ডার্কসাইড পর্ব ৪৪

ডার্কসাইড পর্ব ৪৪
জাবিন ফোরকান

সম্পূর্ণ লাইব্রেরী কক্ষজুড়ে সুনসান নীরবতা।একমাত্র রোযা ব্যাতিত অন্য কারো উপস্থিতি নেই।মাঝখানের একটি টেবিলের সামনে বসে অবহেলায় নির্বাচিত বইটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রোযা।যেন খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছে।কিন্তু তার চিন্তাধারা আদতে ঘুরপাক খাচ্ছে ভিন্ন কিছু নিয়ে।মাত্র কিছুদিন আগেও লাইব্রেরীতে এলে তার পাশে বসা মেয়েটি আজ না জানি কোথায় শায়িত!আদও শায়িত নাকি তার নিশ্চয়তাটুকু পর্যন্ত নেই।কোনো বিশ্বাস নেই ক্ষমতার সামনে নতজানু ওই অমা*নুষদের।হয়ত পু*ড়িয়ে দিয়েছে প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে।সেইদিনের হলের তিন তলায় ঝুল*ন্ত লা*শটির দৃশ্য যেন এখনো ভাসছে রোযার নয়নজুড়ে।বর্ব*রতার সঙ্গে সে অভ্যস্থ,কিন্তু এহেন প্রদর্শন?আর কতটা নিচে নামা বাকি আছে মানবজাতির?কিছুদিন আগেও হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি নিয়ে ক্লাস করা মেয়েটি আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে গিয়েছে।সেই স্মৃতিটুকুও লালনের অধিকার নেই যেন কারো।তার অস্তিত্ব মুছে দেয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চলছে তারই অধ্যয়নরত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানজুড়ে!বাইরের একটা মানুষও জানেনা এই নামীদামী প্রতিষ্ঠানটির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কদর্যতার খবর।ভাবতেই কেমন যেন বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো অন্তর।নয়নে ভর করলো টলটলে আবেগ।মুষ্টিবদ্ধ হলো হাত,ক্রোধের উদগীরনে।

– রোযা আপু?
ভাবনার দুনিয়া পেরিয়ে বাস্তবে পদার্পণ করলো রোযা।বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে তাকালো ডাক উদ্দেশ্য করে।নজরে এলো অভিষেককে। সে অবশ্য একা নয়। পাঁচজনের একটি ছোট দল।মালিহা, আরিয়ান তার সঙ্গী,ক্লাসমেট।বাকি দুইজনের চেহারা চিনলেও নাম জানা নেই,তারা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, তথাপি রোযার তুলনায় বয়সে ছোটই।সকলে একত্রে এগিয়ে এলো।তাতে রোযা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে বইটা বন্ধ করে মনোযোগ দিলো।
– কি ব্যাপার অভিষেক?
এক মুহুর্ত নীরব থাকলো ছেলেটি,পরক্ষণে নিজের চশমা ঠিকঠাক করে নিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে জানালো,
– এভাবে আর চলতে পারেনা আপু।কতদিন মনুষ্যত্ব চেপে কাপুরুষের মতন বসে থাকবো?আমাদের কি প্রতিবাদ করা উচিত নয়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– দেখনি প্রতিবাদের পরিণতি?
রোযার প্রশ্নে সকলে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করলো।এগোলো মালিহা।
– দেখেছি আপু,দুই নয়ন মেলে সবটাই দেখেছি।এই অন্তর কিছু ভুলেনি।যে পথে নামতে চাইছি সেই পথের পরিণতি সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত।তবুও বলবো, আরো একবার গর্জে উঠুক বিদ্রোহ!
সামান্যতম কাপলোনা মেয়েটির কন্ঠস্বর।দৃঢ় চেতনায় বলীয়ান সে। অপর একজন মেয়ে এগিয়ে জানালো,
– আমার নাম সাবিহা,রোযা আপু।অহনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ ছিল না,শুধু একবারই এসেছিল প্রথম প্রথম কিছু আগের নোটস নিতে।তখন যা আলাপ হয়েছে তাতে মনে হয়েছে মেয়েটি যথেষ্ট ভালো।তার এমন পরিণতি মানা যায়না।আমরা সকলেই জানি ওর সাথে ঠিক কি হয়েছে!একজন নারী হয়ে এমন নৃশং*সতা কিছুতেই মানতে পারছিনা।আজ অহনার সঙ্গে হয়েছে, কাল পরশু আমাদের সঙ্গে হবেনা তার নিশ্চয়তা কোথায়?

– আমরা ছেলে আপু।পুরুষ জাতি।কিন্তু একজন পুরুষ হয়েও অপর এক পুরুষের এমন বর্ব*রতা কাম্য নয়।অহনা আমাদের বোন,আমাদের সকলের বোন। বোনটাকে ওরা নি*ষ্ঠুরভাবে নিঃশেষ করে দিলো।একজন ভাই হিসাবে আমি কিছুতেই চুপ থাকতে পারছিনা!নিজেকেই কাপুরুষ মনে হচ্ছে!
আরিয়ানের চোখজুড়ে স্পষ্ট অশ্রুরেখা ভাসলো।মালিহা একটা টিস্যু এগিয়ে দিতেই সে উল্টো ঘুরে নিজের চোখ মুছতে লাগলো।নির্বাক চেয়ে থাকল রোযা।
– রোযা আপু…
এক হাঁটু ভাঁজ করে রোযার সম্মুখে বসলো অভিষেক।চাইলো করুণ অভিব্যক্তি নিয়ে।

– আমরা কি আমাদের বোনটাকে সুবিচার দিতে পারবোনা?অহনা হয়ত ঔপারের জগৎ থেকে চেয়ে আছে আশা নিয়ে,তার ভাইবোনগুলো তার আত্মত্যাগকে বৃথা যেতে দেবেনা।কিন্তু আমরা ক্ষমতার ভয়ে ঠকঠক করে কাপছি।কি ছিল অহনার?কিছুই না।এক নিঃস্বতার মূর্ত প্রতীক।তবুও সামান্য ভয় পায়নি সে ক্ষমতাবানের মুখোমুখি হওয়ার।আর আমরা?এত বিত্তশালী হয়েও বা লাভ কি?ক্ষমতার সামনে সেই নতজানুই হয়ে রয়েছি!
অভিষেকের কথাগুলো রোযার অন্তরে কড়া নাড়ল তীব্রভাবে।দৃপ্ত দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকলো ভাইবোনগুলোর উদ্দেশ্যে।মালিহা বললো,

– আপু।প্লীজ কিছু একটা করো।আজ যেমন করে তুমি একাই বয়কটের আওয়াজ তুললে,ঠিক তেমন একটা নেতৃত্বই আমাদের প্রয়োজন।আমরা শুধুমাত্র তোমাকেই বিশ্বাস করি, আর কাউকে না।হ্যাঁ,সংখ্যায় অনেক কম আমরা।তবুও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আমাদের রয়েছে।অহনাকে সুবিচার এনে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে এই হৃদয়।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।ভাবলো রোযা।তার অন্তর চেঁচিয়ে শুধুমাত্র একটি সিদ্ধান্তই ঘোষণা করছে।আজ যদি ঐক্য তৈরি না হয় তবে আর কোনোদিন হবেনা।ক্ষমতার চাপে পিষ্ট হবে সকলে।অদ্ভুতভাবে ভাগ্যের চক্রে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে যেন রোযা। চিত্রলেখা,আর এখন অহনা।মেয়েগুলোর কি কোনো দোষ ছিল?তবুও লালসার ব*লী হতে হয়েছে তাদের। চিত্রর একজন আসমান ছিল,কিন্তু অহনার?কে চাইবে তার ন্যায়বিচার?দৃঢ় অঙ্গীকারে কাপলো যেন রোযার সর্বাঙ্গ। দূর্বল,অক্ষম,ক্ষমতাহীন ছিল সে।বর্তমানে আর নয়।যদিও ক্ষমতাহীন থাকতোও,তবেও কোনোদিন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবপর হতোনা তার পক্ষে।

উঠে দাঁড়ালো রোযা,কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো সকলের দিকে। প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণ করলো নিগূঢ় নজরে, যেন তার নয়ন ভেদ করে লক্ষ্য করলো তাদের অন্তর পর্যন্ত।
– একবার যদি এই বিদ্রোহ শুরু হয় তবে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত থামবার কোনো উপায় নেই।পারবে তোমরা সংগ্রাম করতে?ন্যায় অন্যায়ের এই লড়াইয়ে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যেতে যত বাঁধাই আসুক না কেন?
এক মুহুর্ত ভাবনায় পতিত হলো সবাই। একে অপরের মাঝে চাইলো।মাথা নেড়ে যেন এক নীরব সম্মতিতে যুক্ত হলো।রোযার উদ্দেশ্যে ফিরলো,

– অবশ্যই পারবো আপু।আমাদের বোনের র*ক্তের দাম না নিয়ে আমরা ঘরে ফিরবো না!
সামান্য সন্তুষ্টির হাসির উদ্রেক ঘটলো রোযার অধরে। পরিমিত অথচ অদ্ভুত দুঃসাহসে সিক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– তবে আরো একবার হোক বিদ্রোহ!
প্রচণ্ড সাহসে উদ্ভাসিত হলো যেন তারুণ্য।নিজের হাতখানা অগ্রসর করলো অভিষেক,জানালো,
– আমার বোনের সম্মানের জন্য অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত সংগ্রাম করতে আমি প্রস্তুত!
– প্রস্তুত আমিও!
মালিহা নিজের হাতটি রাখলো তার উপর,অতঃপর আরিয়ান এবং সাবিহা।সর্বশেষে রোযা নিজের হাতটি রেখে প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে তাকালো সম্মুখে।সকলের নয়নজুড়ে ধিকিধিকি জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গের দাবা*নলে রূপান্তরিত হওয়া এখন মাত্র কিছু সময়ের ব্যাপার।

ঘণ্টাখানেক পর।
নগর থানার সামনে এসে থামলো দুইটি গাড়ী।দরজা খুলে একে একে বেরিয়ে এলো বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েগুলো।রোযা বাইরে পা রাখতেই হাবিব তার উদ্দেশ্যে একনজর তাকালো,যেন যা হচ্ছে তাতে তার সম্মতি নেই।তবুও রোযার কাজে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো অধিকার তার নেই,যদিনা সাং*ঘাতিক বিপদের মুখোমুখি হয়।রোযা অবশ্য হাবিবকে তেমন কিছুই বললোনা।তাকে ঘিরে ধরলো বাকিরা।পকেটে হাত ঢুকিয়ে থানার প্রাঙ্গণের দিকে চেয়ে আরিয়ান জিজ্ঞেস করলো,

– আমরা এই মুহূর্তে থানায় কেনো এসেছি রোযা আপু?
– জিশান আহসানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে।
এক মুহুর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সবাই।রোযা মাথা কাত করে জানালো,
– প্রথমেই বিদ্রোহ করতে গেলে আমাদেরই হেনস্তা করা হবে সিস্টেমের দোহাই দিয়ে।শুরুতে সিস্টেমের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখা যাক।যদিও জানি,লাভ হবেনা।তবুও আমাদের নিকট হাতিয়ার থাকবে জানানোর,যে আমরা আইনের কাছে গিয়েছিলাম।
সকলে মাথা নাড়লো সম্মতিতে।থানার দিকে এগোতে এগোতে রোযা জানালো,

– অভিষেক আর আরিয়ান,তোমাদের দায়িত্ব সেইদিনের সকল তথ্য সংগ্রহ করা।অনেকেই সেদিনের বর্ব*রতার বহু ছবি ভিডিও তুলেছে। যদিও অধিকাংশ বেহাত হয়েছে,তবুও আমি নিশ্চিত কিছু না কিছু অন্তত আছে।আমাদের শক্ত প্রমাণ লাগবে প্রকাশের জন্য।
– আমার কাছে আছে কিছু ছবি,যদিও ঝাপসা।মুছতে বলেছিল,লুকিয়ে পেনড্রাইভে সংরক্ষণ করে রেখেছি।
জানালো অভিষেক।আরিয়ান মাথা দুলিয়ে বললো,
– চিন্তা করোনা রোযা আপু,সবকিছু জোগাড় হয়ে যাবে।

থানার ভেতর প্রবেশ করলো সকলে।সম্পূর্ণ স্থানটি ব্যাতিব্যস্ত।ঠিক কাজে নয়। হাবিলদারগণ আশেপাশে পায়চারি করছে,উচ্চ পদের কর্মকর্তার বেশিরভাগ এখনো থানায় পৌঁছায়নি।এতগুলো তরুণ তরুণীকে একসঙ্গে দেখে সামান্য ভ্রুকুটি করে চাইলো সকলে ফিরে ফিরে।কারো কোনোপ্রকার অনুমতি না নিয়েই রোযা টেবিলের সামনে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ল।তাতে একজন হাবিলদার এগিয়ে আসছিল, কিন্তু রোযার পাশে দাঁড়ানো হাবিবের তীক্ষ্ণ চাহুনিতে বিব্রত হয়ে পিছিয়ে গেলো। টেবিলের উপরের নেমপ্লেটটা নেড়েচেড়ে রোযা আপনমনে বিড়বিড় করলো,
– ওসি ওসমান আহমেদ?দুপুর বারোটা পেরিয়ে গেলো, ওনার এখনো অফিস শুরু হয়নি দেখছি।
– স্যার ফিল্ডে আছেন।আপনার কি দরকার?

চোখ তুলে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত গাট্টাগোট্টা ধরণের লোকটাকে লক্ষ্য করে রোযা বললো,
– সেটা নাহয় আপনার স্যার ফিল্ড নামক বাসা থেকে থানায় পৌঁছলে তাকেই জানাবো?
রোযাকে কিছু না বলে এবার বাকিদের উদ্দেশ্যে ফিরল সে,
– এই তোমরা থানার মধ্যে এত ভিড় করো কেনো? যাও বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।
– ওরাও এসেছে আমাদের সাথে,ওদেরও অভিযোগ আছে।বাইরে যাওয়ার কোনো কারণ দেখছিনা।
রোযার উত্তরে তেঁতে উঠে বান্দা বলে বসলো,
– নিজেকে কি এই দেশের প্রেসিডেন্ট মনে করেন নাকি?একটা বিলাসী গাড়ি নিয়ে কি থানায় ঢুকলেন, অমনি তেজের ঠেলায় টেকা দায়।আপনাকে কি পায়ে পড়ে সালাম করতে হবে এখন?

– এলাকার বড়ো ভাই এলে তাইতো করেন মিস্টার অফিসার,তাইনা?
– তর্ক করেন কেনো?আপনার কি কাজ বলেন।
– মামলা দায়ের করবো।
– কিসের মামলা?
– ধ*র্ষণ ও হ*ত্যামা*মলা,জিশান আহসানের বিরুদ্ধে।
স্পষ্টত কম্পিত হলো অফিসার,শুধুমাত্র সেই নয়, আশেপাশের বাকিরাও কেমন বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।নিজেকে দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ করে সে জানালো,
– এটা স্যারকে জানাতে হবে।উনি অনুমতি দিলে তারপরই সব করা যাবে।
– জানতাম।আপনার নেমপ্লেটের এস আই ট্যাগের কোনো ভ্যালু নেই।সেই ওসির কাছেই ভিড়তে হবে।
ক্ষেপে গিয়ে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এর পূর্বেই বৃহৎ শারীরিক গঠনের অধিকারী ওসি হেলেদুলে প্রবেশ করলেন ভেতরে।তেজস্বী কন্ঠে শুধালেন,

– সকাল সকাল এত্ত হাউকাউ কিসের থানায়?
সকলে স্যালুট ঠুকলো একযোগে।কিন্তু ওসির তাতে বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই।অধরের উপরের কাঁচা গোঁফে তা দিতে দিতে শকুনি দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন তিনি সকলকে।
– থানায় হঠাৎ স্টুডেন্ট ঝইরা পড়লো কেনো?
চেয়ার টেনে উল্টোদিকে বসতে বসতে প্রশ্ন ছুঁড়লেন ওসি।
– প্রয়োজন হলে তো আইনের কাছে আসতেই হয় তাইনা ওসি সাহেব? আফটার অল পুলিশ আমাদের বন্ধু!
অভিষেকের কন্ঠে স্পষ্টত খেদ মিশ্রিত ছিল,যার দরুণ ওসি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।খিলখিল হাসি তুলে বললেন,
– তাগড়া জুয়ানদের সাথে বেহুদা প্যাঁচাল পারতে আমি ইচ্ছুক না।ওই মফিজ….এক কাপ চা দে তো?
– আপনার পাওয়ার কত?
অতর্কিত প্রশ্নে থমকে গিয়ে ওসি পিটপিট করে তাকালেন রোযার দিকে,

– মানে?
– জিজ্ঞেস করছি চোখের পাওয়ার কত? মাইনাস নাকি প্লাস?
– আপনি কি মশকরা করতেসেন?আমার চোখে কি কোনো চশমা লাগানো আছে নাকি যে পাওয়ার থাকবে?
– ওহ নেই?আমি তো ভাবলাম আপনার চোখে সমস্যা রয়েছে।নাহলে এখানে অভিযোগ জানানোর উদ্দেশ্যে মানুষ অপেক্ষমান দেখেও আয়েশী হেলান দিয়ে চা চাওয়ার প্রশ্ন তো আসেনা!আমাকে দেখতে পাননি নিশ্চয়ই,তাইনা?
তিরতির করে কাপলো ওসির অধর।সত্যিই চেয়ারে হেলান দিয়েছিলেন,তড়াক করে সোজা হয়ে বসলেন।তীব্র এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অতঃপর একটি খাতা টানতে টানতে বললেন,

– কবির, এই মহিলার কেইস কি?
এস আই অফিসার এগিয়ে আসছিলেন কিন্তু রোযা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে শিরদাঁড়া টানটান করে ওসির সঙ্গে দৃষ্টি মেলালো।
– মামলা লিখুন।ধ*র্ষণ এবং হ*ত্যামা*মলা।মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অহনা আক্তারকে গণধ*র্ষ*ণ করে হ*ত্যা করা হয়েছে,তার লা*শ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল হলের তৃতীয় তলার রেলিংয়ে,সকাল পর্যন্ত।
ওসি নির্বাক চেয়ে থাকলেন।রোযা অবশ্য থামলোনা।
– আমি অহনার পক্ষে বাদী হয়ে মামলা করতে চাই।এক নম্বর আসামী জিশান আহসান,তার দুইজন সহযোগী রাকিব এবং মাহির।সঙ্গে অজ্ঞাতনামা দুইজন নারী।

– আপনারা মাথা ঠিক আছে নাকি?আপনি জানেন জিশান আহসান কে?
– অবশ্যই।আমাদের দেশেরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইকবাল আহসানের ছেলে।
রোযা এতটা নির্বিকারভাবে উত্তর করলো যে তাতে পুলিশ সদস্যরা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো।ওসি সেকেন্ড খানেক নিশ্চুপ থেকে তারপর টেবিলে দুহাত ভাঁজ করে ভ্রু কুঁচকে চাইলেন রোযার উদ্দেশ্যে,
– দেখেন, এইটা সিনেমা না, বাস্তব জীবন।বুঝতেসেন আপনি নিশ্চয়ই? কার বিরুদ্ধে কোথায় এসে কি বলতেসেন? জিশান আহসান এমন ছেলে হইতেই পারেনা,আমি ওকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি বুঝছেন?
– আপনার কাজ মামলা নেয়া।বিচার করা নয়।

আরিয়ানের কন্ঠে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলো ওসির, টেবিলে একটা চাপড় দিয়ে জানালেন,
– একদম চুপ!আমার সাথে সবাই মিলা মশকরা করতে আসছো তোমরা?এই মামলা নিলে আমার থানার কি হাল হবে জানো?
– ওহ আচ্ছা।তাহলে তাই বলুন,যে আপনি ভয় পাচ্ছেন!
মালিহা দুহাত বুকে ভাঁজ করে বললো।স্পষ্টত মুষ্টিবদ্ধ হলো ওসির হাত।তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সকলের মুখোমুখি হলেন তিনি।

– শুনো,তোমাদের ভালো একটা পরামর্শ দেই।এসব ফাতরামি বাদ দিয়া যাও পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।আইনশৃঙ্খলা সবই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইশারায় চলে বুঝছো?আর তোমরা তার ছেলের নামেই বিচার চাইতে আসো?
– আপনি না একজন পুলিশ?আইনের রক্ষক?আইনের চোখে তো সবাই সমান তাইনা? তা হোক ধনী গরীব উঁচু নিচু, সাধারণ জনগণ কিংবা আমলা মন্ত্রী।অন্যায়ের শাস্তি সবার জন্য এক।
সাবিহা বলতেই ওসি এমন ভঙ্গিতে তার দিকে তর্জনী তুললেন যে বেচারী কিঞ্চিৎ ভড়কে গিয়ে পিছিয়ে পড়লো।উত্তোলিত তর্জনী নাড়িয়ে ওসি বললেন,

– তোমার এই ন্যায়ের ভাষণ অন্য কোথাও গিয়ে ঢালো।তোমার ভাষণে বাস্তব দুনিয়া চলেনা।
– তার মানে আপনি আমাদের মামলা নেবেন না?
– পাগলা কুত্তা কামড় দিসে নাকি আমাকে?তোমরা স্টুডেন্ট মানুষ,র*ক্ত গরম বেশি।দুইটা ডান্ডার বাড়ি খাইলে এই র*ক্ত শীতল হইয়া যাবে।মাথা ঠাণ্ডা কইরা বাসায় যাও…যাও!
বাকিরা রোযার উদ্দেশ্যে তাকালো।রোযা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো।একটি নিঃশ্বাস নির্গত করে বললো,
– ঠিক আছে।আমরা অন্য থানায় যাবো।

– লাভ নাই।মামলা নিলেও দুই ঘণ্টাও লাগবে না ফোনফুন কইরা ওইটা বাতিল করতে,বুঝছো?মাইয়া মানুষ এত তেজ দেখাইতে আইসো না।ইজ্জতটা ধইরা টান দিলেই কিন্তু সব শেষ!
তড়িৎ খেলে গেলো রোযার শরীরে,ইচ্ছা হলো হাত তুলে ঠাটিয়ে একটা চপাট দেয়।কিন্তু নিজেকে নিবারণ করলো বহু কষ্টে।থানায় এমন দৃশ্য উপস্থাপনের দরুণ পরবর্তীতে তা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।
একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন ওসি,চেয়ারে হেলান দিয়ে আদেশ করলেন,
– যাওয়ার আগে সবার নাম পরিচয় এই কাগজে লিখা যাও।
– আশ্চর্য্য।আপনি আমাদের মামলা তো নিলেন না, তাহলে আমাদের নাম পরিচয় কেনো লিখব?
আরিয়ানের প্রশ্নে ওসি তেঁতে উঠলেন।

– একদম বেশি বুঝবা না।লিখতে বলসি লিখো।আমরা দেখবো ব্যাপারটা কি হইসে।
রোযা কলম তুলে নিয়ে কাগজে নিজে নাম লিখতে লিখতে মৃদু হেসে বললো,
– সোজাসুজি বললেই হয় ওসি সাহেব যে আমরা যাওয়ার পরপরই আমাদের নাম পরিচয় সব জায়গামতো পৌঁছে যাবে!
দৃশ্যমানভাবে স্থবির হলেন ওসি।একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন সম্মুখে।রোযা নিজেরটা লিখে বাকিদের উদ্দেশ্যে কাগজ এগিয়ে দিলো।সকলে একে একে লিখতে থাকলো।কারো মাঝে সামান্যতম দ্বিধা নেই।লিখা শেষ হতেই কাগজটি ওসির দিকে এগিয়ে দিয়ে রোযা জানালো,
– এই নিন ওসি সাহেব।এইবার অন্তত একটা রেকর্ড থাকলো,যে আমরা আগে আইনের কাছেই সাহায্য চেয়েছিলাম।তবুও সুবিচার পাইনি।

– বাপের টাকা উড়ান তো,তাই দিন দুনিয়া বোঝেন না!
ওসির কথায় শুধু সামান্য হাসির রেখা প্রদর্শন করলো রোযা।ঝুকলো সামনে,টেবিলে দুহাত ঠেকিয়ে ওসির নয়নে নিগূঢ় দৃঢ় দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ব্যক্ত করলো,
– তারুণ্যকে ছোট করে দেখবেন না কখনো।আজ হয়ত মাত্র পাঁচজন বিদ্রোহীকে দেখতে পাচ্ছেন।তাই গায়ে লাগছে।কিন্তু যেদিন পাঁচ হাজার জন সামনে এসে দাঁড়াবে, বোনের হ*ত্যার সুবিচার চাইবে, সেদিন আপনার প্রভু ওই ক্ষমতার গদিও ভূলুণ্ঠিত হবে।
রোযার কন্ঠে অদ্ভুত এক আবেশ ছিল,যার দরুণ সম্মোহিতের ন্যায় সকলে তাকিয়ে রইলো তার অবয়বপানে।আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ এক রমণীর অন্তরের কঠোরতা অনুভব করামাত্রই যেন হিমশীতল আতঙ্ক ঘিরে ধরে অস্তিত্বকে।

– তারুণ্য সর্বদাই অবাধ্য।এমন কোনো শক্তি নেই যা কখনো তারুণ্যের নবজাগরণকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।তারুণ্য কারো আদেশ মানেনা,গোলামী করেনা।ক্রীতদাসের শৃঙ্খল হটিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা আদায় করতে জানে এই দুর্বার তারুণ্য।শুধু সময়ের অপেক্ষা।এক নতুন ইতিহাস লিখা হবে খুব শীঘ্রই।
– এটা কি হু*মকি ছিল?
ব্যাগ কাঁধে তুলে হাসলো রোযা।
– হ্যাঁ,জানিয়ে দেবেন আপনার প্রভুদের।

এটুকুই।হনহন করে বাইরে এগোলো রোযা, তার অনুসরণে বাকিরা।হাবিব একনজর সকলের উদ্দেশ্যে তাকালো,যেন নিজের মাঝে সবকিছু ধারণ করে নিলো।অতঃপর এগোলো।বাইরে পৌঁছতেই রোযা বাকিদের দিকে ফিরে বললো,
– আর দেরি করা যাবেনা।আমাদের যা করার দ্রুত করতে হবে।অভিষেক,আরিয়ান,তোমাদের যা বলেছি তাই করবে।আইপি অ্যাড্রেস হাইড করে ইন্টারনেটে খবর ছড়ানো তোমাদের দায়িত্ব।অন্তর্জাল কিন্তু এসব ক্ষেত্রে একটি বিরাট হাতিয়ার।যদি সম্ভব হয় তাহলে মোবাইল শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করে নষ্ট করে নর্দমায় ফেলবে।ঠিক আছে?
দ্রুত মাথা নাড়লো সকলে।

– আর মেয়েরা।তোমাদের কাজ কয়েকটি প্ল্যাকার্ড বানানো।আগামীকাল থেকে ক্লাস বয়কটের ডাক তুলবো আমরা।আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবাই হয়ত আসবেনা,কিন্তু কেউ কেউ হলেও অন্তত আসবে।সকলে ব্যাগে করে পেপার স্প্রে,ছোটখাট ছু*রি নিয়ে আসবে।সাবধানতা অবলম্বন শ্রেয়। আর সবাই অত্যন্ত সাবধানে থাকবে।পারলে আজকে রাতে বাসার বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই।গেলেও পরিবারের কাউকে সাথে নিয়ে যাবে।ঠিক আছে?
– রোযা আপু চিন্তা করোনা।আমরা নিজেদের খেয়াল রাখবো।

– গুড।এখন তাহলে সবাই বাসায় যাও।টেলিগ্রাম গ্রুপে সবাই পরবর্তী আলোচনা করবো।
সম্মতি জানালো সবাই। একে একে চড়ে বসলো গাড়িতে।জানালার পাশে বসে রোযা পুনরায় হারিয়ে গেলো নিজের জগতে।দারুন এক উত্তেজনা ঘিরে ধরেছে সকলকে।যেন সত্যিই কোনো এক যু*দ্ধে নামতে চলেছে তারা আগামীকাল হতে।রোযা কি আদও পারবে যোগ্য নেতৃত্ব দিতে? ভাইবোনগুলোর দায়িত্ব এখন তার কাঁধে,যদি কিছু হয়ে যায়?কোনোদিন কি ক্ষমা করা সম্ভব হবে নিজেকে?কিন্তু চুপ করে পিছিয়ে আসাও কি আর সম্ভব?সে কি আদতে ঠিক করছে নাকি ভুল?চিন্তার দ্বন্দ্ব রোযাকে মোটেও শান্তি দিলোনা।

মেঘতীর।
পরিশ্রান্ত শরীরে ধীরপায়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই রোযা একটি অভাবনীয় দৃশ্য লক্ষ্য করলো।কিচেনে নিহাদ গায়ে কিচেন অ্যাপ্রোন জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠিক পাশেই বুকে দুবাহু ভাঁজ করে রেখে অতি মনোযোগী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণরত আসমান।
– পাত্রে এক কাপ পানি রাখো।
ডাগর ডাগর আঁখিজোড়ায় উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি খেলে গেলো নিহাদের।তড়াক করে একটি কাপে পানি ঢেলে সিরামিকের পাত্রের মাঝ বরাবর বসিয়ে দিলো কাপটি।নিষ্পাপ শিশুসুলভ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

– এবার?
বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আসমান,একবার নিহাদ আরেকবার পাত্রের দিকে তাকালো। নেত্রপল্লব তার পিটপিট করলো দ্রুতগতিতে।হাত বাড়িয়ে কাপ তুলে পানিটুকু পাত্রে ঢেলে কাপটি সরিয়ে রাখলো।তারপরই ডান হাতখানা দিয়ে মোক্ষম এক চপাট হানলো নিহাদের ঘাড়ে।
– উহঃ!
– এক কাপ পানি পাত্রে নিতে বলেছি,কাপ শুদ্ধ পাত্রে জাল দিয়ে ঘেঁটু বানাতে বলিনি!
– আমার কি দোষ?তুমি তোমার ব্যাকরণ ঠিক করো!
– ছাড়ো, সরো।তোমার আর রান্না শিখতে হবেনা।
– না না,প্লীজ প্লীজ আসমান ভাই,এমন অনাচার করোনা।আরেকবার আরেকবার,এবার আমি ঠিকঠাক করবো কথা দিচ্ছি।

তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আসমান পুনরায় কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রোযার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হওয়ায় থমকে গেলো।সামান্য হেসে বললো,
– এসে গিয়েছ?পরীক্ষা কেমন হয়েছে আজ?
– হুম।
এটুকুই। রোযা আর কিছু না বলে সোজা সিঁড়ি বেয়ে দুইতলায় চলে গেলো।ব্যাপারটা আসমান এবং নিহাদ উভয়কে কিঞ্চিৎ বিস্মিত করলো।
– ব্যাপারটা কি হলো?ফুলটুশী আজ এত উদাসীন কেনো?
– তোমাকে না বারণ করেছি রোযাকে ফুলটুশী বলে ডাকবেনা?
– কেনো?তোমার জ্বলে?
– হ্যাঁ।খুব জ্বলে!এবার ঘ্যানর ঘ্যানর না করে এক চামচ লবণ দাও,পানি ফুটে আসতে শুরু করেছে।দেখো আবার চামচ শুদ্ধ দিয়ে দিওনা।দুপুরে আমাদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার চাই, ধাতব চামচের স্যুপ না!
হাসলো নিহাদ।লবণের কৌটা থেকে মেপে মেপে এক চামচ লবণ নিতে নিতে বিড়বিড় করলো,

– হে হে….আমি এতটাও গর্ধব নই বদ্দা….
টাং!
নিহাদের হাত ফসকে চামচ শুদ্ধ পাত্রের ফু*টন্ত পানির মাঝে পরে গেলো।সম্পূর্ণ জমে গেলো উভয়ে। চেহারাজুড়ে আতঙ্ক ফুটিয়ে নিহাদ আসমানের দিকে চাইলো ভয়ে ভয়ে,যে এই মুহূর্তে একদৃষ্টে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে পাত্রের দিকে।এই নির্বিকারতা যেন অনুভূতির চাইতেও ভ*য়ংকর।কম্পিত কন্ঠে নিহাদ বললো,

– স…সরি….আমাকে ক্ষমা করে দাও…
– এই চামচ তুমি হাত দিয়ে তুলবে নিহাদ!
– না না….আমি আর জীবনে রান্না শিখতে আসবো না, প্লীজ….
উল্টো ঘুরে চম্পট দিতে গেলে আসমান নিহাদের পরিধানের শার্ট টেনে ধরলো পিছন থেকে।যদিও সে এক হাতে ধরেছে,নিহাদ উভয় হাতে টেনে হিঁচড়ে ছাড়াতে গিয়ে বেগ পেলো।
– ছেড়ে দে শয়তান!তুই আমার দেহ পাবি কিন্তু মন পাবি না!
– দেহটাই দরকার। মাঞ্জা মে*রে রোদে শুকাতে দেবো।
আবারও আসমানের চপাটে নিহাদের পিঠটা রীতিমত টনটন করতে লাগলো।অবশেষে বহু থালা বাটি গ্লাসের মহতী আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে নিহাদ যখন রান্না সম্পন্ন করে টেবিলে রাখছে তখন সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখা গেলো রোযাকে।বিশ্রাম আর গোসল সেরে তৈরি হয়ে এসেছে।তবে মুখজুড়ে কোনোপ্রকার প্রফুল্লতা নেই।চুপচাপ সে টেবিলে বসলো।কিছুটা যান্ত্রিক ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করলো,

– আজ তুমি রান্না করলে যে নিহাদ?
চেয়ার টেনে বিপরীত প্রান্তে বসতে বসতে নিহাদ জানালো,
– ক্যান আর ফ্রোজেন ফুড খেয়ে খেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি।বাইরের খাবারও লোভনীয় লাগেনা।তাই ভাবলাম আমার মাস্টার শেফ বাংলাদেশের কাছ থেকে একটা দুইটা সহজ রেসিপি শিখে যাই।
– ওহ।
– তোমার কি কিছু হয়েছে রোযা?কোনো সমস্যা?
– উহুম।কিছুনা।
– পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?
মাথা নাড়লো রোযা।আসমান সকলকে খাবার পরিবেশন করে দিলো।আজ বিলাল এবং চারুলতা বাড়িতে নেই।খাবারের দিকে একনজর তাকিয়ে রোযা শুধালো,

– এটা কি?
– জাপানিজ কারি।
একনজর নিহাদ আর এক নজর খাবার দেখলো রোযা,লোভনীয় ঠেকছে ঠিকই কিন্তু নিহাদের অপটু হাতের রান্না কেমন হবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এদিকে নিহাদ বেচারা ভীষণ উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে।
– খাও খাও রোযা,প্লীজ রিভিউ।কেমন হয়েছে বলো তাড়াতাড়ি।
একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করে অবশেষে রোযা এক চামচ মুখে তুললো,তারপরই সম্পূর্ণ স্থির হয়ে পড়লো তার চোয়াল,চিবুচ্ছে পর্যন্ত না।শুধুমাত্র দৃষ্টি প্রসারিত হয়ে রয়েছে।
– খুব ভালো হয়েছে তাইনা?আমি জানতাম!এইযে, আজ বাংলার মাটিতে এক নতুন মাস্টার শেফের জন্ম হলো।সেই দিন সুদূরে নয় যেদিন সকলের নাম ছাড়িয়ে এই নিহাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করবে রন্ধনশৈলীর ইতিহাসের পাতায়!

তথাপি ছেলেটির প্রফুল্লতায় যেন পঁচা পাক ঢেলে উদ্যত হলো আসমানের হাত।তড়িৎ গতিতে একটি টিস্যু তুলে নিজের হাতের তালুতে পেঁচিয়ে ধরলো রোযার মুখের সামনে, বললো,
– ফেলে দাও।আমি জানি খুবই লবণাক্ত হয়েছে।
– থু…
সত্যি সত্যি খাবারটুকু ফেলে দিলো রোযা।তার সমস্ত শরীর একটা ঝটকা খেলো অতিরিক্ত লবণের শিরশিরে অনুভূতিতে।আসমান টিস্যুটি মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসলো,এক গ্লাস পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো রোযার দিকে।এই দৃশ্য অবলোকন করে নিহাদের হৃদয় ঝরঝর করে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো!ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে সে বেসুরো গান ধরলো,

– আয়না মন ভাঙ্গা আয়না,যায়না ব্যথা ভোলা যায়না, সয়না এই ব্যথা যে,সয়না~
– তোমার ক্যালমা কোম্পানির ভাঙ্গা রেডিও বন্ধ করো বলে দিলাম।
– ইশ!সব তোমার দোষ! তুমিই তো গুরু,আমি শিষ্য।আমার ভুল মানে তোমার ভুল!
আসমান মাথা নেড়ে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।রোযা স্থির হয়েছে,আরেক গ্লাস পানিতে মজেছে।ঠিক তখনি বাইরের গার্ড দরজায় এসে থমকালো,হাতে একটি বড়সড় প্যাকেট।আসমান এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটি নিয়ে এসে টেবিলে রেখে খুলতে আরম্ভ করলো।ভেতর থেকে কাচ্চি বিরিয়ানীর সুঘ্রাণ ভেসে এলো।
– জানতাম একটা না একটা ঝামেলা আমাদের চিংটা পাকাবেই।ভাগ্যিস আগেভাগে অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম।নাহলে আজ সবাইকে ক্ষুধার্থ থাকতে হতো।

– কেনো?এতই যখন শখ তখন যাও,নিজে রান্না করে খাওয়াও।অর্ডার করলে কেনো?যত্তসব!
গাল ফুলিয়ে অভিমানী ভঙ্গিতে বললো নিহাদ।তাতে আসমান সামান্য চটে গিয়ে পুনরায় চপাট দিলো।তবে আজ তাদের খুনসুঁটিতে সামান্যতম মনোযোগ রইলোনা রোযার।সম্পূর্ণ উদাসীন সে।যা কারোর দৃষ্টিই এড়ালোনা।
দুপুরের খাবারের পর বাইরের বাগান থেকে খানিকটা হেঁটে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই হাবিবকে লক্ষ্য করলো রোযা।তাকে সালাম দিয়ে হাবিব দ্রুতই বাড়ি পরিত্যাগ করলো।কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে রোযা পায়ে পায়ে পৌঁছলো রুমে। আরামকেদারায় বসে দুলছে আসমান,হাতে একটি সিগারেট।আজ বহুদিন বাদে তাকে এই বস্তুটি স্পর্শ করতে দেখা গেছে,যদিও এখনো জ্বালায়নি,শুধু দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে রেখেছে। রোযা কিছু বলবে কিনা ভাবলো।তারপর বলেই ফেললো,

– এসব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।সেবন করোনা।
আসমান মাথা কাত করে তাকালো,সিগারেটটি আঙুলের মাঝে ঘোরাতে ঘোরাতে অতর্কিতে আদেশ করলো,
– বসো রোযা।
কন্ঠজুড়ে এক শীতলতার আবহ অনুভূত হলো স্পষ্ট।না চাইতেও রোযার বুক ধক করে উঠলো যেন।
– তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।
আসমানের কন্ঠস্বর ভীষণ রকম অশুভ ঠেকলো।যান্ত্রিক,অনুভূতিশূন্য,ভারিক্কি এবং কঠোর।সম্মোহিতের ন্যায় রোযা বিছানায় বসলো,মুখোমুখি হলো আসমানের।মুখের মাস্কটি খুলে ঝুঁকলো অমানিশা, এক হাতে তার উঠে এলো লাইটার।সেটির স্ক্রু ঘোরাতে ঘোরাতে সেই একই প্রগাঢ় কন্ঠে শুধালো,

ডার্কসাইড পর্ব ৪৩

– কি করতে চাইছো তুমি রোযা?
চোখ বুজে দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে স্বামীর উদ্দেশ্যে দৃষ্টিপাত করলো রোযা, নয়নজুড়ে তার অগ্নি চেতনা খচিত।বিদ্রোহী অস্তিত্বের টলটলে উন্মাতাল সেই দৃষ্টিতে একনাগাড়ে চেয়ে রইলো আসমান।

ডার্কসাইড পর্ব ৪৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here