ডার্কসাইড পর্ব ৪৩
জাবিন ফোরকান
গতকাল রাত:-
মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমি হল ১
প্রত্যেকটি হলে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের গ্রুপভিত্তিক পড়াশোনা এবং আলোচনার জন্য পাঠকক্ষ রয়েছে।যাতে ডেস্কটপ সুবিধাও বিদ্যমান।কম্পিউটারের সামনে বসে প্রেজেন্টেশন তৈরিতে ব্যাস্ত সময় অতিবাহিত করছে অহনা।স্ট্যান্ডে ঠেকিয়ে রাখা ফোনখানায় চলছে ভিডিও কল।
– হ্যাঁ,এবার নিচে দেখো ফাইলের মতন একটা আইকন, ওটাতে প্রেস করলে সব ঠিকঠাক হবে।আর পয়েন্ট কয়টা নিয়েছ?
– পাঁচটা।
– আরো দুটি বাড়িয়ে সাতটা মতন নাও।বেশিরভাগ পাঁচটাই নেবে।আমি আটটা নিয়েছি।
– ঠিক আছে, রোযা আপু।
প্রায় ঘন্টাখানেক সময় প্রয়োজন হলো সম্পূর্ণ প্রেজেন্টেশন প্রজেক্ট সমাপ্ত করতে।চেয়ারে এলিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ব্যাস্ত অহনা ফোনের দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে ফেললো,সঙ্গে ওপাশে অপেক্ষমাণ রোযাও।
– থ্যাংক ইউ রোযা আপু।ইউ আর দ্যা বেস্ট!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– হয়েছে হয়েছে।আগামীকাল রাব্বি চাচার ভেলপুরি চাই কিন্তু!
– আরে অবশ্যই অবশ্যই,নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দেবো তোমাকে।শুধু বিলটা তুমি দিও।
– হাহাহা….তুমি তো বেজায়… হুম?কিছু লাগবে?
স্ক্রিনে দেখা গেলো রোযা মাথা তুলে ভিন্নদিকে চেয়ে আছে,তার রুমে বোধ হয় অন্য কেউ এসেছে।অহনা আগ্রহভরে অপেক্ষা করলো। রোযা তার সঙ্গেই কথা বলতে ব্যাস্ত,
– না আমি নেইনি,নিহাদকে দিয়েছ নাকি?
“নিহাদ”— নামটা শুনতেই কেমন যেন অনুভূত হলো অহনার।বিনা কারণেই উষ্ণতায় ছেয়ে গেলো তার অস্তিত্ব।আজকের দিনটা তার জীবনের অন্যতম সেরা দিন হিসাবে ইতোমধ্যে হৃদয়মাঝে স্থান করে নিয়েছে।বাইকে বসা হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটির নিষ্পাপ মুখাবয়ব স্মরণে আসতেই অহনার ঠোঁটজুড়ে মিষ্টি হাসির ধারা ছড়িয়ে পড়ল।রোযার কন্ঠে তার ভাবনার জগতে বিচরণের সমাপ্তি ঘটলো।
– কি ব্যাপার?কোথায় হারিয়ে গেলে?এমন একা একা হাসি তো ভালো লক্ষণ নয়!
– না না রোযা আপু,তেমন কিছুনা।এহেম…তোমার উল্টোপাশে কে?ভাইজান?
হাসলো রোযা,মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
– হুম।আমাকে এখন যেতে হবে।তোমার ভাইজান ওনার সাধের হুডি খুঁজে পাচ্ছে না।বউয়ের থেকে হুডির মূল্য বেশি,খুঁজে দিয়ে আসি।
– হাহাহা… যাও যাও।বিবাহিত জীবন মুবারাক হ্যায়!
– তুমিও যাও,রাত কয়টা বেজেছে খেয়াল আছে।গিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতন খানিকটা দানাপানি হজম করে লম্বা একটা ঘুম দাও।আগামীকাল ফিল্ড ট্রিপ আছে কিন্তু।
– হ্যাঁ আপু,গুড নাইট।
– গুড নাইট বাবু।সি ইউ টুমরো।
ভিডিও কল সমাপ্ত হলো।তারপরও ফোনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো অহনা।রোযা মেয়েটি ঠিক যেন নিজের ছোট বোনের মতন করে আগলে রাখে তাকে।র*ক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও কাউকে এতটা আপন অনুভূত হতে পারে অহনা এর পূর্বে কোনোদিন উপলব্ধি করেনি।নিজের সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সে যখন ফিরতি পথ ধরেছে রুমের উদ্দেশ্যে তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছাড়িয়েছে।এমনিতেই আজ হল খানিকটা ফাঁকা,ভার্সিটিতে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের কিছু প্রোগ্রাম চলছে।সেখানেই যোগদান করেছে সকলে।অহনার মতন গুটিকতক পড়ুয়া বোধ হয় রয়ে গিয়েছে,কিংবা যারা খুব আলসি,ইতোমধ্যে কম্বল তুলে ঘুম দিয়েছে অথবা পপকর্ন এবং নেটফ্লিক্স নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।
করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিন তলায় পৌঁছলো সে, চতুর্থ তলায় তার কক্ষ।আবছা আঁধারখচিত করিডোর বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কি যেন মনে করে হাতের ফোন খুললো।গ্রীক গড —নামে সেইভ করা নাম্বারটিতে ছোট্ট একটি মেসেজ করলো,
“ হ্যালো ”
অহনাকে সম্পূর্ণ স্থবির করে দিয়ে রীতিমত তড়িৎ গতিতে রিপ্লাই ভেসে এলো।
“ লেডিফিঙ্গার?”
থমকে গেলো মেয়েটি,অনুভব করলো বিনা প্রয়োজনে তার হৃদযন্ত্র উন্মাতাল ঝোড়ো গতিতে স্পন্দিত হতে আরম্ভ করেছে।কি বোর্ডের উপর আঙুলগুলোতে সামান্য কম্পন তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে।
“ এত রাতে অনলাইনে কি?”
“ একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি।”
“ প্রেজেন্টেশনের কাজ ছিল।”
“ আমিও দেবের মুভি দেখছি, মন মানে না।এটা শেষ হলে প্রেমের কাহিনী দেখব।”
“ রাত জাগা ভালো না।ঘুমান।”
“ রাত বিরাতে মেসেজ করে অন্তর্জ্বালা ধরিয়ে এখন ঘুমান বলাটা কি নতুন ট্রেন্ড নাকি মেয়েমানুষের?”
মুখ টিপে হাসলো অহনা।এই পুরুষ এক ভিন্নরকম ব্যক্তিত্ব।সরাসরি হোক কিংবা ভার্চুয়ালি,তার স্বভাব চরিত্রের মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই।
“ অন্তর্জ্বালা?আমি কি আপনার প্রেয়সী নাকি যে সামান্য হ্যালোতে আপনার অন্তর্জ্বালা ধরবে?”
“ ছি ছি!কি নষ্টমার্কা কথাবার্তা! পোলাপানগুলো সব দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!মানলাম আমি একটু হ্যান্ডসাম,তাই বলে এমন গলায় ঝুলে যাওয়ার ধান্দা করতে হবে?”
“ আপনি বুঝি খুব বোঝদার গুরুজন?”
“ সামনে থাকলে মাথায় দুটো গাট্টা দিয়ে বুঝিয়ে দিতাম আমি কি!এখন ভাগো ভাগো,মুভিতে সুন্দর একটা গান এসেছে,একটু ডিস্কো ড্যান্স না করলে হয়না।”
“ এক্সক্লুসিভ ভিডিও দিয়েন কেমন?”
“ ৫০০০ সেন্ড মানি করো।এত সস্তা না!”
আরেক দফা আপনমনে হেসে অহনা ফিরতি মেসেজ পাঠাতে যাচ্ছিল,কিন্তু সম্ভবপর হলোনা।হ্যাঁচকা একটা টান খেলো হাতে, ফোনটা ছিটকে পড়লো মেঝেতে।এক লহমায় ভেঙে দুপাট হয়ে স্থির রইলো।কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করবার সুযোগ অহনার হলোনা।করিডোরের শেষ প্রান্তের কক্ষটির ভেতর তাকে টেনে নিয়ে ধপাস করে দরজা আটকে দেয়া হলো।
অভ্যন্তরের পরিবেশ অহনাকে সম্পূর্ণ বিহ্বল করে তুললো।প্রথমবার নিজের দর্শন ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস হলোনা তার।আদও সঠিক পর্যবেক্ষণ করছে কি তার নয়ন?তিনটি কক্ষের সমান জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই কক্ষটি।হলদে সোডিয়াম আলোয় উদ্ভাসিত স্থানজুড়ে কেমন অশুভ আবহ। তকতকে মেঝেজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বস্ত্রাদি।সুবিশাল দুটি বিছানার একটিতে স্বল্পবসনা দুই অচেনা রমণী উপুড় হয়ে রয়েছে,উভয়ের আঙুলের ফাঁকে ধোঁয়া নির্গমিত সিগারেট।একপাশে বসমান একটি ছেলে,অপরজন দন্ডায়মান জানালার নিকট।গভীর দৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে তারা অহনার উদ্দেশ্যে।হতবিহ্বল মেয়েটির পদক্ষেপে গড়িয়ে এলো দুটি কাঁচের বোতল।নিষিদ্ধ তরল তার ছড়িয়ে রয়েছে মেঝেজুড়ে,থকথকে এক কদর্যতা।সম্পূর্ণ আবদ্ধ স্থানটি উৎকট মাদকীয় গন্ধে এতটাই পরিপূর্ণ যে ফুসফুস শুদ্ধ বাতাসের আশায় হাসফাঁস করতে আরম্ভ করেছে।
শিরদাঁড়া বেয়ে এক আতঙ্কস্রোত প্রবাহিত হলো অহনার।তবুও ঢোক গিলে দুঃসাহসী মোকাবেলা করতে চাইলো পরিস্থিতি।তাকালো তার হাতটি টেনে ধরা পুরুষটির উদ্দেশ্যে।ঊর্ধ্বাঙ্গ তার অনাবৃত,ঘন পশমে আবৃত বুকখানায় পরিশ্রান্ত ঘামের ফোঁটা স্পষ্ট। মুখজুড়ে অমানবিক হিং*স্রতা,টকটকে নয়নে ঘোলাটে চাহুনি।জোরপূর্বক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল অহনা।
– জিশান ভাই!বিনা অনুমতিতে এমন অশোভন আচরণের অর্থ কি?
তাকিয়ে রইলো জিশান,একদৃষ্টে।যেন পিশাচ অপেক্ষারত উৎকৃষ্ট সুযোগের আশায়।অহনা চারিপাশে নজর বুলিয়ে বিড়বিড় করলো,
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসনকে ব্যক্তিগত ক্লাব বানিয়েছেন?নিষিদ্ধ সব দ্রব্যাদির ব্যবহার।ড্রা*গস করেন আপনি? মোটেও ভালো ব্যাপার নয়।আমি এক্ষুনি অভিযোগ দেবো কর্তৃপক্ষকে,আপনার বিরুদ্ধে।
তীর্যক হাসলো জিশান,অতি অমানবীয় ঠেকলো তা।অহনা মুহূর্তেই বিপদের আঁচ অনুভব করতে পেরেছে, এহেন কথাবার্তা তার সময়ক্ষেপন। সুযোগমতন উল্টো ঘুরে দরজার হ্যান্ডেল আঁকড়ে ধরতেই তার ঘাড়ে খপ করে বসলো জিশানের শক্তিশালী হাত।এক ঝটকায় টেনে আছড়ে ফেললো তাকে মাটিতে।যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠতেই জিশান অশ্রাব্য গালমন্দ উচ্চারণ করে বললো,
– শা** বে**! দেমাগ দেখাস আমাকে?আমিও দেখব কত তেজ ভরা এই শরীরে!তোর ওই দেমাগ যদি আমি আজ না ভেঙেছি তবে আমার নাম জিশান আহসান না!
হন্যে হয়ে আশেপাশে চেয়ে একটি ক্রিকেট ব্যাট নজরে এলো।সিজন ব্যাটটি ভীষণ কঠিন।সেটির হ্যান্ডেল ধরে টেনে এনে কেউ কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া করবার পূর্বেই সজো*রে অহনার শরীরে আ*ঘা*ত হা*নলো জিশান। একটিমাত্র ঘা*তেই কপাল ফে*টে র*ক্ত ঝ*রলো। থামলোনা পা*শবিকতা, চললো একের পর এক আ*ক্রমন।দুহাতে ব্যাটের র*ক্তা*ক্ত প্রান্ত আঁকড়ে ধরে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলো অহনা, তথাপি সম্ভব হলোনা।জানো*য়ারের মস্তিষ্ক দখলে নিয়েছে আসক্তি।আশেপাশের মানুষগুলোর মাঝে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই,ওই একই ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।একজন ফ্রিজ থেকে নতুন একটি বোতল বের করে আনলো,গ্লাসে ঢালার প্রয়োজনবোধ না করেই চুমুক দিয়ে চেয়ে রইলো দৃশ্যপটে।
অহনার সমস্ত দে*হ রীতিমত ভে*ঙেচুরে থমকালো জিশান।বিভীষিকার হাতিয়ার ব্যাটখানা ছুঁড়ে ফেললো দূরে।পা দিয়ে চেপে ধরলো গ্রী*বা,হিসিয়ে উচ্চারণ করলো,
– কর্তৃপক্ষ?দেখি আজ কোন কর্তৃপক্ষ তোকে রক্ষা করতে আসে!এই পুরো ভার্সিটি আমার ক্ষমতার গোলাম,বুঝেছিস?আজকে তোকেও বোঝাবো, গোলামের বিদ্রোহের শা*স্তি কেমন!
এক টানে অহনার র*ক্তমাখা ওড়নাখানি সরিয়ে একপাশে ছুঁড়ে দিলো জিশান।দুর্বলতায় বাঁধা দেয়ার প্রচেষ্টা সম্ভবপর হলোনা।ঝাপসা হয়েছে দৃষ্টি,টনটন করছে ম*গজ।গলা ছেড়ে চিৎকার দিতে চাইলো অহনা, সম্ভবপর হলোনা। পাশবিকতায় মাতলো সম্পূর্ণ দলটি।একজন মেঝে থেকে এক রমণীর পরিধানের টপখানা তুলে গুঁজে দিলো অহনার মুখে, যাতে গোঙানি ব্যতিত ভিন্ন কোনো শব্দ নির্গত হলোনা।অসহায় দৃষ্টিতে তাকে ঘিরে ধরা পা*ষণ্ডের দলের পানে চেয়ে থাকল অহনা।অদ্ভুত হলেও সত্য সামান্যতম অশ্রু ঝরলোনা তার নয়ন হতে।
এইকি ছিল তবে তার পরিণতি?খুব বেশি কিছু কি সে চেয়েছিল জীবনের কাছে?মা কে নিয়ে একটু ভালো থাকার স্বপ্ন ছিল তার,এটুকুই।অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কি খুব বড় ভুল করে ফেলেছে?গরীব হয়েও ক্ষমতার সম্মুখে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে ন্যায়ের জন্য লড়াই করার পরিণতি কি এহেন নৃ*শং*স মৃ*ত্যু?তাকে খু*বলে খু*বলে খা*বে এই প*শুরা,হয়ত সামান্যতম অংশও অবশিষ্ট রাখবেনা।কেউ কোনোদিন জানতেও পারবেনা হলের তৃতীয় তলার ৩০৭ নম্বর এই রুমে ঠিক কি হয়েছিল!তার মা খুব কাদবে,নিঃস্ব হয়ে পড়বে এই ধরিত্রীর বুকে।যে ভবিষ্যত হতে পারতো মধুর, তা পরিপূর্ণ হবে নিকষ কালো আঁধারে।আফসোস হচ্ছে কি?সেদিন জিশানকে ঐভাবে চড় না দিলেই ভালো হতো।কি দরকার ছিল গরীব হয়ে আত্মসম্মান ধরে রাখার?এই ধরিত্রী অর্থের সম্মুখে নতজানু,অর্থ প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতাকে।দরকার ছিল তার চুনোপুঁটি হয়ে রাঘব বোয়ালকে মোকাবেলা করতে চাওয়ার দুঃসাহস করার? হায় আফসোস!
নাহ!বিন্দুমাত্র আফসোস অনুভূত হলোনা অহনার। দৃঢ়চেতা এই ধ্বংসকাব্য যদি পুনরায় রচনা করার সুযোগ হতো তাহলে সে তাই করতো!কি হয়েছে গরীব হিসাবে জন্ম নিয়েছে তো? কিই বা হয়েছে তার পাশে দাঁড়ানোর মতন একটাও মানুষ নেই বলে?তাই বলে সে অন্যায় সয়ে যেতো চুপচাপ?গোলাম হয়ে সহস্র বর্ষ দাসত্ব করার তুলনায় প্রতিবাদী হয়ে আত্মসম্মান নিয়ে আত্মত্যাগের মহিমা অধিক নয় কি?হয়ত ইহকাল তার ব্যর্থ,কিন্তু পরকাল?এই পাষণ্ডগুলোর কি ক্ষমতা ওই খোদার বিচারকে রুখে দেয়ার!সৃষ্টিকর্তা মহা পরাক্রমশালী,তিনি ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।তার কাছেই নিজের সকল অব্যক্ত অভিযোগ পেশ করবে অহনা।এই বিশ্বজগৎ যদি তাকে সুবিচার নাও দেয়, অন্তিম বিচারের দিনের রায় ন্যায়ের পক্ষেই সাফাই গাইবে।
দৃষ্টি বুজে নিলো অহনা,একটিমাত্র আফসোস রয়ে গেলো তার….আম্মা।তার মা যেন ভালো থাকে,যেন তাকে দোষারোপ না করে,বুঝতে পারে তার অন্তরকে।
অহনার অন্তরে চলা ঘূর্ণিপাকের মুহূর্তে জানোয়ারের দল ব্যাতিব্যাস্ত আপন লালসা চরিতার্থ করতে। একে কি ঠিক লালসা বলেও অভিহিত করা যায়? জিশানের হাতে উঠে এলো ধা*রা*লো চা*পাতি,অতি যত্নে ভাস্করের মতন আপন জীবন্ত ভাস্কর্যে কা*টাকু*টি করে যেন নব্য শিল্প রচনা করে গেলো সে। কে*টে তুললো অ*ঙ্গ,জী*ব*ন্ত অবস্থাতেই!বাকিরাও থেমে নেই,তাদের অপবিত্র হাতের ছোঁয়া প্রবাহিত হয়ে চলেছে সর্বাঙ্গে।বহুদিন বাদে ক্ষুধার্ত প*শুর দল একটি মনমতো শি*কার পেয়েছে।
ভয়ং*করতম ব্যাপার হলো কক্ষে উপস্থিত রমণীদুজন দৃষ্টির সম্মুখে এহেন বিভীষিকা লক্ষ্য করেও সামান্যতম টললোনা।বরং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সাহায্যার্থে এগিয়ে এলো।তাদেরও আপন প্রাণের বিশেষ বাসনা রয়েছে, লালসার হয়ত নয়,কিন্তু ধূসরতা পূর্ণ পাশবিকতার।হাতের সিগারেটের ছেঁ*কা ঠেকালো অ*ঙ্গে অ*ঙ্গে, বেখেয়ালী বোতলের ঘা*তে উ*গ*ড়ে নি*লো দাঁ*ত!ঝটকা দিয়ে য*ন্ত্রণা ওঠা দৃষ্টিতে অনুভূত হলো ভীষণ মনোমুগ্ধকর!
প্রকৃতি আজ কাদলো কুয়াশা হয়ে।হায়রে দুনিয়া! সম অধিকারের তরে লড়াই করা এই নারীই যে অন্য নারীর নিকৃষ্টতম শত্রু!সুযোগ পেলে পিছপা হয়না আপন রূপ প্রদর্শনে।কি পুরুষ কি নারী!ভেদাভেদ নেই এই অন্যায় সমরে।ম্রিয়মাণ হলো ধরিত্রী স্বয়ং।ঘন অমানিশায় ছেয়ে ফেললো ব্রহ্মান্ড।চারিপাশে অমাবস্যার ভয়াল ছায়া।
ঠিক যে সময়ে একপ্রান্তে মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীরা ব্যাস্ত আনন্দ উদযাপনে ঠিক তখনি বিপরীত প্রান্তে রচিত হলো এক কলুষিত অধ্যায়। বর্ণনার ভাষাও যেখানে বিলীন।
একটা সময় প্রাণপাখি পরকালের যাত্রী হলো এক ভাগ্যের নিকট পরাজয় বরণ করেও বিন্দুমাত্র আফসোস না রাখা কঠোর চিত্তের রমণীর।রমণী সম্বোধনের মতন দে*হাং*শ ততক্ষণে অবশ্য অবশিষ্ট নেই।তবুও কি থমকালো হিং*স্র দা*নবগুলো?মোটেও না।জারি রইলো তাদের লীলাখেলা,মৃ*তদে*হের উপর!এ যেন এক ভিন্নরকম কামনার আস্বাদন!অভিশপ্ত রাত্রিজুড়ে শুধুমাত্র অশুভ পেঁচার ডাক শোনা গেলো, সঙ্গে সুনসান নীরবতা।তদুপরি সম্পূর্ণ তৃপ্তি পেলোনা তারা।এই মহা ধ্বং*সের প্রদর্শন প্রয়োজন।নাহলে গোলাম পুনরায় ক্ষমতাবান প্রভুর পানে চোখ তুলে চাইবে!ওই নয়নকে নির্বাসিত করা প্রয়োজন।
তাইতো শেষ রাতের দিকে বি*বস্ত্র বিদ্ধ*স্ত দে*হ*টি তারা ঝুলিয়ে দিলো রেলিংয়ে।দেখুক সকলে,দেখে শিক্ষা নিক,কি ফল প্রতিবাদের!
২১ শে জানুয়ারি
রেমান গ্রুপের কোম্পানিভবন
সম্পূর্ণ মিটিং কক্ষজুড়ে পিনপতন নীরবতা।কেউই কোনোপ্রকার বাক্য উচ্চারণে সমর্থ নয়।সকলের দৃষ্টি বিশালাকৃতির প্রজেক্টরের স্ক্রিনের পানে নিবদ্ধ।সুদীর্ঘ লম্বা টেবিলখানার অন্তিম প্রান্তে স্থির ভঙ্গিতে বসা আসমান চেয়ে আছে হাতের ফাইলের দিকে।দুইজন সেক্রেটারি দুপাশে দাঁড়ানো,নিস্তব্ধ অপেক্ষারত।
একটি নিঃশ্বাস নির্গত করে ফাইল বন্ধ করলো আসমান।সেটি টেবিলে রেখে কিছুক্ষণ নির্বাক থাকলো।অবশেষে শীতল কন্ঠে ব্যক্ত করলো,
– আমদানি দ্রব্যাদির উপর এমন অতর্কিত সরকারি শুল্ক বৃদ্ধির কারণ?আমার জানামতে এই শুল্ক পাঁচ পার্সেন্ট নির্ধারিত,শুধুমাত্র রেমান গ্রুপের জন্য আট পার্সেন্ট?ব্যাপারটা ঘোলাটে হয়ে গেলোনা?
– স্যার,কারণ দর্শানো হয়েছে যে রেমান এই মুহূর্তে দেশের সর্ববৃহৎ ব্যবসাসফল গ্রুপ,তাই অতিরিক্ত শুল্ক প্রদান বাধ্যতামূলক।
একজন কর্মচারী উত্তর করলো।আসমান নিজের কপালে তর্জনী ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ রইলো।তারপর বললো,
– গত মাসেও সরকারি বেসরকারি এবং বিদেশী, মোট তিনটি টেন্ডার নানান নিষেধাজ্ঞায় বেহাত করতে বাধ্য করা হয়েছে আমাদের।ডোন্ট ইউ থিংক দ্যাট দ্যা গবমেন্ট ইয অ্যাগেইনস্ট আয?
কেউ উত্তর করার সাহস করলোনা,দৃষ্টিপাত ঘটালো মেঝেতে।চেয়ারে হেলান দিলো আসমান,সিলিংয়ের উদ্দেশ্যে তাকালো।আপনমনে বিড়বিড় করলো,
– ব্যাপার নয়,তাদের খেলাধুলার ইচ্ছা পূরণ করা হবে।
বসের এমন বাক্যের অর্থ উদঘাটনে সকলে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় ঘটালো।উচ্চপদস্থ দুই একজন বাদে কেউই অমানিশার এহেন কথার অশুভ অর্থ ধরতে সক্ষম হয়নি।মিটিং জারি রাখার উদ্দেশ্যে দুজন প্রজেক্টর স্ক্রিনের উদ্দেশ্যে এগোচ্ছিল কিন্তু অতর্কিতে মিটিং কক্ষের দরজা খুলে যাওয়ায় স্থবির হলো সকলে।ফিরে চেয়ে দেখা গেলো বাহিরে দন্ডায়মান এক গার্ডকে।কিঞ্চিৎ উত্তেজিত কন্ঠে সে জানালো,
– সরি স্যার।
– এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে।পূর্বেই জানানো হয়েছে যেন কোনোপ্রকার ডিস্টারবেন্স না হয়।
বয়স্ক ধাঁচের ম্যানেজার কঠোর কন্ঠে জানাতেই গার্ড বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো আসমানের উদ্দেশ্যে,
– স্যার, ম্যাম এসেছেন।আমরা ওনাকে অপেক্ষা করতে বলেছি কিন্তু উনি রাজী নন।ওনার গার্ড জানালো….
সমাপ্ত করতে পারলোনা সে।পাশ দিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো রোযা।অনুসরণে হাবিব।খানিক বিরক্তি নিয়েই চাইলো উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ,কোনো জরুরী সময়ে এমন পারিবারিক হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।আসমান নিজেও তা পছন্দ করেনা,এর পূর্বে কোনোদিন কোম্পানি বিল্ডিংয়ে তার স্ত্রীর আগমন ঘটেনি।যদিও তার সদ্য বিয়ে সম্পর্কে সকলেই অবহিত।ব্যাপারটা কতিপয়কে খানিক কৌতূহলীও করলো।চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আসমান কিছু বলতে যাচ্ছিল মিটিং জারি রাখার উদ্দেশ্যে,কিন্তু রোযার অবয়ব লক্ষ্য করে থমকে পড়লো।
সম্পূর্ণ পাথরে পরিণত হয়েছে যেন সে। মুখখানায় অদ্ভুত এক হীনমন্যতা এবং উদাসীনতার মিশ্র অভিব্যক্তি।আপন ঘোরের মাঝে রয়েছে সে,জগতের কোন স্থানে অবস্থান করছে তা সম্পর্কে যেন বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত,শরীরে জড়ানো ওড়নাখানি দুহাতে জোরপূর্বক আঁকড়ে ধরে রেখেছে। চাবি দেয়া কলের পুতুল যেন।সামান্যতম স্পর্শেই বুঝি গুঁড়িয়ে যাবে।
– আউট….
বজ্রকণ্ঠের আদেশে সকলে স্থির হয়ে পড়লো।আসমান বাকিদের উদ্দেশ্যে তাকালো,এবার সুস্থির কন্ঠে নির্দেশ দিলো,
– মিটিং ইয পোস্টপোন্ড,এভরিওয়ান স্টেপ আউট প্লীজ।
একে একে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো সকলে। শৃংখলিতভাবেই পরিত্যাগ করলো মিটিং রুম,এমনকি গার্ড আর সেক্রেটারিগণও।হাবিব বের হওয়ার পূর্বে দরজা আটকে দিলো।সম্পূর্ণ বিস্তৃত কক্ষজুড়ে বর্তমানে শুধুমাত্র রোযা এবং আসমান।
নিজের পাশে একটি চেয়ার টেনে নিলো আসমান, উদ্দেশ্য রোযা।রমণী এগোলো ঠিকই,কিন্তু পাশের চেয়ার এড়িয়ে সোজা আসমানের সামনে থমকালো, এক মুহুর্ত চেয়ে থাকল,অতঃপর গুটিশুটি দিয়ে বিড়ালছানার ন্যায় চেপে বসলো তার কোলে।দুবাহু জড়িয়ে মাথা গুজলো প্রশস্ত কঠিন বক্ষমাঝে।নিশ্চুপ থাকলো আসমান,যেন হিসাব করে নিলো পরিস্থিতি। পরমুহুর্তে অর্ধাঙ্গিনীকে আপন সুরক্ষিত বাহুডোরে আগলে নিয়ে পিঠে ভরসার হাত বুলিয়ে নমনীয় কন্ঠে শুধালো,
– কি হয়েছে?
নীরবতা।
– রোযা?
ডুকরে কেঁদে উঠলো অর্ধাঙ্গিনী,আসমানের বুকে আরো গভীরভাবে আড়াল করলো নিজেকে। আঁকড়ে ধরলো তার পরিধানের শার্টখানি, অধরে অধর চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো তবুও সম্ভবপর হলোনা।রোযার এমন অবস্থা আসমানকে বিচলিত করে তুললো।এক বাহুতে তাকে জড়িয়ে অপর হাত ঠেকালো মাথায়, ধীরে ধীরে বুলিয়ে যেতে থাকলো স্নেহ।কিছু জিজ্ঞেস করলোনা।তথাপি রোযার ভগ্ন কন্ঠস্বর যেন আর নিকট অভিযোগ জারি করতে থাকলো।
– মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয়? পাশবিকতাও এভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হয়?
আসমান কিছুই উচ্চারণ করলোনা।শুধু শুনে যেতে থাকলো একমনে।অভিযোগ করতে দিলো,আপনাকে উজাড় করে সবটা প্রকাশ ঘটাতে দিলো।
– এমন যন্ত্রণাদায়ক মৃ*ত্যু কেনো?এই নৃশং*সতা কেনো?আঙুল ভে*ঙে দিয়েছে,চো*খ তু*লে নিয়েছে, চা*ম*ড়া চেঁ*ছে তু*লেছে!মাথার খু*লি গুঁ*ড়িয়ে দি*য়েছে,এরপর…. অঙ্গগুলোও কে*টে ফে*লে রে*খেছে!
রোযার কান্নার দমক বৃদ্ধি পেলো।আসমানের অনুভূত হলো যেন তার হৃদয়মাঝে জোরালো এক তরঙ্গ খেলে গিয়েছে।রোযা ঠিক কি সম্পর্কে কথা বলছে সে অবগত নয়,কিন্তু এমন বেদনাদায়ক পীড়া তাকে আক্রান্ত করতে আরম্ভ করেছে।রোযার মুখ নিজের বুকে চেপে আসমান মৃদু কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– আর বলতে হবেনা,আমি বুঝতে পেরেছি।
– ওরা…ওরা ওর লা*শটাও…
– হুশ।আমি আছি,কিছু হবেনা।এইযে আমি আছি তোমার কাছে।
রোযা নিঃশব্দে কেঁদে গেলো।আসমান তাকে কি হয়েছে,কেন হয়েছে,তার কান্নার কারণ কিছুই জিজ্ঞেস করলনা।শুধু চুপচাপ নিজের ভরসার বাহুডোরে আগলে রাখলো জ্যোৎস্নাকে।একটা সময় রোযা থামলো,মুখ তুলে তাকালো আসমানের দিকে।
– পানি খাবে?
মাথা দোলালো রোযা।আসমান টেবিল থেকে পানির বোতল তুলে ক্যাপ খুলে রোযাকে দিলো।নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে তার সিক্ত চেহারা মুছে নিলো।পানি খাওয়া শেষ হতেই ললাটে আলতো চুমু এঁকে আসমান জানালো,
– আমার কেবিনে বসো।বাসায় নিয়ে যাব,ঠিক আছে?
শিশুসুলভ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো রোযা।আসমান মেসেজ করতেই বাহির থেকে একজন মেয়ে কর্মচারী ভেতরে প্রবেশ করলো, রোযাকে ধরে সাবধানে নিয়ে গেলো বাহিরে।সম্পূর্ণ কক্ষ ফাঁকা হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠলো আসমান।টেবিল ঘেঁষে দেয়ালের সামনে এসে থমকালো।সচ্ছ সীমানার ওপাশজুড়ে সমস্ত নগরী যেন দৃশ্যমান, ব্যাস্ত সকলে আপন পরিক্রমায়।টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে দুহাত পকেটে ভরে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো আসমান।কিছুক্ষণের মাঝেই মৃদু পদশব্দ শোনা গেলো,সামান্য মাথা কাত করে চাইতেই হাবিবকে টানটান শিরদাঁড়ায় দন্ডায়মান লক্ষ্য করা গেলো।
– রিপোর্ট।
শুধুমাত্র একটি শব্দই উচ্চারণ করলো অমানিশা, প্রতিধ্বনির জোয়ার তুললো তা সমস্ত কক্ষজুড়ে।
সময় নামক সোনার হরিণ কারো জন্য কখনো থমকে থাকেনা।সে প্রবাহমান স্রোতস্বিনীর ঊর্মীমালার ন্যায়।২১ শে জানুয়ারি পেরিয়ে ধরিত্রী পদার্পণ করেছে ২৪ শে জানুয়ারিতে।গোটা তিন তিনটে দিন অতিবাহিত হয়েছে কলুষিত ধরিত্রীতে।কিন্তু সেই কদর্যতার চিন্তা কয়জনের?কারো কিছু এসেছে গিয়েছে? হ্যাঁ, সামান্য অন্তর কেঁপেছে অবক্ষয়ের প্রমাণে।কিন্তু ক্ষমতার জোরে যে সবটুকু লোপাট হয়েছে তা?অহনার যে শ*রীর প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তা পো*স্ট মর্টেম পর্যন্ত করার সুযোগ দেয়া হয়নি!অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে,কোথায় তার ঠিকানাটুকু পর্যন্ত নেই কারো নিকট।বেওয়ারিশ?অহনা?কই?তার তো পৃথিবীজুড়ে এক জন্মদাত্রী ছিল!মেয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশা হারিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষার আঁচল বিছিয়ে ঘুরেছেন মা,কিন্তু তার সন্তানের খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।কর্তৃপক্ষ হতে আরম্ভ করে শিক্ষার্থী,সকলের মুখেই ক্ষমতার কুলুপ এঁটে দেয়া হয়েছে।
রোযা এই কয়েকদিন ক্লাসে যায়নি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে সে কিছুটা,এমন একটিও রাত যায়নি এই পর্যন্ত যে সে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেনি।অহনার সঙ্গে তার বন্ধন হয়ত খুব বেশি দৃঢ় নয়,অল্প কিছুদিনের পরিচয়,কিন্তু সম্পর্ক তো এক প্রকার বোনসুলভ।যদি অহনার স্থানে ভিন্ন কোনো নারী হতো, তবুও এহেন বর্বরতা মেনে নেয়ার মতন পাষাণ হৃদয় রোযার এখনো তৈরী হয়নি।আসমান ছিল তার পাশে।রোযা নিজে মুখ ফুটে অহনা সম্পর্কে কিছুই বলেনি তাকে,কিন্তু তার স্বামী যে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয় সম্পর্কেও অবহিত সে খুব ভালোভাবে জানে। বিষয়টির প্রতি খুব একটা আগ্রহ আসমান প্রদর্শন করেনি,সে স্বাভাবিক।তবুও রোযার অতিরিক্ত যত্নে সে কোনো খামতি রাখেনি।দুঃস্বপ্নের কারণে জেগে গেলে আসমানও সারারাত তাকে আগলে নিয়ে বসে থাকে, সামান্যতম খেদের অভিযোগটুকু পর্যন্ত করেনা।শুধু একটাই কথা বলে,
– সব ঠিক হয়ে যাবে।
গতকালই একজন মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের চিন্তা রোযার নিকট পরিষ্কার করেছে আসমান।কিন্তু রোযা কিছুই বলেনি,নিজেকে নিজেই গুছিয়ে নিতে ইচ্ছুক সে।হয়ত আসমান ঠিকই বলেছে।ক্ষমতার জোরে ধামাচাপা দেয়া এক বর্বরতম অধ্যায়ের ইতি এখানেই।সময়ের পরিক্রমায় অহনা নামক অস্তিত্ব মুছে যাবে মানুষের অন্তর হতে।কিন্তু দগদগে ঘা?তার কি কোনো মেরামত হবে?
আজ চতুর্থদিন পুনরায় ভার্সিটিগামী হয়েছে রোযা।কিছুটা বারণ ছিল,কিছুদিন পড়াশোনা থেকে দূরে থাকা শ্রেয়।তবুও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন উঠেপড়ে লেগেছে পরিবেশ স্বাভাবিক করে তোলার জন্য।প্রত্যেকটি ভার্চুয়াল গ্রুপে ইতোমধ্যে নোটিশ প্রকাশ করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে কোনো ছাত্রছাত্রী যদি এই বিষয়ক আলোচনায়ও জড়িত থাকে তাহলে তাকে বহিষ্কার করা হবে।নব উদ্যমে প্রারম্ভের আশায় ক্লাস পরীক্ষা আরম্ভ করা হয়েছে যদিও তা আদতে আগামী মাসে নেয়ার কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে গাড়ি থামতেই নিচে নেমে চারিপাশ নির্বিকার এক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো রোযা।সবকিছু একইরকম আছে।শিক্ষার্থীদের যাতায়াত,কলকাকলি মুখর ক্যাম্পাস,কর্মচারী শিক্ষকদের কর্মব্যস্ততা।হায়রে পৃথিবীবাসী!এত স্বাভাবিক তারা?যেন কোনোদিন কোনোপ্রকার পাপাচারের চিহ্নটুকু পর্যন্ত পড়েনি এই প্রাঙ্গণে!একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো রোযার বক্ষ থেকে।ভাবলো, কিভাবে আরো কয়েকটি বছর সে অতিবাহিত করবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামক কারাগারে!
পায়ে পায়ে নিজের ক্লাসে পৌঁছতেই রোযা এক নজর থমকালো।উপস্থিত সহপাঠীরা সকলেই তার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে চাইলো।যদিও কিছুই উচ্চারণ করলোনা,তবুও তাদের নয়নজুড়ে মিশ্রিত বিষাদরেখা স্পষ্ট।এখানে অহনা সম্পর্কিত যেকোনো আলোচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।উঠলো রোযা, প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে পায়ে পায়ে পৌঁছলো সবচেয়ে উঁচু প্রান্তে।নিঃশব্দে বসে পড়ল।অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের খবর অজানা,তবে বিশেষভাবে সমগ্র জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টজুড়ে তীব্র শীতলতার আবহ।শিক্ষার্থীগণ সম্পূর্ণ সুস্থির,কারো মুখেই কোনোপ্রকার হাসি নেই।কেমন যেন গুমোট পরিবেশ।
নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সবকিছু হলো।প্রফেসর এলেন।ক্লাস টেস্টের উদ্দেশ্যে সকলকে পেপার বণ্টন করা হলো।সবকিছু এতটাই স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে যে তা রীতিমত হাসফাঁস ঠেকছে।নিজের পেপারে নাম লিখতে গিয়ে রোযা অনুভব করলো তার হাত কিঞ্চিৎ কাপছে।জোরপূর্বক হৃদয়কে শাসিয়ে সে লিখলো।প্রফেসর পোডিয়ামে উঠে এলেন।দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন,
– পরীক্ষার পূর্বে সবার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ ঘোষণা।
নজর তুলে প্রত্যেকটি দৃষ্টি আবদ্ধ হলো মহান শিক্ষকের উদ্দেশ্যে।সামান্য কন্ঠ পরিষ্কার করে পঞ্চাশোর্ধ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রফেসর জানালেন,
– আমাদের অ্যাকাডেমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে।তোমাদের শিক্ষাবর্ষ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।সামনে প্রেজেন্টেশন,ফার্স্ট টার্ম,ফিল্ড ট্রিপ সবই আসন্ন।কিন্তু জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের কতিপয় শিক্ষার্থীকে উশৃঙ্খলতা প্রদর্শন করতে দেখা যাচ্ছে।বিশেষ করে গোপন টেলিগ্রাম গ্রুপ বানিয়ে তাতে অপ্রীতিকর ঘটনা সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হচ্ছে এমন খবর রয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে।
থামলেন তিনি,সকলের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করলেন।তারপর বললেন,
– তাই জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের সকলকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে।তারা যেন কোনোপ্রকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে জড়িত না থাকে।এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে বিনা বাক্যে বহিষ্কার করা হবে তাকে।
পিনপতন নীরবতা।প্রত্যেকের মুখজুড়ে ফুটে ওঠা আক্রোশ পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রফেসর কিঞ্চিৎ বিব্রতবোধ করলেন।কণ্ঠের সুর পাল্টে নমনীয় কন্ঠে বললেন,
– দেখো বাচ্চারা,তোমরা আমার ছেলেমেয়ের বয়সী।আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি চাইনা।তাই আমার উপদেশ থাকবে তোমরা নীরব থাকো।নিজেদের কাজে নিজেরা মনোযোগ দাও।পড়াশোনা করো।এটুকুই যথেষ্ট।তোমাদের বুঝতে হবে ওরা ক্ষমতা, এই ক্ষমতার কাছে কর্তৃপক্ষও জিম্মি।
আর সম্ভব হলোনা রোযার পক্ষে।ঠাস করে হাতের কলমটি টেবিলে রেখে সে উঠে দাঁড়ালো।তার এমন অতর্কিত আবাহন সকলের মনোযোগ আকর্ষিত করলো।প্রফেসর চশমার লেন্সের অভ্যন্তর হতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধালেন,
– কি ব্যাপার রোযা? এনি প্রবলেম।
– ক্ষমতার কাছে কর্তৃপক্ষ জিম্মি?অহনার র*ক্তের সঙ্গে গাদ্দারী করতে একবারও বিবেকে দংশন হচ্ছেনা প্রফেসর?
হতবিহ্বল ক্লাসরুম।সামান্য গুঞ্জণও উঠলো।তবুও নিশ্চল নিটল রোযা।আর সহ্য করা যায়না!অন্তর তার পুড়ছে প্রচণ্ড বিদ্রোহের আ*গুনে!এই বিবেক বারংবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অহনা নামক ছোট্ট বোনটির নির্মম আত্মত্যাগ! কিভাবে মেনে নেয়া সম্ভব?আর কত চুপ করে সয়ে যাওয়া সম্ভব?
– রোযা! বিহেইভ ইওরসেল্ফ!তোমার শিক্ষা দেখে আমি অবাক হচ্ছি।
– আর আমি আপনার মতন শিক্ষিত ভদ্রের খোলস গায়ে জড়ানো নামধারী শিক্ষকদের দেখে অবাক হচ্ছি প্রফেসর!ক্ষমতার সামনে যে শিক্ষার মেরুদন্ড ভেঙে যায়,সেই শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ডের ভূমিকা পালন করবে কোন দুঃসাহসে?
তিরতির করে কাপতে থাকলো রোযার অধর,অধিক আবেগের তাড়নায়।উভয় হাত তার মুষ্টিবদ্ধ।প্রফেসর নির্বাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে তার পানে।
– অস্থিতিশীলতা? উশৃঙ্খলতা?কি বলছেন আপনি?এসবের চেষ্টা চালাচ্ছে আমার ভাইবোনেরা?জিশান আহসানকে চোখে পড়েনা আপনার কর্তৃপক্ষের?কিভাবে সে গায়ে বাতাস লাগিয়ে সম্পূর্ণ ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ায়?কোথায় ন্যায়বিচার?অপরাধীরা আজ নিষ্কলঙ্ক, বিদ্রোহীরা অপরাধী?
– স্টপ ইট!আর একটাও কথা না।তোমার বয়স কত মেয়ে?জীবনের কতটুকু বোঝো? তোমাদের একটাই সমস্যা,র*ক্ত গরম বেশি,তেজে ভরা শরীর।তেজ কমিয়ে মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবো।
– এমন মস্তিষ্কের দরকার নেই যে মস্তিষ্ক ন্যায় অন্যায়ের ফারাক করতে পারেনা।
নিস্তব্ধতা। প্রফেসরও জবাব প্রদানে হিমশিম খাচ্ছেন।ক্রমেই সকলের চিত্তে দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠছে।যে স্ফুলিঙ্গ তাদের মাঝে ধিকিধিকি জ্বলছিল তার অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়েছে রোযা।
– ন্যায় অন্যায়ের পাঠ এখন তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে আমাদের?চুপচাপ পরীক্ষা দিতে বসো।তুমি ভালো ছাত্রী,আমি ভুলে যাচ্ছি তোমার সঙ্গে আমার বাকবিতণ্ডা হয়েছিল।পরীক্ষা শেষ করে লেকচারে বসবে চুপচাপ।স্টুডেন্টস, ইওর এক্সাম স্টার্টস নাউ।
এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকলো রোযা।দ্বিধান্বিত প্রত্যেকে।এক নজর দৃষ্টি গেলো রোযার,একদম সামনের গ্যালারিতে।ঠিক যে স্থানে আজ থেকে মাত্র কিছুদিন আগেও বসতো অহনা,আজ সমস্ত স্থান শূন্যতায় আচ্ছাদিত।হাহাকার চারিপাশজুড়ে।সিদ্ধান্ত এলো হৃদয়ের।টেবিল থেকে নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে ভরে রোযা হনহন করে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে।ভ্রু কুঁচকে তাকালেন প্রফেসর।
– এমন মেরুদণ্ডহীন শিক্ষক এবং কর্তৃপক্ষকে আমার ভবিষ্যত গড়ার কারিগর হিসাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়।কোনো এক সময়ে আমার সঙ্গেও যে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবেনা তার নিশ্চয়তা কোথায়?তাই আমি, একজন দায়িত্ববান শিক্ষার্থী এবং একজন বিবেকবান মানুষ হিসাবে এই পরীক্ষা বয়কট করছি!
বিস্তৃত গ্যালারি ক্লাসজুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো রোযার কঠোর কন্ঠস্বর। চোয়াল ঝুলে পড়লো প্রফেসরের।সামান্যতম প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের পূর্বেই রোযা উল্টো ঘুরল,একনজর বাকিদের উদ্দেশ্যে চেয়ে সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেলো ক্লাসরুম থেকে।কয়েক মুহূর্ত তীব্র নীরবতা।শুধু গমগমে গুমোটতা পরিবেশজুড়ে।প্রফেসর নিয়ন্ত্রণ আনলেন নিজের মেজাজে,
– একেকটা চরম বেয়াদব!
ফিরলেন বাকিদের উদ্দেশ্যে,ধমক দিয়ে বললেন,
– একজন গেলে গিয়েছে। তারই সি জি পি এ তে প্রভাব পড়বে।তোমরা পরীক্ষা শুরু করো,দ্রুত।
তবুও নড়লোনা কলম। আঙুলসমূহ চেপে বসলো কাগজের পাতায়।বিবেক কড়া নাড়লো হৃদয়ের দুয়ারে।সহসাই দ্বিতীয় গ্যালারির মাঝে উঠে দাঁড়ালো আরেকজন ছেলে,নাম অভিষেক।চোখের চশমা ঠিকঠাক করে সে দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করলো,
– আমি,অভিষেক চৌধুরী,জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের একজন দায়িত্ববান শিক্ষার্থী এবং একজন বিবেকবান মানুষ হিসাবে এই পরীক্ষা বয়কট করছি!
ব্যাগ কাঁধে তুলে লাফিয়ে সে নামলো নিচে, তাকালোও না প্রফেসরের দিকে।সোজা বেরিয়ে গেলো বাইরে।প্রফেসর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন সম্পূর্ণ।তাকে আরো এক মাত্রায় হতবিহ্বল করে তুলে শেষ প্রান্তের আরেক শিক্ষার্থী দাঁড়ালো,
– আমি, মালিহা আফসার,জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের একজন দায়িত্ববান শিক্ষার্থী এবং একজন বিবেকবান মানুষ হিসাবে এই পরীক্ষা বয়কট করছি।
ডার্কসাইড পর্ব ৪২
– ক্রেজি!
পরোয়া করলোনা মালিহা, সিঁড়ি টপকে নেমে ত্যাগ করলো ক্লাসরুম।অতঃপর….?
থামলোনা এই গণজোয়ার। একে একে সকলে নিজেদের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।এবার কোনোপ্রকার ঘোষণারও প্রয়োজন হলোনা।বেপরোয়া দুর্বার তারুণ্য বয়কটের জোয়ার তুলে একে একে পরিত্যাগ করলো কারাগারের দুয়ার।হিড়িক লাগা নবজাগরণের পানে নিষ্পলক চেয়ে রইলেন প্রফেসর।ঠিক কেমন অনুভূত হলো অন্তরের মাঝে? জানা নেই।
অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে অতর্কিতে দানা বাঁধতে থাকা মহাপ্রলয়ের পানে চেয়ে থাকলো অবাক নয়নে……
