ডার্কসাইড পর্ব ৫৩
জাবিন ফোরকান
দৃষ্টি মেলতেই প্রথমে সবকিছু ঝাপসা গোচর হলো।দীর্ঘ কয়েক মুহূর্তের সময় প্রয়োজন হলো মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা সচল হতে।অতঃপর ধীরে ধীরে ফিরে আসতে থাকলো শ্রবণশক্তি, অনুভবশক্তি এবং সর্বশেষে দৃষ্টিশক্তি।পরিচ্ছন্ন চাহুনিতে স্থানটি দেখালো এক পরিত্যক্ত গোডাউনের ন্যায়।চারিপাশে কার্ডবোর্ড ছড়ানো ছিটানো।মাঝখানে একটিমাত্র চেয়ার,যার উপরে একটি টিমটিমে আলোর বাতি।সেটি অবশ্য এখন বন্ধ রয়েছে।ভোরের আলো প্রবেশ করছে একপাশের খোলা দেয়ালের প্রান্ত চুঁইয়ে।
সর্বপ্রথম দীর্ঘ একটি প্রশ্বাস গ্রহণ করলো নিহাদ। বেঁচে আছে নাকি এখনো বোধগম্য নয়।নড়েচড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই অনুভব হলো যে তার সম্পূর্ণ শরীর লোহার শিকল দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে আবদ্ধ রয়েছে।তবে ব্যাপারটি তাকে আতঙ্কিত করলোনা,কারণ এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু তার বোধশক্তি স্থবির করে দিয়েছে।নিজের দুই পা অনুভব করতে পারছেনা নিহাদ!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে উঠলো যেন।দপদপ যন্ত্রণা দিয়ে অনুভূতির জোয়ার তুলে ফিরে আসলো সব মস্তিষ্কে। কার্গো ভ্যানটি ধা*ক্কা দেয়ার পর বাইক তার উপর এসে পড়েছিল,কোনো এক দৈবিক শক্তির জোরে নিহাদ নিজের শরীর টেনে আধখানিক বের করতে পেরেছিল।এরপর আর সম্ভব হয়নি,তার জ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে যায়।বাইকটি তার পায়ের উপর চেপে গিয়েছিল।অতএব,নিশ্চিতভাবে অঙ্গটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।ঠিক কতটা বোঝা সম্ভব হয়নি।নার্ভ সিস্টেমে সমস্যা হওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত,এতক্ষণ চাপা থাকার পর মাংসপেশি ঠিকমত কাজ করতে অক্ষম,তাই কিছুই বোধগম্য হচ্ছেনা।সহসাই সম্পূর্ণ শরীর অসাড় হয়ে পড়ল নিহাদের উপলব্ধিতে।সত্যি যদি নার্ভ সিস্টেম গুরুতর ক্ষ*তিগ্রস্ত হয়ে থাকে তবে হয়ত সে আর কোনোদিন হাঁটতে পারবেনা!এই উপলব্ধি যেন মৃ*ত্যুর চাইতেও আগ্রাসী।নিহাদের সম্পূর্ণ জীবন দূর্বার ছুটে চলার মাঝেই পূর্ণ,তার সেই শক্তিটুকুই যদি চলে যায় তাহলে এই ধরিত্রীর বুকে বেঁচে থাকা আর না থাকার মাঝে কোনো পার্থক্য রইবেনা তার জন্য।
তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে নিহাদ প্রাণপনে প্রচেষ্টা চালালো নড়চড় করবার,কিন্তু সম্ভব হলোনা।ইতোমধ্যে দাঁতে লেগে ক্ষ*ত হওয়া অধর সে আবারও কামড়ে ধরলো,সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালালো,তবুও পাথরের মতন র*ক্তাক্ত পা দুখানা নাড়াতে সে সক্ষম হলোনা।এক লহমায় যেন গোটা পৃথিবী অমানিশায় ছেয়ে গেলো নিহাদের, ঝুলে পড়লো মাথা,টপটপ করে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে থাকলো তার কোলে।অশ্রুর মাঝে র*ক্তে*র ফোঁটা শূণ্য হৃদয়ে কোনোপ্রকার অনুভূতি সৃষ্টিতে সক্ষম হলোনা।
– মা…..
একটিমাত্র শব্দ অস্ফুট স্বরে নির্গত হলো তার কন্ঠ বেয়ে।দৃষ্টি বুজে আসলো,অশ্রুর জমাকৃত ফোঁটা তরতর করে বইতে থাকলো।ঠিক কতক্ষন ওই অবস্থায় নিহাদ বসেছিল সর্বহারার মতন হিসাব নেই।তার মনোযোগ আকর্ষিত করলো মৃদু কিছু পদশব্দ।মুখ না তুলেই দৃষ্টি মেললো সে,মলিন মেঝেতে সামনে এসে থমকাতে দেখলো দুজোড়া ফরমাল বুট পরিধানকৃত পদক্ষেপকে।সামান্য দৃষ্টি তুলতেই তাদের লম্বাটে অবয়ব দৃষ্টিগোচর হলো।কালো পোশাকে আবৃত, টারটেলনেক সোয়েটশার্টের বুকে সিলভার পেঁচার সূক্ষ্ম এক প্রতিচ্ছবি।পাথরের মতন শক্ত মুখ, দৃষ্টি আবৃত সানগ্লাসে।বুঝতে সামান্যও বেগ পোহাতে হলোনা নিহাদকে।সুদূর অতীতের স্মৃতিগুলো আজও তাজা।
মিস্টিক রিপার—ইতালির আন্ডারওয়ার্ল্ডে রাজত্ব করে বেড়ানো মাফিয়া গোষ্ঠী।নেতৃত্ব যার এক অদৃশ্যমান আলফার হাতে, সান্দ্রোর পিতা!
অবশেষে নিজের চাল চেলেছেন আলফা।
নিহাদকে বন্দী করার অর্থ আসমানকে কষ্ট দেয়া, নাকি কোনোভাবে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা আপাতত বুঝে উঠতে ব্যর্থ নিহাদ।লোক দুইজনের একজন মাথা কাত করে শুষ্ক কন্ঠে শুধু একটাই কথা বললো,
– স্টেরয়েড দেয়া হয়েছে।ডোন্ট ট্রাই এনিথিং স্টুপিড।ইউ আর ডুমড এনিওয়ে।
পাল্টা কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া করলোনা নিহাদ।তার সামনে একটি কার্ডবোর্ডের বাক্স টেনে এনে একটি আইপ্যাড স্থাপন করা হলো স্ট্যান্ডে ঠেকিয়ে।যথাযথ আলোর ব্যবস্থা রয়েছে,যেন নিহাদকে স্পষ্ট দেখা যায়।মিটমিট করে তাকালো ছেলেটি চারিপাশে,বুঝতে পারলোনা কি ঘটছে।একজন এগিয়ে তার শিকলের চারিপাশে সংযুক্ত করলো একটি ডিভাইস। সরে যেতেই দেখা গেলো তাতে ত্রিশ মিনিটের টাইমার সংযুক্ত রয়েছে।শিরদাঁড়া বেয়ে এক হিমশীতল স্রোত খেলে গেলো নিহাদের।
টাইমড ব*ম্ব!
বিপরীত প্রান্তে দন্ডায়মান লোকটি যান্ত্রিক কন্ঠে জানালো,
– এই একই জিনিস আরেক স্থানে আছে।ভিন্ন লোকেশনে,ভিন্ন একজনের শরীরে।মজার ব্যাপার কি জানো?উভয় ঠিকানার দূরত্ব ত্রিশ মিনিটের।
কথা সমাপ্ত হতে না হতেই আইপ্যাডের স্ক্রিনে একটি ফুটেজ ভেসে উঠলো। সিসিক্যাম থেকে নেয়া খুব সম্ভবত।যেখানে পাশাপাশি দুজনকে দেখা কাছে।একটি নিহাদ নিজে,এবং অপরজন….বিলাল রেমান!
স্তম্ভিত হয়ে থাকলো নিহাদ।স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে একটি চেয়ারে আবদ্ধ বিলাল রেমান,র*ক্তা*ক্ত তার মুখাবয়ব।তবুও দৃষ্টির মাঝে সামান্যতম দুর্বলতা নেই, তীক্ষ্ণ ধার নিয়ে চেয়ে রয়েছেন একদিকে,খুব সম্ভবত সেখানে কেউ রয়েছে।তার শরীরে নাইলনের দড়ি পেঁচানো,একইভাবে সংযুক্ত ডিভাইসটি।ত্রিশ মিনিটের টাইমার দেয়া।এক লহমায় সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বোধগম্য হলো নিহাদের।
আসমানের সঙ্গে এক ধ্বং*সের খেলা খেলছেন আলফা।শারীরিকভাবে নয়,বরং মানসিকভাবে বিনাশ ঘটাবে সে আসমানের অস্তিত্বের।ত্রিশ মিনিট মাত্র সময় বেঁধে দেয়ার অর্থ আসমানকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে,যা তার সিদ্ধান্ত নেয়ারও অতীত!অসম্ভব এমন দোলাচলে নিজেকে হারানোর।ভীষণ ভুগবে আসমান,অপরাধবোধে।এই ব্যাপারটিই চাইছেন আলফা।ক্রোধে নিহাদের সর্বাঙ্গ শক্ত হয়ে এলো,যন্ত্রণা উপেক্ষা করেই জোর ঝটকা দিয়ে উঠল সে মুক্তির আশায়।আসমানকে এমন অসহায় অবস্থায় পড়তে দিতে রাজী নয়।কিন্তু ঘটলো হিতে বিপরীত। দূর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকা শরীর তার সামান্য নড়চড়ও সহ্য করতে ব্যার্থ,দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেলো, এই বুঝি জ্ঞান হারায়!কিন্তু দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাম*ড়ে তা প্রতিরোধ করলো নিহাদ।ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে নিতে অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো আইপ্যাডের স্ক্রীনের দিকে।
– দেখা যাক,কে বিজয়ী হয় এই ভাগ্যের খেলায়।চিন্তা করোনা,শেষ বাক্য বিনিময়ের সুযোগ অবশ্যই পাবে।
আইপ্যাড হাতে নিয়ে কিছু একটা করলো লোক দুইজন,অতঃপর আবারো রাখলো নিহাদের সম্মুখে।রুদ্ধশ্বাস হয়ে নিহাদ লক্ষ্য করলো ভিডিও কল,ওপাশে কে থাকতে পারে তা উপলব্ধিতে বেগ পোহাতে হলোনা।
অত্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে নিহাদকে, সময় নেই।আসমানকে কিছুতেই অনুভূতির দোটানায় ফেলা যাবেনা। বিলাল রেমান তার পিতা,আসমানের পরিবার।সেখানে নিহাদ…..হয়ত পরিবারই।তবুও, নিজের প্রাণের জন্য স্বার্থপর হওয়া অসম্ভব।সময়ের ব্যবধান অত্যন্ত ক্ষীণ,তবুও তার মাঝেই সকল স্মৃতি ভেসে উঠলো নয়নপর্দায় একের পর এক।
আসমান যদি তার জীবনে না আসতো তবে আজ কি হতো তার?কোন পর্যায়ে থাকতো তার জীবন?ভয়াল হতো না তা?পরিবারহীন,একলা,যাযাবর এক সত্তা, অপ্রয়োজনীয় পৃথিবীর তরে।একটি ঢোক গিললো নিহাদ,প্রশান্তি পাচ্ছেনা অন্তর,রোমন্থনে ব্যাস্ত সে।মনে পড়ল কৈশোরের দিনগুলি,কলেজে ছেলেপেলেদের সঙ্গে কতবার মা*রামা*রি বাঁধিয়েছে সে,আসমানের তলব ঘটেছে অভিভাবক হিসাবে বারংবার।যৌক্তিক কারণে নিহাদকে আগলে রেখেছে,আবার অযৌক্তিক ক্ষেত্রে শাসনও করেছে।হাতে কলমে শিখিয়েছে প্রত্যেকটি লড়াই বিদ্যা।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মাঝে ভয়ং*কর জ্বরে পড়েছিল নিহাদ,রাতের পর রাত পড়বার সময় তার কাছেই বসে থেকেছে আসমান, জলপট্টি দিয়ে দিয়েছে,জোর করে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিয়েছে।পাবলিক পরীক্ষার সেন্টারে অনেকেই মা বাবার সঙ্গে যেতো,চাপা কষ্ট হতো নিহাদের পরিবারের অভাবে।কিন্তু আসমান তাকে সেই কষ্ট অনুভব করতে দেয়নি। রোজ পরীক্ষা সমাপ্ত করে বাইরে বেরিয়েই গাড়ির সঙ্গে আসমানকে অপেক্ষারত পেতো সে,
– পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
– ভালো।
– প্রশ্ন দেখি।
বাক্য বিনিময়ের পর গাড়িতে করে বাড়ি ফেরার সময় রাজ্যের কাহিনী বলা ছিলো নিহাদের নিত্যদিনের কর্ম।গুটিকতক বন্ধুবান্ধব যা হয়েছিল,সবাই আসমানকে চিনত তার বড় ভাই হিসাবে।তার অমোঘ সাধনা, বাইকের প্রতি ভালোবাসাটাও অনেকাংশে আসমানের দান।আঠারতম জন্মদিনে প্রথম আসমান তাকে একটি বাইক উপহার দেয়,সঙ্গে লাইসেন্স ট্রেনিংয়ের পাস।সেদিন যতটা খুশি হয়েছিল নিহাদ তা আজও স্মরণে রয়েছে স্পষ্ট।সেখান থেকে তার তীব্র বাইক আকর্ষণের সূচনা।এক কথায়, নিহাদের সম্পূর্ণ জীবনজুড়ে আসমানের অস্তিত্ব মিশে রয়েছে।আসমান তার কেউ না,আবার সবকিছু।পরিবার পায়নি নিহাদ কোনোদিন,কিন্তু আসমানকে পেয়েছে।মা,বাবা,ভাই, বোন,বন্ধু,সঙ্গী—সবকিছুই তার জন্য ছিল শুধুমাত্র আসমান।নিঃস্বার্থভাবে তাকে গড়ে তুলেছে অমানিশা, ভ্রাতৃত্বের চাদরে ছেয়ে রেখেছে জীবনভর।
আসমান নিহাদের শূণ্য পৃথিবীতে একমাত্র পরিবারের ছায়া।র*ক্তের সম্পর্ক নেই তাদের মাঝে,তবে যে আত্মার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তা উপেক্ষার কোনো ক্ষমতা নিহাদের নেই।গোটা জীবনটাই তার আসমানের নামে উৎসর্গকৃত।এই প্রতিজ্ঞার ব্যাত্যয় ঘটবেনা অমোঘ সমাপ্তি পর্যন্ত।
আজই সেই অমোঘ সমাপ্তির দিন।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কে বি গ্রুপের প্রাক্তন হিটম্যান।
দীর্ঘ প্রশ্বাস টেনে নিজেকে প্রশান্ত করে দৃষ্টি মেললো নিহাদ,সম্পূর্ণ প্রস্তুত সে।আসমানের জন্য নিজেকে ধ্বংস করতেও দ্বিধা নেই তার।হ্যাঁ,তার ভাইটি কষ্ট পাবে।কিন্তু ধীরে ধীরে ঠিক নিজেকে মানিয়ে নেবে।সে একা নয়,তার একটি সুন্দর ছিমছাম পরিবার রয়েছে।বিলাল রেমান,রোযা,চারুলতা…..
অতর্কিতে থমকালো নিহাদ। চারুলতা?চিনচিনে এক ব্যথা উঠলো অন্তরে।কেনো?অসহনীয় এক প্রগাঢ় অনুভূতি,ভিন্নরকম এক আবেশ,এক না পাওয়ার তীব্র বেদনা।নিঃশ্বাস আটকে এলো নিহাদের,ভেঙে পড়তে চাইলো সর্বাঙ্গ।তার মৃ*ত্যুতে কি চারুলতা কষ্ট পাবে?নাকি খুশি হবে?অবশেষে তার সঙ্গে সারাক্ষণ ঝগড়ারত ছেলেটি আজীবনের জন্য উধাও হয়ে যাবে, পেত্নী বলে একটুও জ্বালাতন করবেনা।
“ তুমি কি উৎফুল্ল হবে প্রিয়?”
অন্তরে ধ্বনিত হলো নিহাদের।নাহ,আর পারছেনা।নিদারুণ অনুভূতি সহ্য করা দায়।ল্যাপটপের দিকে নজর পড়লো।অতি ক্ষীণ মুহূর্তটি তার নিকট অনুভূত হলো এক বছরসম দীর্ঘ।অবশেষে ভিডিও কলের ওপাশে স্ক্রিনের মুখটি ভেসে উঠলো,শুভ্রতাকে অবলোকন করলো নিহাদ অন্তিম মুহূর্তভরে।তারপর মৃদু কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– আসমান ভাই।
মেঘতীর ভবন।
স্তব্ধ হয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে আছে আসমান।নিজেকে তার সম্পূর্ণ শূন্য অনুভূত হচ্ছে।বহুদিন বাদে সে জীবনের এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে আবারো।চারিদিকে শুধুই আঁধার,পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।ল্যাপটপে তার একটি ভিডিও প্রদর্শিত হচ্ছে।যেখানে তিনটি দৃশ্য বিদ্যমান।প্রথম দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে রোযা এবং চারুলতাকে, উভয়ে আন্দোলনে গিয়েছে।সেখানেরই আশেপাশের কোনো এক উঁচু বিল্ডিং থেকে তাদের উপর নজরদারি করা হচ্ছে।দ্বিতীয় দৃশ্য বিলাল রেমানের,একটি দীর্ঘ টেবিলের অপরপ্রান্তে বসা।দৃষ্টিতে তার কঠোরতা, কিন্তু অবস্থা শোচনীয়।শরীরের চারিপাশে নাইলনের শক্ত দড়ি।বুকে বাঁধা একটি ডিভাইস।বুঝে উঠতে না উঠতেই অন্তিম দৃশ্যটি আসমানের শরীর সম্পূর্ণ হিম করে দিলো।র*ক্তা*ক্ত এক অবয়ব, শরীর আবদ্ধ শিকলে,পড়ে রয়েছে মেঝেতে,চারিপাশে তার র*ক্ত শুষ্ক হয়ে যেন এক নদীর রেখা তৈরি করেছে।একই ডিভাইস তার কোমরে সংযুক্ত।প্রা*ণহীন এক শরীর যেন,শুধুমাত্র পোশাকে অস্তিত্ব অনুধাবন সম্ভব।
নিহাদ!
সম্পূর্ণ বিষয়টি উপলব্ধি করতে আসমানের কয়েক সেকেন্ডের অধিক সময়ের প্রয়োজন হলোনা।বারংবার দেখেছে সে দৃশ্যগুলো।অতঃপর একটি অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে তার নিকট।
“ ক্যান ইউ কম্পিট উইথ দ্যা ক্লক?
— আলফা ”
একটিমাত্র বাক্য,কিন্তু তাতে জড়ানো অসামান্য হু*মকি।নিচে সংযুক্ত তিনটি ঠিকানা। অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিটি সমান দূরত্বে নির্বাচিত স্থান,যেখানে পৌঁছতে আসমানের আদতেই ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে মেঘতীর থেকে।ডিভাইসে সেট করা সময় ত্রিশ মিনিট, অপরদিকে রোযাদের উপর যে নজরদারি করছে সেও নিশ্চয়ই ত্রিশ মিনিটের মাথায় কাজ আরম্ভ করবে।বিষয়টি নিয়ে আসমান চিন্তিত নয়,কারণ আন্দোলনের দিকটা সে বহু আগেই সুরক্ষিত করে রেখেছে।কিন্তু নিহাদ এবং বিলাল?তাদের কিভাবে একসঙ্গে রক্ষা করা সম্ভব?ঠিকানা দুটোতে কোনক্রমেই সে পৌঁছাতে পারবেনা ত্রিশ মিনিটের ভেতর।এমনও সম্ভব নয় যে অন্য কাউকে পাঠাবে। হিটটিমের ছেলেগুলোর নিজস্ব মিশন রয়েছে,যদি বা কাউকে পাওয়াও যায় কখনোই ত্রিশ মিনিটের ভেতর পৌঁছাতে পারবেনা গন্তব্যে।
অতএব,আসমানকে যেকোনো একজনের জীবন রক্ষা করতে হবে।এটাই চায় আলফা।শারীরিক নয়, বরং মানসিক আ*ঘা*তে জর্জরিত করার এক বি*ধ্বংসী পরিকল্পনা সান্দ্রোর পিতার।
ক্ষিপ্র গতিতে একটিমাত্র উপায়ের আশায় মস্তিষ্ক উল্টেপাল্টে ফেলতে আরম্ভ করলো আসমান।ঠিক তখনি তার ল্যাপটপে অপরিচিত আরেকটি নম্বর থেকে ভিডিও কলের ইনভাইট এলো,ঠিক যেখান থেকে ভিডিওগুলো কিছুক্ষণ আগেই তাকে পাঠানো হয়েছে।কম্পিত হাতে আসমান রিসিভ করলো।ওপাশে ভেসে উঠলো বিলাল রেমানের চেহারা।
– বাবা!
অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করলো আসমান।মাত্র গতকাল রাতেই একটি বিজনেস মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ার ফ্লাইট ছিল তার।তখন আসমান সত্যিই চিন্তা করেনি এমন কিছু হওয়া সম্ভব।পিতার ভগ্ন মুখশ্রী তার অন্তরে তোলপাড় খেলিয়ে দিলো যেন। ভ্রুর নিচে একটি কা*টা দাগ বিলালের,শ্রান্ত চেহারায় ছোপ ছোপ র*ক্তের চিহ্ন।বহু কষ্টে যেন সজ্ঞানে রয়েছেন তিনি।
– বাবা?
আরও একবার ডাকলো আসমান, তক্ষুণি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন বিলাল।মাথা ঝাঁকালেন বারকয়েক, নিজেকে সজ্ঞানে আনার চেষ্টায়।ঠিক পরক্ষণেই আসমানকে দেখলেন।বলে বসলেন,
– আসমান বেইবি…
– আমি আসছি বাবা।তুমি একটুও চিন্তা করোনা।আমি তোমাকে ঠিক সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনবো।
– না!
বিলালের চেহারা উদ্ভ্রান্ত দেখালো,তিনি নিজের দৃষ্টিতে গভীরভাবে তাকালেন,তারপর বললেন,
– আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো বেইবি,তুমি নিহাদের কাছে যাবে।ঠিক আছে?
স্তব্ধ চেয়ে থাকলো আসমান,কিছু উচ্চারণ করা সম্ভব হলোনা। বিলাল দীর্ঘ এক প্রশ্বাস গ্রহণ করে বললেন,
– আমাকে যেতে দাও,আমার কিছু যায় আসেনা।অনেকদিন বেঁচে থেকেছি,তোমাদের লালন পালন করেছি। আশা করি বাকিটা পথ একা চলতে পারবে।আমি পরপার থেকে তোমাদের সুখের কামনা করবো।নিহাদের গোটা জীবন এখনো পরে আছে,যাও,ওকে রক্ষা করো।জীবনে খুশি থেকো,সবাই একসাথে থেকো এবং আনন্দে থেকো।
– অসম্ভব বাবা!আমি কিছুতেই তোমাকে….
– বেইবি!এটা আমার অনুরোধ নয়,আদেশ!আমার পরিণতির জন্য নিজেকে দোষারোপ করোনা,তুমি দায়ী নও।তুমি আমার সন্তান,পিতার কাছে সন্তানের দায় থাকেনা।ভালো থেকো।সুস্থ থেকো,সুন্দর থেকো আমার বাচ্চা।
এটুকুই শোনা গেলো ওপাশ থেকে,আসমান প্রতিক্রিয়া করার পূর্বেই লাইনটি কেটে গেলো।সোফা থেকে হুড়মুড় করে মেঝেতে বসে পড়ল অমানিশা,উদভ্রান্তের মতন স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকল,ইচ্ছা হলো হাত বাড়িয়ে ওই পর্দার ওপাশ থেকেই মানুষটির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।সম্পূর্ণ পৃথিবী একদিকে,এবং অপরদিকে বিলাল হলে আসমান হয়ত তার পক্ষেই দাঁড়াবে।পিতৃতুল্য মানুষটাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব।পিতৃতুল্য শুধু নয়,আসমানের জীবনে যদি সত্যিই পিতা বলে কিছু থেকে থাকে,তাহলে সেটা একমাত্র বিলাল রেমান।একজন সন্তানের পক্ষে কি সম্ভব পিতাকে বিসর্জন দেয়া?দ্বিধার দোলাচল মিটতে না মিটতেই স্কিনে আরেকটি ভিডিও কল ভেসে উঠলো। প্রতিবার ভিন্ন নম্বর ব্যবহার করছে।নিশ্চয়ই একবার ব্যবহারের পরেই নষ্ট করে ফেলে। ট্র্যাক করা অসম্ভব।রিসিভ করলো আসমান।হৃদয়ে তার তড়িৎ খেলে গেলো মুহূর্তেই।
– আসমান ভাই….প্লীজ! লিভ মি….
নিহাদের র*ক্তস্নাত মুখাবয়বের কন্ঠে করুণ আবেদন আসমানের অন্তর যেন জলোচ্ছ্বাসের জোয়ারে তলিয়ে ফেললো।চারিদিকে শুধুমাত্র অন্ধকার,উপায় নেই।যেকোনো একজনকে বেছে নিতেই হবে তাকে।একটিমাত্র জীবন রক্ষা করার ক্ষমতা রয়েছে তার, অপরজনকে পরিত্যাগ করতে হবে, অবহেলায় ছিঁড়ে খানিকক্ষণ ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলা পুষ্পের মতন, সময় নেই ভাববার।
আসমানের জন্য সেই পুষ্পটি….নিহাদ।
– ইটস ওকে…আমি যতদিন বেঁচে থেকেছি,তাতেই শুকরিয়া।নিজেকে দোষারোপ করোনা…..
নিহাদের উচ্চারণ করতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, ল্যাপটপের স্ক্রিনের ওপাশে তার ভগ্ন র*ক্তা*ক্ত অবয়ব লক্ষ্য করে বুক ফে*টে যাচ্ছে আসমানের।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই তার, কিচ্ছু না!হাতে সময় মাত্র ত্রিশ মিনিট,এর মধ্যে একজনকে মাত্র উদ্ধার করা সম্ভব,এবং অপরজন….
হারাবে সে অপরজনকে চিরজীবনের মতন।
নিহাদের কপোল বেয়ে র*ক্তমিশ্রিত অশ্রুকণা গড়ালো।অন্তিম বারের মতন প্রদর্শিত হলো ক্ষতপূর্ণ অধরে নির্মল চিরায়ত সেই হাসিখানি।আসমানের দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত হলো নিহাদের নিষ্পাপ দৃষ্টির,
– ভালোবাসি আসমান ভাই।
অন্তিম বাক্য।অতঃপর…..
স্ক্রিন শূন্য হয়ে গেলো।হাত বাড়ালো আসমান,স্ক্রিন ছুঁয়ে দিলো,দুর্বোধ্য এক প্রচেষ্টায়।ল্যাপটপের পাশে ফোনখানি তার ভাইব্রেট করে উঠলো।অন্তিম মেসেজ,
“ দ্যা রেইস বিগিনস নাউ।
—আলফা ”
চকিতে ঘড়ির দিকে নজর পড়লো,ত্রিশ মিনিটের সময় শুরু।একটি ঢোক গিললো আসমান,ল্যাপটপ ঠাস করে বন্ধ করলো।অস্ফুট স্বরে শুধুমাত্র একটি বাক্যই উচ্চারিত হলো,ভগ্ন আবেশে,
– এই অধম ভাইকে ক্ষমা করে দিও নিহাদ,সে আজ স্বার্থপরের মতন তোমাকে পরিত্যাগ করেছে।
এক লহমায় ছেলেটির সঙ্গে অতিবাহিত করা সকল মুহূর্ত ভেসে উঠলো আসমানের দৃষ্টিতে,সেই চট্টগ্রাম থেকে তাকে নিয়ে আসা থেকে বর্তমান পর্যন্ত।কোনোদিন নিহাদ আসমানের হাত ছাড়েনি,পাশে থেকেছে, লড়ে গিয়েছে তার তরে।কিন্তু আজ আসমান নিজের স্বার্থে তাকে ব্যবহৃত কাগজের মতন ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেললো।এই অপরাধবোধের দায় থেকে আসমান আজীবনেও মুক্ত হতে পারবেনা।
নিশ্চয়ই এটাই উদ্দেশ্য আলফার,এক নিদারুণ প্রতিশোধ!
সময় থেমে নেই,থেমে থাকা যাবেনা। দ্রুত এগোলো আসমান,উপেক্ষা করলো অবাধ্য গড়িয়ে পড়া অশ্রু নিজের,অন্তরে জোরালো ভ্রাতৃত্বের টানকে।তবুও স্মৃতিরা শান্তি দিলোনা তাকে,কটূক্তি করতে থাকলো ভীষণভাবে।
বেঈমান আসমান!—ধ্বনিত হতে থাকলো তার সর্বাঙ্গজুড়ে।
বাইরে বের হলো আসমান,উঠলো নিজের পোর্শে।শক্ত হাতে স্টিয়ারিং চেপে উচ্চগতিতে চালাতে আরম্ভ করলো।তাতে গাড়ির দরজা পর্যন্ত কাপতে আরম্ভ করলো,তবুও তার কৃষ্ণগহ্বর নয়নজুড়ে সামান্য অনুভূতি আর প্রদর্শিত হলোনা।
একটি সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের বারোতম তলায় দাঁড়িয়ে আছে রোযা।সে একা নয় অবশ্য,তাকে ঘিরে আছে চারুলতা এবং হাবিব।ভিন্ন একটি মানুষের অস্তিত্বও রয়েছে,যে এই মুহূর্তে দেয়াল ঘেঁষে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।সকলের মাঝে মেঝেতে লুটিয়ে রয়েছে দুই দুইটি মৃ*তদে*হ।কালো পোশাকে আবৃত,বুকের দিকে একটি পেঁচার চিহ্ন।একদম কপাল বরাবর বু*লে*ট ঠু*কে গিয়েছে।র*ক্ত চারপাশে ছড়িয়ে ইতোমধ্যে জমাট বাঁধতে আরম্ভ করেছে।রোযা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকালো।তারপর তার নয়নজোড়া স্থির হলো দেয়ালের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক গোছের ছেলেটার দিকে।চেহারা দেখার উপায় নেই, মাস্ক পরিহিত।তবে হাতে বহন করা উচ্চ এফ এক্স যুক্ত স্নাইপার রাই*ফেলটি চিনতে রোযার বেগ পেতে হয়নি।এমন বস্তু সিনেমার দৃশ্যে ব্যবহার হতে দেখেছে সে।
– এসব কি?
রোযা জিজ্ঞেস করতেই যুবকটি মাথা কাত করলো। এরপর মৃদু কন্ঠে বিড়বিড় করে জানালো,
– এই দুইজন আপনাদের উপর টার্গেট করছিলো, বিপরীত দিকের টাওয়ার থেকে আমি দেখতে পাই।কিছু করার আগেই খতম করে দিয়েছি।
– স্নাইপার দিয়ে?
– হুম,এদের কাছেও স্নাইপার রয়েছে, আর একটি জুম ইন ক্যামেরা।
– এবং আপনি কে?
সামান্য ইতস্তত করলো সে,আড়চোখে তাকালো হাবিবের দিকে।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাবিব জানালো,
– ও শুধুমাত্র নিজের দায়িত্ব পালন করছিল ম্যাম।
– দায়িত্ব?
রোযার কন্ঠে দ্বিধা ঝরে পড়ল।যুবকটি স্থির জবাব দিলো,
– আমি হিটটিমের এক্সপার্ট স্নাইপার।আমার ডিউটি আন্দোলনের সময় আপনাদের নিরাপত্তা দেয়া।আসমান ভাই আমাকে সেই কাজে নিয়োজিত করেছিলেন।
হতবাক হয়ে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করলো রোযা এবং চারুলতা।তাদের কারোরই বিষয়টা জানা ছিলোনা।আসমানের পক্ষ থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু মোটেও বিস্ময়কর নয়।হাবিবের দিকে ফিরলো রোযা, কঠোর কন্ঠে জানতে চাইলো,
– এ সম্পর্কে আমি কেনো জানিনা হাবিব?
– দুঃখিত ম্যাম।কিন্তু আমাদের কাজ গোপনীয়,যা সম্পর্কে কথা বলার অধিকার নেই।
– আমি এক্ষুনি আসমানকে জিজ্ঞেস করছি।
রোযা সত্যি সত্যি ফোন বের করলো,কিন্তু কিছু করার আগেই চারুলতা এগোলো।পা দিয়ে মৃ*তদে*হ দুটো সামান্য নাড়িয়ে বিড়বিড় করলো,
– কিন্তু এরা কারা?এখানে কি করছিল?অবশ্যই সরকারি লোক নয়।এদের বুকের এই চিহ্নটা….
উপলব্ধি সহসাই চারুকে আ*ঘাত করলো।তবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পূর্বেই হাবিব এবং যুবক উভয়ের পকেটের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।দুইজন তা বের করলো,এক লহমায় আঁধারে ছেয়ে গেলো তাদের চেহারা।বিনা কারণেই রোযার অভ্যন্তর কেমন যেন শঙ্কিত হয়ে পড়ল।
– কি হয়েছে হাবিব?
স্তম্ভিত হাবিব এক পলকের জন্য রোযাকে দেখলো, তারপর অস্ফুট কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– আসমান ভাইয়ের মেসেজ।
সমাপ্ত করার সাথে সাথে ফোনটি ছিনিয়ে নিলো রোযা, স্ক্রিনের দিকে তাকালো।
“ ইফ ইউ ক্যান,প্লীজ সেইভ নিহাদ।”
সঙ্গে ঠিকানা এবং ভিডিও সংযুক্ত।একই জিনিস আসমান টিমের সকলের নিকট পাঠিয়েছে।স্তব্ধ হয়ে থাকলো রোযা,কিছুই তার বোধগম্য হলোনা।নিহাদ কি বিপদে রয়েছে?কিন্তু কেনো?কিসের বিপদ?আর আসমানই বা কোথায়? দুশ্চিন্তারা তাকে চারিপাশ থেকে আঁকড়ে ধরলো।পাশে দন্ডায়মান চারু ঝুঁকে দেখলো স্ক্রিন,কিছু উচ্চারণ পর্যন্ত করলোনা।হাতঘড়ির দিকে তাকালো নিজের,যেন সময়ের হিসাব করলো মনে মনে।তারপর সহসাই উল্টো ঘুরে দৌড় দিলো ঊর্ধ্বশ্বাসে।বিহ্বল বাকিরা বরফখন্ডে পরিণত হলো যেন তার এমন আচরণে। রোযা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা,পিছু নিলো চারুর।হাবিব যাওয়ার পূর্বে যুবককে বললো,
– এই ব*ডি দুটোর ব্যবস্থা করো।কন্ট্যাক্ট এভরিবাডি, উই মাস্ট সেইভ নিহাদ ভাই!
উত্তরে জোরে জোরে মাথা দোলালো যুবক।তারপর নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটি রিভ*লভার বের করে হাবিবকে দিলো,অতিরিক্ত অ*স্ত্রে*র প্রয়োজন হতে পারে।সাদরে তা গ্রহণ করে হাবিব প্রাণপণে ছুটলো রমণীদের অনুসরণে।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ বিশাল এক শোভাযাত্রা হওয়ার কথা।রোযা খুব দ্রুতই সাবিহা এবং অভিষেককে খুঁজে বের করলো।বেশ অল্প কথায় নিজের পরিস্থিতি বোঝাতে বোঝাতে দেখা গেলো চারুলতা অনির্বাণকে পাকড়াও করেছে।
– আপনার বাইক,প্লীজ,কিছুক্ষণের জন্য ধার দিন!
– কিন্তু কেনো?
– আই নিড ইওর বাইক রাইট নাউ ড্যাম ইট!
চারুলতার উত্তেজিত কণ্ঠস্বরের হুম*কিতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল অনির্বাণ।মেয়েটির টানা টানা নয়নজুড়ে অগ্নিশিখার উদগীরণ স্পষ্ট।কোনো এক অজানা আবেশে থরথর করে কাপছে তার সর্বাঙ্গ।একনজর রোযার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো সাংবাদিকের,মাথা দোলালো রোযা। চারুলতার হাতে চাবি তুলে দিলো অনির্বাণ,তৎক্ষণাৎ ছুটে পাশে পার্ক করে রাখা বাইকটিতে চেপে বসলো চারুলতা।হেলমেট পরিধান করলো, রোযাও ছুটলো দ্রুত।
– তুমি বাইক চালাতে জানো?
– কিছুটা….
– কিছুটা?যদি দুর্ঘটনা…
– আই ডোন্ট কেয়ার! লেট মি গো!
রোযাকেও একপ্রকার ক্রোধান্বিত হয়েই জবাব দিলো চারুলতা,তার অতর্কিত রূপ পরিবর্তনে রোযা সামান্য বিস্মিত হলো। তবে বুঝতে পারছে মানসিক অবস্থা, প্রত্যেকটি সেকেন্ডের মূল্যও অনেক।তাই কোনোপ্রকার উত্তেজিত বাক্য বিনিময়ের সুযোগ না দিয়ে সে নিজেই বাইকে চারুলতার পিছনে চেপে বসলো।কোনোপ্রকার অনুভূতি প্রদর্শন করলোনা চারু, বাইকের হ্যান্ডেল ধরলো।কয়েক মুহূর্তের মাঝেই শোভাযাত্রাস্থল পেরিয়ে তাদের বাইক মূল সড়কে এসে পড়লো।পিছনে হাবিবকে গাড়ি নিয়ে অনুসরণ করতে দেখা গেলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই চারুলতা কেনো বাইক বেছে নিয়েছে তা উপলব্ধি করলো রোযা। সরু শর্টকাট নেয়া, জ্যামের মাঝখান দিয়ে চলা গাড়ির পক্ষে সম্ভব নয়।উচ্চ গতিরও একটা ব্যাপার রয়েছে।ফাঁকা স্থানে আসতেই বাইকের গতি ছাড়িয়ে গেলো সবকিছু। স্পিডমিটারে হুহু করে বৃদ্ধি পেতে থাকলো গতি, একের পর এক গাড়িকে বেপরোয়াভাবে ওভারটেইক করে গেলো চারুলতা।দৃষ্টি তার সড়কে নিবদ্ধ।রোযা পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে রইলো মেয়েটিকে।
মস্তিষ্কে চিন্তায় চিন্তায় সকলকিছু মেলাতে থাকলো সে।খন্ড খন্ডভাবে সবকিছু ফুটে উঠলো তার হৃদয়পটে।নিহাদ বিপদে রয়েছে,এদিকে আসমান বাকিদের তার খোঁজ দিয়ে নিজে কোথায় গিয়েছে?এই মুহূর্তে তা জানা অসম্ভব।তবে যেহেতু নিহাদ বিপদে রয়েছে জেনেও আসমান এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার অর্থ কি,এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু সে এখন সম্পন্ন করছে? কার জন্য?…..বিলাল রেমান?তবে কি দুইজন একসাথে বিপদে রয়েছে? তাদেরকেও কিছুক্ষণ পূর্বে টা*র্গেট করা হচ্ছিল। কার কাজ এটি?রাফা কায়সার?নাকি অন্য কেউ?
নাহ,আপাতত ভেবে লাভ নেই। এখন শুধুমাত্র নিহাদকে রক্ষা করা দরকার।
ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে রীতিমত পাল্লা দিয়ে বাইক চালাচ্ছে চারুলতা।মারাত্মক সব বাক কাটছে ক্ষণে ক্ষণে।কপাল বেয়ে ঘামের ফোঁটা গড়াচ্ছে,শরীর আতঙ্কে হিমশীতল হয়ে রয়েছে।হ্যান্ডেলে ক্রমশ শক্তভাবে চেপে বসলো তার হাত,অন্তর বিড়বিড় করলো,
– প্লীজ নিহাদ…প্লীজ… বেঁচে থেকো!
অবশেষে দীর্ঘ সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে যেন নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছলো চারুলতা এবং রোযা।একটি পরিত্যাক্ত গোডাউন।দুজন বাইক থেকে নামলো, এক ছুট দিলো চারু।রোযা হেলমেটখানি শক্তভাবে ধরে এগোলো, শত্রুর বিরুদ্ধে মোক্ষম অ*স্ত্র হিসাবে ব্যবহার সম্ভব।হাবিব তখনো এসে পৌঁছায়নি,পাল্লা দেয়া সম্ভব হয়নি চারুর বাইকের ঝোড়ো গতিকে।অদূরে তার গাড়ির আবছায়া অস্তিত্ব নজরে পড়ছে অবশ্য। রোযা দীর্ঘ প্রশ্বাস নিয়ে এগোলো দ্রুত, চারুলতা ইতোমধ্যে গোডাউনের বারান্দায় পৌঁছে গেছে।
ধাম!ধাম!
বিকট এক আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠল যেন সমস্ত ধরিত্রী।বুঝতেও পারলোনা রোযা কি ঘটছে,কানে তালা লেগে গিয়েছে তার।সে শুধু চারুলতাকে ছিটকে এসে মাটিতে আ*ছড়ে পড়তে দেখলো,তারপর সামনে শুধুমাত্র দা*উদাউ প্রজ্জ্বলিত আ*গুন!নিজের ইন্দ্রিয়ের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে রোযা ছুটলো, চারুলতাকে আঁকড়ে ধরে টেনে হিঁচড়ে পিছিয়ে আনলো উত্তাপ থেকে। সম্পূর্ণ চেহারা মেয়েটির কালিমায় ছেয়ে গিয়েছে,দৃষ্টি তার প্রসারিত,অবাক তাকিয়ে আছে সম্মুখে।
গোডাউন উধাও তাদের দৃষ্টিসম্মুখ হতে।বর্তমানে শুধু আগু*নের লেলিহান শিখা।আর কিছুই দৃষ্টিগোচর নয়।ওই প্রচণ্ড বিস্ফো*রণে অভ্যন্তরে থাকা কারোর বেঁচে থাকা অসম্ভব!
– নিহাদ…..!
বিড়বিড় করলো রোযা,অজান্তেই তার নয়ন বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়াতে আরম্ভ করলো।তার আলিঙ্গনে স্তব্ধ হয়ে থাকা চারুলতা হঠাৎ ঝটকা দিয়ে উঠলো।
– না!
ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো,তারপর রোযাকে ঠেলে সরিয়ে তপ্ত নরকের দুয়ারের উদ্দেশ্যে ছুট দিলো।উদ্ভ্রান্ত,দিশেহারা এক অস্তিত্ব যেন।সামনে তার আ*গুন নেই যেন,হিমশীতল বরফখন্ড।আবেগ প্রকাশের সময়টুকুও পাওয়া গেলনা।রোযা দ্রুত জাপটে ধরলো চারুলতাকে,ধস্তাধস্তি আরম্ভ হলো উভয় রমণীর।
– আমাকে ছেড়ে দাও রোযা!
– পাগল হয়ে গিয়েছ?ওটা আ*গুন চারুলতা!
রমণীর সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠা দায়,তবুও ক্ষান্ত দিলোনা রোযা।হাবিব ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে।গাড়ি থেকে বেরিয়েই সে ছুটলো দৃশ্যপটে।রোযা এবং হাবিব উভয়ের জোর প্রচেষ্টায় টেনে হিঁচড়ে চারুলতাকে সরিয়ে নিয়ে আসা হলো নিরাপদ দূরত্বে।কালো ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ তখন প্রাঙ্গণ, নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণও দায়।সকলের বাকরুদ্ধ দৃষ্টি আবদ্ধ ওই ধ্বংসস্তুপের দাবানলের মাঝে,যার অন্তরালে পু*ড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে এক নিকট অস্তিত্ব।
চেয়ারে আবদ্ধ অবস্থায় আধ জাগরণ এবং আধ আবছায়ার জগতে বিচরণ করছেন বিলাল।তার সকল চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে।সংযুক্ত টাইমড ব*ম্বে*র কাটা আটাশ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ডে গিয়ে ঠেকেছে।তার মাঝে খুব বেশি পরোয়া অবশ্য নেই।জীবনের অন্তিম মুহূর্তে ভালোবাসার মুখটিই তার দুই নয়নের বারংবার ভেসে উঠছে।আয়েশা,প্রথম কোলে নেয়া সেই নবজাতক,চারুলতা চিত্রলেখার বেড়ে ওঠা, আরো একবার আসমানকে সন্তান হিসাবে লাভ করা…..জীবনে তার কতকিছু ঘটে গিয়েছে।আজ অন্তিম লগ্নে তার খুব বেশি আফসোস নেই।শুধু একটি বাদে।আয়েশা তার নিকট অধরাই রয়ে গেলো, সত্যিই এক শখের রমণীকে ভালোবেসে তিনি সারাটা জীবন অতিবাহিত করে ফেললেন।
ঠিক যে মুহূর্তে চোখ বুজে আসছিলো তার আবেশে, তখনি বাহির থেকে বেশকিছু গোলমালের আওয়াজ ভেসে এলো।চকিতে সতর্ক হলেন বিলাল,তাকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে আপাতত কেউই নেই।বাইরে কি হচ্ছে? তীক্ষ্ণ নজর বোলালেন,ঘড়ির ডায়াল জানাচ্ছে ঊনত্রিশতম মিনিটে পৌঁছেছে সময়।
অতর্কিতে খুলে গেলো দরজা,হতভম্ব বিলাল প্রথমে ভাবলেন তার ভ্রম বুঝি।কিন্তু না, ভ্রম নয়,সত্যি। দরজার ওপাশে দন্ডায়মান অমানিশা,সম্পূর্ণ অবয়ব তার র*ক্তে লেপ্টানো।যেন র*ক্তস্রোতে গোসল সেরে এসেছে।বাম হাত থেকে মেঝে পর্যন্ত ঝুলন্ত নানচাক্সে খ*ন্ড খ*ন্ড মানবদে*হের অং*শ লে*গে রয়ে*ছে। অপর হাতে একটি রিভ*লভার,যার প্রান্তে গ*লি*ত ম*গ*জ লেপ্টে রয়েছে,এতটাই সন্নিকট থেকে বু*লে*ট ঠু*কে*ছে নির্দয়ভাবে। আরো একবার স্বয়ং কি*লিং মেশিনের মুখোমুখি পিতা!এ যেন তার শিশুসুলভ, কোলে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে প্রশান্তির খোঁজ করা আসমান নয়।বরং পরাশক্তিরাজ জান্তব।
এগোলো আসমান বিলাল রেমানের দিকে, অপ্রতিরোধ্য হিং*স্র পশুর ন্যায়।প্রকম্পিত হলেন বিলাল,
– বেইবি…তুমি…
সুযোগ দিলোনা আসমান।অতর্কিতে হাত এগোলো।তার কৃষ্ণগহ্বরে এতটাই গভীরতা যে তাতে তলিয়ে নিজের সমস্ত আত্মশক্তি হরণ হয়।বিলাল শিহরিত হলেন ক্ষণিকের জন্য,এতটাই প্রভাব অমানিশার রূপের।আসমান এক টানে বম্বটি খু*লে নি*লো, বন্ধ করার কোনো প্রয়াশ না চালিয়ে ঊনত্রিশ মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ডে থাকা ডিভাইসটি পাশের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললো বাহিরে।কয়েক সেকেন্ড পিনপতন নীরবতা।তারপরই প্রকম্পনে কেঁপে উঠল সমস্ত স্থান, বিলাল ধাক্কা সহ্য করতে অক্ষম।মাথা নুইয়ে নিলেন, আসমান এগিয়ে দুবাহুর শক্ত আলিঙ্গনে তাকে বি*স্ফো*র*ণের সমস্ত প্রভাব থেকে আড়াল করে নিলো।
আবারো নীরবতা,সঙ্গে ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মাথা তুললেন বিলাল।
– আসমান তুমি এখানে কেনো?নিহাদ…
বলতে দিলোনা আসমান। বুট থেকে চা*কু বের করে নাইলনের দড়ি কা*টলো,মুক্ত করলো বিলালকে।অন্তিম বাঁধন সরে যাওয়া পর্যন্ত যেন অতি কষ্টে নিবারণ করলো নিজেকে।অতঃপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বিলালের বুকে।একটিও শব্দ উচ্চারণ করলোনা, কাদলোওনা।শুধুমাত্র নির্বিকার আলিঙ্গন করে থাকলো। বিলালও তাকে সম্পূর্ণ নিজের ছায়াতলে আড়াল করে নিলেন।সন্তানের মানসিক অবস্থা বুঝতে তাকে একটুও বেগ পোহাতে হচ্ছেনা।
আসমান তাকে নির্বাচন করেছে!
উপলব্ধিটি এক মিশ্রিত অনুভূতির জাগরণ ঘটালো পিতৃহৃদয়ে।নয়নে অশ্রু ভর করলো,বিলাল ভগ্ন কন্ঠে বিড়বিড় করলেন,
– এটা কেনো করলে?আমি কেনো?
প্রত্যাশা না করলেও জবাব এলো,অত্যন্ত ক্ষীণভাবে।
– আমার নামটিও যে অস্তিত্বের প্রদান তাকে অবহেলা করার ক্ষমতা আমার কোনোদিন না হোক….বাবা!
আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলেন বিলাল আসমানকে, অনুভবকৃত অনুভূতির আস্ফালন ব্যাখ্যা করা দায়।আসমান তার কাঁধে মাথা গুঁজে রইলো, নীরবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই পুনরায় আসমানের পোর্শে সড়কে নামলো।এবার উদ্দেশ্য ভিন্ন।সময় ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে,তবুও এক ক্ষীণ আশার তাড়া।কিন্তু নিরাশ করলো ভাগ্য।সকল আশা ভরসা চুরমার হয়ে ভেঙে গেলো এক প্রজ্জ্বলিত গোডাউন লক্ষ্য করে।কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারিপাশ। দূর থেকে ভেসে আসছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সাইরেনের শব্দ।হয় কেউ খবর দিয়েছে।তবুও প্রাণপণে সন্নিকটে পৌঁছলো আসমান।নিজের র*ক্তস্নাত অবয়বের পরোয়া করলোনা, আরও একবার ধ্বং*সযজ্ঞ রচনায় হাত কাপবে না তার।
বাহিরে পা রাখতেই দৃশ্যটি নজরে পড়ল।রোযা, চারুলতা এবং হাবিব।তাদের সঙ্গে টিমের আরও তিনজন ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে।তবে সকলের মলিন চেহারা লক্ষ্য করে কিছুই অনুধাবনে বাকি রইলোনা আসমানের।এক পা নড়লোনা,নিস্তব্ধ চেয়ে থাকল দাউদাউ অ*গ্নির পানে।বিলাল এগোলেন,তার বুকে ছুটে এলো চারুলতা।সন্তানকে পুনরায় শান্তনা প্রদানে ব্যাস্ত হলেন তিনি।অপরদিকে রোযা ফিরে তাকালো,
– আসমান?
শুনতে পেলেও কোনো জবাব এলোনা অমানিশার তরফ থেকে। দৌঁড়ে এলো রোযা,আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো আসমানকে।অতঃপর শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো।তাকে বিস্মিত করে দিয়ে পাল্টা কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া আসমান করলোনা,ওই একই ভঙ্গিতে দন্ডায়মান।নড়চড় নেই সামান্যতম।এক বিভীষিকাময় পাথরের ভাস্কর্য যেন।রোযা মুখ তুললো, সিক্ত দৃষ্টিতে আসমানের র*ক্তা*ক্ত কপোল ছুঁয়ে দিলো।বিড়বিড় করলো,
– আসমান প্লীজ….
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে শুধুমাত্র অগ্নিশিখার প্রতিফলন।এই নির্বিকারতা,এই শীতলতা অত্যন্ত পরিচিত রোযার। আতকে উঠলো সে,এই আসমান…আবারো এই আসমান…!কি*লিং মেশিন!
র*ক্ত চাই তার!তাজা র*ক্ত!শুধু ধ্বং*স জানে সে, অনুভূতি তার সম্মুখে উপেক্ষণীয় নুড়িপাথর। র*ক্তপিপাসা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।বিভীষিকা তার অ*স্ত্র, হিং*স্রতা তার অলংকার।এ সেই পুরাতন আসমান, দ্যা কি*লিং মেশিন!
আজ আরো একবার আপন মানুষের হারানোর যন্ত্রণায় সে সম্পুর্ণ যান্ত্রিক অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে।
হিমশীতল হিমালয় সে,তাকে টলানো অসম্ভব।
রোযার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো মেঘতীরে ফেরার পরই। গোধূলী পেরিয়ে যখন রাত্রির আঁধার চারিপাশ গ্রাস করেছে,তখন সকলের অগোচরে একলা নিজের কক্ষে আবদ্ধ থাকা আসমান পায়ে পায়ে নেমে আসে নিচে।তার অবয়ব থেকে নিঃশব্দে বসে থাকা সম্পূর্ণ রেমান পরিবার স্তম্ভিত।
বুলে*টপ্রুফ ভেস্টের উপর কালো পোশাক, উভয় হাতে দুইটি রিভ*লভার।পকেটে গুঁজে নেয়া নানচাক্স।যথারীতি হিমশীতল নির্বিকার দৃষ্টি,মাস্কের অন্তরালে লোকায়িত অনুভূতির অভিব্যক্তি। পায়ে পায়ে নেমে এলো সে,কারো প্রতি কোনোপ্রকার দৃষ্টিপাত না করে হনহন করে এগোলো বাইরের উদ্দেশ্যে।বিলাল সিঁড়ির নিকট থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
ডার্কসাইড পর্ব ৫২
– কোথায় যাচ্ছো?
কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকালেও ফিরে দেখলোনা আসমান।পুনরায় এগোতে এগোতে তার বজ্রকন্ঠ ঘোষণা করলো,
– আলফাকে খতম করতে!
সমস্ত ধরিত্রী যেন এক লহমায় গুঁড়িয়ে গেলো।রোযা দূর থেকেই ছুটে যেতে চাইলো,শেষমেষ হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিলো।আসমান দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে, আজ সে হয় আলফাকে ধ্বংস করবে,নয় নিজে ধ্বংস হবে।
জগতের কোনো শক্তিই নেই যা বর্তমানে এই পরাশক্তিধর অমানিশাকে আটকাতে সক্ষম!
