ডার্কসাইড পর্ব ৪৬

ডার্কসাইড পর্ব ৪৬
জাবিন ফোরকান

– আপনার ছেলে অন্যায়ের প্রতিবাদে আপোষহীন হয়ে নিজের র*ক্ত ঝরিয়েছে,জন্মদাত্রী হিসাবে আপনি স্বার্থক।গর্ব করা উচিত আপনার,অন্যকে দোষারোপ করা নয়।
কণ্ঠস্বরটি হাসপাতালের রিসিপশনে উপস্থিত প্রত্যেকের অন্তরে দোলা দিয়ে গেলো যেন।ঘুরে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকলো রোযা।শুভ্র সোয়েটশার্ট এবং কালো ফরমাল প্যান্ট পরিধানে এগিয়ে আসছে আসমান, অনুসরণে চারুলতা।আসমানের নিগূঢ় দৃষ্টি প্রশান্ত হলেও চারুলতার মাঝে উদ্ভ্রান্ত মনোভাব স্পষ্ট। উভয়ে থমকালো রোযার সম্মুখে।

– তোমার এ কি অবস্থা রোযা?
দুশ্চিন্তাগ্রস্থ চারুলতা রোযার কাঁধে হাত রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তাকে।অপরদিকে আসমান মুখোমুখি হলো আরিয়ানের পিতামাতার।
– আপনি কে?
– আমি ওর হাসব্যান্ড।
আরিয়ানের মার প্রশ্নের জবাবে আসমান জানাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন যেন মহিলা,
– আপনি দেখতে পাচ্ছেন না আপনার স্ত্রী কি শুরু করেছে?তার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েগুলো সব রাস্তায় পড়ে মা*র খাচ্ছে!কেনো উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে সে,মদদদাতা হয়ে নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোকে ঝামেলায় জড়াতে লজ্জা করেনা ওর?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– প্রথমত,কেউই বাচ্চা নয়।সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রাপ্তবয়ষ্ক শিক্ষার্থী,যাদের নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণের অধিকার রয়েছে।আর দ্বিতীয়ত,আমার স্ত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত একান্তই তার ব্যাপার, তাতে আমি বাঁধ সাধতে পারিনা যদি না সে কোনোপ্রকার অন্যায় না করে থাকে।এক্ষেত্রে তার কোনো অন্যায় নেই।
– যুক্তি দেখাচ্ছেন?আজ যদি আমার ছেলেটার জায়গায় এই মেয়েটা র*ক্তা*ক্ত পরে থাকতো তাহলেও অধিকার অনধিকারের বুলি শোনাতেন আমায়?
এক মুহুর্ত নীরব থাকলো আসমান। তারপর মাথা কাত করে জানালো,

– হয়ত নীরব থাকতাম না,কিন্তু অন্তত অন্যকেও এই অবস্থার জন্য দোষারোপ করতাম না।আপনার ছেলে হোক,আমার স্ত্রী হোক,কিংবা অন্য যে কারো ভাইবোন যাই হোক না কেনো;এই ছেলেমেয়েগুলো সবকিছু বুঝেশুনেই নিজেদের এমন বিভীষিকায় জড়িয়েছে এক বোনের সম্ভ্রমের মূল্য আদায়ের আশায়।আমার নিকট অন্তত তাদের উদ্দেশ্য মহৎ ঠেকছে।
– আপনি ঠিকই বলেছেন।
আরিয়ানের বাবার কন্ঠে অতর্কিতে নীরবতা নামলো স্থানজুড়ে।পকেটে দুহাত ভরে তিনি আসমানের মুখোমুখি দাঁড়ালেন,

– একজন পিতা হিসাবে নিজের সন্তানের এমন অবস্থায় আমি অভ্যন্তরে রীতিমত দিশাহারা অনুভব করছি।কিন্তু সত্যি বলতে আমার কারো প্রতি কোনো খেদ নেই।আমার ছেলে আমার কাছে পূর্বেই এসেছিল, আমি তাকে বারণ করিনি ন্যায়ের পথে চলতে।সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পেরেছি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম,আজ আবারও করলাম।
রোযার দিকে ফিরলেন তিনি,মৃদু কন্ঠে জানালেন,

– আমার স্ত্রীর আচরণের জন্য আমি দুঃখিত।মায়ের মন, আশা করি বুঝতে পারবে।আমি দেখেছি,তুমি কিভাবে ওই ঘাত*কদের থেকে আমার ছেলেটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলে।তোমাকে ধন্যবাদ মা।দোয়া করো, আমার আরিয়ান যেন সুস্থ হয়ে ওঠে। শত হোক,একমাত্র ছেলেটাকে হারাতে চাইনা।
রোযার কি হলো বলতে পারবে না,এগিয়ে এসে সে খপ করে তার হাতজোড়া ধরে ফেলে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিড়বিড় করলো,

– আমায় ক্ষমা করবেন আংকেল।আমিও দুর্বল, ক্ষমতাহীন,নিঃস্ব।ওই ক্ষমতার সামনে সকলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়,আবার কাউকে দূরে ঠেলাও সম্ভব নয়।এই লড়াই আমাদের আত্মশুদ্ধির লড়াই,অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা পাবার লড়াই।তাতে যত আত্মত্যাগ করতে হোক না কেন আমার নির্দ্বিধায় করবো।আরিয়ান সুস্থ হয়ে যাবে,ওকে সুস্থ অবশ্যই হতে হবে আরো একবার আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে রাজপথ দখলের জন্য।আপনিও দোয়া করবেন আমাদের জন্য,যেন আমরা সুবিচার হাসিল করে তবেই ঘরে ফিরতে পারি।

– দোয়া করি মা,দোয়া করি।অনেক বড় হও।
এটুকুই বলা সম্ভবপর হলো।অতঃপর আরিয়ানের বাবা মা উভয়েই কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাসপাতালের ভেতরে চলে গেলেন নিজেদের ছেলের অবস্থা জানার উদ্দেশ্যে।নিজের স্থানে দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাস নির্গত করে পাশ ফিরতেই আসমানের নিগূঢ় দৃষ্টির মুখোমুখি হলো রোযা।না চাইতেও একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হলো।আসমান যা যা বলেছে তার সবটাই ফলে গিয়েছে,এখন পরিস্থিতি ঠিক কোনদিকে মোড় নেবে?

মেঘতীর।
হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা এবং অন্যান্য কার্যক্রম শেষে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নামলো।তবুও সারা রাস্তা ক্ষান্ত থাকেনি রোযা, নিজের সঙ্গীদের খবর নিয়েছে।পুলিশের হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝামেলা মিটেছে ঠিকই কিন্তু অনেকেই আহ*ত হয়েছে।সকলকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে।সেইসব ঘটনার ছবি ভিডিও দিয়ে ভর্তি সমস্ত সোশাল মিডিয়া।যে অহনা কেইস এতদিন সকলের সামনে থেকেও যেন অন্তরালে ছিল,সেই কেইসই যেন ডালপালা বিস্তৃত করেছে আপন মহিমায়।আজকের নৃশং*সতা কড়া নেড়েছে বহু বিবেকে।ন্যায়ের দাবিতে এহেন নিপীড়ন সহ্য করা দায়।রীতিমত দাবা*নলের মতন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সকল খবর।মেরিডিয়ান অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীদের সমর্থনে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও এগিয়ে এসেছে।ঘোষণানামা বের করেছে তাদের পরবর্তী কর্মসূচিতে সাথে থাকার।গণজোয়ার এবার ঠেকায় কে?তবুও যেন তৃপ্তি অনুভব করলোনা রোযা।যতই নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করুক না কেনো,আজকের ঘটনাটি তার দৃঢ় চিত্তে সামান্য হলেও চির ধরিয়েছে।ক্রমেই দায়িত্বের বোঝার ভার বাড়ছে।যদি কোনো ভুল হয় তাহলে চরম মাশুল গুণতে হবে সকলকে।নিজেকে রীতিমত আঁধার কূপের গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকা এক অসহায় অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছে রোযার।

বাড়িতে ঢুকে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে শীতের মাঝেও হিমশীতল পানিতে গোসল করলো রোযা। ধুয়েমুছে সাফ করলো সকল কদর্যতা যেন।শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে প্রবাহিত হয়ে যাওয়া রক্তিম স্রোতের পানে চেয়ে তার অন্তর বারংবার জ্বলে উঠলো ক্রোধবাসনায়।উপলব্ধি করলো নতুনভাবে,এখন দুর্বলতা প্রদর্শনের সময় নয়।গণজোয়ার বৃথা যেতে দেয়া যাবেনা,এই সুযোগ লুফে নিতে হবে শক্তহাতে।তবেই শক্তি বৃদ্ধি পাবে ক্ষমতার বিরুদ্ধে।
গোসল সেরে বেরোতেই ক্লোজেটের কাছে আসমানকে লক্ষ্য করা গেলো। ড্রয়ার থেকে কিছু কৌটোর মতন বস্তু বের করেছে। রোযাকে দেখে শীতল কন্ঠে আদেশ করলো,

– বিছানায় উল্টো হয়ে শোও।
সামান্য কম্পিত হলো রোযা।আরিয়ানকে আড়াল করতে গিয়ে তার শরীরে যে বারংবার আঘা*ত পড়েছে তাতে শারীরিক অবস্থা কিছুটা নাজুকই বটে।টনটন করছে পিঠ এখনো,জ্বলুনি হয়েছিল গোসলের সময়।
– দ্বিতীয়বার আদেশ করতে ভালো লাগেনা আমার।
কথাটি কর্ণগোচর হতেই রোযা বিছানায় এলো,বালিশ ঠিকঠাক করে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো।অদ্ভুত শিরশির অনুভূতিতে কম্পিত হচ্ছে তার সর্বাঙ্গ।আসমান বিছানায় এসে বসলো,হাতের কৌটোটি খুলতেই এক তীব্র ঔষধি ঘ্রাণে বায়ু পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।রোযা মাথা কাত করে জিজ্ঞেস করলো,

– এটা কি?
– অয়েন্টমেন্ট।একটু বেশি কড়া,খুব দ্রুত কার্যকরী।আগে প্রচুর ব্যবহার করতাম।
বলে রোযার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই আসমান বাঁধাটুকু অনুভব করলো।এতক্ষণ ভাববার অবসর হয়নি।ভ্রু কুঁচকে রোযার পিঠ ভাসিয়ে নেমে যাওয়া কেশরাশি লক্ষ্য করলো কিছুক্ষণ।তারপর কন্ঠ পরিষ্কার করে অনুমতি চাইলো,
– আমি তোমার পিঠে ঔষধ লাগিয়ে দিলে সমস্যা আছে?নাকি চারুলতাকে ডেকে দেবো?
– ক…কোনো সমস্যা নেই।তুমি করতে পারো।

মৃদু কন্ঠে জবাব দিলো রোযা,অধর গুজলো বালিশে।একটি দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে নিজেকে প্রস্তুত করে অবশেষে আসমান হাত এগিয়ে দিলো,রোযার পরিধানের পোশাকটির বোতাম খুলে উন্মুক্ত করলো পিঠ।হাত কাপলো তার,অনুভূতিতে নয়, পিঠজুড়ে লালচে কালচে হয়ে থাকা নৃশং*সতার চিহ্ন লক্ষ্য করে। ধপ করে জ্বলে উঠলো তার অন্তর,দৃষ্টিতে ভর করলো প্রগাঢ় আঁধার।আঙুলের ডগায় আলতো আঁচে ছুঁয়ে দিলো ক্ষ*ত,রোযা যন্ত্রণাবোধক শব্দ করলোনা ঠিকই কিন্তু তার শারীরিক কম্পন কষ্টটুকু ঠিকই জাহির করে দিলো।মুষ্টিবদ্ধ হলো আসমানের হাত, নিজেকে সংযত করে ধীরে ধীরে অতি সন্তপর্নে ঔষধের প্রলেপ দিয়ে দিতে আরম্ভ করলো।মুহূর্তেই হিমশীতলতা আচ্ছন্ন করলো রোযাকে, পিঠজুড়ে তার স্থবিরতা।ব্যথা দূরীভূত হয়েছে এক নিমিষেই যেন, প্রশান্তির অনুভব ছড়িয়ে।

– সাবধান করেছিলাম আমি।
আসমানের কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই রোযা সামান্য মাথা কাত করে পিছনপানে চাইলো। কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে এক অব্যক্ত সিক্ততা।গভীর মনোযোগে সবটুকু দৃশ্যপট যেন নিজের মাঝে ধারণ করে নিচ্ছে।
– আমি ঠিক আছি আসমান।
মৃদু হাসার প্রচেষ্টা করলো রোযা।তাতে থমকালো আসমান।
– কতটুকু ঠিক আছো তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
– পিঠের আঘা*তের কথা বলছো?অহনাকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে র*ক্তা*ক্ত করবার পর খু*বলে খু*বলে খেয়ে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কে*টে নি*য়েছে ন*রপশুর দল।সেই যন্ত্রণার সামনে আমার ঘা যৎসামান্য।
স্থবির হলো অমানিশা,দৃষ্টিপাত করলো জ্যোৎস্নার উদ্দেশ্যে।প্রগাঢ় আঁধারখচিত নয়নজুড়ে রোযা এক টলটলে ধারার উপস্থিতি খেয়াল করলো।অন্তরে যেন তরঙ্গ খেলে গেলো তার।সটান উঠে বসলো বিছানায়,

– আসমান?
অতি দ্রুত নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসমান দৃষ্টি হটিয়ে ভগ্ন কন্ঠে বললো,
– এমন পরিণতির সঙ্গে নিজেকে তুলনা করোনা রোযা।
এটুকুই উচ্চারণ সম্ভব হলো।আসমানকে দেখে মনে হলো সে আরো কিছু বলতে চায়,কিন্তু শীতলতার খোলস ভেদ করে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলোনা।টিস্যু দিয়ে হাত মুছে নিতে নিতে মেঝের দিকে চেয়ে থাকল সে।খানিক অপরাধবোধে ভুগলো রোযা,অতঃপর এগিয়ে গিয়ে দুবাহু বাড়িয়ে আসমানের ঘাড় জড়িয়ে ধরলো। কপোলে কপোল স্পর্শ করে কানের কাছে বিড়বিড় করলো,

– আমি দুঃখিত চাঁদ।আর কক্ষনো এমন করে বলবোনা।তুমি কষ্ট পেওনা প্লীজ।
এক মুহুর্ত স্থির হয়ে থাকলো আসমান।পরবর্তীতে আপন বলিষ্ঠ বাহুজোড়া বাড়িয়ে রোযাকে আগলে নিলো,সাবধানে পিঠের অংশখানি এড়িয়ে গেলো, প্রলেপ এখনো শুকায়নি। কাঁধে মাথা গুঁজে বললো,
– যে অতীত আমি মোকাবেলা করে এসেছি তা দ্বিতীয়বার উপলব্ধির আগে যেন মৃ*ত্যু আমায় গ্রাস করে।
বুকের ভেতর ঘূর্ণিপাক খেলে গেলো রোযার।আসমানকে আরো জোরালোভাবে নিজের মাঝে আঁকড়ে ধরে কাপা কাপা কন্ঠে ব্যক্ত করলো,

– ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবেনা আসমান,অন্তত তোমার জীবনে আর নয়।কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জীবনে বারংবার অভিশাপ হয়ে ফিরে আসছে তা।এই বিধ্বংসী চক্রকে যদি থামানো না হয় তাহলে তা অচিরেই কুক্ষিগত করবে জগৎটাকে।
মুখ তুলে রোযার মুখোমুখি হলো আসমান, তার কপোলে হাত রেখে সন্নিকটে সরে বললো,
– কেনো বুঝতে চাইছোনা রোযা?কেনো বারংবার নিজেকে পিষ্ট হতে দিচ্ছ?তোমার কি মনে হয় আমার তোমার প্রতি কোনো অনুভূতি নেই?শীতল হতে পারি, নির্বিকার হতে পারি,কিন্তু তোমার অশ্রুজল আমার অন্তরকে ঘাতে প্রতিঘাতে ক্ষ*তবি*ক্ষত করে তাও কি আমাকে মুখফুটে বলতে হবে এবার?
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো রোযা।এর পূর্বে আসমান কোনোদিন নিজের আবেগকে শব্দে রূপান্তর করেনি।নিজের শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করে উঠতে খানিক বেগ পোহাতে হলো রোযাকে,যখন আসমান তার কোমরে দুহাত রেখে কাছে টেনে সুগভীর কন্ঠে জানালো,

– তুমি আমার অমানিশায় ঘেরা জীবনে এক মুঠো সুখের রোদ রোযা।এটুকু সুখ থেকে আমায় বঞ্চিত করোনা।
রোযার নয়ন সিক্ত হয়ে এলো অনুভূতির প্রগাঢ়তায়। অধরজুড়ে বিস্তৃত হাসির ধারার উৎপত্তি ঘটলো।দুহাতে আসমানের মুখখানি ধরে অতি স্নেহের দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে রোযা বিড়বিড় করলো,
– আমার চাঁদ কি অবশেষে তার জ্যোৎস্নাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?
তাকিয়ে রইলো আসমান,একদৃষ্টে।কোনো জবাব দিলোনা। অতর্কিতেই ঘটলো অভূতপূর্ব ঘটনাটি।নিজের মুখের মাস্কটি খুলে দূরে ছুঁড়ে আসমান ঝুকলো রোযার উদ্দেশ্যে,এক হাত কোমরে এবং অপর হাত কপোলে ঠেকিয়ে অতি সন্নিকটে টেনে অধরের উদ্দেশ্যে চেয়ে ফিসফিস কণ্ঠস্বরে শুধালো,

– যদি বলি হ্যাঁ,তবে কি বিশ্বাস করবে?নাকি আরো শক্ত প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে?
– আ… আসমা…. ন…
আর কিছু বলা সম্ভবপর হলোনা রোযার পক্ষে।তার সর্বাঙ্গে প্রকম্পন ছড়িয়ে দিয়ে অধরজুড়ে ঠেকলো অপর এক অধরের কোমল স্পর্শ।দৃষ্টি বুজে এলো এক লহমায়, তিরতির করে কাঁপতে থাকলো নয়নপল্লব।সহসাই সরে গেলো আসমান,রোযার অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করলো।অনুভূতির গাঢ়ত্বে কম্পিত অস্তিত্বের মাঝে কোনোপ্রকার খেদ নেই, সমর্পণ করেছে যেন সে নিজেকে অমানিশার দুয়ারে। দ্বিধাদ্বন্দের দেয়াল গুঁড়িয়ে অবশেষে ঝুঁকলো আসমান, দ্বিতীয় দফায় দখল নিলো অর্ধাঙ্গিনীর ওষ্ঠের।এবার কোমল কিছু স্পর্শে থেমে থাকলোনা অনুভূতির বিনিময়।ক্রমশ প্রগাঢ় হলো মুহূর্তখানি।সুখের প্রস্রবণ খেলে গেলো রোযার প্রতিটি রোমকূপজুড়ে। দূর্বল হাতের বাঁধনে আঁকড়ে ধরলো আসমানের বুকের বা পাশের শার্টের অংশ।নিজেকে বিলিয়ে দিলো অমানিশার নিগূঢ় স্পর্শের মাঝে।

একটা সময় নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো।হৃদযন্ত্র স্পন্দিত হতে থাকলো প্রচণ্ড বেগে।তবুও যেন জ্যোৎস্নার মাঝে বিলীন চাঁদ,ছাড়তে রাজি নয়।বুকে হাত ঠেকিয়ে রোযা সামান্য ঠেলে নিজেকে মুক্ত করলো,চোখ খুলে তাকালো আসমানের উদ্দেশ্যে।ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে ফেলতে ধোঁয়াশাঘেরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে,সন্তুষ্টির আভাস নেই চেহারায়।যেন তৃষ্ণার্ত পথিক।একটুখানি শীতল প্রশান্তি চায়।রোযার কি হলো সে বলতে পারবেনা,সম্মোহিতের ন্যায় হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো তার সদ্য স্পর্শলাভ করা ঠোঁটের পাশের দাগে।আদরের কোমলতা বুলিয়ে দিলো যেন বিভীষিকাজুড়ে।নয়ন বুজে ছোঁয়াটুকু অনুভব করে গেলো আসমান।তারপর হঠাৎই দৃষ্টি মেলে রীতিমত শিশুসুলভ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

– আরেকটু আদর করি?
প্রশ্নটি এতটা নিষ্পাপ এবং আসমানের নিকট হতে এতটাই অপ্রত্যাশিত শোনালো যে রোযা ফিক করে হেসে ফেললো।
– তোমাকে ঠিক একটি বিড়ালছানার মতন দেখাচ্ছে, যে নিজের মনিবের কাছে ঘেঁষতে বাহানা খুঁজে বেড়াচ্ছে।এটা কি আসলেই আমার আসমান?
– হয়ত হ্যাঁ,কিংবা হয়ত না।

বলে রোযাকে পুনরায় নিকটে টেনে কপালে অধর ছোঁয়ালো আসমান।তারপর কপোলে, ধীরে ধীরে নিম্নপানে ধাবিত হলো।রোযার চুলে আঙুল গুঁজে উন্মুক্ত কাঁধে ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শ বুলিয়ে গেলো আসমান।থরথর করে কাপলো রোযা,চোখ বুজে নিলো শক্তভাবে।দুহাতে আঁকড়ে ধরলো ভালোবাসার পুরুষটিকে।জীবনে সর্বপ্রথম অনুভূত এই গাঢ় সুখের প্রবাহের অনুভূতি ব্যাখ্যা করা দায়।জগতের সকল চিন্তা যেন তার বিলুপ্ত হলো দীর্ঘ কিছু মুহূর্তের জন্য।গ্রীবার ভাঁজে ভাঁজে আসমানের অধরের ছোঁয়া ভালোবাসার জলোচ্ছ্বাস ঘটালো অন্তরজুড়ে।স্থির এবং স্বাভাবিক চিন্তা করা যেন দায়।আনমনে রোযার পিঠে হাত ঠেকতেই থমকালো আসমান, ঔষধের প্রলেপে আঙুল সিক্ত হতেই যেন বাস্তবতার দুনিয়ায় পদার্পণ ঘটলো তার আবেশিত মস্তিষ্কের।নিজেকেই নিজে ধিক্কার জানালো।অতঃপর শুয়ে পড়ল বিছানায়,বুকে টেনে নিলো রোযাকে।
বিহ্বল হয়ে রোযা মাথা তুলে তাকালো।

– বিশ্রাম নাও,আমি তোমার কাছেই আছি।
এটুকুই উত্তর এলো।অতঃপর প্রশস্ত বুকে মাথা রাখলো রোযা,দীর্ঘ প্রশ্বাস টেনে শান্ত করলো নিজের অবাধ্য হৃদযন্ত্রকে।আসমান তাকে আগলে রাখলো বাহুডোরের মাঝে,জগতের সবচাইতে সুরক্ষিত এই স্থানে নিজেকে এলিয়ে নিশ্চিন্তে পরিশ্রান্ত নয়ন বুজলো রোযা।তার আ*ঘাতে জর্জরিত শরীরে যেন প্রশান্তির শীতলতা ছড়িয়ে দিতে থাকলো আসমান।মস্তিষ্কজুড়ে রোযার চলতে থাকলো তার পরবর্তী পরিকল্পনার ছক।এই শান্তির আশ্রয় তার দুর্বলতাটুকু যেন শুষে নিয়ে পরিপূর্ণ করেছে নব উদ্যমে।

গাড়ির ভেতর জিনিসপত্র ভরে রাকিব প্যাসেঞ্জার সিটে উঠলো।ড্রাইভিং সিটে থাকা ব্যক্তি কোনোপ্রকার কথা না বলেই ইঞ্জিন চালু করলো। সড়কপথে নেমে এলো গাড়িটি।মেজাজ ভীষণ তিরিক্ষী হয়ে রয়েছে রাকিবের।ইচ্ছা হচ্ছে কাউকে ধরে বেধড়ক পি*টুনি দিতে।ক্ষান্ত হয়নি তার প্রতিহিংসা।উল্টো দ্বিগুণ আকার লাভ করেছে।কেনো তাকে এভাবে চোরের মতন পালিয়ে যেতে হচ্ছে?সে কি চুরি করেছে?করেনি তো!উল্টো বীরদর্পে আদেশ পালন করেছে।ওই বেয়াদব ছেলেমেয়েগুলোকে উচিত শিক্ষা দেয়া হয়েছে।তারপর জিশান তার সঙ্গে এমনটা করতে পারলো?বলে কিনা দূরে কোথাও কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে?

– শালা বেঈমান!
অশ্রাব্য শব্দ বিড়বিড় করতে করতে রাকিব জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।ঠিক তখনি নজরে এলো ব্যাপারটি।গাড়ির পাশে পাশে চলন্ত একটি বাইক।প্রথম প্রথম খুব একটা ইয়ত্তা না দিলেও পরবর্তীতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো বিষয়টি।পাশের ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে চেয়ে আনমনে জিজ্ঞেস করলো,
– বাইকটা কি আমাদের ফলো করছে?
– জানিনা।
সড়কপথে মনোযোগ রেখেই জবাব দিলো ব্যক্তি।তাতে সামান্য চমকে উঠলো রাকিব।ঝট করে পাশ ফিরে চাইলো।আবছায়া আধারিতে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটির অবয়ব স্পষ্ট নয়, হুডির আবরণে আড়াল করা তার সর্বাঙ্গ।

– তোর কন্ঠ এমন শোনায় কেনো?
– কেমন শোনায়?
নির্বিকার প্রশ্ন ভেসে এলো। এবার সম্পূর্ণ জমে গেলো রাকিব।জানালার সঙ্গে একেবারে লেপ্টে গেলো, সিটবেল্টে টান লাগছে, তা লাগুক।
– ক…কে তুই?
জবাব এলোনা,ড্রাইভার ওই একই ভঙ্গিতে সড়কপথে মনোযোগী।অতর্কিতে বাইকটি সরে এলো গাড়ির নিকট,রাকিব অনুভব করলো আরোহী শক্তিশালী বাহুতে তার ক*ন্ঠ চেপে ধরেছে।ছটফট করতে থাকলো রাকিব।

– ছাড়… ছাড় আমাকে!
কোনো নড়চড় নেই।ঐভাবেই এগিয়ে চলেছে বাইক এবং গাড়ি, একে অপরের পাশাপাশি।ড্রাইভার হুট করে পাশ ফিরলো,তাতে হেডলাইটের মৃদু আভায় তার চেহারা দৃষ্টিগোচর হলো।অদ্ভুত ধরনের সুদর্শন ঠেকলো তা,এক কানের লতিতে সংযুক্ত লম্বাটে সিলভার ধাঁচের দুলটি চকচকে দ্যুতি ছড়ালো। তীর্যক হাসিতে আবর্তিত হলো বিস্তৃত অধর,
– কর্মফল ভোগ না করে পলায়ন কাপুরুষের ধর্ম।তুই কাপুরুষ হয়ে জন্ম নিয়েছিস,মৃ*ত্যু পর্যন্ত কাপুরুষই রয়ে গেলি!

প্রায় চোখের পলকে ঘটলো ঘটনাটি।গাড়ির একপাশের দরজা খুলে গেলো,বাইক আরোহী সজোর টানে রাকিবকে বাইরে ঠেললো,পরিধানের পোশাকের অংশ আটকে দিল হুকে।নিস্তার নেই।কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলোনা রাকিব কি হচ্ছে।যতক্ষণে অনুধাবন করলো ততক্ষণে নির্মম মৃ*ত্যু লিখিত হয়েছে তার।
বাইকটি গতি কমিয়ে ভিন্নপ্রান্তে সরে গেলো।তারপরই দেখা মিললো তীব্র গতিতে মহাসড়ক বেয়ে ছুটে আসা লরির।হৃদস্পন্দন থমকে গেলো রাকিবের,এক ঝটকায় চাইলো গাড়ির ভেতরে বসা ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে।চিৎকার ছুড়লো,
– না…..আআআআআ!

ধরিত্রীজুড়ে প্রকম্পন তোলা আর্তনাদও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল চাকার কর্কশ আর্তনাদের আড়ালে।ড্রাইভার বনবন করে ঘোরালো স্টিয়ারিং,পাশ দিয়ে যাওয়া লরির গায়ে ঠু*কে দিলো গাড়িটিকে।তাতে রাকিবের শরী*রখানি গাড়ি এবং লরির ধাতব দেহের মাঝে পি*ষ্ট হ*লো নির্ম*মভাবে! চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে আসলেও থমকালো না গাড়িটি, আরো জোরে চেপে লরির গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে থাকলো।যতক্ষণ না রাকিব দলি*ত ম*থিত হয়।একটি হা*ত উগ*ড়ে পড়*লো তার সড়কে,অতঃপর একটি পা…. খসে খসে ছন্নছাড়াভাবে লুটতে থাকলো দে*হাং*শ, একে একে।তার সূক্ষ্ম পথ সৃষ্টি করে এগিয়ে যেতে থাকলো গাড়ি এবং লরি উভয়ে।
অতঃপর যখন গাড়িটি সরে এলো,তখন ধাতব শরীরে লেগে থাকা টিকটিকির লেজের অংশের মতন রাকিবের দে*হের অব*শিষ্টাংশ থপ করে পড়লো সড়কে।
উন্মত্ত ছুটে চলে গেলো লরি,থমকালো গাড়ি।পাশে এসে ব্রেক করলো বাইকখানি।হেলমেট খুলে উঁকি দিলো হাবিবের মুখ,

– নিহাদ ভাই,ঠিক আছো?
জবাব ভেসে এলোনা।ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং চেপে ধরে হাঁপিয়ে গেলো নিহাদ।তারপর হুট করে মাথা ঠেকালো,বেজে উঠলো হর্নের আওয়াজ,জ্বলতে নিভতে আরম্ভ করলো হেডলাইট।এর মাঝেই গাড়ির শরীরে লেপ্টে থাকা র*ক্ত এবং দে*হাং*শের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো হাবিব।অদ্ভুত হলেও সত্যি এই নৃ*শং*সতা তাকে অস্বস্তি দিচ্ছেনা,বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে সম্পূর্ণ সড়কজুড়ে ছড়িয়ে থাকা খ*ন্ড বি*খ*ণ্ড মানবদেহটি লক্ষ্য করে।

তেরো বছর বয়সী আসমান সুবিশাল থামের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে।দৃষ্টি তার উপরে বিস্তৃত অসীম গগনের পানে আবদ্ধ। হৃদয়জুড়ে চরম এক শূণ্যতা।এই ধরিত্রীর বুকে অত্যন্ত কলুষিত এক অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছে নিজেকে। কি হতো যদি মায়ের সাথে সাথে তার প্রাণপাখিটিও পরকালের যাত্রী হতো?খুব সুখী থাকা সম্ভব হতো ওপারের জীবনে।সে আর তার মা।জাগতিক অন্য কোনো চাহিদা ছিলোনা।তবুও সেটি সম্ভবপর হয়নি।হয়নি বলেই যেন আজকের আসমান পরিণত হয়েছে এক খু*নিতে!
হ্যাঁ,আজ হতে আসমান একজন খু*নি!গতকাল রাতে এক জলজ্যান্ত প্রাণের বিনাশ ঘটিয়ে সে প্রবেশ করেছে আঁধার জগতে,অমানিশার অধিপতি হয়ে।তবুও অনুভূতি যেন ভোঁতা।বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হচ্ছেনা,কারণ যাকে ধ্বংস করেছে তার পতন আরো পূর্বে সংঘটিত হওয়া উচিত ছিল,এমনি এক নাপুরুষ সে।তবুও এহেন ক্রুরতাকে ন্যায়ের গন্ডিতে ফেলা যায়না।

আজ স্কুল রয়েছে,অতঃপর জিম এবং ট্রেনিং।রাত্রিতে আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতি।কোনকিছুতেই যোগদানের ইচ্ছা হচ্ছেনা।ক্ষুধায় উদর মুচড়ে উঠছে বারংবার।গতকাল বিকাল থেকে একফোঁটা পানিও পেটে পড়েনি।খাবারের দানা গলাধঃকরণ করা সম্ভব নয়।তবুও অবাধ্য শরীর কি আর অন্তরের কথা শুনতে চায়?তার প্রচুর চাহিদা।এই ক্ষুধার জ্বালা মেটাতেই তো জগতের অনিয়ন্ত্রিত আবর্তন।
– খাও।

মিষ্টি কণ্ঠটি কর্ণগোচর হতেই আপন ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে মুখ তুলে চাইল আসমান।সামনে দন্ডায়মান গোলাপরাঙা ফ্রক পরিহিত কোমল মেয়েটিকে লক্ষ্য করে থমকালো। বৃক্ষলতা সদৃশ হাতে একটি প্যাকেট বাড়িয়ে ধরেছে তার দিকে।সঙ্গে এক বোতল জুস।
– চিকেন স্যান্ডউইচ।খুব মজা হয়েছে,খেয়ে দেখো ভাইয়া।
একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো আসমান।“ভাইয়া” সম্বোধনটি তার হৃদয়ে অদ্ভুত এক তোলপাড় সৃষ্টি করলো যেন।অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্যাকেটটি গ্রহণ করতেই মেয়েটির শিশুসুলভ মুখজুড়ে যে খুশির আস্ফালন দেখা গেলো তা যেন হৃদয় জুড়ানো।

– ধন্যবাদ… ম্যাম।
মেয়েটি হাসলো,ধপাস করে আসমানের পাশের স্থানটিতে বসে পরে খিলখিলে হাসির দমক তুলে জানালো,
– আমার নাম রাফা কায়সার,তুমি আমাকে রাফা বলে ডাকতে পারো, ম্যাম বলার প্রয়োজন নেই ভাইয়া।
আসমান কিছু বলতে পারলোনা,দৃষ্টি ফিরিয়ে স্যান্ডউইচে কামড় বসালো।রাফা নিষ্পলক অবলোকন করে গেলো তাকে।
– নাবিল ভাইয়া আমার সঙ্গে পুতুল খেলতে চায়না, তুমি খেলবে ভাইয়া?আমি তোমার আর পুতুলের জন্য অনেক মজার মজার রান্না করবো,খাবে?
এক মুহুর্ত নীরব থাকলো আসমান,তারপর অধরে মৃদু হাসির প্রস্ফুটন ঘটিয়ে সম্মতি জানালো,
– অবশ্যই।

ভীষন উত্তেজিত হয়ে রাফা উঠে পড়লো,এক ছুটে নিজের খেলনাসামগ্রী নিয়ে হাজির হলো। আসমানও যোগদান করলো সেই পুতুলখেলায়।কায়সার এম্পায়ারের কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ মুগ্ধ নয়নে ফিরে ফিরে বারংবার দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করে গেলো।

মিষ্টিমধুর সম্পর্কটির পরিবর্তন ঘটেছিল রীতিমতো অস্বাভাবিক ভাবেই।আসমান তখন সবে অষ্টাদশীতে পদার্পণ করেছে।সদ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন থেকে ফিরেছে ব্যাংকক হতে। সরকারবিরোধী এক কূটনীতিকের সঙ্গে বোঝাপড়ার কাজ,গোটা একটা মাস সময় প্রয়োজন হয়েছে তার সূক্ষ্মভাবে মিশনটি সম্পন্ন করতে।পারিশ্রমিক সেই অনুযায়ীই লাভ করেছে।বহুদিন বাদে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে খানিক স্বস্তিবোধ করলো সে।দীর্ঘ সময় ধরে উষ্ম পানিতে গোসল সেরে যেন তরতাজা করে নিলো নিজেকে।অনাবৃত ঊর্ধাঙ্গেই রুমে এলো,টি শার্টখানি আরামকেদারায় ঝোলানো।সেটি হাতে নিয়ে শরীরে গলিয়ে দিতে যেয়েই অস্বাভাবিকতাটি ধরা পড়ল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তার ইন্দ্রিয় ক্রমশ সুচারু হয়েছে।নিজের উপর নজরদারি স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে তার।চকিতে আশেপাশে তাকালো,সতর্ক ভঙ্গিতে নিগূঢ় তল্লাশি চালালো নয়নজোড়া।কোনো মানুষের উপস্থিতি নেই,কিন্তু নজরদারি অবশ্যই রয়েছে সে নিশ্চিত।অবশেষে দৃষ্টিপাত হলো বস্তুটিতে।

বেডরুমের বেডসাইড টেবিলের উপর ফুলদানিখানায় কৃত্রিম পুষ্পগুচ্ছ।বিশেষ আগ্রহ নেই আসমানের পুষ্পের প্রতি,কখনো পরিবর্তন করা হয়না তাই।তবুও অভিজ্ঞতা বলে কালো গোলাপের ধূলোর আস্তরণের মাঝে একটি ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন গোলাপ সন্দেহজনক।দ্রুত হাতে ফুলটি তুলে নিলো আসমান।মনোযোগী নিরীক্ষণ চালাতেই স্পষ্ট হলো বৃন্তে সংযুক্ত মাইক্রোক্যামেরাটি।শীতল এক শিহরণ বয়ে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে।উদ্ভ্রান্তের ন্যায় চারিপাশে তাকালো।অতঃপর যা হলো তা ছিল সম্পূর্ণ কল্পনাতীত।

গোটা অ্যাপার্টমেন্ট চষে ফেলে সর্বমোট পাঁচটি মাইক্রোক্যামেরা এবং দুইটি মাইক্রোফোন আবিষ্কার করলো আসমান।বাদ যায়নি বাথরুম অবধি!আজ গোসলের সময় শাওয়ারের পর্দা টেনে দেয়ার দরুণ দৃষ্টিগোচর হয়নি দেয়ালের টাইলসের ফাঁকে সংযুক্ত প্রায় অদৃশ্যমান বস্তুটি।টেবিলে সকল বস্তু একসঙ্গে জড়ো করে খানিকক্ষন স্তব্ধ হয়ে থাকলো আসমান।কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা অনুভূত হচ্ছে অভ্যন্তরে। কন্ঠতালু শুকিয়ে এসেছে, হৃদযন্ত্র অনিয়ন্ত্রিত তরঙ্গে স্পন্দিত হয়ে চলেছে।তাকে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।কাজটি কোনো শত্রুর হওয়া অসম্ভব।হলে বাথরুম পর্যন্ত যাওয়ার কথা নয়।একটি অস্বস্তিকর ধারণাই বারংবার ঘুরেফিরে আসছে তার মস্তিষ্কে।নিশ্চিত হওয়ার উদ্দেশ্যে ফোন বের করে একটি নাম্বার ডায়াল করলো।রিসিভ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলো,

– আমার অ্যাপার্টমেন্টে কে কে এসেছিল?
– স্যার গিয়েছিলেন।একবার।
– একাই?
এক মুহুর্ত নীরবতা,অতঃপর উত্তর এলো,
– রাফা ম্যাম সঙ্গে ছিলেন।
তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দিলো আসমান। ধপ করে বসে পড়ল পার্শ্ববর্তী চেয়ারে।কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজলো।এক লহমায় যেন তার সকল অনুভূতিরা অনশনে গিয়েছে,কিছুই অনুভূত হচ্ছেনা হিমশীতলতা ব্যাতিত।অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তির ন্যায় একটানা দেড় ঘণ্টা যাবৎ ওই একই ভঙ্গিতে বসে রইলো আসমান।পরক্ষণে সটান উঠে দাঁড়ালো,ব্যাংকক থেকে ফেরার পর ক্লোজেটের কাছে রাখা লাগেজটি খুলে ভেতর থেকে একটি ছোট্ট বক্স বের করলো।

মখমলি বক্সটির ভেতর একটি পেনডেন্ট, এমারেল্ডের তৈরী।প্রজ্জ্বলিত রত্নটি সবুজাভ দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছে চারিদিকে।এমন চকচকে বস্তু রাফা কায়সারের বৃহৎ দূর্বলতা, নানাপ্রকার অলংকারে নিজেকে সজ্জিত করতে খুব ভালোবাসে কিশোরী মেয়েটি।মুষ্টিবদ্ধ হলো আসমানের হাত,বক্সটি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো।একটি জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে বেরোলো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।বাইরের প্রাঙ্গণের নিকটবর্তী ড্রেনেজ লাইনের কাছে এসে থমকালো। গগনপানে চাইলো।অতঃপর প্রচণ্ড ঘৃণায় হাতের বক্সটি ছুঁড়ে দিলো নর্দমায়।অতি মূল্যবান এমারেল্ড রত্নও যেন আজ সকল মূল্য হারিয়েছে, লুণ্ঠিত হয়েছে সকল আবেগ,অনুভূতি,ভালোবাসা।নর্দমার পানিতে ঘুরপাক খেতে খেতে রত্নসহ বক্সটি ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলো অতল গহ্বরে।

প্রগাঢ় দৃষ্টিতে সেই দৃশ্যটি অবলোকন করে গেলো অমানিশা।
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো আসমান।উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চারিপাশে তাকিয়ে উপলব্ধি করলো সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে,সে বাস্তব জগতে ফিরে এসেছে।দুহাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বুজে নিলো, চুলে হাত চালালো কয়েকবার।হৃদযন্ত্র তেজস্বী অশ্বকেও দ্রুততায় হার মানিয়েছে।সংক্ষিপ্ত মেডিটেশন করে দৈহিক কার্যক্রম নিজের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনলো আসমান।অতীতের স্মৃতিসমূহ দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে বেড়ায় তাকে বারংবার।এর থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব নয়,তার সমস্ত অস্তিত্ব জানে।আনমনে নিজের সম্পূর্ণ কক্ষে দৃষ্টি বুলিয়ে আনলো,যেন এখানেও কোনো গোপন কুঠুরি লোকায়িত রয়েছে,যা পর্যবেক্ষণ করে চলেছে তাকে নিগূঢ়ভাবে।কিন্তু তেমন কোনো অনুভূতি টের পেলোনা,উল্টো স্নিগ্ধ এক সুঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকলো।বিছানার পাশে তাকাতেই শূন্যস্থানজুড়ে স্কার্ফের অস্তিত্ব তাকে অর্ধাঙ্গিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। স্কার্ফটি তুলে বুকে চেপে ধরে বসে থাকলো আসমান।অহেতুক চিন্তা করছে সে,রোযার সঙ্গে সেই অতীতের তুলনা করার মতন পাপকার্য সম্পাদনে নারাজ তার অন্তর।ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে আটটার ঘোষণা দিতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল আসমান।

তৈরি হয়ে শীতের আবহে একটি সোয়েটশার্ট গায়ে জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আসমান সম্পূর্ণ জমে গেলো সামনের দৃশ্য লক্ষ্য করে।ডাইন ইন এরিয়ায় টেবিলের পাশে বিলাল রেমান।উষ্ম ধোঁয়া ওঠা গরম গরম খিচুড়ি এবং মুরগী কষা বড়সড় আকৃতির দুইটি টিফিন বক্সে ভরে নিচ্ছেন।তার পাশেই দাঁড়িয়ে আগ্রহভরে সেই দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে চলেছে রোযা এবং চারুলতা।উভয়ের বেশভূষা চিন্তা জাগানিয়া।চারুর পরিধানে ট্রাউজার এবং টি শার্ট, উপরে একটি জ্যাকেট জড়িয়েছে।এক হাতে হকিস্টিক,যার প্রান্ত কাঁধে ঠেকিয়ে রেখেছে।অপরদিকে রোযা আসমানের ক্লোজেট থেকে ধার করা ওভারসাইজড হুডি আর জিন্স পরে তৈরি,গলায় স্কার্ফ,হাতে একটি লম্বাটে কালো কাপড়।হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো আসমান,চোখের পলক পর্যন্ত পড়লোনা তার।

বিলাল রেমান অতি যত্নে নিজের দুই মেয়ের ব্যাগেই টিফিন বক্স এবং পানির বোতল ঢুকিয়ে দিলেন, সঙ্গে কিছু নগদ টাকার নোট গুঁজে দিলেন পকেটে। চারুলতা এবং রোযা উভয়ের কপালে স্নেহময় চুম্বন এঁকে দৃপ্ত কন্ঠে বললেন,
– বিজয়ী হয়ে ফিরে এসো আমার মেয়েরা!
– অবশ্যই বাবা।আপনি দোয়া রাখবেন।
– হ্যাঁ ড্যাড,চিন্তা করোনা। একেকটাকে ছাতু বানিয়ে তবেই ক্ষান্ত দেবো।
দীঘল কালোর মাঝে নীলাভ বর্ণের কেশগুচ্ছ এলিয়ে জানান দিলো চারুলতা, অধরজুড়ে তার বিস্তৃতিলাভ করলো এক তীর্যক হাসি।নিজেকে সংবরণ সম্ভব হলোনা আসমানের পক্ষে,দ্রুত নিচে নেমে এগিয়ে এলো,

– বাবা?
কণ্ঠটি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যধিক শীতল শোনালো যার দরুণ সকলে ফিরে তাকালো।রোযা এবং চারুলতাকে এড়িয়ে আসমান মুখোমুখি হলো পিতার।
– ওরা কোথায় যাচ্ছে বাবা?
– আন্দোলনে।
জবাব দিলো চারুলতা,আসমান মাথা কাত করে তাকাতেই পুনরায় বললো,
– আজ থেকে গণআন্দোলন শুরু হচ্ছে।দায়িত্ববান নাগরিক মাত্রই এই প্রতিবাদের মিছিলে যোগদান করতে পারবে।একজন নারী হিসাবে নিজের অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয় মনে করছি,তাই রোযার সাথে আমিও যাচ্ছি আন্দোলনে।অহনার ন্যায়বিচার আদায় করে তবেই আমরা রাজপথ ছাড়বো।

– রাজনৈতিক দলের নেত্রী হয়ে গিয়েছিস একেকজন তাইনা? আর এই গণআন্দোলনের ডাক কে দিয়েছে শুনি?
এই প্রথম আসমানের কন্ঠ এতটা চড়াও হতে উপলব্ধি করলো সকলে।সাধারণত তার মাঝে অনুভূতি প্রকাশ পায়না,কিন্ত আজ তার শব্দগুচ্ছে ক্রোধ মিশ্রিত রয়েছে।তবুও টললোনা রোযা,এগিয়ে গেলো, মুখোমুখি হলো স্বামীর।
– অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদ। ন্যায়ের দাবিতে মাঠে নেমেছি আমরা,সুবিচার আদায় না করে ক্ষান্ত হবোনা।অহনা হ*ত্যা*র বিচার চাই,আমার ভাইবোনদের উপর নিপীড়নের উপযুক্ত তদন্ত এবং শাস্তি চাই।
– অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদ?নামটা নিশ্চয়ই তোমার মাথা থেকে বেরিয়েছে?
মৃদু হাসলো রোযা,সম্মতি জানালো নিঃশব্দে,যেন অতি গর্বের বিষয় তা।আসমানের ভ্রুজোড়া তীব্র কুঞ্চন ধারণ করলো,দৃষ্টিতে ফুটে উঠল অব্যক্ত অনুভূতি।

– তুমি কোথাও যাবেনা রোযা,তুমি অসুস্থ।আজকে বিশ্রাম নেবে।
আসমানের ঘোষণা যেন প্রতিধ্বনিত হলো সমগ্র বিস্তৃত কক্ষজুড়ে।এক মুহুর্ত চেয়ে তার দৃষ্টিতে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে রোযা মাথা নাড়লো,
– সম্ভব নয় আসমান।আমাকে যেতেই হবে।ওদের একটা শক্ত ভিত্তির দরকার।যে গণজোয়ার উদগীরিত হয়েছে আমাদের তরে, তা বৃথা যেতে দিতে পারিনা আমি।এই আন্দোলন বর্তমানে আমার নৈতিক দায়িত্ব।
– আমি আদেশ করেছি রোযা,অনুরোধ নয়।
– তোমার আদেশ অমান্য করতে আমি বাধ্য হচ্ছি, আসমান।

একে অপরের পানে অদ্ভুত এক কঠোরতা এবং অনুভূতি জড়ানো মিশ্রিত দৃষ্টি বিনিময় করলো আসমান এবং রোযা। চাঁদ কিংবা তার জ্যোৎস্না, কেউই যেন কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়।উভয়ের মাঝে কোনোপ্রকার খেদ নেই,নেই কোনো অভিমান।তথাপি আপন আপন চিন্তাধারা সমর্থনে কার্পণ্য করছেনা কেউই।উল্টো ঘুরল রোযা, খপ করে তার হাতখানি পাকড়াও করলো আসমান।
– বারণ করেছি আমি রোযা….
ফিরে চাইলো জ্যোৎস্না, দৃষ্টিজুড়ে এক নীরব আশ্বাস যেন।নিকটে এসে চাঁদের দুহাত আপন মুঠোয় নিয়ে অধরে ছোঁয়ালো।বিড়বিড় করলো,
– আমার উপর ভরসা রাখো চাঁদ। ভাইবোনদের র*ক্তের উপযুক্ত মূল্য আদায় করে আমি তোমার উষ্ণতার আলিঙ্গনে আবারো ফিরে আসবো,কথা দিচ্ছি।

একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো আসমান, প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো শুধু।রোযা আশেপাশের চারুলতা এবং বিলাল রেমানের উপস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও প্রয়োজনীয় মনে করে নিকটে সরে আসমানের কপোলে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো।বিদায় জানালো যেন।অতঃপর মৃদু হেসে চারুলতার হাত ধরে হেঁটে বেরিয়ে গেলো বাড়ির বাহিরে।তাদের চলে যাওয়ার পথপানে চেয়ে থাকল আসমান।বরফের ন্যায় স্থির হয়ে।বিলাল রেমান তার কাঁধে হাত রাখতেই আপন ঘোর থেকে বের হলো সে,পাশ ফিরে তাকালো।
– চিন্তা করোনা বেইবি,মেয়েরা পারবে,আমার বিশ্বাস।
– তুমি ওদের এইভাবে সমর্থন করে ঠিক করছোনা বাবা।
– ঠিক কি বেঠিক জানিনা,ন্যায়ের সমর্থনে আছি এটুকুই জানি।আমার চিত্রলেখা সুবিচার পায়নি,অন্তত অহনার মাধ্যমে তা আদায় হোক।এই ক্ষমতার দেয়াল গুঁড়িয়ে যাক, জয় হোক মনুষ্যত্বের।
কিছুই উচ্চারণ করতে সমর্থ হলোনা আসমান,ক্রমশ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো তার হাতজোড়া।

ক্লাব পাতাল।
ভি আই পি এরিয়ার আবদ্ধ চেম্বারটিতেও বাইরের উন্মাদ মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে।গমগমে এক অনুভব ছড়িয়ে পড়েছে তামাকের গন্ধে ভারী হয়ে আসা বায়ুজুড়ে।স্বাভাবিক মানুষমাত্রই অসুস্থতাবোধ করবে এমন এক পরিস্থিতি যেন।গুমোট বাঁধা স্থানটি খানিক কবরের মতন।বিস্তৃত মেঝেজুড়ে বস্ত্রাদি ছড়ানো ছিটানো।বিছানার একপাশে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে কপোত কপোতী যুগল।অভিসারের সমাপ্তি ঘটেছে,মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উঠে বসলো রমণী।যৎসামান্য বস্ত্রেই উঠে একটি সিগারেট ধরালো, বিছানার একপাশে বসে হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে একমনে আস্বাদন করে গেলো তামাকের ধোঁয়াটে স্বাদ।
বিশ্রামে ক্ষান্ত দিয়ে সামান্য মাথা তুলে চেয়ে জিশান জিজ্ঞেস করলো,

– তোমার স্বামী কিছু বলবেনা?
– দিমিত্রী?
সিগারেটে দীর্ঘ এক সুখটান দিয়ে তীর্যক হাসলো রাফা কায়সার।মাথা ঝাঁকিয়ে জানালো,
– উহুম।উই আর ফ্রি টু ডু হোয়াটএভার উই ওয়ান্ট।
– ওহ?
বিনোদন পেলো জিশান। বালিশ হার্ডবোর্ডে ঠেকিয়ে তাতে হেলান দিয়ে কিঞ্চিৎ লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রাফার লাস্যময়ী অবয়বজুড়ে। আরো একবার হা*মলে পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে।কিন্তু এই রমণীর মর্জি ব্যাতিত তা সম্ভবপর নয়।সে আপন খেয়ালের মালিক।তার পরাবাস্তব দুনিয়ায় কোনো পুরুষের আধিপত্য চলেনা,সেই জগতের একমাত্র মহারাণী সে স্বয়ং।জিশান একটি দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে শুধালো,

– হুম…. তাহলে বলো কে অধিক তৃপ্তিদায়ক?আমি নাকি দিমিত্রী ভলকভ?
মৃদু আঁচে হাসলো রাফা,সিগারেট হটিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়।নয়ন তুলে জিশানের উদ্দেশ্যে চেয়ে জানালো,
– তৃপ্তি?যদি বলি কেউ কোনোদিন আমার অন্তরের বাসনা পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হবেনা তাহলে কি বিশ্বাস করবে?
– হাহা।কাউকে ভালো টালো বাসো নাকি?
ঠোঁট ওল্টালো রাফা,সিলিংয়ের উদ্দেশ্যে দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ সমাপ্ত করলো। অ্যাশট্রেতে ছোট্ট অংশটুকু রেখে দিয়ে উত্তর করলো,
– রাফা কায়সারের তৃপ্তি ততদিন হবেনা যতদিন না সে শুভ্রতাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করতে সক্ষম হবে।
– তাহলে রাফার জীবনেও কিছু অপূর্ণতা রয়েছে!
কৌতুকসূচক কন্ঠে উচ্চারণ করে বেডসাইড টেবিল থেকে আধখাওয়া হুইস্কির বোতলখানি তুলে নিয়ে চুমুক দিলো জিশান, ঢোক গিলতে আরম্ভ করলো একের পর এক। রাফা কিছুক্ষণ নিঃশব্দ তাকিয়ে রইলো,তারপর খিলখিল হাসির ধ্বনি তুলে জানালো,

– আমার জীবনের চিন্তা না করে নিজের চিন্তা করো।দেশের যা অবস্থা,তোমাকে খুব শীঘ্রই ফাঁ*সিকা*ষ্ঠে দেখতে পাচ্ছি।
মেজাজ বিগড়ে গেলো জিশানের।বোতল খালি করে ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে।ঝরঝর করে ভাঙলো তা, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।
– সবগুলা বেজন্মার দল! রাকিবটাও অক্কা পেয়েছে…. ওটার কাহিনী বের করতে করতে মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে!
– মুখে,হাতে, পায়ে,চোখে কালো পট্টি বেঁধে মিছিল করেছে। মেটাফোর বোঝো?বোঝাতে চেয়েছে এই দেশে ক্ষমতার সামনে মানুষকে কিভাবে মুখ থাকতে বোবা,চোখ থাকতে অন্ধ,আর হাত থাকতে পঙ্গু হয়ে থাকতে হয়।খুব সুনাম কুড়িয়েছে দেখছি।দেশীয় মিডিয়া সরকারি অনুযোগে প্রচার না করলে কি হবে? সোশাল মিডিয়া থেমে নেই।
থমথমে হয়ে থাকলো জিশানের মুখ।দাঁত কিড়মিড় করলেও কিছুই উচ্চারণ সম্ভব হলোনা।

– চুপ করে থাকার সময় এটি নয়।এখন বেসরকারি ভার্সিটিগুলো একজোট হয়েছে,তার সঙ্গে সরকারি ভার্সিটি যোগ দিলে কি হবে ভাবছো?ছাত্র আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কোনো ইতিহাস এদেশে স্থাপিত হয়নি।
শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেলো জিশানের হৃদয়জুড়ে।
– না না।এইসব আর চলতে দেয়া যাবেনা।কিছু একটা করতে হবে।কিন্তু আমার বাপ তো আমার উপর হেব্বি নারাজ,একটা কথা যদি কানে নেয়!শুধু বলে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে,সবকিছু অস্বীকার করতে।বাকি ব্যবস্থা তারা বুঝে নেবে।

– হুম,এরপর তোমাকে সরকার ব*লির পাঁঠা বানাবে।
– কি করা যায়?তুমি কোনো আইডিয়া দিতে পারবে?
এত মুহূর্ত যাবৎ যেন এই মুহূর্তটির অপেক্ষায়ই ছিল রাফা।এই জিশানকে ব্রেইন ওয়াশ করা যতটা সহজ হবে ভেবেছিল,তার চাইতেও অধিক সহজ!হায়রে বোকা পুরুষ!আপনমনে হাসলো রাফা।উঠে বসলো বিছানায়। দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে ব্যক্ত করলো,
– সহজ সমাধান চাও?পালতু কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দাও।কয়েকটাকে গু*লি ক*রে জ*খ*ম ক*রুক। জান প্রান ঝড়ুক কিছু।তবেই টলবে এই ঐক্য।প্রাণের ভয় সবচেয়ে বড় ভয়।রাস্তা এক নিমিষে ফাঁকা হয়ে যাবে।
একদৃষ্টে চেয়ে থাকল জিশান, আবেশিত মস্তিষ্কে খুব বেশি ভাবা সম্ভবপর হলোনা।এটিই যেন সর্বোৎকৃষ্ট উপায় মনে হচ্ছে তার কাছে।

– হিতে বিপরীত হবেনা?
– বিরোধী দলের অস্তিত্ব আছে কি করতে?তাদের নাম লাগিয়ে দিও।
বিস্তৃত এক হাসি ফুটলো জিশানের অধরে।যারপরনাই সন্তুষ্ট সে।এগিয়ে এলো,একটানে রাফাকে কাছে এনে অধরে অধর মিলিয়ে বললো,
– আরে বেবি তুমি এখানে কি করো?তোমার তো রাজনীতিতে নামা উচিত!

প্রতি উত্তরে শুধু হাসলো রাফা,জিশানের আলিঙ্গনের মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ এলিয়ে দিলো।রাফায় মত্ত থাকায় জিশান খেয়ালটুকু করতে সক্ষম হলোনা রমণীর চেহারাজুড়ে কতটা অশুভ আস্ফালন ঘটেছে। ম্যানিউপুলেশন—শব্দটির বাস্তবিক প্রয়োগ জিশান এর পূর্বে কোনোদিন উপলব্ধি করেনি,যা রাফা তার সঙ্গে করে দেখিয়েছে তার অজান্তেই!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বখে যাওয়া ছেলেটি অনুধাবন করতেও সক্ষম হলোনা ন্যায়বিচারের দাবিতে করা এক আন্দোলনকে ঘিরে আড়ালে আবডালে কতশত রাঘব বোয়ালদের ষড়যন্ত্র চলছে,যার মধ্যে রাফা কায়সার একজন।ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এক নির্মম ইতিহাস রচনা করা বোধ হয় এই রমণীর দ্বারাই সম্ভব!আপনমনে হাসলো রাফা,অন্তরে অন্তরে বিড়বিড় করলো,

ডার্কসাইড পর্ব ৪৫

“ ন্যায়ের নেত্রী রোযা,দেখি তুমি কিভাবে রাফা কায়সারের মায়াজালকে টক্কর দাও!রাস্তায় পড়ে পড়ে লা*শ বুকে নিয়ে কাদবে,আর আমি তা দেখে অন্তরের তৃষ্ণা মেটাবো….”

ডার্কসাইড পর্ব ৪৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here