ডার্কসাইড পর্ব ৫২
জাবিন ফোরকান
বছরখানেক আগের কথা।একটি বিজনেস পার্টিতে সাক্ষাৎ হয় আয়েশা এবং বাদশাহর।আয়েশা তখন অপর এক ছোট কোম্পানির কর্মচারী হিসাবে কর্মরত ছিলো,তার সৌন্দর্য্য এবং গুণ উভয়ই নজর কেড়েছিল স্বয়ং কায়সার বংশধরের।দীর্ঘদিনের নানা প্রচেষ্টার পর অবশেষে বাদশাহ কায়সারের প্রেম নিবেদনে সাড়া দেয় আয়েশা।ভালোবাসে সে বাদশাহকে, সত্যিই ভালোবাসে।আয়েশার নিঃস্ব আঁধার যান্ত্রিক জীবনে প্রথমবার আভার প্রদীপ নিয়ে পদার্পণ ঘটেছিল বাদশাহর।কনিষ্ঠ সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ছেলেটির যোগ্যতা এবং গুণাগুণের ঘাটতি ছিলনা,যার দরুণ পরবর্তী কায়সার অধিপতি হিসাবে তার নামটিই তালিকার শীর্ষে উঠে আসে।ক্ষমতাধর এই প্রভাবের বাহিরে সত্যিকার বাদশাহ ছিল এক ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। শখের রমণীর প্রতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নিবেদনগুলো ছিল তার অসামান্য।সেই মায়ায় টলেছিল আয়েশার যন্ত্রণায় শক্ত হয়ে আসা অন্তরও।একটুখানি সুখ লাভের আশায় বাদশাহর মাঝে নিজেকে বিলীন করেছিল আয়েশা।
বিয়ে করে বাদশাহ এবং সে,কায়সার পরিবারকে না জানিয়েই। বাদশাহর বক্তব্য ছিল এই মুহূর্তে তার বাবা তাদের সম্পর্ক মেনে নেবেনা।কায়সার অধিপতি হিসাবে স্থান থিতু হলেই সে এই সম্পর্ক প্রকাশ্যে আনবে।প্রথম প্রথম কিছুটা বিব্রত হলেও বাদশাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসার দরুণ আয়েশা দ্বিমত করেনা। উভয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয় গোপনেই।মাস কয়েক একদম স্বপ্নের মতন অতিবাহিত হয় জীবন তাদের।গোপনে হলেও আয়েশার প্রতি বাদশাহর নিবেদনে কোনোদিন সামান্যতম ঘাটতি হয়নি।ধীরে ধীরে বিশ্বাসের ভিত্তি আরো জোরালো হয়।বাদশাহ নিজের স্থান পাকাপোক্ত করতে তৎপর হয়ে উঠে,যা ভরসা দেয় আয়েশাকে,যে তাকে বরণ করে নিতে ছেলেটা কতটা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন সয়না তাদের কপালে।এক ধ্বংসের প্রভাব নিয়ে তাদের জীবনে আবির্ভূত হয় বিলাল রেমান।কায়সার পরিবারের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রেমানদের পুনর্বার ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা বাদশাহকে ভীষণ বেকায়দায় ফেলে দেয়।তিন ভাইয়ের মধ্যে এক নীরব প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়, রেমানদের যে ঠেকাতে পারবে সেই ক্ষমতার সিংহাসন লাভে বিজয়ী হবে।এর মাঝেই অপ্রত্যাশিতভাবে বিলালের অ্যাসিস্টেন্ট হওয়ার প্রস্তাব আসে আয়েশার নিকট।রেমানদের পূর্ববর্তী কর্মচারী পরিবার হওয়ার দরুণ তার প্রতি রেমান অধিপতির অগাধ বিশ্বাস ছিল।আয়েশা বাদশাহকে বিষয়টা অবহিত করলে তার মস্তিষ্ক সুচারু এক পরিকল্পনার ফাঁদ পাতে।আয়েশার সাহায্যে বিজয় হাসিল,তার ক্ষমতা লাভের পথ আরো সহজ হয়ে যাবে তাতে।প্রথমে ভীষণ গড়িমসি করে আয়েশা, তাতে বাদশাহও জানায় সে না চাইলে কিছুই করতে হবেনা।কিন্তু পরবর্তীতে ভবিষ্যতের চিন্তা দ্বিধায় ফেলে আয়েশাকে।যদি রেমান কায়সারদের কোনো ক্ষতি করে দেয়?তাই করার জন্যই তো এসেছে রেমান বংশধর।
বাদশাহর আতঙ্কে ভুগতে থাকে আয়েশা।ইতোমধ্যে কয়েকবার ছেলেটির জীবনের উপর প্রতিপক্ষ দল হা*ম*লা করেছিল।সম্প্রতি তা হয়েছিল তাদের বিয়ের কিছুদিন পূর্বেই।নিজেকে মানাতে পারেনা আয়েশা, তার সামান্য হস্তক্ষেপে হয়ত ভবিষ্যত সুন্দর হয়ে যেতে পারে।অবশেষে বাদশাহর পরিকল্পনায় সম্মতি জানায় সে।সেদিন খুশি হয়ে বাদশাহ তাকে আলিঙ্গন করে এক চমৎকার ভবিষ্যতের ওয়াদা করেছিল,আপ্লুত হয়েছিল রমণী সেই ভালোবাসাময় নিবেদনে।
অতঃপর?যা হওয়ার তাই হতে আরম্ভ করে।বিলাল রেমানের অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে রেমানদের রাজত্বে প্রবেশ করে আয়েশা,আদতে কায়সারদের গুপ্তচর।প্রথমে ভরসাবান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, দীর্ঘ কয়েক মাসের সময় নিয়ে।এরপর শুরু হয় সত্যিকার খেলা।মূল্যবান তথ্য সে গোপনে বাদশাহকে হস্তান্তর করতে থাকে।যা কাজে লাগিয়ে সময়ে অসময়ে বেশ সূক্ষ্মভাবে রেমান গ্রুপের পতনের পরিকল্পনা সাজাতে থাকে বাদশাহ।তার কাজ ছিল অত্যন্ত নির্ভূল,আয়েশাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখার মতন পদ্ধতিই প্রয়োগ করতো সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে।যার দরুণ ধীরে ধীরে দিশেহারা হয়ে পড়ে রেমান গ্রুপ।অপরদিকে আয়েশা বেশ বড়সড় এক প্রভাব খাটাতে সক্ষম হয় স্বয়ং বিলালের উপর।প্রথমদিকে কাজটি শুধুমাত্র লক্ষ্য পূরণেই করছিল সে,বিলাল হাতের মুঠোয় থাকলে সবকিছু পানির মতন সহজ হবে।কিন্তু দিনকে দিন বিলালের নিবেদন আয়েশার উদ্দেশ্য ভঙ্গুর করে তুলতে থাকে।
বাদশাহর নিকট থেকে জেনে রেমানদের সম্পর্কে যে ধারণা আয়েশার হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছিল তা একটু একটু করে দূরীভূত হতে থাকে বিলালের প্রয়াশে।এই যুবক যেন সাধারণের মাঝেও অসাধারণ।তার অবয়ব তাকে অত্যন্ত ধূর্ত এবং চতুর হিসাবে উপস্থাপন করে,কিন্তু তার অন্তর আদতে সকল কদর্যতা থেকে মুক্ত।অন্তত নিকট মানুষগুলোর জন্য বিলাল জগতের সবথেকে স্নিগ্ধ অস্তিত্ব।যার সঙ্গে যেমন হওয়া দরকার সে তেমনি। অসত্যের জন্য কঠোর,হিং*স্র; সত্যের জন্য ঠিক ততটাই নমনীয়,কোমল।বিলালের তার প্রতি আগ্রহ,দৃষ্টি,অনুভূতি সবকিছুর বোঝা আয়েশার উপর চেপে বসতে থাকে ক্রমশ।একটা সময়ে তা হাসফাঁস লাগতে থাকে।বিলালের প্রতি অনুভূতি জন্মায়নি তার কোনোদিন,অন্তত প্রেমের অনুভূতি নয়, তা সে একমাত্র বাদশাহর জন্যই উৎসর্গ করেছে।কিন্তু চেতনাবোধ চেপে ধরে,বিবেকে বাঁধা দেয়।কাকে ধ্বং*স করতে চাইছে সে?এই ছেলেটার কি দো*ষ?সে তো নিজের জীবন গড়তেই চায়,এভাবে তার বিশ্বাস নিয়ে খেলা যায়?দংশন করতে থাকে বিবেক বারংবার।দিনদিন দূর্বলতা বাড়তে আরম্ভ করলো।বিলালের প্রেমের অনুভূতি স্পষ্ট টের পায় আয়েশা।কিন্তু ততদিনে সে অন্য কারো স্ত্রী,তার অস্তিত্ব অন্য এক পুরুষের নামে বিলীন।
যদি বাদশাহর পূর্বে আয়েশার জীবনে বিলালের আগমন ঘটতো,তবে কি নিজেকে দূর্বার প্রেমের দরিয়ায় ভাসাতো সে?— প্রশ্নটির উত্তর লাভের সাহস হয়না আয়েশার।
তার সবটুকু অস্তিত্বজুড়ে শুধুমাত্র বাদশাহর বিচরণ।বিশ্বাসঘাতক তাকে হতেই হবে।হয় বাদশাহ, নয়ত বিলালের নিকট।নিজেকে এমন পরিস্থিতিতে নিজেই জড়িয়েছে আয়েশা,তাই এর যথাযথ শাস্তি তার প্রাপ্য।সেই শাস্তি হয়েই যেন তার সামনে দন্ডায়মান হয় বিলাল,ভগ্ন হৃদয়ের অধিকারী এক পুরুষ।হুড়মুড় করে তার কঠোর অবয়ব গুঁড়িয়ে যায় বিশ্বাসের পতনে।যে সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী অধিপতির সম্মুখে নতজানু হয় ক্ষমতা,সে নিজেই অশ্রুসিক্ত হয়ে নমিত হয় ভালোবাসার রমণীর পদক্ষেপে,একটুখানি ভালোবাসা ভিক্ষালাভে।এমন দৃশ্যের চেয়ে ভয়ানক শাস্তি আয়েশার জন্য আর কিছু হতে পারেনা!
নারী চাইলে গড়তে পারে,আবার ধ্বংসও করতে পারে।কিন্তু আয়েশা একইসঙ্গে দুটোই করে দেখিয়েছে।এক হাতে গড়েছে বাদশাহকে, অপর হাতে ধ্বংস রচেছে বিলালের।এমন পাপের বোঝা তাকে সারাটি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে,কোনো সন্দেহ নেই তাতে।
কনকনে এক শীতের রাত্রি।বাংলার শীত ইউরোপের তুলনায় কিছু না হলেও নেহায়েত কম নয়। হাড়হিম করা হওয়া বইছে চারিদিকে। ক্ষণে ক্ষণে ঝোড়ো বায়ুর ঝাঁপটায় অদ্ভুতুড়ে নিশির শব্দরা ভেসে আসছে।তবুও নির্বিকার বিলাল।বাঁশের বেড়াখানির সামনের সিমেন্টের তৈরী বেঞ্চিখানিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে সে।পরিধানে ঢোলা শার্ট এবং প্যান্ট।উদর পর্যন্ত উন্মুক্ত বোতাম।হিম তার পাথর শরীরকে যেন ভাস্কর্যে পরিণত করেছে।তবুও ভ্রুক্ষেপ নেই। জুতোর দিকে দৃষ্টিপাত করে একাকী বসে আছে।বিন্দুমাত্র অনুভূতি হচ্ছেনা,যেন সবটুকুর মোচন হয়েছে অন্তর থেকে।কতদিন পেরিয়েছে সব শেষ হওয়ার পর?হিসাব নেই।ঘণ্টা,দিন,মাসের হিসাব রাখা হয়না তার আর।সবকিছুই ভেঙে পড়েছে তার আশেপাশে।সম্পর্ক, ব্যবসা,অনুভূতি,অবশিষ্ট নেই কিছুই।কায়সারের মোক্ষম চালে মুখ থুবড়ে পড়েছে নতুনভাবে বিস্তৃত হতে চাওয়ার বাসনা।বাবা এসেছেন ইতালি থেকে, ছেলেকে ফিরিয়ে নিতে চান।কিন্তু বর্তমানে বিলাল যেতে নারাজ।সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।ঘর থেকে বের হতেও অস্বস্তি তার,আজ বহুদিন বাদে বোধ হয় রাত্রিতে একাকী বেরিয়েছে।কেউ টের পেয়ে থাকলে নিশ্চিত চিন্তা করছে,কিন্তু পরোয়া নেই তার।যার পরোয়া করেছিল,সে তাকে জীবনের সবথেকে অধিক যন্ত্রণা দিয়ে হারিয়ে গেলো।তবুও রমণীকে ঘৃণা করা যাচ্ছে না,এতটাই ভালোবেসেছিল বিলাল তাকে?এতটাও ভালোবাসা কি আদও সম্ভব?
অতর্কিতে সড়কে মৃদু বাতির প্রতিফলের মাঝে এক ছায়ামূর্তির অবয়ব লক্ষ্য করে বিলাল নয়ন তুলে তাকালো,স্থির হয়ে পড়ল সম্পূর্ণ। ওই কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে মিলিত হলো তার দৃষ্টি,ক্রোধান্বিত হলোনা অন্তর,বরং যেন বহুদিন বাদে ভালোবাসাকে অবলোকনে তৃপ্ত হয়েছে তৃষ্ণার্ত অন্তর।ধীরপায়ে এগিয়ে এলো ধূসর শাড়ি পরিহিতা রমণী।কিছুই বললোনা,একদৃষ্টে চেয়ে থাকলো শুধু বিলালের মুখপানে।তীর্যক হাসলো বিলাল,বিদ্ধস্ত অবয়বেও তা ঠেকলো অতীব আকর্ষণীয়।
– কি দেখতে এসেছ?আমার পতন?আনন্দ হচ্ছে?
জবাব এলোনা,শুধু আরো এক পদক্ষেপ অগ্রসর হলো আয়েশা।মাথা কাত করলো বিলাল,দৃষ্টিতে ফুটলো তার প্রজ্জ্বলিত অনুভূতি।
– মাঝরাতে একা নারীর বাইরে থাকা উচিত নয়।
থমকালো বিলাল,অতঃপর পরিহাসের হাসি হেসে বললো,
– ওহ…মাই ব্যাড।তোমার স্বামীও এসেছে নিশ্চয়ই?কোথায় সে? আই উইল রিয়েলি এনজয় আ ফাইট নাউ….
– দুঃখিত।
ছোট্ট শব্দটি কর্ণগোচর হলেও বিশ্বাস করলোনা বিলাল, ফ্যালফ্যাল করে তাকালো।আয়েশার সুগভীর দৃষ্টিপাত তার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত।
– আমি যা করেছি তার জন্য দুঃখিত।জানি,এতে কিছুই ঠিক হবেনা।তবুও।
হাসলো বিলাল,সশব্দে।যেন ভীষণ এক কৌতুক করেছে আয়েশা।নিজের চুলে হাত বুলিয়ে উঠে পড়লো বিলাল,অতঃপর একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে উচ্চারণ করলো।
– বাড়ি যাও আয়েশা।
এটুকুই।তৎক্ষণাৎ উল্টো ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করলো বিলাল,কিন্তু কি যেন মনে করে থমকে পড়লো তার পদক্ষেপ।সটান ঘুরে তাকালো। উঁচু বাতি পোস্টের উপরে ঝুলছে,ঠিক আয়েশার পিছনে।সম্পূর্ণ অবয়ব মেয়েটির সিক্ত সেই আলোয়।হলুদাভ প্রতিফলনে তার কপোলে অশ্রুরেখা স্পষ্ট,তার সঙ্গে…. আ*ঘা*তচিহ্ন! দপ করে জ্বলে উঠলো বিলালের মস্তিষ্ক,মুষ্টিবদ্ধ হলো উভয় হাত শক্তভাবে।এক ছুটে আয়েশার নিকট পৌঁছে তার কপোল পাকড়াও করলো,নিজের দিকে ঘোরালো। ভ্রু কুঞ্চিত হলো তার ক্রোধে,অপরদিকে বিস্মিত আয়েশা।বিলালের শীতল কন্ঠ জিজ্ঞেস করলো,
– এটা কে করেছে?
কোনো জবাব এলোনা, তিরতির করে কাপলো রমণীর অধর,অতঃপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।তাতেই যা বোঝার বুঝে গেলো বিলাল। দাঁতে দাঁত পিষে ঘোষণা দিলো,
– আই উইল কি*ল হিম!
সত্যি সত্যি উল্টো ঘুরলো বিলাল,দ্রুত কয়েক পদক্ষেপ হাঁটতেই পিছন থেকে তার কব্জি পাকড়াও করলো আয়েশা।দৃপ্ত কণ্ঠে জানালো,
– আমি আপনার কাছে অভিযোগ জানাতে আসিনি, বিলাল!আমার স্বামীকে স্পর্শ করার অধিকার আপনার নেই।
স্থির হয়ে পড়লো বিলাল সম্পূর্ণ,পিছন ঘুরলোনা।আয়েশা তার হাতটি ছেড়ে দিয়ে ধীরপায়ে সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো।রমণীর অশ্রু দূরীভূত হয়েছে।পুরাতন সেই বারুদ রূপে ফিরেছে অভিব্যক্তি।সামান্য হাসলো আয়েশা,বিষাদের হাসি।
– আমি আমার শাস্তি পাচ্ছি বিলাল,আপনার বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।শুধু পারলে কোনোদিন আমাকে ক্ষমা করে দেবেন,অন্যথায় মৃ*ত্যুও আমায় শান্তি দেবেনা।এটুকুই বলার ছিল।
মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে প্রস্থান করতে চাইলো আয়েশা, কিন্তু সম্ভবপর হলোনা।দুঃসাহস জাগিয়ে অতর্কিতে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো বিলাল।দুহাত আবৃত করলো কাঁধ,টেনে নিলো আপন অস্তিত্বের সংস্পর্শে।দপদপ করতে থাকলো আয়েশার হৃদযন্ত্র।বিলালের দীর্ঘশ্বাস আছড়ে পড়লো তার কাঁধে,তার সঙ্গে অশ্রুপাত।ভগ্ন কন্ঠ ভেসে এলো,
– একবার….শুধুমাত্র একবার সুযোগ দাও তন্দ্রাহরণী।ভিক্ষা চাইছি আমি আমার ভালোবাসা তোমার কাছে, আমায় একটিমাত্র সুযোগ দাও?
সিক্ত হলো আয়েশার দৃষ্টিও।প্রথমবারের মতন ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সে বিলালের বাহু স্পর্শ করলো,নিজেকে আলিঙ্গনের উষ্ণতায় বিলিয়ে দিয়ে বললো,
– দেরি করে ফেলেছেন বিলাল….সামান্য একটু দেরি।
দুঃসাহসের ডানায় ভর করে আজ নিজের যথাযথ অনুভূতি প্রকাশে কোনো বাঁধা মানলোনা আয়েশা, কারণ জানে,এই হয়ত অন্তিমবার।বিলালের হাতটি টেনে তাই নিজের উদরে স্পর্শ করলো, আলতোভাবে।হতচকিত দৃষ্টি অনুভব করে বিড়বিড় করলো,
– আমার গর্ভে একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে,যার পরিচয় আপনার নয়,অন্য এক পুরুষের।
দীর্ঘ মুহূর্তভর স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো বিলাল,আয়েশা ভাবলো ঘৃণায় এখনি নিজেকে গুটিয়ে নেবে সে।কিন্তু বিলাল রেমান যে সর্বদাই অপ্রত্যাশিত।স্পর্শ সরালোনা পুরুষটি,বরং হাঁটু মুড়ে বসলো সামনে, নত হলো আরো একবার ভালোবাসার তরে। শাড়ির আঁচলে আচ্ছাদিত উদর গর্ভে চেয়ে বিলাল আরো একবার আলতোভাবে ছুঁয়ে দিলো।ব্যক্ত করলো,
– খেদ নেই।আমার সন্তান ও।ভালোবাসবো ওকে আমি,তোমার চাইতেও দ্বিগুণ।
– আপনি কি মানুষ?
হাহাকার করে উঠলো আয়েশা,ভেঙে পড়ল তার শরীর।লুটিয়ে গেলো সড়কে,আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললো বিলাল।হাসলো মৃদু।রমণীর জমাট বাঁধা সকল অনুভূতির জোয়ারে আজ ভেসে গেলো মুহূর্ত। কাদলো সে দীর্ঘ সময় জুড়ে,বিলাল নিঃশব্দে পাশে থাকলো তার।একটা সময় যেন বিবেক কড়া নাড়লো।নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আয়েশা,চটজলদি উঠে দাঁড়ালো। বিলাল তখনো আশান্বিত হয়ে চেয়ে আছে,জানে স্বার্থপরের মতন আচরণ করছে,তবুও।তার সেই আশা গুঁড়িয়ে দিয়ে আয়েশা পুনরায় সহজাত বৈশিষ্ট্যে ফিরে বললো,
– আপনার এবং আমার মাঝে মিল কোথায় জানেন?
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো বিলাল।
– আমরা উভয়ই ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি।
হৃদয়ে বিষাদ তরঙ্গ ঝংকার তুললো।অশ্রু ঠেকানো যায়।এবার আর রমণী থমকালোনা,ঘুরল,হাঁটতে হাঁটতে জানালো,
– ভুলে যান বিলাল,কোনো প্রয়োজন নেই এমন বিশ্বাসঘাতক তন্দ্রাহরণীকে স্মরণে রাখার।আমার মতন অধম আপনার মতন দেবদূতের যোগ্য নয়।
অদূরে মিলিয়ে যেতে থাকলো আয়েশার পদচারণা।উঠলো বিলাল,আর্দ্র অথচ উচ্চকন্ঠে পাল্টা জানালো,
– অভিশাপ দিলাম,তপ্ত মরুর বুকে হেঁটে চলা পথিকের জলসুধার তৃষ্ণা হও।তুমি নামক মরীচিকার ভ্রম আমার সারাটি জীবনে নিবারণ না হোক, আয়েশা।
ফিরে চাইলো রমণী,অশ্রুসিক্ত নয়নে,আবেশিত কন্ঠে তৃপ্ত হাসির সঙ্গে উত্তর করলো,
– এমন অভিশাপ লাভের ভাগ্যই বা আর কতজনের হয়?
উত্তর করতে পারলোনা বিলাল,অপলক তাকিয়ে রইলো,সুদূরে অদৃশ্যমান হতে দেখলো নিজের সর্বস্বকে।
একে একে অতিক্রান্ত হলো ছয় ছয়টি দীর্ঘ মাস।নিজের ভঙ্গুর অবস্থাকে পুনরায় গড়তে সময়টি প্রয়োজন হয়েছে বিলালের।বর্তমানে সে প্রস্তুত,জীবনে অগ্রসর হওয়ার উদ্দেশ্যে।এই জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা,তার জন্যও থাকবেনা।ইতালিতে ফেরার বন্দোবস্ত হয়েছে।দীর্ঘদিন যাবৎ লোকচক্ষুর অন্তরালে বসবাস করে নিজেকে একটু একটু করে গুছিয়ে নেয়া বিলালের উদ্দেশ্য ভালো থাকা। সেও ভালো থাকবে জীবনে,হোক সে ভালো থাকা কাজের মাধ্যমে।
সন্ধ্যায় বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট।সকাল সকাল বিলাল নিজেকে আবিষ্কার করলো ভালোবাসার দুয়ারে।আয়েশার সঙ্গে সেই ছয় মাস পূর্বের সাক্ষাৎই ছিল শেষ।এরপর কোনোপ্রকার যোগাযোগ হয়নি।যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায় ক্রমশ।অন্তর পো*ড়ে।কিন্তু আজ, অন্তিম লগ্নে,এক অন্তিম সাক্ষাতের বড্ড প্রয়োজন।কেমন আছে তার আয়েশা?পুরাতন একতলা বাড়িটির ভঙ্গুর দরজায় বারকয়েক কড়াঘাত করে স্থির রইলো বিলাল।বেশ কিছু মুহূর্ত পর দরজা খুলে গেল।বাইরে উঁকি দিলো তার অতি ভালোবাসার মুখখানি।বিস্ময়ে টানা টানা নয়ন তার প্রসারিত হলো, সেই দৃপ্ত কৃষ্ণগহ্বরের মাঝে অপলক দৃষ্টিপাত ঘটালো বিলাল।
– আ…আপনি…
জবাব এলোনা।অন্তিম বারের মতন মুখখানির মায়া অবলোকনে ব্যস্ত বিলাল। সরে দাঁড়ালো আয়েশা, বিড়বিড় করলো,
– ভেতরে আসুন।
– উহুম।আমি শুধুমাত্র তোমাকে বিদায় জানাতে এসেছি।
– ওহ।
যথাসম্ভব নির্বিকার ভাব প্রদর্শন করতে চাইলেও আয়েশার সিক্ত দৃষ্টি তার অনুভূতি প্রকাশ করে দিলো।প্রচণ্ড ইচ্ছা হলো, আরো একবার নিজের ভালোবাসার দাবী প্রকাশের।কিন্তু বাঁধ সাঁধলো আয়েশার ফুলেফেঁপে ওঠা উদরের দৃশ্যে।একনজর তাকালো বিলাল সেদিকে,তারপর বললো,
– ভালো আছো?
– জ্বি।
– সত্যিই?
– সত্যি।
সংক্ষিপ্ত জবাবগুলো কষ্টদায়ক। পীড়া বাড়াতে চাইলোনা অন্তর।তাই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিলাল বললো,
– ঠিক আছে।তবে বিদায় আয়েশা।
– বি…বিদায়।
কিছু বলতে চাইলেও সম্ভব হলোনা আর বিলালের পক্ষে।বক্ষ ছে*দিত হয়ে আবেগ ভাসছে।তৎক্ষণাৎ তাই ঘুরে গেলো,ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো বাড়ির চৌকাঠ থেকে।সড়কে পা রাখতেই মৃদু অথচ ভারী এক শব্দে তার পদক্ষেপ থামলো।পাই করে ঘুরল।দরজার সামনে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে পেট আঁকড়ে ধরে রাখা আয়েশার প্রতিচ্ছবি দগ*দগে ঘা তৈরি করলো তার অন্তরে। একছুটে পৌঁছল নিকটে, আবিষ্কার করলো চারিপাশে ছড়িয়ে পড়া পানির অস্তিত্ব।সংক্ষিপ্ত জবাবের তাহলে এই কারণ?কঠোরতার আড়ালে কি নিদারুণভাবে যন্ত্রণা লুকিয়েছিল!
আয়েশাকে কোনোপ্রকার কিছু জিজ্ঞেসও করলোনা বিলাল,সঙ্গে নিয়ে আসা গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত পাঁজাকোলা করে ছুটলো। সিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে চেপে বসলো।
– আয়েশা একটু সহ্য করো…প্লীজ… বাদশাহকে খবর দেবো?
– না!
যন্ত্রনাবোধক ধ্বনিতে চিৎকার করে উঠলো আয়েশা।বিস্মিত হলেও পাল্টা প্রতিক্রিয়া না করে বিলাল দ্রুত ড্রাইভ শুরু করলো।ভাগ্যগুণে হাসপাতাল নিকটেই ছিলো।কিন্তু আয়েশা তার হাত চেপে ধরলো,
– পাশের গলিতে… দাই মা…
– কি…কিন্তু…
– দোহাই লাগে!
তর্ক বিতর্কের সময় নেই।ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও দ্রুতই গাড়ি কয়েক গলি পরের এক বাড়ির সামনে থামালো বিলাল।বারান্দায় বসে রোদ পোহাতে থাকা এক লোক দৃশ্য খেয়াল করে দ্রুতই বেরিয়ে এলো।চিৎকার করে ডাকলো নিজের মাকে।অভিজ্ঞ এক বয়স্কা এগিয়ে এলেন।বিলাল আয়েশাকে তুলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো।একটি কক্ষে গিয়ে তাদের বাইরে বের করে দিয়ে বাড়ির বউ এবং বৃদ্ধা দুইজন রয়ে গেলেন অভ্যন্তরে।উঠানে পায়চারি করতে করতে বিলাল আয়েশার চিৎকার ভেসে আসতে শুনলো।বুক কাপলো তার,প্রচণ্ড।অভিসম্পাত করলো নিজেকে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটাই দরকার ছিলো।মাথা চেপে ধরে একটি চেয়ারে বসে থাকলো,তাকে এক গ্লাস পানি এবং ফল দিলো বাড়ির লোকটি।মুখেও তুললোনা বিলাল,কিন্তু কিছু একটা নজরে আসতেই পাশের টেবিলে সার দিয়ে রাখা খবরের কাগজের একটা টেনে নিলো।মুহূর্তেই ভেসে উঠলো তার দৃষ্টিসম্মুখে,
“ বাগদান সারলেন কায়সার পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান”—
খবরটি আজ থেকে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগের।অথচ বিলাল সে সম্পর্কে মোটেও অবহিত নয়।অন্তরালে থাকাকালীন জাগতিক কোনকিছুর প্রতি আগ্রহী ছিলোনা সে।বাদশাহ বাগদান সেরেছে?ভিন্ন কারো সঙ্গে?তবে আয়েশা….?
দুপুর পেরিয়ে বিকালপ্রায়।ঠিক তখনি বাইরে বেরিয়ে এলেন বৃদ্ধা এবং তার বউ।উভয়ের চেহারাই হাসিখুশি। এরা বোধ হয় বিলালকেই আয়েশার স্বামী ভাবছে,কেমন সম্পর্ক এদের তার সঙ্গে? জানা নেই বিলালের।বৃদ্ধা শুষ্ক হেসে বললেন,
– ছেলে হইসে,এক্কেবারে দুধ সাদা টুকটুকা।
তার সম্পূর্ণ বাক্য শ্রবণের অপেক্ষায় বিলাল নেই ততক্ষণে,এক ছুটে সে পৌঁছলো ভেতরে। আয়েশাকে লক্ষ্য করলো,সুস্থই।একটি চাদর টেনে ঢেকে দেয়া হয়েছে।তার ঠিক পাশেই,বিছানায় এক নরম কাপড়ের মাঝে নড়চড় করছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এক অস্তিত্ব। পায়ে পায়ে এগোলো বিলাল,কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিলো।শুভ্র এক মুখ,চোখজোড়া বন্ধ,লালচে হয়ে রয়েছে গাল থেকে কান পর্যন্ত।সামান্য নড়ছে,যেন দৃষ্টি মেলতে চাইছে।অপলক চেয়ে রইলো বিলাল,অদ্ভুতভাবে দৃষ্টি ফেরানো দায়।অতর্কিতে তার কাঁধে চেপে বসলো বাড়ির কর্তার হাত,
– অপেক্ষা করেন কিসের ভাইজান?তুইলা নেন, ছেলের কানে আযান দেন।
– আ…আমি..?
– আপনি না তো কি? বাপ না আপনি?
একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করে আয়েশার উদ্দেশ্যে তাকালো বিলাল,নিঃশব্দে চেয়ে আছে, নিজেও দ্বিধান্বিত।অবশেষে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো আয়েশা,এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো বিলাল।অত সন্তপর্নে নবজাতককে নিজের কোলে তুলে নিলো।বুকে স্পর্শ করতেই কেমন যেন অনুভূতি হলো, অযথাই নয়ন বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকলো বিলালের।প্রায় কেঁদে উঠছিল নবজাতক,কিন্তু তার কানের নিকট মুখ নিয়ে মৃদু কন্ঠে পবিত্র আযানের ধ্বনি বিড়বিড় করতে থাকলো বিলাল।তাতে ফল হলো, স্থবির হয়ে নবজাতক যেন শ্রবণ করে গেলো,সামান্য দৃষ্টি মেলে অবলোকন করলো বিলালকে কৌতূহলভরে।উপস্থিত বাকিরা পরিবারকে ব্যক্তিগত মুহূর্ত প্রদানে দরজা চাপিয়ে বাহিরে চলে গেলো।
অবশেষে থামলো বিলাল,চোখ মেলতেই তার আবদ্ধ অশ্রু টপটপ করে পড়লো নবজাতকের কপোলে।
– একটা শেষ অনুরোধ করবো?
ভেসে এলো আয়েশার দূর্বল কন্ঠস্বর।বিলাল তার দিকে তাকালো।
– আমার ছেলের একটা সুন্দর নাম রাখবেন?
হাহাকার উঠলো বিলালের অন্তরে, কাপলো সর্বাঙ্গ এক অনুভূতির গাঢ়ত্বে। ঝুঁকলো বিলাল,কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো।তারপর নবজাতকের কপালে অধর ছুঁয়ে বিড়বিড় করলো,
– আসমান….. গগনের ন্যায় সুবিশাল এবং উদার।দিনে দিবাকর,রাত্রিতে চন্দ্র তারকারাজি,ভরপুর থাকুক সে আজীবন।
দৃশ্যটি দৃষ্টিভরে অবলোকন করলো আয়েশা, অশ্রুসিক্ত হলো তার নয়ন। বিলাল এবং তার বলিষ্ঠ বাহুর মাঝে সদ্য জন্ম নেয়া সন্তান…..হয়ত এটিই তার জীবনের সত্য হতে পারতো।কিন্তু তা বর্তমানে মধুর ভ্রম বই ভিন্ন কিছু নয়।
বিলাল সাবধানে নবজাত আসমানকে আয়েশার পাশে শুইয়ে দিলো।কিছুটা অধিকার ফলিয়েই রমণীর কপালে নিজের স্নেহের হাত বুলিয়ে আনলো।
– আয়েশা,জানি এমন কথা বলার মুহুর্ত নয় কিন্তু…
– দূর্বল হবেন না।
একটি বাক্যই যথেষ্ট বিলালকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনতে।আয়েশার দূর্বলতা মিলিয়েছে আঁধারে,দৃপ্ত দৃষ্টিতে সে বিলালকে দেখলো,
– আপনার ইতালির ফ্লাইট আছে তাইনা?
– তুমি জানলে কি…
– যান।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।দেরী হয়ে যাবে।
– কিন্তু…
– আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আমি এবং আমার সন্তান আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার প্রতি।তবে আমাদের আর কোনোদিন সাক্ষাৎ না হলেই আমি খুশি হবো।বিদায় বিলাল।
এরপর আদতে মুখ খোলার মতন কিছুই থাকেনা।দৃষ্টি নামিয়ে পরিহাসের হাসি হাসলো বিলাল,তারপর বিড়বিড় করলো,
– অবশ্যই আয়েশা….বিদায়।
জড়িয়ে এলো কন্ঠস্বর,
– ভালো থেকো তন্দ্রাহরণী।
জোরপূর্বক অধরে অধর চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো আয়েশা।বিলাল উঠলো,ঝুঁকে আরো একবার দেখলো নবজাতককে প্রাণভরে।আলতো ছোঁয়ায় ক্ষুদ্র হাতটি টেনে নিজের অধর স্পর্শ করলো,
– বি আ গুড বয় মাই অ্যাঞ্জেল, অ্যাণ্ড টেইক কেয়ার অব মাম্মা।
চকিতে আয়েশার দিকে চেয়ে উঠলো বিলাল, ঢোক গিললো।সম্পূর্ণ ভেঙে আসছে শরীর, আর সম্ভব নয়।তৎক্ষণাৎ উল্টো ঘুরে হনহন করে বেরিয়ে গেলো সে।আজীবনের জন্য।চেয়ে থাকলো আয়েশা,অপলক।নবজাতকের তীব্র কান্নার ধ্বনি উঠলো,তাকে বুকে চেপে ধরলো, তাল মিলিয়ে কাদলো নিজেও।এক লহমায় মস্তিষ্কে ভাসলো কতশত না পাওয়ার আক্ষেপ।যদি, কিন্তুর ভিড়ে জর্জরিত হলো অন্তর।
তবে এতসব না পাওয়ার মাঝে এক টুকরো স্বর্গসুখ তার বুকে,তার ছেলে….আসমান! বেঁচে থাকার প্রেরণা, লড়াই চালিয়ে যাওয়ার স্পৃহা। বিলালকে অপবিত্র করার অধিকার নেই, ঠিক তেমনি বাদশাহকে ছেড়ে দেয়ারও সুযোগ নেই।একলা চলবে সে,নিজের সন্তানকে নিয়ে।কোনো পুরুষের সহযোগীতার প্রয়োজন।কর্মফল ভোগ করবে, আগলে নেবে ভাগ্যকে।বাদশাহ তাকে যে যন্ত্রণা দিয়েছে তা সুদে আসলে ফেরত দেবে।যোগ্য হবে সে।নিজের ছেলেকে গড়বে নতুন শিক্ষায়।অতঃপর বহু বহু বছর পেরিয়ে,যদি সত্যিই কোনো এক সময় আবারো বিলালের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়,যদি সত্যিই বিলাল নিজের কথা রাখে,যদি সত্যিই ভাগ্য সহায় হয়, তাহলে হয়ত নিজেকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়ার দুঃসাহস করবে আয়েশা।কিন্তু আপাতত…..
সমাপ্তি এক না পাওয়ার উপাখ্যানের।
বর্তমান।
নৈঃশব্দ্য।
গাঢ় নৈঃশব্দ্য।
অতঃপর একটি দীর্ঘশ্বাস।
বিলাল রেমান সোফায় সোজা হয়ে বসলেন।বিপরীত প্রান্তে রোযা মাথা নিচু করে একদৃষ্টে ফটো অ্যালবামের দিকে চেয়ে আছে।নয়নের কোণে জমা হওয়া অশ্রুফোঁটা অতি সন্তপর্নে মুছে নিলেন বিলাল।বিড়বিড় করলেন,
– মাঝে মাঝে সময়,পরিস্থিতি,অনুভূতি…. কোনোকিছুই আমাদের হাতে থাকেনা।আমি বরবাদ হয়েছি আয়েশাকে ভালোবেসে,আয়েশা বরবাদ হয়েছে বাদশাহকে ভালোবেসে….এই ভাগ্যচক্র যেন এক রঙ্গমঞ্চ।তাইনা?
– বাবা…
কম্পিত কন্ঠে উচ্চারণ করলো রোযা,এর অধিক কিছু বলা সম্ভব হলোনা।এখনো প্রশ্ন রয়েছে তার, এরপর কি হয়েছিল?কিন্তু তা করতে বাঁধ সাধছে।বিলাল নিজে থেকেই বললেন,
– আমি আর একবারই বাংলাদেশে এসেছিলাম, প্রায় বছর তিনেক পর। চিত্রলেখা এবং চারুলতাকে দত্তক নিয়েছিলাম, তীব্র ইচ্ছা হয়েছিল সেবার একটিবার আয়েশার দর্শন লাভের।কিন্তু করিনি।আমায় আরো একবার ফিরিয়ে দিলে হয়ত সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারতাম না।ততদিনে কায়সার একদম জেঁকে বসেছে ক্ষমতার গদিতে।হটানো প্রচণ্ড দুঃসাধ্য।তাই ফিরে যাই।নিজের মেয়েদের নিয়েই সুখের স্বপ্ন বুনি।তবুও তাদের মাঝে প্রায়ই খুঁজে বেড়াতাম,কাকে জানো?
রোযা সিক্ত দৃষ্টিতে তাকালো।বিলাল সামান্য হাসলেন রোমন্থন করে,
– আসমানকে!জীবনে প্রথম যে নবজাতককে বুকে আগলে নিয়েছিলাম,তার অনুভবের স্বাদ কোনকিছুতেই যেন মিটবার ছিলোনা।
সামান্য থামলেন বিলাল,বিষাদ ভর করলো চেহারায়।
– এরপর আরো কতক বছর পর, হুট করেই একদিন শুনলাম আয়েশা জীবিত নেই।কি হয়েছে,কিভাবে হয়েছে কিছুই জানতাম না।সবকিছু উপেক্ষা করে পাগলপ্রায় হয়ে ছুটে এসেছিলাম আমি,কিন্ত ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে।আসমানকে খুঁজে পাইনি।কায়সারের দ্বারস্থ হওয়া তখন ছিল আত্মা*হু*তি দেয়ার সামিল।নিজের দুটো মেয়ে সন্তান,ওদের বিপদে ঠেলতে পারতাম না।তাই স্বার্থপর কাপুরুষের মতন পিছু হটতে বাধ্য হই। আরও বহু বছর পর অন্ধকার জগতে রাজত্ব করে বেড়ানো কি*লিং মেশিনের নাম শুনতে পাই।আসমান দ্যা কি*লিং মেশিন… যন্ত্রণাদায়ক এক উপলব্ধি।
রোযার পক্ষে আর সম্ভব হলোনা।উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে সে বিলালের নিকটবর্তী হলো, দুকাঁধে বাহু জড়িয়ে বিড়বিড় করলো।
– আপনি আর এক নন বাবা,আপনার সঙ্গে আমরা সবাই আছি।আপনি ব্যর্থ নন,আপনি সফল।আর এই সুন্দর গোছালো পরিবারটিই আপনার সফলতার প্রতিচ্ছবি।
– ধন্যবাদ…. মামণি।
অগোচরে এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলেন বিলাল।ঠিক তখনি খুট করে মৃদু শব্দে দরজা খুলে গেলো।আর একটি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
– বাবা?
চট করে তাকালেন বিলাল, রোযাও।হতচকিত হয়ে আবিষ্কার করলো দরজার পাশে দাঁড়ানো আসমানকে।এই তীব্র শীতেও কেমন ঘর্মাক্ত তার শুভ্র শরীর,চিকচিক করছে তা।খানিকটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। রোযাকে লক্ষ্য করে আসমান থামলো।
– ওহ..তুমিও এখানে?
– কি ব্যাপার বেইবি?
চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন বিলাল।অতঃপর এক নজর রোযার উদ্দেশ্যে তাকালেন,ইশারা করলেন সূক্ষ্ম।অনুরোধ,আসমান যেন কিছু উপলব্ধি না করে। রোযা তাই নীরব রইলো।ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো আসমান,কোনো জবাব দিলোনা।সোফায় লুটিয়ে পড়লো,কোনকিছু উচ্চারণ না করেই বিলালের কোলে মাথা রেখে গুটিশুটি দিয়ে চোখ বুজলো।সামান্য হাসলেন পিতা।কপালে হাত বুলিয়ে শুধালেন,
– দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
– হুম।
এটুকুই। বিলাল আর কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না, নিজের মাঝে আগলে নিলেন সন্তানকে।ঝুঁকে কপালে চুমু খেলেন।
– ঘুমাও,আমি আছি তোমার সাথে।
অত্যন্ত আপ্লুত অনুভব করলো রোযা,কিন্তু জোরপূর্বক তা প্রদর্শন থেকে নিজেকে নিবারণ করলো।বিছানা থেকে একটি চাদর টেনে এনে আসমানের শরীরে ছড়িয়ে দিলো।সোফার সামনে উবু হয়ে বসলো, কপালে আলতো স্নেহ বুলিয়ে দিলো।একটি হাত নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে বললো,
– হ্যাঁ আসমান,আমরা তোমার সাথে আছি।
দৃষ্টি মেললোনা আসমান ঠিকই,কিন্তু তার অধরে প্রস্ফুটিত হওয়া পরিতৃপ্তির হাসিখানি পিতা এবং স্ত্রী কারোরই দৃষ্টি এড়ালোনা।
আঁধার রাত্রি। নির্জন সড়কের একধারে রীতিমত অপ্রত্যাশিতভাবে একলা দন্ডায়মান একটিমাত্র স্ট্রিট লাইট।তার আভার নিচে বাইকে বসা নিহাদ।গ্লাভস পরিহিত শক্ত হাতে ফোন ঘাঁটছে, লোকেশনটা গুলিয়ে ফেলেছে।নিশ্চিত হতে ম্যাপ দেখছে।ঠিক তখনি স্ক্রিনে মেসেজের শট ভেসে উঠলো,
নাগরাণীর বিষাক্ত ছোবল: সামনে আসো, একটা চটকানা দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো!
খিলখিল করে হাসলো নিহাদ,পাল্টা মেসেজ করলো,
আ লিটল শিট: বা রে, তুমিই তো বললে আপু ডাকতে।যখন সত্যি সত্যি ডাকলাম দোষ হয়ে গেলো?
নাগরাণীর বিষাক্ত ছোবল: আমার বন্ধুবান্ধবদের সামনে জোরে জোরে ইচ্ছা করে গা ঘেঁষে বলতে বলিনি,চিংটা কোথাকার!
আ লিটল শিট: সহমত আপু।কিন্তু কি বলুন তো?তারা আমাকে আপনার বয়ফ্রেন্ড ভেবে বসছিলো,একটু উচিত জ্ঞান তো দিতেই হতো বলুন!
নাগরাণীর বিষাক্ত ছোবল: শাট আপ!তোমাকে আর কোথাও নিয়ে যাবো না!পার্টির ফ্রি খাবারের কথা শুনেই লোভীর মতন হাতজোড় করছিলে!সহমর্মিতার দাম নেই!
আ লিটল শিট: আরে আপু আপনি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন কেনো?
নাগরাণীর বিষাক্ত ছোবল: স্টুপিড শিট!
আ লিটল শিট: চিটাইঙ্গে ফুয়ারল্যে ডুবাইগিরি মারাদ্দেনা?
নাগরাণীর বিষাক্ত ছোবল: তুমি একবার মেঘতীরে আসো, তোমার মেজবান খাওয়াবো আমি সবাইকে।
আ লিটল শিট: খাওয়াও,প্লীজ!আমার প্লেটে যেন মাংস বেশি পরে!
নাগরাণীর বিষাক্ত ছোবল: নিহাদ!
আ লিটল শিট: হা হা,তোমরা মেয়েরা যে কথায় কথায় আমাদের ভাইয়া বানিয়ে দাও,এবার বুঝতে পারছো সেই ভাইয়া ডাকার জ্বালা?
সিন হলো….কিন্তু আর রিপ্লাই এলোনা।শুধুমাত্র ক্রোধের রিয়েক্ট দিয়ে চারুলতা অফলাইন হয়ে গেলো।ক্ষেপেছে ভীষণ,মিটিমিটি হাসলো নিহাদ।তারপর ফোন পকেটে ভরলো।ব্যাপার নয়,কিছু একটা করে মান ভাঙানো দুষ্কর হবেনা।হ্যান্ডেলে হাত রেখে যেই না সে বাইক চালু করতে যাবে তখনি ঘটলো ঘটনাটি।পিছন থেকে তীব্রবেগে তেড়ে এলো একটি কার্গোভ্যান।নিহাদ রিয়ার ভিউ মিররে দেখলো,যেহেতু সম্পূর্ণ রাস্তা ফাঁকা তাই তেমন পরোয়া করলোনা।
ডার্কসাইড পর্ব ৫১
কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তার সতর্ক করলো অতর্কিতে।অত্যন্ত দ্রুত হ্যান্ডেল পাকড়াও করে ইঞ্জিন চালু করলো।কিন্তু শেষরক্ষা হলোনা। কার্গোটি অন্তিম মুহূর্তে ভীষণ এক বাক কে*টে নিহাদের বাইকটি ধা*ক্কা দিলো স*জোরে।এতটা জোরালো সংঘ*র্ষে নিহাদের শরীর এবং বাইক উভয়ে ছিটকে গেলো।সড়কের হাত দশেক দূরে গিয়ে আছ*ড়ে প*ড়ল নিহাদ,হেলমেট পরিহিত মাথায় আ*ঘা*ত লাগলো প্রচণ্ড।তবুও জ্ঞান ছিল তার।সেটুকু কেড়ে নিলো দানবের ন্যায় উড়ে আসা বাইকটি,শত ওজনের ভারী ধাতব যন্ত্রটি তার শ*রীরকে পি*ষে ফে*ললো সড়কে,চেপে বসলো উভয় পায়ে।একটিমাত্র প্রশ্বাস গ্রহণের সুযোগ পেলো নিহাদ।
অতঃপর……পিনপতন নীরবতা।
