ডার্কসাইড পর্ব ৫০

ডার্কসাইড পর্ব ৫০
জাবিন ফোরকান

অমাবস্যার আঁধারে আচ্ছন্ন এক রাত্রি।স্ট্রিট লাইটের নিয়ন আলো সেই আঁধারকে করে তুলেছে তীব্রভাবে দৃশ্যমান। গগনও আজ যেন রুষ্ট।শীতের মাঝেও ক্ষণে ক্ষণে গর্জে ওঠা মেঘরাজ বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে এক অশুভ উপাখ্যানের সূত্রপাতের।হৃদযন্ত্রজুড়ে ক্ষণে ক্ষণে বি*স্ফো*রণ ঘটছে মৃ*ত্যু আতঙ্কের।নরকের প্রহরী যেন স্বয়ং তাড়া করছে তার পেছনে,টেনে হিঁচড়ে ফেলবে তাকে নরকলা*ভায়।ঘামের প্রবাহে সিক্ত অঙ্গ আবৃত ভীতির চরম অনুভবে খাড়া হয়ে ওঠা রোমের আবরণে।আর সম্ভব নয়, এই কি সমাপ্তি?এতটা নি*র্মম?

নি*র্মম?তোর নৃ*শংস*তার সামনে এ তো বড্ড তুচ্ছ! ভোগ কর নিজের কর্মফল পাপীষ্ঠ!
বজ্রের হুংকারের পরতে পরতে যেন অদৃশ্যমান আত্মারা ঘোষণা করলো তার বিনাশ।খচিত হলো এক ক্রান্তিমালা,কুলষিত ইতিহাসের ভয়াল পাতায়।যে ইতিহাসের খোঁজ সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এবং কল্পনা উভয়ের অতীত।
থমকে পড়লো পদক্ষেপ,সামনে দেয়াল।আঁধারমাঝে পলায়নের পথ অবশিষ্ট নেই।স্পষ্টত পিছনে অনুভব করলো এক পরাবাস্তবকে।অশুভ ছায়া যেন গলাধঃকরণ করলো অস্তিত্বকে,উন্মুক্ত হাতের রা*মদাখানায় তীক্ষ্ণতার প্রজ্জ্বলন।যেন ঘষেমেজে শুধুমাত্র তার জন্যই প্রস্তুত করা হয়েছে।
ঘোষিত হলো মৃ*ত্যু পরোয়ানা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– কাপুরুষ!অবক্ষয়ের কোন সীমায় গিয়ে ঠেকেছিস?মন ভরেনি তোর লালসায়?বাচ্চাগুলোর উপর ঘাত উত্তোলনে কাপেনি ওই হাত?
বায়ু কে*টে তীব্র একটি টানে বি*চ্ছি*ন্ন হয়ে ছিটকে পড়লো ডান হাতখানি,যা মাত্র কিছুদিন আগেই কেড়ে নিয়েছে মিছিলরত এক পথশিশুর প্রাণ।র*ক্তে*র ফোয়ারার সঙ্গে মিলিত হলো আর্তচিৎকার!তবুও নির্দয় দন্ডায়মান শা*স্তিদাতা।পিছনে ঘুরল পাষন্ড, সম্পূর্ণ শরীর কম্পমান সমাপ্তির আবাহনে।দৃষ্টি মিলিত হলো নিষ্পাপ ডাগর ডাগর নয়নে,এই নিষ্পাপতা এমন র*ক্তস্নাত বিপ্লবে সক্ষম?
শেষ আর্জি জানালো,

– আমারে মাফ কইরা দেন!
শুধুমাত্র ক্রুর হাসির ধ্বনি ভেসে এলো বিপরীতে।
– নেমেসিসের নিকট কোনো ক্ষমা নেই,নেমেসিস জানে শুধু প্রতিশোধ আর ধ্বংস!
এটুকুই।অ*স্ত্র সম্বলিত হাতের জোরালো একটি টান,অতঃপর?
ছি*ন্ন ম*স্ত*কটি গ*ড়িয়ে পড়ল সড়কে,মাখামাখি হলো নর্দমার কাদাপানিতে।জ্বলজ্বলে নিষ্প্রাণ চোখজোড়া তখনো চেয়ে আছে,অমানিশার বিচারের সাক্ষী হয়ে…….

নিজের পোর্শের বনেটে হেলান দিয়ে ঘোর অন্ধকারে ডুবে থাকা সুবিস্তৃত আকাশপানে চেয়ে আছে আসমান।হাতে একটি লাইটার,বিনা কারণেই ঘুরিয়ে চলেছে তা আঙুলের মাঝে।ঝিরঝিরে হিমেল সমীরণ তার পরিধানের লেদার জ্যাকেটখানিতে ঢেউ খেলিয়ে দিচ্ছে।তার ক্ষুরধার মস্তিষ্কের নিগূঢ় চিন্তায় ছেদ ঘটালো ফোনের ভাইব্রেশন।পকেট থেকে বের করে হাতে তুলতেই আসমানের গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হয়ে তাতে প্রফুল্লতা ভর করলো। ক্ষুদে বার্তা এসেছে।

মুনলাইট: কোথায় তুমি?কখন আসবে?
শেষে একটি অপেক্ষারত কার্টুনের ইমোজী পাঠানো হয়েছে।সামান্য হাসলো আসমান,পাল্টা টাইপ করলো।
মুন: আমার ফিরতে একটু দেরি হবে।খেয়েছ?
মুনলাইট: তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
মুন: অপেক্ষা করোনা।খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে, আগামীকালও যাবে।
মুনলাইট: আজ একবারও তোমাকে দেখতে পেলাম না।ভালো লাগে না।
আসমানের হাসি বিস্তৃত হলো।উত্তর করলো,
মুন: আমার বউয়ের এত ভালোবাসা আমি কোথায় রাখি?
মুনলাইট: তুমি শুধু মেসেজেই রোম্যান্টিক।সত্যিকারে অষ্টরম্ভা!
মুন: হুম।প্রস্তুত থেকো।বাসায় এসে বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি কি জিনিস।
মুনলাইট: ভয়ে আমি কাপতে কাপতে শেষ হয়ে গেলাম গো!এখন আমার কি হবে গো?ও খালা,ও চাচা!আমাকে বাঁচাও!

মুন: ……(স্পিচলেস বায় ইওর ড্রামা)
মুনলাইট: তুমি কি আমাকে নাটকবাজ বললে?
মুন: তুমি?একদম না।তুমি আমাদের নেত্রী দ্যা লিডার।যাকে একবাক্যে সবাই চেনে।
মুনলাইট: একবাক্যে চেনে!ঢং দেখাও?
মুন: সত্যি বলছি।বিশ্বাস হচ্ছে না?সেদিন বিজনেস ডিনার পার্টিতে আমাকে এইচপি কোম্পানির ম্যানেজার কি বললো জানো? আরে আপনি রোযা রেমানের স্বামী না?
মুনলাইট: তুমি কি বললে?
মুন: বললাম যে না,আমি রোযা রেমানের ব্যক্তিগত কোলবালিশ যাকে সে প্রতিদিন রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়।
মুনলাইট: অসভ্য!
মুন: তোমার জন্য!

মুনলাইট: সরি।খুবই ক্রিঞ্জি ছিল।
মুন: তাই বুঝি? আই গেস,রোম্যান্স ইয নট মাই কাপ অব টি দ্যান।
মুনলাইট: হুম,ঠিক লাইনে এসেছ।এবার সুন্দর করে বাসায়ও চলে আসো।ব্যক্তিগত কোলবালিশ ছাড়া ঘুমিয়ে শান্তি পাবোনা।
মুন: হাহা,আসছি।স্লিপ ওয়েল মাই কুইন।
মুনলাইট: ……(ব্লাশিং)
মুন: এখন আমার কি বলা উচিত যে ফোনের ওপাশ থেকে একটা চুমু দাও আমি এপাশ থেকে দেই, টেলিপ্যাথির মাধ্যমে ডেলিভারি হবে?
মুনলাইট: ইশ!ছিঃ!আমরা কি ক্লাস নাইনে পড়া প্রেমিক প্রেমিকা নাকি?
মুন: হুম,ধরে নিতেই পারি।
মুনলাইট: আসমান!তোমার ফোন নিশ্চিত হাইজ্যাক হয়েছে।তুমি কি মোহাম্মদপুরে গিয়েছ?এই মিস্টার আপনি কে?আমার স্বামীর ফোন ফেরত দিন বলছি।আপনি জানেন না তিনি আপনাকে এক ঝটকায় পরপারের যাত্রী বানিয়ে দেবে!

মুন: একটুও হাসি আসলোনা।
মুনলাইট: ফোন ফেরত দিন বলছি!
মুন: হাহা,অনেক মজা হয়েছে।ঘুমাও।আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
মুনলাইট: আচ্ছা।গুড নাইট মাই মুন।
পাল্টা শুভরাত্রি জানানোর সুযোগ হলোনা আসমানের। আঁধার ভেদ করে বেরিয়ে আসা ছায়ামূর্তিগুলো তাকে থমকাতে বাধ্য করলো।ফোন পকেটে পুরে শিরদাঁড়া টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আসমান।তার বিপরীত প্রান্তে এসে দাঁড়ালো হাবিব এবং মাস্কে মুখ ঢাকা দুইজন যুবক।
– কাজ শেষ।
হাবিব উচ্চারণ করতেই ডান পাশের গলির অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এলো নিহাদ।পরিধানের কালো জ্যাকেটজুড়ে তার ছোপ ছোপ র*ক্তে*র দাগ,হাতের দা খানি চুঁইয়ে টপটপ করে রক্তিম তরল গড়াচ্ছে ভূমিতে।দৃষ্টি তার অত্যন্ত কঠিন,তাতে অব্যক্ত অনুভূতির প্রজ্বলন।আসমানের মুখোমুখি থামলো সে, অ*স্ত্র ছুঁড়ে দিলো পার্শ্ববর্তী যুবকের হাতে।মাথা কাত করে জানালো,

– ডান!
সন্তুষ্ট হয়ে মাথা দোলালো আসমান।হাবিব চারিদিকে নজর বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– লা*শগুলো ওভাবেই পরে থাকবে?
আসমান এই প্রশ্নের জবাব দিলোনা।উল্টো ঘুরে নিজের গাড়ির দরজার দিকে এগোলো।তার পক্ষ থেকে উত্তর করলো নিহাদ,
– অবশ্যই।দেখুক সবাই,জানুক,ক্ষমতার বিরুদ্ধে নেমেসিসের অবস্থান।
– ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবেনা ব্যাপারটা?
তীর্যক হাসলো নিহাদ,হাবিবের কাধ চাপড়ে জানালো,
– খেলা সবেমাত্র শুরু।

– ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয়না।প্রতিপক্ষ যে আরো লোক জড়ো করে পাঠাবেনা তার নিশ্চয়তা কতটুকু?
সশব্দে গাড়ির দরজা খুলে হাবিব এবং নিহাদের দিকে তাকালো আসমান।তার দৃষ্টিজুড়ে প্রজ্জ্বলিত এক অগ্নিগহ্বর।
– ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয়না সত্যি,কিন্তু ভুলেও যেওনা, কাক কখনো কুকুর হয়না।
হাবিব একটি ঢোক গিললো আনমনে,আসমানের কন্ঠ প্রগাঢ়তা ধারণ করলো,
– পালিত কুকুর মনিবের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে উৎসর্গ করার মনোভাব রাখে,কিন্তু কাক বিপদের আঁচ পাওয়ামাত্র পলায়ন করে।সরকারের পালতু সেনা ভিন্ন কিছু নয়।তাদের পূর্ববর্তী দলের এই হাল উপলব্ধি করামাত্র সটকে পড়তে বাধ্য।

বক্তব্যের মাঝে এক সম্মোহনী ব্যাপ্তি ছিল আসমানের, যার দরুণ সকলে দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো।তাদের সেই সম্মোহন ভাঙলো কঠোর আদেশে,
– গেট ইন দ্যা রাইড।
গাড়িতে চেপে বসতেই নিহাদ প্যাসেঞ্জার সিটখানা দখল করে নিলো।অপরদিকে পিছনের জ্বীপে চেপে বসলো হাবিব এবং বাকিরা।নিঃশব্দে যাত্রা আরম্ভ করলো তারা।পিছনে ফেলে গেলো এক হ*ত্যাযজ্ঞের ময়দান।

আলোর মিছিল কর্মসূচি দূর্দান্তভাবে সফল হয়েছে।রোযা যা কাম্যও করেনি তাই ঘটে গিয়েছে।শুধুমাত্র শিক্ষার্থী নয়,বরং জনসাধারণও এই ন্যায়ের লড়াইয়ে যোগদান করেছে।ঠিক যেমন আঁধার রাত্রি ছাড়িয়ে চারিদিকে নতুন দিনের রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে,তেমন করেই যেন আন্দোলনের মোড় ঘুরে গিয়েছে অতর্কিতে।দোয়েল চত্বরের হ*ত্যা*কাণ্ড ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে সরকারের উপর।আলোর মিছিল কর্মসূচির মাধ্যমে বর্তমানে শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়,বরং নামকরা সব নেতৃস্থানীয় সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে এসে।প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট চলছে,ক্লাস,পরীক্ষা বয়কটের ডাক তুলেছে সকলে একযোগে।

অনির্বাণ আহমেদের শক্তিশালী ভিত্তির রিপোর্টসমূহ কাজ করেছে এই বিদ্রোহের অ*গ্নিকুন্ডে ঘি ঢালার মতন।সকলের নিকট পৌঁছে যাচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খ সকল খবর।বিশেষ করে তার নেমেসিস সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি বর্তমানে আগ্রহের তুঙ্গে রয়েছে।সত্যিই কি নেমেসিস রয়েছে?যদি থেকেই থাকে,তবে নেমেসিস কি এইবার ন্যায়ের তরে লড়বে?এমনি এক গুঞ্জনে ছেয়ে আছে চারিদিক।এর মাঝেও অবশ্য হাল ছাড়তে নারাজ সরকার।অহনা হ*ত্যা*য় জড়িত মাহির এবং একজন রমণীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।কিন্তু তা যে শুধুমাত্র লোক দেখানো বুঝতে বেগ পেতে হয়নি কারো।এখন যদি এই আন্দোলন থেমে যায়,আর কিছুদিন পর অর্থবিত্তের জোরে সবকিছুই যে ধামাচাপা পড়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

আজ চৌরাস্তাজুড়ে আন্দোলন চলছে।একটি সড়ক ছেড়ে দেয়া হয়েছে সম্পূর্ণ,যেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স এবং জরুরী যাতায়াত বাহনগুলো দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে বিশেষভাবে নির্বাচিত কয়েকজন ছাত্র।অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদের পক্ষ থেকে আজ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।একটি ছোট্ট স্টেজের মতন স্থান তৈরি করা হয়েছে, হ্যান্ডমাইকে বিস্তৃত পরিসরে কাজ সম্ভব নয় বলে মাইক্রোফোন এবং স্পিকারের ব্যবস্থা করেছে আইটি টিম।পরিষদকে এরকম কয়েকটি ছোট ছোট ভাগে ভাগ করেছে রোযা।যাদের একেক ভাগের দায়িত্ব একেক।এক দল সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং মিডিয়ায় মনোযোগ দেবে,আরেক দল গুপ্তচরের মতন আন্দোলনের মাঝে মিশে থেকে নজর রাখবে যেন কোনোপ্রকার অপ্রীতিকর কিছু সংগঠিত না হয়,কেউ করবে সমন্বয়ের কাজ,কেউ আবার তথ্য সংগ্রহ ও বণ্টনের কাজ।একেক দলের নেতৃত্ব একেকজনের, সবকিছুর নির্দেশদাত্রী রোযা।পরিষদকে এভাবে গুছিয়ে নেয়ার দরুণ বিশৃংখলা খুবই কম হচ্ছে, যা এইসব আন্দোলনে মোকাবেলা করা অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ।এই ধাপ বেশ ভালোভাবেই উৎরে গিয়েছে রোযা।রাজধানী ছাড়িয়ে বর্তমানে সমগ্র দেশজুড়ে তাই ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। দায়িত্বের বোঝা ক্রমশ ভারী হয়ে জেঁকে বসছে রোযার কাঁধে,কিন্তু বর্তমানে এটিকে বোঝা নয় বরং ঐক্যশক্তি অনুভূত হয় রোযার।

বর্তমানে স্টেজে মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে সোজা।যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু মানুষ এবং মানুষ।আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল রোযারা ছিল মাত্র পাঁচজন।আর আজ?সংখ্যাটা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে।দিগন্ত পর্যন্ত তাকালেও অনুভূত হয় মানুষের ভীড়।এতজনের সামনে নিয়ন্ত্রণকারী নেত্রী হয়ে দন্ডায়মান রোযা।আজ থেকে কয়েক মাস আগেও বিষয়টি ছিল অকল্পনীয়।মানুষের জীবন নাটকের চাইতেও নাটকীয়।
– আসসালামু আলাইকুম।
রোযা মাইক্রোফোনে বলতেই গণসমুদ্রের গর্জন ভেসে এলো।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।

অতঃপর,নীরবতা।প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্য রোযাকেও ভড়কে দিলো।এত এত মানুষ,যেদিকে তাকাচ্ছে মানুষ ব্যতিত কিছুই নজরে আসছেনা।তবুও এতটা প্রশান্ত কিভাবে থাকছে তারা?রোযার বক্তব্য শোনার উদ্দেশ্যে?এই আন্দোলনের সম্মানে?হয়ত।গর্ববোধ করলো রোযা।এর পূর্বে কোনোদিন সে উপলব্ধি করেনি তার মাঝে মানুষকে প্রভাবিত করবার সম্মোহনী শক্তি রয়েছে।পরিস্থিতি কত কিছুই না নিজের মাঝে নতুনভাবে আবিষ্কার করায়,নতুনভাবে উন্মোচিত করে অস্তিত্বের নব্য দ্বার।

– ক্রান্তিলগ্ন পেরিয়ে আমাদের এই সংগ্রাম বর্তমানে এক অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছেছে।যেখানে বর্তমানে আমরা একা নই।আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের মা,বাবা,ভাইবোন,স্বামী,স্ত্রী,গুরুজন,আত্মীয় স্বজন সকলে।আমি সকল অভিভাবকদের প্রতি কৃতজ্ঞ যারা সন্তানদের ন্যায়ের প্রতিবাদকে সমর্থন করে মাঠে নেমেছেন।আমি গর্বিত সেইসব ভাইবোনদের প্রতি যারা তাদের বোনের সম্ভ্রম এবং জীবনের তরে এগিয়ে এসেছে বিদ্রোহী হয়ে।বর্তমানে কোনো ক্ষমতার ব্যারিকেডের সাধ্য নেই আমাদের দমানোর।
প্রচণ্ড এক হুংকার উঠলো,

“ সম্ভ্রম গেলো অহনার,ঘটিয়ে দিয়ে তোলপাড়
জীবন দিলো মালিহারা,দানব এবার সরে দাড়া
ছুটিয়ে দ্রোহের পাগলা ঘোড়া,আসছে ছুটে বিদ্রোহীরা
ক্ষমতার গদি উপড়ে ফেলে,বিদ্রোহ হোক ঘরে ঘরে।”
আপ্লুত হয়ে পড়ল রোযা।বারকয়েক ধ্বনিত হয়ে আবার ম্রিয়মাণ হলো জনতা।তার উদ্দেশ্যে সকলের মনোযোগী দৃষ্টি।মাইক্রোফোন তুলে রোযা বলতে থাকলো,
– আজ থেকে তিন দফা কর্মসূচি ঘোষণা করছে অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদ।দফা এক,অহনা হ*ত্যাকা*ণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারকার্য।দফা দুই, আমার ভাইবোনদের উপর ন্যক্কারজনক হা*মলার বিচার।এবং দফা তিন,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইকবাল আহসানের পদত্যাগ!যে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তার দেশে,তার অধীনে,তার সন্তানতুল্য ছেলেমেয়েদের বু*ক গু*লি*তে ঝাঁ*ঝরা হয়,তার পুলিশ থাকে নীরব,কাপুরুষ দন্ডায়মান,ক্ষমতার আসন তাকে ধিক্কার জানায়! স্টেপ ডাউন হোম মিনিস্টার!

করতালির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গর্জন উঠলো।রোযার অন্তিম দফা সকলকে যতটা না বিস্মিত করেছে,তার তুলনায় অধিক তৃপ্ত এবং দুঃসাহসী করেছে। জনসমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে রোযা বললো,
– আমাদের তিন দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। কোনো বৈঠক,কোনো আলোচনা, কোনো শান্তিচুক্তির লোভ দেখিয়ে লাভ নেই।আমার ভাইবোনের র*ক্তে*র সঙ্গে বেঈমানি করে কোনো আলোচনা হবেনা।পলাতক জিশান আহসানকে অতি সত্ত্বর আইনের আওতায় আনতে হবে।সামান্য এক মন্ত্রীর ছেলে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা বাহিনীর চোখে ধূলো দিয়ে ঘুরে বেড়াতে সক্ষম হলে এই জাতি কতটা অক্ষম ধরে নেব?দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।এবং অবশ্যই অবশ্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করতে হবে,জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব যে সিংহাসনের,সেই সিংহাসনে এক অযোগ্য কাপুরুষ পিতাকে আমরা দেখতে চাইনা।

– চাইনা চাইনা!
প্রতিধ্বনিত হলো চারিদিকে।সন্তুষ্টির হাসি হাসলো রোযা,তারপর নমনীয় কন্ঠে ব্যক্ত করলো,
– পরিশেষে বলব,আমার ভাইবোনেরা এবং গুরুজনেরা,তোমরা একেকজন একটি বিদ্রোহী স্ফুলিঙ্গ।যে স্ফুলিঙ্গের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছে অহনা,যে বোনটির তরে আমরা রাজপথে নেমেছি।এই স্ফুলিঙ্গকে সম্মিলিত করে দাবানল ঘটিয়েছে মালিহা, রাজিয়া খাতুন এবং রাব্বি নামের শিশুটি, যাদের র*ক্তে*র বিনিময়ে আমাদের আলোর মিছিল আর নতুন স্বাধীনতা।ঐক্যবদ্ধ হয়েছি আমরা, লড়তে হবে অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত। নেমেসিসের কথা ভাবছো?তার সাহায্য কামনা করছো?তোমার লড়াই তোমাকেই লড়তে হবে,নেমসিস আছে কি নেই,সে আসবে কি আসবেনা তার ব্যাপার।তবে প্রেরণা নিতে পারো।গড়তে পারো নিজেকে।ভাইয়েরা আমার,অনুরোধ থাকবে তোমাদের প্রতি,নিজেকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলো,সুশিক্ষিত হও, জন্মদাত্রীর জাতিকে সম্মান করতে শিখো এবং অপরকেও সেই শিক্ষা দাও।আর বোনেরা,ভয় পেয়ে পিছিয়ে এসোনা কখনো,অহনা কখনো ভয় পায়নি,অক্ষম হয়েও ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে,মাথা নোয়ায়নি কোনোদিন।পরিণতি?দেখো,আজ তার তরে রাস্তায় নেমেছে শত সহস্র মানুষ।জাগ্রত হও তোমরা,ছিনিয়ে নাও আপন অধিকার।ভীতি নয়,মোকাবেলা করো নিজের বাঁধাকে।তবেই তুমি সফল।
থামলো রোযা,এক মুহুর্ত,অতঃপর সমাপ্তি টানলো,

– ভুলে যেওনা,তোমাদের প্রত্যেকের মাঝে একজন করে নেমেসিস বাস করে!কে নেমেসিস?বিভ্রান্ত হয়োনা।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো,নেমেসিস তুমি,আমি,আমরা সকলে!
বক্তব্য সমাপ্তি হওয়ার পরও দীর্ঘ এক মুহুর্তজুড়ে পিনপতন নীরবতা।তারপর গর্জে উঠলো জনতা, মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল প্রান্তর। বুক ভরে প্রশ্বাস গ্রহণ করলো রোযা,তাকালো আকাশের পানে।তারপর ধীরে ধীরে স্টেজ থেকে নেমে এলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর।

সম্পূর্ণ কর্মসূচি সমাপ্ত করার দায়িত্ব অভিষেক এবং সাবিহাকে ন্যস্ত করে রোযা আরিয়ানকে নিয়ে চললো পরবর্তী গন্তব্যে।সামান্যতম ফুরসৎ যেন নেই তার।বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংঘের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিটিং রয়েছে।পরিকল্পনা করতে হবে।অভিষেক, সাবিহা এবং অনির্বাণ পরে যোগ দেবে।গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাবিব।অন্যদিনের তুলনায় ছেলেটি নির্বিকার।বর্তমানে সে রোযার কোনোপ্রকার কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেনা,শুধু নিঃশব্দে পাশে থাকে এবং আজ্ঞা পালন করে।

সামনের মূল সড়কে ড্রেনেজের কাজ চলায় গাড়ি ঘুরিয়ে হাবিব পার্শ্ববর্তী গলিতে ঢুকলো।ভেতরে আরিয়ান ব্যাস্ত ল্যাপটপে,সে মূলত আইটি টিমকে নেতৃত্ব দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের দায়িত্ব তার।বেশ দক্ষভাবেই সে পালন করে চলেছে প্রত্যেকটি অর্পিত কর্তব্য।ব্যান্ডেজ খোলা হলেও হাতে বর্তমানে বিভীষিকার ছাপ স্পষ্ট।ডাক্তার বলেছে সময়ের সাথে সাথে মিইয়ে আসবে ঠিকই,কিন্তু সম্পূর্ণ দূরীভূত হবেনা।ব্ল্যাক স্কিন ব্যবহার করে তা আচ্ছাদিত করে রাখে আরিয়ান।এই স্থানে এসে তার সঙ্গে আসমানের কিঞ্চিৎ মিল পাওয়া যায়।দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলো রোযা,আরিয়ানের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বাহিরে তাকালো।

অতর্কিতে ব্রেক কষে থেমে গেলো গাড়ি।তাতে খানিক ঝটকা খেলো আরিয়ান এবং রোযা।সামনে তাকাতেই খেয়াল করলো ঠিক বিপরীত প্রান্তে অপর একটি গাড়ি অবস্থানরত।ঝকঝকে শুভ্র বর্ণের গাড়িটির বনেটের উপর হাঁটু তুলে বসা এক রমণী।শরীরে জড়ানো তার কালো বর্ণের বডিকোন গাউন,যেন সদ্য কোনো পার্টি থেকে বেরিয়েছে।কাঁধের উপর তুলে দেয়া কোনো পুরুষের জ্যাকেট,দুহাতে স্বচ্ছ গ্লাভস।চিকচিকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।হাতে একটি ধূসর মলাটের বই,যাতে মুখ ঢেকে রেখেছে।তবে তাকে চিনতে সামান্যতম বেগ পেতে হলোনা রোযার।এমন অপ্রীতিকর এক প্রভাব শুধুমাত্র একটিমাত্র মানুষের আশেপাশেই বিদ্যমান থাকে।
রাফা কায়সার!

– কোনো ফিল্মের হিরোইন নাকি?
আরিয়ানের সতর্ক কন্ঠস্বর ভেসে এলো পাশ থেকে।রোযা মাথা নাড়লো,হাত বাড়িয়ে দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে বললো,
– ব্যক্তিগত শত্রু।
বাইরে পা রাখার পূর্বে লুকিং গ্লাসে হাবিবের সঙ্গে একনজর দৃষ্টি বিনিময় করলো সে।ছেলেটি মাথা দোলালো,সন্তপর্নে নজর বিছিয়ে রাখলো সামনে।বাইরে বেরিয়ে রোযা ধীরগতিতে এগোলো রাফার দিকে।ড্রাইভার বাদে অন্য কারো অস্তিত্ব চোখে পড়ছেনা ওপাশে,তবুও চারিদিকে ধারালো নজর বুলিয়ে আনলো।এই রমণী যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু করতে সক্ষম।কিঞ্চিৎ আতঙ্ক অবশ্যই অনুভূত হচ্ছে।কিন্তু কতদিনই পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়া যায়? সমস্যা থেকে না পালিয়ে তাকে মোকাবেলা করতে হয়।

রোযার পরিধানের জুতোর সোলের মৃদু শব্দে বই থেকে মুখ সরিয়ে রাফা সামনে তাকালো।কালো লিপস্টিকে আবৃত অধরে তার জ্বলজ্বল করছে জরির খেলা,যেন আকাশের তারকারাজি নেমে এসে স্থান নিয়েছে তার অবয়বজুড়ে।স্মোকি মেইকআপ করা মুখাবয়ব ঠেকছে অত্যন্ত ধূর্ত এবং তীক্ষ্ণ। রোযাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো তার দৃষ্টি,অত্যন্ত অবজ্ঞাভরে।রোযা কিছুই বললোনা,চেয়ে থাকলো স্থির। রাফা মাথা একবার এদিক আরেকবার ওদিক কাত করে অতর্কিতে বইটা বন্ধ করলো,তার হাতে উঠে এলো মোটা একটি বান্ডিল।টাকার নয়,ডলারের।
– আসমানের জীবন থেকে সরে যেতে কত চাই তোমার?
বিস্তৃত হলো রোযার অধর,বুকে দুবাহু ভাঁজ করে এমন ভঙ্গিতে রাফার দিকে তাকালো যেন সে ভীষণ বিনোদিত হয়েছে।

– নব্বই দশকের বাংলা সিনেমার ডায়লগ হয়ে গেলো না ব্যাপারটা?
– হুম।
পিছনে হাত বেঁধে রোযার নিকটে এলো রাফা, চারিদিকে বৃত্তাকার ঘুরে মুখোমুখি এসে থমকালো।সামান্য নড়লোনা রোযা,একই ভঙ্গিতে অটল সে।হিমালয়ের যোগ্য অর্ধাঙ্গিনী—মনে মনে সন্তুষ্ট হলো রাফা।সন্নিকটে সরলো সে রোযার,এতটা যে বিতৃষ্ণায় ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো মেয়েটির।জিভ বের করে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে রাফা শুধালো,
– অর্থ চাইনা?তবে?বাড়ি,গাড়ি,সম্পত্তি?বিদেশের কোথাও স্থায়ী ঠিকানা?সুদর্শন পুরুষ? জাস্ট নেইম ইট, আই ক্যান মেইক ইওর এনি ড্রিম কাম ট্রু কিটেন!

শেষ বাক্যটি অত্যন্ত আবেশিত শোনালো, আরো নিকটে এলো রাফা। রোযার সঙ্গে মাইন্ড গেইম খেলছে সে।শত্রু যত সন্নিকটে থাকে,প্রতিপক্ষ তত অসহায়বোধ করে।আর রোযা তো সামান্য এক অবলা নারীমাত্র!
রোযার অধরে ফুটে ওঠা তীর্যক হাসিটি এক লহমায় রাফার আত্মবিশ্বাসকে যেন গুঁড়িয়ে দিলো।সামনে ঝুঁকলো রোযা।রাফা ভারসাম্য হারিয়ে পিছনে গাড়ির বনেটে হেলান দিতে বাধ্য হলো,দুপাশে দুহাত ঠেকিয়ে তাকে মাঝখানে আবদ্ধ করে ফেললো অমানিশার দীপ্তি।মাথা কাত করে বললো,
– সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করছেন তার জল চাই কিনা?অত্যন্ত হাস্যকর।
খুব দ্রুতই নিজেকে নিয়ন্ত্রনে নিলো রাফা,ভরকালে চলবেনা।শত্রুর অপ্রত্যাশিত আচরণ দুঃসাহসী হয়ে মোকাবেলা করতে হয়।অন্যথায় নিশ্চিত পরাজয়।সামান্যতম দুর্বলতার ঠাঁই নেই এই অদৃশ্যমান যু*দ্ধক্ষেত্রে।

– কি চাই তোমার তাহলে?
– আসমানের কলংকহীন মুখশ্রী।পারবেন ফিরিয়ে দিতে?
সম্পূর্ণ স্থির চেয়ে থাকলো রাফা,সামান্য নড়লোনা।রোযা হাত সরিয়ে এক পা দূরে সরে দাঁড়ালো,তারপর মৃদু হেসে জানালো,
– এমনিতে আমার কোনো খেদ নেই।আমি কলংকিত চাঁদকেই ভালোবাসি।তার কলংকের বৃদ্ধি কিংবা মোচনে আমার অন্তরের প্রেমের ঘাটতি ঘটবে না কোনোদিনও।
– ভালোবাসা?প্রেম? হোয়াট অ্যান ইনোসেন্ট কিটেন ইউ আর!

হাসলো রাফা,তার খিলখিলে ধ্বনি মাধূর্যপূর্ণ শোনালেও কেমন যেন অন্তর্জ্বালা সৃষ্টিকারী।এমনি এক অস্তিত্ব রাফা কায়সার,যাকে ঘৃণা করা যায়,কিন্তু তার উপস্থিতি কখনো উপেক্ষা করা যায়না।
– আসমান তোমাকে ভালোবাসে,তুমিও আসমানকে ভালোবাসো।শুনতে কি মধুর লাগে তাইনা?কিন্তু জগতের সবথেকে বড় মিথ্যা এই “ভালোবাসা”। ভালোবাসা বলতে কিছু নেই,এর নাম দেয়া উচিৎ স্বার্থ।
স্থির তাকিয়ে থাকলো রোযা।তার দিকে এগিয়ে এলো রাফা,এখনো অধরে হাসি লেপ্টে রয়েছে।অদূরে গাড়ি থেকে সবকিছু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে হাবিব,এমনকি আরিয়ানও।দুই রমণী একে অপরের মুখোমুখি।তারা কোনোপ্রকার লড়াই করছেনা।তবুও তাদের ঘিরে থাকা অদৃশ্য কলুষিত প্রভাব জানান দিচ্ছে, এ এক বিনা যু*দ্ধে র*ক্তপাতের খেলা।যেখানে অ*স্ত্র হলো কথা।

রাফা রোযার নয়নে দৃষ্টি মেলালো।বলল,
– মানুষ তার চাহিদা অনুসারে সঙ্গী নির্বাচন করে।অতঃপর সম্পর্কের নাম দেয় ভালোবাসা।এই ভালোবাসা এক চমৎকার মরীচিকা।
– খুব ভালো দর্শন আপনার।ঠিক ধরেছেন।আমার এবং আসমানের মাঝে চাহিদা রয়েছে।অন্তরের চাহিদা। একে অপরের অস্তিত্বের সাথ পেতে আমরা উভয়ই স্বার্থপর।

বলতে বলতে এগোতে থাকলো রোযা, রাফা না চাইতেও পেছাতে আরম্ভ করলো।মেয়েটির মুখাবয়বজুড়ে যে ধূর্ততা প্রকাশ পাচ্ছে তার উৎপত্তি কবে ঘটলো?নাকি বহু আগে থেকেই তার মাঝে এর বীজ বোনা ছিল?বর্তমানে উপলক্ষ পেয়ে উন্মুক্ত হয়েছে।ভাবতে পারলোনা রাফা,রোযার অসম্ভব গভীর এক কন্ঠ তার চিন্তায় বাঁধা সৃষ্টি করলো।
– আসমানের চাহিদার শেষ নেই।কোনোদিন অমানিশার স্পর্শ অনুভব করেছেন?কপালে, অধরে কিংবা কপোলে?জানেন কেমন সুখ সুখ অনুভূতি হয় যখন তার বাহুজোড়া আলিঙ্গনে আগলে নেয়, হিমশীতল আশ্বাসের প্রবাহ খেলে চলে সর্বাঙ্গজুড়ে?উপস!আপনি জানবেন কিভাবে?আপনি তো নর্দমার কীটের চাইতেও অধম!বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর সাধ্য কার?

স্পষ্টত কম্পিত হলো রাফা,মুখের উপর এমন অপমান আর যেই হোক অন্তত রাফা কায়সার সহ্য করবেনা।এটাই কাম্য ছিল রোযার।মুষ্টিবদ্ধ করে সহসাই হাত উত্তোলন করলো রাফা,উদ্দেশ্য রোযাকে আ*ঘাত করা।কিন্তু তার হাত পাকড়াও করলো রোযা দৃপ্ত স্পর্শে,মুষ্টিবদ্ধ হয়ে তার আঙ্গুল চেপে বসলো রাফার কব্জিজুড়ে।এতটা জোর পড়লো যে বেদনায় ভ্রু কুঁচকে এলো দানবীর।
– ইশ!খুব হিংসা হচ্ছে বুঝি?নিজের মতন খোলা ময়দানে গোল দিতে পারছেন না বলে?প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাইন্ড গেইমে হারাতে ব্যর্থ?

ঝুঁকলো রোযা, রাফার কানে ফিসফিস করে বললো,
– যে খেলা আপনি খেলছেন আমি সেই খেলার রেফারি।
শীতল শিহরণ খেলে গেল রাফার শরীরে।প্রসারিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো রোযার মুখাবয়বে।তারপর অতর্কিতে ঘটলো ঘটনাটি।হাঁটু দিয়ে রোযার তলপেট বরাবর আ*ঘা*ত হে*নে আ*ছড়ে ফেলল তাকে বনেটের উপর।হাবিব দ্রুত গাড়ির বাইরে বেরোলো, কিন্তু অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন হলোনা।রোযা হাত তুলে থামিয়ে দিয়েছে তাকে।
– বক্তৃতা ভালোই জানো ন্যায়ের নেত্রী।তবে শক্তি কি আছে?
হাসলো রোযা,তার স্নিগ্ধ হাসিটি বড্ড অশুভ ঠেকলো।
– বললাম না,এই খেলার রেফারি আমি?

রাফা এক সেকেন্ড দেরি করলো উপলব্ধি করতে, ওটুকুই রোযার জন্য যথেষ্ট ছিল।বনেটে রাখা মোটা মলাটের বইখানি তুলে ধরে সটান আ*ঘা*ত করলো সে রাফার মুখ বরাবর।উল্টো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হলো দ্রুতই। রাফার কেশরাশি পাকড়াও করে তাকে বনেটে আ*ছড়ে ফেললো রোযা, ঘাড়ে সাড়াশির মতন চেপে রাখলো হাত যেন নড়চড় না করতে পারে।মুক্ত হওয়ার জন্য রাফার ছটফটানি অগ্রাহ্য করে রোযা বইটির মলাট দেখলো,
– হুম।চেইজিং ক্যামেলিয়া?কেমন বই এটি?

রাফাকে ছেড়ে দিয়ে বইয়ে মনোনিবেশ করল রোযা, পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো।অপরদিকে মুক্তি পেয়ে ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে থাকলো রাফা।ঝট করে তাকালো পিছনে।তবে রোযার উপর হা*মলা করলোনা।আজ সেই উদ্দেশ্য নেই তার।বইয়ের পৃষ্ঠায় দৃষ্টি বুলিয়ে ভ্রু উঁচু হলো রোযার,
– ওহ?ক্যামেলিয়া মূল চরিত্র?আর এই জ্যাকসন একজন….স্টকার,ক্যামেলিয়ার সৎ ভাই?মাইক্রো ক্যাম লাগিয়ে রেখেছে ক্যামেলিয়ার রুমে,একজন মেয়ের অজান্তেই তাকে পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিটা মুহূর্তে। হাউ রোম্যান্টিক!
তীর্যক হাসি নিয়ে রাফার দিকে তাকালো রোযা, পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে জানালো,
– আপনার বইয়ের পছন্দ দেখে একটুও অবাক হচ্ছিনা।

তৎক্ষণাৎ বইটি ছিনিয়ে নিলো রাফা।স্থির তাকিয়ে থাকলো রোযার দিকে।পিছনে দুহাত বেঁধে রোযা সামনে ঝুঁকলো,
– ধূসর পৃষ্ঠার জগৎ থেকে বাস্তবে পদার্পণ করুন।চেয়ে দেখুন আশেপাশে,সত্যিকার পৃথিবী কোথায় আর এই কাল্পনিক জগৎ কোথায়!আপনার সঙ্গে এমনটি ঘটলে একটুও রোম্যান্টিক লাগবেনা বিষয়গুলো বিশ্বাস করুন।নিজের অন্তরকে ধূসর চিন্তায় কলুষিত করবেন না।
– বাস্তবতা নাটকের চাইতেও নাটকীয়, কিটেন!এই কাহিনীর অনুপ্রেরণা লেখক কোথা থেকে পায় বলে মনে করো তুমি?
হাসলো রাফা,বইটি নিজের বুকে চেপে ধরলো।

– এটি আমার সবথেকে পছন্দের বই।কেনো জানো?কারণ এর সঙ্গে আমার জীবনের প্রচণ্ড মিল রয়েছে।ক্যামেলিয়া এবং জ্যাকসন যেন আমার আর আসমানের প্রতিচ্ছবি।শুধু চরিত্রের রোল অদল বদল হয়ে গেছে এই যা।বাকি সব….এক!
শেষ বাক্যে অদ্ভুত জোর প্রদান করলো রাফা।তাতে প্রথমবারের মতন হতচকিত হলো রোযা।উপলব্ধি ঘূর্ণিঝড়ের বেগে আ*ঘা*ত হা*নলো সহসাই।ব*জ্রাহত হয়ে দন্ডায়মান রইলো সে, দৃষ্টিজুড়ে অবিশ্বাস।
– আস….আসমান….আপনার সৎ ভাই?
জবাব দিলোনা রাফা, কেশগুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে বিস্তৃত হাসলো শুধু।

– আসমান….বাদশাহ কায়সারের ছেলে?
– হুম,যতটা অকর্মণ্য ভেবেছিলাম ততটাও নও তুমি।কি সুন্দর বুঝে ফেললে সত্যিটা!
কয়েক মুহূর্ত স্থবির হয়ে থাকলো রোযা,চরম উপলব্ধি তার প্রশান্তি কেড়ে নিয়েছে। রাফা বোধ হয় এই মোক্ষম চালটি অন্তিম সময়ের জন্য বরাদ্দ রেখেছিল।
– একই র*ক্তের আভিজাত্য বইছে আমাদের শরীরে। আত্মায় আত্মায় মিলন আমাদের।সেখানে তুমি কোথাকার কোন কদর্য র*ক্ত নিয়ে এসেছ অমোঘ সম্পর্কের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে?
অনুভবও করতে পারলোনা রাফা,সহসাই উত্তোলিত হলো রোযার হাত।সশব্দে তার গালে চ*ড় বসালো মেয়েটি।ধাক্কায় রাফা বনেটে আছড়ে পড়লো,কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র পার্থক্য হলোনা আগ্রাসনে।হাসির দমক বৃদ্ধ পেলো,রীতিমত অট্টহাসি হাসতে আরম্ভ করলো সে।যেন বহু বছর যাবৎ নির্বাসনে থাকা কোনো দানবীর মুক্তির আনন্দের বহিঃপ্রকাশ।

– আপনি মানুষ নন,সাক্ষাৎ নরকের পিশাচিনী।
মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে হাসি অব্যাহত রাখলো রাফা। সৌন্দর্য্যের সঙ্গে উৎফুল্লতার সংমিশ্রণে আঁধার অবয়ব ধারণ করেছে পরাবাস্তব রূপ।যার অস্তিত্ব উপেক্ষা অসম্ভব।সম্মোহন করে নেয় সে আপন জাদুর মায়াজালে।রোযার দিকে সরাসরি তাকালো রাফা, অদ্ভুত জ্বলজ্বলে আভায় প্রজ্জ্বলিত হলো তার নয়ন।হাসি ধরে রেখে বিড়বিড় করলো,
– আমি নিশীথিনি, যার কুহেলী ডাকে মানবহৃদয় সাড়া দিতে বাধ্য।
এই নিশিথিনীর প্রতি আর এক মুহুর্ত নয়নপাতে বাঁধ সাধলো রোযার অন্তর।তবুও অবাধ্য হলো সে, মস্তিষ্কের তাড়নায় এগিয়ে এলো,সন্নিকটে। ঝুঁকলো সামান্য।ঘোষণা করলো,
– জ্যোৎস্না আমি, চাঁদকে ঘিরে রাখা স্নিগ্ধ মায়ার দেয়াল।কিন্তু বিজ্ঞান কি বলে জানেন?সূর্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে উৎপত্তি ঘটে জ্যোৎস্নার।অতএব, আমি স্বয়ং সূর্য, চাঁদের রক্ষক।সূর্যের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে আসবেন না, রশ্মির তেজে ভষ্ম হয়ে যাবেন!

চেয়ে থাকলো রাফা,নিগূঢ় দৃষ্টিতে। অধরে সন্তুষ্টির হাসি।
– বহুদিন বাদে একজন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পেলাম। আই লাইক ইওর অ্যাটিটিউড, কিটেন।
পাল্টা হাসলো রোযাও,
– এক হাত আমার অমানিশার অভিশপ্ত উপাখ্যানের নতুন সূচনা লিখেছে, অপর হাত নিশিথীনির আখ্যানের বিধ্বংসী সমাপ্তি লিখবে।কথা দিলাম।
প্রতিধ্বনিত হলো রোযার প্রতিটি বাক্য, রাফার কর্ণগুহরে।উভয় রমণীর মাঝে দীর্ঘ এক নীরব দৃষ্টি বিনিময় ঘটলো।অতঃপর উল্টো ঘুরলো রোযা, একইসঙ্গে রাফাও।যার যার গাড়িতে চেপে বসলো। সরু গলিতে কোনোমতে একদম পাশ ঘেঁষে যখন গাড়ি দুটো বিপরীত গন্তব্যে গমন করলো,তখন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রাফা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় অবলোকন করলো রোযাকে।ফিরেও তাকালোনা রোযা। রাফার চেহারার প্রফুল্লতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেলো।
“ তোমার বরফকাঠিন্য প্রতিরোধের দেয়াল গুঁড়িয়ে দেয়ার যাত্রাটা বেশ উপভোগ্য হবে…. জ্যোৎস্না!”
আপনমনে বিড়বিড় করলো রাফা কায়সার।

মেঘতীর ভবন।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় একটি ল্যাভেন্ডার বর্ণের শাড়ীর অস্তিত্ব খেয়াল করলো রোযা। তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলো,একদম হালকা রঙের উপর সিলভার জরির কাজ। অরগাঞ্জা সিল্ক শাড়িটি অদ্ভুত ধরণের সুন্দর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শাড়ির উপরেই একটি ছোট্ট স্টিকি নোট,
“ ছাদে আসো।অপেক্ষা করছি।শাড়িটা পড়লে খুশি হবো।”

নাম লেখা নেই,তবুও হাতের লিখা চিনতে বেগ পোহাতে হলোনা রোযাকে।আসমান!কিছুটা দ্বিধান্বিত হলো সে।ঘড়ির দিকে তাকালো।রাত এগারোটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট।আজ ফিরতে ফিরতে এমনিতেও দেরি হয়েছে।আসমানের সঙ্গে জরুরী কথা বলবে ভাবলেও সে ঘরে ছিলোনা।লম্বা একটা শাওয়ার নিতে নিতে কখন এলো এবং এইসব রেখে গেলো রোযা টেরটুকুও পায়নি।কিন্তু হঠাৎ তাকে মাঝরাতে শাড়ি পড়তে বলার কারণ?
খুব বেশি চিন্তার সুযোগ নেই।আসমানের সঙ্গে অতি দ্রুত কথোপকথন সারতে হবে।রোযা দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো। শাড়ির আঁচল অঙ্গে জড়িয়ে সজ্জিত করে তুললো নিজেকে,হালকা ভেজা কেশরাশি খোলাই রাখলো।অতঃপর দ্রুত এগোলো ছাদের উদ্দেশ্যে। মেঘতীর ভবনের ছাদ অতি আকর্ষণীয় এক স্থান বটে।তবে আজ অভ্যন্তরে পা রাখতেই রোযাকে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে যেতে হলো।নিজের দৃষ্টিকে কয়েক মুহূর্ত বিশ্বাস করে উঠতে পারলোনা রোযা।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সামনে।

ছাদজুড়ে একটি কার্পেট বিছানো,যার আশেপাশে কুশন এবং বালিশ দিয়ে বেশ আরামদায়ক বসার স্থান তৈরী করা হয়েছে।আশেপাশে মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত।তবে দেখার বিষয় সেটি নয়।সমস্ত নজর কেড়ে নিয়েছে তার ভালোবাসার পুরুষটি।একপাশে যে দন্ডায়মান।ধবধবে একটি ঢোলা ফতুয়া পরিধানে, যার বুকের অংশে কালো সুতোর এমব্রয়ডারি। লম্বাটে অংশ প্যান্টে ইন করে নিয়েছে,চকচকে কালো বাকল তার রোশনাই ছড়াচ্ছে।মুখ মাস্কহীন।বিভীষিকা তার শুভ্রতার সামনে অদৃশ্য প্রায়।প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে ঝুঁকে আছে ল্যাপটপের দিকে। যার পাশেই ব্লুটুথ স্পিকার।এক মৃদু সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন চারিপাশ।
এমন ভঙ্গিতে আসমানকে লক্ষ্য করে হাজার চাইতেও
দৃষ্টি ফেরাতে অক্ষম হয়ে পড়ল রোযা।চিন্তাভাবনা যেন লোপ পেয়েছে সম্পূর্ণ।রোযার উপস্থিতি টের পেয়ে ফিরে তাকালো আসমান।মৃদু হাসলো।সামান্য হাসিটুকু যেন অর্ধাঙ্গিনীর হৃদয় ভেদ করে গেলো।তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো আসমানের নিগূঢ় দৃষ্টি।দৃষ্টির গভীরতায় রোযার সর্বাঙ্গে তরঙ্গ খেলে গেলো,যেন আসমান তার অবাধ্য হৃদস্পন্দন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। কৃষ্ণগহ্বরের এতই ক্ষমতা!

– গর্জিয়াস।
উচ্চারণ করলো আসমান একটিমাত্র শব্দ,এর বেশি কিছু নয়।তবুও তা যে প্রশংসা স্পষ্ট উপলব্ধি করলো রোযা।আসমানের কাছ থেকে সরাসরি প্রসংশা লাভ দুষ্কর এক ব্যাপার। রোযা অনুভূতিটুকু তাই লুফে নিলো যেন।তার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো আসমান, এমন ভঙ্গিতে এই বুঝি ছুঁয়ে দেবে।কিন্তু দিলোনা। উল্টো সামনে ঝুঁকলো।
রোযাকে হতবিহ্বল করে তুলে মাথা ঝুঁকিয়ে ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিলো আসমান,কোমল কন্ঠে শুধালো,
– উইল ইউ ড্যান্স উইথ মি, মাই মুনলাইট?
বিস্মিত রোযা ছাদজুড়ে উদ্ভাসিত মৃদু আঁচের সুরেলা আবহে বিমুগ্ধ।সকল চিন্তা যেন বেমালুম ভুলে বসেছে।মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে দিলো নিজের,মৃদু হেসে সেই হাতের পিঠে অধর ছোঁয়ালো আসমান।
– এসব…কি?কেনো?

ভগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো রোযা।জবাবের পরিবর্তে তার সবটুকু সম্মোহনের অধিকারী পুরুষটি অতি যত্নে তাকে নিজের মাঝে আগলে নিলো।সুরের ধ্বনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলতো আঁচে নাচতে আরম্ভ করলো।একটিবারের জন্যও রোযার নয়ন থেকে তার দৃষ্টি সরলোনা। তাল মেলাতে হিমশিম খেলো রোযা,তবুও খেদ ফুটলোনা। সঙ্গীতের ধ্বনি ছাড়িয়ে তার এক সময়কার যন্ত্রণাদায়ক কন্ঠস্বর রূপান্তরিত হলো ঐন্দ্রজালিক মাধুর্যে।
“ বেইবি আ’ম…. ড্যান্সিং ইন দ্যা ডার্ক
উইথ ইউ বিটউইন মাই আর্মস
বেয়ারফুট অন দ্যা গ্রাস ”

কণ্ঠের জাদুতে,সঙ্গীতের মায়ায়,সুরের ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে গেলো রোযা।আসমান তাকে আরো নিকটে টেনে নিলো। প্রিয়তমর শরীর থেকে ভেসে আসা অতি পরিচিত সুঘ্রাণটি রোযার সম্পূর্ণ চিত্তে আবেশ ছড়িয়ে দিলো প্রশান্তির।আসমান থামলোনা। রোযার আঙুল ধরে ঘুরিয়ে দিলো,গান জারি রাখলো।ভালোবাসার উদ্দেশ্যে নিবেদন তার।
“ হোয়াইল লিসেনিং টু আওয়ার ফেইভরিট সং
হোয়েন ইউ সেইড ইউ লুকড আ মেস
আই হুইসপার্ড আন্ডার্নিথ মাই ব্রেথ
বাট ইউ হার্ড ইট
ডার্লিং,ইউ লুক পার্ফেক্ট টুনাইট ”~

জাদুকর সে,সম্মোহনী তার কন্ঠ, মন্ত্রমুগ্ধকর তার চলন।নিজের দৃষ্টি,স্পর্শ,শ্রবণ কোনটি ফেরানো দায়।রোযা জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলো।আসমানের গান থামলেও সুর তখনো প্রবাহমান।ঝুঁকলো সে,গানের সুর ছাপিয়ে বিড়বিড় করলো,
– শুভ জন্মদিন আমার জ্যোৎস্না।
অতর্কিতে আসমানের হাতঘড়ির ডিজিটাল ডায়াগ্রামে নজর পড়ল রোযার—আঠারো ফেব্রুয়ারি,বারোটা বেজে এক মিনিট।
পুনরায় আসমানের মুখপানে তাকালো সে,স্থির রাখা সম্ভব হলোনা নিজেকে।জড়িয়ে ধরলো অমানিশাকে, বুকে মাথা গুঁজলো,অনুভব করলো কতটা ভাগ্যশালী সে।

– ধন্যবাদ আসমান।তুমি….তুমি কিভাবে জানলে?
ক্ষীণ হাসির আওয়াজ ভেসে এলো,আসমানের বাহু জড়িয়ে গেলো তার অবয়বে।কাছে টেনে নিলো আরো, যেন নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চায়।
– হুম।কিভাবে জানলাম বলো তো?
রোযার কানের নিকটে এসে ফিসফিস কন্ঠে আসমান জানালো,
– আই হ্যাভ মাই ওয়ে…. মুনলাইট।
– আমার লজ্জা লাগছে!
– হাহা…দুঃখিত।

মাথা তুললো রোযা,আসমানের দিকে তাকালো।তার বাম হাত পাকড়াও করলো অত্যন্ত আবেগ নিয়ে,
– আসমান,তুমি জানোনা আজ আমি কতটা খুশি।আমি কেমন অনুভব করছি তা ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব।শুধু….
থামলো রোযা,হাতে ধরা আসমানের হাতের দিকে তাকালো। কব্জিজুড়ে শোভা পাচ্ছে রেজিনের ব্রেসলেটখানি,যার প্রান্তে ঝুলন্ত অর্ধচন্দ্র।বস্তুটি আসমান একবারও খুলে রেখেছে কিনা সন্দেহ।রোযার অধর বিস্তৃত হলো,হাতটি টেনে তুললো উপরে।তারপর আঙুলে ছুঁয়ে দিলো নিজের ওষ্ঠজোড়া।এক এক করে প্রত্যেক আঙুলের প্রান্ত স্পর্শ করলো তার অধর।সামান্য কাপলো আসমানের হাত।
– ধন্যবাদ আমার চাঁদ।

হাতের তালুতে রোযার গাঢ় চুম্বন অনুভব হতেই তড়িৎ খেলে গেলো আসমানের শরীরে।এক ঝটকায় সে রোযার কপোল পাকড়াও করলো,ঝুঁকে এলো নিচে, উদ্দেশ্য স্নেহের অদল বদল। বাঁধ সাধলোনা রোযা, অপেক্ষমাণ সে অমানিশার দ্বারস্থ হতে।দুবাহু জড়িয়ে গেলো তার আসমানের কাঁধজুড়ে।অমোঘ মিলন চাঁদ এবং জ্যোৎস্নার।
ধপাস!
মেঝেতে ভারী কিছু আছাড় খেয়ে পড়ার শব্দে উভয়ের সম্মোহনী ঘোর যেন কেটে গেলো।হতভম্ব হয়ে ফিরে তাকালো পিছনে।
ছাদের দরজা হাট করে খোলা।রোযা এসেছিল যখন একেবারে চাপিয়ে এসেছিল,বর্তমানে দেয়ালের সাথে লাগোয়া হয়ে আছে একদম। আর সেই দরজার প্রবেশপথের মাঝেই মেঝেতে চিৎ হয়ে পরে আছে নিহাদ।দুহাত তার উত্তোলিত উপরে,যেখানে শোভা পাচ্ছে ব্ল্যাক ফরেস্ট ফ্লেভারের একটি কেক।তবে সবথেকে অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হলো ঠিক নিহাদের বুকের উপর উল্টে আছে চারুলতা।দীঘল কেশ তার ছড়িয়ে আছে নিহাদের বক্ষজুড়ে।উভয়েই বরফের মতন স্থির।

অশ্রাব্য একটি ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করে মাথা তুললো চারুলতা,প্রসারিত দৃষ্টিতে তাকালো তার ঠিক নিচেই অবস্থান করা নিহাদের দিকে।দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই স্পষ্ট খেয়াল করলো ছেলেটির কন্ঠতালু বেয়ে একটি শক্ত ঢোক নেমে গিয়েছে, অ্যাডামস অ্যাপেল উঁচিয়ে উঠেছে তাতে।হাজার চাওয়া সত্ত্বেও দৃষ্টি ফেরাতে পারলোনা চারুলতা। নিহাদও তার দীঘল কেশের পানে চেয়ে আছে,জ্বলজ্বল করছে নিষ্পাপ নয়নজোড়া।
নাটকীয় দৃশ্যটি কাছ থেকেই উপভোগ করে যাচ্ছে আসমান এবং রোযা,এতটাই নিমজ্জিত তারা দৃশ্যপটে যে একে অপরের আলিঙ্গন ছেড়ে দূরে সরে আসতে হবে তাও ভুলে বসেছে।

ডার্কসাইড পর্ব ৪৯

অবশেষে সম্মোহন মুক্ত হলো চারুলতা।লালিমা ছাওয়া কপোল সরিয়ে তাকালো ভিন্নদিকে।উঠতে গেলো নিহাদের উপর থেকে।তাতে ঘটলো হিতে বিপরীত।বেচারার বহু কষ্টে ভারসাম্য সামলে রাখা কেকখানি নড়ে উঠতেই পিছল খেয়ে স্লেট থেকে ধপাস করে মেঝেতে পড়লো।
থপ!
ধূলোয় মাখামাখি হয়ে অসহায় আত্মবিসর্জন দিতে বাধ্য হলো রোযার জন্মদিনের কেক।নিহাদ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো,মাথা উল্টে চেয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো,
– হ্যাপি বার্থডে রোযা!

ডার্কসাইড পর্ব ৫১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here