ডার্কসাইড পর্ব ৩৯

ডার্কসাইড পর্ব ৩৯
জাবিন ফোরকান

“ প্রিয়তমা,
ক্রোধান্বিত হয়েছ কি?আমি কি তোমার পর হয়ে গেলাম?অভিমানে মুখ লুকিয়ে রেখেছ বুঝি?আমি অন্য কারো হয়ে যাচ্ছি বলে?সারাটা জীবন তোমাকে ভালোবেসে অতিক্রান্ত করতে পারলাম না,আমি বুঝি কাপুরুষ?আমার ভালোবাসা বুঝি ভঙ্গুর?স্বার্থপর?
নাকি আদতেই তুমি মানব হৃদয়ের কল্পনার মতন সুন্দর?দূর থেকে খুশি হচ্ছো?আমি নতুন এক সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে নিজেকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চাইছি বলে?এই হৃদয় যে বড্ড টানাপোড়েনে ভুগছে মায়াবিনী,কিভাবে বোঝাই অস্তিত্বকে?

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কি আমি কোনো ভুল করেছি?তুমি আমায় বলতে পারো আমার কি করা উচিৎ ছিল? জীবনে কখনো দ্বিতীয়বার ভালোবাসা সম্ভব নয়, যদি হয়,তার অর্থ ভালোবাসা কোনোকালে পবিত্র ছিলোনা।যার তরে একবার এই অন্তর লুণ্ঠিত হয়, তাকে আর কোনোদিন ভুলতে পারেনা সত্তা।তবে কি আমি তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি?আমার ভালোবাসা কি আজ থেকে অপবিত্র হয়ে গেলো?সকল অনুভূতি কি শূন্য হয়ে গেলো যা আমি তোমার তরে বুনেছিলাম?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি জানিনা আমার চিত্র,কিন্তু আমি এটুকু জানি, আমার সমস্ত অস্তিত্ব জানে,তুমি আমার মাঝে বসবাস করো।নতুন এক জগতে প্রবেশ করছি,সত্যি কথা।এই প্রকৃতি কখনো শূন্যস্থান পছন্দ করেনা।সে তা পূরণ করে আপন ক্ষমতায়।আমার নিষ্ঠুর অভিশপ্ত ভাগ্যও দুহাত ভরে এক টুকরো সুখ উপহার দিয়েছে আমায়, আমি তা পায়ে ঠেলতে পারিনা।ক্লান্ত আমি,ভীষণ ক্লান্ত।আমি একলা নই।আমার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরো কিছু মানুষের ভবিষ্যত।সেই তাড়নায় যদি নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়,আমি প্রস্তুত।

আমি কি খুব ভুল করছি গো চিত্র?নিশ্চিত নই,তবুও আশা রাখছি নয়।এই অভিশপ্ত অস্তিত্ব যদি কারো সুখের চাবিকাঠি হতে পারে তাতে দোষের কি?তোমার নিকট লুকিয়ে রাখার কিছুই নেই। স্বীকার করছি, আমার অন্তরও পুড়ছে আবেগাগ্নিতে।এক সুতীব্র চাহিদা হৃদয়জুড়ে।ওই মায়াবী মুখখানা দেখলে এই পাথরের মাঝেও জ্বালাতন হয়,একটুখানি লোভী হওয়ার বাসনা জাগে।তোমার সত্তা আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান পাবে এক আবদ্ধ বাক্সে,যে বাক্স এতটাই চমৎকার অনুভূতিতে খচিত যে তা খোলার অধিকার শুধুমাত্র আমি ব্যতিত আর কারও থাকবেনা।বাকিটা জুড়ে নাহয় এই অন্তর নতুন অনুভূতিদের স্থান দেয়ার প্রচেষ্টা চালাবে?

ভালোবাসি চিত্রলেখা। ভালোবাসি আমার পরিণীতা।আগামীকালের পর থেকে হয়ত জগতের কাছে আমি বেঈমান হয়ে যাবো,তবুও বেহায়ার মতন বলছি,আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলোনা মায়াবিনী।যে অনুভূতির মুকুল তুমি এই হৃদয়ের পাথর অঙ্গনে প্রস্ফুটিত করেছ,যে প্রচেষ্টায় অমানিশাকে দীপ্তিতে টেনে এনেছ,সেই পর্যায়ে আমার জন্য কেউ কোনোদিন পৌঁছাতে পারেনি এবং পারবেও না।তুমি আমার চিত্রলেখা,তোমার আমার অংশ আমাদের মেঘ, আমার স্বপ্নপুরীর রাজকন্যা; আমার আঁধার জগতের একমাত্র প্রজ্জ্বলিত তারকা,যে তারকার অস্তিত্ব সৃষ্টিজগৎ ধ্বংস পর্যন্ত মুছবেনা এই পিতার অন্তর থেকে।তোমরা ছিলে, আছে,এবং থাকবে এই হৃদয়জুড়ে।এক সুখকর স্মৃতির বাক্স হয়ে।
তোমার তরে আপন সমাপ্তি রচেছি,এবার নাহয় কারো তরে নবীন সূচনা রচি?
শক্তি দাও চিত্র,এই নবযাত্রায় প্রার্থনা দাও।
ইতি,

তোমার ব্রোকেন হার্ট।”
উড়োচিঠির সমাপ্তি ঘটলো এক ফোঁটা অশ্রুর দাগে। পত্রখানি উড়লোনা,আবদ্ধ হয়ে পড়ল ডায়েরীর পাতার ভাঁজে।যে ডায়েরীজুড়ে আটক মানুষরূপী এক মেশিনের অনুভূত সকল অব্যক্ত আবেগী পংক্তিমালা।

ডিসেম্বরের জেঁকে বসা শীতের আবহ উপেক্ষা করে গা ঝাড়া দিয়ে জাগ্রত হয়েছে সমস্ত নগরী।শুষ্ক প্রকৃতির মাঝে বছরের অন্তিম পর্যায়ের বিষাদ এবং নতুন বর্ষ বরণের প্রফুল্ল প্রস্রবণ। ব্যাস্ত নগরী, ব্যাস্ত জনজীবন।তবুও যেন কোথাও এক সুখ সুখ অনুভূতির উদগীরণ। শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার ঝামেলা শেষ হয়েছে, দিন অতিবাহিত হচ্ছে ব্যাডমিন্টনের কোর্টে।কেউ কেউ আবার পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে ভিড়ছে গ্রামের বাড়িতে।শহরের বুক কিঞ্চিৎ শূণ্যতা ধারণ করেছে। অভিজাতদের উপভোগের মাত্রা ছাড়িয়েছে।ঠিক উল্টো দৃশ্যপটে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দিন ওই একটি নিয়মের ছকেই বাঁধা।কর্ম না করলে এই নিষ্ঠুর শহরে খাদ্য মেলেনা।আলসেমি করবার সুযোগ কোথায়? দু মুঠো ডাল ভাতের তীব্র হাহাকার উদরজুড়ে।

এমনি এক মিশ্রিত অনুভবপূর্ণ স্নিগ্ধ সকাল।বৃক্ষের পাতায় পাতায় ঝুল শিশিরফোঁটা। শৈত্যপ্রবাহের ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত প্রকৃতি।হিমশীতল সমীরণের পালতোলা অনুভূতি।এর মাঝেও জেগে ওঠা পাখিদের কলকাকলি।মিষ্টি রোদের হাতছানিতে ছেয়েছে সমস্ত ধরিত্রী।যেন এক নতুন সূচনার ঘোষণা করতে।
হাতের ব্যান্ডেজ খুলেছে তিনদিন আগে। আঙুল এবং তালু রেঙেছে মেহেদীর টকটকে বর্ণে।শুভ্র শাড়ীর ভাঁজে জড়িয়েছে অঙ্গ।প্রজ্জ্বলিত কারুকার্য সম্বলিত চোলি আচ্ছাদিত করেছে মস্তক।এক প্রশান্তির অনুভব খচিত সম্পূর্ণ অবয়বজুড়ে।বিয়ের পাত্রীর সাজে আয়নার সামনে বসে আছে রোযা। আঁখিজোড়া তার বুজে আছে,যে পল্লবে আপনমনে কাজ করে চলেছে চারুলতা।

চেহারার সাজসজ্জা অভিজ্ঞ হাতে সমাপ্ত করে অলংকারের দিকে হাত বাড়ালো চারু।সিলভার বর্ণের সেটটি থেকে এক এক করে অলংকারে সজ্জিত করলো রোযার সর্বাঙ্গ।বেশি কিছু নেই।একটি সরু নেকলেস,দুই কানে ছোট্ট পাথরের দুল।নাকে নথ এবং মাথার বাম পাশে টায়রা।নিজের বিয়ের শাড়ি থেকে আরম্ভ করে অলংকার সবকিছুই রোযা প্রস্তুত করেছে নিজ দায়িত্বে।মাসিক ২০ হাজার টাকা উপার্জন থেকে জমানো হাজার সাতেক টাকার সম্পূর্ণই সে খরচ করেছে এই উদ্দেশ্যে।তেমন আহামরি হয়ত নয় ব্যাপারটি,তবুও রোযার আপন চিত্তে প্রশান্তির জন্য ব্যাপক।আজ যদি তার পরিবার থাকতো,যদি ইউনূস রহমান থাকতেন,তাহলে নিশ্চয়ই বৃহৎ আড়ম্বরের ব্যবস্থা থাকতো।তবুও এতিম মেয়েটি আপন বিয়ের খুশিতে ভাটা পড়তে দিতে চায়নি,হোক তা নিজের বিয়ের আয়োজন নিজেই সম্পন্ন করা,ক্ষতি কিসে?

রোযার সাজ সম্পূর্ণ করে চারুলতা তাকে আয়নায় নিজেকে অবলোকন করতে দিলো।নিজের অবয়ব লক্ষ্য করে মৃদু লাজমাখা হাসির উদ্ভব ঘটলো রমণীর গোলাপরাঙা অধরে।
– খুব চমৎকার হয়েছে চারু।তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
চারুলতা হাসলো,রোযার মাথায় দুহাত স্পর্শ করে প্রার্থনা জানালো,
– দোয়া করি।খুব সুখী হও।

তুমি ঠিক আছো তো?অবাধ্য অন্তর পুড়ছেনা ভালোবাসাকে অন্য কারো হতে দেখার বিরহে?— জিজ্ঞেস করে দিনটির মাধুর্য্য নষ্ট করতে চাইলোনা রোযা। চারুলতা তার কাছে গতকালই এসেছে, হাতের মেহেদী থেকে আরম্ভ করে আজকের কনে সাজের সম্পূর্ণ কারিগর সে।মেয়েটি সামান্যতম খেদ প্রদর্শন করেনি।বরং অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে করেছে।যেন সে বিরহ বেদনায় আক্রান্ত নয়,বরং প্রচণ্ড খুশি।কি দরকার এই প্রফুল্লতা ধ্বংস করবার?
গাড়ির হর্ণের শব্দে উভয় রমণী সামান্য চমকালো।বারান্দায় গিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে পুনরায় ফিরে এসে চারু জানালো,

– নিহাদ এসে পড়েছে। এবার যাওয়া উচিত।
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে উঠলো রোযা। ড্রয়ার টেনে একটি বাক্স বের করে হ্যান্ড ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।তাকে কিছুটা সময় দিলো চারুলতা।নিজের সবুজাভ লেহেঙ্গাতে সজ্জিত অবয়বের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করে দীঘল কালো চুলে চিরুনি বুলিয়ে নিলো একবার।চকচকে কালো কেশরাশির মাঝে উঁকি দিলো সবুজ বর্ণের লুকায়িত গুচ্ছ।গতকালই কালার করিয়েছে,আসমান এবং রোযার বিয়ে উপলক্ষ্যে।

রোযা নিজের শোবার ঘরের ট্রাংকের কাছে এলো।খুলতেই ভেতরে দেখা মিললো তার পিতার ডায়েরী এবং মায়ের রুপোর নূপুরখানি।তার সঙ্গে ইউনূস রহমানের ব্যবহৃত একটি পোশাক।আপন মানুষগুলোর স্মৃতিসমূহের উদ্দেশ্যে চেয়ে থাকলো রোযা,অজান্তেই কপোল বেয়ে গড়ালো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। দ্রুত মুছে নিয়ে চোখ বুজলো।মনে মনে বিড়বিড় করলো,

“ দোয়া করো দাদু,তোমার চড়ুই অবশেষে জীবনে সুখের পথে পা বাড়িয়েছে।সে যেন সফলকাম হয়।দোয়া করো আব্বু আম্মু,খোদা যেন তোমার মেয়ে এবং জামাইয়ের নতুন জীবনে বরকত দান করেন।আমি জানি তোমরা সবাই আমার পাশে আছো। ভালোবাসি তোমাদের,এই মেয়েটাকে দেখে রেখো।”
– তুমি প্রস্তুত?
কাঁধে হালকা স্পর্শে রোযা চোখ মেললো।ঘুরে তাকিয়ে দেখলো চারুলতাকে।
– হুম,চলো যাওয়া যাক।

সম্মতি পেতেই হাত বাড়িয়ে দিলো চারু।তার হাতটি ধরলো রোযা,অতঃপর বেরিয়ে এলো বাসা থেকে।চৌকাঠের বাইরে পা দেয়ার সময় এক অব্যক্ত অনুভূতিতে পূর্ণ হলো অন্তর।এক নব্য রূপকথা মুদ্রিত করতে চলেছে সে আজ।জীবন তার বদলে যাচ্ছে, অনন্তকালের জন্য।কিন্তু এই বদলে কোনো খেদ নেই।আছে শুধুমাত্র এক জগৎ সমান অনুভূতি, প্রিয়তমকে আপন করে পাওয়ার সুতীব্র বাসনার পরিপূর্ণতা।

বিল্ডিংয়ের সামনে নেমে আসতেই কালো বর্ণের মার্সিডিজ বেঞ্জ নজরে এলো।যার শরীরে হেলান দিয়ে দন্ডায়মান নিহাদ।আসমানী বর্ণের পাঞ্জাবী এবং শুভ্র পায়জামায় তাকে দেখতে অন্যরকম ঠেকছে।সুদর্শন অবয়বের মারকাটারি ভঙ্গি এবং অস্থিরতা দূরীভূত হয়ে তাতে ভর করেছে সুস্থিরতা।সুবিশাল আসমানের একটি ছোট্ট টুকরো যেন।প্রশান্ত,স্নিগ্ধ,সুস্থির।হাতের আঙুলে গাড়ির চাবিটি ঘুরিয়ে চলেছে, নেত্রজুড়ে সানগ্লাস। রোযাকে নিয়ে চারুলতা বেরোতেই ঘুরে তাকালো সে।আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো কনেকে, সানগ্লাস টেনে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বখাটেদের মতন শীষ বাজিয়ে হাসলো বিস্তৃত।

– মার ডালা ফুলটুশীইইই…!
রোযার হাতের এক চপাটে খিলখিল ধ্বনি তুলে হাসতে থাকলো।
– কি আশ্চর্য্য! প্রশংসাই তো করলাম।বিয়ের কনে তুমি, এতটা বেশরম হলে হয়?দেবরের গায়ে হাত তুলো!
– দেবর যদি ছ্যাচড়া নাম্বার চারশো বিশ হয় তাহলে আর কি করার?
পাল্টা চারুলতার জবাবে কটমট করে তাকালো নিহাদ।
– এইযে এসে গিয়েছে মুরগী কড়কড় করতে করতে।নিজের চঞ্চু নিয়ে দূরে থাকো বৎস,উত্তেজিত হয়ে পাখনা মেলে ঠোকর দিতে আসো কেনো খালি? হ্যান্ডসামনেস দেখে লোভ সামলাতে পারোনা?
তেঁতে উঠে তিন ইঞ্চি হিলের ডগা নিহাদের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে হানলো সে,ছেলেটা পাঞ্জাবীর সঙ্গে মানানসই চটি পড়েছে,তাই দূর্বলতা।হিসিয়ে উঠে সরে দাঁড়ালো।

– বেটি মানুষ বলে ছেড়ে দেবো ভেবেছ নাকি?
আঙুলে পেঁচিয়ে ধরলো চারুলতার দীঘল কেশরাশি, হ্যাঁচকা টানে ভারসাম্য হারিয়ে হুড়মুড় করে নিহাদের বুকে ধাক্কা খেলো চারুলতা।ব্যাপারটা এমন হবে ভাবেনি বেচারা,সে সবসময়কার মতোই চুল টানাটানি খেলায় মেতেছিল।কিন্তু…. বর্তমানে হলো টা কি?নিদারুণ স্তব্ধতা ছেয়ে গেলো চারিপাশে।নিহাদ এবং চারুলতা উভয়ই সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়েছে।রোযা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।এরপর মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলো,
– বিয়ে আমার নাকি আপনাদের বোঝা বড়ই দায়!
– ইশ, ছিঃ!

ঘৃণার মনোভাব দেখিয়ে নিহাদকে এক ধাক্কায় দূরে সরালো চারুলতা। মার্সিডিজের দরজায় ধাক্কা খেয়ে দ্রুতকন্ঠে নিহাদ জানালো,
– আমার বয়েই গেছে!এই চুন্নি যদি পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে হিসাবেও অবশিষ্ট থাকে,সারাজীবন কুমার থাকবো তবুও এর দিকে ফিরে তাকাবোনা!জলজ্যান্ত একটা টাইমড ব*ম্ব!
– আমারও যেন খেয়েদেয়ে কাজ নেই!সারাজীবন কুমারী থাকবো তবুও তোমার মতন একটা চ্যাংড়া ব্যাটার বাড়ির বাউন্ডারির কাছেও ঘেষবো না!

– ছিঃ ছিঃ, নির্লজ্য মেয়েমানুষ, ঘেঁষাঘেষির আলাপ করে,ওয়াক থু!
নিহাদের ভঙ্গিমা লক্ষ্য করে না হেসে টেকা দায়।রোযা মুখে হাত চেপে হাসতে থাকলো।
– ডিয়ার কনেযাত্রীগণ।আমরা কি বিবাহের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করতে পারি?নাকি বিবাহের সময় আগামীকাল পর্যন্ত বর্ধিত করবার সুযোগ সুবিধা রয়েছে?
গাড়ির জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে উচ্চকন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো ফারিয়া।তাতে যেন সবার হুশ হলো।
– আরে তাইতো,ড্যাড ফোনের উপর ফোন দিয়ে চলেছে।এক ইবলিশের সহচরের পাল্লায় পড়ে ভুলেই গিয়েছিলাম।
– ইবলিশটা তাহলে তোমার ভাইকে বলা হলো না?
চারুলতার দুটো চপাট পড়লো পিঠের উপর,তবুও নির্বিকার নিহাদ দরজা খুলে গাড়িতে উঠলো।ড্রাইভিং সিটে বসে রোযার দিকে ফিরল,

– উঠুন গর্জিয়াস ব্রাইড,আপনার কনেযাত্রী তৈরি।আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার বরযাত্রী হিসাবে কামলা দিতে যেতে হবে।আমার জীবনটা পুরাই ঝিংকু ব্র্যান্ডের পিংকি বদনা!
হাসতে হাসতে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসলো রোযা।সে মাঝখানে,দুপাশে ফারিয়া এবং চারুলতা।ফারিয়া জানালো,
– তোমাকে চমৎকার দেখাচ্ছে রোযা,একটা মিষ্টি বধূ।
নতুন বউয়ের সহজাত লজ্জায় রাঙা হলো রমণীর কপোল।
– ধন্যবাদ বস।আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে আসার জন্য।
– আরে কিসের বস?আজকে আমি তোমার বস টস নই।আজ আমি কনেপক্ষের সাক্ষী,তোমার বান্ধবী।
চোখ টিপ দিয়ে মৃদু হাসলো ফারিয়া। চারুলতার সঙ্গে হাত মেলালো কৌতুক ভঙ্গিতে।দুই বান্ধবীর যেন খুশির বাঁধ ভেঙেছে।

– কনেযাত্রীগণ, দিস ইয ইওর ক্যাপ্টেন স্পিকিং। ফাসেন ইওর সিটবেল্টস….
নিহাদের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি সামান্য গতিতে সড়কে নেমে অতঃপর দুর্বার অশ্বের ন্যায় ছুটতে আরম্ভ করলো।গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাউন্ড বক্সজুড়ে তীব্র শব্দে বেজে উঠল,
~ ঠুমকা লাগালি রুপের বিজলি গিরালি
তোকে দেখে গাইছে এ মন রিমিক্স কাওয়ালি
জোহরা জাবি না তুই আনারকলি
তোকে দেখে গাইছে এ মন রিমিক্স কাওয়ালি~
দেবের গানের সঙ্গে সঙ্গে নিহাদের বেপরোয়া বেসুরো কণ্ঠের ঝংকার যে কারো মন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।অন্তত রোযার জন্য। চারুলতা এবং ফারিয়ার অভিব্যক্তি অবশ্য ভিন্ন।উভয়ই গাড়ির দুর্বার গতি নিয়ে চিন্তায় রয়েছে।বুকে ধুমধাম মিউজিকের বিট অনুভবে বিরক্তি ফুটেছে।

– কাকের মতন কা কা করছে দেখ দেখ ফারিয়া…
– তাইতো দেখছি।পুরোই আউট অব কন্ট্রোল পাবলিক!
এর জবাব এলো নিহাদের কন্ঠ এবং গানের লেখনীর মিশেলে,
~ দিল টা জ্বালালি, ভয়টা দেখালি
হালকা করে শুনিয়ে দেবো রিমিক্স কাওয়ালি~

– ভাইয়ার হবু বউ যদি বিয়ের আগে টপকেছে তাহলে ভাইয়া তোমায় জাহান্নাম পর্যন্ত তাড়া করে ছাড়বে নিহাদ!
চারুর ধমকে শুধু জিভ বের করে কৌতুক করলো চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান,তারপর যেই লাউ সেই কদু কার্যক্রম জারি রাখলো নিজের।এক মুহূর্তে কেউই নিজেদের রুখতে পারলোনা,খুশি আনন্দ এতটাই সংক্রামক। একে একে গান এবং কথোপকথনে যোগদান করলো সকল ভয়ডর ভুলে।সময়টা ভীষণ উপভোগ্য।কিছুই নেই,তবুও যেন অগণিত অনুভূতি খচিত রয়েছে এই সময়জুড়ে,যা বারবার ফিরে আসবেনা উপস্থিত মানুষগুলোর জীবনে।

সকলের মাঝখানে অতি যত্নে রক্ষিত মধ্যমণি হয়ে সকলকে পর্যবেক্ষণ করে গেলো রোযা।প্রত্যেকটি মানুষের আপন উচ্ছ্বাস তার হৃদয়ে দোলা দিয়ে গিয়েছে।না চাইতেও পরিবার হয়ে দাঁড়িয়েছে।এখনো মনে পড়ে,আসমানকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়ার ঠিক পরদিন নিহাদ কিভাবে হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছিল।আকুল আবেদনে জানতে চেয়েছিল সে আসলেই আসমানকে বিয়ে করছে কিনা!যখন রোযা নিশ্চয়তা দিলো,তখন বিনা কারণেই অশ্রুপাতে সিক্ত হয়ে উঠেছিল তার মুখ।অবশেষে!নিহাদের আপন বলে পরিচয় দেয়ার মতন মানুষটির জীবনে সুখ প্রজাপতিরা হানা দিয়েছিল,নিজ অনুভূতি দমিয়ে রাখতে পারেনি সে।রোযা ঠোঁটে হাসি চোখে জল নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল।সকল সুখ স্মৃতি স্মরণ করে তার অধর পুনরায় হাসির ধারায় উদ্ভাসিত হলো,জ্বলজ্বল করতে লাগলো নয়নজোড়া,অব্যক্ত ভালো লাগার অনুভূতিতে।এই প্রফুল্ল মুখগুলো সে সারাটা জীবন অবলোকন করতে চায়।

হযরত ফাতিমা কামিল মাদরাসা এবং এতিমখানার বাচ্চাগুলোর অন্তরে আজ ঈদের খুশির ছোঁয়া লেগেছে।এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। এতিমখানার শ দুয়েক সদস্যের প্রত্যেকের জন্য নতুন পোশাক, উপহারসামগ্রী এবং ভরপেট খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।ভবনের প্রাঙ্গণজুড়ে রান্নার প্রক্রিয়া চলমান।ছোট ছোট বাচ্চারা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে,আয়োজন পর্যবেক্ষণ করছে।শুক্রবার,সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় খুশির মাত্রা ছাড়িয়েছে।পরিবারহীন হয়েও সুবিশাল এক পরিবারের অংশ শিশুগুলোর অন্তরজুড়ে সীমাহীন খুশি।

এই আয়োজনের উপলক্ষ্য সম্পর্কে অবশ্য হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক এবং কর্মচারী ব্যতিত আর কারোরই জানা নেই।এই এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা, দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রেমান গ্রুপের অধিপতির বড়ো সন্তানের বিয়ে আজ।অভিজাত পরিবারগুলোর বিরাট বহিঃপ্রকাশের ঐতিহ্য এড়িয়ে রেমান পরিবার বেছে নিয়েছে একান্তই সাদামাটা এবং ব্যক্তিগত এক আয়োজন। উপলক্ষ্য নাহয় অজানাই রইলো,খুশি ভাগাভাগি করতে দোষের কিছু নেই।
এতিমখানার এলাকাটি বিস্তৃত।মূল প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের পিছনে বাসস্থান ও শিক্ষক কর্মচারীদের কোয়ার্টার।কিছুটা দূরে রয়েছে মাঝারি আকৃতির একটি মসজিদ।যাতে আশেপাশের এলাকাবাসীও জুমাবারে নামাযে অংশ নেয়।বাকি অংশ মোটামুটি খালি।যেখানে গড়ে উঠছে আরও শ খানেক বাচ্চার থাকার জন্য নতুন এক ভবন।দুইতলা পর্যন্ত কাজ সমাপ্ত হয়েছে।বাকিটা চলমান।এই নতুন ভবনের ঠিক পিছনেই সড়কপথ,মূল সড়ক নয়।বিশেষ ব্যক্তিগণ ছাড়া কেউই এই যাতায়াতপথ ব্যবহার করেনা।আজ তাই ব্যবহার হচ্ছে।

সড়কের ধারে মার্সিডিজের ধারে অপেক্ষারত নিহাদ আর ফারিয়া।তাদের সঙ্গে রয়েছে মসজিদের হুজুর এবং কাজী সাহেব। উকিলও এসে পৌঁছেছেন সামান্য আগেই।শুধুমাত্র মূল আকর্ষণের প্রতীক্ষা যেন সকলের।প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো দ্রুতই।সড়ক ধরে এগিয়ে এসে মৃদু ধ্বনি তুলে থামলো পোর্শে।প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে ধূসর বর্ণের পাঞ্জাবী পায়জামা পরিহিত বিলাল রেমান বের হলেন।তার সুদর্শন চেহারাজুড়ে খুশির ঝলক,গোঁফের নিচে অধরে লেগে রয়েছে বিস্তৃত হাসি।মাদ্রাসার শিক্ষক এবং হুজুর এগোতেই সকলের সঙ্গেই কোলাকুলি সারলেন।ততক্ষণে ড্রাইভিং সিটের দরজা খুললো।বাইরে পদক্ষেপ রাখলো আয়োজনের মধ্যমণি, অমানিশা।

সকলে খানিক বাকরুদ্ধ হয়েই পর্যবেক্ষণ করলো তাকে।শুভ্র শার্ট এবং কালো ফরমাল স্যুটে আবৃত তার অভিজাত বলিষ্ঠ অবয়ব। কোটের কাফে যুক্ত চিকচিকে দ্যুতি ছড়ানো কাফলিংক।মুখে মাস্ক।মসৃণ কেশরাশি কিঞ্চিৎ এলোমেলো। কৃষ্ণগহ্বরের নিগূঢ় দৃষ্টিতে ধরিত্রীর বুকে এক রহস্যময় অস্তিত্বের ন্যায় ঠেকছে উপস্থিতি।তবুও এই রহস্য ঠিক না চাওয়ার নয়।দ্রুত এগিয়ে গেলো নিহাদ,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে জড়িয়ে ধরলো।তার পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে আসমান বিড়বিড় করলো,

– কি হয়েছে?
– কিছু না।
– কাদঁছো?
– উহুম।আজ কান্নার দিন নয়,সুখের দিন।অল দ্যা বেস্ট আসমান ভাই,আমার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে।ডোন্ট বি অ্যাফরেইড,জাস্ট লিভ ইওর লাইফ ব্রো,ইউ ডিজার্ভ ইট!
প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টি নিয়ে হাসলো নিহাদ।তাকিয়ে রইলো আসমান,একদৃষ্টে।
– আমার মনে হয় খুব বেশি দেরী করা উচিত হবেনা।সকলেই উপস্থিত? কনেপক্ষের সাক্ষী?
– এইযে।
উকিলের কথায় হাত তুলে এগোলো ফারিয়া।
– বরপক্ষ?
– আমিও রয়েছি।
নিহাদ জানালো।কাজী সাহেব এক নজর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– পাত্রী কি প্রস্তুত?
– হুম।দুইতলার নতুন ঘরে রয়েছে।
নিহাদ জবাব দিতেই কাজী সাহেব বিলাল রেমানকে জানালেন,
– বেশ।তবে আমরা এগোই?আপনার পুত্রকে বলুন মসজিদে অপেক্ষা করতে।পাত্রীর সম্মতি নিয়ে আমরা তার কাছে যাবো।
বিলাল মাথা নেড়ে আসমানের দিকে এগোলেন।দুই কাঁধে হাত জড়িয়ে হেসে বললেন,
– গুড লাক বেইবি।

নিজের মাঝে এক অজ্ঞাত অনুভূতির উপস্থিতি টের পেলো আসমান, ঠিক ব্যাখ্যা করা যায়না তা।একটি ঢোক গিলে সম্মতি জানালো নীরবে।বিলাল এগোচ্ছিলেন,কিন্তু থমকালেন কি যেন মনে করে।নিজের আস্তিনে হাত চালান করে ছোট্ট একটি চিরুনি তুলে সন্তানের পানে ফিরলেন।আসমানের খানিক এলোমেলো হয়ে আসা চুলগুলো অতি যত্নে আঁচড়ে দিয়ে ললাটে স্নেহ চুম্বন আঁকলেন।আর কিছুই উচ্চারণের দরকার হলোনা তার আপন অনুভূতি প্রকাশে।সকলে মুগ্ধতা নিয়ে অবলোকন করলো দৃশ্যটুকু।পিতার নিকট যেন ছেলে আজও সেই বাচ্চাটি রয়ে গিয়েছে,কে বলবে আজ তার বিয়ে?

সকলে নতুন ভবনের দিকে এগোতে এগোতে বাকিরা আসমানকে নিয়ে চললো মসজিদের দিকে।পথিমধ্যে একবার পিছন ফিরে চাইলো চাঁদ,যেন আপন জ্যোৎস্নার বধূ সাজে অবয়বখানা কল্পনা করে নিলো ক্ষণিকের জন্য।পরমুহুর্তেই পুনরায় আপন কাজে মনোযোগ দিলো।
অপরদিকে নতুন ভবনে পূর্ব হতে প্রস্তুত করে রাখা একটি কক্ষের সোফায় বসে প্রথমবারের মতন কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত বোধ করছে রোযা।ঠিক আতঙ্ক বলা উচিত নয়।বিয়ের পূর্বমুহূর্তে এক অবোধ্য অনুভূতি।হৃদস্পন্দন বিনা কারণেই বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে।শীতল আবহাওয়ায়ও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে, বারংবার মুছে নিচ্ছে টিস্যু দিয়ে। চারুলতা আশেপাশে পায়চারি করছে,সবকিছুর প্রস্তুতি যথাযথ হয়েছে কিনা পর্যবেক্ষণ করছে।অবশেষে একে একে কক্ষে প্রবেশ করলো সকলে।ছোট্ট দলটিকে দেখে বিনা কারণেই রোযার কন্ঠ শুকিয়ে এলো।নড়েচড়ে বসে দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে।

– হাউ বিউটিফুল!
বিলালের কন্ঠস্বর ধ্বনিত হলো সবার প্রথমে।রোযা দৃষ্টি তুলে চেয়েই লজ্জাবোধ অনুভব করলো শ্বশুরের প্রশংসায়।কাজী সাহেব বসে সকল কাগজপত্র ঠিক করতে করতে বিলাল রোযার একটি হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে হাসলেন,
– তোমাকে চমৎকার লাগছে মামণি।আজ আমি খুব খুশি।আমার অগোছালো ছেলেটাকে আপন করে নেয়ার জন্য তোমাকে যত ধন্যবাদই জানাই না কেনো কম হয়ে যাবে।
– এভাবে বলবেন না প্লিজ বাবা।
– আমি তোমাদের জন্য খুব খুশি হয়েছি মামণি,খুব খুব খুশি!
তা চেহারাতেই প্রকাশ পাচ্ছে বিলালের।মৃদু হাসলো রোযা।অবশেষে অমোঘ এক সম্পর্কের জালে বাঁধা পড়তে চলেছে সে।এবার কোনো মিথ্যা নয়,এক পবিত্র সত্যের বাঁধন!বহুদূর এগিয়েছে সে জীবনে।
সবকিছু প্রস্তুত।সকলে চারিপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।রোযার মুখোমুখি কাজী সাহেব।তিনি দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করতে আরম্ভ করলেন,

– মরহুম আরমান রহমানের কন্যা রোযা রহমান চড়ুই, আপনি বিলাল রেমানের সুযোগ্য পুত্র নীলাদ্রি রেমান নীলকে উনপঞ্চাশ লাখ টাকা দেনমোহরে আপনার স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে রাজী? রাজী হলে কবুল বলুন।
“ কবুল ”—
ছোট্ট শব্দটির মাঝেও যেন একরাশ অনুভূতিমালা খচিত রয়েছে।নিজের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পরিবারকে পরিত্যাগের বেদনা,নতুন এক পরিবারের মাঝে একাকীত্বের বশবর্তী হয়েও মানিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা,তার সঙ্গে স্বপ্ন মাখানো এক অভূতপূর্ব জীবনের সুত্রপাত।তাই হয়ত নারীরা শব্দটি উচ্চারণের ক্ষেত্রে গড়িমসি করে,মস্তিষ্ক এবং অন্তরের দোলাচলে অশ্রু নির্গমিত হয় নয়ন বেয়ে।অতঃপর সম্মতি।
কিন্তু রোযা শব্দটি উচ্চারণ করতে বিন্দুমাত্র সময় নিলোনা।উপস্থিত মানুষগুলোর অন্তরে পুষ্পমুকুল প্রস্ফুটিত করে মৃদু অথচ দৃঢ়চিত্ত কন্ঠে বললো,

– কবুল।
এই ছোট্ট শব্দটির আধাঁরে লুকায়িত বাণী….
—আমি প্রতিজ্ঞা করছি চাঁদ,তোমার অভিশপ্ত ভাগ্যকে মোকাবেলা করবো আমি।জানি, দূর্বল,ভঙ্গুর, নিঃস্ব আমি;তবুও তোমার তরে আপন অস্তিত্ব বাজি রাখতে কুণ্ঠাবোধ হবেনা কোনোদিন।শুধু তুমি আমার পাশে থেকো চাঁদ,একটুখানি সুখ আর ভরসা দিও। অমানিশাকে দীপ্তিতে দূরীভূত করবোনা, অতি যত্নে আগলে নেবো আপন বাহুডোরের উষ্ণ অনুভূতিতে। একা একা আর কেঁদোনা,এই ভালোবাসার কাঁধটিতে মাথা রেখো হৃদয়েশ্বর……
অতঃপর কাবিননামায় সাক্ষরিত হলো তার আপন অস্তিত্বের সমর্পণ।এক মুহূর্তের জন্য স্মরণে এলো সেই মুহুর্তের কথা,যেদিন গাড়িতে আসমানের পাশে বসে অতি অবহেলায় সে মিথ্যা সার্টিফিকেটে সই দিয়েছিল।কোনো পরোয়া ছিল না,কিন্তু আজ মানুষটির প্রতি অনুভূতি তার আকাশ সমান।কখনো ভেবেছিল কি ভাগ্য তাকে এই প্রান্তে এনে দাঁড় করাবে?
ঠিক মিনিট ত্রিশেক পর।মসজিদের মেঝেতে বসমান প্রত্যেকে।বাকরুদ্ধ নিহাদ,দৃশ্যপটে চেয়ে আপন হাত ঘষে চলেছে।সকলেই ব্যাতিব্যাস্ত চেয়ে আছে সামনে।পুনরায় একই প্রশ্ন ধ্বনিত হলো।

– বিলাল রেমানের পুত্র নীলাদ্রি রেমান নীল।আপনি কি উনপঞ্চাশ লাখ টাকা দেনমোহরের বিনিময়ে মরহুম আরমান রহমানের সুযোগ্যা কন্যা,রোযা রহমান চড়ুইকে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে রাজী? রাজী হলো কবুল বলুন।
নীরবতা।ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলো সকলের উদ্বেগ।বিশেষ করে নিহাদ এবং বিলাল রেমানের।আসমানের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অবগত।অন্তিম মুহূর্তে নিজের সিদ্ধান্তে পরিবদল ঘটাবে না তো সে! দৃশ্যমানভাবে মুষ্টিবদ্ধ হলো আসমানের দুহাত।স্পষ্টত একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো।দ্বিধা তার অবয়বজুড়ে খচিত যেন। দৃষ্টিজুড়ে এক অদ্ভুতুড়ে শীতলতা।নিজের চোখ বুজলো আসমান,শক্তি সঞ্চয় করতে যেন।ভাগ্য তাকে আরো একবার দাঁড় করিয়েছে অত্যন্ত সুতীব্র অনুভূতিপূর্ণ মুহূর্তের সামনে।অবোধ মস্তিষ্ক একবার চাইলো সবকিছু জোরালোভাবে উপেক্ষা করতে।পুনরায় অমানিশায় হারিয়ে যেতে।ঠিক তখনি বদ্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠলো অবয়বটি,এক স্নিগ্ধতাঘেরা রমণী,যে নিঃস্বার্থভাবে তার তরে লুটিয়েছে সবকিছু।বিনিময়ে সামান্য সুখটুকু কি তাকে দেয়া সম্ভব নয়?তাকে দূরে ঠেলতে কাপবে এই অন্তর,বিলীন হবে অস্তিত্ব।অন্তরের জোরালো ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো সমস্ত হিমালয়জুড়ে।

– কবুল।
“ —রক্ষা করবো, ভাগ্যের মুখোমুখি হবো,আপন সত্তার সঙ্গে লড়বো প্রয়োজনে বারংবার।কথা দিচ্ছি জ্যোৎস্না…..”
অবশেষে নির্গত হলো ছোট্ট অথচ পবিত্র শব্দটি।তড়িৎ গতিতে কাবিন নামায় স্বাক্ষরিত হলো পরিচয়।পাশে বসে থাকা বিলাল দৃষ্টি মেলে অবলোকন করলেন, আড়ালে মুছে নিলেন চোখে জমা অশ্রুর ফোঁটাসমূহ।সম্পন্ন হলো কার্যক্রম।দুটি অন্তর বাঁধা পড়লো পবিত্র এক বন্ধনে।এবার কোনো খাদ নেই,নেই কোনো মিথ্যার প্রলেপ,শুধুমাত্র নিখাদ সদ্য।
সকলে কোলাকুলি করে খুশি বিনিময় ঘটাতে ঘটাতে নিহাদ ঝাঁপিয়ে পড়লো আসমানের সামনে,দ্রুত তার মাস্কটি টেনে মুখে একটি খেজুর ঢুকিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো শক্তভাবে।

– আম সো সো সো প্রাউড অব ইউ ব্রাদার!
না পারতে হাসলো আসমান,পাল্টা আলিঙ্গন করলো নিহাদকে।এক প্রশান্তিময় আবেশ তার হৃদয়জুড়ে।অবশেষে সে সত্যিই বিবাহিত!দৃষ্টিতে জমা আবেগ রুখতে জোরপূর্বক নয়ন বুজে নিলো।এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নির্গত হলো বক্ষ থেকে,সে সফল হয়েছে।
শুকরিয়া মোনাজাতে অংশ নিলো আসমান সকলের সঙ্গে,নিজের সকল অকথ্য অনুভূতি নিঃশব্দে পৌঁছলো যেন সৃষ্টিকর্তার দরবারে।কি চাইলো সে?সামান্য একটু ভালো থাকার সুযোগ।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার কন্ঠ পরিষ্কার করলো আসমান।পিছন ফিরে বারবার চাইলো। নিচতলার সিঁড়ির কাছ থেকে সকলের কথোপকথনের শব্দাবলী ভেসে আসছে। দাঁতে অধর চেপে কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো।পরক্ষণে মাথা নেড়ে চিন্তাসমূহকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলো।ইতস্তত ভাব ঝেড়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।তার হৃদস্পন্দন থেমে থাকলো যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।সোফায় বসে থাকা নব বিবাহিতা স্ত্রীকে লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে বিকটভাবে হৃদযন্ত্র লাফিয়ে উঠলো।তবুও বাহ্যিক অবয়ব শান্তই দেখালো।যেন অটল পর্বত দন্ডায়মান আপন দৃঢ়তায়।

একা একা বসে কিছুটা বিরক্তই হচ্ছিল রোযা।সঙ্গে খানিক চিন্তা।সবকিছু আদতেই ঠিক রয়েছে তো?ঐদিকে আসমানের কি খবর?সামান্যতম সময়ের জন্যও সাক্ষাৎ হয়নি। কল্পনাশক্তিতে হৃদয়পটে আঁকিবুঁকি কেটে গেলো সে, হৃদয় অধিপতির এক কাল্পনিক চিত্র ফুটিয়ে তুললো তাতে।তার কল্পনা অতি সত্ত্বর বাস্তবে পরিণত হলো,দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখলো আসমানকে।কালো ফরমাল স্যুটে আবৃত তার অভিজাত অবয়বে নজর আবদ্ধ হলো না চাইতেও।অজান্তেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।মুখোমুখি হলো অনুভূতির….উহুম।
স্বামীর!

শিরশিরে তরঙ্গ খেলে গেলো শরীরজুড়ে।দৃষ্টিতে ভর করলো আবেগাশ্রু।ওই কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন ঘটালো নিজের।কেমন সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে অন্তরে। চাঁদের দৃষ্টিও আজ হার মানিয়েছে সকল মাধুর্য্যকে। নির্লজ্জ্বভাবেই পর্যবেক্ষণ করলো জ্যোৎস্নাকে, আপাদমস্তক।সামান্যতম লোকানোর চেষ্টা করলোনা অভিব্যক্তি,ওই দৃষ্টিতে ফুটলো অসীম মুগ্ধতা।
– আমার নয়নপটে তোমার অস্তিত্বের সুন্দরিমা অলৌকিক।
কণ্ঠটি হৃদ বালুচরে অনুভূতির জলোচ্ছ্বাস ঘটালো।অশ্রুর ফোঁটা মুক্তোদানার মতন গড়িয়ে নামলো কপোল থেকে।এগোলো ধীরে ধীরে। দূর্বার দেয়াল গুঁড়িয়ে সন্নিকটে এলো ভাগ্যের চক্রে আবর্তিত একজোড়া অপার্থিব অস্তিত্ব। নিগূঢ় কালো বর্ণের তোরণে আবদ্ধ অমানিশা,এবং প্রশান্তিময় শুভ্রতার স্নিগ্ধতায় সিক্ত দীপ্তি। একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত, তবুও যেন এক সুতোয় গাঁথা।

ঝুঁকলো রোযা অতর্কিতে,নব্য বিবাহিত স্বামীকে সালাম করতে চাইলো।কিন্তু আসমানের দুবাহু তাকে থামিয়ে দিলো মাঝপথে।উত্তোলন করে হাতজোড়া আপন মুঠোয় পুরলো,ঠেকালো পাথরকঠিন প্রশস্ত বুকে।
– স্ত্রীর স্থান স্বামীর পদক্ষেপে নয় অন্তরজুড়ে।
কন্ঠটি শান্ত থাকতে দিলোনা। বজ্রঝড় তুললো হৃদয়াঙ্গনে।এগোলো রোযা,নিজেকে লুটিয়ে দিলো অমানিশার আলিঙ্গনে।খামতি রাখলোনা আসমানও, জড়িয়ে নিলো এক পশলা অনুভূতিকে,শক্তভাবে।রোযার অশ্রু তার শার্ট সিক্ত করলো ক্রমশ, বাঁধা দিলোনা,শুধু চোলির উপর আলতোভাবে হাত বুলিয়ে গেলো।তার কোমরে জড়ালো বিবাহিতা স্ত্রীর বাহু, আঁকড়ে ধরলো তাকে আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে।বিড়বিড় করলো,

– আমার চাঁদ…
– বলো জ্যোৎস্না।
নমনীয় কন্ঠস্বরটির জবাব ভেসে এলো তৎক্ষণাৎ।সামান্য কাপলো রোযা,অনুভূতির গাঢ়ত্বে।আবারো শুধালো,
– চাঁদ…
– জ্যোৎস্না…
– চাঁদ?
– হুম?
– আমার চাঁদ….
– বারবার চাঁদ বলে ডাকছো কেনো?
মুখ তুললো রোযা, উপরে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত হাসিমাখা অধরে জানালো,
– তুমি জ্যোৎস্না ডেকে উত্তর করছো, বারবার শুনতে ইচ্ছা করছে।

তাকিয়ে থাকলো আসমান ওই তারকাখচিত নয়নজুড়ে,অনুভব করলো তার নয়নজোড়াও ক্রমশ সিক্ত হয়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে।এই রমণী তার অটল হিমশীতল হিমালয়কে এক লহমায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে, দূর করেছে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বকে।
অবশেষে সত্যের পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ তারা,এই পথচলা আজীবনের।আপন আপন প্রতিজ্ঞায় প্রত্যেকেই বলীয়ান।মোকাবেলা করবে ক্রুর ভাগ্যের, একসঙ্গে, হাতে হাত মিলিয়ে।রক্ষা করবে একে অপরকে,আপন আলিঙ্গনের মাঝে। দীপ্তিময় না হোক, অমানিশায় ছেয়ে যাক জীবন।তবুও, একে অপরের শক্তি হয়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতেও যেন কোনো ভয় নেই।

ডার্কসাইড পর্ব ৩৮

প্রতিশ্রুতিস্বরুপই যেন আসমানের ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে একে একে আবদ্ধ হলো রোযার আঙুলসমূহ।কপালে ঠেকলো কপাল। বুজে এলো নয়নজোড়া। দরজার পিছন থেকে দৃশ্যটি লক্ষ্য করতে থাকা নিহাদ, চারুলতা এবং বিলাল হাসিমাখা ঠোঁটে নিঃশব্দে দরজা চাপিয়ে বিদায় নিলো খুশিমনে।
আজ অমানিশা সমর্পণ করেছে নিজেকে দীপ্তির দুয়ারে।কোন মহাকাব্যের সূচনা ঘটাবে এহেন আত্মসমর্পণ?পুনরায় বিচ্ছেদ,নাকি এক ভালোবাসাময় উপাখ্যান?

ডার্কসাইড পর্ব ৪০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here