গোড়া এই জিনিস তাইনা?
কয়েক পলকের মাঝে ঘটলো ঘটনাটি। ব্রেসলেটটি খুলে অবহেলায় মেঝেতে ছুড়ে দিলো আসমান,গড়িয়ে গিয়ে তা গোত্তা খেলো প্লাস্টিকের চেয়ারের সঙ্গে।দৃশ্যটি সম্পূর্ণ নির্বাক করে দিলো রোযাকে।বিলীন হলো তার হৃদস্পন্দন।দৃষ্টির সামনে শুধুমাত্র শূণ্যতা যেন।

– এবার আর কোনো অভিযোগ নেই নিশ্চয়ই?
পারলোনা রোযা।অসম্ভব।আর নয়।এক নারী আর কত সহ্য করবে?নিজেকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাও চালালোনা সে।সটান উল্টো ঘুরল,আসমানের মুখোমুখি হলো।পরমুহুর্তে যা হলো তা কল্পনাতীত।
ডান হাতটি উত্তোলন করে আসমানকে সশব্দে চড় দিলো রোযা!ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ তিরতির করে কাপছে, চেহারাও রক্তিম আভা ধারণ করেছে।প্রসারিত দৃষ্টিজুড়ে অশ্রুকণা।সামান্য টললো পাথরমানব,এক পা পিছিয়ে মুখ তুলে পুনরায় চাইলো রোযার পানে।কিন্তু তার দৃষ্টিতে শূন্যতা ছাড়া কিছুই নেই।

– গেট আউট!
বাক্যটি ফিসফিসে শোনালো।পরমুহুর্তেই রোযা চিৎকার করলো,
– গেট আউট ফ্রম মাই হাউস নাউ!
যেন প্রস্তুত ছিল আসমান।তৎক্ষণাৎ ঘুরলো, দরজা খুলে হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাইরে।একটিবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালোনা। হুমড়ে পড়লো রোযা মেঝেতে,তুলে নিলো ব্রেসলেটটি,চেপে ধরলো নিজের বুকে।ক্রন্দনের দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠলো।মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল,নিজেকে গুটিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাদতে থাকলো।

এতটা তীব্রভাবে তাকে আঘা*ত না করলেও পারতো আসমান!এ যন্ত্রণা যে সহ্য করা দায়!
আজ আরো একবার নতুন করে অনুধাবন করলো রোযা,সে একলা।প্রচণ্ড একলা এই জগতে। কেউ নেই তার পাশে,কেউ না!তার আজীবন কাটতে চলেছে এই একাকীত্বে।

রেমান পরিবারের মানুষগুলো বেশ শৌখিন।নিজেদের পৈতৃক ভিটার নাম দিয়েছে “ মেঘতীর ”।এই শৌখিনতার ভাব বিলাল রেমানের মাঝেও রয়েছে।তাইতো নিজ কন্যাদের নাম রেখেছেন,চিত্রলেখা এবং চারুলতা।শ্রবণ হলেও প্রশান্তি ভর করে অন্তরে। গতকালই সিটি ইউফোরিয়া ছেড়ে গুলশানের বাড়ি মেঘতীরে পৌঁছেছে সমগ্র রেমান পরিবার।স্থাপনাটিকে অবশ্য বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই শ্রেয়।বিস্তৃত জমির উপর দন্ডায়মান কিঞ্চিৎ মোঘল এবং কিঞ্চিৎ ব্রিটিশ ধাঁচে নির্মিত স্থাপনাটি এক অনন্য শৈলীর প্রতীক যেন।নিজের মাঝে বহন করে চলেছে ঐতিহ্য,সংস্কৃতি।অভ্যন্তরে আধুনিকতা।চারিপাশ ঘিরে রয়েছে বাগান, বৃক্ষরাজি।একপাশে ছোট্ট একটি পুকুরের মতন।একান্তে সময় অতিবাহনের আদর্শ স্থান।

কে বি গ্রুপের ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়েছে।ইতোমধ্যেই কায়সার পরিবারকে ঘিরে তোলপাড় চলছে দেশের প্রতিটি অঙ্গনে।শুধুমাত্র পতন নয়,বরং তাদের দ্বারা পরিচালিত সকল কুকর্মের পর্দাফাঁস হয়েছে।ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অবৈধ কার্যক্রমে লিপ্ত কোম্পানিটির বিরুদ্ধে হাজারের অধিক অভিযোগ জমা পড়েছে আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর কাছে। দুর্ঘ*টনার দিন বিলাল রেমান ও তার কন্যাকে জোরপূর্বক আবদ্ধ করার ঘটনাও এসেছে জনসম্মুখে। সবই ছিল বিলাল রেমানের পূর্ব পরিকল্পনা।আসমান যেমন কে বি গ্রুপের ধ্বংসকাব্য রচনা করেছে,তেমনি পিতা বিলাল সেই ধ্বংসের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ একটু একটু করে সাজিয়েছেন।যেন আর কোনোদিনও ভষ্ম থেকে নতুনভাবে মেরুদন্ড সোজা করে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম না হয় কে বি ইন্ডাস্ট্রিজ।

কায়সার অধিপতি বাদশাহ কায়সারের হ*ত্যাকা*ণ্ড সম্প্রচার করা হয়েছে হা*র্ট অ্যা*টাকে মৃ*ত্যুবরণ হিসাবে।কেনো করেছে এই কাজ কায়সার পরিবার?নিজেদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য রক্ষায়।এই ঘটনা হ*ত্যা হিসাবে প্রচারিত হলে তার হাত ধরে আরো বহু কালো অধ্যায়ের সত্যতা সামনে আসতে বাধ্য।এমনিতেও চারিদিক থেকে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত হু*ম*কি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে গোটা প্রতিষ্ঠানকে।নিজেদের অধিপতির বিদায়, করুণ অবস্থা,দোষারোপ,অবৈধ সংযোগ…সব মিলিয়ে কে বি গ্রুপ বিলুপ্তপ্রায়।ঠিক যে মুহূর্তে রেমান গ্রুপ নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে অগ্রসর হয়ে যাচ্ছে সিংহাসনের দিকে।

সকাল সকাল কড়া এক মগ কফির সাথে ফাইলপত্র ঘাটতে ব্যাস্ত বিলাল।তার খেলা এখনো শেষ হয়নি।কে বি গ্রুপ সম্পূর্ণ দেউলিয়া না হওয়া পর্যন্ত থামা অসম্ভব।তার সঙ্গে নিজের কোম্পানিকেও ঠিক এই মুহুর্তেই এগিয়ে নেয়ার চরম সুযোগ,যেহেতু এই ঘটনাপ্রবাহ ঘিরে রেমান পরিবার লাইমলাইটে রয়েছে।কাজের পরিমাণ পাঁচগুণ হয়েছে তার।যা সামলাতে চারুলতাকে দায়িত্ব দিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

দেয়ালঘড়ি ঢং ঢং করে সকাল নয়টার ঘোষণা দিতেই ডুপ্লেক্স বাড়িটির দুইতলার রাজকীয় ধাঁচের পেঁচানো অথচ প্রশস্ত সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিচে নেমে এলো আসমান।তার ভারী পদশব্দে মুখ তুলে চাইলেন বাদশাহ।ছেলেকে চিনে উঠতে পারলেন না কয়েক মুহূর্ত।শুভ্র শার্ট এবং ধূসর ক্রপস্যুটে আবৃত সর্বাঙ্গ।গলায় চেকের টাই,যা ঢুকিয়ে রেখেছে স্যুটের ভেতর।মুখে মাস্ক,বুকের বাম পাশে ছোট্ট একটি ব্রুচ।বাহুতে ঝুলছে কোটখানি,আপাতত পরিধানের ইচ্ছা হয়নি বোধ হয়।পুরোদস্তুর প্রস্তুত সে।হাসি ফুটলো বিলালের অধরে।

– বাহ্ বেইবি।তোমাকে অসাধারণ লাগছে!
উত্তরে শুধু হালকা মাথা দোলালো আসমান।বিলাল উঠলেন।নিজের বাদামি কোট গায়ে জড়িয়ে শুধালেন,
– তাহলে যাওয়া যাক?
এবারেও নিঃশব্দে সম্মতি জানালো আসমান।অনুসরণ করলো পিতাকে।বাইরে মার্সিডিজ অপেক্ষারত রয়েছে। উভয়ে চেপে বসতেই ইঞ্জিন চালু হলো।বেশ কিছুক্ষণের মাঝেই গন্তব্যে পৌঁছলো তারা।বাইরে পা রাখতেই সম্মুখে দানবাকৃতির সুউচ্চ আধুনিক ভবনটি দৃষ্টি কাড়লো।যার মাঝ বরাবর খচিত,
“ রেমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ”

বিলালের অনুসরণে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো আসমান। রিসিপশনের পাশ দিয়ে হাঁটতেই বডিগার্ড এবং অ্যাসিস্ট্যান্টগণ অনুসরণ করলো তাদের। কর্মচারীগণ সম্মান জানালো,সালাম প্রদান করলো।সকলের চরম আগ্রহ আজ আসমানকে ঘিরে।এর পূর্বে এই কোম্পানিতে তাকে দেখা যায়নি,কিন্তু তার নাম সকলের নিকট পরিচিত।
প্রাইভেট এলিভেটরে চেপে বত্রিশ তলায় পৌঁছল সকলে।কনফারেন্স রুম তৈরি।আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে এগোলেন বিলাল।অপরদিকে কিঞ্চিৎ দ্বিধায় তাকে অনুসরণ করে গেলো আসমান।ভেতরে প্রবেশের আগে পুত্রের মুখোমুখি হলেন বিলাল।মৃদু আঁচে আসমান প্রশ্ন করলো,

– আর ইউ শিওর?ইউ ওয়ান্ট মি টু সিট ওভার দ্যা চেয়ার?
– অফকোর্স মাই বয়!নার্ভাস?
অস্বীকৃতি জানালোনা আসমান।তাতে বিলাল হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।এক হাতে পিঠ চাপড়ে বিড়বিড় করলেন,
– চিন্তা করোনা।আমি জানি তুমি পারবে।আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।তোমার একটি সামাজিক পরিচিতি অত্যন্ত দরকার,কথা দিচ্ছি তা গড়ে তবেই ক্ষান্ত হবো।

একটি প্রশ্বাস গ্রহণ করলো আসমান।মাথা দোলালো।আরেক দফায় তাকে উৎসাহ প্রদান করে বিলাল এগোলেন।ভেতরে প্রবেশ করলেন। কোটখানা গায়ে চড়িয়ে অনুসরণ করলো আসমান তাকে,দৃপ্ত পদক্ষেপে।উপস্থিত সকলে উঠে দাঁড়ালো সহসাই।সম্মান জানালো অধিপতিকে।বিশাল প্রজেক্টরের সামনে,একদম মাঝখানে পোডিয়ামের উপর দাঁড়ালেন বিলাল।দৃষ্টিপাত ঘটালেন অনুসারীদের মাঝে।ইশারা জানালেন বসতে।সকলে একে একে আসন গ্রহণ করলো।গাঢ় নৈঃশব্দ্য কক্ষে।মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বিলাল রেমানের পাশে দন্ডায়মান ব্যক্তিত্ব।হাত বাড়ালেন বিলাল,আসমানের বাহু আঁকড়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে ঘোষণা করলেন,

– লেট মি ইনট্রুডিউস টু ইউ অল….
আসমানের দিকে তাকালেন এক পলক।অতঃপর বললেন,
– নীলাদ্রি রেমান নীল, দ্যা এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অব রেমান কর্পোরেশন। মাই সন্।
শিরদাঁড়া টানটান করে সকলের মুখোমুখি হলো আসমান,বিন্দুমাত্র দুর্বলতার ছাপ নেই তার কঠোরতার অবয়বজুড়ে।

নভেম্বরের পনেরতম দিনটি অন্যান্য দিনগুলোর তুলনায় অধিক শীতলতা ধারণ করেছে।শরীরে সোয়েটশার্ট জড়িয়েও মৃদু কাপছে রোযা।বাসায় ফিরে দ্রুত কম্বলের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত।ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছে সে। গোধূলী পেরিয়ে আজ রাত্রি নেমেছে শহরে।ফিরতে কিছুটা দেরীই হয়েছে।ক্যাফে লো ফাইয়ের একজন কর্মচারীর জন্মদিন ছিল,বাকি সকলে মিলে তাকে সারপ্রাইজ পার্টি দিয়েছে।সেই নিয়ে একটুখানি দেরী।
আনমনে বাড়ির সামনের রাস্তায় পৌঁছলো রোযা।আর দুই গলি পেরোলেই তার নিবাস।নির্জনতা ছুঁয়েছে চারিপাশ।অন্যদিন উপস্থিতি থাকলেও আজ নজরে আসছেনা তেমন কিছুই।শীতের প্রভাবে কি?হতে পারে।আনমনে ভাবনায় হারিয়ে গেলো রোযা।

আসমানের সঙ্গে তার কেনোপ্রকার যোগাযোগ অবশিষ্ট নেই।সেদিনের সেই ঘটনা তাকে সত্যিই আঘা*ত করেছে ভীষণভাবে।পুনরায় অমানিশার মুখোমুখি হওয়া আর কোনোদিন সম্ভবপর হবে কিনা জানা নেই।তীব্র হতাশা জেঁকে বসেছে তার অস্তিত্বে।যেন দেয়ালে এসে পিঠ ঠেকেছে।কোথাও সামান্যতম নড়বার সুযোগ পর্যন্ত নেই।অজান্তেই চোখের কোণে অশ্রু জমলো রোযার, তর্জনীর দ্বারা সন্তপর্নে তা মুছে নিলো সে।আর কতবার বেহায়া হবে সে?এর থেকেও নির্লজ্জ হওয়া সম্ভব কি?আসমান নিশ্চয়ই ভালো আছে,নিজের মতন,আপন দুনিয়ায়।মাঝখানে সে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হচ্ছে।উফ!কেনো ভাবছে এত?কি দরকার?অভিমানের পাহাড় জমেছে তার হৃদয়ে, চাঁদের প্রতি ভীষণভাবে নারাজ সে।

– মিস রোযা রহমান চড়ুই?
কণ্ঠটি কর্ণগোচর হতেই অতর্কিতে থমকে গেলো রোযা।সামনে তাকিয়ে সাদা শার্ট এবং টাই পরিহিত দুজন পুরুষকে লক্ষ্য করলো।কিছুটা দূরে একটি কালো প্রাইভেট কার অবস্থানরত।
– জ্বি।
খানিক দ্বিধান্বিত হয়ে জবাব দিলো রোযা।একজন এগোলো,একটি কার্ড দেখিয়ে বললো,
– আমরা সরকারের স্পেশাল সার্ভিস ইউনিট থেকে এসেছি।আমাদের কাছে আপনার সম্পূর্ণ প্রোফাইল রয়েছে।আপনাকে ঘণ্টাখানেকের জন্য আমাদের অফিসে আসতে হবে।
স্পেশাল সার্ভিস ইউনিট?এমন নামে সরকারি কোনো সংস্থা রয়েছে কি?কখনো শুনেনি রোযা।কিন্তু গোয়েন্দা দপ্তর হিসাবে থাকতেও পারে,যা সাধারণত সাধারণ মানুষদের জানানো হয়না।

– অফিসে কেন?
– কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
– জিজ্ঞাসাবাদ?
– ভয় পাবেন না।তেমন কিছু নয়।আমরা একটি গোপন কেইস নিয়ে কাজ করছি।তার মাঝে কাকতালীয়ভাবে আপনার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।শুধু সাধারণ কিছু তথ্য জানতে চাইবো।ক্যাফে লো ফাই তে কাজ করেন আপনি তাইনা?
রোযা হতবাক হলো।তার সম্পর্কে মোটামুটি সকল কিছুই জানে এরা।আসলেই সরকারি লোক?
– আমাদের সহযোগিতা করলে ভালো হবে আপনার জন্য।নাহলে আপনাকে সন্দেহের তালিকায় তুলতে বাধ্য হবো মিস।

– না না।ওকে,আমি…আসছি আপনাদের সঙ্গে।শুধু…
দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো রোযা।
– একটি ফোনকল করে নেই।আমি যে যাচ্ছি সেটা আমার টিউশনের ছাত্রকে জানিয়ে দেই,যেহেতু আজকে ওকে পড়ানোর কথা আমার।
হালকা হাসির ভান ধরে রোযা দ্রুত নিহাদের নাম্বারটি সামনে আনলো।রিং পড়লো দুইবার,কিন্তু রিসিভ হওয়ার আগেই তার হাত থেকে ফোনটি ছিনিয়ে নেয়া হলো।

– সরি ম্যাম।আপনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন কাউকে জানানো যাবে না।
– কেনো?
– এটাই নিয়ম।
– এ আবার কেমন নিয়ম?
রোযা বুঝতেও পারলোনা কিভাবে কি হলো।বিদ্যুৎ গতিতে তার নিকটে এগোলো লোকটি,শীতল নলের স্পর্শ ঠেকলো তার পেটে।সহসাই অনুধাবন করলো, পি*স্ত*ল!
– চুপচাপ গাড়িতে উঠুন।বিন্দুমাত্র চালাকিরও চরম মাশুল গুণতে হবে।
একটি শক্ত ঢোক গিললো রোযা।সম্পূর্ণ ফাঁদে পরে গিয়েছে সে।উপলব্ধি করতে পারছে সে।কিন্তু এরা কারা?তাকে কেনো বন্দী করতে এসেছে?কি সম্পর্ক সবকিছুর সঙ্গে তার?তবে কি আসমানের কোনো শত্রু এই কাজ করছে?কিন্তু তাদের কেউ কি জীবিত আছে?কে বি গ্রুপের তো পতন হয়েছে।

বেশি ভাবনার সময় পেলোনা রোযা।অ*স্ত্রের মুখে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো গাড়ির কাছে।কিন্তু এত সহজেই হার মানতে নারাজ রমণী।দরজা খুলে তাকে ভেতরে ঠেলতেই অতর্কিতে ঘুরে গিয়ে হাতের ব্যাগটি দিয়ে সজো*রে আ*ঘা*ত হান*লো লোকটির হাত বরাবর।পি*স্ত*লটি ছিটকে গেলো দূরে।সুযোগ গ্রহণ করে চিৎকার দিতে চাইলে অপরজন রোযার মুখ চেপে ধরলো।ধস্তাধস্তি করতে করতে গাড়িতে হেলান দিলো রোযা।নিহাদ এবং আসমানের ট্রেনিং থেকে শিখা টেকনিক প্রয়োগ করলো,লোকটির জায়গা বরাবর হাঁটু দিয়ে আ*ঘা*ত করলো।তাতে যন্ত্রণাবোধক ধ্বনি তুলে লোকটি কুকড়ে গেলে রোযা ছুট লাগালো।তখনি আঁধারের চাদর ভেদ করে গলির মুখ থেকে বেরোলো তৃতীয়জন।রোযার চুলের মুঠি ধরে তাকে আ*ছড়ে ফেললো গাড়ির বনেটের উপর।মাথা ঠু*কে র*ক্তপাত ঘটলো,সমস্ত শরীর স্থবির হয়ে এলো।রোযার উভয় বাহু হ্যান্ডকাফে আবদ্ধ করা হলো।একসঙ্গে তিনজন তাকে চেপে ধরে মুখে কাপড় গুঁজে তুললো গাড়ির ভেতর।দুইজন বসলো দুপাশে, তাকে আবদ্ধ রাখতে। অপর একজন উঠলো ড্রাইভিং সিটে।চালু করলো গাড়ি।

গলি পেরিয়ে মূল সড়কে আসতেই গাড়ির ভেতর ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা রোযা জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য লক্ষ্য করলো।একটি বাইক।ঠিক কয়েক হাত দূরেই। হেলমেটের চারিপাশে জড়ানো পাণ্ডা কভার, পরনের বাইক স্যুটটিও পরিচিত।নিহাদ!সমস্ত অন্তরাত্মা চেঁচিয়ে উঠলো রোযার।কিন্তু মুখে কাপড় গুঁজে রাখায় গোঙানি ছাড়া কিছুই শোনা গেলোনা।শুধু অধিক প্রচেষ্টায় ঘাড় বরাবর প্রচণ্ড আ*ঘা*ত লাভ করলো সে।দৃষ্টি এক লহমায় ঝাপসা হয়ে গেলো তার।

ডার্কসাইড পর্ব ৩৫

চোখ বুজে আসার পূর্বে রোযা শুধু দেখলো নিহাদের বাইকটি পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে বিপরীত দিকে।গাড়িটি তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপন গন্তব্যে যাচ্ছে, অপরদিকে নিহাদ তার বাড়ির দিকে যাচ্ছে।এটুকুই…..
সম্পূর্ণ জ্ঞান লোপ পেতেই রোযা সিটে এলিয়ে পড়লো।র*ক্তা*ক্ত চেহারার নয়নে তার জমাকৃত অশ্রুফোঁটা।

ডার্কসাইড পর্ব ৩৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here