ডার্কসাইড পর্ব ৪৫

ডার্কসাইড পর্ব ৪৫
জাবিন ফোরকান

– বিদ্রোহ।
ছোট্ট একটি তিন অক্ষরের শব্দ,তথাপি এর পটভূমিতে লুকায়িত অর্থ ব্যাপক।আসমান স্তব্ধ হয়ে অর্ধাঙ্গিনী মুখপানে চেয়ে রইলো।তার এমন বিধ্বংসী রূপ কিছুটা হলেও হৃদয়ে বিস্ময়ের উৎপত্তি ঘটিয়েছে।
– ন্যায়বিচার চাই আসমান। বোনের সম্ভ্রমের উপযুক্ত মূল্য চাই।
নির্বাক রইলো আসমান,হাতের সিগারেটটি বেডসাইড টেবিলে রেখে দিলো।তার অভিব্যক্তি একপ্রকার নির্বিকারই।
– যে পথে হাঁটতে চাইছো সে পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ উপলব্ধি করতে পারছো নিশ্চয়ই।
– পারছি।তবুও প্রতিজ্ঞায় অটল এই হৃদয়।বিজয় ছিনিয়ে না আনা অবধি টলবে না অঙ্গীকার।
– সংগ্রামের মাঠ কল্পনাতীত রোযা।যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।মোকাবেলা করার আগেই নিঃস্ব হবে। কুলহারা পথিকের ন্যায়।

আরামকেদারায় হেলান দিলো আসমান।উভয় হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙুল চেপে চিবুকে স্পর্শ করলো, তাকালো রোযার দিকে তীক্ষ্ণ আবেশিত দৃষ্টিতে।
– এই বিদ্রোহ যদি প্রারম্ভেই দমিত না হয় তবে তা আন্দোলনে রূপ নেবে, ন্যায়ের আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন,যুক্ত হবে সরকার এমনকি বিরোধী দলও। ভবিষ্যতবাণী করলাম। একবারও ভেবে দেখেছ কোন মহাকুণ্ডলীতে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছো তুমি?
এক মুহুর্ত ভাবলো রোযা।নিজের কোলের উপর ভাঁজ করে রাখা হাত দুটোর দিকে তাকালো।অতঃপর বিড়বিড় করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– ছেলেমেয়েগুলো খুব ভরসা করে আমার কাছে এসেছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দাবি নিয়ে।ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসতাম?কি শিখতো নতুন প্রজন্ম?ভীরুতা এবং কাপুরুষতা?ক্ষমতার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম ঠুকতে হয়। ন্যায় অন্যায়ের কোনো পার্থক্য নেই ক্ষমতায়।এমন এক আত্মধবংসী বীজ পুঁততাম তাদের অন্তরে?
মাথা তুলে তাকালো রোযা,মনোবল তার কঠোর। দৃষ্টিজুড়ে নেই সামান্যতম দুর্বলতার ছোঁয়া।সন্তুষ্ট হলো আসমান,যদিও অভিব্যক্তিতে প্রদর্শিত হতে দিলোনা।
– মুখে পট্টি বেঁধে ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকা সম্ভব নয়।হাতে অ*স্ত্র তুলে ভক্ষকদের বিনাশ করার সময় এটি।নারী জন্মদাত্রী, এই কোমলতার খোলসের অন্তরালে থাকা নারী বিনাশীনি উন্মোচনের পালা এবার।
– খুব ভালো বক্তা তুমি।চমৎকার তোমার উপলব্ধি।কিন্তু যু*দ্ধের ময়দানে বুলি দিয়ে লড়াই চলেনা রোযা, মনে রেখো।
সামান্য দুঃখ পেলো রোযা, বললো,

– সমর্থন না করতে পারো,অন্তত নিরুৎসাহিত করোনা।
– আমি নিরুৎসাহিত করছিনা।সত্য কথা বলছি।তুমি অনভিজ্ঞ,তোমার জানা থাকা দরকার এই জগৎ আদতে কোন নিয়মে আবর্তন করে।
আরামকেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আসমান,হাত বাড়িয়ে রোযার কপোল স্পর্শ করলো,স্নেহের ছোঁয়া বুলিয়ে নমনীয় কন্ঠে জানালো,
– আমি চাইনা তোমার কোনো ক্ষতি হোক।যে মহাযাত্রায় তুমি নিজেকে জড়াতে চাইছো সেখান থেকে তোমায় ফিরিয়ে আনার অধিকার আমার নেই।তুমি প্রাপ্তবয়স্ক,নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণের অধিকার তোমার রয়েছে।আর তোমার প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে।নিজেকে গড়তে পারলে গড়ো,কিন্তু ভেঙে ফেলোনা।

– আসমান….
হাতটি নিজের কপোলে চেপে ধরে অত্যন্ত আবেগ নিয়ে চাইলো রোযা তার চাঁদের উদ্দেশ্যে।
– আমি কি ভুল করছি?তুমি কি আমার পাশে থাকবে না?
কিছুক্ষণ নির্বাক থাকলো আসমান,তারপর হাঁটু মুড়ে রোযার সামনে বসলো।দূরত্ব ঘুচিয়ে দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে জবাব দিলো,
– তিক্ত হলেও সত্য আমি চাইনা তুমি এসবে নিজেকে জড়াও।
স্তম্ভিত হয়ে পড়ল রোযা।অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন যেন থমকে গিয়েছে। অধরে অধর চেপে টলটলে দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকলো আসমানের মুখপানে।হিমালয় তার আপন শীতলতায় আচ্ছন্ন।
– তুমি ফ্রন্টলাইনে।তোমার নির্দেশ,আন্দোলনের গতিবিধি।ভাবতে পারছো যদি সামান্যতম এদিক সেদিক হয় কতটা ভার জেঁকে বসবে তোমার কাঁধে?রাতের পর রাত তুমি ঘুমাতে পারোনা,দুঃস্বপ্ন তোমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।যদি এই ছেলেমেয়েগুলোর শরীরে একটা আঁচড় পরে,ক্ষমা করতে পারবে নিজেকে?জানি,পারবে না।তাই তোমাকে নিয়ে আমার খুব ভয় জ্যোৎস্না।

এগিয়ে এলো আসমান,বাকরুদ্ধ রোযাকে নিজের সুরক্ষিত বাহুডোরে বেঁধে তার কানে মৃদু কন্ঠে জানালো,
– এখনো সময় আছে।ফিরে এসো রোযা এই বিভীষিকাময় পথ থেকে।
আসমানকে পাল্টা আলিঙ্গন করলোনা রোযা,শুধু অভিযোগের সুরে বিড়বিড় করলো,
– আর যেই হোক,অন্তত তোমার কাছ থেকে আমি এমন ভীরুতা আশা করিনি আসমান।
কোনো জবাব দিলোনা অমানিশা,তার অন্তরের কথা অন্তরেই আবদ্ধ রইলো। রোযাকে ছেড়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো।আরামকেদারা থেকে নিজের জ্যাকেটখানা তুলে বিনা বাক্য ব্যয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাইরে।নিজের স্থানে বসে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো রোযা তার চলে যাওয়ার পথের দিকে।
আসমান তার সাথে নেই,তার চাওয়া রোযা ফিরে আসুক,অগ্রসর না হোক— এই উপলব্ধিটুকু চাঁদের জ্যোৎস্নাকে ভীষণ রকম ব্যাথিত করলো।

পরদিন।
ভার্সিটির উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ তৈরি রোযা।
কালো স্কার্ট আর শুভ্র কার্ডিগান জড়িয়েছে সে অঙ্গে।একটি স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিয়েছে। ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি টিজার,পেপার স্প্রে,ফার্স্ট এইড কিট এবং আসমানের ড্রয়ার থেকে নেয়া সুইস নাইফটি রাখতে ভুললোনা।আয়নায় নিজ প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করে দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করলো সে।আপন সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে সে।অহনার সুবিচার আদায় করে তবেই ঘরে ফিরবে।তাতে তার পাশে কেউ থাকুক বা না থাকুক।উল্টো ঘুরে রুম থেকে বেরোতে গিয়েই মুখোমুখি হলো আসমানের।গতকাল বেরিয়ে যাওয়ার পর বাসায় ফেরেনি সে,কোথায় ছিল জানা নেই কারো। রোযাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো আসমান,দৃষ্টি বিনিময় ঘটলো দ্বৈরথপূর্ণ। কোনোপ্রকার মন্তব্য না করে রুমে ঢুকে পড়ল সে, রোযাও কোনো কথা বললোনা।চুপচাপ এগোলো।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতেই নজরে এলো দৃশ্যটি।সদর দরজা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেছে নিহাদ।আশেপাশে তাকিয়ে রোযাকে নজরে পড়তেই ছুটে এলো।ভীষণ উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে,শীতের মাঝেও কপালে ঘামের ফোঁটা স্পষ্ট।মুখের অভিব্যক্তি কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত।
– এটা কি সত্যি রোযা?
অতর্কিতে রোযার মুখের সামনে নিজের ফোন ঠেলে দিলো নিহাদ। তা কোনোমতে পাকড়াও করে রোযা দেখলো।
“ মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির বর্বরতা—অহনা”
হেডলাইনটির সঙ্গে যুক্ত ছবিগুলো অত্যন্ত রোমহর্ষক।কিছু কিছু এতটাই বীভৎস যে ঝাপসা করে দেয়া হয়েছে স্থানে স্থানে।সোশাল মিডিয়া উন্মাতাল এই একটিমাত্র খবর নিয়ে।সন্তুষ্ট হলো রোযা,অভিষেক এবং আরিয়ান নিজেদের কাজ সুসম্পন্ন করেছে।
মুখ তুলে নিহাদের দিকে তাকালো রোযা,ফোন ফিরিয়ে দিয়ে নির্বিকার কন্ঠেই জানালো,

– হুম।সত্যি।
ব*জ্রাহত হলো যেন নিহাদ,অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে থাকলো রোযার উদ্দেশ্যে।নিষ্পাপ নয়নজুড়ে তার আঁধার খচিত হলো,যেন ওই দৃষ্টি চিৎকার করে বলতে চাইছে রোযা অস্বীকার করুক,এসব সত্যি না হোক।কিন্তু ভাগ্য কি আর তা হতে দেয়?নিহাদের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ করে দিয়ে রোযা আবারো বললো,
– সবকিছু সত্যি নিহাদ।সামান্যতম মিথ্যা নেই।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এই বুঝি চিৎকার করে উঠে নিহাদ,তার অধর ফাঁক হলো ঠিকই,কিন্তু নির্গত হলো শুধুমাত্র দুইটি শব্দ।

– ওহ আচ্ছা।
আপন জগতে যেন বিলীন ঘটেছে নিহাদের। উল্টো ঘুরে সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো,তৃতীয় ধাপ পেরোতেই আনমনে হোঁচট খেলো।নিজের ঘর থেকে কফির মগ নিয়ে বেরিয়ে আসা চারুলতা লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে হাতের বাঁধনে তার পতন ঠেকালো।
– আরে চোখের মাথা খেয়েছ?অন্ধ নাকি তুমি?
– ধন্যবাদ।
স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করে নিহাদ চারুলতাকে এড়িয়ে এগিয়ে গেলো,তারপর চুপচাপ সোফায় বসে থাকলো।একদৃষ্টে দেখতে লাগলো ফোনের স্ক্রীন।হতভম্ব চারুলতা বিড়বিড় করলো,

– ব্যাপারটা কি হলো?আজকে আমাকে পেত্নী বলে অপমান করলো না!চিন্তার বিষয় দেখছি।
রোযা সিঁড়ির নিচে নেমে বললো,
– বোধ হয় মানুষের পাশ*বিকতা ওকে নির্বাক করে দিয়েছে।
একটি নিঃশ্বাস ফেলে চারুলতা শুধালো,
– তোমার ভার্সিটির ঘটনাটা তাহলে সত্যি?
– হুম।
– কিছু করছো না তোমরা?
– ক্লাস বয়কট করছি আজ থেকে।
চারুলতা মাথা দোলালো।
– অল দ্যা বেস্ট।কোনকিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানিও,সাহায্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
মৃদু হেসে নিঃশব্দে সম্মতি জানিয়ে রোযা এগোলো দৃপ্ত পদক্ষেপে,বাইরে গাড়ি অপেক্ষমাণ।তার চলে যাওয়া পথের পানে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে বসে রইলো নিহাদ, সম্পূর্ণ শান্ত অবয়বের অভ্যন্তরে চলা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের উপস্থিতি কেউ টের পেলোনা,একমাত্র চারুলতা ছাড়া।

অতঃপর অতিবাহিত হলো তিনদিন।অহনার ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরতে চাওয়া প্রায় সকল পোস্ট রিমুভ করা হয়েছে।যদিও থেমে থাকেনি কার্যক্রম।সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে এখনো।তবুও ঘটনাটির ঠিক যেমন আকর্ষণ পাওয়ার কথা তা পাচ্ছেনা এক ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ইস্যুর কারণে।বিষয়টিকে ইচ্ছাকৃতভাবে বড়ো আকারে উপস্থাপন করা হচ্ছে অহনার ব্যাপারটি ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে।দেশের কোনো বড় মিডিয়াই এখনো পর্যন্ত এই ঘটনার কোনো কভারেজ করেনি।

দমে যায়নি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাওয়া ছোট্ট দলটি।প্রথম দিন মাত্র পাঁচজন মিলেই ভার্সিটি প্রাঙ্গণে তারা বয়কটের আন্দোলন চালিয়েছে।ব্যাপারটা প্রদর্শিত হয়েছে খুব হাস্যকরভাবে।সুবিস্তৃত ক্যাম্পাসে কাঠফাটা রোদের মাঝে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকা পাঁচজন তরুণ তরুণী সকলেরই হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে।জিশান এবং তার দল সুউচ্চ ভবন থেকে তাদের উপর ময়লা আবর্জনা ফেলে মজাও নিয়েছে বেশ।লজ্জিত হয়েছে সকলে ভীষণ। ভাবা হয়েছিল পরদিন থেকেই শুধরে যাবে।কিন্তু দ্বিতীয়দিন যখন আবারো সেই পাঁচজন ওই একইভাবে ন্যায়ের দাবি নিয়ে দিবাকরের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বসলো,তখন কিছুটা হলেও নজর কাড়লো।অন্তর কাপলো অহনার অন্যান্য সহপাঠীদের। বোনের সুবিচারের জন্য সর্বপ্রকার হেনস্তা সহ্য করেও তাদের সহপাঠীরা লড়াই করছে,আর এদিকে তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুমে বসে লেকচার শুনে সেই কষ্টের প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাচ্ছে?বিবেক দংশন করলো ভীষণভাবে। দ্বিতীয়দিন প্রথম বর্ষের সকল শিক্ষার্থীই বয়কটের ডাকে সামিল হলো।পাঁচজন থেকে পরিণত হলো তারা বাহাত্তর জনে।

তবুও টললো না ক্ষমতাধর মহীধর।তৃতীয় দিন জিশান প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেক ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে শাসিয়ে গেলো সবাইকে,যদি এই আন্দোলনে সামান্যতম সহযোগীতাও কেউ করে তাকে ছেড়ে দেয়া হবেনা।অতিরিক্ত রোদে বসে থাকায় আরিয়ানকে শুধু এক বোতল পানি খেতে দিয়েছিল চতুর্থ বর্ষের জিশানেরই এক সহপাঠী ছেলে,তাকে প্রাঙ্গণের মাঝেই যাচ্ছেতাইভাবে পি*টুনি দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তাই আতঙ্কে তটস্থ মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির প্রত্যেক শিক্ষার্থী।একপ্রকার ঘোরের মাঝে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কেটেছে এই তিনটি দিন।
চতুর্থ দিন।
বাহাত্তর জন কমে সংখ্যাটা আটচল্লিশে এসে ঠেকেছে। ভয়ে অনেকেই নিজেদের হটিয়ে নিয়েছে।তবুও দমে যায়নি কেউই।শিক্ষার্থীদের সামনে পায়চারি করতে করতে কিছু বলতে থাকা রোযার পিছনে এসে দাঁড়ালো কয়েকজন কর্মকর্তা।

– রোযা,আরিয়ান,অভিষেক,মালিহা আর সাবিহা…. তোমাদের এক্ষুণি প্রিন্সিপালের কেবিনে যেতে হবে।কুইক।
যেন এই ক্ষণটিরই অপেক্ষায় ছিল সকলে।রোযা দৃঢ়চিত্তে মুখোমুখি হলো তাদের,
– আমি,অভিষেক আর মালিহা আসছি।বাকিদের দরকার নেই।
– অযথা তর্ক করে….
কর্ণপাত পর্যন্ত করলোনা রোযা।তার অনুসরণে অভিষেক আর মালিহা নিজেদের স্থান ত্যাগ করে হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করলো প্রিন্সিপালের অফিসকক্ষের উদ্দেশ্যে।
অফিস কক্ষে প্রবেশ করতেই প্রিন্সিপালের পাশাপাশি কয়েকজন প্রফেসরকে লক্ষ্য করা গেলো।এনারা শিক্ষার্থী মহলে বেশ পরিচিত এবং প্রিয় মুখ।তাদের যে ব্রেইন ওয়াশ করার উদ্দেশ্যে এখানে আনা হয়েছে সুস্থ অনুধাবন করলো রোযা।তবুও এগোলো,যথারীতি সবাইকে সালাম প্রদান করলো। শুভ্র স্যুট পরিধানকৃত প্রিন্সিপাল নিজের ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সকলের উদ্দেশ্যে।নিজে থেকে কিছু বললেন না।এগোলেন সকলের প্রিয় অল্পবয়সী তরুণ প্রফেসর জাহিদ।

– স্টুডেন্টস।সবাই ভালো আছো?
– আমাদের রোদে পোড়া চেহারা দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কতটা ভালো আছি স্যার!
অভিষেকের জবাবে জাহিদ সামান্য বিব্রতবোধ করলেন। নাক চুলকে গ্রীবাদেশে জড়ানো টাইখানা ঢিলে করে বললেন,
– দেখো বাচ্চারা,আমরা তোমাদের কষ্ট দিতে চাইনা।তোমরা এক অমূলক দাবি নিয়ে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছ,তাতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং তোমাদের শিক্ষাজীবন উভয়েরই ক্ষতি হচ্ছে।আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং ভালো থাকা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত।
– এতটাই চিন্তিত স্যার?তাহলে আসুন,ক্ষমতার পায়ে চুম্বন করা মেরিডিয়ান কর্তৃপক্ষের খোলস ছেড়ে আপনার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সড়কে বসুন,দেখিয়ে দিন আপনিই সত্যিকারের আদর্শ শিক্ষক!অন্যায়ের প্রতিবাদে ন্যায়ের সঙ্গী হন।পারবেন কি?
মালিহার প্রশ্নে সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লেন জাহিদ।তার অভিব্যক্তিজুড়ে এক বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো।এবার অন্য একজন প্রফেসর অগ্রসর হলেন, তিনি তুলনামূলক বয়স্ক।

– ছেলেমেয়েরা।তোমরা বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করো।আমরা তোমাদের ভালো চাই বলেই বলছি।কর্তৃপক্ষের উপর অর্ডার রয়েছে,এটা সরকারের নির্দেশ।আমরা তো আর রাষ্ট্রের আদেশের ব্যতিক্রম কিছু করতে পারিনা তাইনা?
– অন্যায়কে অন্যায় বলার সুযোগ যে রাষ্ট্র দেয়না সে রাষ্ট্রের নির্দেশের মূল্য কতটুকু?
সাবিহা প্রশ্ন করলো।তাতে স্তব্ধ হলো সকলে মুহূর্তের জন্য।
– আমরা কর্তৃপক্ষ।আমাদের তোমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও ভাবতে হয়।

– নিরাপত্তা?কোথায় নিরাপত্তা আমাদের?জিশান আহসান যেখানে মুক্ত স্বাধীন পাখির ন্যায় সম্পূর্ণ ক্যাম্পাস বিনা বাঁধায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে,কারণে অকারণে ধরে সবাইকে শাসিয়ে চলেছে,সেখানে নিরাপত্তার দোহাই দেয়া হাস্যকর নয় কি স্যার?কোথায় ছিল এই নিরাপত্তা যখন বিশ্ববিদ্যালয়েরই হলে আমার বোন অহনাকে নৃশং*সভাবে হ*ত্যা করা হয়েছে?কোথায় ছিল এই নিরাপত্তা যখন তার বিভৎস লা*শ মধ্যযুগের বর্বরতার মতন ঝু*লিয়ে রাখা হয়েছে রেলিংয়ে?আমার বোনের সম্ভ্রমের নিরাপত্তা কেনো দিতে পারেনি আমার বিদ্যাপীঠ?
রোযার বক্তব্য সম্পূর্ণ কক্ষজুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো বারংবার,যেন প্রশ্নবিদ্ধ করলো বিবেককে।পিনপতন নীরবতা নেমে এলো সম্পূর্ণ কক্ষজুড়ে।তীব্র নৈঃশব্দ্য।কোনো জবাব নেই প্রশ্নের।প্রিয় প্রফেসরদের অনুরোধেও কাউকে অঙ্গীকার হতে টলানো যাচ্ছেনা অনুধাবন করে প্রিন্সিপাল একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলেন।নিজের কপালে তর্জনী ঠেকিয়ে জানালেন,
– ঠিক আছে।এই যদি তোমাদের শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে ওকে।আমরা সাবধান করেছিলাম, পরবর্তীতে যা হবে তাতে মেরিডিয়ান কর্তৃপক্ষ কোনো দায়ভার বহন করবেনা। প্রফেসরগণ সাক্ষী।

– আপনার কথাগুলো হুমকির মতন কেনো শোনাচ্ছে স্যার?
রোযা প্রশ্ন করতেই প্রিন্সিপালের অধরে তীর্যক হাসি ফুটলো,একটি খাতা টেনে কলমের ক্যাপ খুলে জানালেন,
– রোযা রহমান চড়ুই,ওরফে রোযা রেমান।আমাদের বিদ্রোহী নেত্রী,স্টাডি গ্যাপের পরেও অসাধারণ রেজাল্ট এবং প্রতিভার কারণে জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টে ভর্তি গ্রহণ করা হয়েছে।অবশ্যই এমন অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়ার জন্য নয়।কি মনে হয় রোযা?তোমার ক্ষমতাবান পরিবার তোমাকে রক্ষা করতে পারবে?রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকের চাইতে অধিক ক্ষমতাশালী তারা?
মৃদু হাসলো রোযা, প্রিন্সিপালের টেবিলের নিকটে সরে দাঁড়িয়ে জানালো,

– ক্ষমতাশালী কিনা জানিনা,তবে অবশ্যই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকের সামনে নতজানু নয় তারা।
কলমে প্রিন্সিপালের আঙুলসমূহ চেপে বসলো।অতি জোরের সঙ্গে তিনি কাগজে কলম ঠেসে লিখে চললেন,
– জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রোযা, অভিষেক, আরিয়ান, মালিহা এবং সাবিহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা সৃষ্টি করার অপরাধে মেরিডিয়ান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাদের ভর্তি বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কৃত ঘোষণা করা হলো!

– আমাদের বোনের সম্ভ্রম হরণ এবং বর্বর হ*ত্যার সুবিচার আদায় না করে ঘরে ফিরবো না আমরা।বহিষ্কার করে লাভ নেই স্যার,এটা আমাদের বিদ্যাপীঠ, একে সংশোধন করার দায়িত্বও আমাদের।
দৃঢ় কন্ঠে যেন ঘোষণা করলো অভিষেক।তাতে প্রিন্সিপাল তেঁতে উঠে ধমক দিলেন,
– শাট আপ!তোমাদের প্রত্যেকের পরিবারের কাছে অভিযোগ করা হবে।অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে,তাই বলে ভেবোনা মাথায় উঠে গিয়েছ।
স্বাক্ষর করতে গেলেন প্রিন্সিপাল বহিষ্কারনামায়, কিন্তু পারলেন না। রোযা ঝুঁকে দুহাত স্থাপন করলো টেবিলের উপর,তার দিকে চেয়ে বিনা কারণেই স্থবির হয়ে পড়লেন প্রিন্সিপাল।মেয়েটির নয়নজুড়ে খচিত যেন অগ্নিশিখা,তাতে অগ্ন্যুৎপাতের উদগীরণ।বি*স্ফো*রণ ঘটাচ্ছে আতঙ্কের সর্বাঙ্গজুড়ে।
– কি হলো স্যার?করুন সাইন।বহিষ্কার করুন আমাদের।

সামান্য কম্পিত হলো প্রিন্সিপালের হাত,কিঞ্চিৎ অসহায় ভঙ্গিতে আশেপাশের প্রফেসরদের উদ্দেশ্যে তাকালেন।সকলেই হতবিহ্বল।নিজের অন্তরকে কঠোর করে তিনি যেই না কাগজে পুনরায় কলম ছুঁইয়ে দিলেন,ঠিক ওই মুহূর্তেই বাহির থেকে খানিক কোলাহলের শব্দ ভেসে এলো।প্রত্যেকে খানিক চিন্তিত হয়ে ফিরে চাইলো।কেমন যেন অস্বস্তি ঠেকলো রোযার, তাই দৌঁড়ে বের হলো অফিসকক্ষ থেকে।অনুসরণে বাকিরা।করিডোর ধরে ছুটে প্রাঙ্গণের নিকটবর্তী হতেই সামনের দৃশ্য লক্ষ্য করে সম্পূর্ণ জমে গেলো সবাই।

শক্ত পাথরের প্রাঙ্গণের মাঝে পরে আছে আরিয়ান, তাকে ঘিরে ধরেছে জিশানের সাঙ্গপাঙ্গের দল, নেতৃত্বে রাকিব।হাতে ধা*রালো চা*পাতি,যেটা দিয়ে এলোপাতাড়ি জ*খম ক*রে চলেছে আরিয়ানকে!র*ক্তে রঞ্জিত বেচারার সর্বাঙ্গ,হাত দিয়ে ঠেকানোর প্রচেষ্টা করছে আঘা*ত,তাতে ঘটছে হিতে বিপরীত। আশেপাশের সকলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে পলায়নের চেষ্টায়,সাবিহার চুলের গোছা ধরে টেনে ফেলা হয়েছে মাটিতে।লাঠিসোটা এবং ধা*রালো অ*স্ত্র নিয়ে উদ্যত জিশানের দল,যদিও জিশান স্বয়ং উপস্থিত নেই।

নিজের মাঝে তড়িৎ খেলে গেলো যেন রোযার।কিছু বোঝার আগেই অনুভব করলো তার শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে টেনে নিলো প্রতিহিংসার কেন্দ্রবিন্দুতে।তীব্র বাঁধা উপেক্ষা করে র*ক্তা*ক্ত আরিয়ানের শরীর জড়িয়ে ধরলো,যেন তার ভাইটিকে আর কেউ আঘা*ত করতে না পারে।রাকিবের চা*পাতি সজো*রে আ*ছড়ে পড়লো রোযার কপালে,মাথা ফে*টে ঝরঝর করে ঝরলো রক্তিম তরল,তবুও আরিয়ানকে ছাড়লোনা রোযা।
সম্পূর্ণ মেরিডিয়ান প্রাঙ্গণ যেন এক লহমায় কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।বায়ুতে র*ক্তের গন্ধ!চিৎকার, চেঁচামেচি,আর্তনাদ এবং হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে বায়ু।ছত্রভঙ্গ তারুণ্য অতর্কিতে আগত ঘা*তকদের নিপীড়নে জর্জরিত।একটি ব্যক্তিও এগিয়ে এলোনা কর্তৃপক্ষের।মালিহা, অভিষেক উভয়েই দৌড়ে এলো নিজেদের ভাইবোনদের রক্ষায়।বিন্দুমাত্র লাভ হলোনা,উল্টো তাদের উপরেও চড়াও হলো লাঠিয়াল বাহিনী।বাইরের পার্কিং এরিয়া থেকে গোলমাল পর্যবেক্ষণ করে তড়িৎ গতিতে ছুটে এলো হাবিব, কিন্তু ভিড় ভাট্টা এবং গণ্ডগোলের কারণে রোযার নিকট পৌঁছতে বেশ একপ্রকার যু*দ্ধে লিপ্ত হতে হলো তাকে।

নিজের মাঝে আরিয়ানকে চেপে ধরে রেখেছে রোযা, তার কাছ থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে র*ক্তস্না*ত ছেলেটিকে,তবুও ছাড়তে নারাজ রোযা।আঘা*তে আঘা*তে তার শরীর ভেঙে আসছে রীতিমত, পা*ষণ্ডের দল কি নারী কি পুরুষ কাউকেই রেহাই দিচ্ছেনা।
– ইয়া আল্লাহ! তুমি এর বিচার করো!
প্রতিধ্বনিত হলো কারো ভগ্ন কণ্ঠস্বরের আর্তনাদ সমগ্র প্রাঙ্গণজুড়ে। গগনও যেন আজ বিষাদে শামিল হয়েছে,ঘন কালো মেঘপুঞ্জে আচ্ছাদিত হয়ে।থেকে থেকে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে,যার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে দিনটির ভয়ংকর এক বিভীষিকা।

– আর করবি আন্দোলন?আর করবি?সব কুত্তার ছাওগুলা!
অশ্রাব্য আওয়াজ তুলে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে চারিপাশে।রোযার কঠোর চিত্তেও তা চির ধরালো।কোলে আগলে রাখা আরিয়ানের ম্রিয়মাণ অবয়ব তার নয়নে অশ্রুপাত ঘটালো।এই কি তবে অন্যায়ের প্রতিবাদের প্রতিদান?ন্যায় কি আজীবন এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়বে?

ঠিক যেমন জিশানের দল অতর্কিতে হাম*লে পড়েছিল, তেমন অতর্কিতেই ঘটলো ঘটনাটি।ভূকম্পন হলো যেন রীতিমত,পরমুহুর্তেই মৌমাছির ঝাঁকের মতন ছুটে আসা তরুণ তরুণীদের দেখা মিললো।মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির মূল ভবনের ফটক গলে দৌঁড়ে আসছে অন্যান্য সকল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা।এক বিরাট জমায়েত যেন। পাষণ্ডের দল থমকে পড়লো হঠাৎ এই গণ বি*স্ফো*রণ লক্ষ্য করে।তাদেরও অন্তর কাপলো।পিছনের হলের ভেতর থাকা শিক্ষার্থীরাও একে একে দৌড়ে আসছে,হাতে লাঠি, খুন্তি,হকিস্টিক,ক্রিকেট ব্যাট,হাতুড়ি,এমনকি শক্ত মলাটের বই – খাতা – ছাতাও….যে হাতের সামনে যা পেয়েছে তাই নিয়ে এসেছে।সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে আজ।ভাইবোনের র*ক্তে রঞ্জিত হয়েছে বিদ্যাপীঠ।এতেও যদি রুহ না কাপে তাহলে নিজের কাছে নিজেরই মনুষ্যত্বের পতন। বাঁধ ভেঙেছে আজ সহ্যের, উপচে পড়েছে প্রতিবাদের হুংকার।এক মুহুর্ত নিজের নয়নকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলোনা রোযা।ছোট ভাইবোনদের রক্ষায় এগিয়ে আসছে সবাই?আদও কি সত্যি নাকি দৃষ্টিভ্রম?

কোনোকিছুই দৃষ্টিভ্রম নয় তা প্রমাণিত হলো যখন জিশানের নিজের সহপাঠী,চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররাই আরিয়ান এবং রোযার কাছ থেকে টেনে সরিয়ে ফেললো আ*ক্রমণকারীদের।এক মহাযু*দ্ধের সূত্রপাত ঘটলো যেন চারিপাশ জুড়ে।এ যেন লড়াই ক্ষমতা এবং ন্যায়ের! যাদের চিত্ত আজ পর্যন্ত নড়েনি, ভয়ে কোণঠাসা হয়ে থেকেছে সর্বাবস্থায়,আপন ভাইবোনদের তাজা র*ক্ত যেন তাদের শৃঙ্খলকে এক লহমায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে।উন্মুক্ত করেছে নবজাগরণকে।এই তারুণ্য মুক্তি পেয়েছে,আর যেন কোনোক্রমেই দমবার নয়।
হট্টগোলের মাঝে রোযা আরিয়ানকে যথাসম্ভব আগলে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত হলো, ভিড়ভাট্টার মধ্য থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কাছে পৌঁছলো মালিহা।ঘর্মাক্ত, আ*ঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় কোনক্রমে পৌঁছলো অভিষেকও।

– আরিয়ানের অবস্থা ভালো না,ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।
মালিহা কাদতে কাদতে বললো।অসহায় দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো।কর্তৃপক্ষ কিংবা নিরাপত্তা প্রদানের একটা মানুষকেও নজরে পড়ছেনা।তারা ঠিকই নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছে চার দেয়ালের মাঝে।অবশেষে হাবিব পৌঁছতে সক্ষম হলো রোযার নিকট,বেচারীর মাথা এবং সারা শরীরের ক্ষ*ত লক্ষ্য করে ক্রোধ তরঙ্গ খেলে গেলো তার মাঝে।দ্রুত এগোলো,গর্জন তুলে জানালো,

– আমি আপনার একটা কথাও শুনবো না ম্যাম!আপনি এক্ষুনি আমার সঙ্গে এই স্থান ত্যাগ করবেন!
হাবিবকে দেখে যেন আশা খুঁজে পেলো রোযা, উচ্চকন্ঠে চিৎকার খুললো,
– জলদি, গাড়ি বের করুন হাবিব।হাসপাতালে যেতে হবে।
রোযার কোলে শায়িত মুমূর্ষু ছেলেটিকে লক্ষ্য করে হাবিবের অন্তর হুহু করে উঠলো যেন।মাথা দুলিয়ে বলল,
– আপনারা আসুন প্লীজ,আমি সবাইকে নিরাপদে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাই।
– আরিয়ান ভাই আমার,প্লীজ চোখ খোলা রাখো।
আরিয়ানের দুগাল চাপড়ে ভগ্ন কন্ঠে বললো রোযা।মিটমিট করছে ছেলেটির চোখের পাতা,বুক ওঠানামা করছে অস্বাভাবিকভাবে।

– আমি কি…. ম*রে যাবো…. রোযা আপু?
– একদম না!
জবাব দিতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললো মালিহা।রোযা কিছু বলতেও পারলোনা,সর্বাঙ্গ কাপতে লাগলো তার।অভিষেক হুমড়ি খেয়ে পড়ল,
– না দোস্ত!একদম না….তোকে আমরা ম*রতে দেবোনা! প্লীজ,একটুখানি সময় দে,তুই ঠিক হয়ে যাবি…
নিজের কাঁধে আরিয়ানের শরীর টেনে তুললো অভিষেক, তারপর ছুটলো হাবিবের পিছনে,অনুসরণ করলো রোযা এবং মালিহাও।একটু পরেই যুক্ত হলো সাবিহা,সে যাচ্ছে না,এখানে উপস্থিত থাকা তার দায়িত্ব।তার আহ্বানে অন্যান্য সকল ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টি লক্ষ্য করে এগিয়ে এলো,চারিপাশে ব্যারিকেডের মতন দাঁড়িয়ে আরিয়ানকে নিরাপদে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে সহযোগীতা করলো। গাড়িতে ওঠার আগে একবার বিদ্ধস্তপ্রায় সাবিহার দিকে চাইলো রোযা,যার হাতে এক খাবলা ইট শোভা পাচ্ছে।তার দ্বিধাদ্বন্দ্ব বুঝতে পেরে সাবিহা এগিয়ে এলো,

– আপু তুমি যাও,আরিয়ানের কাছে থাকাটা অধিক জরুরী এই মুহূর্তে।আমাদের চিন্তা করোনা,এখানে আমি আছি।আমরা আর একা নই আপু,আমাদের সঙ্গে এখন সবাই আছে!
সামান্য হাসলো মেয়েটি,উৎসাহ দেয়ার উদ্দেশ্যে।এক ফোঁটা অশ্রু গড়ালো রোযার কপোল বেয়ে,মাথা নেড়ে উঠলো গাড়িতে।
– প্লীজ সবাই নিরাপদ থেকো।
– তোমরাও আপু।আরিয়ানের কিছু হতে দিওনা।
ক্রদনরত কন্ঠে অনুরোধ করলো সাবিহা।আর দেখা সম্ভব হলোনা।হাবিব দ্রুত স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ভিড় এড়িয়ে আঁকাবাকা গতিতে মূল সড়কে এসে থামলো।সুদূর থেকে ভেসে আসছে সাইরেনের আওয়াজ,বোঝা গেলো পুলিশ আসছে।কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই রোযার,তার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকা আরিয়ানের মুখটার দিকে চেয়ে রোযা নতুনভাবে উপলব্ধি করলো—র*ক্ত ঝরে গিয়েছে, আর পিছিয়ে আসা অসম্ভব!

হেলথ প্লাস হসপিটাল।
আরিয়ানকে নিয়ে ঢুকতেই সমগ্র হাসপাতালজুড়ে কলরব পরে গেলো যেন।তার বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত এই হাসপাতাল,পরিচিত ডাক্তারদের হতবিহ্বল হওয়ারই কথা। রিসিপশনিস্ট কোনোপ্রকার ভর্তি প্রক্রিয়ায় সময় ব্যয় না করে তড়িৎ গতিতে কয়েক জায়গায় ফোন করলেন।দ্রুত কেবিনবয় স্ট্রেচার নিয়ে ছুটে এলো।অভিষেক এবং মালিহা উভয় তাদের সঙ্গে গেলো।ইতোমধ্যে দুইজন ডাক্তারও এসে পড়েছে, অতি দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে উপলব্ধি করে রোযা সামান্য স্বস্তিবোধ করলো।

শরীরের সব শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে এসেছে তার, প্রচণ্ড ইচ্ছা সত্ত্বেও আরিয়ানকে অনুসরণ করে যাওয়া সম্ভব হলোনা।গেলেও লাভ হবেনা,একটু পর ডাক্তারই তাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলবে।ধপাস করে দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত চেয়ারে বসে পড়ল রোযা।সমস্ত শরীর তার থরথর করে কাপছে এখনো পর্যন্ত।দুহাত জুড়ে লেপ্টে রয়েছে আরিয়ানের তাজা র*ক্ত!দুঃসহ সব স্মৃতি তাড়া করে বেড়ালো যেন তাকে।কিভাবে আরিয়ানকে এলোপাতাড়ি কো*প দি*য়ে চলেছিল, কিভাবে মেয়েগুলোর চুলের গোছা ধরে আছ*ড়ে ফেলছিল মাটিতে…..এই কি তবে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য?যদি আজ ভার্সিটির অন্যান্য শিক্ষার্থীরা এগিয়ে না আসতো তবে একটি গণক*বর রচনা হতো,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।ক্রোধ,অনুশোচনা,অপরাধবোধ, দুর্বলতা,বেদনা সবকিছুর মিশ্র অনুভূতি রোযার অভ্যন্তরে যেন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।কপাল বেয়ে নামা জমাট বাঁধা র*ক্তের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে চলেছে অশ্রুরেখা।

হাবিব ঠিক তার পাশেই অবস্থান করছে,দ্রুত হেঁটে রিসিপশনিস্টের সঙ্গে আলাপ সারলো রোযা এবং বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য।আশেপাশে উপস্থিত গুটিকতক মানুষ বারংবার ফিরে ফিরে বসে থাকা রোযাকে দেখছে,ঠিক কি কারণে তা প্রথমে বুঝতে না পারলেও হাবিবের প্রচেষ্টায় জানা গেলো তাদের ভার্সিটিতে হওয়া গোলমালের খবর এবং ভিডিও সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে ইতোমধ্যে সকলের ফোনের স্ক্রীনে পৌঁছে গিয়েছে।ব্যাপারটা ভালো হলো নাকি মন্দ তা বিচারের সময় কিংবা মনোবল কোনোটিই আপাতত কারো নেই।
হঠাৎই ঘটলো ঘটনাটি। ভারী পদক্ষেপের আওয়াজে আপন সম্মোহনের দুনিয়া হতে বাস্তবে পদার্পণ করে রোযা ঘুরে তাকালো।হাসপাতালের রিসিপশনে প্রবেশ করতে দেখা গেলো নিহাদকে। বাদামী জ্যাকেট এবং কালো প্যান্ট পরিধানে,ভারী বুটজোড়ায় প্রতিধ্বনি তুলে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে হনহন করে।রোযার উপর নজর পড়তেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো।আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো তাকে।

পরিধানের শুভ্র কার্ডিগান রোযার রক্তিম ধারায় সিক্ত। ভগ্নপ্রায় অবয়ব,বিদ্ধস্ত দৃষ্টি।মলিন ঘর্মাক্ত মুখে র*ক্তের ছোঁয়া।বিশেষ করে কপালের অংশে ক্ষতটি বেশ নজরে লাগছে,র*ক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে এসেছে আশেপাশে।নিহাদ ধীরপায়ে এগোলো,অতঃপর এক হাঁটু ভাঁজ করে রোযার সামনে বসলো।ছেলেটির দৃষ্টির নিষ্পাপতা লুটায়িত হয়েছে,তাতে বর্তমানে সীমাহীন কঠোরতা।হাত উত্তোলন করে আলতো করে রোযার কপাল ছুঁয়ে দিলো নিহাদ,তারপর কি যেন মনে করে দ্রুত পকেট থেকে নিজের ফোন বের করলো।একটি ভিডিও বের করলো,রোযার সামনে ধরতেই হতভম্ব রোযা খেয়াল করলো তাদের ভার্সিটির ভিডিও এটি।আরিয়ানকে মা*রা*র সময়ে কেউ উপরের করিডোর থেকে ভিডিওটি করেছে।যেখানে ঝাপসা হলেও বোঝা যাচ্ছে রোযাকে,আরিয়ানকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, একের পর এক আঘা*ত আসছে তার উপরেও।নিহাদ আঙুল দিয়ে দেখালো চা*পা*তি হাতে থাকা ছেলেটিকে,

– এটা কে?
তিরতির করে কাপলো রোযার অধর,সামান্য দ্বিধা ঝেড়ে জানালো,
– রা…রাকিব, জিশান আহসানের সহচর।
স্পষ্টত নিহাদের আঙুলসমূহ ফোনের মাঝে চেপে বসতে দেখা গেলো।মুঠো পাকিয়ে তা পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালো নিহাদ, অবয়বজুড়ে তার অত্যন্ত অশুভ প্রভাব।
– কোথায় যাচ্ছ নিহাদ?
জবাব এলোনা।উল্টো ঘুরে নিহাদ হাবিবের কাছে পৌঁছলো, কাঁধে হাত রেখে বললো,
– আসমান ভাই আসছে,রোযার খেয়াল রেখো।বাকি সবারও….

এটুকুই। হেঁটে নিহাদ সোজা বেরিয়ে গেলো হাসপাতালের বাইরে, একটাবারও আর পিছন ফিরে তাকালোনা।কাচের দেয়াল ভেদ করে দৃশ্যমান পটে রোযা খেয়াল করলো নিজের বাইকে চেপে হেলমেট চড়িয়েছে নিহাদ,হ্যান্ডেলে হাত রেখে ইঞ্জিনের গর্জন তুলে অত্যন্ত দ্রুত বাতাস কে*টে ছুটে গেলো তার বাইকখানি।

নিহাদের বাইক চলে যেতেই একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ থামলো।হন্তদন্ত হয়ে অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এলেন এক অভিজাত পুরুষ এবং অনুসরণে মধ্যবয়স্ক নারী। উভয়ে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করতেই রিসিপশনিস্ট এবং কর্মচারীগণ তাদের সালাম দিলো।বোঝা গেলো আরিয়ানের বাবা মা এনারা।একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মহিলা হুট করে বসে থাকা রোযার উদ্দেশ্যে তাকালেন।তার নয়নজুড়ে এক তড়িৎ খেলে গেলো যেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে পরিস্থিতি উপেক্ষা করেই সর্বসম্মুখে রোযাকে চড় দিলেন!বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলো না রোযা,শুধু নির্বিকার চেয়ে রইলো। হাবিব পাশে থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারেনি মহিলা এমন কাজ করে বসবেন,দৃশ্যটি লক্ষ্য করে দ্রুত সে রোযাকে আড়াল করে দাঁড়ালো।স্থির চেয়ে আছে সকলে।মহিলা তা উপেক্ষা করেই চিৎকার ছুঁড়লেন,

ডার্কসাইড পর্ব ৪৪

– সব তোমার দোষ!আজ যদি আমার ছেলের কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে কথা বলব না মেয়ে!
কোনোপ্রকার উত্তর করলোনা রোযা,চেয়ে থাকলো শুধু প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে।

ডার্কসাইড পর্ব ৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here