ডার্কসাইড পর্ব ৬১

ডার্কসাইড পর্ব ৬১
জাবিন ফোরকান

স্থির চেয়ে রয়েছে রোযা,অন্তরে তার অনুভূতির পরিমাণ শূন্যের কোঠায়।নির্বিকার দৃষ্টি আপতিত অনির্বাণের উপর,যে এই মুহূর্তে কক্ষের একদম কোণায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্তৃত কক্ষটির মাঝখানে একটি সোফাসেট,যার সম্পূর্ণটাই দখলে রয়েছে রাশিয়ান পুরুষটির।এলিয়ে রয়েছে দিমিত্রী ভলকভ।উন্মুক্ত কয়েক বোতামে বোঝা সম্ভব, বক্ষজুড়ে তার ট্যাটু আবৃত। গ্রীবাদেশ পর্যন্ত উঠে এসেছে তা।বিশালাকৃতির এক কণ্টকাকীর্ণ গোলাপ।এ যেন তার জীবনের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি।তার রমণী এক গোলাপ,যার বৃন্তে সংযুক্ত তীক্ষ্ণ কাঁটাজাল,তবুও তাকে আঁকড়ে ধরবার অদম্য বাসনা অন্তরজুড়ে।এই বাসনার জোরেই আজ আঁধার জগতের মহারাণী তার ব্যক্তিগত শখের নারীতে পরিণত হয়েছে।

রোযার দৃষ্টি শুধুমাত্র তাদের উদ্দেশ্যেই নয়,বরং তৃতীয় একটি দিকে সতর্ক ছাপ ফেলছে। একপাশের বিছানায় বসে আছে একজন যুবতী।তার শরীরজুড়ে চওড়া বেল্টের বাঁধন,উভয় হাত আবদ্ধ হ্যান্ডকাফে।বৃত্তাকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তার মাথার চারিপাশে পাঁচ পাঁচটি পি*স্ত*ল নি*শানা করে রেখেছে দিমিত্রীর লোকজন।রোযার সঙ্গে ভয়ার্ত দৃষ্টি বিনিময় হলো তার।তৎক্ষণাৎ জোরের সঙ্গে ডানে বামে মাথা নেড়ে গোঙানি তুললো সে।রোযা একটি নিঃশ্বাস ফেলে দিমিত্রীকে মোকাবেলা করলো।স্থির কন্ঠে জানালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– সাবিহাকে ছেড়ে দিন।
দিমিত্রী যেন তাতে বিনোদিত হলো।সমুজ্জ্বল চেহারায় তার বিস্তৃত এক হাসির আবির্ভাব ঘটলো,মাথা কাত করে সোফার হাতলে আঙুল চালিয়ে অদ্ভুত এক তরঙ্গের উৎপত্তি ঘটালো সে।
– অনুভূতিই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ দূর্বলতা।
হাঁটুর উপর পা তুলে একবার অনির্বাণ এবং পরক্ষণে রোযার দিকে তাকালো রাশিয়ান বান্দা।খিলখিল করে হাসির ধ্বনি তুলে পুনরায় বললো,
– জাল ফেলে মাছ ধরা না গেলে বড়শিই কাজে দেয়।
– কি বলতে চাইছেন আপনি?
রোযার কন্ঠে ঠিক আতঙ্ক নয়,বরং ক্রোধ প্রকাশ পেলো।তাতে সন্তুষ্ট মনে হলো দিমিত্রীকে।দুবাহু বুকের উপর ভাঁজ করে সে ব্যক্ত করলো,

– ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি আইডিয়া, হাউ প্রেশিয়াস ইউ আর প্রিন্সেস!
আপাদমস্তক রোযাকে পর্যবেক্ষণ করলো রাশিয়ানের ফ্যাকাশে দৃষ্টি।সমস্ত শরীরজুড়ে এক ঘৃণার আবেশ অনুভব করলো রোযা।গলার স্কার্ফখানি অজান্তেই টেনেটুনে কাঁধের চারিপাশে জড়িয়ে নিলো।তাতে ওষ্ঠজোড়া বাঁকিয়ে সামান্য শীষ বাজিয়ে দিমিত্রী বর্ণনা দিলো,
– তোমাকে সরাসরি তুলে নেয়া কঠিন ব্যাপার ছিলো।কেনো জানো?এক নম্বর কারণ তোমার দৃশ্যমান বডিগার্ড, দুই নম্বর কারণ অদৃশ্যমান বডিগার্ড।
– অদৃশ্যমান বডিগার্ড?
কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো রোযা।তার বিস্ময় পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করে গেলো দিমিত্রী।

– ট্রেইন্ড অ্যা*সাসিন।তোমার আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায় তারা।যেখানেই যাওনা কেনো।তুমি টেরটুকুও পাওনা।
– ইউ মিন….
– রাইট! ইউ আর প্রেশিয়াস….তাই তোমার স্বামী তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো কমতি রাখেনি।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো রোযা। দিমিত্রীর স্বীকারোক্তি তার নিকট সবটাই বর্তমানে পরিষ্কার করে দিয়েছে। হাবিবের পাশাপাশি আসমান আরো কাউকে নিযুক্ত করেছে,যার কিংবা যাদের সম্পর্কে সে রোযাকেও জানায়নি।নিশ্চয়ই আলফার ঘটনার পর থেকে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে সে। রোযাকে সরাসরি অপহ*রণ করা দিমিত্রীর জন্য কঠিন হতো।কারণ, আদতেই যদি তারা ট্রেইন্ড অ্যা*সাসিন হয়ে থাকে,তবে বেশ কয়েক চোট পোহাতে হতো আর রোযাকে আয়ত্বে নেয়াও অনিশ্চিত হতো।তাই ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে দিমিত্রী।সাবিহাকে অপহ*রণ করেছে, যার সঙ্গে আদতে এইসবকিছুর কোনো সংযোগ নেই। তাকে ব্যবহার করে অনির্বাণ আহমেদকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। যেহেতু অনির্বাণ সন্দেহের বাইরে ছিল,যার সম্পর্কে ইতোমধ্যে আসমান ব্যক্তিগত তদন্ত সেরে ফেলেছে,তাই তাকে অবিশ্বাসের প্রশ্ন ছিলোনা কোনো। রোযাও খুব বেশি ভাবেনি যখন অনির্বাণ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছে।হয়ত হাবিব কিংবা অন্য গার্ডরা এখনো পর্যন্ত কল্পনা করতে পারছেনা বর্তমানে রোযা কত বড় ফাঁদে পড়ে গিয়েছে।অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং নিখুঁত এক পরিকল্পনা।

দিমিত্রীর মস্তিষ্ক এতটা সক্ষম কিনা জানা নেই,তবে সম্পূর্ণ উপলব্ধি একজনের দিকেই যেন ইঙ্গিত করছে।
রাফা কায়সার!
চকিতে অনির্বাণের দিকে তাকালো রোযা,দৃষ্টি মেলতেই তা সরিয়ে নিলো সাংবাদিক। দিমিত্রীর দিকে ফিরে রোযা বিড়বিড় করলো,
– হোটেল ইনফ্রা – রে এর প্রকৃত মালিক আপনি, তাইনা মিস্টার ভলকভ?
দিমিত্রীর চেহারাজুড়ে মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো, রোযার নয়ন থেকে একটিবারের জন্যও দৃষ্টি সরছেনা তার।তর্জনী চিবুকে ঠেকিয়ে সে বললো,

– ইউ আর আ প্রিটি লিটল ইন্টেলিজেন্ট কিটেন, আরেন্ট ইউ?
তীক্ষ্ণ ধাঁচে চেয়ে থাকলো রোযা।অনির্বাণ ইনফ্রা – রে হোটেল এবং এর রহস্যময় মালিকপক্ষ সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করেছে,ইতোমধ্যে ট্যাক্স, গ্যাম্বলিং নিয়ে রিপোর্টও প্রকাশ করেছে যার দরুণ ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখে পড়েছে কর্তৃপক্ষ। এক ঢিলে দুই পাখি হাসিল করেছে দিমিত্রীর,অনির্বাণ আহমেদ এবং রোযা দুইজনকেই বাগে আনতে সক্ষম হয়েছে।এই পরিকল্পনা আদতেই তার?নাকি রাফা কায়সারের?
সেসব এখন মুখ্য বিষয় নয়।মুখ্য বিষয়….

নজর ঘুরিয়ে পুনরায় সাবিহার দিকে তাকালো রোযা।যে এখনো পর্যন্ত মাথা নেড়ে চলেছে।যেন বলতে চাইছে, ” তুমি কিছুতেই এদের ফাঁদে পা দিওনা রোযা আপু!” কিন্তু সে হয়ত অনুধাবন করতে পারছেনা এই দিমিত্রী উদ্দেশ্য হাসিলে তাকে হ*ত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করবেনা।যদি সত্যিই তাই হয় তবে রোযা নিজেকে আর কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেনা।উহু,উৎসর্গ নয় এটি।পরিস্থিতি বুঝে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ।রোযা যদি কোনকিছুতে অস্বীকৃতি জানায়ও,অনির্বাণ এবং সাবিহাকে এখানেই হ*ত্যা ক*রে রোযাকে তুলে নিতে পিছপা হবেনা রাশিয়ান গ্যাংটি।
দুহাত কপালে ঠেকালো রোযা।তার নয়নজুড়ে উদ্ভাসিত হলো শুভ্রতার আবহ।ওই বিভীষিকার মাঝে অবর্ণনীয় সুন্দর হাসি,নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বর,বাড়িয়ে ধরা বলিষ্ঠ বাহুযুগল এবং তার উষ্ণ আলিঙ্গন।তাকে রক্ষা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তার চাঁদ।কিন্তু বর্তমানে শত্রু এক পদক্ষেপ এগিয়ে। রোযাকে অনুভূতি দিয়ে নয়,বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।আসমান নিশ্চয়ই বুঝতে সক্ষম হবে। সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রোযা সকলের অগোচরে নিজের উদর ছুঁয়ে দিলো।যেন এক মায়ের সন্তানকে সর্বাবস্থায় রক্ষা করার আশ্বাস।অতঃপর মুখ তুলে চেয়ে দিমিত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,

– আপনি নিশ্চয়ই আমাকে চান?ঠিক আছে,আমি আপনার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত।শুধু সাবিহা এবং অনির্বাণ আহমেদকে ছেড়ে দিন।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো দিমিত্রী। ধীরপায়ে হেঁটে এসে রোযার সম্মুখে ঝুঁকলো,একটি হাত বাড়িয়ে চিবুক স্পর্শ করলো তার।সেই স্পর্শে সম্পূর্ণ শরীর গুলিয়ে উঠলেও দূর্বলতাটুকু অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পেতে দিলোনা রোযা।
– দ্যাট ওয়ায দ্যা প্ল্যান অল অ্যালং।
অতর্কিতে রোযার কব্জি ধরে সজোর টানে তাকে দাঁড় করালো দিমিত্রী।নিজের লোকদের দিকে তাকালো।ইশারায় আদেশ বিনিময় ঘটলো যেন।রোযা এক পলক তাকালো সাবিহার উদ্দেশ্যে।মেয়েটির নয়ন বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত ঘটছে।মুখ ফুটে না বললেও রোযা নিশ্চিত তার পরিণতির জন্য মেয়েটি নিজেকেই দোষারোপ করছে।কিন্তু আদতে তার দোষ নেই।সে তো শুধুমাত্র এমন একজনের কাছের মানুষ,এবং এমন একজনের দূর্বলতায় পরিণত হয়েছে যাদের জীবন নাট্যমঞ্চের চাইতে কোনো অংশে কম কিছু নয়।

– সাবিহা, কেঁদো না।আমাদের আবার দেখা হবে।কথা দিচ্ছি।
গোঙানির শব্দ এলো শুধু বিনিময়ে।অনির্বাণ নিজেকে নির্বাক রাখতে সক্ষম হলোনা।উভয় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দিমিত্রীর উদ্দেশ্যে সে শুধু একটি শব্দই উচ্চারণ করলো,
– কাপুরুষ!
তাতে কোনো পরোয়া হলোনা রাফা কায়সারের স্বামীর।তীর্যক হেসে সে মাথা হেলিয়ে বিড়বিড় করলো,
– এবং তুমি?সুপুরুষ?নিজের প্রেমিকাকে রক্ষা করতে অন্য কারো শখের রমণীকে বিসর্জন দিয়েছ। দ্যা চয়েয ওয়ায ইওর’স!
স্তব্ধ হয়ে গেলো অনির্বাণ। তিরতির করে কাঁপতে থাকলো তার সর্বাঙ্গ,একটি শক্ত ঢোক নেমে গেলো কন্ঠতালু বেয়ে পাকস্থলী অবধি।রোযার উদ্দেশ্যে অসহায় দৃষ্টি ফেললো সে,তাতে অনুশোচনা, অপরাধবোধ এবং ক্ষমা প্রার্থনা।রোযার বুঝতে কিছুই বাকি রইলোনা। ঘুরলো সে,অনির্বাণের উদ্দেশ্যে তাকালো।প্রশান্ত কন্ঠে জানালো,

– আমার আপনার প্রতি কোনো খেদ নেই অনির্বাণ….
সামান্য একটু আশার উদগীরণ ঘটলো সাংবাদিকের নয়নজুড়ে।কিন্তু তা মিইয়ে গেলো রোযার অন্তিম বক্তব্যে।
– কিন্তু আমার স্বামী আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবেনা!
এটুকুই। দিমিত্রীর হ্যাঁচকা টানে রোযা হাঁটতে আরম্ভ করতে বাধ্য হলো।দরজা খুলে তার হাত শক্তভাবে পাকড়াও করে এগোলো দিমিত্রী।একে একে তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো বাকি লোকজন।রোযা অধরে অধর চেপে রইলো,পরক্ষণে আর্তনাদ তুলে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি কেনো এমন করছেন?আপনার সঙ্গে তো আমাদের কোনো শত্রুতা নেই।
– এনিথিং ফর মাই কুইন….
অশুভ কন্ঠে উত্তরটি ভেসে এলো।উপলব্ধি করলো রোযা,রাফা এবং দিমিত্রীর মাঝে আদতে কোনো পার্থক্য নেই।এই পরিকল্পনা কতটা বৃহৎ তা সে আবিষ্কার করলো হোটেলের ছাদে ওঠার পরপরই।বিস্তৃত ছাদজুড়ে হেলিপ্যাড,যাতে অবস্থান করছে একটি হেলিকপ্টার।

পার্কিং লটে গাড়ির নিকট দাঁড়িয়ে হাবিব নিজের ফোন ঘাটছে। ক্ষণে ক্ষণে হোটেলের প্রবেশপথের দিকে নজর রাখছে।ভাবছে ভেতরে যাবে কিনা।কিন্তু,কিছুটা ব্যক্তিগত স্থানও দেয়া উচিত।রোযা তাকে এখানেই থাকতে বলেছে।তবুও,কেন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে অন্তরে।এক খচখচ উপলব্ধি।একটি জিনিস ধরতে যেয়েও ধরতে পারছেনা সে।আচ্ছা,অনির্বাণ আহমেদ তাইনা?এই বান্দার সম্পর্কে ইতোমধ্যে কয়েক দফা তদন্ত সেরেছে তারা।অন্তত রেমান পরিবারের জন্য হু*মকি হিসাবে নেয়া যায়না তাকে।চিন্তার কারণ কি তাহলে?ভাবতে ভাবতে অনির্বাণের সোশাল মিডিয়া ওয়েবসাইটে ঢুকলো হাবিব।স্ক্রল করে দেখতে থাকলো সাম্প্রতিক সময়ে আপলোড করা ভিডিও, রিপোর্ট।একটি পোস্ট নজরে এলো তার,যার অন্তিম লাইনে দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে গেলো।

” পাঁচ তারকার কারসাজি…..”
মূলত কয়েকটি স্বনামধন্য পাঁচ তারকা হোটেল এবং তাদের বিভিন্ন বেআইনি কর্মকান্ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা হয়েছে।সম্পূর্ণ আলোচনায় প্রথম সারির প্রথম নামতি, “হোটেল ইনফ্রা – রে “।সর্বাঙ্গ কম্পিত হলো হাবিবের,নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো।কিন্তু সামান্যতম ক্ষেপণের মতনও সময় তার হাতে অবশিষ্ট নেই।দ্রুত গ্রুপে একটিমাত্র মেসেজ করলো সে।সকলের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ অসম্ভব।গাড়ি ছেড়ে ছুটলো হোটেলের অভ্যন্তরে।বিন্দুমাত্র পরোয়া করলোনা রিসিপশনের।তার এমন ঔদ্ধত্যে কয়েকজন কর্মচারী বাঁধা প্রদান করে বিপত্তি ঘটালে নিজের আইডি দেখিয়ে দ্রুতই কাজ সম্পাদন করতে চাইলো।উঠে গেলো এলিভেটর ধরে পনেরো তলায় পৌঁছলো।করিডোরের দৃশ্য দেখেই থমকাতে বাধ্য হলো।অনির্বাণ এগিয়ে আসছে,তার আলিঙ্গনের মাঝে রোযার বান্ধবী সাবিহা।ভীষণ দূর্বল শরীর রমণীর,তাকে ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করছে অনির্বাণ।সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো হাবিব।

– ম্যাম কোথায়?
তার কন্ঠস্বর করিডোরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো।মুখ তুলে তাকালো অনির্বাণ এবং সাবিহা।কিন্তু জবাব দেয়া সম্ভব হলোনা।এর পূর্বেই ঘড়ঘড় একটি শব্দে চারিপাশে প্রকম্পিত হয়ে উঠল।তড়িৎ খেলে গেলো হাবিবের শরীরে।এক ছুটে করিডোরের বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালো।একটি হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করেছে হোটেলের রুফটপ থেকে। বনবন করে ঘুরছে শক্তিশালী পাখা, সজোর বায়ুর ঝাঁপটায় চারিপাশে যেন ক্ষণিকের কালবৈশাখী ঘটছে।
– ড্যাম ইট!
পুনরায় এলিভেটরের দিকে ছুটলো হাবিব,এক সেকেন্ডের জন্য পিছনে ফিরল সাবিহা,অনির্বাণের উদ্দেশ্যে।জোরালো কন্ঠে জানালো,

– আপনি যান।আমরা নিরাপদ আছি।
পরোয়াও করলোনা আর হাবিব।নিচে নেমে এলো।ততক্ষণে তার এমন দৌরাত্ম্যে হোটেলের লবিতে হৈচৈ সৃষ্টি হয়েছে।সবকিছু তীব্রভাবে পাশ কাটিয়ে পার্কিং লটের গাড়িতে চেপে বসলো সে।গিয়ার ধরলো,অন্য হাতে স্টিয়ারিং, পায়ে অ্যাক্সিলারেটর। কপ্টারটি এখনো মাথার উপরেই ঘুরপাক খাচ্ছে,ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।হাবিব অনুসরণ করল সেটিকে।অনুভব করলো,তার পিছন পিছন আরো দুইটি গাড়ি কপ্টারটিকে অনুসরণ করছে।ক্রমশ স্পিডমিটারের কাটার ঘূর্ণন জানান দিলো অস্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে হাবিব।মুক্ত গগনে বিচরণ করা কপ্টারটিকে এই যানবাহনপূর্ণ সড়ক ধরে অনুসরণ করা প্রায় অসম্ভব।দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে হুহু করে।তবুও হাল ছাড়বার পাত্র নয় সে।কানে এয়ারপিস গুঁজে সিগন্যাল অন করে সে বাকি অ্যা*সাসিনদের আদেশ করলো,

– কিপ টেইলিং, নো ম্যাটার হোয়াট!
হাবিবের বক্তব্য শেষ হতেই ঘটলো ঘটনাটি।অতর্কিতে ক্ষীপ্র গতিতে কিছু একটা ছুটে এলো যেন।গাড়ির জানালার কাচে আ*ঘা*ত হা*নলো,প্রতিক্রিয়া স্বরুপ মাথা নুইয়ে ফেললো হাবিব।ঝরঝর করে কাচভাঙার শব্দ।অতঃপর হতবিহ্বল হয়ে সে আবিষ্কার করলো তার ঠিক পাশেই প্যাসেঞ্জার সিটের গদিতে গেঁ*থে আছে, বু*লেট!কপ্টার থেকে গু*লি ছোঁ*ড়া হচ্ছে!হিমশীতল আবেশে ছেয়ে গেলো হাবিবের সর্বাঙ্গ।বনবন করে ঘোরালো স্টিয়ারিং,তাদের জন্য সড়কের বাকি যানগুলোও আ*ক্রান্ত হবে।এটাই কি চায় শত্রুপক্ষ?
যদি তাই চেয়ে থাকে, তবে তারা সফল।

মেঘতীর।
ফার্স্ট এইড কিট থেকে ব্যান্ডেজ এবং অ্যান্টিসেপ্টিক বের করছে চারুলতা।অপরদিকে কাউন্টারের কাছে থাকা নিহাদ আসমানের তর্জনী আঙুলটি সাবধানে ধরে রেখেছে।মাত্রই একটি দুর্ঘ*টনা ঘটে গিয়েছে। বাসমতী পোলাও করতে চেয়েছিল আসমান।প্রয়োজনীয় উপকরণ কা*টাকুটি করবার সময় অতর্কিতে ধা*রালো ছু*রির প্রান্তে আঙুল কে*টে যা*য় তার।তাতে বাকিরা চিন্তাগ্রস্ত এবং বিস্মিত বটে।এর পূর্বে কোনোদিন আসমান কিচেনজনিত কাজে দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়নি।
অতি যত্নে তার আঙুলের ক্ষতে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে চারু বিড়বিড় করলো,

– দেখেশুনে কাজ করতে পারিসনা?মনোযোগ কোথায় থাকে তোর?
জবাব এলোনা আসমানের পক্ষ থেকে।নির্বিকার চেয়ে আছে সে।সামান্যতম বেদনার অনুভূতিটুকুও নেই।আপন চিন্তায় বিলীন সে।বিনা কারণেই অস্থির লাগছে তার।অন্তর কেমন ছটফট করছে।সকাল থেকেই কোনো কাজে মনোযোগ বসাতে পারছেনা।কোম্পানিতে গিয়েছিল,কিন্তু মিটিং ক্যানসেল করে ফিরে এসেছে।তার এই অস্থিরতা অবশ্য অন্য কেউ টের পায়নি।বাহ্যিক অবয়বে কোনোদিনও তার নির্বিকারতা ব্যতিত ঔদ্ধত্যপূর্ণ কিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটেনা।কিন্তু অভ্যন্তরে চলমান ঘূর্ণিপাক আসমান উপেক্ষা করতে পারছেনা।মানসিক সংযুক্তি রয়েছে তার রোযার সঙ্গে।তবে এই অস্থিরতা কি তার প্রেয়সীর কারণে?রোযা কি এমন কিছুর মাঝ দিয়ে যাচ্ছে যাতে সে ভীষণ অস্থির হয়ে আছে?দুশ্চিন্তায় কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না থাকার দরুণ এই ঘটনা বাঁধিয়েছে সে।আসমানের আঙুলে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে কাজ সমাপ্ত করে চারুলতা জানানো,

– যাহ,বিশ্রাম নে তুই।আমি করছি আজ রান্না।
আসমান উত্তর করলোনা।চুপচাপ হলঘরে এলো।যেন সে এখানে থেকেও তাদের মাঝে নেই,ভিন্ন এক জগতে বিচরণ করছে,এমন অনুভূতি হলো চারুলতা এবং নিহাদের। উভয়ে দৃষ্টি বিনিময় করলো।তারপর মাথা দুলিয়ে নিহাদ এগোলো,পিছন থেকে হাত রাখলো আসমানের কাঁধে।
– ভাই,তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?
ঠিক ওই মুহূর্তেই কলিং বেলের মৃদুমন্থর মিষ্টি আওয়াজ ধ্বনিত হলো মেঘতীরের বিস্তৃত হলঘরজুড়ে।নিহাদ এগোলো।দরজা খুলে দিতেই ওপাশের দৃশ্য নজরে এলো সকলের।সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে পড়লো প্রত্যেকে।
অপরপ্রান্তে দন্ডায়মান শাড়ি পরিহিতা এক রমণী। সর্বাঙ্গজুড়ে তার নিকষ কালো বর্ণের বস্ত্রটি জড়ানো।স্বচ্ছতার অন্তরালে অবয়বের অনেকটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে দারুণভাবে। কেশরাশি পিঠ ভাসিয়ে কাঁধের চারিপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। সুদর্শনার চেহারাজুড়ে টকটকে এক সাজসজ্জার আবহ, অধরে গাঢ় লাল লিপস্টিক।কন্ঠ এবং হাতের কব্জিতে প্রজ্জ্বলিত অলংকার অবলোকন করে বুঝতে বাকি নেই যে তা হীরার তৈরী।অসহনীয় এক প্রভাব তার অস্তিত্বজুড়ে।কারণ সে স্বয়ং রাফা কায়সার!

ধীরপায়ে মেঘতীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো রাফা।পরিধানের পাঁচ হিঞ্চি হিলজোড়ার শক্ত সোলের ঠকঠক আওয়াজ যেন কানে অসহ্যকর ঠেকছে।চারিপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছে রমণী।বাড়িটির প্রত্যেকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু পর্যবেক্ষণ করছে,বিশ্লেষণ করছে মস্তিষ্কের মাঝে।নিরেট নিটল হয়ে চেয়ে রইলো সকলে।অত্যন্ত সতর্ক প্রত্যেকের অভিব্যক্তি।কিচেনে চারুলতার হাত চেপে বসলো চাপা*তিতে, দরজার সামনে নিহাদ দেয়ালে সংযুক্ত ধাতব তলো*য়ার সদৃশ বস্তুটির সন্নিকটে সরলো, মূলত শো পিস হলেও অ*স্ত্র হিসাবে ব্যবহার সম্ভব।যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি তাদের।এতটাই উদ্বিগ্নতা তুলেছে তাদের অন্তরে এই রাফা কায়সারের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব,যাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব।

একমাত্র আসমান সম্পূর্ণ নির্বিকার রয়েছে।একটি হাত ট্রাউজারের পকেটে ভরে স্থির চেয়ে আছে সে। রাফার অবয়ব থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরছেনা তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ।সোফা ঘুরে বরাবর সামনে এসে থমকালো রাফা।আশপাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চাইলো আসমানের উদ্দেশ্যে।ভ্রু জোড়া উঁচু হলো মুগ্ধতায়,অবলোকন করলো সে আসক্তিকে আপাদমস্তক।

হাফহাতা ঢোলা ফতুয়া এবং ট্রাউজার পরিধানে আসমানের। বাহুর অর্ধাংশ উন্মুক্ত থাকায় শক্তিশালী মাংসপেশীর গাঁথুনি স্পষ্ট নজরে পড়ছে।ভি নেক কলারের অন্তরালে বুকের উপরাংশে আচ্ছাদিত তীক্ষ্ণ হাড়ের মাঝে নজর আবদ্ধ হয়ে পড়ল রাফার। কলারবোন,তার প্রধান দূর্বলতা।মুখ মাস্কে আবৃত নয়।তাতে অধরের দুপাশজুড়ে দগদ*গে সেলাইয়ের দাগ রাফার চিত্তকে যেন কামনাগ্নিতে দ*গ্ধ করে চলেছে।এবং ওই শুভ্রতা।অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে ঔজ্জ্বল্যের ত্বকজুড়ে রোমকূপের মাঝে মাঝে অনুভূতি খচিত যেন।সম্পূর্ণ সম্মোহিত রাফা।
আসমানের ইচ্ছা হলো কোনো পর্দার অন্তরালে সে নিজেকে আচ্ছাদিত করে ফেলে।কিন্তু জোরপূর্বক আপন চিত্তের সঙ্গে মোকাবেলা করলো সে।দূর্বলতা ধ্বংস ডেকে আনে।মাথা নত করা অসম্ভব।

– হোয়াট আ ডিভাইন ক্রিয়েচার ইউ আর!
আঁধাররাণীর মন্তব্যে ঘৃণা অনুভূত হলো অন্তরে।কিন্তু বেপরোয়া রাফা তাতে আগ্রহী নয়। হাত বাড়িয়ে সে আসমানের বাহু স্পর্শ করলো,ত্বকের মাঝে নিজের তীক্ষ্ণ নখর সম্বলিত আঙুল বুলিয়ে আনলো।আহ,যদি আঁচড় দেয়া সম্ভব হতো,তবে কতই না চমৎকার হতো বিষয়টি!
– বয়স যত বাড়ছে,তত প্রস্ফুটিত হচ্ছো তুমি।ইউ আর এজিং লাইক আ ফাইন ওয়াইন!
তৎক্ষণাৎ এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে এক পা দূরে সরে দাঁড়ালো আসমান।যে স্থানে রাফা ছুঁয়ে দিয়েছে,সেখানে যেন ত্বকজুড়ে এক অসহ্যকর জ্বলুনি হচ্ছে তার।ইচ্ছা হলো ঘষেমেজে ওই স্পর্শের বিলীন ঘটাতে।কিন্তু বর্তমানে তা দূর্বলতা প্রদর্শনের সামিল।খিলখিল করে হাসলো রাফা।তারপর নিজের শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে এনে ভ্রু দুলিয়ে শুধালো,

– এই দেখো।জীবনে প্রথমবার শাড়ি পড়েছি।তোমার ভালো লাগে তাইনা?কেমন লাগছে আমাকে?
– বিশ্রী নর্দমার কীটের মতন।
জবাব প্রদানে এক সেকেন্ডও সময় নিলোনা আসমান।তাতে সামান্যতম বিস্ময়ও প্রদর্শিত হলোনা রাফার চেহারায়।প্রফুল্ল সে,যেন ভৎসর্ণা নয় প্রশংসা লাভ করেছে আপন আসক্তির তরফ থেকে।
– নর্দমার কীট? হাহা….খারাপ নয়। কিন্তু তোমাকে আমার কাছে কেমন লাগে জানো?
হাত বাড়িয়ে আসমানের কপোলে ছুঁয়ে দিতে চাইলো রাফা,কিন্তু পিছিয়ে গেলো অমানিশা।নিজের অস্তিত্বে এই অপবিত্রতা সহ্য করতে রাজী নয় সে। তাতেও দমলোনা রাফা,হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে জানালো,
– একটি ভাস্কর্যের মতন।যে ভাস্কর্যের ভাস্কর আমি স্বয়ং।আমার হাতে একটি কাঠের কলম,যা দিয়ে এই তুলতুলে ভাস্কর্যকে আমি ইচ্ছামত রূপ দিতে সক্ষম।

এগোলো সে, ঊর্ধ্বপানে মাথা তুলে নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বরে আপন আঁধার মিলিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বললো,
– এই ভাস্কর্যের মাটি শক্ত হয়ে গিয়েছে।সামান্য একটু পানি ছিটিয়ে দিলেই পুনরায় কাদা হয়ে আসবে।সেই কাদামাটিতে আমি আমার মর্জি ফলাবো,রাঙিয়ে তুলবো নব্য অনুভবে।
আসমানের অধর সামান্য কুঞ্চিত হলো, অবোধ্য এক অনুভূতির দেখা মিললো,যা খুব সম্ভবত হাসি হিসাবে ধরা সম্ভব। ঝুঁকলো অমানিশা, রাফার নিকটে সরে গাম্ভীর্যপূর্ণ ভারিক্কি এক আবেশিত কন্ঠে জানালো,
– আমার অস্তিত্বের ভাস্কর?হাহা….আফসোস কায়সার।যে পরাশক্তিরাজের রাজত্বে শুধুমাত্র জ্যোৎস্নার হুকুম চলে,সে রাজ্যে তুমি দাসী হওয়ারও যোগ্য নও।

সর্বাঙ্গ কম্পিত হলো রাফার।আসমান তার গর্ব গুঁড়িয়ে দিয়েছে এক লহমায়।বহু কষ্টে সে নিজেকে উদগীরণ করা থেকে নিবারণ করলো।তারপর সামান্য হেসে বললো,
– জ্যোৎস্না? তা কোথায় তোমার রাজত্বের মহারাণী জ্যোৎস্না?
আসমান আগ্রহ হারিয়ে উল্টো ঘুরছিলো কিন্তু রাফার এই কথায় জমে গেলো।চকিতে পিছন ফিরে তাকালো। দৃষ্টিজুড়ে তার নির্বিকারতার বদলে এক প্রজ্জ্বলন ফুটে উঠলো।তড়িৎ গতিতে তার হাত পাকড়াও করলো রাফার গ্রীবাদেশ।রমণী শুধু চেয়ে থাকলো,কোনো বাঁধা দিলোনা।আসমানের বজ্রকন্ঠ ধ্বনিত হলো,

– রোযা….কোথায়?
উত্তরে শুধু তীক্ষ্ণ হাসির উদগীরণ ঘটলো।অগ্নুৎপাত ঘটালো তা আসমানের হৃদয় অঙ্গনে।তার হাতটি উভয় হাতে শক্তভাবে চেপে ধরলো রাফা,যেন চায় তাকে আরও আ*ঘা*ত করুক আসমান।
– হুম….কোথায় বলো তো?
– কায়সার….
কম্পিত হলো আসমানের কন্ঠস্বর,নিঃশ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো।একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো সে, অ্যাডামস অ্যাপেলে ঢেউ খেলিয়ে তা নিম্নপানে ধাবিত হলো। দৃশ্যটি অবলোকন করলো রাফা,আপনমনে জিভ দিয়ে টকটকে অধর নিজের ভিজিয়ে নিলো।

– কুল ডাউন।আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি তোমার জ্যোৎস্নার খোঁজ কোথা থেকে পাবে….. চাঁদ?
চাঁদ — যে সম্বোধনটি আসমানের অন্তরকে প্রতিবার আবেগে ভাসিয়ে তোলে,আজ সেই সম্বোধনই বি*ষাক্ত ফলার ন্যায় বি*দ্ধ হলো অন্তরজুড়ে। রাফার নিকট থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো আসমান।ট্রাউজারের পকেটে ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো তার।তৎক্ষণাৎ তা বের করে দৃষ্টিপাত করলো স্ক্রীনে।হাবিবের মেসেজ ভেসে উঠেছে।
পিনপতন নীরবতা।

এক….দুই… তিন… চারটি বাকরুদ্ধ সেকেন্ড।
হাঁটু ভেঙে এলো আসমানের।ধপাস করে বসে পড়লো মেঝেতে, রাফার সামনেই।দৃষ্টি তার আবদ্ধ ফোনের স্ক্রীনজুড়ে।অভিব্যক্তি শূণ্য।শুধুমাত্র দৈহিক কম্পন অনুভূতিহীনতার বিপক্ষে কাজ করছে।কিচেন থেকে চারুলতা এবং দূর থেকে নিহাদ ছুটে এলো।

– আসমান ভাই….
– হস্তক্ষেপ করোনা।
রাফার একটি হাত উত্তোলনে সহসাই থমকে যেতে বাধ্য হলো নিহাদ এবং চারু।নিজেরাও অনুধাবন করলোনা ঠিক কেনো এই রমণীর আজ্ঞা পালন করছে তারা।কিন্তু পরিস্থিতির গুরুতর চাহিদা তাদের স্থবির করে দিয়েছে।স্বয়ং অমানিশা এই রমণীর পদসম্মুখে নতজানু।কতটা প্রগাঢ় প্রভাব এই অশুভতার।সম্পূর্ণ একলা এই বাঘিনী এসেছে শত্রুর ডেরায়,আপন জীবনের প্রতি এতটাই বেপরোয়া নাকি সে?

নিহাদ এবং চারুর প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্ট হয়ে রাফা সামনে ফিরলো।আসমান নিশ্চল হয়ে আছে,মেঝেতে দুহাত ঠেকিয়ে কোনো এক জগতে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।হিল পরিহিত পা তুললো রাফা,ঠেকালো আসমানের বুক বরাবর।যেন আপন দাসকে অতি অবহেলায় ছুঁয়ে দিচ্ছে।র*ক্ত চ*ড়ে গেল নিহাদের মস্তিষ্কে,চারুর হাত থেকে ছু*রি কে*ড়ে নিয়ে সে এগোচ্ছিল কিন্তু প্রেয়সী তাকে আটকে দিলো। “উত্তেজনার বশে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মানেই পতন ” —উচ্চারণ না করলেও চারুলতার নয়নজুড়ে খচিত বাক্যটি বুঝতে নিহাদের অসুবিধা হলোনা। দাঁত দিয়ে অধর চেপে সে নিবারণ করলো নিজের অফুরন্ত ক্রোধ।

আসমান নির্বিকার। রাফার ঔদ্ধত্য তাকে বিচলিত করেনি যেন।শুধুমাত্র মুখ তুলে তাকালো সে।হিলের প্রান্ত কাঁধে এসে পৌঁছলো তার।একটিবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো শুধু অমানিশা।
– ইউ আর মাই টয়,অনলি মাইন।আন্ডারস্ট্যান্ড?
শূন্যতা।হিমালয়ের মাঝে হিমশীতলতার চাদর।তাতে রাফা ক্রোধান্বিত হলো।সে চায় আসমান চিৎকার করুক, তাকে হুম*কি দিক,আ*ঘাত করুক, অন্তত কিছু একটা করুক!কিন্তু অমানিশার নির্বিকারতা তাকে ক্রমেই সহ্যসীমার চূড়ান্তে ঠেলে দিচ্ছে।আসমানের যন্ত্রণা উপলব্ধি করার সুতীব্র বাসনা তাকে আজ প্রথমবারের মতন রেমানদের ডেরায় টেনে এনেছে।কিন্তু এই অনুভূতিহীনতা অভিশাপের মতন বর্ষিত হচ্ছে তার অস্তিত্বে।আসমান হেরে গিয়েছে।কিন্তু হেরে গিয়েও যেন জিত হাসিল করে নিয়েছে।এই উপলব্ধি প্রশান্তি দিলোনা রাফাকে। ঝুঁকলো সে,আসমানের চিবুক স্পর্শ করলো অতি জোরের সঙ্গে।

– পালতু কুকুরের কাজ গোলামী,রাজত্ব করা নয়। যত নিজের ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবে,তত প্রগাঢ়ভাবে তোমাকে আঁকড়ে ধরবে তা।
আরো একটু ঝুঁকলো আপন আঁধার জগতের মহারাণী।তীর্যক হেসে ঘোষণা করলো,
– আমি এমন এক চোরাবালি যার কবল থেকে তোমার কোনো মুক্তি নেই, শুভ্রতা। মুক্তির আশায় যত ছটফট করবে,চোরাবালির তত গভীরে ডুবে যাবে।
আসমানকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেলো রাফা।পরিতৃপ্তির হাসি তার টকটকে অধরে।
– তোমার অপেক্ষায় থাকবো শুভ্রতা,ইউ নো হোয়্যার টু ফাইন্ড মি,ডোন্ট ইউ?
এটুকুই।উল্টো ঘুরল রাফা।ঠিক যেমন টর্নেডো হয়ে আগমন ঘটেছিল তার,তেমনি তাণ্ডব চালিয়ে প্রস্থান ঘটলো দ্রুতই।শুধুমাত্র গটগটে হিলের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে গেলো দীর্ঘ সময়জুড়ে।

অতঃপর আবারো নীরবতা।
আসমান মেঝেতেই বসে থাকলো।নড়চড় নেই তার অবয়বে।নিহাদ এগোলো।কোনকিছু জিজ্ঞেস না করেই আসমানের ফোনটি তুলে নিলো।স্ক্রীনে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো। ভ্রুজোড়া তীব্র কুঞ্চন ধারণ করলো তার। সোফায় এলানো জ্যাকেটটি শরীরে জড়িয়ে কাউকে কোনকিছু না বলে দ্রুত পদক্ষেপে সে বেরিয়ে গেলো বাইরে।
– নিহাদ….কোথায় যাচ্ছো?
জবাব এলোনা চারুলতার প্রশ্নের।প্রিয়তম আড়াল হয়েছে দৃষ্টিসীমার।একবার বাইরের পথে,এবং তারপর অভ্যন্তরে আসমানের দিকে তাকালো সে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে হৃদয়।কি করবে সে?

সন্ধ্যাবেলা।
নৈঃশব্দ্য। মেঘতীরজুড়ে আজ নীরবতার রাজত্ব।সোফায় বসে আছে হাবিব এবং কয়েকজন।প্রত্যেকের অবস্থাই নাজেহাল।ব্যান্ডেজ শরীরজুড়ে।ছোটখাট কিছু ক্ষত দেখা যাচ্ছে হাতের কব্জি, কাঁধ এবং গ্রীবাজুড়ে।প্রত্যেকে মাথা নত করে রয়েছে।সামনে বসে আছেন বিলাল রেমান।একপাশে বুকে দুবাহু ভাঁজ করে দন্ডায়মান চারুলতা।অপরদিকে চেহারায় অব্যক্ত অভিব্যক্তি নিয়ে দাঁড়ানো নিহাদ।আসমানের অস্তিত্ব নেই কোথাও।
দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কাটলো।তারপর হঠাৎই ধৈর্য্য হারিয়ে নিহাদ এগোলো।অতর্কিতে হাবিবের কলার চেপে ধরলো, সজোর টানে ঝাঁকিয়ে হুংকার তুললো,
– হাউ ডিড ইউ লেট দিস হ্যাপেন?
অপরাধবোধে মাথা নত করে নিলো হাবিব।বাকিদের উদ্দেশ্যে তাকানোরও প্রয়োজন হলোনা।তারা সোফা ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়লো হাঁটুমুড়ে।একেকজন যুদ্ধ ফেরত ব্যর্থ সৈনিক যেন।বিলাল রেমানের কন্ঠস্বর নিহাদকে থামতে বাধ্য করলো।

– শান্ত হও নিহাদ।দোষারোপের সময় নয় এটি।
হাবিবকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো নিহাদ।কোমরে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলো।আরো একবার কলিং বেলের আওয়াজে ভড়কে গেলো সকলে। বিশেষ করে চারু এবং নিহাদ।সকালে রাফার আগমন স্মরণে এসেছে তাদের।এবার চারুলতা এগিয়ে গেলো সাবধানে, দরজা খুলতেই আরো এক দফায় বিস্মিত হতে হলো তাকে।বিপরীত প্রান্তে দন্ডায়মান অনির্বাণ আহমেদ এবং সাবিহা।

– তো….তোমরা?
– ভেতরে আসতে পারি?
সাবিহার প্রার্থনায় পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো চারুলতা।অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো তারা। মেঘতীরের পরিস্থিতি তাদের মাঝে যেন এক প্রকার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলো।সাবিহা বিনা কারণেই সামান্য কাঁপতে লাগলো।অনির্বাণ তার কাঁধে একটি হাত চেপে সামনে এগোলো।সিঁড়ির উদ্দেশ্যে তাকালো।নিজের কন্ঠ স্থির রেখে বিড়বিড় করলো,
– মিস্টার নীল…..
এতক্ষণ যাবৎ ঘটনাবলীর কারণে বাকিরা খেয়ালই করেনি কখন আসমান দোতলার সিঁড়ির উপরে এসে দাঁড়িয়েছে।সকলের দৃষ্টি তার উপর আপতিত হলো।স্থির দন্ডায়মান অমানিশা। কালো সার্জিক্যাল মাস্কে আবৃত চেহারা নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বর ম্রিয়মাণ করতে ব্যার্থ।প্রজ্জ্বলিত তা।অমানিশার হাতে একটি কালো বর্ণের টেডি বিয়ার,যেটি পাঁচ আঙুলের মাঝে শক্তভাবে আঁকড়ে রেখেছে সে।অনির্বাণ আরো এক পা এগোলো, আসমানের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলতে গেলো,

– রোযাকে খুঁজতে আমি আপনাকে সাহায্য……
বাক্যটি সম্পূর্ণ করা সম্ভব হলোনা।এক পলকের ব্যবধানে ক্ষীপ্র গতিতে আসমান সিঁড়ির ধাপ টপকে এলো।যেন বিদ্যুতের সঙ্গে দৌড়পাল্লায় নেমেছে।অনির্বাণ বুঝতেও পারলোনা কি হচ্ছে।তার পূর্বেই আসমানের মুষ্টিবদ্ধ হাত আছ*ড়ে পড়লো তার চোয়াল বরাবর।ছিটকে গেলো সে মেঝেতে।তৎক্ষণাৎ মুখে র*ক্তে*র নোনতা ধাতব স্বাদ টের পেলো।শুধুমাত্র এক তীব্র গুঞ্জন টের পাওয়া সম্ভব হলো অসম চিত্তে।আসমান তার কলার টেনে ধরে মেঝে থেকে তুললো, ঘাড়জুড়ে নিজের একটি হাত জড়িয়ে সজোরে ঠু*ক*লো পাশের থামে।
– আ’ম গনা কি*ল ইউ।
অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত হলো অমানিশার ঘোষণাপত্র।স্তব্ধ হয়ে সেই দৃশ্যপটে চেয়ে থাকলো প্রত্যেকে।
ধ্বংসযজ্ঞ।
এক মহা ধ্বংসযজ্ঞ আসন্ন।

– আসমান ভাই?
নিহাদ ছুটে গেলো আসমানকে রোখার উদ্দেশ্যে,কিন্তু গুরুর পক্ষ থেকে এক পলক তীব্র দৃষ্টিই যথেষ্ট ছিল পিছপা হতে। রুদ্রচিত্ত আসমান,যে চিত্তকে মোকাবেলার সাধ্য বর্তমানে কারো নেই। অনির্বাণকে ডাইন ইন টেবিলের উপর আ*ছড়ে ফেললো আসমান, ঘাড় চেপে ধরে আবদ্ধ রাখলো।বেচারা অনির্বাণের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ,তীব্র য*ন্ত্রণা হচ্ছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জুড়ে।দপদপ করছে মস্তিষ্ক।কপাল বেয়ে গড়াতে থাকা উষ্ণ র*ক্তের ধারা স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে।

– ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ!
আসমানের কন্ঠস্বরে ঝটকা দিয়ে উঠলো অনির্বাণ, তবুও নিজেকে ছাড়াতে সক্ষম হলোনা।তীব্র অনুশোচনায় চিৎকার করে উঠল,
– হ্যাঁ আমি কাপুরুষ!আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন আপনি?যদি আপনার স্ত্রীকে একইভাবে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কেউ এমন কোনো কাজ করতে বাধ্য করতো?
– আর যাই হোক নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় ভীরুতার পরিচয় দিতাম না…..
ঝুঁকলো আসমান,অনির্বাণের কানের নিকট মৃদু কন্ঠে জানালো,
– আমি লড়াই করতে জানি।

এটুকুই।অনির্বাণের গ্রীবাদেশজুড়ে জড়িয়ে গেলো তার বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন।সম্পূর্ণ বাকশক্তি লোপ পেলো বান্দার,সঙ্গে শ্বাস প্রশ্বাসের ক্ষমতাও।দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকলো।সজোরে তাকে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো আসমান।পা উত্তোলন করে যেই না জোরালো আ*ঘা*ত হা*নতে যাবে ঠিক তখনি মাঝখানে দুহাত তুলে এসে দাঁড়ালো সাবিহা।
– প্লীজ ভাইয়া….
স্থবির হলো আসমান।প্রেমিকের তরে দূর্বার ঘূর্ণিপাককে থামাতে উদ্যত রমণীর নয়নের অশ্রু তাকে মুহূর্তের জন্য চৈতন্যহারা করলো। ক্রোধটুকু মুষ্টির মাঝে আবদ্ধ করে ফেললো।সাবিহা যথাসম্ভব স্বাভাবিক কন্ঠে বলার চেষ্টা করলো,

– আমি জানি ভাইয়া।অনির্বাণ যা করেছে,তার কোনো ক্ষমা হয়না।তবুও,এই বোনটা আপনাকে অনুরোধ করছে, ক্ষমা করুন।একটিবার শুধু।
ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে তীব্র দৃষ্টিতে একবার সাবিহা,অতঃপর মেঝেতে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসা অনির্বাণের দিকে তাকালো আসমান।ছেলেটার বিদ্ধস্ত অবয়ব লক্ষ্য করলো,র*ক্তা*ক্ত মুখমন্ডল, যা তার ক্রোধের পরিণাম।সাবিহায় দৃষ্টি ফিরলো।মাথা ঘুরিয়ে ফেললো আসমান,বাম হাতে ধরে রাখা টেডি বিয়ারটি বুকে আগলে নিয়ে বললো,

– তুমি জানোনা মেয়ে এই হৃদয়ে কেমন অনুভূতি হচ্ছে!
স্তব্ধ হয়ে থাকলো সাবিহা,কান্নার দমক উঠলো, জোরপূর্বক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো।নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে তার।আসমান উল্টো ঘুরলো,দৃপ্ত কণ্ঠে আদেশ করলো,
– গেট আউট ফ্রম মাই সাইট,বিফোর আই কি*ল হিম!
এটুকুই।ঠিক যেমন ঘূর্ণিঝড় হয়ে আসমানের পদার্পণ ঘটেছিল,তেমনি মেঘপুঞ্জের অন্তরাল থেকে সদ্যমুক্ত আকাশের প্রশান্তি তৈরি করে সে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় আড়াল হয়ে গেলো।নিস্তব্ধতা নেমে এলো সম্পূর্ণ হলঘরজুড়ে।নিজের অশ্রু মুছে মেঝে থেকে সাবধানে অনির্বাণকে তুললো সাবিহা।ওড়না দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরলো।তৎক্ষণাৎ চারুলতা এগিয়ে জানালো,

– আমি ফার্স্ট এইড কিট নিয়ে আসছি।
– ইটস ফাইন।
হাত তুলে তাকে নিবারণ করলো অনির্বাণ।দীর্ঘ প্রশ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করলো সে। রেমান পরিবারের মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে তাকালো।
– আপনাদের কাছে কিছু বলার মতন মুখ আমার নেই।তবুও বেহায়ার মতন বলছি।যদি সম্ভব হয়,কোনোদিন আমাকে ক্ষমা করে দেয়ার চেষ্টা করবেন।
কেউই কোনো জবাব দিলোনা।শুধু স্থির তাকিয়ে রইলো।এটুকুই যথেষ্ট,অধিক কোনো প্রতিক্রিয়া কিংবা সত্যিকারের ক্ষমা অনির্বাণ আশা করেনা।সাবিহার হাতটি নিজের মুঠোয় পুরে সে বিড়বিড় করলো,

– চলো সাবিহা।
দুজন বাইরের উদ্দেশ্যে হাঁটতে আরম্ভ করতেই এক পা অগ্রসর হলো নিহাদ।তার কন্ঠে উচ্চারিত হলো একটি প্রশ্ন,
– আপনি কি হোটেল ইনফ্রা – রে এবং দিমিত্রী ভলকভ সম্পর্কিত তদন্ত বন্ধ করে দেবেন?
থমকালো অনির্বাণের পদক্ষেপ।পিছন ফিরে তাকালো। ক্ষ*তপূর্ণ অবয়বেও দূর্বলতার অস্তিত্ব পাওয়া গেলনা।শুধুমাত্র এক সুতীব্র বিষাদ এবং অনুশোচনার অনুভূতি।মাথা হেলিয়ে সামান্য হেসে অনির্বাণ জানালো,
– না।
নিহাদের চেহারায় অব্যক্ত এক অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটলো যা চারুলতা ব্যতীত আর কারো বোধগম্য হলোনা।এগোলো নিহাদ,নিজের একটি হাত বাড়িয়ে ধরলো।

– আপনার ফোনটা দিন।
অনির্বাণ এবং সাবিহা একে অপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলো।তবে অধিক না ভেবে শখের সাংবাদিক নিজের ফোন বের করে নিহাদের হাতে তুলে দিলো। মিনিটখানেক সময় নিয়ে কাজ সেরে ডিভাইসটি ফিরিয়ে দিয়ে নিহাদ বিড়বিড় করলো,
– এটা আমার নম্বর। রোযাকে খুঁজতে আপনার সূত্র আমাদের কাজে লাগতে পারে।ইউ বেটার কো অপারেট!নীল ভাইকে বলার দরকার নেই,যা হবে আমার সঙ্গে।অলরাইট?
একটি ছোট্ট স্বস্তির নিঃশ্বাস নির্গত হলো অনির্বাণের বুক থেকে।মৃদু কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– থ্যাংক ইউ।

স্রোতের শব্দ।
সমুদ্রতীরে উথলিত ঢেউয়ের কলতান। আছড়ে পড়ছে বালুচরে।আবারো ফিরে আসছে সাগরে, ধূলোয় ধূসরিত হয়ে। অদূর থেকে পাখিদের কুহুতান ভেসে আসছে।তার সঙ্গে একত্রিত হয়েছে চিরচিরে বায়ুপ্রবাহের আখ্যান।এক স্বর্গীয় লীলা যেন। যতদূর দৃষ্টি যায়, জনমানবের চিহ্ন নেই। তট মিলিয়েছে দিগন্তে,যেখানে রাজত্ব অস্তমিত দিবাকরের।
মিটমিট করে দৃষ্টি মেললো রোযা।অনুভব করলো সম্পূর্ণ শরীর তার অবশ হয়ে রয়েছে।বিন্দুমাত্র শক্তি নেই যেন অ*ঙ্গ প্র*ত্যঙ্গে।এক অদ্ভুত দোলাচলে কাপছে তা,খুবই ধীরগতিতে।কখনো বামে,কখনো ডানে।দুলুনিতে শরীর গুলিয়ে উঠলো।মুখ চেপে ধরে কনুইয়ে ভর দিয়ে নিজের শরীর উত্তোলন করলো রোযা।আশেপাশে তাকালো।নিজেকে আবিষ্কার করলো একটি আবদ্ধ কক্ষে।

ঠিক কক্ষ নয়।কেবিন বলা শ্রেয়।কারণ সমগ্র দেয়াল ধাতব।একটি বিছানা,টেবিল,মেঝেতে সংযুক্ত ধাতব চেয়ার ছাড়া তেমন কিছু নজরে আসছেনা। একপাশের দেয়ালে গোলাকৃতির এক জানালার মতন,যার পাশে ঝুলছে একটি লাইফবয়া।বিস্মিত হলো রোযা।নিজের মাথা চেপে ধরলো।স্মরণে আনার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে,কোথায় ছিল।হোটেল ইনফ্রা – রে থেকে হেলিকপ্টারযোগে যাত্রা পর্যন্ত স্মরণে আছে।কিন্তু এরপর? স্মৃতিগুলো কেমন ধোঁয়াশা।অ*জ্ঞান করা হয়েছিল তাকে?

কিংবা কোনো ড্রা*গস দেয়া হয়েছে?কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা।কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে এক ভিন্ন জগতের মাঝে নিয়ে এসেছে তাকে দিমিত্রী।ধরাছোঁয়ার বাইরে।তেমনটা করাই যুক্তিযুক্ত।
বহু কষ্টে নিজের শরীর টেনে বিছানা থেকে নামাতেই রোযা লক্ষ্য করলো টেবিলের উপর নতুন কিছু পোশাক এবং খাবার রাখা আছে।রসিকতা করা হচ্ছে তার সঙ্গে?অত্যন্ত ক্রোধে খাবারের প্লেট ছুঁড়ে দিতে গিয়েও দিলোনা।নিবারণ করলো ক্রোধকে।কিন্তু তাতে হাত দিলোনা।কেবিনের দরজার দিকে এগোলো।প্রায় নিরানব্বই ভাগ নিশ্চিত সে,তাকে এই কেবিনে বন্দী করে রাখা হয়েছে।কিন্তু ওই ক্ষীণ এক ভাগকে সত্যি করে দিয়ে কাকতালীয় জয়ী হলো।দরজা খোলাই পাওয়া গেলো।হতবিহ্বল রোযা বাইরে এলো।লম্বা একটি করিডোর এগিয়ে গিয়েছে,একটি ধাতব সিঁড়ি। ধাপগুলো পেরিয়ে উপরে উঠতেই তীব্র বায়ুর ঝটকায় তার স্কার্ফখানি উড়ে গেলো।অবোধ্য অনুসরণেও পাকড়াও করা সম্ভব হলোনা। তা ইতোমধ্যে বয়ে গিয়েছে দূরে,ধীরে ধীরে বাহিত হয়ে নেমেছে স্রোতের উপর।বাকরুদ্ধ রোযা বায়ুঘূর্ণির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলো স্তম্ভিত অস্তিত্ব হয়ে।

স্রোত…স্রোতস্বিনী? উহুম।
সমুদ্র!
একটি বিশালাকৃতির জাহাজ।যার মাঝে নগণ্য রোযা।ডেকে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক হয়ে।চারিপাশে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুমাত্র পানির অস্তিত্ব।এ যেন জলরাজ্য।শুষ্ক ডাঙার চিহ্নটুকু নেই কোথাও।মাঝখানে ভাসমান একমাত্র জাহাজ।কোনো নড়চড় নেই।শুধুমাত্র স্রোতের মাঝেই নোঙর ফেলে দোল খাচ্ছে।হাঁটু ভেঙে এলো প্রায় রোযার,কিন্তু নিজের পতন ঠেকালো অনতিবিলম্বে। মুষ্টি পাকালো উভয় হাত।হতাশার চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইলো।কোথায় আছে সে?
– এনজয়িং ইওরসেল্ফ?
কন্ঠস্বরটি কর্ণগোচর হতেই সমস্ত শরীর তীব্র কাঁপুনি দিয়ে উঠলো।আতঙ্কের নয়, ক্ষোভের।সটান ঘুরে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ের কাছে একটি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় দেখা গেলো দিমিত্রীকে।একটি ফ্ল্যানেল শার্ট পরিধানে, যার বোতামগুলো উন্মুক্ত।তাতে গোলাপের ট্যাটু প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে রীতিমত, কাটাগুলো হিং*স্র অনুভব ছড়াচ্ছে।এক হাতে ওয়াইনের গ্লাস।অতি আয়েশী ভঙ্গিতে তা ঘুরিয়ে চলেছে বান্দা ঢেউয়ের তালে তালে।উত্তর পাওয়া যাবেনা জানা সত্ত্বেও রোযা জিজ্ঞেস করলো,

– আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন আপনি?
হাসলো দিমিত্রী।ওয়াইনের গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিলো।তারপর মাথা ঘুরিয়ে রোযার দিকে ফিরলো।
– আমার সঙ্গে এমন ছুটি কাটানোর ভাগ্য কজনের হয় বলো?শুধুশুধু নাক ফুলিয়ে সময়টা নষ্ট করছো কেনো?যে পোশাকটি দিয়েছি,পছন্দ হয়নি?
– রাফার খুব বড় ভক্ত আপনি,তাইনা?
বুকে দুবাহু ভাঁজ করে রেখে রোযা দিমিত্রীর দৃষ্টিতে তীব্র দৃষ্টিপাত করলো।তাতে ক্ষণিকের জন্য রাশিয়ান বান্দার চেহারা থেকে উৎফুল্ল দূরীভূত হলো।সহসাই চেয়ার ছাড়লো সে।ধীরপায়ে এগোলো রোযার দিকে।পিছপা হলোনা জ্যোৎস্না,নিজের দূর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে অনিচ্ছুক।নিকটে থেকে দিমিত্রী ঝুঁকলো।তর্জনী এবং বৃদ্ধার মাঝে রোযার চিবুক ছুঁয়ে নিজের মুখপানে তুলে বিড়বিড় করলো,

– রাফা যা করতে বলেছিল তা করলে তুমি এই অবধি সুস্থ সবল পায়ে হাঁটার মতন অবস্থায় থাকতেনা, প্রিন্সেস!
প্রচণ্ড ঘৃণা হলো অন্তরে।এতটাই যে চেহারা কুঁচকে গেলো। গা গোলানোর তোড় রোযা উপেক্ষা করলো, এতটা শক্তি প্রয়োজন হলো তাতে যে শরীর নুইয়ে এলো তার।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো।তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হাসলো দিমিত্রী। হাঁটুতে হাত রেখে ঝুঁকে আবেশিত কন্ঠে শুধালো,
– ওয়াও, আরেণ্ট ইউ আ প্রিটি লিটল মাদার অ্যাঞ্জেল?
নিজের উদর চেপে ধরলো রোযা।প্রথমবারের মতন আতঙ্ক অনুভব করলো।শিরদাঁড়া বেয়ে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো তার। দিমিত্রী জানে!তবে কি রাফাও?রোযার বাহু টেনে তাকে সোজা করে দাঁড় করালো দিমিত্রী। বরাবর নয়নপানে তাকিয়ে তীর্যক হেসে জানালো,

– চিন্তা করোনা।আমি শিকারকে ধীরে ধীরে উপভোগের মাধ্যমে গ্রাস করতে পছন্দ করি।তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের।আমাদের হাতে প্রচুর সময় আছে।
দাঁতে দাঁত চেপে রোযা মুষ্টিবদ্ধ হাত পাকিয়ে অতর্কিতে দিমিত্রীর মুখ বরাবর ঘু*ষি হাঁকিয়ে বসলো।অস্বাভাবিক ধরনের জোর পড়লো তাতে।বলিষ্ঠদেহী পুরুষটি কয়েক কদম পিছিয়ে নিজের নাক চেপে ধরতে বাধ্য হলো।আশেপাশে দাঁড়ানো সশ*স্ত্র লোকগুলো এগোতে গেলেই হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিলো দিমিত্রী। ক্রোধ নয়, বরং এক কৌতূহল প্রস্ফুটিত হলো তার চেহারায়।চিবুক ঘষে নিয়ে তাকালো রোযার দিকে, দৃষ্টিজুড়ে মুগ্ধতা।
– প্রচুর সময়?আপনার স্বপ্নে।অমানিশা আপনাকে অচিরেই গ্রাস করবে।

রোযার দৃপ্ত কন্ঠস্বর দিমিত্রীর মনোযোগ আবদ্ধ রাখলো দারুণভাবে।আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগোলো রোযা,পায়ে পায়ে। চলনজুড়ে তার অব্যক্ত এক শক্তির আবাহন।পরিপূর্ণ তাতে এক অটল হিমালয়ের অস্তিত্বের ক্ষমতা। দিমিত্রীর মুখোমুখি হয়ে রোযা ঘোষণা করলো,
– রাফা কায়সার হয়ত আপনাকে বলেনি এই ব্যাপারটি ঠিক কতটা গু*রুতর।ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির আশেপাশে ভূমিকম্পের পরিণতি জানেন?
নিকটে সরলো জ্যোৎস্না, অগ্নিশিখা খচিত তার নয়নজুড়ে।যা অন্তরকে দোদুল্যমান দোলাচলে ভাসাতে পারদর্শী।ধ্বনিত হলো তার কন্ঠে,

– অগ্ন্যুৎপাত!
সামান্য বিরতি।
– হারিয়ে যাবেন তপ্ত লাভার স্রোতে।আপনার এই অশুভ সমুদ্র শুকিয়ে খাঁক হয়ে যাবে সেই উত্তাপে।
– এতই বিশ্বাস?
– শুধুমাত্র বিশ্বাস নয়।এ আমার ভবিষ্যতবাণী।
দিমিত্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তীর্যক হাসলো রোযাও।শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে বললো,
– স্বয়ং কে বি গ্রুপ যে পরাশক্তির আগ্রাসনে ধ্বং*স হয়েছে,সেখানে রাফা কায়সার এবং তার পালতু কুকুরের দল কেমন সুবিধা রাখে?
প্রথমবারের মতন দিমিত্রীর চেহারায় প্রফুল্লতার বদলে ক্রোধ ভর করলো।এক ঝটকায় সে রোযাকে রেলিংয়ের নিকটে ঠেললো।এই বুঝি ফে*লে দেয় সাগরে! কিন্তু ফেললোনা।রেলিংয়ের বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে কর্কশ ধাঁচে বললো,

– পালতু কুকুর?রিয়েলী?
খানিকক্ষণের জন্য ভড়কে গেলেও দিমিত্রীর অতর্কিত ক্রোধ লক্ষ্য করে রোযা নিজেকে শক্ত করলো, বিনোদিত ভাব বজায় রেখে উচ্চারণ করলো,
– ওহ প্লীজ!বলবেন না সত্যিই বিশ্বাস করেন যে, আপনি রাফা কায়সারের স্বামী হতে পেরেছেন,সে আপনাকে ভালোবাসে।
– শি ডায।শি লাভস মি!
হাসির পরিমাণ দ্বিগুণ হলো রোযার।অভূতপূর্ব!দিমিত্রী ভলকভের দূর্বলতা সে এত সহজে খুঁজে পাবে কল্পনা করেনি।ভাগ্য কি সহায় তবে তার?একটি হাত এগিয়ে রাশিয়ানের কপালে তর্জনী ছুঁয়ে রোযা জানালো,
– মস্তিষ্কের মাঝে স্থায়ীভাবে বসিয়ে নিন।রাফা কায়সার একজন সাই*কোপ্যাথ।ভালোবাসার যোগ্য নয় তার অন্তর।সে শুধু জানে ভোগ,ধ্বং*স,য*ন্ত্রণা,শোষণ, আসক্তি।আপনি তার কাছে উপযোগী,তাই সে ব্যবহার করছে।যখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবেন,ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেনা।

– তুমি মিথ্যা বলছো।
অস্বীকৃতি জানালো দিমিত্রী।মাথা হেলিয়ে রোযা তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বললো,
– তাই বুঝি?তবে কেনো আপনি এখানে বলুন তো?আমাকে বন্দী করে কি হাসিল করতে চায় রাফা?শুধুই নিজের পরিবার ধ্বং*সের প্রতিশোধ?নাকি ভিন্নকিছু?
আরো একটু চাপ প্রয়োগ করলো রোযা,
– আপনার কি মনে হয়?একজন রমণীর পক্ষে আদও সম্ভব নিজের শখের পুরুষকে অন্য কারো সঙ্গে দেখা? দয়া করে বলবেন না,এসব শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় তৃপ্তি।আপনি সঙ্গী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও অন্য রমণী কিংবা অন্য পুরুষে তৃপ্তি পাচ্ছেন,এটি আর যাই হোক অন্তত ভালোবাসা হতে পারেনা। স্রেফ মানসিক বি*কৃতি।
দিমিত্রী গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।চেহারার অব্যক্ত অভিব্যক্তি জানান দিচ্ছে রোযার কথাগুলো তাকে ভাবাচ্ছে।দুর্বোধ্য অন্তরকে শান্তনা দিয়ে রোযা ব্যক্ত করলো,

– শুভ্রতা,তাইনা? রাফার মূল লক্ষ্য?আপনার কি মনে হয় মিস্টার ভলকভ?যদি এক প্রান্তে সেই শুভ্রতা এবং অপরপ্রান্তে আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন,তবে কাকে বেছে নেবে রাফা?আপনাকে?নাকি…. শুভ্রতার আসক্তিকে?
নৈঃশব্দ্য।কোনো জবাব নেই।তবে কি সফল হতে চলেছে রোযা?কিন্তু এত সহজে যে সফলতা ধরা দেয়ার নয়। দিমিত্রীর হাত তার কাঁধে চেপে বসলো,এতটা জোরালোভাবে যে তাতে য*ন্ত্রণা অনুভূত হলো।দাঁতে দাঁত চেপে রইলো রোযা।হজম করলো অনুভূতিকে।
– ইউ আর আ গ্রেট ম্যানিউপুলেটর।
মাথা হেলিয়ে নিজের স্পর্শের জোর বাড়িয়ে দিমিত্রী যুক্ত করলো,
– ব্রেইন ওয়াশ করার চেয়ে নিজের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবো।ইউ আর ট্র্যাপড।কোথায় যাবে?কি করবে তুমি? আদার দ্যান…. সার্ভিং মি?

অন্তিম বাক্যটি উচ্চারণের সময় দিমিত্রী অযথাই জিভ দিয়ে নিজের অধর ভিজিয়ে আনলো,এক কৌতুক যেন, লোভাতুর অনুভূতি প্রদর্শন। রোযাকে ছেড়ে দিয়ে সে হনহন করে জাহাজের অভ্যন্তরে চলে গেলো। গার্ডদের নজরের মাঝে একলা দাঁড়িয়ে থাকলো রোযা।তাকে কোনোপ্রকার বাঁধনে বাঁধার প্রয়োজনবোধ করেনি কেউ।কারণ, এখান থেকে পালানোর কোনো পথ নেই।চারিপাশে শুধুমাত্র সমুদ্র।রোযা যদি কিছু করার প্রচেষ্টা করেও,তবে তা হবে আ*ত্মাহু*তি দেয়ার সামিল।অজান্তেই উদর স্পর্শ করলো সে নিজের।নাহ,কিছুতেই নাহ।সে আর একলা নয়।গর্ভে তার সন্তান রয়েছে।একজন মা হিসাবে সন্তানকে রক্ষার দায়িত্ব তার।করবে সে,যেভাবেই হোক না কেনো।ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কিছুতেই ঘটতে দেবেনা। চাঁদকে কথা দিয়েছে যে, সারাটা জীবন হাত ধরে পাশাপাশি চলবে।
আনমনে গলার লকেটটা খুলে নিলো রোযা, আসমানের দেয়া স্মৃতিচিহ্ন।এতটা সময়ে প্রথমবারের মতন প্রচণ্ড আবেগ অনুভব করলো সে।নয়নে জমলো অশ্রু।ধাতব মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল, লকেটের মাঝে অস্বচ্ছ দৃষ্টি আবদ্ধ করে আপনমনে সিক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– আমার চাঁদ…..কেমন অনুভব করছো তুমি?তোমার শূন্যতা যে আমায় বড্ড পীড়া দিচ্ছে,উপলব্ধি করতে পারছো কি?

হযরত ফাতিমা কামিল মাদরাসা সংলগ্ন মসজিদ।
বিস্তৃত তিনটি গম্বুজ সম্বলিত মসজিদটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসমান।স্থির নয়নে চেয়ে আছে একটিমাত্র উঁচু মিনারের দিকে।এখন নামাজের সময় নয়।এশার ওয়াক্ত পেরিয়েছে বহু আগেই।চারিপাশে কারো অস্তিত্ব তাই নেই বললেই চলে।শুধুমাত্র অদূরে এতিমখানার বিল্ডিংজুড়ে আলো আঁধারির খেলা, মাঝে মাঝে ভেসে আসা বাচ্চাদের কলকাকলি।নিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে সকলে।কিন্তু নিদ্রা নেই আসমানের নয়নে। কত দিন পেরিয়েছে?কত ঘন্টা?কত মিনিট?কত সেকেন্ড? কোনোপ্রকার হিসাব নেই।নিজের কক্ষের চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ ছিলো সে সম্পূর্ণ সময়।নিদ্রা,খাওয়া?ওসব বিলাসিতা করবার সুযোগ কি আদও রয়েছে তার?

অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটেছে আসমানের মাঝে।কোনোপ্রকার অনুভূতি অনুভব করছেনা।শুধুমাত্র এক নিরেট শূন্যতা।কান্না আসেনি তার,জাগ্রত হয়নি চেতনা।এ যেন চিত্রলেখা এবং মেঘকে হারানোর পর জন্ম নেয়া সেই রুদ্র প্রলয়। অনুভূতিহীনতা যার অলংকার,গ্লানির অভিমান যার নির্বাসন।ব্যর্থতা।আবারো এক ব্যর্থতা।এইবারের ব্যর্থতা তার সকল সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে।বর্তমানকে ধূলোয় ধূসরিত করেছে।সবটা সঠিক করা সম্ভবপর হবে কিনা জানা নেই।যদি হয়ও, নিজেকে আর কোনোদিন মোকাবেলা করতে পারবে কি?যে আতঙ্কে সে ভালোবাসাকে দূরে ঠেলেছে তীব্রভাবে,আজ সেই ভীতিই বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।এর দায় কার?তার?নাকি তার অভিশপ্ত ভাগ্যের?এই চক্র থেকে কি আদও কোনো মুক্তি রয়েছে আসমানের?

– সাহেব,আপনি?
পুরুষালী কণ্ঠটি শ্রবণ হতেই নির্বিকার দৃষ্টি তুলে চেয়ে মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে ইমামকে নেমে আসতে দেখলো আসমান।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।এই সময়ে আপনি?কোনো জরুরী দরকার নাকি? স্যার পাঠিয়েছেন?
মাথা নাড়লো আসমান,জানালো,
– সৃষ্টিকর্তার দরবারের প্রশান্তির খোঁজে এসেছি।নির্দিষ্ট কোনো সময় আছে কি আশ্রয় নেয়ার?
হাসলেন ইমাম,মাথা দুলিয়ে জানালেন,
– অবশ্যই নয়।খোদার দুয়ার সকলের জন্যই উন্মুক্ত।আপনি পবিত্র হয়ে ভেতরে প্রবেশ করুন, আশা করি শান্তি কিংবা সমাধান সবকিছুই খুঁজে পাবেন।

আসমান আর উত্তর করলোনা।প্রস্তুত সে হয়েই এসেছিল।জুতা খুলে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলো।বাক্সে রাখা টুপি থেকে একটি সংগ্রহ করে মাথায় জড়ালো।পায়ে পায়ে মেঝেতে বিছিয়ে রাখা কার্পেটে এসে থামলো।একেবারে ঈদগামের স্থানের সম্মুখে।একটি কোরআন শরীফ রাখা,নিশ্চয়ই ইমাম পাঠ করছিলেন এতক্ষণ।এখানে বর্তমানে কেউই উপস্থিত নেই আসমান ব্যতীত।
মিনিট দশেক আসমান শুধু দাঁড়িয়ে থেকেই অতিবাহিত করলো।গ্রীষ্মের ভ্যাঁপসা গরম প্রকৃতিকে অতিষ্ঠ করে তুললেও সৃষ্টিকর্তার এই প্রান্তে যেন শান্তির শীতলতা।শরীর এক মোহময় আবেশে পরিপূর্ণ হয় অজান্তেই।নিজের অন্তরের সঙ্গে দ্বিধাদ্বন্দে লিপ্ত হলো আসমান।তারপর অগ্রসর হলো।হাঁটু মুড়ে বসলো কার্পেটে।তাকালো অদৃশ্য কোনো এক সর্বশক্তির অনুভব লক্ষ্য করে।কাঁপতে থাকলো তার দুহাত,জোরপূর্বক মোনাজাতে আবদ্ধ করলো সে তা। ঝুঁকলো নত হয়ে।স্থির কন্ঠে সে বলতে আরম্ভ করলো,

– আমার মতন পা*পীর প্রার্থনার অধিকারও হয়ত নেই।তবুও আজ করজোড়ে মাথা ঠেকিয়েছি।মানুষের যখন সকল পথ বন্ধ হয়ে যায়,তখন সে পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী হয়।আমিও হয়ত তেমনি অধম এক মানুষ।
সামান্য বিরতি।তারপর মুখ তুলে তাকালো আসমান।অজানার উদ্দেশ্যে বললো,
– আমার ভাগ্য এমন কেনো খোদা?এসব কি আমার পা*পের দুনিয়াবি ফল?বারংবার ব্যর্থতার গ্লানিতে জর্জরিত হচ্ছি।সবকিছু পেয়েও হারিয়ে ফেলছি।এহেন ভ*য়ংকর অভিশাপ আমার উপর?সত্যিই কি আমি অভিশপ্ত?জগতের কোনো শক্তিই কি এর বিনাশ ঘটাতে পারবেনা?
ঢোক গিললো আসমান, নুয়ে এলো তার সর্বাঙ্গ।

– আমি পা*পী।আমার পা*পের শা*স্তি আমাকে দিন, খোদা।আমার স্ত্রী,আমার অভূমিষ্ঠ সন্তান,ওদের কেনো ভুগতে হচ্ছে বারংবার?আ*ঘা*ত আসুক,ঘৃণা আসুক, যন্ত্রণা, বেদনা,কষ্ট সব আমার হোক!আপনি মহিমান্বিত, রহমানুর রহিম।আমার পরিবারটাকে রেহাই দেয়া যায়না?নিজের অভিশাপে তাদের বিলীন ঘটলে যে আমি ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যাবো।আপনি তো সবই জানেন।আ*ত্মহ*ত্যা ম*হাপাপ।কিন্তু আমার যে তাই করতে তীব্র বাসনা হচ্ছে আল্লাহ!
ক্রমেই ভঙ্গুর হলো কন্ঠস্বর।অনুভূতিহীন বালুচরে আবেগের তীব্র স্রোত আছড়ে পড়ছে।টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে ক্রমশ ভিজিয়ে তুলছে কার্পেট।কাঁপুনি উঠেছে সমস্ত শরীরে। রোমকূপজুড়ে অবাধ্য শিহরণের বিচরণ।সেজদায় মাথা ঠুকলো আসমান।

– কারো সামনে মাথা নত করিনি কোনোদিন।আপনি তো রব।আপনার এই কলঙ্কিত বান্দা আজ বড্ড অসহায়।একটুখানি পথ দেখানো যায়না তাকে?পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু আপনি।আমাকে সামান্যতম রহমতের ভিখারী আজ আমি।কোন পর্যায়ে ঠেকলে এই যন্ত্রমানবও গুঁড়িয়ে যায়,আল্লাহ?ভিক্ষা চাইছি আমি,আপনার কাছে।হয়ত এর আগে কোনোদিন আপনার দুয়ারে এসে দাঁড়াইনি।আসলে অনেক আগেই আমার সকল বাসনা, সকল স্বপ্ন আপনি পূরণ করতেন।তবে আজ,আজ সবকিছুর ব্যতিক্রম ঘটুক।আমিও অসহায় খোদা। স্বীকার করতে খেদ নেই।দূর্বল,নগণ্য,তুচ্ছ এক অস্তিত্ব আমি। ব্যর্থ,চরম ব্যর্থ।আমার জ্যোৎস্নাকে রক্ষা করুন আল্লাহ,রক্ষা করুন আমার অংশকে।এটুকুই আমার চাওয়া।আমাকে একটুখানি দয়া করবেন?

কান্নার দমক উঠলো।কার্পেটে আঁকড়ে বসলো আঙুল, শক্তভাবে।নিঃশব্দে নিজের বিসর্জন ঘটালো অমানিশা।মহিমান্বিত রবের সামনে ভঙ্গুর সে,একমাত্র তিনিই আজ পারেন তাকে নতুনভাবে পথ দেখাতে।একজন পিতা, একজন স্বামীর এই হাহাকার,আর্তনাদের ভাষা কি কবুল হবে?নাকি তার পা*পের অন্তরালে আচ্ছাদিত হয়ে পড়বে সকল চাহিদা?

গুটিশুটি দিয়ে কার্পেটেই শুয়ে থাকলো আসমান।দীর্ঘক্ষণ।অদ্ভুত হলেও সত্য,আজ তার নয়নভরে নিদ্রা এলো।এলিয়ে পড়লো সম্পূর্ণ।অদ্ভুত এক প্রশান্তিদায়ক ঘুম,ভালোবাসাময় এক স্বপ্নের জগতে বিচরণ।যেখানে শুধুমাত্র সে,তার জ্যোৎস্না এবং তাদের অংশের উপস্থিতি।অতঃপর ফজরের সময় মুয়াজ্জিন তাকে ডেকে তুললো।ওজুখানায় মুখ হাত ধুয়ে নামাজ আদায় করে নিজের গাড়িতে উঠলো আসমান।কোথায় যাবে?বাড়িতে?আবারো বন্দী করবে নিজেকে কারাগারের মাঝে?এমন দোলাচলের মাঝেই তার পকেটের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।নিহাদের নামটি স্ক্রীনে দেখে রিসিভ করলো আসমান।নিজে থেকে কিছুই বললোনা।

– আসাদ উদ্দিন এসেছেন।তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসো।
এটুকুই।আসমান স্টিয়ারিংয়ে হাত চাপলো।বাম কব্জিতে ব্রেসলেটখানি জ্বলজ্বল করে উঠতেই হৃদয়জুড়ে অসহনীয় তরঙ্গ খেলে গেলো তার।উপেক্ষা করলো সেই অনুভূতি। মেঘতীরে পৌঁছলো দ্রুত।হলঘরে প্রবেশ করতেই বিলাল এবং আসাদকে মুখোমুখি অবস্থায় লক্ষ্য করলো।অপরদিকে নিহাদ দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে। চারুলতা উদাসী দৃষ্টিতে ডাইন ইন টেবিল থেকে বাইরের দিকে চেয়ে আছে।আসমান আসতেই আসাদ নয়ন তুলে তাকালেন।

রোযাকে যেদিন দিমিত্রী তুলে নিয়ে গিয়েছে,সেদিন থেকেই খোঁজ অভিযান আরম্ভ হয়েছে।এতে মূল ভূমিকা পালন করেছেন বিলাল এবং আসাদ।সম্পূর্ণ শহরজুড়ে সূত্রের আশায় অভিযানে এখন পর্যন্ত কত কোটি টাকা ঢালা হয়েছে তার সম্পর্কে হিসাব আসমানের নিকট নেই।তবে এটুকু সে নিশ্চিত,বিলাল নিজের ক্ষমতা এবং বিত্ত ব্যবহারে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি।আসাদ উদ্দিন একজন তথ্য সরবরাহকারী দলের নেতা,মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ড জগতে যার বিচরণ।সেই হিসাবে তার সূত্র এবং সৈনিকের অভাব নেই মোটেও।সবকিছু ব্যবহারে আদও কিছু জানা গিয়েছে কিনা তা সম্পর্কে আসমান এখনো পর্যন্ত ধারণা করতে পারছেনা।

আসাদ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।শান্ত তার দৃষ্টি।মুখোমুখি হলেন তিনি অমানিশার।
– কপ্টারটি ৪০ ফিট উচ্চতায় ঘোরাঘুরি করছিলো মাটি থেকে,পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংয়ের সিসিটিভি থেকে হালকা পাতলা ধারণা নিয়ে হিসাব সম্ভব হয়েছে।আশেপাশেই ল্যান্ড করেছে এই জায়গার। সেখানের স্থাপনাসমূহ থেকে পাওয়া ফুটেজ এবং রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করা হয়েছে।সব মিলিয়ে,আমি নিশ্চিতভাবে সার্বিক এক ধারণা করতে পারছি।
নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো আসমানের ক্ষণিকের জন্য।ঢোক গিললো শক্তভাবে।আসাদ বেশিক্ষণ চিন্তায় রাখলেন না তাকে।ফরমাল প্যান্টে দুহাত ভরে জানালেন,

– গেট রেডি ফর চট্টগ্রাম।
স্তম্ভিত হয়ে থাকলো আসমান,টেবিলের পাশে বসা চারুলতা এবং সিঁড়ির নিকট থাকা নিহাদ।একমাত্র বিলাল শান্ত,অর্থাৎ তিনি আগেই জানতে পেরেছেন।নিজের ভঙ্গি ত্যাগ করে নিহাদ এগোলো,ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– ভলকভ রোযাকে চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়েছে?
– বিশ্লেষণ তাই বলছে।আমাদের সেখানে পৌঁছে একদম সঠিক স্থানটি খুঁজে বের করতে হবে।এর আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা।
– সিরিয়াসলি!

ডার্কসাইড পর্ব ৬০

নিজের চুলে হাত চালালো নিহাদ।তারপর হঠাৎ করেই খিলখিল ধ্বনি তুলে হাসতে আরম্ভ করলো।তার এমন উদ্ভট আচরণে বাকিরা বিহ্বল না হয়ে পারলোনা।তীব্র এক আগ্রাসন ফুটে উঠল নিহাদের চেহারাজুড়ে,যার বিধ্বং*সী অনুভব একমাত্র আসমান উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো।
– দে ডিড আ ডার্টি মিসটেক…..
প্রতিধ্বনিত হলো নিহাদের অভাবনীয় গভীর কন্ঠস্বর, যেন বি*স্ফো*রিত বা*রুদধ্বনি।
– চিটাগং ইয মাই টেরিটরি!
দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হলো না নিহাদের পরিবর্ধমান অমিত শক্তিধর অস্তিত্ব থেকে।

ডার্কসাইড পর্ব ৬২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here