ডার্কসাইড পর্ব ৫৪

ডার্কসাইড পর্ব ৫৪
জাবিন ফোরকান

মেঘতীর,কিছুক্ষণ আগে:
শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকাংশে।কিঞ্চিৎ কাপছে থেকে থেকে।কাশির কারণে কন্ঠতালু শুষ্ক হয়ে রয়েছে।দুইটি টিস্যু বক্স খতম হয়েছে, আরো একখানি ধরেছে আসমান।খুব একটা অসুস্থ হয়না সে, কিন্তু এই জ্বর ঠান্ডা তাকে কিছুটা কাহিলই করে দিয়েছে।বিছানায় হেলান দিয়ে টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে মুছতে আবার কয়েকবার খুকখুক করে কাশি হলো।

– গরম গরম চিকেন স্যুপ হাজির।
কক্ষে প্রবেশ করলো কিশোর নিহাদ,হাতে একটি বড়সড় ট্রে।আসমান ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকালো। ট্র্যাকস্যুট পরিধানে নিহাদের,মাত্রই কলেজের বাস্কেটবল টিমের প্র্যাকটিস থেকে ফিরেছে বোঝা সম্ভব।
– বারণ করেছি।সামনে পরীক্ষা,ভাইরাস ছোঁয়াচে হলে কি করবে?
নিহাদ আসমানের শুষ্ক কণ্ঠের বকুনির পরোয়াও করলোনা,এগিয়ে এসে ট্রে বেডসাইড টেবিলে রাখলো। পরবর্তীতে কপালে হাত ছোঁয়ালো,তাপমাত্রা মেপে নিয়ে কিশোর মুখাবয়বে বিজ্ঞের ভঙ্গি নিয়ে বললো,
– হুম,ঠিক আছে মনে হচ্ছে।ব্যাপার না,কিছুটা জলপট্টি দিলে হবে।তবে তারও আগে প্রয়োজন খাবার এবং ঔষুধ।
– হাচ্ছো!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাঁচি দিয়ে দ্রুত নাকে টিস্যু চাপলো আসমান,কথা বলা সম্ভবপর হলোনা।নিহাদ স্যুপের বাটি নিয়ে সামনে বসলো,কলেজ থেকে ফেরার পথে ইনস্ট্যান্ট প্যাকেট কিনে এনেছে,জানে জ্বরের মুখে সবটাই বিস্বাদ লাগবে। আসমানকে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলো নিহাদ, প্রথমটায় হম্বিতম্বি করলেও পরে বাধ্য শিশুটি হয়ে আনুগত্য করে গেলো।ঔষুধ সেবনের পর আসমানকে শুইয়ে দিয়ে কপালে জলপট্টির নরম সিক্ত কাপড় চেপে দিতে দিতে নিহাদ বিড়বিড় করলো,
– জলদি সুস্থ হয়ে যাও আসমান ভাই,আমার পরশুর বাস্কেটবল ম্যাচে তোমাকে আসতে হবে কিন্তু।
মৃদু হাসার চেষ্টা করলো আসমান,সিলিংয়ের দিকে তাকালো,বিড়বিড় করলো,
– এতটা ভালোবাসো আমায়,নিহাদ?

অতর্কিতে কি হলো নিহাদ বলতেও পারবেনা, কৈশোরের আবেগ অধিক।সবকিছুর পরোয়া ত্যাগ করে আসমানের বক্ষে নিজেকে বিলীন করলো সে, অমানিশা উষ্ণ আলিঙ্গনের মায়ায় স্নেহ বুলিয়ে দিলো তার পিঠে।
– খুব ভালোবাসি। তুমি আমার সবকিছু আসমান ভাই, কখনো ছেড়ে যেওনা।কেমন?
“ আজ আমি নিজেই তোমাকে ছেড়ে দিলাম নিহাদ, পরিত্যাগ করলাম,বর্জন করলাম,ধ্বংস করলাম।আমাকে ভালোবাসার পরিণাম শুধুমাত্র বিনাশ, তোমার মাধ্যমে আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিলো আমার অভিশপ্ত ভাগ্য”—

ধড়ফড় করে উঠে বসলো আসমান বিছানায়।নিজেকে দুঃস্বপ্নের জগৎ পেরিয়ে নিদারুণ বাস্তবে আবিষ্কার করে তার ঠিক কেমন অনুভূত হলো বোঝা দায়,আদও হচ্ছে কি অনুভূতি? হয়তো না।নিজেকে অনুভূতিশূন্য নিরেট পাথরের ভাস্কর্য কিংবা যান্ত্রিক মেশিন বই ভিন্ন কিছু মনে হচ্ছেনা আসমানের।শীতল আবহাওয়ার মাঝেও দুহাতের দিকে তাকালো, তালুজুড়ে অস্বস্তির ঘামের ফোঁটা স্পষ্ট, শূণ্য বক্ষ,বরফ অন্তর।হৃদয় তাকে কিছুতেই প্রশান্তি দিচ্ছেনা। দৃষ্টিমুখে ভাসছে সেই অগ্নিশিখার দৃশ্য।যার অন্তরালে ধুলিস্যাৎ হয়েছে আরো এক নিকট অস্তিত্ব,আসমানের তরে।
চিত্রলেখা,মেঘ এবং সবশেষে নিহাদ….কি দোষ ছিল তাদের?শুধুমাত্র আসমানের জীবনের কাছের মানুষ বলে ভাগ্য তাদের নিয়ে এভাবে খেললো।

তবে কি আসমান সত্যিই অভিশপ্ত?যেই তার তরে নিজেকে বিলিয়েছে,সেই সর্বস্ব হারিয়ে বিদায় নিয়েছে এই ধরিত্রী থেকে। আর কতটুকু অক্ষম হওয়া সম্ভব?নিজের ছোট ভাইটাকে রক্ষা করতে পারলোনা সে, এতটাই অধম এক বড়ো ভাই সে!উহু,রক্ষা করতে পারেনি তা নয়।সে নিজেই তো নিহাদকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।যদি ছেলেটির সঙ্গে কোনোদিন তার সাক্ষাৎ না হতো,হয়ত আজও বা কোনো না কোনো রূপে সে বেঁচে থাকত এই পৃথিবীতে আপন প্রয়াশে।হস্তক্ষেপ করেছে আসমান তার জীবনে, নিজের অভিশাপের জগতে টেনে এনেছে,জড়িয়েছে কলংকে,ব্যবহার করেছে আপন স্বার্থে বারংবার।অতঃপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।আর কোনো প্রয়োজন নেই,যেন ভাঙারীর দোকানের অযত্নে লুণ্ঠিত কোনো বস্তু নিহাদ, যার জীবন মূল্যহীন।তাইতো এত সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়েছিল।

আসমান এবং বাদশাহ কায়সারের মাঝে কি আজ কোনো পার্থক্য রইলো?ঠিক যেমন বাদশাহ আসমানকে নিজের স্বার্থে আজীবন ব্যবহার করে শেষমেষ পরিত্যক্ত জড়বস্তুর ন্যায় ছুঁড়ে ফেলেছেন, ঠিক তেমনটাই আসমান নিহাদকে পরিত্যাগ করেছে।উপলব্ধি অমানিশার সর্বাঙ্গ কম্পিত করলো জোর আবেগে।মুষ্টিবদ্ধ হয়ে পড়লো তার উভয় হাত।অন্তরাত্মা চেঁচিয়ে উঠলো,
“ তুই আসলেই বাদশাহ কায়সারের সন্তান বেঈমান আসমান!”
জীবনে সবথেকে ঘৃণিত ব্যক্তির পরিণতি বরণ করা, এর তুলনায় যন্ত্রণাদায়ক কোনো উপলব্ধি আর হতে পারেনা।তবে যন্ত্রণাটুকু যেন অনুভব করলোনা আসমান।করবে কিভাবে?তার অনুভূতি যে হারিয়েছে ওই অ*গ্নিকুন্ডের গহ্বরে!
অতর্কিতে ফোন ভাইব্রেশন করতেই আনমনে তা তুললো আসমান,একটি মেসেজ।

“ গোল্ডেন রোজ হোটেল—বারিধারা ২
প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইট,১২২০,চব্বিশ তলা
এন্টায়ার ফ্লোর বুকড। ”
অতঃপর এক মুহুর্ত মাত্র প্রয়োজন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে।
বিছানা ছাড়লো আসমান। হিটটিমের গ্রুপে মেসেজ করলো,
“ গেট রেডি ”

এটুকুই।কেন কি,কোনো প্রকার ব্যাখ্যা প্রদান করলোনা।বাথরুমে ঢুকে দশ মিনিটের মাঝে এক শীতল শাওয়ার নিলো,বাইরে বেরিয়েই বুলে*টপ্রুফ ভেস্ট এবং ব্যাগি ক্লথস গায়ে জড়ালো।দুহাতে ফিঙ্গারলেস গ্লাভস,প্রান্তে ধা*রালো নাকেলস। কেডসজোড়া পায়ে শক্তভাবে বাঁধলো,ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে নিলো হিডেন ব্লে*ড।মাস্ক পরিধানে ভুল করলোনা,নেক টু ফেস মাস্কে নয়ন বাদে সম্পূর্ণ চেহারা আড়াল করে মাথায় সানক্যাপ তুললো।তারপর একনজর আয়নায় চাইলো,সম্পূর্ণ প্রস্তুত সে। ক্লোজেটের ড্রয়ার খুলে দুটো রিভ*লভার,সাইলেন্সার, এফ এক্স এবং ডজনখানেক ম্যাগাজিন ব্যাগে নিয়ে বেল্টের মাধ্যমে বুকে জড়ালো।

দ্রুত কাজগুলো করতে করতে নজর পড়লো নিজের বাম হাতের কব্জিতে আবদ্ধ ব্রেসলেটখানির দিকে, অর্ধচন্দ্র ধাতব সংস্পর্শে আসলেই টুংটাং আওয়াজ করছে।অসুবিধা হবে কার্যক্রমে,খুলে রাখা উচিত।কিন্তু আসমান খুললোনা, বরং শক্তভাবে তা টেনে আবদ্ধ করলো নিজের কব্জিতে,যেন এই ছোট্ট ক্ষমতাহীন জড়বস্তুটিই তার সকল শক্তির উৎস।অতঃপর একটি দীর্ঘ প্রশ্বাস।কক্ষ ত্যাগ করলো, পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো আসমান দ্যা কি*লিং মেশিন।ভাই হ*ত্যা*র তীব্র আক্রোশ এবং প্রতিশোধের র*ক্তপিপাসা খচিত তার নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বরে।

বাইরের ডাইন ইন টেবিলে চুপটি করে বসেছিল চারুলতা।তার পাশেই রোযা।বিলাল সিঁড়ির গোড়ায় হেলান দিয়ে অদূরে দৃষ্টি ফেলেছিলেন,তার কপাল জুড়ে ব্যান্ডেজ,কব্জি এবং পায়েও কিছুটা ক্ষ*ত রয়েছে।সকলেই স্তব্ধ,কেউই যেন বিশ্বাস করতে অক্ষম যে নিহাদ সত্যিই আর জীবিত নেই।এই বুঝি অতর্কিতে দৌড়ে আসে সদর দরজা দিয়ে,এমন আকাঙ্ক্ষায় ক্ষণে ক্ষণে বাইরের পানে তাকাচ্ছে তারা।একমাত্র চারু ব্যাতিত,ওই একইভাবে বসে আছে মেয়েটি।দীঘল কালো কেশ তার অতি অযত্নে ভগ্ন অবয়বের চারিপাশে ছড়িয়ে রয়েছে।কেমন অনুভূতি হচ্ছে অন্তরে?বোধগম্য নয়।নিহাদ আর আসবেনা,সত্যিই সে চলে গিয়েছে ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে।

চারুলতাকে আর কেউ কখনো পেত্নী বলে জ্বালাতন করবেনা, কথায় কথায় চুল ধরে টানবেনা, ঝগড়াও করবেনা,বন্ধুদের সামনে আপু ডেকে বেকায়দায় ফেলবেনা,অপমান করবেনা।চির শত্রু বিদায় হয়েছে চারুলতার,তার খুশি হওয়া উচিত।কিন্তু পারছেনা!কিছুতেই উৎফুল্ল হতে পারছেনা চারু,অন্তর তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।একমাত্র কাছের মানুষ, আপন বোন চিত্রলেখা।তাকে হারানোর কষ্ট আজও দগদগে ঘা এর মতন তাজা চারুর হৃদয়ে,সেখানে ভিন্ন একটি ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে।যাকেই সে নিজের নিকট জগতে স্থান দিয়েছে,তারাই তাকে দূরে ঠেলে আজীবনের জন্য চলে গিয়েছে।নিহাদ….আদতে কি ছিল চারুলতার জন্য?ঝগড়ার সঙ্গী?আদও কি এটুকুই ছিল ছেলেটি?তবে কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে?কেনো মনে হচ্ছে জীবনে এগিয়ে চলার মতন, আঁকড়ে ধরার মতন, বেঁচে থাকার মতন আর কোনো কারণ অবশিষ্ট নেই?

ভারী পদক্ষেপের শব্দে থমকালো চারুলতার চিন্তা।আসমানকে নেমে আসতে দেখা গেলো, তা সকলেরই ঘোর দূরীভূত করলো যেন।কাউকে কোনোপ্রকার জবাবদিহি করলোনা আসমান,দৃপ্ত পদক্ষেপে এগোলো সোজা সদর দরজার দিকে।একমাত্র বিলাল তাকে রুখবার প্রয়াশ করলেন,
– কোথায় যাচ্ছো?
সামান্য দ্বিধা লক্ষ্য করা গেলো,তবুও পিছন ফিরলোনা অমানিশা।জবাব ভেসে এলো বজ্রকণ্ঠের।
– আলফাকে খতম করতে।

চেয়ারে বসে থাকা রোযা সশব্দে চেয়ার টেনে উঠে দাঁড়ালো,তীব্র ইচ্ছা হলো তার চেঁচিয়ে আসমানকে ডাকার।রুখে দেয়ার তার এই যাত্রাকে।আসমানের এই মুহূর্তে আলফার নিকট যাওয়ার অর্থ আ*ত্মাহু*তি দেয়া, ওই ক্ষুরধার মাফিয়া নিশ্চয়ই এমন কিছু সূক্ষ্ম পরিকল্পনার আদলে বুনেছেন।আসমান নিজেও তা উপলব্ধি করতে সক্ষম,তবুও? একটুও চিন্তা হচ্ছেনা?যদি তার কিছু হয়ে যায় তবে…..

থমকে গেলো রোযা।স্বার্থপরের মতন চিন্তা করছে কেনো?নিহাদ চলে গিয়েছে,তার ভাইয়ের মতন ছেলেটা,না চাইতেও জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা ছেলেটা সকলের মায়া ত্যাগ করে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে অমানিশার তরে।তার প্রতিশোধ আদায়ে আসমানের এই যু*দ্ধযাত্রা কি অমূলক?তাকে আটকানো কি উচিৎ হবে?অন্তর মানতে নারাজ, হারাতে চায়না নিজের স্বামীকে।কিন্তু নিহাদ একবারও ভাবেনি নিজের জীবনের কথা,তবে আজ আসমান কেনো রুখবে তার প্রেয়সীর তরে?অন্যায় নয় কি তা?
রোযা পায়ে পায়ে এগোলো,আসমান সদর দরজার নিকটে পৌঁছে গিয়েছে,কেউই তাকে কোনোপ্রকার বাঁধা দিচ্ছেনা।যেন জানে,এই ঘূর্ণিবায়ুকে রোখা অসম্ভব।অন্তিম মুহূর্তে রোযার দৃপ্ত কন্ঠস্বর ধ্বনিত হলো হলরুমজুড়ে।
– বিজয়ী হয়ে ফিরে এসো,আমার চাঁদ।

চৌকাঠের বাইরে রাখতে যাওয়া পদক্ষেপ আসমানের থমকে পড়লো।স্থির হয়ে পড়ল সম্পূর্ণ,পরক্ষণেই সটান ঘুরে দাঁড়ালো।অমানিশার প্রগাঢ় দৃষ্টিপাত ঘটলো অর্ধাঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে।রোযা তাকিয়ে থাকলো, উৎসাহভরে। ক্ষীপ্র গতিতে এগোলো আসমান, পলকের ব্যবধানে রোযার কাছে পৌঁছে কোমরে হাত রেখে নিকটে টেনে নিলো।অধরযুগলের মিলন ঘটলো,প্রচণ্ড তৃষ্ণায়।ক্ষীণকয়েক মুহূর্ত,তারপর রোযার কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে সরে গেলো আসমান। একটিও বাক্য বিনিময় হলোনা,দৃষ্টিই তাদের অনুভূতি বিনিময়ে যথেষ্ট।অতঃপর উল্টো ঘুরলো আসমান, বেরিয়ে গেলো বাড়ির বাইরে,আর একবারও পিছনে দৃষ্টিপাত করলোনা।

আসমান চলে যেতেই এক নিদারুণ শূন্যতা চেপে বসলো চারিদিকে।শরীরের সমস্ত জোর হারিয়ে রোযা মেঝেতেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো।টপটপ করে ঝরতে থাকলো তার আবেগ অশ্রু। চারুলতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো বিলালের উদ্দেশ্যে,যিনি তখনো আসমানের চলে যাওয়ার পথে চেয়ে আছেন।তার নয়নজুড়ে এক অদ্ভুত তীক্ষ্মতা।কারো দিকেই তাকালেন না, তিনি সোজা নিজের কক্ষে চলে গেলেন।তার এমন নির্বিকার আচরণে চারুলতার হৃদয়ে সন্দেহের উদ্রেক ঘটলো।কারো বুঝতেই বাকি নেই আলফার দুয়ারে কড়াঘাতের অর্থ বর্তমানে মৃ*ত্যু*কে বরণের সামিল।তবুও কেনো তিনি আটকালেন না তার সন্তানকে? পায়ে পায়ে নিজের পিতার কক্ষে পৌঁছলো চারু, নিঃশব্দে।শুনতে পেলো ফোনে কারো সঙ্গে আলাপ করছেন তিনি।

– আমি তোমার চুক্তিতে রাজী।
থামলেন বিলাল,কয়েক সেকেন্ডের জন্য।অতঃপর তার নমনীয় কন্ঠ রূপ নিলো আদেশপূর্ণ কঠোর স্বরে,
– প্রোটেক্ট মাই সন্ অ্যাট এনি কস্ট….নেমেসিস!
অদূর থেকেও ফোনের ওপাশ থেকে অদ্ভুতুড়ে এক শিহরণ জাগানিয়া হাসির আওয়াজ ভেসে এলো, অতঃপর অসম্ভব ভারিক্কি এক অমিত শক্তিধর কন্ঠস্বর,
– ইউ মেইড আ ডিল উইথ দ্যা ডেভিল হিমসেল্ফ স্যার!
লাইন কেটে গেলো,অতঃপর পিনপতন নীরবতা।

কনকনে বায়ুর ঘূর্ণিপাক শৈত্যপ্রবাহের জানান দিচ্ছে বেশ।হোটেল গোল্ডেন রোজের অধিকাংশ অতিথি আজ একটি বার্ষিক পার্টিতে যোগদান করেছে।যার দরুণ মূল ভবন প্রায় ফাঁকাই বলা চলে।শুধুমাত্র কর্মচারীগণ রয়েছে।রিসিপশনিস্ট প্রতিদিনকার মতন ডেস্কটপে নতুন আগত অতিথিদের তথ্যসমূহ টুকে নিচ্ছিলো ঠিক তখনি পরপর ভোঁতা কয়েকটি শব্দ তার কর্ণগোচর হলো।প্রথমে ইয়ত্তা না দিয়ে নিজের কাজের মনোযোগ ধরে রাখলো সে।তারপরই অতর্কিতে হোটেলের প্রবেশপথের কাঁচের দরজা গুঁড়িয়ে দিয়ে উড়ে আসা বাইরের দুজন গার্ডের শরীর আ*ছ*ড়ে পড়লো দামী মার্বেলপাথরের মেঝে জুড়ে।আতঙ্কিত হয়ে তাকাতেই এক স*শ*স্ত্র বাহিনীর দেখা পাওয়া গেলো, মোট চারজন প্রবেশ করলো অভ্যন্তরে।নেতৃত্বে মানুষটির সর্বাঙ্গ আবৃত কালো পোশাকে, দৃষ্টিপাতে সামান্য সময়ও ব্যয় করলোনা সে।অতি দ্রুত লিফটের দিকে এগোলো।হাত দুখানায় উন্মুক্ত লম্বাটে নলযুক্ত রিভ*লভার স্পষ্টত দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সকলের। রিসিপশনিস্ট আতঙ্কে কাপতে কাপতে ল্যান্ডলাইনে হাত দিতেই তার হাতটি চেপে ধরলো একজন,ঝুঁকে বিড়বিড় করলো,

– ডোন্ট ট্রাই এনিথিং স্টুপিড সুইটহার্ট,বি কোয়াইট, অ্যাণ্ড ইউ উইল লিভ!
সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো সে।বাকি কর্মচারীরাও এক কোণায় সরে গিয়ে আতঙ্কে প্রকম্পিত হয়ে দৃশ্যপট দেখে গেলো।প্রত্যেকের হাতে রয়েছে অ্যাসল্ট রাই*ফেল, কারা এরা?কোনো আত*ঙ্কবাদী হা*মলা নয়তো?সকলের প্রাণশঙ্কার সীমা ছাড়িয়ে অতর্কিতে সম্পূর্ণ হোটেলের বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।গাঢ় আঁধারে তলিয়ে গেলো চারিপাশ,এ যেন স্বয়ং মৃ*ত্যু*র জগৎ!
লিফটে করে চব্বিশ তলায় পূর্বেই পৌঁছেছে আসমান।তারপরই তার নির্দেশে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।চারিপাশে নেটওয়ার্ক জ্যামার ব্যবহার করে সেলফোনের নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সে।সর্বোচ্চ এক ঘন্টা আছে তার হাতে,এর মাঝেই সম্পূর্ণ মিশন সমাপ্ত করতে হবে।সাধারণ অতিথি এবং কর্মচারীদের সুরক্ষার অন্তরালে পাঠিয়ে সে নিজে এসেছে সিংহের ডেরায়,যেখানে হয়ত অপেক্ষমান রয়েছে এক আলফা!আর অন্তরাল থেকে নয়,এবার মুখোমুখি লড়াইয়ের পালা!

আঁধারে আচ্ছন্ন করিডোর ধরে এগিয়ে যেতে আসমানকে একটুও বেগ পোহাতে হলোনা। এই অমানিশাই তার শক্তি,অন্ধকারের অভিশাপ তার নিত্যসঙ্গী, একে ভয় নয় বরং জয় করেছে সে।তাই হয়ত পরাশক্তিরাজ সে,অধিপতি অশুভের।হিং*স্র বাঘের নীরব চলন অনুসরণের ভঙ্গিতে আসমান তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে এগোতে আরম্ভ করলো।যেকোনো মুহূর্তে শত্রুপক্ষ যেকোনো স্থান থেকে…..

ভাবনা সম্পূর্ণের আগেই ঘটলো ঘটনাটি।তেড়ে এলো কেউ একজন,আসমানের সজাগ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত ক্ষীণ চলনও নির্ণয়ের সক্ষম হলো। ডান দিকে হাত বাড়িয়ে পাকড়াও করলো তার গ্রীবা, ঠেলে দিলো সিঁড়ির দিকে।একটিমাত্র জোরালো ধাক্কা,অতঃপর বুকের পেঁচা চিহ্নের প্রতিফলন ঘটিয়ে সিঁড়ি থেকে আছ*ড়ে পড়লো সে।স্পষ্টত আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হলো দেয়ালে দেয়ালে।কটমট করে ঘা*ড় ভা*ঙার শ*ব্দ,জোরালো ধাক্কায় থেঁ*তলে যা*ওয়া মাং*সপি*ন্ড!সাধারণের জন্য অতি অস্বস্তিকর এই ধ্বনি আসমানের কর্ণগুহরে ঠেকলো অমৃত সুধার মতন।পিপাসা বৃদ্ধি পেল তার, আরও চায়, আরও শুনতে চায় ওই হাহাকার!

আগমন ঘটলো আরো দুইজনের।তাদের সহজ নিস্তার দিতে নারাজ অন্তর।রিভ*লভার এড়িয়ে নানচাক্সে মনোনিবেশ করলো আসমান,সংযুক্তি শিকলের বাঁধনে একজনের কন্ঠ পেঁচিয়ে আছ*ড়ে ফেলল শক্ত মেঝেতে, মা*থাখানি চে*পে ধরলো নিজের ভারী কেডস পরিহিত পায়ে।একটামাত্র জো*রা*লো আ*ঘা*ত, করোটি গুঁড়িয়ে একেবারে পি*ষে গেলো ম*স্ত*ক মেঝের সঙ্গে। তাজা র*ক্ত এবং গ*লি*ত ম*গ*জের মিশ্রণ ছিট*কে উঠলো,কেডস ভরিয়ে তুললো তার কদর্য দাগে।

অপরজন এহেন অমানবিক দৃশ্য লক্ষ্য করে থরথর করে কাঁপতে থাকলো,অজান্তেই তার হাতের অ*স্ত্র গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে সশব্দে।আসমান মুখ তুলে চাইল।আশেপাশের স্ট্রিট লাইট হতে ভেসে আসা আভায় যে আবছায়া পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তাতে তার নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বর যেন জমিয়ে দিলো অপরপক্ষকে।শিরদাঁড়া টানটান করে আসমান এগোলো, পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে।দুহাত চেপে ধরলো তার,কন্ঠে ঠেকিয়ে অশরীরী কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– চো*ক ইওরসেল্ফ টু ডে*থ!

তার হাত দিয়েই তারই কন্ঠ সজো*রে চে*পে ধর*লো আসমান,দেয়ালে আবদ্ধ করে জারি রাখলো কার্যক্রম।নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের তাড়নায় ঝটকা খেতে থাকলো শরীর তার,অশ্রুসিক্ত হলো নয়ন।তবুও নিটল অমানিশা।মিনিট সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই শিথিল হয়ে গেলো শরীর,লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। নানচাক্সের জো*রালো ঘা*তে র*ক্তে*র ফি*ন*কি ছুটিয়ে মৃ*ত্যু নিশ্চিত করলো আসমান।সম্পূর্ণ হাত তার সিক্ত তাজা র*ক্তে,সামান্য ছিটেফোঁটা লাগা ব্রেসলেটেটি সে ঘষে ঘষে মুছলো কাপড়ে, এই কদর্য ছাপ লাগতে দিতে রাজী নয়।
দ্রুত এগোলো আসমান, বাঁধা আসলো তার সম্মুখে একের পর এক। বি*ধ্বং*সীভাবে মোকাবেলা করলো তার অমানিশা।অত্যন্ত দ্রুত পৌঁছলো প্রেসিডেন্ট স্যুইটের নিকট।আর অপেক্ষা করা দায়।এক টানে দরজা খুলতেই ঘটলো ঘটনাটি।
ধুম!

কানে তালা লেগে যাওয়ার মতন এক শব্দ।অত্যন্ত জো*রালো ধাক্কায় ছিট*কে গেলো আসমানের শরীর, দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়লো মেঝেতে কয়েক মুহুর্ত দৃষ্টিতে ধোঁয়াশা এবং কানে শুধু অদ্ভুত সঙ্গীতশৈলী শুনতে পেলো আসমান।সম্পূর্ণ শরীরে তার প্রকম্পন খেলে গেলো,অনুভব করলো কপাল বেয়ে নেমে আসা উষ্ম তরল,র*ক্ত!মস্তিষ্ক পুনরায় সচল হতেই চিন্তাশক্তির দল হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো যেন।টাচ সেনসিটিভ ব*ম্ব?এগুলো খুব বেশি শক্তিশালী নয়,তবে শারীরিক ক্ষতিসাধনে যথেষ্ট। দরজার হাতলে নিশ্চয়ই সংযুক্ত ছিলো টাচ্ সেন্স, আসমান স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই….
খুকখুক করে কেশে উঠলো আসমান।মুখে র*ক্তে*র নোনতা ধাতব স্বাদ পেলো।তরলটি তার অঙ্গের ক্ষ*তিসাধনে হয়েছে নাকি দাঁত কিংবা জিহ্বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় বোঝার সুযোগ পেলোনা আসমান।কানের এয়ারপিসে তার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর বেজে চলেছে হাবিবের,

– আসমান ভাই,আর ইউ ওকে?
কোনো জবাব দেয়ার মতন অবস্থায় আসমান নেই, শরীর টেনে তুলতে চাইলেও হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো।রেডিয়েশনের ধাক্কা শরীর সামলাতে বেগ পোহাচ্ছে।মাথা ঝাড়া দিলো কয়েকবার, হাবিবের কন্ঠস্বর এবার যান্ত্রিক গোলযোগের মতন শোনাচ্ছে। এয়ারপিস নষ্ট হয়ে গিয়েছে।বের করে ছুঁড়ে ফেললো তা আসমান।কয়েকবার জোরালোভাবে হাঁপালো। ধোঁয়াটে দৃষ্টি নিয়েই কোনোমতে হাঁটু মুড়ে বসলো, কলার থেকে হিডেন ব্লে*ড বের করে হাতে রাখলো যেকোনো প্রয়োজনে।তারপরই অনুভব করলো,তাকে চারিপাশ থেকে ইতোমধ্যে ঘিরে ফেলেছে পেঁচাবাহিনী।কমপক্ষে এগারোজন রয়েছে,আন্দাজ করলো আসমান।সুস্থ সবল অবস্থায় সামান্য কষ্ট হলেও মোকাবেলা হয়ত করতে পারতো,কিন্তু এই ভগ্ন আ*হ*ত শরীরে তা অসম্ভবপ্রায়।তবে কি হার মেনে নেবে আসমান?উহু….অমানিশার অভিধানে পরাজয় বলে কোনো শব্দ নেই। মৃ*ত্যু হলে তার লড়াই করেই হোক।

প্রতিক্রিয়া করলো আসমান সহসাই,হিডেন ব্লে*ড বসি*য়ে দিলো সবচেয়ে নিকটজনের ক*ন্ঠতালু বরাবর।ধম*নী ফুঁ*ড়ে র*ক্তগ*ঙ্গা বইলো, অপরজনের চাইতেও ক্ষীপ্র আসমান পুনর্বার ব্লে*ডটি গুঁ*জলো পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির চো*খে!এক টানে শিরা উপশিরা ছি*ন্ন ক*রে ঈগলের ন্যায় খু*ব*লে আনলো রত্নসদৃশ ম*ণি!চিৎকার করে ধরাশায়ী হলো তারা,আর্তনাদ প্রবাহমান রইলো।এটুকুই।আসমানের বেপরোয়া ক্রিয়া এড়িয়ে অধিক জনসংখ্যার ফায়দা লুটে তাকে দেয়ালে আছ*ড়ে ফেললো একজন,অপরজন জো*র আ*ঘা*ত হা*ন*লো তার মা*থা*য়।
দৃষ্টি এবার যেন সম্পূর্ণ লোপ পেলো,শুধু আবছায়া ছায়ামূর্তি নজরে আসছে আসমানের।হৃদস্পন্দন তেজস্বী হয়ে উঠেছে,শরীরে অক্সিজেন যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে ফুসফুস।এই কি তবে সমাপ্তি?নাহ!কিছুতেই না!ওই আলফাকে খতম করবার আগ পর্যন্ত আসমানের ধ্বংস হতে পারেনা!এই লহমায় নানচাক্সের প্রান্ত ছুঁয়ে দিলো আসমান,কিন্তু প্রচণ্ড কম্পনে সম্ভব হলোনা স্পর্শ।তবুও,প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি।একটিবার শুধু,প্রায় ধরে ফেলেছে,এবার শুধু জোরালো একটি টান……

নাটকের চাইতেও নাটকীয় ঘটনাটি ঘটলো তখনি।আসমানের উদ্দেশ্যে পি*স্ত*ল তা*ক করা পেঁচাবাহিনীর সদস্য অতর্কিতে পাশ ফিরে তার সঙ্গীর কপালে বু*লে*ট ঠু*কে বসলো!দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল দলটি।এ কিসের বিভেদ? আরো একজন হঠাৎ তার পাশেরজনকে গ্রী*বা ব*রাবর গু*লি ক*রলো।কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একে অপরকে খতম করতে আরম্ভ করলো তারা।আসমান শুধু হতভম্ব চেয়ে থাকল,এটা কি তার কোনো ভ্রম নাকি?
এক মিনিটের মাথায় সকলে ধরাশায়ী,শুধুমাত্র তিনজন অবশিষ্ট রয়েছে।বাকিদের তা*জা র*ক্তে*র স্রোত গড়িয়ে আসমানের কেডস সিক্ত করে তুলেছে।বিহ্বল দৃষ্টিতে দন্ডায়মান তিনজনের দিকে তাকালো অমানিশা, ঠাওর করার চেষ্টা করলো এরা শত্রু নাকি মিত্র।এর মধ্যে একজন আসমানের সন্নিকটে এগোলো,দৃষ্টি ক্রমশ স্পষ্ট হতেই তার অধরে ঝুলন্ত এক সাদা রোল দেখা গেলো,মুখ থেকে টেনে বের করতেই প্রদর্শিত হলো একটি স্ট্রবেরী ফ্লেভারের ললিপপ।মাথা কাত করে ভীষণ আগ্রহভরে আসমানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো বান্দা, তারপর সরে দাঁড়ালো।ললিপপ মুখে পুরলো পুনরায়।এমন আচরণের কূলকিনারা করে উঠতে সক্ষম হলোনা আসমান,তার পূর্বেই,

– গুড জব।
প্রতিধ্বনিত হলো এক অপরিচিত কন্ঠস্বর।সামান্য শিহরিত হলো আসমান,এতটা ভারিক্কি কন্ঠস্বর সে কখনো শ্রবণ করেছে কিনা স্মরণ করতে পারলোনা।সকলের দৃষ্টি ঘুরে গেলো করিডোরের দিকে,যেখান থেকে পদশব্দ ভেসে আসছে।সর্বপ্রথম দৃশ্যমান হলো একটি সিগারেটের প্রজ্জ্বলিত প্রান্ত,তার ধোঁয়াটে কুয়াশা।সেই ধোঁয়াশার চাদর হটিয়ে আবছায়ার মাঝে দৃশ্যমান হলো প্রভাবশালী ব্যক্তিটি,কালো শার্ট এবং ফরমাল পরিধানে।এক হাতে ব্লেজার কাঁধের উপর থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে, অধরে প্রজ্জ্বলিত সিগারেট।চেহারা তার দেবদূততুল্য,তামাটে বর্ণের ত্বকের অগোচরে দৃপ্ত নয়ন।ওই অগ্নির স্ফুলিঙ্গকেও যেন হার মানায় তা। অগ্নিশিখাখচিত দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক অশরীরী প্রভাব রয়েছে,যার দরুণ এক মুহূর্তের অধিক তাকিয়ে থাকা দুষ্কর।কিন্তু আসমান টললোনা, বরং তীক্ষ্ণ চোখে মোকাবেলা করলো অচেনা আগন্তুককে।তার দুঃসাহস যেন সন্তুষ্ট করলো ব্যক্তিকে।এগিয়ে আসতে গিয়েই অতর্কিতে হোঁচট খেলো সে,তাতে তার সৃষ্টি হওয়া অসহনীয় প্রভাব যেন এক লহমায় নিঃশেষ হয়ে গেলো।

– শিট!
অতি ঘৃণায় সামনে পরে থাকা মৃ*তদে*হ লা*থি দি*য়ে ছিটকে ফেললো সে দূরে।তারপর ঘাড় কয়েকবার এদিক সেদিক কাত করে পকেটে হাত দিলো, সিগারেটটা ধাক্কা খেয়ে পরে গেছে মেঝেতে।নতুন আরেকটি দরকার।
– এজন্যই বলি ওসব ছেড়ে ললিপপ ধরো।
বলে বসলো একপাশে দাঁড়িয়ে অতি অবহেলায় ললিপপে ব্যাস্ত ছেলেটি,বিনিময়ে শুধু তীব্র দৃষ্টি লাভ করলো সে।এদের সকলের এমন নির্ভার আচরণে আসমান খানিকক্ষণ বিহ্বল থাকলেও পরবর্তীতে সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেললো।উল্টো ঘুরে এগোলো নিজের কাজে,এটুকু অনুধাবন করেছে যে এরা হয়ত তার ক্ষতি করবেনা,যদি না আলফার কেউ হয়ে থাকে।

– আপনাকে কি বলা যায় বলুন তো?বেপরোয়া নাকি অতিবিশ্বাসী?
একটি নিঃশ্বাস ফেলে থমকালো আসমান,ফিরে তাকালো।নিজে থেকে প্রশ্ন করলোনা কোনো।তার উদ্দেশ্যে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ব্যক্তি,সকলে সরে গিয়ে তাকে এগোনোর জায়গা করে দিলো।ঠিক তখনি ওপাশ থেকে আরো এক দল পেঁচা বাহিনীকে দৌড়ে আসতে দেখা গেলো,তবে সামান্যতম পরোয়া নেই পুরুষটির।শক্তিশালী অবয়বে অতি অলস ভঙ্গিতে সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে এগিয়ে আসছে সে আসমানের উদ্দেশ্যে।পিছনের তিনজনই যথেষ্ট মোকাবেলায়,তার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। হলোও তাই,একটি ছু*রি ছুটে এলো বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে।না চেয়েই বাম হাতে সেটির হাতল বরাবর পাকড়াও করলো সে,গেঁ*থে ফেললো দেয়ালের গায়ে।সিগারেট ছোঁয়া অধরেই তীর্যক হাসলো, ঘাড় পর্যন্ত গড়ানো চুলে আঙুল চালালো।একটি ছোট্ট রাবার ব্যান্ড তার দুই আঙ্গুলে,পিছনের কেশরাশি গুছিয়ে ইঞ্চিখানেক দৈর্ঘ্যের এক ঝুটি পাকালো সে।তারপর চাইলো আসমানের দিকে।

চারিপাশ থেকে শত্রু ঘিরে ধরলো তাদের।এবার আসমান ছাড় দিতে নারাজ।পিছন থেকে দৌড়ে আসা দুইজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল,রিভ*লভার তুলে বু*লে*ট ঠু*ক*লো কয়েকটি করে।উঠলো, অপর আরেকজনকে আছ*ড়ে ফেললো দেয়ালে,কনুই দিয়ে চে*পে ধরে কোমরের বেল্টে গুঁজে রাখা সুইস না*ইফের এক টানে গ্রী*বা*য় ছে*দ ঘ*টালো।রীতিমত অভ্যন্তরের অ*ঙ্গ প্রত্য*ঙ্গ দৃশ্যমান হয়ে গেলো ত্ব*কের ছে*দ*নে!সম্পূর্ণ দলটিই ব্যাস্ত হয়ে পড়ল চারিপাশের পেঁচাবাহিনী নিধনে।
– হু আর ইউ?

কুরুক্ষেত্রের মাঝেই হাঁপাতে হাঁপাতে ভগ্ন অথচ স্থির আবেশিত এক কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো আসমান। ব্যক্তিটি তীর্যক হাসলো, বিপরীত প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পেঁচাবাহিনীর সদস্যকে এক হাতে পাকড়াও করলো, আছ*ড়ে ফেললো মেঝেতে একেবারে আসমানের পদক্ষেপের সম্মুখে।অতঃপর বু*লে*ট ঠু*কলো কপাল বরাবর,পরপর তিনটি।র*ক্ত ছিটকে তার মুখশ্রী আচ্ছাদিত করলো,বেপরোয়াভাবে হাতের উল্টোপিঠে তা মুছে নিয়ে আসমানের দিকে তাকালো সে।জবাব দিলো,

– ওরা ডাকে আজরাইলের ছোট ভাই।
তড়িৎ খেলে গেলো আসমানের শরীরে,নামটা তার কিছুটা হলেও পরিচিত।কে বি গ্রুপের হয়ে কাজ করাকালীন বেশ কয়েকবার সাইফের কাছ থেকে শুনেছিল,ভীষণ ত্যাক্ত বিরক্ত ছিল সে ওই বান্দাকে মোকাবেলায়।আসমান অবশ্য কোনোকালে তেমন আগ্রহবোধ করেনি।আঁধার জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আগমুহূর্তে এই আজরাইলের ছোটভাই ছিল এক বিরাট নাম।কি বলা যায় তাকে?এদেশীয় মাফিয়া?হয়ত।আসমান কল্পনাও করেনি আদতে কোনোদিন এই নামধারীর ব্যক্তির মুখোমুখি তাকে হতে হবে।তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে বাঁকা হাসলো ব্যক্তিটি, এতক্ষণ বাম হাতের আঙুলের মাঝে ধরে রাখা সিগারেটখানি অধরে ছোঁয়ালো,ছোট্ট একটি টান দিয়ে বিড়বিড় করলো,

– তবে আমি আদতে নেমেসিস….
মাথা কাত করলো,হাসিটি বিস্তৃত হলো তার।আসমানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো তার তীব্র অসহনীয় দৃষ্টি, যেন ভ্রুকুটি করলো,পরক্ষণেই যুক্ত করলো,
– দ্যা রিয়েল নেমেসিস!
নেমেসিসের পিছন থেকে দৌড়ে আসা লোকটিকে রিভল*ভার তা*ক করে ধরাশায়ী করে আসমান বিরভে করলো,
– কি চাই আপনার?
– চুক্তির শর্তপূরণ।
সামান্য থামলো সে, পেঁচাবাহিনীর আরেক সদস্যকে সজো*রে দেয়ালে চেপে উৎফুল্ল কন্ঠে জানালো,
– তবে এখন ভিন্ন কথাই মনে হচ্ছে।
– কি কথা?
– শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়।

বাঁকা হাসলো সে।ঠিক তখনি বাহির থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,ভীষণ জোরালো আওয়াজ।আসমান একছুটে পৌঁছলো করিডোরের জানালার নিকট।হতবিহ্বল দৃষ্টিতে দেখলো হোটেলের হেলিপ্যাড থেকে একটি হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করেছে,তার পাখার ঘূর্ণনের আওয়াজে ছেয়ে গিয়েছে রাত্রির নীরবতা।কিঞ্চিৎ অসহায়ত্ব এবং কিঞ্চিৎ ক্রোধ মিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল আসমান,কিছুক্ষণের মাঝেই অনুভব করলো নেমেসিস তার পাশে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে।দৃষ্টি তার সুদূরে বিলীন হতে থাকা হেলিকপ্টারের ছায়ার পানে।

– পাখি তবে উড়ে গেলো শেষমেষ?
– আপনার মজা লাগছে?
– খুব।এতটাই যে ইচ্ছা করছে একটি মিসাইল নিক্ষেপ করি।
আসমান জবাব দিলোনা,তার আঙুলসমূহ চেপে বসলো জানালার ফ্রেমে।নেমেসিস উল্টো ঘুরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার কাঁধ চাপড়ে দিলো,বলল,
– আলফাকে আয়ত্ব করার পথ আরো দীর্ঘ।
এবারেও নিঃশব্দ রইলো আসমান।

বেশ কিছুক্ষণ পর।
বর্তমানে হোটেল গোল্ডেন রোজের হেলিপ্যাডে অবস্থান করছে আসমানের হিটটিম এবং নেমেসিসের বাহিনী।চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জন ত্রিশেক মৃ*তদে*হ।নিচের ফ্লোরগুলোতে আরও রয়েছে নিশ্চয়ই।তবে কোনোকিছুই আর আসমানের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই।নিজেকে তার প্রচণ্ড ব্যর্থ অনুভূত হচ্ছে। আ*হ*ত শরীর নিয়েও একদম ছাদের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সে। কেশগুচ্ছ উড়ছে এলোমেলোভাবে। কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে অব্যক্ত এক প্রজ্জ্বলন।

– আআআহহহহ!!
অতর্কিতে তার দানবীয় হুংকার পর্বতের উপর থেকে প্রতিধ্বনিত হওয়া অশরীরী সুরসঙ্গীতের ন্যায় শোনালো।যন্ত্রণার তাড়নায় অন্তর কাপে তাতে।আসমানের সন্নিকটে যাওয়ার দুঃসাহস কেউই অর্জন করতে পারছেনা।এক পা অগ্রসর হলো নেমেসিস, দৃষ্টি সরু করে প্রশ্ন ছুড়লো,
– হোয়াই সো ডেসপারেট ম্যান?
– শাট আপ!
পাল্টা চেঁচিয়ে উঠলো আসমান।অতঃপর তার কাঁধ ঝুলে পড়লো।কপালে হাত ঠেকালো,পদক্ষেপে দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করলো,
– আপনি বুঝবেন না।
– আলফাকে পাকড়াও করার এতই তাড়না?
– হ্যাঁ!
– ধরতে পারলে কি করবেন?
– হ*ত্যা করবো!

যদিও আসমান সাধারণত অপরিচিত কারো সঙ্গে কথোপকথনে আগ্রহী নয়,কিন্তু এই মানুষটির সঙ্গে ঠিক তর্ক করবার ইচ্ছা হচ্ছেনা।সে কি আসমানকে সাহায্য করলো? নাকি এর পিছনে নিজের কোনো উদ্দেশ্য আছে?নেমেসিস যেন তার অন্তর পড়তে পারলো।দুবাহু বুকে চেপে বললো,
– অবশ্যই আমার উদ্দেশ্য আছে।নাথিং ইয ফ্রি, ইটস গিভ অ্যান্ড টেইক! তা ওই আলফা আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে শুনি?
– আপনাকে বলবো কেনো?
– হুম….কারণ আমরা দুজনেই নেমেসিস?
অধর উল্টে এক বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া করলো সে, তারপর নিঃশব্দে হাসলো।তবে সেই হাসিটুকুও কেমন অশুভ দেখালো।দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো আসমান,ক্ষীণ কন্ঠে জানালো,
– আমার ভাইকে কেড়ে নিয়েছে।
নেমেসিস সামান্য ভ্রু উঁচু করলো,

– টাইমড ব*ম্ব দিয়ে?
অতর্কিতে থমকে গেলো আসমানের হৃদস্পন্দন।তাকালো সে নেমেসিসের উদ্দেশ্যে, অতি আগ্রহভরে।এই প্রথমবার এই বান্দার উপস্থিতি তার সহনীয় ঠেকছে,সামান্য দ্বিধা এবং উত্তেজনা মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলো সে,
– আপনি…কিভাবে জানলেন?
নেমেসিস ঘাড়ে হাত ঘষলো,তার তীর্যক হেসে বললো,
– ওই ছেলে তাহলে আপনার ভাই?
অগ্রসর হলো আসমান পায়ে পায়ে,সহসাই নেমেসিসের কলার আঁকড়ে ধরলো। ভড়কে গেলো বান্দা,তবে আসমানকে পাল্টা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।
– আপনি কিভাবে জানলেন?সে ইট!
– কুল ডাউন কুল ডাউন!

পাশে ফিরলো সে,এই নিয়ে তৃতীয় নম্বর ললিপপে মনোযোগ দেয়া ছেলেটির দিকে ফিরে হাত বাড়িয়ে শুধালো,
– জাকি?ওই ছেলেটা কি বেঁচে আছে?
অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে তাকালো জাকি নামক যুবক, ভ্রুকুটি করে ললিপপ বের করে জানালো,
– তুমিই তো বললে হাসপাতালে ভর্তি করতে,ভুলে গেছো?
– আমি জিজ্ঞেস করেছি বেঁচে আছে কিনা।
– আছে।ডাক্তার অ*স্ত্রপচার করেছেন।শেষ আপডেট অনুযায়ী এখনো জ্ঞান ফেরেনি।

ডার্কসাইড পর্ব ৫৩

হাঁটু ভেঙে পড়ল আসমানের,ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল সে।উভয় হাতের তালু ঠেকলো তার ভূমিতে, শুষ্ক কাঠামো ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হতে থাকলো একের পর এক গড়িয়ে পড়া অশ্রুফোঁটায়।রাত্রির স্নিগ্ধ আভার প্রতিফলনে তা চিকচিক করতে থাকলো চিত্রকর্মের ন্যায়।হতবিহ্বল হয়ে ভগ্ন সত্তার উদ্দেশ্যে তাকিয়ে থাকলো সকলে।সামান্য কিছু মুহূর্ত আগেই বিনাশকারী ধ্বং*সরূপে আবির্ভূত হয়েছিল যে,বর্তমানে তাকেই দেখাচ্ছে যু*দ্ধে পরাজিত এক সৈনিকের মতন।কিন্তু আসমানের কোনো পরোয়া নেই, ভঙ্গুর হতে দিলো সে নিজেকে,একটিমাত্র সত্য তার পাথর হৃদয়ে পুনরায় অনুভূতির উষ্ম জোয়ার তুলেছে,
— নিহাদ বেঁচে আছে!

ডার্কসাইড পর্ব ৫৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here