ডার্কসাইড পর্ব ৫৫

ডার্কসাইড পর্ব ৫৫
জাবিন ফোরকান

টেবিলের এক প্রান্তে বসে আছে আসমান।ঠিক বিপরীত প্রান্তে অ্যাপ্রোন পরিহিত চিকিৎসক চশমার অন্তরাল থেকে বেশ সূক্ষ্ম নজর বুলিয়ে যাচ্ছেন সামনের রক্ষিত ফাইলে।মৃদু ঔষধি ঘ্রাণযুক্ত কক্ষটির চেয়ারের দুই প্রান্তে দুই পা ঝুলিয়ে খানিক অলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে নেমেসিস।সে এবং আসমান উভয়েই এখানে আসার পূর্বে বেশভূষা পরিবর্তন করে এসেছে।তাদের বাহিনী হোটেল গোল্ডেন রোজেই রয়েছে,যে ধ্বংসস্তূপ তারা ফেলে এসেছে তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে কিছুটা বেগই পোহাতে হবে তাদের।
দীর্ঘক্ষণ পর অবশেষে দৃষ্টি তুলে আসমানের দিকে তাকালেন চিকিৎসক।একনজর আড়চোখে নেমেসিসের পানে অস্বস্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শেষমেষ কন্ঠ পরিষ্কার করে জানালেন,

– মডারেট নার্ভ ড্যামেজ হয়েছে দুই পায়ে।দীর্ঘক্ষণ ভারী চাপ এবং বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে নার্ভের মূল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হৃদস্পন্দন ক্রমশ দ্রুততর হয়ে উঠল আসমানের, পরবর্তী বক্তব্য শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হচ্ছেনা তার।যদি চিকিৎসক জানায় নিহাদ আর কোনোদিন হাঁটতে পারবেনা তখন?ছেলেটা বেঁচে আছে সেটাই আসমানের কাছে অনেক।কিন্তু নিজের অক্ষমতা কিভাবে নেবে নিহাদ নিজে?চিকিৎসক যেন আসমানের দুশ্চিন্তা ধরতে পারলেন।খানিক আস্থার স্বরে ব্যক্ত করলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আপাতত খুব বেশি দুশ্চিন্তার কিছু নেই।আমরা নার্ভ গ্রাফটিং করেছি,অন্য স্থান থেকে নার্ভ নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সূক্ষ্ম অস্ত্রপচারের পর শারীরিক ধকলের কারণে রোগী এখনো জ্ঞানহীন রয়েছেন,তবে পূর্ণ বিশ্রামের পর ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে সেই আশা করা যায়।
দৃশ্যমানভাবে স্বস্তি ফুটলো আসমানের মাঝে,চিন্তায় শক্ত হয়ে থাকা কাধযুগল ছেড়ে আসলো।
– প্রথমত সম্পূর্ণ বেডরেস্টে থাকতে হবে।হাঁটাচলার ব্যাপারটা আমরা পরবর্তীতে পরীক্ষা করব। আপনারা চাইলে ফিজিওথেরাপি এবং রিহ্যাবিলিটেশন করতে পারেন।তবে তার আগে রোগীর শারীরিক ও মানসিক স্থিরতা জরুরী।
– ধন্যবাদ ডক্টর।

ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো আসমান।
কিছুক্ষণ পরেই চিকিৎসকের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো আসমান,অনুসরণে নেমেসিস।নিঃশব্দে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকলো অমানিশা,আশেপাশে তাকালোনা একবারও।দেয়ালে সংযুক্ত বেঞ্চের নিকট পৌঁছেই ধপ করে বসে পড়লো।দুহাতের আড়ালে গুঁজলো মুখাবয়ব।নেমেসিস দেয়ালে হেলান দিয়ে পরিধানের গাবার্ডিনের পকেটে হাত ভরলো,অতঃপর শুধালো,
– আপনার ভাইকে একবারও দেখতে যাবেন না?
জবাব দিলোনা আসমান,ওই একই ভঙ্গিতে বসে আছে সে।নেমেসিস কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে তার দিকে ঝুঁকলো।বিড়বিড় করলো,

– অনুশোচনা হচ্ছে?নাকি অপরাধবোধ?
– আপনাকে তার কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি।
তেতে উঠছিলো আসমান,কিন্তু নেমেসিসের অধরে তীর্যক হাসি লক্ষ্য করে থমকালো।একটি নিঃশ্বাস নির্গত করে বললো,
– ধন্যবাদ।
নেমেসিস কানের কাছে তর্জনী তুলে মাথা ঝোকালো, নাটকীয় ভঙ্গিতে বিড়বিড় করলো,
– হ্যাঁ?কি বললেন?শুনতে পাইনি,আরেকবার বলুন।
মুষ্টিবদ্ধ হলো আসমানের হাত,তবুও জানালো,
– আপনাকে ধন্যবাদ।আমার ভাইয়ের জীবন রক্ষার জন্য।
বিস্তৃত হাসলো নেমেসিস।দুবাহু বক্ষে চেপে আসমানের অবয়বের দিকে চাইলো,জিভ দিয়ে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে নিয়ে ব্যক্ত করলো,

– সে আমি ইচ্ছা করে রক্ষা করিনি,আপনার ভাই আমার কাজের মাঝখানে এসে পড়েছিল তাই তাকে সরানো দরকার ছিল।
– মানে?
কাধ তুলে ঠোঁট ওল্টালো নেমেসিস।
– মানে তেমন কিছুই না।কি সুন্দর ঘুম থেকে উঠে ডিম পরোটা খাচ্ছিলাম,দিলো জাকি ফোন করে মেজাজটা বিগড়ে!বলে একজন থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার মিশনের মাঝখানে ঢুকে গেছে, চেয়ারের সঙ্গে টাইমড ব*ম্ব দিয়ে বেঁধে রেখেছে।এখন ওটাকে ফেলে আসবে নাকি নিয়ে আসবে।
আসমান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো।তাতে নেমেসিসের হাসিটি বিস্তৃত হলো।
– প্রথমে ভাবলাম থাক দরকার কি?কিন্তু আমার আবার অদ্ভুত এক বাতিক আছে।শেষমেষ বললাম, ওটাকে তুলে হাসপাতালে ফেলতে। পরে যা হবে দেখা যাবে।বলা যায়না,কৃতজ্ঞতার জোরে আমার দলে যোগদানও করতে পারে।
হালকা চোখটিপ দিয়ে বক্তব্যের সমাপ্তি টানলো নেমেসিস।আসমান বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকল,তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়লো,

– আপনি আলফার আস্তানায় কি করছিলেন?কিসের মিশন ছিল?
ললাটে এলোমেলো হয়ে পড়া কেশগুচ্ছে আঙুল চালালো বান্দা,মাথা কাত করে তার অসহনীয় অগ্নিদৃষ্টি আসমানের কৃষ্ণগহ্বরে মিলিয়ে বিড়বিড় করলো,
– উহু।আমরা এতটাও নিকট লোক নই,অধিকার জন্মায়নি আমার রহস্যের দুনিয়ায় পদার্পণের।
শক্ত হয়ে এলো আসমানের দৃষ্টি।পাল্টা জিজ্ঞেস করলো,
– তবে আপনি আমায় সাহায্য করলেন কেনো?দয়া করে বলবেন না সেটাও কাকতালীয়।
নেমেসিস ঝুঁকলো,নিকটে সরলো আসমানের।উভয়ের দৃষ্টি বর্তমানে যেন সমানে সমান।যে দৃষ্টি অপরকে মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হয়,সে দৃষ্টিতেই তারা তাকিয়ে রয়েছে নির্ভীক নিটল হয়ে।উভয়ের জীবনের আপন আপন উদ্দেশ্য রয়েছে,কিন্তু একটি পর্যায়ে গিয়ে তারা সূক্ষ্ম এক অদৃশ্যমান বন্ধনে আবদ্ধ—নেমেসিস।কি এবং কেন?এই রহস্যের সমাধান হয়ত তাদের নিজের কাছেও নেই।নেমেসিস পকেট থেকে একটি লাইটার বের করলো, বিনা কারণেই বারবার সেটি জ্বালতে নিভতে থাকার প্রক্রিয়ায় মশগুল থেকে বিড়বিড় করলো,

– উত্তরটা নাহয় আপনাকে আপনার বাবাই দেবে?ঐযে….আসছেন উনি।
ভ্রু তুলে পিছনদিকে ইশারা করতেই আসমান চকিতে ঘুরে তাকালো।করিডোর বেয়ে হনহন করে এগিয়ে আসতে দেখলো বিলাল রেমানকে।অনুসরণে রোযা এবং চারুলতা।সকলেই সামনে এসে থমকালো, নেমেসিসের উদ্দেশ্যে সতর্কিত দৃষ্টি ফেললো। প্রতিক্রিয়াস্বরুপ শীষ বাজাতে বাজাতে নির্ভার ভঙ্গিতে নিজের দীর্ঘ কেশরাশি জুড়ে হাত বোলাতে থাকলো নেমেসিস।

– ৪০২ নম্বর আই সি ইউ কেবিন,তুমি যাও।আমরা আসছি।
বিলালের কন্ঠ ধ্বনিত হতেই উত্তেজিত চারুলতা দৌঁড়ে চলে গেলো সকলের সামনে থেকে।করিডোরে ভর করলো পিনপতন নীরবতা।নেমেসিস এবং বিলালের নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের মাঝে রোযা দ্রুত এগোলো,বসে থাকা আসমানের কাঁধে দুহাত চেপে তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো গভীর দৃষ্টিতে। কপাল এবং কাঁধে জড়ানো ব্যান্ডেজের দৃশ্য তার নয়ন সামান্য সিক্ত করে তুললো। অধরে অধর চেপে নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে শুধালো,
– ডাক্তার দেখিয়েছ?

উত্তরে আসমান দুবাহু বাড়িয়ে রোযাকে সন্নিকটে টেনে নিলো,কোমর জড়িয়ে উদরে মাথা ঠেকালো।রোযা তাকে আগলে নিলো নিজের মাঝে।
– আমি ঠিক আছি রোযা।
মৃদু কন্ঠে জানালো আসমান।তাদের মধুর অনুভূতি বিনিময়ের দৃশ্যপটে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বিরক্তিবোধ করছে এমন ভঙ্গিতে ছোট্ট এক নিঃশ্বাস নির্গত করলো নেমেসিস,অতঃপর বিলালের দিকে ফিরলো।
– সো….আমার যা করার কথা তার চেয়ে অধিক করেছি।
সামান্য শিহরিত হলেন বিলাল,আসমান এবং নিহাদ উভয়কে রক্ষার দিকটা ইঙ্গিত করছে নেমেসিস বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছেনা তার।এক পা অগ্রসর হয়ে বিলালের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে সে ঝুঁকলো,তার কন্ঠ অত্যন্ত গভীর এবং হু*মকিস্বরূপ শোনালো,

– ইউ বেটার কিপ ইওর ওয়ার্ড, আদারওয়াইজ….
বিলালের কানের কাছে নেমেসিসের অশুভ কন্ঠস্বর ধ্বনিত হলো,
– আপনার বংশের নাম নিশানা মিটিয়ে দিতে আমার দুইদিনও লাগবেনা।নেমেসিসের সঙ্গে চালাকির পরিণাম নিজের ধ্বংসকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো।
কিঞ্চিৎ হাসলো,অতঃপর সমাপ্তি টানলো।
– শয়তান মানুষকে তার প্ররোচনায় ফেলে,নিজে তার প্ররোচনায় পড়েনা।ইউ নো দ্যাট স্যার, ডোন্ট ইউ?
সহসাই উঠে দাঁড়ালো আসমান,হনহন করে এগিয়ে নেমেসিসের কলার ধরে এক ঝটকায় টেনে সরিয়ে আনলো বিলাল রেমানের নিকট থেকে।তার কাজে বাকিরা হতভম্ব হয়ে পড়লেও নেমেসিস স্বয়ং নির্বিকার, ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হলো,দৃষ্টিজোড়া প্রসারিত হয়ে অধরে খেললো মিটিমিটি হাসির রেখা।যেন আসমানের এমন ঔদ্ধত্যে ভীষণ বিনোদিত হয়েছে সে।

– আপনি কি আমার বাবাকে হু*ম*কি দিচ্ছেন?
অদ্ভুতভাবে সামান্য শীষ বাজিয়ে নেমেসিস উল্টোদিকের রোযার দিকে তাকালো,
– আপনার স্বামী কি জন্ম থেকেই এমন নাকি মাথায় আ*ঘা*ত পেয়ে এমন হয়েছে?
বিব্রত হলো রোযা,জবাব কি দেবে কিংবা আদও দেয়া উচিৎ কিনা বুঝতে পারছেনা।তড়িৎ খেললো আসমানের শরীরে,কলারে আরো শক্তভাবে চেপে বসলো তার আঙুলসমূহ। রোযাকে নিজের বলিষ্ঠ অবয়বের আড়ালে ছেয়ে ফেলে নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বরের শোষণ ক্ষমতা প্রয়োগ করলো নেমেসিসের উপর।
– ইউ বেটার কিপ হার অ্যাওয়ে ফ্রম দিস,অন্যথায় যা হবে তার জন্য আমি দায়ী থাকবোনা!
বজ্রকন্ঠে হু*ম*কি ঝরে পড়লো আসমানের,এক মুহূর্তের জন্য থমকালো নেমেসিসও।তারপর মাথা কাত করে নিজের কলার থেকে সযত্নে আসমানের আঙুলসমূহ ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,

– হোয়াই ডু ইউ কিপ মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং মি?
এক পা দূরে সরে দাঁড়িয়ে দুহাত আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে তুলে নেমেসিস জানালো,
– চিল ম্যান।আই হ্যাভ আই’য ওনলি ফর মাই কুইন!
– তোমার কুইন তোমাকে আজ ঘরে তুললে হয়!
পাল্টা কণ্ঠটি সকলকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভড়কে দিলো।ঘুরে তাকিয়ে করিডোরের একদম শেষ প্রান্তে আঁধারির মাঝে দেয়ালে হেলান দিয়ে ললিপপ মুখে ছেলেটিকে দেখা গেলো।প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে বাকিদের উদ্দেশ্যে।নেমেসিস সামান্য ক্রোধান্বিত হলো।

– তুমি এখানে কেনো?ওদিকে সব ক্লিয়ার?
– অল ক্লিয়ার।
আসমান যেন তাও ভরসা পেলোনা,দ্রুত নিজের ফোন বের করে হাবিবের মেসেজ চেক করলো।ছেলেটাও জাকির মতোই কথা বলেছে,সবকিছু নিয়ন্ত্রণাধীন। আঁধারির মাঝ থেকে আভায় এসে জাকি নেমেসিসের দিকে ভ্রু উঁচু করে চেয়ে বলল,
– সে বাদ দাও।নতুন ঠেলা কিভাবে সামলাবে তার চিন্তা করো।
– নতুন ঠেলা?

নেমেসিসের কন্ঠ মিইয়ে আসতেই মেঝেতে শক্ত সোলের পদশব্দ ভেসে এলো।সকলের মনোযোগ আকর্ষিত করে আবির্ভাব ঘটলো দুই অস্তিত্বের।একজন রমণী,পরিধানে চিকচিকে দ্যুতি ছড়ানো কালো কামিজ,একটি কাশ্মীরি চাদর আলগোছে ঝুলছে বাহুতে।মাঝারি দৈর্ঘ্যের কেশরাশি ছড়িয়ে রয়েছে কপাল এবং কাঁধের চারিপাশে।স্নিগ্ধ মুখশ্রী, দৃপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনে।তার সঙ্গী এক ছিমছিমে যুবক,নমনীয় কাঠামোর অধিকারী শরীর।একটি ওভারসাইজড ফুলহাতা জ্যাকেট এবং ডেনিম জিন্স পরিধানে।ব্লন্ড ধাঁচের মসৃণ কেশ কপালের চারিপাশে আচ্ছাদিত,ধবধবে সাদা মাস্কে আবৃত চেহারা।বুকের উপর হাত গুটিয়ে চেয়ে আছে নেমেসিসের উদ্দেশ্যে।
তাদের লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমানভাবে স্বভাব বদলালো নেমেসিসের,এতক্ষণ যাবৎ থাকা নির্বিকার এবং উৎফুল্ল বেপরোয়া ভঙ্গি ত্যাগ করে সে সহজাত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো।বিস্মিত কন্ঠে জানতে চাইলো,

– তুমি এখানে কি করছো?
প্রশ্নটা কার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে ততক্ষণ বোধগম্য হলোনা যতক্ষণ না সে জ্যাকেট পরিহিত ব্লন্ডির দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
– তুই ওকে এখানে এনেছিস কেনো?
কাঁধ তুলে ব্লন্ডি বিড়বিড় করলো,
– তোর হুকুম।তোর বউকে যেকোনো জায়গায় নিরাপদভাবে পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব,তাইনা?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নেমেসিস।কপালে তর্জনী ঘষে মৃদু কন্ঠে বললো,
– আজ সবাই মিলে কি আমার পিন্ডি চটকানোর শখ হয়েছে?
– আমি তোমার পিন্ডি চটকাচ্ছি?
রমণীর স্থির কন্ঠে স্পষ্টত কম্পিত হলো নেমেসিস, চেহারায় বিস্তর এক হাসি ফোটালো।

– অবশ্যই না বিবিজান।আমি তো শুধু….
– শাট আপ।
সত্যি সত্যি নেমেসিস একদম বাধ্য ছেলেটি হয়ে চুপ করে গেলো।রমণী ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আজকে কত তারিখ?
– আজ…আজকে?
ভগ্ন কন্ঠে উচ্চারণ করে মাথা চুলকাতে আরম্ভ করলো নেমেসিস,কিছুতেই স্মরণে আনতে পারছেনা।প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে নিজের স্ত্রী এবং অতঃপর সঙ্গীদের দিকে তাকাচ্ছে।কিন্তু কেউই তাকে সাহায্যের বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করছেনা।বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ নাটক উপভোগে তাদের বিনোদনের কমতি নেই, শুধুমাত্র পপকর্নের কমতি।

– আজকে সাতাশ তারিখ?
– হুম সাতাশ তারিখ।সাতাশ তারিখ কি?
– তোমার জন্মদিন?
– না।
– আমার জন্মদিন?
– উহু।
– আমাদের বিবাহবার্ষিকী?
– তোমার মুন্ডু!
– তবে কি?
বোকার মতন প্রশ্ন ছুড়লো বেচারা নেমেসিস,তাতে উৎফুল্ল হয়ে ব্লন্ডি বলে বসলো,
– অ্যান্ড ইউ আর বোল্ড আউট!
রমণী স্থির চেয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।কাচুমাচু হয়ে নেমেসিস তার চাদরের খুট চেপে ধরলো, রীতিমত শিশুসুলভ কন্ঠে আবেদন করলো,

– প্লীজ….
– আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই।
– এভাবে বলেনা বিবিজান।সব নিমকহারামদের মাঝে আমি থাকি….
তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে ব্লন্ডি এবং জাকির উদ্দেশ্যে। তারপর পুনরায় তাতে নমনীয়তা ফিরিয়ে এনে স্ত্রীকে মোকাবেলা করলো।
– তুমিও যদি এমন করো তাহলে আমি বুড়িগঙ্গায় ডু*ব দেবো।
– কিন্তু তুমি সাঁতার জানো।তার চেয়ে বরং হোটেলের টপ ফ্লোর থেকে তোমায় একটা ধা*ক্কা দেবো। রাজী আছো?
– কি নিষ্ঠুর!

মিছিমিছি কান্নার ভান করে বুক চেপে ধরলো নেমেসিস।তার এমন স্বভাব দেখে উপস্থিত বাকিরা কিঞ্চিৎ বিস্মিত না হয়ে পারলোনা।কিছুক্ষণ পূর্বেই যাকে অনুভূত হচ্ছিলো এক অটল পর্বত, দৃষ্টিজুড়ে যার খচিত অগ্ন্যুৎপাত;সেই নিজের স্ত্রীর সামনে কেমন যেন বাচ্চাটি হয়ে গিয়েছে।এই বুঝি একজন পুরুষের শখের নারীর ক্ষমতা?অজান্তেই পিছন ফিরে একনজর রোযার দিকে তাকালো আসমান, ফ্যালফ্যাল করে যে চেয়ে আছে দৃশ্যপটে।
চাদর থেকে নেমেসিসের হাত সরিয়ে নিয়ে রমণী উল্টো ঘুরতে গেলো,কিন্তু রোযার উপর দৃষ্টিপাত হওয়ায় ক্ষণিকের জন্য থামলো।

– আপনি রোযা রেমান?
সামান্য কাপলো রোযা,অতর্কিত সম্বোধন আশা করেনি।
– জ… জ্বি… আপনি কিভাবে…
– আপনাকে চেনেনা দেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
রমণীর লালচে অধরে বিস্তৃত এক মায়াবী হাসির প্রস্ফুটন ঘটলো।এগিয়ে এসে রোযার সঙ্গে করমর্দন করলো সে।
– আপনি খুব ভালো একটি কাজ করছেন।প্রার্থনা থাকবে।এগিয়ে যান।অচিরেই সফলতা ধরা দেবে।
– ধ….ধন্যবাদ।
লজ্জিত হলো রোযা।যদিও সে এই রমণীর পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞাত,তবুও কেন যেন প্রশংসা এবং শুভকামনা ভীষণ আপন ঠেকলো।পাল্টা হেসে রমণী এগোলো।তার অনুসরণ করতে গেলো নেমেসিস, ঠিক তখনি বিলাল রেমান মৃদু কন্ঠে জানালেন,

– থ্যাংক ইউ।
থমকে গিয়ে ঘুরে তাকালো নেমেসিস,ভ্রু উঁচু করে চাইতেই বিলাল রেমান আবারো বললেন,
– আমার সন্তানদের রক্ষার জন্য ধন্যবাদ।
তীর্যক হাসি ফুটলো নেমেসিসের অধরে,পাল্টা কোনো জবাব দিলোনা।মাথা হেলিয়ে একনজর আসমানের দিকে চেয়ে দুই আঙ্গুলে স্যালুট ঠুকে বিড়বিড় করলো,
– আন্টিল উই মিট অ্যাগেইন…..
চলে গেলো সে।পিছু নিলো স্ত্রীর।পরিধানের ব্লেজার খুলে রমণীর কাঁধে জড়িয়ে দিলো,তাদের অনুসরণে জাকি এবং ব্লন্ডি উভয়েই হাঁটতে আরম্ভ করলো।অদূর থেকে রমণী এবং নেমেসিসের কথোপকথন ভেসে এলো,

– সুশি খাবো।
– এই মাঝরাতে?
– হ্যাঁ।তোমার বাবুর তেমনি ইচ্ছা।
– পৃথিবীতে না আসতেই এত হম্বিতম্বি করছে।এসে গেলে কি করবে?
– তোমারই তো সন্তান,তোমার মতই হবে।
– হাহা….রাইট।হোটেলে সুশি নেই?
– না নেই।ওখানের শেফ জাপানিজ খাবার বানায়না।
– ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু বায় দ্যা হোল হোটেল প্রপার্টি?
– এত পিরিতের প্রয়োজন নেই।যে সাতাশ তারিখ কি মনে রাখতে পারেনা তার সাথে আমার আড়ি।
– উন্নাহ….প্লীজ বিবিজান!
করিডোরের শেষ প্রান্তে মিলিয়ে গেলো নেমেসিস এবং তার সঙ্গীদের প্রতিচ্ছবি।দীর্ঘক্ষণ সেই দৃশ্যপটে চেয়ে থাকলো আসমান।তারপর একটি নিঃশ্বাস ফেললো।মাথা ঝাঁকিয়ে বাস্তব চিন্তায় মনোযোগ দিলো।নেমেসিস এবং তার পথ আবারো এক হবে কি হবেনা তা সুদূর ভবিষ্যতই বলে দেবে।

দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো।মাথার উপরের ধবধবে সিলিং দৃষ্টিগোচর হলো তাতে।ঔষধি ঘ্রাণ বায়ুতে,হার্টবিট মনিটরের বিপ বিপ যান্ত্রিক ধ্বনি।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো নিহাদের বুক থেকে।যদি না নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করতো,তবে ধরেই নিতো যে সে আদতেই মৃ*ত্যুবরণ করেছে।

আবছায়াভাবে স্মরণে এলো স্মৃতিগুলো।মৃ*ত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলো সে। পনেরো মিনিটের মাথায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে।আলফার যেসব লোক আশেপাশে পায়চারি করছিলো,কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকে।কিছুক্ষণ অবলোকনের পর নিহাদ উপলব্ধি করে স্টানগা*ন ব্যবহার করা হয়েছে,বৈদ্যুতিক শ*কের মাধ্যমে শরীর অবশ করে দেয়া হয়েছে।উপলব্ধি করতে না করতেই একদল সশ*স্ত্র পোশাকধারী হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ভেতরে, একে একে আলফার সাঙ্গপাঙ্গদের অচেতন দে*হ তুলে নিয়ে যায় বাইরে।বন্দী করলো নাকি তাদের?ঠিক বুঝে উঠতে পারলোনা নিহাদ।তার সামনে এসে দাঁড়ালো দলটির নেতৃত্বে থাকা ছেলেটি,মাথা কাত করে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো।কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া করেনি নিহাদ,তাকেও হ*ত্যা করবে নিশ্চয়ই?প্রথমবার তাই করলো,পি*স্ত*ল তা*ক করলো সে নিহাদের কপাল বরাবর।পরক্ষণে কি যেন ভাবলো,অদূরে সরে কাউকে কল করলো।ফিরে এসে একটিই কথা বললো,

– ইউ আর লাকি ম্যান!
এটুকুই।অতঃপর নিহাদের আর কিছুই স্মরণে নেই।কোনোভাবে তাকে অজ্ঞান করানো হয়েছিল?হয়তবা। কারা ছিলো?কোন দলের এত বড় দুঃসাহস যে স্বয়ং আলফাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে?আপাতত সে সম্পর্কে অজ্ঞ সে।
– নিহাদ!
পরিচিত কণ্ঠটির ডাকে নিহাদ অবশেষে ভাবনার দুনিয়া থেকে বাইরে পদার্পণ করলো।মাথা তুলে তাকিয়ে নিজের উপর দুইটি মুখাবয়ব ঝুঁকে থাকতে দেখলো।একটি রোযা,অপরজন চারুলতা।নিহাদের একটি হাত নিজের মুঠোয় নিলো রোযা, বিড়বিড় করলো,
– এখন কেমন বোধ করছো নিহাদ?ডাক্তারকে ডাকবো?কোথাও খারাপ লাগছে?
এক মুহুর্ত চেয়ে থাকলো নিহাদ নিঃশব্দে,রোযার নয়নজুড়ে সিক্ত অভিব্যক্তি স্পষ্ট।সামান্য বিস্তৃত হলো নিহাদের অধর,নিজের সহজাত কন্ঠে বলে উঠলো,

– ফুলটুশী!
সম্বোধনটি কর্ণগোচর হতেই এতক্ষণ যাবৎ নিয়ন্ত্রণে রাখা অশ্রুফোঁটা রোযার কপোল বেয়ে গড়ালো।উৎফুল্ল হাসিমাখা অধরে সে বিড়বিড় করলো,
– হ্যাঁ নিহাদ বলো।
– আমি ঠিক আছি ফুলটুশী চিন্তা করোনা।তুমি চাইলে এক্ষুণি উঠে তোমাকে লে পাগলু ড্যান্স দেখাতে পারি।
– হাহা…থাক দরকার নেই,আগে সুস্থ হও সম্পূর্ণ।
– কে বলেছে দরকার নেই? এক্ষুণি দেখাচ্ছি আমি…

উঠে বসতে চাইলো নিহাদ।সমস্ত শরীরজুড়ে যেন তৎক্ষণাৎ তড়িৎ খেলে গেলো তার।পা দুখানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সে নাড়াতে পারলোনা।সঙ্গে সঙ্গে অধরের হাসি অদৃশ্যমান হলো তার,চেহারায় ভর করলো থমথমে অভিব্যক্তি।নিজেদের মাঝে শংকিত দৃষ্টি বিনিময় করেছে রোযা এবং চারুলতা, তা তার দৃষ্টি এড়ালোনা।পুনরায় বালিশে মাথা রেখে নিহাদ দীর্ঘ এক প্রশ্বাস টানলো,তারপর স্থির কন্ঠে জানতে চাইলো,
– আমার পায়ে কি হয়েছে রোযা?
সামান্য ইতস্তত করলো রোযা,চারুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় দৃষ্টি বিনিময় করে দ্রুতকন্ঠে জবাব দিলো,
– সামান্য নার্ভ ড্যামেজ নিহাদ,চিন্তা করোনা।ঠিক হয়ে যাবে।
দৃষ্টি বুজলো নিহাদ,পরবর্তীতে মেললো। নয়নজুড়ে তার কোনো প্রকার প্রফুল্লতা নেই,নিদারুণ বাস্তবতার প্রতিফলন তাতে।

– আমার পায়ে বাইক চাপা পড়েছিল।ওরা স্টেরয়েড দিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ।সামান্য নার্ভ ড্যামেজ? ফুলটুশী,এতটাও অধম ভেবোনা আমাকে প্লীজ।আমি সত্যিটা জানতে চাই।
একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো রোযা।তারপর জানালো,
– মডারেট নার্ভ ড্যামেজ।অপারেশন হয়েছে।তোমার পা ঠিকই আছে।তবে তুমি ঠিক কবে নাগাদ হাঁটতে পারবে কিংবা আদও পারবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা।
– ধন্যবাদ।
ভীষন বিস্মিত হলো রোযা,নিহাদের এত স্থির এবং অনুভূতিহীন প্রতিক্রিয়া সে আশা করেনি। চারুলতা একপাশে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি গভীরভাবে,ছেলেটার এমন নির্বিকার আচরণ তাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।

দীর্ঘ মুহূর্ত নীরবতা। সত্য আত্মপ্রকাশ করতেই কেমন যেন অস্বস্তিতে পূর্ণ হয়েছে পরিবেশ।সেই অস্বস্তি ভাঙলো রোযাই,নিহাদের কপালে হাত বুলিয়ে বললো,
– তুমি এখন বিশ্রাম নাও নিহাদ,ওইসব নিয়ে চিন্তা করোনা।আমার বিশ্বাস তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে, তুমি নিশ্চয়ই পারবে।আমরা সবাই তোমার সাথে আছি।
– আসমান ভাই কোথায়?
প্রশ্নে থমকে গেলো রোযা,তার স্পর্শও স্থিরতা ধারণ করলো।নিহাদ মাথা কাত করে রোযার মুখপানে তাকালো,আবারো জানতে চাইলো,
– আসমান ভাইকে ডাকো,আমি ওর সাথে একটু কথা বলতে চাই।
– আসমান আছে নিহাদ,আসবে।তোমার জ্ঞান ফেরার খবর জানালেই হয়ত আসবে।
– হয়ত?

নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো রোযা,নিহাদের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়।তার এমন লুকোচুরি খেলায় ছেলেটির শুষ্ক অধরে বিষাদের হাসি ফুটলো।
– আসমান ভাই একবারও আমাকে দেখতে আসেনি, তাইনা রোযা?
নৈঃশব্দ্য।
– আমি এখন বোঝা হয়ে গিয়েছি বলে কি সকলে আমাকে বর্জন করছে?
নীরবতা ছেদ করে ধ্বনিত হতেই রোযা নিহাদের হাত পুনরায় চেপে ধরলো,
– পাগল হয়ে গিয়েছ নিহাদ?কি বকবক করছো?তুমি কারো বোঝা নও,কেউ তোমাকে বর্জন করছেনা।
– তবে আসমান ভাই কেনো এলোনা?

এই প্রশ্নের জবাব রোযার নিজেরও জানা নেই।আসমান প্রথম দিনের পর সত্যিই আর একটিবারের জন্যও হাসপাতালে আসেনি।বিষয়টি গোটা রেমান পরিবারকেই বিস্মিত করেছে।তবে রোযার দৃঢ় বিশ্বাস, নিশ্চয়ই আসমানের অন্তরে কিছু চলছে।নিহাদের মুখোমুখি হতে কি সে ভয় পাচ্ছে?নাকি অপরাধবোধ? কোনটা হচ্ছে তার?মুখ ফুটে তো সেই অনুভূতিটুকুও ছেলেটা ব্যক্ত করেনা।
রোযার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো নিহাদ, তারপর স্বাভাবিক স্থির কন্ঠে বললো,

– দুঃখিত।বাদ দাও।তোমরা এখন আসতে পারো, আমি একটু একা থাকতে চাই।
– নিহাদ আমার কথা…
– প্লীজ,আমার অনুরোধ রোযা।
একটি নিঃশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠলো রোযা, এগোলো দরজার দিকে।কেবিন থেকে সে বাইরে বেরিয়ে যেতেই চারুলতা দরজা আটকে ফিরে এলো।চুপচাপ একপাশের সোফায় বসলো ঠিক যেমনটা এতক্ষণ বসেছিল।নিহাদ দৃশ্যটি লক্ষ্য করে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– আমি স্পষ্ট বলেছি যে আমি একা থাকতে চাই, শুনতে পাওনি?
– থাকো একা,আমি বিরক্ত করছিনা।

বলেই চারুলতা পাশের স্ট্যান্ড থেকে একটা মোটা মলাটের ইংরেজি বই তুলে পড়তে আরম্ভ করলো।সে প্রথম থেকে খুব বেশি আলাপ করেনি,নিহাদের জ্ঞান আসার পরেও নির্বিকার থেকেছে।কিছুটা বিস্ময় অনুভব করছে নিহাদ।তার কেবিনের সোফার দিকটায় তাকে বেশকতক বই,একটা ল্যাপটপ, আইপ্যাড এবং কম্বল রাখা আছে।যেন কেউ ব্যবহার করে জিনিসগুলো। চারুলতা?সে কি নিহাদের সাথে থাকে?প্রশ্নটি উত্থাপিত হলেও প্রকাশ করার দুঃসাহস হলোনা নিহাদের।আলগোছে সে মাথা তুলে নিজের ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকালো।কম্পিত হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো,জোর এক চিমটি কেটে দেখলো কিছু অনুভূত হয় কিনা।কিন্তু….ফলাফল শূন্য।যেন দুখানা পাথর!বুকের ভেতর সবটা কেমন তালগোল পাকিয়ে গেলো,সিক্ত অনুভূতি নয়ন বেয়ে গড়াতে থাকলো ফোঁটায় ফোঁটায়।জীবনে যা সে সর্বদা পরিহার করতে চেয়েছে আজ তাতেই পরিণত হয়েছে।অপরের বোঝা!তার দুরন্ত ছুটে চলার জীবনের কি নিদারুণ এক সমাপ্তি!খুব ইচ্ছা হচ্ছে,আসমানের বুকে মাথা গুঁজে নিজের ভেতর বহু যত্নে গুটিয়ে রাখা বিষাদগুলো কেঁদেকেটে ভাসাতে।কিন্তু তার সবচেয়ে নিকট মানুষটিও পাশে নেই।নিহাদ কি তবে অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত একাই রয়ে গেলো?এ কেমন অভিশাপ?

দৃষ্টি বুজে নিঃশব্দে নিজের অনুভূতির দোলাচলে পিষ্ট হচ্ছিল নিহাদ।তারপর হঠাৎই এক উষ্ম স্পর্শ অনুভব করলো।সামান্য চোখ মেলতেই চারুলতার বৃদ্ধাঙ্গুল তার অশ্রুর ফোঁটা সযত্নে মুছে নিলো।কিছুই উচ্চারণ করলোনা মেয়েটি,বিছানায় নিহাদের কাছেই বসলো।তার মনোযোগ যথারীতি হাতের বইয়ের দিকেই আবদ্ধ,কিন্তু হাত স্নেহ বুলিয়ে চলেছে নিহাদের কপোলজুড়ে।সেই মধুর স্পর্শ ঠেকলো তার মাথায়, কেশরাশির মাঝে আঙুল বুলিয়ে যেন বাক্যহীন প্রশান্তি বিলিয়ে গেলো সুদর্শনা।এক মুহুর্ত চেয়ে থাকল নিহাদ,অতঃপর পুনরায় দৃষ্টি বুজলো।তবে এবার দোলাচলে পতিত হলোনা।বরং এক রমণীর উষ্ণমাখা হাতের আদরের ছোঁয়া তার অন্তরকে শীতল এক প্রশান্তিতে ছেয়ে ফেললো সম্পূর্ণ।

প্রায় সপ্তাহখানেক অতিক্রান্ত হয়েছে নিহাদের জ্ঞান ফিরেছে।রোযা বর্তমানে আন্দোলন এবং হাসপাতালের মাঝেই ব্যাস্ত থাকে।আগামীকাল একটি বিরাট দিন।স্বরাষ্ট্রদপ্তর অভিমুখে যাত্রা তাদের।এর উপরে অনেক কিছুই নির্ভর করছে বর্তমানে।ইতোমধ্যে মিডিয়ার একটি অংশ এবং বিরোধী দলগুলোর অনেকেই আন্দোলনের স্বপক্ষে নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করেছে।যার দরুণ মাত্রা বেগবান হয়েছে।তবে এখনো পর্যন্ত মন্ত্রীদের কেউই পদত্যাগ করেনি, জিশান আহসানের খবর পাওয়া সম্ভব হয়নি।এবার আর হাত গুটিয়ে থাকা অসম্ভবপ্রায়।হয় এসপার নয় ওসপার।এমনি এক উত্তেজনাকর মুহূর্ত।

সন্ধ্যাবেলা সকল কার্যক্রম শেষে মেঘতীরে ফিরে এলো রোযা।দুইদিনের মাঝেই নিহাদকে এখানে নিয়ে আসা হবে,তাই একটি ঘর সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা হচ্ছে। ঘরে ঢুকতেই ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ারটি নজরে এলো তার,সঙ্গে দুজোড়া ক্রাচ।বস্তুগুলো এমনিতে প্রয়োজনীয়,কিন্তু কেন যেন এগুলো দেখেই রোযার অন্তর হুহু করে উঠলো নিহাদের জন্য।সত্যিই কি আজীবন এইসব সহায়ক যন্ত্রের ভরসায় তার জীবনটা স্থবির হয়ে যাবে? ভাবা সম্ভব হলোনা,বেদনায় মুচড়ে উঠলো অভ্যন্তর।

রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটি ফ্রক পড়লো রোযা।জিন্স আর উপরে সোয়েটশার্ট জড়িয়ে নিচে নেমে এলো পায়ে পায়ে।তার দৃষ্টি আসমানকে খুঁজে ফিরছে।গত দুইদিন যাবৎ ছেলেটি ঘরে ফিরছেনা। ফোনে অবশ্য যোগাযোগ হয়েছে,জিজ্ঞেস করলে বলে আলফার খোঁজে আছে।কিন্তু রোযা বুঝতে পারে,নিজেকে গুটিয়ে রাখছে সে।নিহাদের সঙ্গে দেখা করতে অনিচ্ছুক।যদিও ছেলেটির যেন কোনোপ্রকার অসুবিধা না হয় তাই হুইলচেয়ার থেকে আরম্ভ করে সবকিছুর ব্যবস্থা সে নিজেই করেছে।আসমানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা জরুরী।অন্যথায় এমন পরিস্থিতি দীর্ঘ হবে।ভেবে রোযা কিচেনে এলো।সামান্য একটু ফলের রস পান করতে করতে বিলালের দেখা পেলো যিনি বর্তমানে হলরুমের সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছেন।রোযা এগিয়ে গেলো।

– বাবা?
– বলো মামণি।
– আসমান কোথায়?
দৃশ্যমানভাবে থমকালেন বিলাল, নয়ন তুলে তাকালেন রোযার উদ্দেশ্যে।সামান্য হাসলেন,
– তুমি যেহেতু জানো না,আমার জানার কথা নয় নিশ্চয়ই?
– মারবেলে থাকতে আসমান এমন দিন কয়েকের জন্য গায়েব হয়ে যেতো।অথচ আপনি কোনো দুশ্চিন্তা করতেন না বাবা।ধরে নিচ্ছি আপনি জানেন,কিংবা ধারণা করতে পারেন ও কোথায় রয়েছে।
বিলালের হাসি বিস্তৃত হলো,যেন রোযার প্রতি সন্তুষ্ট তিনি।পকেটে হাত ভরলেন তিনি,একটি চাবির রিং ছুঁড়ে দিলেন।রোযা সেটি এক হাতেই পাকড়াও করলো।

– আমার ছেলেটা খুব বেশি হতাশায় থাকলে মায়ের কাছেই প্রশান্তি খুঁজতে যায়।
– ধন্যবাদ বাবা।
– ওকে কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো।মানসিক আ*ঘা*ত পেয়েছে ভীষণ।
মাথা দুলিয়ে সায় জানালো রোযা।বেশ কিছুক্ষণ বাদেই সে তৈরি হয়ে বেরোলো।হাবিব তাকে দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলো।সামনে এক একতলা বাংলোর মুখোমুখি হলো রোযা।বহু পুরাতন স্থাপনা, তবুও বহু যত্নভরে চারিপাশ পরিচ্ছন্ন এবং ছিমছাম রাখার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।ভেতরে প্রবেশের সময় ধুলোয় মলিন এক ঘুনে ধরা কাঠের বোর্ড নজরে পড়ে। যাতে খচিত,

“ তালুকদার নিবাস ”
— আসমানের মায়ের বাড়ি!
মনে মনে আওরালো রোযা।বিলালের দেয়া চাবিখানি বের করে লক খুললো,যদিও স্পষ্ট অনুভব করলো ভেতরে ইতোমধ্যে আসমান রয়েছে।একজোড়া স্যান্ডেল তার বাহিরে পাপোসে রাখা আছে।ভেতরের দৃশ্য বেশ ছিমছাম।ইন্টেরিয়র এবং আসবাব আজ থেকে বহু পুরাতন ঐতিহ্যের।তবে তার মাঝে সামান্য আধুনিকতার মিশ্রণে বোঝা গেলো যে হয়ত তা মেরামত করতে গিয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে।অন্যথায় সব আগের মতোই রয়েছে।ক্ষণিকের জন্য রোযার মনে হলো সে বুঝি আশির দশকের কোনো সিনেমার দুনিয়ায় ঢুকে গিয়েছে।টেবিলের উপর ল্যান্ডফোন,একটি বিশাল বক্সের মতন দেখতে সাদাকালো টেলিভিশন।তার পাশে রেডিও, ছড়ানো ছিটানো রয়েছে বিভিন্ন ব্যান্ডের ক্যাসেট। মাইলস, এল আর বি।রয়েছে সংগীতসাধক মান্না দের অ্যালবাম।অতি যত্নে তা আজও সজ্জিত।

খুঁজেপেতে রান্নাঘর বের করলো রোযা।একটি স্টোভ এবং গ্যাস সিলিন্ডার।সচরাচর রান্না হয়না এখানে দেখেই বোঝা সম্ভব। পাত্রের সংখ্যাও হাতেগোনা।সঙ্গে করে কিছু বাজার এনেছে রোযা, তা রাখলো প্রথমে।তারপর শোবার ঘর খোঁজার উদ্দেশ্যে নিঃশব্দে এগোলো। সরু এক বারান্দা পেরিয়ে আবছায়া টিমটিমে আলোয় হাট করে খোলা উন্মুক্ত দরজা নজরে এলো তার।এগিয়ে গেলো সন্তপর্নে। আরামকেদারায় দোলার ক্যাচক্যাচ আওয়াজ আসছে অভ্যন্তর থেকে।এক পা প্রবেশ করলো রোযা,অতঃপর সম্পূর্ণ জমে গেলো।
সিলিংয়ে ঝুলন্ত স্বর্ণালী বাতির আভায় দৃষ্টিগোচর হলো দৃশ্যপট। আরামকেদারায় দুলছে আসমান।পাশের বেডসাইড টেবিলের গ্রামোফোনরূপী ডিভাইসে বহুকাল আগের এক সঙ্গীত বেজে চলেছে।

~তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি,ভেঙে চুরে শতবার
রয়েছ তুমি বহুদূরে
আমাকে রেখে ছলনায়
এ হৃদয় ভেঙে গেলে জানো কি তা
লাগেনা লাগেনা জোড়া~

পুরাতন টেপের আওয়াজ কিঞ্চিৎ ভেঙে ভেঙে আসছে।এ যেন সত্যিই পুরাতন সেই সময়,কেমন রোমন্থনের শিহরণ খেলে গেলো অঙ্গে।তবে রোযার সমস্ত মনোযোগ বর্তমানে কেন্দ্রীভূত আসমানে।একটি কালো ট্রাউজার ছাড়া কিছু পরিধানে নেই,ঊর্ধ্বাঙ্গ তার অনাবৃত।হলদেটে আভার প্রতিফলনে তার অতিরিক্ত শুভ ত্বক দেখাচ্ছে মধুর ন্যায় নির্মল।শারীরিক গঠন এবং মাংসপেশির শক্তিশালী গাঁথুনি স্পষ্টত ফুটে উঠেছে।তার সঙ্গে বিভীষিকাও!রোযা এর পূর্বে আসমানকে সম্পূর্ণ অনাবৃত অবস্থায় দেখেনি, একবার দেখেছিল জ্বরে থাকাকালীন শরীর মুছে দেয়ার সময়।সেদিনের সঙ্গে আজকের তুলনা চলেনা কোনক্রমেই।তার অবলোকন ঠিক মাধুর্যের হলোনা।কারণ,আসমানের অতীত।
বুকজুড়ে মাংসপেশীর খাঁজে খাঁজে বিভীষিকার রেখা।

যেন যত্ন সহকারে ভাস্কর্যে খোদাই করা হয়েছে দাগ।বাম কাঁধ থেকে একেবারে উদর পর্যন্ত নেমে যাওয়া ক্ষ*ত,সামান্য গভীরতা তাতে।কোমরের দিকটায় ক্রসের মতন কা*টাচিহ্ন।শিরশির করে উঠলো রোযার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।এত যন্ত্রণা?কিভাবে সহ্য করে গিয়েছে আসমান?আর কত বীভৎসতা অবশিষ্ট রয়েছে? আরামকেদারায় দুলতে দুলতে চোখ বুজে আছে আসমান,দৃশ্যের দিকে চেয়ে রোযার উভয় হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।
রাফা কায়সার!
সুযোগ পেলে মেয়েটার কি হাল রোযা করবে তার অশুভ চিন্তাশক্তি মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠলো।

– রোযা?
ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে পদার্পণ করলো রোযা, আবিষ্কার করলো আসমান তার দিকে চেয়ে আছে।নিজেকে আবৃত করার চেষ্টা করছেনা সে,স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই দেখছে রোযাকে।কন্ঠ পরিষ্কার করে রোযা জানালো,
– তুমি একা একা এখানে কি করছো আসমান?
ভণিতা করলোনা অমানিশা।পুনরায় কেদারায় হেলান দিয়ে জানালো,
– এটা আমার প্রশান্তির নীড়।ভালোই হয়েছে তুমি এসেছ।অনেকদিন যাবৎ ইচ্ছা ছিল তোমাকে আমার শেকড়ের সঙ্গে পরিচয় করানোর।
– বাড়িটা সত্যিই সুন্দর আসমান,আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
প্রশংসায় গর্বিত হয়ে সামান্য হাসলো আসমান।মুখে তার কোনো মাস্ক নেই।এ তার জন্মদাত্রীর কোল যেন, যেখানে তার নিজেকে কোনপ্রকার রহস্যের পর্দায় আবৃত করবার প্রয়োজন নেই।

– কিছু খেয়েছ?
ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো রোযা।আসমান নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।
– ঠিক আছে।আমি রান্না করতে যাচ্ছি,খেয়ে নাও কিছুটা।
– রান্নাঘরের তৃতীয় তাকের দরজা খুলো,ভেতরে কড়াই আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আছে।
আসমানের পরামর্শ গ্রহণ করে রোযা গেলো। তাক থেকে ম্যাচবক্স এবং মশলাপাতি সংগ্রহ করলো।অতঃপর কড়াইয়ে রান্না চড়ালো।খুব বেশি আহামরি কিছু নয়। ফ্রাইড রাইস।কিছু বাগদা চিংড়ি এনেছে সে আসার সময়ে।সেগুলো মশলা মেখে লালচে করে ভেজে নিতে নিতে পদশব্দ শুনে ঘুরে তাকালো।আসমান রান্নাঘরের দরজার এসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে।বিরক্ত করেছেনা,একদৃষ্টে কাজ দেখছে রোযার।তবে সে এখনো শরীরে কিছুই জড়ায়নি।ব্যাপারটি রোযাকে বিব্রত করলো কিছুটা,লালিমা ছোঁয়া কপোলে সে দৃষ্টি এড়িয়ে কাজে মনোযোগ দিলো,অনুভব করলো হৃদস্পন্দন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে তার।

খাবারের পর্ব প্রায় নিঃশব্দেই মিটলো। ডিভিডিতে অতি পুরাতন এক বাংলা সিনেমার রসায়ন দেখতে দেখতেই সময় পেরিয়ে গেলো।দুই গ্লাস আমের জুস পরিবেশন করে রোযা আসমানের হাতে দিয়ে পাশে বসলো।ছেলেটির দৃষ্টি সাদাকালো পর্দায় আবদ্ধ।
– উম…আসমান?তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।
– হুম?
– তুমি নিহাদকে দেখতে যাচ্ছনা কেনো?
উন্মুক্ত থাকায় আসমানের মাংসপেশীর শিথীলতা স্পষ্টত দৃষ্টিগোচর হলো রোযার। নীরব থাকলো অমানিশা,জবাব এলোনা।পুনরায় অর্ধাঙ্গিনী বললো,
– নিহাদ বারবার তোমাকে খুঁজছিল।
– আমি এই সম্পর্কে কথা বলতে ইচ্ছুক নই রোযা।
শীতল শোনালো স্বামীর কন্ঠস্বর।যেন এক কথায় ইতি টানতে ইচ্ছুক আলোচনার।কিন্তু রোযা নাছোড়বান্দা।এত সহজে হাল ছাড়বেনা সে।

– অপরাধবোধে ভুগছ?
নীরবতা।শুধু সিনেমার ডায়লগ বিনিময়ের ধ্বনি ভেসে আসছে চিরচিরে আওয়াজের সাথে সাথে।রোযা আসমানের দিকে ফিরলো,আলতো করে ছুঁয়ে দিলো আবছায়ায় উদ্ভাসিত কপোল।বিড়বিড় করলো,
– তুমি নিহাদের সব আসমান।তোমার জন্য আমরা সবাই আছি,কিন্তু নিহাদের জন্য একমাত্র তুমিই যেন ওর আপনজন।এমন কষ্ট দিওনা ছেলেটাকে।
আরও একটু সন্নিকটে ঝুঁকলো সে আসমানের।বলল,
– পরিস্থিতি তোমায় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল আসমান।তুমি দোষ করনি,দোষ তো ওই আলফার।অপরাধবোধে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হওয়ার আগে একবার ভেবে দেখো,এটাই চাইছিলো আলফা!তোমাকে মানসিক কষাঘাতে জর্জরিত করতে।আর দেখো,আলফা আজ হেরে গিয়েও যেন জিতে গিয়েছে!তুমি তার পথই অনুসরণ করছো,নিজেকে হতাশায় হারিয়ে ফেলছো।

জোরপূর্বক আসমানের চেহারা নিজের দিকে ঘোরালো রোযা,সিক্ত আবেগ নিয়ে জানালো,
– চাঁদ,এটুকু মনে রেখো। যাই হয়ে যাক না কেন, আমি তোমার পাশে ছিলাম,আছি এবং সর্বদা থাকবো।তোমার অর্ধাঙ্গিনী আমি,এই কণ্টকাকীর্ণ পথ তোমার হাতে হাত রেখে চলবো আমিও।ঠিক যেমন করে তোমার জীবনের আঁধার কেটে নতুন দিনের সূচনা হয়েছে,তেমনি এক নব্য সূচনা হয়ত অপেক্ষা করছে নিহাদের জন্যও।নিজেকে ভাইয়ের পরিণতির জন্য দোষারোপ করার আগে ভেবে দেখো তোমার ভাইটি জানলে কতটা কষ্ট পাবে!তোমার গ্লানির জন্য সে নিজেকে বিসর্জন দেয়নি,দিয়েছে তোমার সুখের জন্য।মনে রেখো চাঁদ।

ঝুঁকে আসমানের অধরে আলতো করে অধর ছোঁয়ালো রোযা।অতি ক্ষীণ এক ভরসার স্পর্শ যেন।তারপর মৃদু হেসে উঠে গেলো, একদিনে অধিক চাপ দেয়া উচিত হবেনা।সময় নিক আসমান,বুঝুক কিছুটা।জুসের বোতলটা টেবিলে রেখেছে,সেখান থেকে আরেক গ্লাস ভর্তি করলো।তবে ফিরে যাওয়ার পূর্বেই অতর্কিতে ঘটলো ঘটনাটি।
টেবিলের দুই প্রান্তে হাত ঠেকিয়ে রোযাকে মাঝখানে আবদ্ধ করে ফেললো আসমান,সে কখন পৌঁছেছে পিছনে টের পায়নি রোযা।শিরশির করে উঠলো রোযার সর্বাঙ্গ,ঠিক ঘাড়ের কাছে আসমানের উষ্ম নিঃশ্বাসের প্রভাব টের পাচ্ছে।
– আ…আসমান?তুমি কি আরেকটু জুস…. আ!

সম্পূর্ণ করতে পারলোনা রোযা,তার কোমরে আসমানের বলিষ্ঠ বাহু জড়িয়ে গেলো।শক্তভাবে ধরে তাকে টেবিলের উপর বসিয়ে অতি সন্নিকটে সরে এলো আসমান।জ্বলজ্বলে তারকাখচিত কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে চাইলো বিহ্বল অর্ধাঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে।এতটা নিকট থেকে আসমানের সুগঠিত শারীরিক অবয়ব রোযাকে মুহূর্তের জন্য সম্মোহিত করে ফেললো।অজান্তেই তার হাতের কোমল স্পর্শ ছুঁয়ে গেলো বুক থেকে উদরে নেমে যাওয়া দাগে উদ্ভাসিত ত্বকজুড়ে।আসমান কোনো বাঁধা দিলোনা,বরং ঝুঁকে এলো।যেন সে চায় জ্যোৎস্নার স্পর্শ দারুণভাবে।রোযার আঙুল আসমানের উদরে এসে থামলো,প্রকম্পিত হলো শরীর তার স্পর্শের অন্তরালে,স্পষ্টত অনুভব করলো রোযা।কিন্তু তার মস্তিষ্ক বর্তমানে এক ভিন্ন চিন্তায় মশগুল। দাঁতে দাঁত চেপে সে ঘোষণা করলো,

– আই উইল কি*ল দ্যাট বি*চ্ উইথ মাই ওন হ্যান্ড!
রোযার নিকট থেকে এমন বাক্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিলো।যার দরুণ খিলখিল করে হাসলো আসমান,তার হাসির ধ্বনি সুধাবর্ষণ করে গেলো অর্ধাঙ্গিনীর শ্রবণ ইন্দ্রিয়জুড়ে।
– হাউ ইমপ্রেসিভ!আমার জ্যোৎস্নাও দেখি কঠোর হওয়া শিখে গিয়েছে।
দুবাহু বাড়িয়ে আসমানের কাঁধে জড়িয়ে নিকটে টেনে রোযা বিড়বিড় করলো,

– অবশ্যই।আর কেউ ছুঁয়ে দেখুক আমার চাঁদকে।তাদের ভাগ্যাকাশে শনি,রাহু,কেতু হয়ে ঘুরবো আমি!
চেয়ে থাকল আসমান,একদৃষ্টে।রোযার দৃষ্টি বেয়ে তার নজর ঠেকলো অধরে।রমণীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো।কয়েক সেকেন্ডের ভাবনাচিন্তা যেন,পরক্ষণেই মিলিত হলো উভয়ের অধর। একে অপরকে আঁকড়ে ধরলো তারা দারুণ উদ্যমে।এ যেন ভিন্ন এক অনুভূতি।আজ পর্যন্ত অনুভব করা সকল মুহূর্ত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।প্রগাঢ় অনুভূতি বিনিময়ের মাঝে চোখ মেলে তাকালো রোযা,পর্যবেক্ষণ করলো আসমানের অভিব্যক্তি।আর কোনো দ্বিধার দেয়াল তাদের মাঝে নেই।বিয়ের প্রথম রাতের আসমানের যান্ত্রিক স্পর্শ, আর আজকের আসমানের নিগূঢ় অনুভূতির স্পর্শ….কতটা ভিন্ন, কতটা মধুর!এই আনন্দ,এই নব্য প্রস্ফুটিত কলির মতন অনুভূতির ব্যাখ্যা করা বড়ই দুষ্কর।
রোযার অধর মুক্ত করে দীর্ঘ প্রশ্বাস নিলো আসমান, তার আবেশিত অনুভূতিপূর্ণ কন্ঠস্বর ফিসফিস করে বললো,

– তোমার স্নিগ্ধ রশ্মিতে আমি সিক্ত হতে চাই জ্যোৎস্না।
রোযার কপোলে হাত ঠেকিয়ে নিকটে টেনে বিড়বিড় করলো,
– তোমার অস্তিত্বে আজ চাঁদের গ্রহণ লাগুক,আমার পৃথিবী।
টলটলে অভিব্যক্তিতে পূর্ণ হলো রোযার নয়ন,সমর্পণ করলো সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে।
– গ্রাস করো আমায় চাঁদ,বিনাশ করো।
এটুকুই।আসমানের অধর পুনরায় নিজের অধিকার হাসিল করলো।জোরালো প্রতিক্রিয়ায় টেবিল আঁকড়ে ধরলো রোযা,হাতে লেগে ধপাস করে কাঁচের গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।কেউ পরোয়াই করলোনা।বেশ কিছুক্ষণ বাদে রোযাকে বাহুতে বসিয়ে এগোলো আসমান,তার ঘাড় জড়িয়ে নিজের ভারসাম্য রাখলো রোযা।হৃদস্পন্দন তার আসমানের স্পন্দনের সঙ্গে বিলীন,উভয়ের হৃদযন্ত্র আজ বাঁধনহারা।সমস্ত শরীরের রোমকূপজুড়ে সুখের প্রস্রবণ।

শোবার ঘরে এসে বিছানায় সাবধানে রোযাকে বসালো আসমান।একটানে তার পরিধানের সোয়েটশার্টখানি খুলে ছুড়ে ফেললো দূরে।একনজর পর্যবেক্ষণ করলো,অর্ধাঙ্গিনী আঙুলজুড়ে জড়িয়ে গেলো তার আঙুলসমূহ।হাতের পিঠে আলতো করে চুমু খেয়ে আসমান বিড়বিড় করলো,
– ভালোবাসি জ্যোৎস্না।
– ভালোবাসি আমার চাঁদ।
আসমানের নমনীয় দৃষ্টি সহসাই হিং*স্র শিকারীর দৃষ্টিতে রূপান্তরিত হলো।তাতে ভড়কে গেলো রোযা, বিছানায় উঠে গেলো অজান্তেই।আসমান তীর্যক হেসে তাকে অনুসরণ করলো একই গতিতে।
– ভয় পাচ্ছো কেন?আমি তো এখনো কিছুই করিনি।
– তু..তুম… তুমি এভাবে তাকাচ্ছ কেনো?
– কিভাবে তাকাচ্ছি?

লালিমায় টকটকে হয়ে গেলো রোযার চেহারা,অধর কামড়ে ধরে পাশে তাকালো সে।বিস্তর হেসে আসমান কাছে টেনে নিলো তাকে,এলোমেলো হয়ে যাওয়া কেশগুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে কপালে চুমু খেলো।বিড়বিড় করলো,
– ভয় পেওনা জ্যোৎস্না আমার।আমার ভালোবাসা সব তোমার তরে।তোমায় খুব করে ভালবাসবো,বিনিময়ে আমাকে নাহয় এক নতুন মেঘ দিও?

টপটপ করে অশ্রু গড়ালো রোযার,আসমানের বুকে মাথা গুঁজলো,নীরবে সম্মতি জানালো।আলিঙ্গন করলো আসমান তার জ্যোৎস্নাকে,যে অনুভূতি সে বর্তমানে অনুভব করছে তা শব্দেরও অতীত। অর্ধাঙ্গিনীর অধরে পুনরায় অধর মেলালো সে, অতি যত্নে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, যতটা দীর্ঘ সময়জুড়ে এই গভীর অনুভূতি অনুভব সম্ভব।অধর পেরিয়ে কপোল, গ্রীবা…..সবকিছুর দখল নিলো রোযার অস্তিত্বের একমাত্র অধিকারী,তার স্বামী।ক্ষণে ক্ষণে প্রকম্পিত হলো রোযা,প্রগাঢ় অনুভবে বিছানার চাদরে বারংবার আঁকড়ে বসলো তার আঙুল।অতঃপর……
সুদীর্ঘ এক অনুভূতিতে মোড়ানো রাত্রি।

ডার্কসাইড পর্ব ৫৪

চাঁদ এবং জ্যোৎস্নার অমোঘ মিলন ঘটেছে।আজ সত্যিই চন্দ্রগ্রহণ লেগেছে যেন পৃথিবীর বুকে।বাইরে ঘরের চাল থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়া শিশিরের ফোঁটা যেন তারই জানান দিলো।

ডার্কসাইড পর্ব ৫৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here