ডার্কসাইড পর্ব ৫৮
জাবিন ফোরকান
অতিবাহিত হয়েছে তিন মাস।
শীতের শুষ্কতাকে বিদায় করে প্রকৃতিতে আগমন ঘটেছে ঋতুরাজ বসন্তের।তারও বিদায়বেলা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়।দিবাকরের তেজস্বী রশ্মি অদূর হতে আগত গ্রীষ্মের জানান দিচ্ছে স্বগর্বে।তবুও নব্য প্রফুল্লতায় পূর্ণ হয়ে ওঠা প্রকৃতি আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। বৃক্ষলতার ভাঁজে ভাঁজে রঙিন পুষ্পরাজি এই বেরং নগরেও বর্ণের স্বপ্নজাল বুনে রেখেছে।নাম না জানা পাখির দলের কিচিরমিচির সুধার আঁধার। ঝাঁক বেঁধে নীড়ে ফেরার দৃশ্য তাদের এই নিষ্প্রাণ নগরেও নতুন জীবন দান করে।দীর্ঘ অথচ জীবনের হিসাবে তুচ্ছ এই সময়কালজুড়ে ধরিত্রীর প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এসেছে পরিবর্তন,হোক তা ভালো কিংবা মন্দ।সময়ের যাত্রা পরিবর্তনে উদগ্রীব।
কিছুদিন বাদেই পূর্ণিমা।আজ তাই আকাশে চন্দ্রের অবস্থান ঔজ্জ্বল্যে পরিপূর্ণ। দশা তার প্রায় সম্পূর্ণ, সামান্য অংশ আঁধারে নিমজ্জিত।মেঘরাজি ক্ষণে ক্ষণে এলোমেলো ভঙ্গিতে আলোছায়ার খেলায় মেতেছে।এর মাঝে একটি আধভাঙা দেয়ালের পুরু আস্তরণে পা ছড়িয়ে বসে আছে আসমান।দৃষ্টি তার সুদূর দিগন্তে,যেখানে উঁকি দেয়া চন্দ্র যেন বায়ুতে কাঁপতে থাকা মোমবাতির শিখার ন্যায় প্রজ্জ্বলিত। বায়ুজুড়ে ধোঁয়াটে এক তামাকজাতীয় গন্ধের পাশাপাশি তীব্র এক ঝাঁঝালো আবেশ।তাজা র*ক্তে*র ঘ্রাণ!হিং*স্র পশুদের উন্মত্ত বাসনায় শিকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে এই মাতাল করা আবেশটুকুই যথেষ্ট যেন।ঠিক সামনেই আবর্জনার স্তূপের মতন এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে গোটা চারেক মৃ*তদে*হ।কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই অমানিশার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেয়াল বেয়ে দুহাত দুদিকে মেলে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এলো হাবিব।এক পলক স্তূপের দিকে চেয়ে পরবর্তীতে আসমানের দিকে ফিরলো।কোনো প্রশ্ন উচ্চারিত না হওয়া সত্ত্বেও বলতে আরম্ভ করলো,
– আলফা ইতালিতে ফিরে গিয়েছে সেদিনই।কোনো একটা ঝামেলায় আছে সে যতটুকু জানা সম্ভব হয়েছে।তাই আপাতত কোনোপ্রকার ঝুঁকি নেই।এর বেশি কারো কিছুই জানা নেই।আলফা সম্পর্কে তথ্যও খুবই কম।
নিঃশব্দে শুনে গেলো আসমান।
– আকাশ আলফার সাথে আছে।কে বি গ্রুপের সঙ্গে ঝামেলার সময় সে নিজের একটি চোখ হারিয়েছে।শোনা গেছে আলফার সহযোগী একটি চোখে আইপ্যাচ পরে থাকে,সে আকাশ তাতে সন্দেহ নেই।
“ কি এমন জরুরী কাজ আলফার যাতে তার প্রতিশোধের আগ্রাসন বিঘ্নিত হয়? ”
প্রশ্নটি ধ্বনিত হলোনা,আসমানের অন্তরেই রয়ে গেলো।এক মুহুর্ত কি যেন ভাবলো সে।তারপর চটজলদি উঠে পড়লো।প্যান্ট ঝেড়ে হাবিবের দিকে তাকালো,তারপর জমাকৃত মান*বদে*হের স্তূপের দিকে।
– সদা সতর্ক থাকতে হবে।শত্রু কখন কোনদিক থেকে কোন রূপে আ*ঘা*ত হা*নবে,তার নিশ্চয়তা নেই।অন্তত এইবার কোনপ্রকার ঝুঁকি নিতে আমি রাজী নই।
– তবে কি আপাতত আলফা খোঁজ অভিযান সমাপ্ত?
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো আসমান,তারপর স্তূপের পানে চেয়ে আদেশ করলো,
– বা*র্ন দিস।
অতঃপর একবারও আর পিছন ফিরে তাকালোনা অমানিশা।চুপচাপ গাড়িতে উঠলো।পথিমধ্যে হাইডআউটে থেমে পোশাক এবং রূপ বদলে পুনরায় ফিরে এলো।পথ ধরলো বাড়ির।
মেঘতীরজুড়ে এক উষ্ণ মহল বিরাজমান।আসমান ঢুকতেই হলঘরে আবছায়া আলো আঁধারির খেলা আবিষ্কার করলো।চারিপাশের আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।চুয়াল্লিশ ইঞ্চির টিভিখানি দেখাচ্ছে সিনেমা থিয়েটারের ন্যায়।সোফায় গুটিশুটি দিয়ে আছে চারুলতা এবং নিহাদ।উভয়ের দৃষ্টি আবদ্ধ পর্দায়। স্পিকারে ধীরে ধীরে সিনেমায় চলমান সঙ্গীতের আবহ ভেসে এলো।
~আমার দিলের উইলে লিখে দেব যার নামরে
সে আমার প্যায়ারেলাল রে
আমার প্রেমের ফাঁদে ফেঁসে যাবে যে মালরে
সে আমার প্যায়ারেলাল রে~
– ইশ…. ছিঃ!এসব কোন ধরণের লিরিক্স?
চারুলতা মুখ ভেংচে বিরক্তি প্রকাশ করতেই পাশ থেকে নিহাদ ইচ্ছাকৃতভাবে গানের সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে গাইতে থাকলো,
– চাল হাটা হাটা হাটা এসব আঁতেল কথা, শোন দিলকি রাণী ডোন্ট বি ফানি আই অ্যাম ইওর রাজা।
চারু তৎক্ষণাৎ নিহাদের কোমর বরাবর পা তুলে এক ধাক্কা দিলো,তাতে বান্দা সোফায় উল্টে পড়লো।খিলখিল করে হাসতে হাসতে গাওয়া জারি রাখলো।
– হেহেহে…নেশা নেশা লেগেছে প্রেমের নেশা,তাই মজনু দেবে লায়লাকে….
– চুউউপ! বেত্তমিজ!
নিহাদের মুখ চেপে ধরলো চারুলতা,বিপরীতে তার হাত দুখানা আঁকড়ে নিহাদ ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– ইশ।তোমাদের ইংরেজি গানে চোক মি টিল আই পাস আউট বললে দোষ নেই,শুধু আমার গুরু দেব বাংলায় বললেই দোষ?
– চিংটা!
– ডাইনী!
– এহেম!
অতর্কিত গলা খাঁকারি দেয়ার আওয়াজে নিহাদ এবং চারুলতা উভয়ে সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো।পাশ ফিরে তাকাতেই আসমানকে লক্ষ্য করলো,বুকে দুবাহু ভাঁজ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কোনোকিছু বিবেচনা না করেই চারুকে একটা ধাক্কা দিলো নিহাদ,তাতে বেচারী সোফা থেকে উল্টে নিচের মেঝেতে পড়লো ধপাস করে।
– আহ্হঃ!
– আসমান ভাই?
তড়িঘড়ি করে উঠে বসে প্রফুল্ল দৃষ্টিতে তাকালো নিহাদ, এমন এক অভিব্যক্তি তার চেহারায় যেন কিছুই হয়নি।
– রোযা কোথায়?
স্থির প্রশ্ন ছুড়লো আসমান।নিহাদ মাথা চুলকে জবাব দিলো,
– তোমার বউয়ের খবর আমার কাছে চাইছো কেনো?আমি কি ওর অ্যাসিস্টেন্ট?
– যদি না চাও একটু আগের দৃশ্য নিয়ে আমি মন্তব্য করি তাহলে….
– হয়েছে হয়েছে।আমার ভুল হয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দেন।আপনার বউ নিজের ঘরে আছে।সে তো আমার মতন বেকার আর এই পেত্নীর মতন অকর্মার ঢেঁকি না যে বসে বসে টিভি দেখবে।
আসমান মাথা দোলালো,তারপর সিঁড়ির দিকে এগোলো।স্পষ্ট টের পেলো মেঝে থেকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে চারুলতা।সোফার কুশন তুলে নিয়ে সে রাগান্বিত মারমুখী ভঙ্গিতে হুংকার দিলো,
– বেঈমানের ঘরের বেঈমান!
নিহাদের মাথায় আছ*ড়ে পড়লো আ*ক্র*মণ।
– টিকটিকির বাচ্চা!
– কিঃ?তুমি আমার ড্যাডকে টিকটিকি বললে?আসুক ড্যাড আজকে!
– বিলাল কাক্কু তো দরবেশের বংশধর।কিন্তু মেয়ে বানিয়েছে শয়তানের উত্তরসূরী।
পাল্টা আরেকটি কুশন আঁকড়ে চারুলতার ক্রমাগত আ*ক্রম*ণ প্রতিহত করে গেলো নিহাদ।
– আমি শয়তানের উত্তরসূরী হলে তুমি সেই অভিশপ্ত অ্যাস্ট্রয়েড যার আ*ঘা*তে মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী থেকে ডায়নোসর জাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
– হাহ? তুমি সেই পারমাণবিক বো*মা যার ধাক্কায় হিরোশিমা নাগাসাকি ধ্বং*স হয়ে গিয়েছিল।
– তুমি চোদ্দ শতাব্দীর সেই ব্ল্যাক ডে*থ, প্লেগ,যাতে একশো মিলিয়ন মানুষ মা*রা গিয়েছিলো!
– তুমি তাহলে ঘূর্ণিঝড় আইলা যার কারণে গোটা দেশ লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিলো!
– শিক্ষামূলক বিনোদন।
সিঁড়ির উপরে দন্ডায়মান আসমানের মন্তব্যে চারুলতা এবং নিহাদ থমকে গেলো মাঝপথেই,একজন অপরজনের চুল টেনে ধরে রেখেছে,ওই অবস্থায়ই। ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলছে উভয়েই,তবুও কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়।আসমান মাথা কাত করে আবারও বললো,
– সিসিমপুরের ইকরিও তোমাদের থেকে বেশি বোঝদার।
– তোমার বোন জাউরা নাম্বার চারশো বিশ হলে সেটা আমার দোষ?
– তোর শিষ্য নেড়ি কুকুরের বাঁকা লেজ হলে সেটা আমার দোষ?
তৎক্ষণাৎ চারুর কেশরাশি জোরসে টেনে ধরলো নিহাদ,চট্টগ্রামের দুর্বোধ্য ভাষা বেরিয়ে এলো কন্ঠ থেকে,
– আঁর ফুন্মারার লাই ফেট ফুরেদ্দে তুর? [ আমার সাথে লাগার খুব শখ?]
পাল্টা তার ঘাড় চেপে ধরলো চারুও,সজোরে টি*পে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
– এমন কাজাখস্তানের ভাষা বলা শুরু করবো যে তোমার চাটগাঁইয়া ভাষা রুমের কোণায় হাউমাউ কান্না কাঁদবে!
– তুর মেজ্জান নো হাইলি আঁর শান্তি ওইতুনো! [ তোমার মেজবান না খেলে আমার শান্তি হবেনা।]
জারি রইলো টম অ্যাণ্ড জেরির লড়াই।কুশন দুটো ফেঁ*টে তুলো উড়ছে চারিপাশে।ইতোমধ্যে আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে উভয়ের চুল ছিঁ*ড়ে উঠে এসেছে।তবুও ক্ষান্ত নেই।আসমান দৃশ্যপটে চেয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর উপরে উঠে এলো।অজান্তেই অধরমাঝে মৃদু এক হাসির রেখা প্রস্ফুটিত হলো তার।
কক্ষে পৌঁছে চারিপাশে তাকালো আসমান।রোযার উপস্থিতি টের পেলো ডানদিকের বায়ুতে দোদুল্যমান পর্দার অপরপ্রান্তে।ট্রিপল মনিটরের কম্পিউটারের সামনে গেমিং চেয়ারে বসে আছে তার প্রেয়সী।নয়ন আবৃত পঞ্চভূজাকৃতির চশমার লেন্সে,যার মনোযোগী দৃষ্টি স্ক্রীনে আবদ্ধ।উভয় হাত স্রোতস্বিনীর ন্যায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে কি বোর্ডের উপর।আসমান কিছুক্ষণ অবলোকন করলো।তার কাজে কোনপ্রকার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।সংক্ষিপ্ত গোসল সেরে টি শার্ট শরীরে জড়িয়ে ভেজা কেশ মুছতে মুছতে যখন সে কক্ষে ফিরে এলো রোযা তখনো মনিটরের সামনে বসমান।ভ্রুজোড়া সামান্য কুঁচকে রয়েছে মনোযোগে,তর্জনী চালাচ্ছে চিবুকে ভাবনায়।তারপর মাউসে হাত চাপলো,কি বোর্ডের কী চেপে ঝুঁকে দেখতে থাকলো।এমন রূপে রোযাকে দেখাচ্ছে গুরুজনের মতন।
আসমান তোয়ালে রেখে এগিয়ে গেলো।পর্দা সরিয়ে এপাশের স্টাডি সেকশনে এসে কোনোপ্রকার সতর্কতা ছাড়াই ঝুঁকে রোযাকে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরলো, মুখ গুঁজলো কাঁধে।বিস্মিত রোযা খানিক ভড়কে গিয়ে স্থবির হয়ে পড়লো।পরক্ষণেই চেয়ারে হেলান দিয়ে আসমানের কপোলে হাত বুলিয়ে কোমল কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– ওয়েলকাম হোম,মাই মুন।
– কি করছো এত মনোযোগ দিয়ে?
স্ক্রীনের দিকে তাকালো আসমান,ফাউন্টেন পেনের ওয়েবসাইট প্রদর্শিত হচ্ছে তাতে।কিঞ্চিৎ হাসলো অমানিশা, স্বগর্বে।
– ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম।আমার জ্যোৎস্না তো এখন একজন বিখ্যাত মানুষ।সোশাল ইনফ্লুয়েন্সার।
– হাহা।তেমন কিছু নয় আসমান।
– কে বলেছে তেমন কিছু নয়?
কম্পিউটার ডেস্কের দুপাশে হাত ঠেকিয়ে মুখ নত করে রোযার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো আসমান,জিজ্ঞেস করলো,
– শুনেছি সকালে তাহমিদ এসেছিলেন দেখা করতে তোমার সাথে?
– তুমি কিভাবে জানলে?
বোকার মতন প্রশ্ন করে রোযা পরক্ষণে হেসে ফেললো।আসমানের ভ্রুজোড়ার কুঞ্চন অবলোকন করে জানালো,
– হুম এসেছিলেন।তিনি এবং তার দলের কয়েকজন নেতা।বাবা ছিলেন তখন।বলেছেন,যদি আমি রাজনীতিতে আগ্রহী থাকি তাহলে তারা আমার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।
– তুমি কি উত্তর করলে?
ডেস্কের উপর রাখা আসমানের হাতের পিঠে নিজের হাত স্থাপন করে রোযা জানালো,
– আমি রাজনীতিতে ইচ্ছুক নই।ওইসব নোংরা ক্ষমতার খেলা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।তার চেয়ে আমি একজন আলোচক হবো।যেহেতু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে আমার মতামতের মূল্য রয়েছে সেহেতু আমি ন্যায় অন্যায়ের ভিত্তিতে আলোচনা করব,মত প্রকাশ করবো।হোক তা যে কেউ,সরকার কিংবা বিরোধী দল।ক্ষমতার ঔদ্ধত্য যেন অহংকারে শাসককে অন্ধ করে না দেয়,তার জন্য এমন কিছু আলোচক থাকা প্রয়োজন,কি বলো?
আসমান দীর্ঘ সময়জুড়ে রোযার দিকে তাকিয়ে রইলো,তারপর ঝুঁকে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
– ভালো সিদ্ধান্ত।আমি তোমার পাশে থাকবো, সবসময়।
– ধন্যবাদ।তুমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও,আমি নিচে গিয়ে রাতের খাবার গরম করে নিচ্ছি।
– হলঘরের অবস্থা শোচনীয়।তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
– মানে?
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো সিক্ত কেশে আঙুল চালালো আসমান,জবাব দিলো,
– টম অ্যান্ড জেরির এপিসোড চলছে।তার মধ্যে তোমার বুলডগ হয়ে না ঢোকাই শ্রেয়।
– নিহাদ চারু?আবার?
নীরবে সম্মতি জানালো আসমান।রোযা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসলো,
– ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।
– মনে হয়না এই দুইজন কোনোদিন শুধরাবে।নিহাদকে নাহয় মানা যায়, ব্যাটা জন্ম থেকেই ত্যাড়া,কিন্তু চারুলতা?অবিশ্বাস্য।
– আমার কি মনে হয় জানো?
আসমান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো রোযার উদ্দেশ্যে।প্রেয়সী তার নাটকীয় ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে সুর ধরলো,
– আমাদের নিহাদ আর চারুলতার মাঝে…. কুছ কুছ হোতা হ্যায়!
– হাহাহা….নাইস জোক।
– আমি মজা করছিনা।তুমি খেয়াল করে দেখেছ ওরা একে অপরের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকায়?
– এই বুঝি কামড়ে দেবে এমন দৃষ্টিতে।
– আসমান!আমি সিরিয়াস!
অধৈর্য্য হয়ে রোযা চেয়ার ঘুরিয়ে পিছনে ফিরলো, মুখোমুখি হলো প্রিয়তমর।
– এমনটাও তো হতে পারে ঝগড়ার আড়ালে ভালোবাসা লুকানো রয়েছে?
– এটা কি কৈশোরের দুরন্ত প্রেমের উপন্যাস নাকি?
– তোমার আমার মাঝে কেমনভাবে প্রেম হয়েছিল চিন্তা করো।
আসমান বুকে দুবাহু ভাঁজ করে তীর্যক হাসলো।
– তোমার আমার প্রেম?উহু,তার সঙ্গে কোনকিছুর তুলনা করা অসম্ভব।
রোযা সামান্য লজ্জাবোধ করলো,তার চেহারায় লালিমা প্রকাশ পেলো স্পষ্ট।দৃষ্টি হটিয়ে পাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো,
– আমার চাঁদ এতটা বিবেচক হলো কবে থেকে?
– নতুনভাবে ভালোবাসতে শেখার পর থেকে।
চেয়ারের হাতলে দুহাত স্থাপন করলো আসমান,ঝুঁকে এলো সন্নিকটে।তার আধভেজা কেশরাশি থেকে শ্যাম্পুর সুঘ্রাণ ভেসে আসছে।রোযা চেয়ারে সংকুচিত হয়ে পড়লো।আসমানের আঙুল ধীরে ধীরে তার কপোল ছুঁয়ে গেলো।অত্যধিক শীতল স্পর্শ,পথিমধ্যে অগ্ন্যুৎপাতের উত্তাপ বিলিয়ে তা রোযার গ্রীবায় এসে ঠেকলো।
– আস….মান…
– কোন মন্ত্রজালে বশ করেছ আমায় প্রিয়তমা?তুমি হীনা অন্যকিছু চিন্তায় অনিচ্ছুক এই অন্তর।আমার জগৎজুড়ে শুধু তোমার খেয়ালের বসবাস।
আসমানের কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে নব্য প্রস্ফুটিত পুষ্পসদৃশ কোমলতা।অনুভূতির টলটলে আবেদনে পরিপূর্ণ ওই শোষণ গহ্বর,যার নিগূঢ় আঁধারজুড়ে শুধুমাত্র জ্যোৎস্নার প্রতিফলন।
– তুমি এভাবেও তাকাতে জানো আমার চাঁদ?
অভূতপূর্ব এক বিস্তৃত হাসি ফুটলো আসমানের পুষ্ট অধরে,কপোলের কলংক তার তাতে সামান্যতম বাঁধ সাঁধতেও সক্ষম হলোনা।বরং আপন মহত্বে উদ্ভাসিত করে তুললো মাধুর্যের হাসিখানি।সম্মোহিত হয়ে পড়ল রোযা সম্পূর্ণ।তার বিনুনী পাকানো কেশের মাঝে আঙুল চালিয়ে খুলে ফেললো আসমান,একগুচ্ছ তুলে ধরে নিজের অধরে ছোঁয়ালো।
– তোমার সম্মুখে এই অমানিশার সমর্পণ ঘটেছে।
– এহেন সৌভাগ্যের যোগ্য আমি?
– পরাশক্তিকে আয়ত্বে নিয়েছ তুমি,যোগ্যতার মাপকাঠি গুঁড়িয়ে গিয়েছে।সাধ্য কি তার তোমায় বিচার করে?
শক্ত একটি ঢোক গলাধঃকরণ করলো রোযা। আসমানের প্রতিটা বাক্য তার হৃদয়কে বারংবার আন্দোলিত করে তুলছে।প্রগাঢ় আবেগের উচ্ছলন সহ্য করা দায়।শিরদাঁড়া টানটান করে বসে আসমানের টি শার্টের বুক খামচে ধরে নিকটে টানলো রোযা, বিলিয়ে দিলো নিজেকে প্রিয়তমর অধরের আসক্তিতে।কিঞ্চিৎ তৃপ্ততার হাসি হাসলো আসমান, পরক্ষণেই সাড়া দিলো।গভীর থেকে গভীরতম আবেগের সামনে আত্মসমর্পণ করলো স্বইচ্ছায়।
ক্রমশ দীর্ঘ হলো অনুভূতির বিনিময়।কেউই একে অপরের মুক্ত করতে রাজী নয় এই আবেশ থেকে।আসমানের শক্তিশালী পেশীবহুল বাহু জড়িয়ে গেলো রোযার কোমরে,চেয়ার থেকে নিজের কোলে তুলে নিলো অর্ধাঙ্গিনীকে।রোযা সামান্য পিছু হটলো,কিন্তু অতৃপ্ত আসমান চোখের চশমা খুলে চেয়ারে ফেলে তাকে পুনরায় নিকটে টেনে অধরের দখল নিলো।পর্দা সরিয়ে এপাশের বিছানায় এসে সন্তপর্নে বসলো সে,কোলে তার জ্যোৎস্না। রোযা নিজেকে মুক্ত করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– একটু পরেই বাবা এসে পড়বেন। ডিনারের জন্য…
– আই ডোন্ট কেয়ার।
রোযার গ্রীবায় আড়াল হলো আসমানের স্নেহ।শিউরে উঠে তার চুল আঁকড়ে রোযা বললো,
– চাঁদ…আমি…
– হুশ।কেউ ডাকতে এলে জবাব দেয়ার প্রয়োজন নেই।যা বোঝার বুঝে নেবে ওরা।
– কি অসভ্য!
রোযার চাটিতে খিলখিলে ধ্বনি তুলে হাসলো আসমান। বললো,
– দিনদিন ব্যাপারটা উল্টো হয়ে যাচ্ছে বলো?জংলী বিল্লী থেকে রসকষহীন হয়ে যাচ্ছো।ক্লান্ত হয়ে গিয়েছ আমাকে নিয়ে?
তড়িৎ খেলে গেলো রোযার শরীরে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক ধাক্কায় আসমানকে বিছানায় ফেললো।সামান্য বিস্মিত হলো অমানিশা।
– রোযা…আমি মজা কর…
বাক্য সমাপ্ত করা সম্ভব হলোনা।অর্ধাঙ্গিনী তার কপালে স্নেহের স্পর্শ ছোঁয়ালো,কপোল বেয়ে দ্রুতই তা নেমে এলো গ্রীবাদেশে।অজান্তেই অধরে অধর চেপে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরলো আসমান।হৃদস্পন্দন তার সীমা ছাড়িয়েছে।প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে তীর্যক হাসলো রোযা,মৃদু কন্ঠে শুধালো,
– এবার বলো,কি বলছিলে যেন?আমি রসকষহীন?
উত্তরে হেসে তাকে শক্তভাবে বুকের মাঝে আলিঙ্গন করে নিলো আসমান।ভালোবাসাময় সেই আলিঙ্গন ক্রমশ সুগভীর হলো।অনুভূতির চাঁদরে একে অপরকে আবৃত করে ফেললো চাঁদ এবং জ্যোৎস্না।
তাদের রাতের খাবারের জন্য ঠিকই ডাকতে আসছিলো চারুলতা,কিন্তু নিহাদ বাঁধা দিলো।ফোনের স্ক্রীন দেখালো।তাতে আসা মেসেজ দুটো প্রসারিত দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করলো চারু।
বদ্দা: ডিস্টার্ব।
বদ্দা: অ্যান্ড আই উইল কি*ল ইউ।
ক্যাফে লো – ফাই।
ভি আই পি এরিয়ায় একপাশের কাঁচের দেয়ালঘেঁষা টেবিলের বিপরীতে বসে আছে চারুলতা।মস্তিষ্ক তার ভাবনায় আচ্ছন্ন।অপর পাশের মানুষটির কথোপকথন কর্ণগুহরে তার গোত্তা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে।
আফসানা রেমান চারুলতা।একজন ফ্রিল্যান্সার। রেমান পরিবারের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী।এই বিশাল পরিচয়ের মাঝে কোনো কমতি নেই।কিন্তু সেই মুদ্রার বিপরীত পিঠের সবটাই যেন শূণ্যতায় ঘেরা।সত্যিকার বাবা মা কে? জানা নেই।ভাগ্য তাকে এবং তার সহদরকে এক দেবদূততুল্য মানুষের কোলে তুলে দিয়েছে।বিলাল রেমান। তিনিই বাবা,তিনিই মা, তিনিই পরিবার।কোনো খেদ নেই।জীবনের চাইতেও তাকে অধিক ভালোবাসে চারুলতা।ছেলেবেলা থেকে কোনোদিন অভাব অনটন কি তা টের পায়নি,করেনি সংগ্রামও।কিন্তু তাই বলে কি সুশিক্ষার কমতি ছিল?উহু।বিলাল নিজের সন্তানদের আপন আদর্শে গড়ে তুলেছেন। চারুলতা হয়েছে প্রতিবাদী,স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল এক আধুনিকা সত্তা।অপরদিকে চিত্রলেখা নিজের দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সাহিত্য সঙ্গীতের প্রতি দূর্বল এবং শেকড়সম্পন্ন এক স্নিগ্ধ অস্তিত্ব।আধুনিকতার ছোঁয়া তার মাঝেও ছিল, কিন্তু কোমলতা এবং নমনীয়তায় ভরপুর ছিল চিত্র, যার ধারণা ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু জয় করা সম্ভব।
যমজ হওয়ার কারণে দুই বোনের মাঝে সর্বদাই এক ভিন্ন ধরণের টান বিদ্যমান ছিল।স্কুল কলেজে যত দাঙ্গা চারুলতা নিজের চড়া মেজাজ এবং প্রতিবাদী স্বভাবের কারণে বাঁধিয়েছে, তা নিরসনে চিত্রর ভূমিকাই ছিল অগ্রগামী।আপাতদৃষ্টিতে হুবহু এক দেখতে অস্তিত্ব দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন হৃদয়ের অধিকারী ছিল।তবুও তাদের মাঝে কোনোদিন খেদ সৃষ্টি হয়নি।যতদিন না আসমান নামক এক সুপুরুষ চিত্রর জীবনে আসে।অমানিশা—এক গভীর প্রভাবে কখন যে তার হৃদয় হরণ করে নিয়েছিল চারু টেরটুকুও পায়নি।কিন্তু সেই নিষিদ্ধ অনুভূতি কোনোদিন ব্যক্ত হয়নি,যমজের খুশির তরে।জীবনে সর্বপ্রথম উৎসর্গ বুঝি চারুর সেটাই ছিলো।তারপর একদিন, হুট করে তার জীবনের খুঁটি,তার যমজ হারিয়ে গেলো,আজীবনের জন্য।বিলাল এবং আসমানের সামনে কোনোদিন নিজেকে প্রকাশ করেনি চারুলতা।কিন্তু সত্যিকার অর্থে,তার যন্ত্রণাটুকুর সঙ্গে জগতের কোনো বিষাদের তুলনাও পাপ।যমজ হারিয়েছে সে,নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশকে হারিয়েছে।আপন অংশ হারিয়ে কি মানুষ বেঁচে থাকতে পারে?কিন্তু চারুলতাকে বাঁচতে হয়েছে।পরিবারের জন্য,পিতার জন্য,আর সহোদরের প্রতিশোধ আদায়ের জন্য।আসমানের লড়াইয়ে সঙ্গ দিয়েছে সে,যেভাবে সম্ভব,যতটুকু সম্ভব।সর্বদা অন্তরালে রেখেছে নিজের অনুভূতি।বিষাদ হোক কিংবা ভালোবাসা।তার সুদর্শন অবয়ব ব্যতিত কিছুই প্রকাশ পায়নি কোনোদিন।
নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল চারুলতা।বারংবার ভেঙে খানখান হওয়া হৃদয়ের টুকরোগুলো সংরক্ষণ করে রাখছিলো।রাত্রিবেলা কক্ষে বসে একাকী চিত্রলেখার ছবির সঙ্গে কথা বলে সে,এখনো।এই সত্যটি কি কেউ জানে?না।কেউ জানেনা,কোনোদিন জানবেও না।এই দিশাহীন জীবনের মাঝে হঠাৎই দমকা হাওয়ার মতন আগমন ঘটে এক পুরুষের।নাম নিহাদ।পূর্ব পরিচয়ের স্মৃতি মোটেও সুখকর ছিলোনা।সহ্য হতোনা ছেলেটিকে তার একদমই।কিন্তু চারুলতা অস্বীকার করতে পারবেনা,এই প্রথম একজন কেউ তাকে সত্যিই সে হিসাবে মূল্যায়ন করেছে।হোক তা ঝগড়ার মাধ্যমে।মা*র খেয়ে পাল্টা মে*রেছে, পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া করেছে সমানতালে।ভেদাভেদ নেই তাদের মাঝে।নারী পুরুষ,জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ কোনো পার্থক্যই নেই। সমানে সমান দুই সত্তা। একে অপরের পরিপূরক।একদিন হুট করেই চারুলতার মনে হলো তার ভগ্ন হৃদয়ের অংশগুলো যেন এক মন্ত্রপূত আঠার বলে জোড়া লাগতে আরম্ভ করেছে।সেই আঠা….নিহাদ।
উপলব্ধিতে বেগ পোহাতে হয়নি।অসহ্যকর ছেলেটাকে ধীরে ধীরে প্রচণ্ড চোখে হারাতে শুরু করে সে।ঝগড়া হলেও,মুখোমুখি সময়টা যেন উপভোগ্য।নিহাদ উধাও হলেই অনুভূত হতো শূন্যতা,কোথাও যেন কিছুর অভাব রয়েছে।সুস্থ হতে আরম্ভ করেছে তার অসুস্থ হৃদয়,উপলব্ধি করে চারু।তারপরই,নিহাদের দূর্ঘটনা।কয়েক ঘণ্টা যাবৎ সকলে ভ্রান্ত ধারণায় ছিল,বুঝি বেঁচে নেই সকলের প্রিয় নিহাদ।ওই কয়েকটি ঘণ্টা যেন চারুর জীবনের সবথেকে দীর্ঘতম সময়।প্রতিটা সেকেন্ড অতিবাহিত হয়েছে এমন এক প্রগাঢ় যন্ত্রণা অনুভব করে,যেন শত সহস্র সূচ বি*ধে দেয়া হয়েছে তার শরীরে।অন্তর পুনরায় ভেঙে খানখান হয়েছে, এমনভাবে যে কোনো আঠার মাধ্যমেই তা জুড়ে দেয়া সম্ভব নয়। আপন মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিল চারু, ইতালি ফিরে যাবে,সবকিছু থেকে দূরে, একাকী, এই পৃথিবীর ভিন্ন কোনো প্রান্তে বসবাস করবে অন্তরালে থেকে,প্রহর গুণবে মৃ*ত্যুর।জীবনের সবথেকে মূল্যবান বস্তুগুলোই সে একে একে হারিয়ে ফেলছে। এই বেদনা সহ্য করা দায়।
অতঃপর নিহাদের বেঁচে থাকার সংবাদ চারুলতাকে ঠিক কেমন অনুভব করিয়েছিল তা সে নিজেও জানেনা।শুধু স্মরণে আছে,প্রচণ্ড গতিতে ড্রাইভ করতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছে পাঁচ হাজার টাকা ফাইন প্রদানের পর বিলাল রেমান তাকে সরিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটের দখল নিয়েছিলেন।এরপর?কোনোদিন ছেলেটার পাশ থেকে সরেনি চারু।ঝগড়া করবে?করুক।আ*ঘা*ত করবে?করুক।তবুও সামনে থাকুক সে,অবলোকন করুক চারু যে ছেলেটা বেঁচে আছে।তাকে বিশেষ কিছু অনুভব করায় এমন মানুষটি এখনো এই পৃথিবীতে বিদ্যমান।বছর পেরিয়ে হলেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার সুদর্শন চেহারা এবং শিশুসুলভ দৃষ্টি অবলোকন করতে পারবে সে।
এতসব অনুভূতির দোলাচলে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে চারুলতা যে চারিপাশে শূন্যতা ব্যাতিত আর কিছু অনুভূত হচ্ছেনা।কি করবে সে?কোন উদ্দেশ্যে জীবনতরী বাইবে?জানা নেই।
– মিস চারুলতা?
কণ্ঠস্বরটি যেন অবশেষে চারুকে আকর্ষিত করতে বাধ্য হলো।মাথা ঝাঁকিয়ে সামনে তাকালো সে।বিপরীত প্রান্তে বসা ফরমাল ব্রাউন স্যুট পরিধানে যুবক তার দিকে চেয়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টিতে।
– ব্ল্যাকআউট হয়ে গিয়েছেন?এতটাই বোরিং লাগছে আমাকে?
– ন…না মিস্টার আশিক।আমি আসলে একটা নতুন প্রজেক্ট নিয়ে চিন্তিত তাই।দুঃখিত।বলুন আপনি,কি যেন বলছিলেন?
আশিক টেবিলে দুহাত রেখে স্মিত হাসির সঙ্গে বললো,
– আমি ভণিতা করবোনা মিস চারুলতা।আপনাকে আমার সত্যিই ভালো লেগেছে।যদি আপনারও একই মত হয়ে থাকে,তবে হয়ত আমরা আমাদের সম্পর্কে এগোতে পারি।
– জ… জ্বি অবশ্যই।
– হয়ত এটি পারিবারিক বিয়ে,এই সম্পর্কের মাধ্যমে আমাদের পরিবারের ব্যবসায়িক ভিত্তিও মজবুত হবে।তবুও আমি কথা দিচ্ছি,আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনাকে সুখী করার।
আশিক সামান্য দুঃসাহস করে টেবিলের উপর রাখা চারুলতার হাত ছুঁয়ে দিচ্ছিলো,কিন্তু তখনি পাশে রাখা ফোনটি ভাইব্রেশন করে উঠলো।সুযোগ পেয়ে চারু তৎক্ষণাৎ ফোনটি তুলে ধরলো। সিম কোম্পানির অফারের মেসেজ।কিন্তু চকিত বুদ্ধিতে চারুলতা উঠে দাঁড়িয়ে চেহারায় বিস্ময় ফুঁটিয়ে বললো,
– আমার খুব জরুরী একটা মেসেজ এসেছে। এক্ষুণি একটি কনফারেন্স কলে যোগদান করতে হবে।আমি সত্যিই দুঃখিত।
– না না, ইটস ওকে।আমাদের ডেট এমনিতেও শেষের দিকেই ছিলো।
– অনেক ধন্যবাদ মিস্টার আশিক।ভালো থাকবেন।
– আপনিও।আপনার উত্তরের আশায় থাকবো।
মিষ্টি করে হেসে চারু দ্রুত নিজের পার্স তুলে বেরিয়ে এলো ক্যাফে থেকে।অপেক্ষারত বি এম ডব্লিউতে উঠে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আর কতজনকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করে যাবে সে?সত্যি বলতে,বয়স তার কম নয়।এবার উচিত নিজের জীবনকে গুছিয়ে নেয়া।এই অসুস্থ মনে কি তা সম্ভব? বিলালকে কি বলবে যে সেও সারাটাজীবন একাকী কাটাতে চায়?তবে এমন সিদ্ধান্ত শেষ জীবনে গিয়ে তাকে আফসোস করাবেনা? পিতার মতন অসীম ভালোবাসাময় নয় তার হৃদয়,আদও কি হবে তার জীবনে?
বিনা প্রয়োজনেই ড্রাইভারকে বলে একাকী বেশ কিছুক্ষণ শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ালো চারু।বাড়িতে ফিরলো খানিক রাত করেই।ক্লান্ত ভঙ্গিতে হিলের পদক্ষেপধ্বনি তুলে হলঘরে প্রবেশ করে কিচেনে আবিষ্কার করলো নার্সকে।একটি ট্রেতে খাবার গুছিয়ে নিচ্ছে সে।চারু এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– নিহাদের খাবার?
– জ্বি।এরপর কিছু ঔষধ আছে।
– আমাকে দিন।আমি নিয়ে যাচ্ছি।
– কিন্তু ম্যাম,আপনি মাত্র ফিরলেন বাহির থেকে।
– সমস্যা নেই।আপনি যান,কিছুটা বিশ্রাম নিন।আমি করে দিচ্ছি।
নার্স সম্মতি জানালো। চারুলতা ট্রে নিয়ে নিহাদের কক্ষের দিকে গেলো। নিচতলার গেস্ট উইংয়ে থাকছে সে। হিল খুলে নিঃশব্দে এবং ধীরপায়ে কক্ষে পৌঁছে দরজা খুলে ঢুকলো চারুলতা।প্রশান্ত চেহারায় বিনা কারণেই ঝগড়ার ভঙ্গিতে বিরক্তি ফুটিয়ে বলতে গেলো,
– এসব গিলে আমাকে উদ্ধার ক…..
চারুলতার বক্তব্য অসম্পূর্ণ রইলো।সম্পূর্ণ শরীর তার স্থবির হয়ে পড়লো।প্রসারিত দৃষ্টিজুড়ে প্রকাশ পেলো অবিশ্বাস।সম্মুখের দৃশ্য,স্বপ্ন নাকি বাস্তব?
কক্ষের একপাশের কাঁচের স্লাইডিং ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিহাদ। হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে আছে!নিজের পায়ে!ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার তার পাশে পরে আছে, খানিক অবহেলায়ই।বাইরের দিকে মুখ করে ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে নিঃশব্দে প্রকৃতি অবলোকন করে চলেছে।
চারুর হাত ফস্কে ট্রে মেঝেতে পরতে পরতে বেঁচে গেলো,সেটি সশব্দে পাশের টেবিলে রাখলো রমণী।আওয়াজ শ্রবণ হতেই ফিরে তাকালো নিহাদ,সামান্য আবর্তিত হলো তার অধর, নিখাঁদ হাসিতে।
– সারপ্রাইজ…. আই গেস?
চেয়ে রইলো রমণী বাকরুদ্ধ হয়ে,দৃষ্টি তার ক্রমশ টলটলে হয়ে উঠল বিনা কারণেই।নিহাদ উল্টো ঘুরলো,কয়েক পা হাঁটলো, কোনোপ্রকার সাহায্য ছাড়াই।মুচকি হাসলো।
– এবার আমাদের ঝগড়া আরো বেগবান হবে,কি বলো?কয়েকটা বক্সিং ম্যাচ হয়ে যাক?
পলকের ব্যবধানে ঘটলো ঘটনাটি।নিহাদকে হতবিহ্বল করে দিয়ে চারুলতা সহসাই ছুটে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।চারুর বাহুদ্বয় জড়িয়ে গেলো নিহাদের সুগঠিত অবয়বজুড়ে,শক্তভাবে।প্রগাঢ় এক আলিঙ্গন।এক মুহুর্ত সম্পূর্ণ স্থির থাকলো নিহাদ, পরক্ষণেই পাল্টা জড়িয়ে ধরলো সে চারুকে,চাপ প্রয়োগে নিজের মাঝে মিশিয়ে ফেললো যেন একেবারে।দীর্ঘ সময়জুড়ে নীরব অব্যক্ত অনুভূতির বিনিময়।অস্ফুট ধ্বনি ভেসে এলো হঠাৎ। চারুলতার মাথায় হাত বুলিয়ে আনলো নিহাদ,কানের কাছে মৃদু কন্ঠে শুধালো,
– আর ইউ ক্রায়িং?
জবাব এলোনা,শুধু ম্রিয়মাণ ক্রন্দনধ্বনি।
– তোমার ডেটকে পছন্দ হয়নি?কিছু উল্টোপাল্টা বলেছে নাকি?এই যেমন….তোমার চুলগুলো ঝাড়ুর মতন,কিংবা তোমার গালদুটো আটার দলার মতন?
– আই….হেইট ইউ!
হাসলো নিহাদ,চারু নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও তা হতে দিলোনা।বরং দ্বিগুণ শক্তি প্রয়োগে রমণীকে নিজ আলিঙ্গনে বেঁধে তার মাথায় অধর স্পর্শ করলো আলতোভাবে।ক্ষীণ কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– আই নো।
রেমান গ্রুপ কোম্পানিভবন।
রাত এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট।দীর্ঘ এক মিটিং শেষে আসমান অবশেষে কার্যময় দিনটির সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নিলো।গত বেশ কয়েকদিন যাবৎ কোম্পানির কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।সরকারি ইস্যুর সমাধান হওয়ার পূর্ববর্তী ডিল এবং নতুন শুল্কভিত্তিক রপ্তানি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বেশ ব্যাস্ত থাকতে হয়েছে।বিলাল নিজেও হিমশিম খাচ্ছেন সবকিছু সামাল দিতে।
বাইরে বেরিয়ে কয়েকবার ঘাড় ঘুরিয়ে জড়তা ঠিক করলো আসমান।উষ্ণতার কারণে কোট আগেই খুলে নিয়েছে,শুধুমাত্র বাদামী শার্ট এবং ফরমাল প্যান্ট পরিধানে।গোল ফ্রেমের চশমাটা চোখে রেখেই সে এলিভেটরের দিকে এগোলো।দুজন অ্যাসিস্টেন্ট তার বিদায় জানিয়ে নিজেদের অবশিষ্ট কাজ সম্পূর্ণ করতে ছুটলো।গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছে গ্যারেজের দিকে আসতেই বিস্মিত হতে হলো আসমানকে।তার পোর্শের বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোযা।প্যাস্টেল গ্রীন বর্ণের অরগাঞ্জা শাড়ি পরিধানে,সঙ্গে ফ্লাওয়ার কাটিং টপ বেশ মানানসই ঠেকছে।অপেক্ষারত সে, দৃষ্টি অদূরে আবদ্ধ।
– তুমি?
ঘুরে তাকালো রোযা,আসমানকে খেয়াল করেই বিস্তৃত এক হাসির প্রস্ফুটন ঘটলো তার অধরে।ছোট ছোট পদক্ষেপে পৌঁছলো নিকটে,কোমর জড়িয়ে ধরে মাথা উঁচু করে দৃষ্টি মেলালো স্বামীর সঙ্গে।
– এই রাতে একাকী বের হয়েছ কেনো?
– একা কোথায়?হাবিব পৌঁছে দিয়েছে।
– কিন্তু হঠাৎ….
– আজ চমৎকার পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে আকাশে। লং ড্রাইভে যাবো। চলো।
আসমান কি যেন ভাবলো কয়েক মুহূর্ত।তাতে রোযা আরেকটু শক্তভাবে তাকে আঁকড়ে ধরে আবদার করলো,
– প্লীজ আসমান।মানা করবে তুমি?হুম?
– আহ,এভাবে তাকালে কিভাবে মানা করতে পারি?
– ইয়ে!
মৃদু হেসে মাস্ক নামিয়ে রোযার কপালে চুমু আঁকলো আসমান।তারপর হাত ধরে নিয়ে গেলো তাকে।প্যাসেঞ্জার সিটে তুলে নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। ইগনিশনে চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই চাপা ইঞ্জিনের গুঞ্জন তুলে চালু হলো জান্তব পোর্শে।গাড়িটি ঘুরিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে সড়কে নামলো আসমান।তারপর আরামদায়ক গতিতে অগ্রসর হতে আরম্ভ করলো।সঙ্গে চালু করা রেডিওতে কম্পমান সঙ্গীত।মুহূর্তটি এতই মনোমুগ্ধকর এবং উষ্ণতায় পরিপূর্ণ যে রোযা কিংবা আসমান কোনো বাক্য বিনিময় করলোনা।বরং নীরবে উপভোগ করে গেলো একে অপরের সান্নিধ্য।
– ওই দেখো পূর্ণিমার চাঁদ।কি সুন্দর আমাদের অনুসরণ করে যাচ্ছে।
– হুম,খুব সুন্দর।
– আমি ছোটবেলায় ভাবতাম চাঁদ বুঝি সত্যিই আমাদের পিছু নেয়।মাঝে মাঝে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতাম,কিন্তু কিছুতেই পিছু ছাড়াতে পারতাম না।
– হাহা,সেই চেষ্টা আমিও করেছি।তবে চাঁদের সঙ্গে নয়, সূর্যের সঙ্গে।
– আসমান বলে কথা,তার সবকিছু একটু ভিন্ন তো হবেই।
– তোমাকে আজ অপূর্ব লাগছে জ্যোৎস্না,ওই পূর্ণিমার চাইতেও সুন্দর।
রোযা পাশ ফিরে চেয়ে সামান্য হাসলো।
– পছন্দ হয়েছে শাড়ি?এটা তোমারই উপহার ছিলো।খুব প্রিয় আমার বস্ত্রটি। তোমার পছন্দ আছে বেশ।
ব্রেসলেট পরিহিত বাম হাতে গিয়ার চেপে আসমান বিড়বিড় করলো,
– তুমি অঙ্গে জড়িয়েছ,সুন্দর তো তাকে হতেই হতো।
– এই,দিনদিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো তুমি,কিশোরদের মতন কথাবার্তা।
– তাই বুঝি?
রহস্য করে হাসলো আসমান,তারপর বাম হাতের মুঠোয় রোযার একটি হাত পাকড়াও করে সামনে তাকালো।আধ ঘণ্টাযাবৎ উভয়ের মাঝে কথোপকথন হলো বিস্তর।পোর্শে তখন শহরের নির্জনতম প্রান্তে পৌঁছেছে।মহাসড়কের সূত্রপাত।আশেপাশে যানবাহনের চলাচল শূণ্য প্রায়।জনমানবহীন সড়ক,গাড়ির মাঝে দুটি ভালোবাসাময় সত্তা,গগনে উদিত পূর্ণিমচন্দ্র।আর কি চাই?
– আজ রাত্রিবেলা হঠাৎ এমন লং ড্রাইভে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করার কারণ জানতে পারি কি?
সামনের সড়কের দিকে নজর আবদ্ধ করে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো আসমান।তার বাম হাতখানি পরম যত্নে মুঠোয় আবদ্ধ করে রেখেছে প্রেয়সীর হাত, অপর দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং সামলাচ্ছে।রোযা পাশ ফিরে নিজের শখের পুরুষটির বাদামী ওভারসাইজড শার্টে আবৃত অবয়ব অবলোকন করলো প্রানভরে।অতঃপর অধরে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে জানালো,
– ব্যাস্ততায় একান্তে সময় কাটানো হয়না।তাই ভাবলাম আজ আমরা তিনজন একান্তে কিছুটা মধুর সময় অতিবাহিত করি।
আসমানের পা ব্রেক পেডালে চেপে বসলো।টায়ারের জোর ঘূর্ণনে কর্কশ আর্তনাদ তুলে জান্তব পোর্শে থমকে গেলো।জড়তার কারণে শরীর সামান্য সামনে ঝুঁকে এলো, সিটবেল্টের সুরক্ষা থাকায় সমস্যা হলোনা।উদ্ভ্রান্তের ন্যায় পিছনের প্যাসেঞ্জার সিটের দিকে তাকালো আসমান,কেউই নেই,একদম শূন্য।এই সম্পূর্ণ নির্জন রাতের সড়কপথ এবং গাড়ি, ধরিত্রীজুড়ে যেন শুধুই তাদের দুইজনের অস্তিত্ব।রোযার দিকে ফিরলো আসমান,জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি আর আমি দুইজন।তৃতীয়জন কোথায়?
রুদ্ধশ্বাস হয়ে অপেক্ষা করলো অমানিশা।তবে জবাব এলোনা।এর পরিবর্তে তার অর্ধাঙ্গিনীর অধরের নির্মল হাসিখানি আরো বিস্তৃত হলো,নয়ন বেয়ে একফোঁটা আবেগাশ্রু মুক্তোর দানার মতন আভা ছড়িয়ে গড়িয়ে নামলো।চেয়ে থাকলো আসমান,হৃদস্পন্দন তার সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে যেন।বিনা কারণেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।কন্ঠ বেয়ে এক ভগ্ন আবেদন গর্জন তুললো তার,
– রোযা!
রোযা নিজের শাড়ির আঁচল চেপে ধরলো মুঠো পাকিয়ে,ক্রন্দনরত কন্ঠে জানালো,
– মেঘ আসছে।
সম্পূর্ণ স্থবির হলো হৃদযন্ত্র।চিন্তাশক্তি লোপ পেলো।শুধুমাত্র ঝাপসা অনুভূতির পাঁক।
মেঘ আসছে।
সত্যি কি?কোনো স্বপ্ন নয়?বাস্তব?বাস্তব কখনো রূপকথার চাইতেও স্বর্গীয় হতে পারে?
বিশ্বাস করতে পারছেনা হৃদয়।চেয়ে থাকলো আসমান, বরফখন্ড হয়ে।নির্বিকার তার অভিব্যক্তি। হিমালয় যেন শীতল থেকে আরো শীতলতর হয়ে উঠেছে।রোযা তার দিকে ফিরলো,আলতো করে হাত স্থাপন করলো নিজের উদরে।সবুজাভ স্নিগ্ধতার আড়ালে তার অনামিকার অমানিশাখচিত আংটি চিকচিক করে উঠলো।ঘোষণা দিলো সে,
– তুমি বাবা হতে চলেছ,আসমান।
বারংবার প্রতিধ্বনিত হলো বাক্যটি বরষার বারিধারার ন্যায়।
“ বাবা…….তুমি…..আসমান……
তুমি বাবা…..হতে চলেছ…..আসমান…..”
স্টিয়ারিং থেকে খসে পড়লো হাত,শূন্যতা নিয়ে সামনে তাকালো আসমান।অদ্ভুত আঁধারে বিলীন সে।এরপর সহসাই পোর্শের দরজা খুলে গেলো,কোনকিছু উচ্চারণ না করেই অমানিশা বেরিয়ে গেলো বাইরে, সশব্দে আটকে দিলো দরজা।অভ্যন্তরে রোযা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো।নয়নের অশ্রু মুছে নিলো তড়িৎ গতিতে।তার চাঁদ কি খুশি হয়নি?এই সংবাদ কি তার কাম্য ছিলোনা?কোথাও কি ভুল হয়ে গেলো?অজানা আশংকায় রোযার শরীর হিম হয়ে গেলো।বেশ কয়েক মিনিট এলোমেলো চিন্তারা তার শান্তি কেড়ে নিলো।আর সহ্য করা সম্ভব হলোনা।দ্রুতই দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।তড়িঘড়ি করে গাড়ির সামনে আসতেই সামনের দৃশ্যপট যেন তার হৃদয় নিংড়ে নিলো সম্পূর্ণ।
আসমান সড়কের উপর হাঁটু মুড়ে বসে আছে।উভয় হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে।লম্বাটে আঙুলের ফাঁক গলে তার অশ্রুফোঁটা টপটপ করে পিচঢালা সড়কে পরে অদ্ভুত চিত্রকর্ম তৈরি করে চলেছে।
আসমান কাদঁছে!
এবার সম্পূর্ণ শরীরের ভারই যেন ছেড়ে দিলো।ভূমিতেই মাথা ঠেকালো আসমান।উভয় হাত দুপাশে আঁকড়ে গেলো, আঁচড় কাটতে থাকলো পাথুরে পথে।নীরব ক্রন্দন নয়,এবার অনুভূতির উদগীরণ ঘটলো প্রচণ্ড বেগে। উচ্চশব্দে কেঁদে উঠলো আসমান।সম্পূর্ণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো রোযা,কি অনুভব করছে সে বর্তমানে?ব্যাখ্যার অতীত।আসমানকে সে চোখের জল ফেলতে দেখেছে হাতে গোনা কয়েকবার,সম্পূর্ণ নিঃশব্দে,খুব ক্ষীণ সময়ের জন্য।কিন্তু আজ,এইভাবে হাহাকার তুলে কান্না কি আদও একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব?ওই আর্তনাদ যেন ছি*ন্ন ভি*ন্ন করে দেয় অন্তরকে।কতটা অনুভূতি চাপা থাকলে,কতটা বিষাদ গোপন থাকলে,কতটা যন্ত্রণা অনুভূত হলে এমনভাবে ক্রন্দন সম্ভব?তাও আসমানের মতন এক অনুভূতিশূন্য নির্বিকার মেশিনের পক্ষে?
কান্নার দমকে দমকে কাঁপছে আসমানের সর্বাঙ্গ।আরেকটু হলে সড়কের পাথুরে ঘর্ষণে তার হাত র*ক্তা*ক্ত হয়ে উঠবে।আর সম্ভব হলোনা রোযার পক্ষে।দ্রুত এগিয়ে এলো।পাশেই বসে পড়ে জোরালো বল প্রয়োগ করে আসমানকে টেনে তুললো। অশ্রুসিক্ত চেহারা, শুভ্রতার ঔজ্জ্বল্যের মাঝে লালচে অনুভব।রোযার নয়ন বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকলো,শক্তভাবে আলিঙ্গন করে নিলো সে আসমানকে।নিজের সবটুকু উষ্ণতা বিলিয়ে শান্ত করতে চাইলো অশান্তকে।
– দুঃখিত।আমি দুঃখিত আমার চাঁদ।তোমাকে কষ্ট দিয়েছি?ক্ষমা করে দাও। কেঁদোনা,প্লীজ কেঁদোনা তুমি।অসহায় লাগছে আমার,বড্ড অসহায়।
রোযার পিঠে জোরের সহিত চেপে বসলো আসমানের আঙুল,রীতিমত বাচ্চাদের মতন কাদঁছে সে।রোযার কন্ঠ ভেঙে এলো,
– দুঃখিত….দুঃখিত…..প্লীজ চাঁদ…
– মেঘ?
চমকালো রোযা।আলিঙ্গন ভেঙে আসমানের মুখ দুহাতে ধরে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত ঘটালো।তখনো কাদঁছে অমানিশা,আর বিড়বিড় করে বলছে,
– আমার….সন্তান?আমি…বাবা…?
ছন্নছাড়া শোনাচ্ছে শব্দগুলো।কিন্তু রোযার বুঝতে একটুও বেগ পেতে হলোনা।সম্মতি জানালো সে।উদগ্রীব হয়ে বললো,
– হ্যাঁ।তুমি বাবা।আমার সন্তানের জন্মদাতা পিতা।
– চাঁদ জ্যোৎস্নার সন্তান?
– হ্যাঁ,তোমার আমার সন্তান।আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন।
আসমানের সিক্ত দৃষ্টি রোযার অবয়ব বেয়ে উদরে এসে থমকালো। ঝুঁকলো সে,রোযার কোলে মাথা রেখে তার উদরে কপাল ঠেকালো।নিজের কান্না বহুকষ্টে দমন করলো রোযা,আসমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।অমানিশা উদরে অধর ছুঁইয়ে বিড়বিড় করলো,
– বলো এ মিথ্যে নয়।আমি স্বপ্ন দেখছিনা।
– মিথ্যে নয় সত্যি।তুমি স্বপ্ন দেখছোনা চাঁদ।
একটি ঢোক গিললো আসমান,প্রশ্বাস টেনে জিজ্ঞেস করলো,
– ও আমাকে বাবা, ড্যাডি কিংবা পাপ্পা বলে ডাকবে।তাইনা?ডাকবে তো?
– হ্যাঁ…. ডাকবে।
– আর তোমাকে মা,আম্মু, মাম্মাম বলবে?
– হুম।
টলটলে নয়ন থেকে অশ্রু বিসর্জন ঘটলো আসমানের, রোযার কোমর জড়িয়ে ধরে সন্নিকটে টেনে নিলো, মুখ গুঁজলো উদরে।ম্রিয়মাণ কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– ওকে তাড়াতাড়ি আসতে বলো।ধ্বং*স করুক ও আমার অপেক্ষাকে।
– আসবে আসমান,আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন খুব শীঘ্রই তোমার কোলে আসবে।
আসমানের কন্ঠস্বর প্রায় ভেঙে এলো,রোযার উদরে স্নেহ বুলিয়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– আমার অভিশপ্ত ভাগ্যকে এভাবে লাঞ্ছিত করলে তুমি?আবীর্ভূত হও,আগমনের বার্তায়ই পিতার ভাগ্যের কুচক্রকে রুখেছ তুমি,অংশ আমার।তোমার অস্তিত্বের আভায় দূরীভূত হোক সকল অশুভ,পদার্পণ করো আমার কোলে,অপেক্ষমাণ আমি,অনন্তকাল ধরে,অংশ।
আসমানের পিঠে চিবুক ঠেকালো রোযা।আবেগের গাঢ়ত্বে থরথর কম্পমান সর্বাঙ্গ তার।এ কেমন সুখ?এত আনন্দ,এত অনুভূতি,এত ভালোবাসা!সবকিছুই আজ ক্রন্দন হয়ে ঝরে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়।
দুই অস্তিত্বের অমোঘ মিলনের ফলাফলের সাক্ষী হলো আজ স্বয়ং পূর্ণিমা।
মেঘতীরে যখন রোযা এবং আসমান ফিরলো তখন রাত একটার ঘর পেরিয়েছে। উভয়ে প্রবেশ করলো নিঃশব্দে।আসমানের চোখ ফুলে রয়েছে সামান্য, তা চশমার অন্তরালে আচ্ছাদনের প্রচেষ্টায় আছে সে।অপরদিকে রোযা ধীরপায়ে হেঁটে এলো।খবরটা অবশ্যই সর্বপ্রথম আসমানকে জানিয়েছে,নিজে নিশ্চিত হয়েছে মাত্র গতকাল।বাড়ির সবাইকে বললে কেমন প্রতিক্রিয়া করবে তারা?
নিহাদকে দেখা গেলো,এই রাতেও সোফায় বসে টিভিতে মশগুল।হাতে একটি চিপসের প্যাকেট।গোগ্রাসে গিলছে,কারণ ছাড়াই,যেন কেউ হাতিয়ে নেবে তা।অপরদিকে বিলাল রেমান ডাইন ইন টেবিলে বসে একটি বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।আসমান এক নজর রোযার দিকে তাকালো।নীরব দৃষ্টি বিনিময় করে এগিয়ে গেলো বিলালের উদ্দেশ্যে।
– বাবা আমার তোমাকে কিছু বলার…..
– ড্যাড!
অতর্কিতে চারুলতার চিৎকার সকলকে চমকে দিলো।সিঁড়ির গোড়ার আড়াল থেকে হনহন করে হেঁটে এলো সে,দীঘল কেশরাশি কাঁধের দুপাশে দোল খাচ্ছে উত্তেজনার তোড়ে। বিলালের সামনে এসে থামলো সে।কোমরে দুহাত রেখে শান্ত অথচ জোরালো কন্ঠে জানালো,
– আমি রাজী,বিয়ে করবো।
বিলাল এমন অতর্কিত ঘোষণায় ভড়কে গেলো, আসমানও। রোযা এবং নিহাদ উভয়ে ভ্রু উঁচু করে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।বিলাল কন্ঠ পরিষ্কার করে বললেন,
– ভালো সিদ্ধান্ত বেইবি।পছন্দ হয়ে গিয়েছে তাহলে কাউকে?কে?প্রফেসর,বিজনেসম্যান?কাকে বিয়ে করতে চাও তুমি?
এক সেকেন্ডও দেরী করলোনা চারুলতা।সটান হাত তুলে সোফায় বসে চিপস খেতে খেতে নাটক দেখতে উৎসাহী নিহাদকে নির্দেশ করে দৃপ্ত কন্ঠে জানালো,
ডার্কসাইড পর্ব ৫৭
– আমি ওই চট্টলার পাগুলুটাকে বিয়ে করতে চাই!
– খ…ক্ষ্ক…..
নিহাদের গলায় চিপস আটকে গেলো, কাশতে আরম্ভ করলো সে গ্রীবাদেশ চেপে ধরে।অপরদিকে বাকি সকলে তার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
