ডার্কসাইড পর্ব ৬২

ডার্কসাইড পর্ব ৬২
জাবিন ফোরকান

~হালুগাডত্তুন ছাইজ্জি গারি লৈ আল্লার নাম
একগন্টা ফার ঐগেইয়্যে আইযু বদ্দারাট ন’আইলাম
কুরোর ডইল্ল্যে যুরি যুরি চলের গারিগান
ডাইবারত্ত্যেঁ সুইৎ-বুইৎ নাই, যাত্রী ফ্যারেশান
এই হালুগাইট্ট্যে মুড়ির টিন
হালুগাইট্ট্যে মুড়ির টিন~

আঞ্চলিক ভাষায় আধুনিক ধাঁচের সঙ্গীতটির মাধুর্যে পরিপূর্ণ চারিপাশ। ব্যাস্ততম সড়কপথ।যেদিকে দৃষ্টি যায় বিভিন্ন পথগামী মানুষের চলাচল।চৌরাস্তার মাঝখানে দন্ডায়মান ট্রাফিক পুলিশ। বাঁশি হাতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে উদ্যত। মুড়ির টিন সদৃশ লোকাল বাসগুলো গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে এগোচ্ছে।সামান্যতম দ্বৈরথেই অশ্রাব্য শব্দগুচ্ছের ফোয়ারা ছুটছে।কিন্তু সেসব যেন গালমন্দ নয় বরং নিত্যদিনের বাক্য বিনিময়ের অবিচ্ছিন্ন অংশ।
– এই আগ্রাবাদ আগ্রাবাদ….এই হাটহাজারী হাটহাজারী…এই বহদ্দারহাট….
কন্ডাকটরদের হাকডাকে সঙ্গীতের ধ্বনি ক্ষণে ক্ষণে মিইয়ে আসছে।পরোয়া নেই কারো।নগরের মানুষ ছুটে চলতেই অভ্যস্থ।সড়কের ধারে ধারে দোকানপাট। হাজীর বিরিয়ানী এবং মেজবানী খাবারের আয়োজনে সয়লাভ সবটা।কাজকর্মের অবসান নেই।গালমন্দ, রেষারেষি, ঝগড়াঝাঁটি নিত্যসঙ্গী।তবুও নগরের মানুষগুলোর মুখে হাসির কোনো কমতি নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিহাদের প্রাণের শহর চট্টগ্রাম এটি।
ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকলে নিহাদ লোকাল বাসে যাতায়াতের পাঁয়তারা করতো।অসহ্যকর হয়েও যেন ভীষণ কাম্য এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তা।কিন্তু বর্তমানে সেটি সম্ভব নয়।নিজের জন্মস্থানে আপন মায়ের কোলে ফিরে আসার মতন অনুভূতি হলেও ঠিক উপভোগ করা যাচ্ছেনা সময়টা।কারণ,তার বোনটির জীবন বাজি রয়েছে।এখানে আয়েশের কোনো সুযোগ নেই।
আগ্রাবাদ এলাকার সংলগ্ন একটি এলাকা।মাথার উপরে ফ্ল্যাইওয়ে,নিচে সাপের মতন এঁকেবেঁকে চলা সড়কজুড়ে যানবাহনের অবাধ বিচরণ।সড়কের একপাশজুড়ে সারে সারে সজ্জিত স্থাপনা।একটি রেস্তোরাঁ, উপরে লিখা রয়েছে, “মেজ্জান হ্যাইল্যে আইয়্যু”।গাড়ি একপাশে থামিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো সকলে।সকলের সম্মুখে নিহাদ,অতঃপর আসমান এবং চারুলতা পাশাপাশি। ঢুকতেই একটি কর্নার টেবিলে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটি নজরে এলো।দুবাহু দুদিকে মেলে এগিয়ে গেলো নিহাদ,

– কিরে সু*দানির ফুয়ারা,ক্যান আঁসোস? [ কেমন আছিস তোরা?]
দুজন ফিনফিনে এবং একজন গাট্টাগোট্টা ধরণের যুবক উঠে দাঁড়ালো, ছুটে এলো নিহাদের বাহুডোরের আলিঙ্গনমাঝে।অতঃপর তাদের মাঝে চট্টলার ভাষায় যা কথোপকথন হলো তা বাকিদের বোধগম্য ঠেকলোনা। চারুলতা আনমনে পাশে দাঁড়ানো আসমানের উদ্দেশ্যে ঝুঁকে ফিসফিস কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– এরা শুভেচ্ছা বিনিময় করছে নাকি গালিগালাজ?
– ওটাই ওদের আদরের ভাষা।
নির্বিকার উত্তর আসমানের।কিছুক্ষণ বাদেই সকলে টেবিলে আসন দখল করলো। মেজবানী মাং*স এবং পরোটার অর্ডার দিয়ে নিহাদ আসমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো সকলের।অতঃপর চারিপাশে সতর্ক নজর বুলিয়ে এনে স্থির কন্ঠে নিহাদ বলা আরম্ভ করলো।

– আমার তোদের সাহায্য লাগবে।
– অবশ্যই ভাই।তুই শুধু বল তোর হুকুম কি!
একদফা আসমানের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে নিহাদ ফিরলো,জানালো,
– প্রত্যেকটা গ্যাংয়ের কাছে খবর পৌঁছে যাওয়া চাই।যেকোনো মূল্যে আমাকে তথ্য এনে দিতে হবে।বাজেটের কোনো চিন্তা করার দরকার নেই।সব আমি সামলে নেবো।সবাইকে শুধু এটুকুই জানাবি,এটা আমার অর্ডার।
টেবিলের উপর মুষ্টিবদ্ধ হলো দেবভক্তের হাত।চেহারায় প্রকাশ পেলো অসম্ভব দৃপ্ততা।তার সদা উৎফুল্ল অবয়বের পরিবর্তে এক হিং*স্রতার ঝিলিক লক্ষ্য করে থমকালো চারুলতা।নিহাদের এহেন রূপ উপলব্ধি তার এই প্রথম।কে বি গ্রুপের পতনকালেও তাকে এতটা উদগ্রীব লক্ষ্য করা যায়নি। রোযার অপ*হরণ সকলকে অভ্যন্তর থেকে সাংঘাতিক নাড়িয়ে দিয়েছে।কারো মেয়ে,কারো বোন,কারো বান্ধবী এবং কারো আবার গোটা পৃথিবী!এমনি এক স্থান দখল করেছে সে প্রত্যেকের অন্তরে।তার জন্য এক পৃথিবী সমান মূল্যও যেন কম হয়ে যাবে।

– নিহাদের রাজত্বে তার নাকের ডগায় এক ভিনদেশী শক্তি হুকুম চালাবে,আর নিহাদ সেটা নিশ্চুপ সহ্য করে যাবে?
তীর্যক হাসলো নিহাদ,মাথা কাত করে বললো,
– ওরা আমার প্রফুল্লতা দেখেছে, এবার আমার তাণ্ডবলীলা দেখার পালা!
ওয়েটার খাবার নিয়ে চলে আসায় অতিরিক্ত কথোপকথন সম্ভব হলোনা।আসমানকে নিহাদ খানিকটা বেড়ে দিতেই তা দূরে ঠেলে দিলো সে।মাথা নাড়ল নিঃশব্দে।পাশে বসা চারুলতা হাত রাখলো কাঁধে।
– একটু খা ভাইয়া,তুই বড্ড অনিয়ম করছিস।এভাবে কি বাঁচা যায়?
পরিহাসের হাসি হাসলো আসমান,মাস্কের অন্তরালে দেখা না গেলেও বুঝতে অসুবিধা হলোনা নিহাদ চারুর।
– ওর কোনো খবর আমার কাছে নেই।তোর মনে হয় খাবারের একটি দানাও আমার গলা দিয়ে নামবে?
এটুকুই।চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ল আসমান। হেঁটে বেরিয়ে গেলো বাইরে।নিঃশব্দে চেয়ে থাকলো সকলে।অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিহাদের উদ্দেশ্যে ফিরলো চারুলতা।নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের মাঝেই ঘটলো তাদের অগণিত অব্যক্ত অনুভূতির বিনিময়।

প্লেটে খাবার সাজানো।কয়েকটি রুটি, ডিমপোচ, ফলের রস এবং ফলমূলের ফ্রুট সালাদ।রোযা একটি ঢোক গিললো।অন্তরে সুতীব্র অভিমান খাবারের প্রতি।কিন্তু উদরে দৃষ্টি পড়তেই সেই ক্রোধ দূরীভূত হলো।টেনে নিয়ে খানিকটা রুটি মুখে পুরলো,সঙ্গে ফলের রসে চুমুক দিলো।
আজ কতদিন পেরিয়েছে?হিসাব নেই রোযার।হৃদয় তার হুহু করছে।কতটা দিন দেখে না সে তার চাঁদকে! বিয়ের পর এতটা লম্বা সময়জুড়ে কখনোই আসমানের কাছ থেকে আলাদা থাকেনি সে।অভিমান হয়েছে,দ্বৈরথ প্রকাশ পেয়েছে।কিন্তু কখনোই দূরে সরে যাওয়া হয়নি।কিভাবে বসবাস করছে তার প্রিয়তম?সে তো চেনে আসমানকে!নিশ্চয়ই কেউই দানাপানি খাওয়াতে সক্ষম হচ্ছেনা।কিন্তু রোযা খাচ্ছে,বাধ্য হয়ে, নিজের অংশের কথা চিন্তা করে।কেমন অনুভব করছে তার অমানিশা?নিজেকে দোষারোপ করছে?অভিশপ্ত ভাবছে?ঠিক যে মুহূর্তে নিজের সবটুকু সুখ খুঁজে পেয়েছিল সে,ওই মুহূর্তেই এক ঘূর্ণিঝড়ের ঝাঁপটায় সবকিছু আবারো উলট পালট হয়ে গেলো।কেনো বারংবার আসমানের ভাগ্য এইভাবে খেলে তাকে নিয়ে?

রাফা কায়সার আদতে চায়টা কি? রোযাকে বন্দী করে আসমানকে হাসিল করতে চাইছে?এতই কি সহজ তা?অমানিশা নিজেকে সমর্পণ করবে ওই অশুভের দুয়ারে? কোনোদিনও নয়।কিন্তু যদি বাধ্য হয়?যদি রোযা এবং তার গর্ভে বেড়ে উঠতে থাকা অংশের চিন্তা তাকে দূর্বল করে তোলে?তখন কি হবে? রাফা কায়সার কি এভাবেই জিত হাসিল করে নেবে?
রোযা বেশিক্ষণ ভাবতে সক্ষম হলোনা।এসব ভাবলেই হৃদয় উগড়ে কান্না আসে তার।এইসব লোকের সামনে সে কেঁদে নিজের দূর্বলতা জাহির করতে ইচ্ছুক নয়।বলা যায়না,কখন কোন মাধ্যমকে তারা ব্যবহার করবে রোযার জীবন ন*রক করে তোলার জন্য।তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো দিমিত্রী এখনো পর্যন্ত রোযার কোনপ্রকার ক্ষতি করেনি।কিন্তু কেনো?এই বান্দার কথাবার্তা শুনলে মনে হয় যে রাফার নির্দেশনা ভিন্ন কিছু ছিলো।তবে কেনো সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে?

দিমিত্রী ভলকভ।রাশিয়ান মা*ফিয়া গ্যাং “ডায়নোসোরাস”—এর নেতা।তার গ্যাংই রাফাকে এহেন লীলাখেলা চালাতে সহযোগিতা করছে।এটুকুই তথ্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে রোযার পক্ষে।কিন্তু এই বান্দা আলফার মতন নয়,খানিকটা ভিন্ন।অতি মাত্রায় চালাক কিংবা অতি মাত্রায় বোকা।তাকে বুঝতে খানিকটা বেগ পোহাতে হচ্ছে।রোযার প্রতি নমনীয়তার উদ্দেশ্য কি?আদতে কি তার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা দিমিত্রীর নেই?তবে কেনো এই কার্যক্রম? রাফা চায় বলে?কোথাও যেন হিসাব মিলছে না।রহস্যে আবৃত সবকিছুই।রোযা একটি নিঃশ্বাস ফেলে মাথা চেপে ধরলো।গা গুলিয়ে আসছে।মাত্রই খেয়েছে। তা বমি করে ফেলে দিতে চায়না।গর্ভে বেড়ে উঠতে থাকা অংশের পুষ্টি দরকার।উঠলো রোযা,কেবিন থেকে বাইরে জাহাজে বেরিয়ে এলো।করিডোর পেরিয়ে পায়ে পায়ে ছাদে উঠলো।
যথারীতি একটি চেয়ারে বসে দূর সমুদ্রের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে দিমিত্রী।আশেপাশে তার লোকজন স*শ*স্ত্র অবস্থায় টহল দিচ্ছে।রোযা আসতেই এক নজর তীক্ষ্ণ নজরে সকলে তাকালো তার দিকে,অতঃপর উদাসীন ভঙ্গিতে তা ফিরিয়েও নিলো।কোনো প্রতিক্রিয়া না করে রোযা এগোলো পায়ে পায়ে, রেলিং ধরে ঝুঁকলো।তীব্র বায়ুর ঘূর্ণির মাঝে মিশ্রিত সমুদ্রের নোনা আবহ।গগনে উদিত দিবাকর রশ্মি ছড়াচ্ছে উষ্ণ।নিজের অস্তিত্বকে প্রাকৃতিক আবেশে সিক্ত করলো রোযা।নিঃশব্দ উপস্থিতি।তারপর হঠাৎই দিমিত্রীর কন্ঠ ভেসে এলো,

– আজকে তুমি সত্যিই খেয়েছ।এবার প্রমাণ হলো তোমার খাবারে যে বি*ষ মেশানো হয়নি?
রোযা থমকালো।তারপর পিছন ঘুরে তাকালো, বরাবর রাশিয়ানের ফ্যাকাশে দৃষ্টি লক্ষ্য করে।কোনপ্রকার ভনিতা এড়িয়ে শুধালো,
– আপনি কি চান মিস্টার ভলকভ?
এক পদক্ষেপ এগোলো,
– রাফা নিশ্চয়ই এতটা দয়ালু নন যে শুধুমাত্র আমাকে বন্দী রেখেই ক্ষান্ত হবেন।তবে আপনার নির্ভারতা কোন উদ্দেশ্যে?কি পরিকল্পনা রয়েছে আপনার?
দিমিত্রীর মাঝে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলোনা।তার জোরালো দৃষ্টি রোযার মুখ থেকে বাহিত হয়ে উদরে ঠেকলো। অতর্কিতেই নজর সরিয়ে নিলো আবার।কন্ঠ পরিষ্কার করে বললো,

– অতি চালাকির পরিণাম সবসময় সফলতা নাও হতে পারে।
পুনরায় রোযার নয়নে দৃষ্টি ফেরালো সে।তীর্যক হাসলো।
– আমার পরিকল্পনা?অবশ্যই,এবং তা শীঘ্রই অর্জন করতে চলেছি আমি।তোমাকে চিন্তা করে মস্তিষ্কের বুদ্ধি খরচ করতে হবেনা।খাও,ঘুমাও,আয়েশ করো।কিন্তু এই জাহাজের গন্ডি পেরোনোর কথা চিন্তাও করোনা।
এটুকু বলেই দিমিত্রী উঠতে গেলো।কিন্তু একজন লোক এগিয়ে এলো,করিডোর বেয়ে ছাদে উঠলো।
– বস।

একটি কার্ড বাড়িয়ে দিলো সে দিমিত্রীকে।অতঃপর যেভাবে এসেছিল,সেভাবেই উধাও হয়ে গেলো।রাশিয়ান বান্দা কার্ডটি খুলতে খুলতে সামান্য কৌতূহল বোধ করে রোযা বিপরীত প্রান্তের চেয়ারটি দখল করে বসলো।একটি নিগূঢ় কালো বর্ণের কার্ড, অনেকটা ইনভাইটেশনের মতন।খুলতেই অভ্যন্তর থেকে আরেকটি কার্ড বেরিয়ে এলো,কালোর মাঝে ঝকঝকে স্বর্ণালী অক্ষরে লিখা খচিত।সঙ্গে একটি লিফলেট।কার্ডে নজর বুলিয়ে দিমিত্রী লিফলেটে থামলো।
” দ্যা রেইস অব ডে*থ ”
“—আর ইউ ব্রেইভ এনাফ টু গ্যা*ম্বেল ইওর লাইফ অ্যাওয়ে?”
লিফলেটের বিজ্ঞাপনটি পড়ে দিমিত্রী চিবুকে তর্জনী চালালো।তীর্যক এক হাসির উদ্ভব ঘটলো অধরজুড়ে। নয়নমাঝে দেখা দিলো উৎসাহী ঝিলিক।

– ইন্টারেস্টিং।
রোযা হাত বাড়াতেই অবিশ্বাস্যভাবে দিমিত্রী তাকে দেখতে দিলো।লিফলেটের শব্দাবলী পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলো সে খানিকক্ষণ।
রেইস প্রতিযোগীতা?ছয়টি ল্যাপসম্পন্ন এই রেইসের প্রতি ল্যাপ অতিক্রমে যে প্রতিযোগী সর্বশেষ হবে,তার পরিণতি…..মৃ*ত্যু!জীবন নিয়ে জু*য়াখেলা?
দৃষ্টি তুলে বিপরীত প্রান্তে একদম চুপটি করে বসে থাকা রোযার উদ্দেশ্যে তাকিয়ে রাফা কায়সারের স্বামী শুধালো,
– শুড উই গ্যা*ম্বেল, প্রিন্সেস?
কোনো জবাব এলোনা।স্থির চেয়ে রইলো রোযা।দৃষ্টি তার আবদ্ধ লিফলেটজুড়ে।
বাইক রেইস।
আন্ডারওয়ার্ল্ড জগতের অভিনব এক ধ্বং*সের খেলা।আদতেই কি শুধুমাত্র তাই?নাকি……ভিন্ন কিছু?

পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত,চট্টগ্রাম।
আঁধারিতে আচ্ছন্ন চারিপাশ।দিবাকর অস্তমিত হয়ে ক্ষীণ চন্দ্ররেখা ছেয়েছে আকাশকে।সমুদ্রমাঝে দোদুল্যমান একটি স্পিডবোটের উপর দন্ডায়মান নিহাদ।হাতে একটি দূরবীন।দৃষ্টি তার বহুদূরে,একদম পিপীলিকার ন্যায় দৃশ্যমান জাহাজটিজুড়ে তার মনোযোগ নিবদ্ধ। সিটের উপর বসে বিস্তৃত গগনে চেয়ে আছে আসমান।হাবিব স্পিডবোটের চালকের পাশেই বসে আছে।আশেপাশে নজর রাখছে।
অবশেষে দূরবীন নামিয়ে নিলো নিহাদ।আজ কততম বার হলো?পঞ্চম নাকি সপ্তম?এই পর্যন্ত কতবার তারা পর্যবেক্ষণ করেছে গোটা অঞ্চলে একটিমাত্র দূর্বল স্থানের আশায়?ঠিক স্মরণে এলোনা।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আসমানের দিকে ফিরলো শিষ্য। বললো,

– আসমান ভাই।কোনোভাবেই সম্ভব নয়।আমরা জাহাজের কাছাকাছি যাওয়া মাত্রই গু*লি করবে।
– হেলিকপ্টার নিয়ে এগোনো আরো অসম্ভব।গো*লাগু*লির মাঝে ম্যাম পড়তে পারেন।
নিঃশব্দ আসমান।একটি বাক্যও সে উচ্চারণ করছেনা।অন্তরে তার কেমন অনুভূতি হচ্ছে?নিজেও তার উত্তর জানেনা।শুধু এটুকু জানে,রোযা তার নিকটেই রয়েছে।তবুও তাকে ছোঁয়া অসাধ্য। চাঁদ তার জ্যোৎস্নাকে সহস্র চাওয়া সত্ত্বেও ছুঁয়ে দিতে পারছেনা, কে কবে শুনেছে এমন তাজ্জব কথা?
– আমাদের ভিন্ন পরিকল্পনা করতে হবে।যেভাবেই হোক ওই ভলকভকে টেনে শুকনো মাটিতে আনতে হবে। সমুদ্রমাঝে তার সুবিধা অধিক।
নিহাদের বক্তব্য কর্ণগোচর হলেও প্রতিক্রিয়াহীন আসমান।হাবিব জিজ্ঞেস করলো,

– কীভাবে?কোনো উপায় রয়েছে কি?
– ইচ্ছাশক্তি থাকলে উপায়ের অভাব হয়না।
– এতটাই বোকা নাকি ওই রাশিয়ান গ্যাং নেতা?
হাবিবের কথায় তীর্যক হাসলো নিহাদ,দুহাতের আঙুল মটকে ঘাড় এদিক ওদিক বাকিয়ে জানালো,
– বোকা হয়ত নয় কিন্তু আসক্ত।আসক্ত অস্তিত্বকে বশ করা অধিকতর সহজ।
হাবিব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।নিহাদের কথা তার মাথায় ঢুকছে না।
– কিসে আসক্ত ওই বান্দা?
প্রশ্নের উত্তরটি দিলো নিহাদ নয়নমাঝে ঝিলিক খেলিয়ে,
– গ্যা*ম্বলিং।
গাঢ় নৈঃশব্দ্য।তারপর অপ্রত্যাশিতভাবেই আসমান শুধালো,
– তুমি কিভাবে জানলে?

সামান্য থতমত খেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে শীষ বাজালো নিহাদ।এই তথ্যটি অনির্বাণের কাছ থেকে আদায় করেছে সে। দিমিত্রী সম্পর্কিত অধিক তদন্ত ওই বান্দাই করেছে।কিন্তু তা আসমান জানলে আর রক্ষা থাকবেনা।তাই উত্তর এড়িয়ে গিয়ে নিহাদ বিড়বিড় করলো,
– আই হ্যাভ সোর্স।এনিওয়ে,সেটা বিষয় না।বিষয় হলো এই ভলকভকে লোভ দেখানো।
– তার জন্য একটা যথার্থ সুযোগ তো রয়েছেই।
হাবিবের উপর মনোযোগ আপতিত হলো সকলের।
– আন্ডারওয়ার্ল্ড রেইসিং টুর্নামেন্ট। গ্যাম্বলিংয়ের জন্য পারফেক্ট প্লেস।প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় এর মাধ্যমে।আমরা চাইলে এই বছরের প্রতিযোগীতাটাকে পুঁজি করতে পারি।
মস্তিষ্কে দূর্বার ঘূর্ণিপাক ঘটলো সকলের।নিহাদ অধরে তর্জনী চালালো,

– ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া।কিন্তু এতে বিশাল বাজেট লাগবে।কমপক্ষে কয়েক কোটি টাকা….
বিড়বিড় করতে করতে থমকে গেলো নিহাদ, পরক্ষণেই অদ্ভুতুড়ে হাসির প্রস্ফুটন ঘটিয়ে জানালো,
– ওহ।দরবেশ কাক্কু আছে কি করতে?
– মাই ডিপোজিট ইয স্টিল ইন্ট্যাক্ট।অর্থ কোনো সমস্যা নয়।
অবশেষে উঠে দাঁড়ালো আসমান।তার কৃষ্ণগহ্বর সংযুক্ত অদূরে,যেখানে খালি চোখে জাহাজটি নজরেও পড়েনা।তবুও চেয়ে আছে সে।উভয় হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে বিড়বিড় করলো,
– প্রধান সমস্যা হলো পিপীলিকাকে গুড়ের প্রতি আকর্ষিত করা।
– মানে?
নিহাদের দিকে ফিরলোনা আসমান,সে ঐভাবেই চেয়ে আছে দিগন্তমাঝে।

– এই রেইস প্রতি বছর হয়,কিন্তু এখনো পর্যন্ত দিমিত্রী ভলকভ অংশ নেয়নি।নিলে সেই তথ্য আমাদের হাতে থাকার কথা।এর অর্থ সে শুধুমাত্র উত্তেজনা পছন্দ করেনা।
– তবে….এখন?
ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন করলো নিহাদ।আসমানের বিশ্লেষণ সঠিক।ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করেনি সে।কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।অতর্কিতে গগনমাঝে গ্রীষ্মের হঠাৎ ঝড়ের বজ্র হানা দিলো।মৃদু গর্জনের ভারে প্রকম্পিত হলো চারিপাশ।মাথা হেলিয়ে পিছন ফিরলো আসমান,ওই গগনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বজ্রকন্ঠ ঘোষণা করলো,
– লেটস টার্ন দিস টুর্নামেন্ট….ইনটু আ ডে*ডলি রেইস!
ওই মুহূর্তে রুদ্রচিত্ত প্রলয়ের উপর থেকে কেউই আপন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হলোনা।

এক শক্তিশালী চপাটে রমণী মেঝেতে আ*ছড়ে পড়লো। বলিষ্ঠদেহী পুরুষ তার পিঠ বরাবর ক্ষীপ্র গতিতে আরো কয়েকবার লা*থি হা*কালো। আর্তনাদে প্রকম্পিত হলো চারিপাশ।রমণী পুরুষটির দুপা আঁকড়ে ধরে করজোড়ে মিনতি জানালো,
– এমনটা করোনা,দোহাই লাগে তোমার।আমার পেটে যে তোমার সন্তান,রেহাই দাও তাকে,সৃষ্টিকর্তার ভয় করো!
মিনতির বিপরীতে আরো তীব্রতর হলো অ*ত্যা*চার। ক্লোজেটের দরজার আড়াল থেকে ফ্যাকাশে চোখের অধিকারী এক শিশু সবটাই প্রসারিত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলো।একটা বারের জন্যও সে দৃষ্টি ফেরায়নি তার মা এবং গর্ভবতী অবস্থায় তাকে নি*র্যাত*নরত পুরুষটির উপর থেকে…..

– স…. বও…বস!
ধড়ফড় করে নয়নপল্লব মেললো দিমিত্রী।মিটমিট করে চারিপাশে তাকালো।নিজের ল্যাম্বরগিনির অভ্যন্তরে রয়েছে সে। সিটে শরীর এলিয়ে দিতেই খানিক চোখ লেগে এসেছিল,বহুদিন বাদে শুকনো মাটিতে পদার্পণ করেছে কিনা!তার লোক বহুক্ষণ যাবৎ তাকে ডেকে চলেছে।মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের চিন্তাধারা পরিষ্কার করলো দিমিত্রী।
– আমরা প্রায় এসে পড়েছি বস।

উত্তরে শুধু নীরব সম্মতি জানালো রাশিয়ান বান্দা।দৃষ্টি তুলে একপাশে তাকালো।তার ঠিক পাশের সিটটি দখল করে বসে আছে রোযা।পরিধানে একটি অফহোয়াইট বর্ণের ফ্লোরাল গাউন।হালকা কিছু অলংকার এবং খোঁপা করা চুল যাকে বলে মেসি বান।এসব মেয়েটি করেছে তাহলে, দিমিত্রীর দেয়া সামগ্রী গ্রহণ করেছে।অবশ্য তা ব্যাতিত আর কোনো উপায়ও অবশিষ্ট ছিলোনা।খুব একটা খারাপ লাগছেনা রোযাকে,বাঙালি রমণীর মাঝে পাশ্চাত্যের ছোঁয়া;কিছুটা আকর্ষণীয় বটে।

বর্তমানে জানালা দিয়ে একদৃষ্টে বাইরের পথের দিকে তাকিয়ে আছে রোযা।নিজের উপর দিমিত্রীর দৃষ্টি স্পষ্ট টের পেলেও কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া করলোনা।একটি হাতে নিজেকে চারিপাশ থেকে আবদ্ধ করে সংকুচিত হয়ে পড়লো।কি হচ্ছে তার সঙ্গে?কেনই বা হচ্ছে? জানা নেই তার। দিমিত্রী আজ আন্ডারওয়ার্ল্ড বাইক রেইস টুর্নামেন্ট দেখতে এসেছে।অবশ্যই রোযাকে সাথে নিয়ে।জাহাজে একা ফেলে আসার প্রশ্নই উঠেনা।রোযা অবশ্য খুব বেশি সুবিধা করতে সক্ষম হতোনা,কিন্তু তবুও ঝুঁকি নিতে চায়নি দিমিত্রী।তাতে রোযার সুবিধাই হয়েছে।যেভাবেই হোক,যেকোনো মূল্যে তাকে একটা ব্যবস্থা আজ করতেই হবে,হয় যোগাযোগের নয়ত পলায়নের।এত বিরাট সুযোগ আর কোনোদিন আসবে বলে মনে হয়না।মনে মনে তাই বদ্ধপরিকর রোযা।

– ডোন্ট ট্রাই এনিথিং স্টুপিড প্রিন্সেস।
দিমিত্রীর সন্নিকট কন্ঠস্বর রোযাকে বিহ্বল করে তুললো।কোনো জবাব দেয়া সম্ভব হলো না।এর আগেই রোযার সিটের পাশের দরজা খুলে গেলো।এসে পড়েছে তারা।উভয় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে একটি দীর্ঘ প্রশ্বাস টেনে অবশেষে রোযা বাহিরে পদার্পণ করলো।

এক ভিন্ন দুনিয়া।পৃথিবীর বুকে এক টুকরো অন্ধকার জগৎ যেন।রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে এথায় ঝাঁক বেঁধেছে মানুষরূপী পশুদের দল,সঙ্গে নিজেদের জীবনকে নিয়ে বেপরোয়া খেলায় মেতে ওঠা আঁধারে নিমজ্জিত অস্তিত্ব।একটা রেসিং ট্র্যাক, অ্যানাকোন্ডা সাপের ন্যায় বয়ে চলেছে এঁকেবেঁকে।বিপদজনক সকল বাক,যার ফাঁকে ফাঁকে প্রজ্জ্বলিত টিমটিমে সবুজ এবং লাল বাতির বহর। ট্র্যাকের স্থানে স্থানে ট্রিট ল্যাম্পের মতন পোস্ট,হলুদাভ চকচকে আভা ছড়াচ্ছে।একদম প্রারম্ভ সীমানায় সার দিয়ে দন্ডায়মান রেসিং মডেলের বেশকিছু বাইক।সবগুলোর মডেল এক এবং রং কালো কিংবা কালো বর্ণের কাছাকাছি।শক্তিশালী ইঞ্জিনের শব্দে মুখরিত পরিবেশ।রোযা হতভম্ব হয়ে সবকিছু লক্ষ্য করে গেলো।রেসিং ট্র্যাক ঘিরে রয়েছে গ্যালারি।খানিকটা ফুটবল কিংবা ক্রিকেট মাঠের আদলে তৈরী করা হয়েছে।গ্যালারি এবং ট্র্যাকের মাঝে ধাতব জাল স্থাপিত,যার থামে থামে মোতায়েন রয়েছে রক্ষী।সবথেকে ভ*য়ংকর ব্যাপার গ্যালারির একদম উঁচুতে স্থাপিত টাওয়ারের মতন অঞ্চল,যেখানে বিশালাকৃতির দুটি অ*স্ত্র দৃশ্যমান।স্ট্যান্ডে বসিয়ে তা নিশানা করে রাখা হয়েছে ট্র্যাকের দিকে।আনমনে একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো রোযা।কি দূর্বার মৃ*ত্যুর আয়োজন!

বর্বর মধ্যযুগীয় সময়।যেখানে ক্ষমতাবান শাসকগণ নিজেদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে ধ্বং*সখেলা রচনা করে অভ্যস্থ ছিলেন। অপরা*ধীদের উন্মুক্ত ময়দানে হিং*স্র শিকারী জন্তুর সম্মুখে ছেড়ে দেয়া হতো।অতঃপর জীবন রক্ষার নিশ্চিত ব্যর্থ লড়াই উপভোগ করতো শত সহস্র মানুষ।জ*ন্তুটি যখন মা*নবদে*হ ছি*ন্ন বি*চ্ছি*ন্ন করে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করতো, তখন উদযাপনে মেতে উঠতো গোটা ধরিত্রী।সেই যুগ হয়ত বদলেছে,কিন্তু বদলায়নি মানুষ!
নিজের কাঁধে স্পর্শ টের পেতেই বাস্তবতায় আগমন ঘটলো রোযার।পাশে দিমিত্রীর অস্তিত্ব তাকে অদ্ভুত এক অনুভবে পরিপূর্ণ করলো।তার কানের নিকট ঝুঁকে দিমিত্রী বিড়বিড় করলো,

– এনজয়িং ইওরসেল্ফ?
মুষ্টিবদ্ধ হাত গাউনের ভাঁজের অন্তরালে লুকিয়ে রোযা জানালো,
– আমার ভালো লাগছে না।আমি একটু বসবো।
দিমিত্রীর চেহারায় সামান্য উদ্বিগ্নতা পরিলক্ষিত হলো।মাথা দোলালো রাশিয়ান গ্যাং নেতা।গাঢ় নীল বর্ণের পরিচ্ছদে আবৃত গার্ডরা রোযাকে গ্যালারিতে নিয়ে গেলো।নিচের দিক থেকে তৃতীয় নম্বর সারিতে আরামদায়ক সোফার গদিতে বসলো রোযা,অনুধাবন করলো এখানে বিশেষ বিশেষ মানুষদের জন্য অতিরিক্ত ব্যবস্থা রয়েছে।আপেলের রসপূর্ণ গ্লাস ট্রেতে করে সাজিয়ে রাখা হলো তার সামনে। কণ্ঠতালু শুকিয়ে খটখটে হয়ে রয়েছে অনুধাবন করে রোযা একটি গ্লাসে চুমুক দিলো।সুচারু দৃষ্টি তার পর্যবেক্ষণে ব্যাস্ত চারিদিক।দুইটি প্রবেশপথ,তিনটি বাহিরের পথ, দুইপাশে দুইটি টাওয়ার,গ্যালারি ঘিরে থাকা জন পঞ্চাশেক গার্ড…..সবটুকু তথ্য নিজের মস্তিষ্কে ধারণ করে নিতে থাকলো সে।বলা বাহুল্য এর মাঝে নিজের উপর অদূর হতে আপতিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার অনুভূত হলোনা।

কন্ট্রোল রুম।
চারিদিকে স্থাপিত উনিশটি মনিটরে সুচারু দৃষ্টি স্থাপিত চারুলতার। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বস্তুও তার অভিজ্ঞ নজর এড়াচ্ছেনা।চোখে একটি বড়সড় গোলগাল ফ্রেমের চশমা ,যা তার কপোলের উপরাংশ পর্যন্ত ঠেকেছে।পরিধানে রেড ওয়াইন বর্ণের শার্ট এবং আইভোরি ফরমাল প্যান্ট।দুহাত গুঁজে রাখা পকেটে।মনিটরের সামনের চারজন বান্দা ব্যাস্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে।মিনিট চারেক বাদে চারুর আদেশে গমগম করে উঠলো চারিদিক।
– কিপ ওয়াচিং। সামান্যতম সন্দেহজনক কিছু নজরে আসলেই আমাকে জানাবেন।
– ইয়েস ম্যাম।

দরজা ঠেলে বাইরে পা রাখতেই বিপরীত প্রান্তে থেকে হেঁটে আসা একজন একটি ফাইল বাড়িয়ে ধরলো, তা গ্রহণ করে খুলতেই সুদর্শনার টানা গভীর ভ্রুজোড়া উঁচু হলো বিস্ময়ে।
– এই পর্যন্ত কোন প্রতিযোগী বিজয়ী হবে সে ভিত্তিক গ্যা*ম্বলিংয়ে মোট দুইশো কোটি সাতানব্বই লাখ সত্তর হাজার টাকা হিসাব করা হয়েছে।
চারুর ওষ্ঠাধরজুড়ে সুবিস্তৃত এক হাসির রেখা প্রকাশ পেলো,ফাইলটি ঠাস্ করে বন্ধ করে সে অস্ফুট স্বরে বললো,
– মানুষ আর কখনো মানুষ হবেনা!

ফাইলটি ফিরিয়ে দিয়ে করিডোর বেয়ে অগ্রসর হলো চারুলতা।সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে নিচতলায় পৌঁছে ডানদিকের বিস্তৃত স্থানে প্রবেশ করলো।শক্ত টাইলসের মেঝেতে তার পরিধানকৃত সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার হিলজোড়া ম্রিয়মাণ অথচ প্রভাবশালী এক শব্দের প্রতিধ্বনি ঘটালো।নিজের হাতঘড়ির দিকে নজর গেলো তার,ফোন বের করে পিতা বিলাল রেমানকে একটি মেসেজ করলো কন্যা।
প্রিন্সেস: ঢাকার পরিস্থিতি?
উত্তর এলো মিনিটখানেকের মাঝেই।
বেস্ট ড্যাড: নিয়ন্ত্রণে।দুই ঘণ্টা সময়।
প্রিন্সেস: গ্রেট।
বেস্ট ড্যাড: ওদিকের সবকিছু ঠিকঠাক?আসমান?

প্রিন্সেস: আপাতত সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক চলছে।চিন্তার কিছু নেই।ভাইয়া আছে।
বেস্ট ড্যাড: আসমান ইয ভেরি স্ট্রং।তারপরও বেইবি, ওর খেয়াল রেখো কেমন?
প্রিন্সেস: অফকোর্স ড্যাড।
এটুকুই।ফোন পকেটস্থ করে সামনের দরজার উদ্দেশ্যে তাকালো চারুলতা।হাত বাড়িয়ে পাশের প্যাডে পিনকোড প্রবেশ করালো।দরজা খুলে প্রবেশপথ উন্মুক্ত হতেই ভেতরে ঢুকলো।

বেশ কয়েকটি টেবিল এবং সোফা। টেবিলজুড়ে রাখা ছয়টি হেলমেট, গ্লাভসের কয়েকজোড়া এবং আরো বেশকিছু আনুষঙ্গিক।দুইজন ছেলে গ্লাভস ঠিকঠাক করতে ব্যাস্ত।তৃতীয়জন একজোড়া ডাম্বেল হাতে ব্যায়াম করছে।একজন জানালার ধারে দন্ডায়মান, হাতে মোবাইল ফোন।অতি মনোযোগী দৃষ্টিতে কিছু পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।সবার মাঝে একজন সোফায় বসে নিচু হয়ে নিজের বুটজোড়ার ফিতা শক্তভাবে বাঁধছে।তার আঙুলের কার্যক্রম লক্ষ্য করে মৃদু হাসলো চারু,এক হাঁটু মুড়ে বসে বিড়বিড় করলো,

– জুতোর ফিতা বাঁধার এই স্টাইলের জন্য তোমায় বিশ্ব আজীবন স্মরণে রাখবে।
ছেলেটি মুখ তুলে তাকালো, চারুলতার সুদর্শনা অবয়ব দৃষ্টিগোচর হতেই তার পাতলা অধরে বক্র হাসির উৎপত্তি ঘটলো।তৎক্ষণাৎ নিজের হাত সরিয়ে সে জানালো,
– তুমি এই স্টাইলে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলে বিন্দুমাত্র ক্রোধান্বিত হবনা,ট্রাস্ট মি।
কিঞ্চিৎ মুহূর্ত ছেলেটির দৃষ্টিতে চেয়ে চারু নিচে তাকালো,নিঃশব্দে জুতোর ফিতা বেঁধে দিতে আরম্ভ করলো।স্পষ্ট অনুভূত হলো তার,ছেলেটির নজর তার অবয়ব থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও সরছেনা।
– ভিকি….

বিড়বিড় করতেই হাসলো ভিকি নামক ছেলেটি, নিজের ঘাড় অবধি নেমে যাওয়া মসৃণ কেশে আঙুল বুলিয়ে বললো,
– আমার কি দোষ? হোয়েন ইউ লুক দিস মাচ প্রিটি? আউচ…!
তৎক্ষণাৎ নিজের হাঁটুতে জোর আঘাত অনুভব করে ভিকি হাঁটু চেপে ধরে খিলখিল করে হাসতে থাকলো।অপরদিকে চারুলতা উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উত্তর করলো,
– বড় আপুদের সম্মান দিয়ে কথা বলবে,বাচ্চা!
চারুলতা উল্টো ঘুরতেই ভিকি উঠে দাঁড়ালো, প্রতিবাদের সুরে বলে বসলো,
– হেই,আমি চব্বিশ।এখানে বাচ্চা কে?
– আর আমি তোমার দাদীর বয়সী।
ফিরে তাকিয়ে চারুলতা উত্তর করতেই বিস্তৃত হেসে এগিয়ে এলো ভিকি,মাথা কাত করে তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে জানালো,

– আই ডোন্ট মাইন্ড এইজ গ্যাপ,সুইটহার্ট।
তীর্যক হাসি প্রস্ফুটিত হলো সুদর্শনার ওষ্ঠাধরে, ধীরপায়ে অগ্রসর হলো ভিকির দিকে।
– আমার এক দুঃসম্পর্কের নানী রয়েছে,এই বছর সাতানব্বইয়ে পড়লো।বিধবা মানুষ, তোর প্রস্তাব চালাবো?
অতর্কিতে পিছন থেকে ভেসে আসা অনুভূতিপূর্ণ ভারিক্কী কণ্ঠস্বরে চারুলতা মাঝপথেই থমকালো।পরক্ষণেই নিজের কাঁধে শক্তিশালী পুরুষালী হাতের স্পর্শ টের পেলো।মুহূর্তের মাঝেই অনুভব করলো এক উষ্ণ অস্তিত্বকে,ঠিক তার পিছনে,তার অবয়বে একদম মিশে গিয়েছে যেন।একটি হাত কাঁধে,এবং অপর হাত কোমরে স্থাপিত হয়েছে,প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে।ভিকি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ,তারপর বিড়বিড় করলো,

– নিহাদ ভাই?
মুচকি হাসি ফুটলো নিহাদের অধরপল্লবজুড়ে। নুয়ে চারুর কাঁধে চিবুক ছুঁয়ে প্রেয়সীর কপোলে আলতো করে চুমু খেয়ে প্রশ্ন করলো,
– বললি না?তোর প্রস্তাব চালাবো কিনা?
ভিকির চোয়াল ঝুলে পড়লো এমন অন্তরঙ্গ দৃশ্যে।তাতে অস্বস্তিবোধ করে চারুলতা নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে মৃদু কন্ঠে শুধালো,
– এসব কি হচ্ছে নিহাদ?আমাকে ছাড়ো।
উত্তরে দ্বিগুণ উৎসাহে তাকে আঁকড়ে ধরলো প্রিয়তম। টানা টানা নয়নজোড়ার স্ফুলিঙ্গ খচিত দৃষ্টি তার প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত।ভিকি তাতে খানিক কেশে উঠে ঘাড় ডলতে ডলতে বললো,
– আমার সঙ্গে মজা করছো নিহাদ ভাই?
শব্দ করে হাসলো নিহাদ, চারুলতার দীঘল চুলে মুখ ডুবিয়ে জানালো,

– তুই কি আমার বেয়াই লাগিস যে তোর সঙ্গে মজা করবো?একদম মজা করছিনা রে পাগলা। এইজ ডাজেন্ট ম্যাটার টু ইউ রাইট?
– এহেম….ওটাতো….
– ওটাতো কি?শুধুমাত্র আমার সুদর্শনা হবু স্ত্রীর বেলায় খাটে,তাইনা?
সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো চারুলতা।ভিকির বাকরুদ্ধ দৃষ্টি তার উদ্দেশ্যে আপতিত।বিস্তর হাসির উদগীরণ ঘটিয়ে নিহাদ চারুর হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে আনলো,উৎফুল্ল কন্ঠে প্রকাশ করলো,
– তোমাকে আসমান ভাই এক্ষুণি ডাকছে।চলো চলো।
– কিন্তু…
প্রতিবাদের সুযোগ হলোনা।নিহাদ তাক জোরপূর্বকই টেনে নিয়ে গেলো,পিনকোড প্রবেশ করিয়ে দরজা খুলে সোজা বাইরে চলে এলো।অপরদিকে অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে তখনো স্তব্ধ হয়ে তাদের চলে যাওয়ার পথে চেয়ে থাকলো ভিকি।কয়েক মুহূর্তের স্থবিরতা।ঠিক পরমুহুর্তেই ফিক করে হেসে ফেললো ছেলেটি,নিজের চুলে আঙুল বুলিয়ে পুনরায় মনোযোগ দিলো কাজে।

হাতে দুটো গ্লাস নিয়ে খানিক লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হেলেদুলে রোযা এগিয়ে যাচ্ছে বিপরীত প্রান্তের সোফার উদ্দেশ্যে।এক ককেশীয় ধাঁচের চেহারাধারী মধ্যবয়স্ক পুরুষ রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে বসে আছে। হিসাবী দৃষ্টি তার ট্র্যাক বরাবর নিবদ্ধ। সোফার চারিদিক ঘিরে রয়েছে নিজস্ব গার্ডের বহর।রোযা অধরে বিস্তর হাসি ফোটালো,খানিক অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে প্রস্ফুটন ঘটালো আবেগীয় ঝিলিকের।সোফার নিকট পৌঁছেই খিলখিল হাসি তুলে আবেশপূর্ণ এক রমণীসুলভ কন্ঠে ইংরেজি ভাষায় শুধালো,
– বসতে পারি?
লোকটি মুখ তুলে তাকালো।লালায়িত দৃষ্টি তার রোযাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো।বিড়ালের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত স্বর্ণালী ধাঁচের মণিজুড়ে প্রকাশ পেলো অব্যক্ত এক আকর্ষণ।দুই আঙ্গুলের ইশারায় গার্ডদের সরিয়ে রোযাকে পাশে বসার ইঙ্গিত করলো।হেসে প্রদানকৃত আসন দখল করে বাম হাতের ওয়াইনের গ্লাসটি জ্যোৎস্না বাড়িয়ে ধরলো লোকটির উদ্দেশ্যে।

– আমার দুয়ারে স্বয়ং চাঁদের পদার্পণের কারণ জানতে পারি?
ওয়াইনের গ্লাস গ্রহণ করে লোকটি জিজ্ঞেস করতেই রোযা মাথা দোলালো।নিজের নিকট থাকা অরেঞ্জ জুসের গ্লাসটি খানিক চেপে ধরে বিড়বিড় করলো,
– আমার সঙ্গ খারাপ লাগছে বুঝি?
তার এমন আবেদনে লোকটির নির্বিকার মুখাবয়বে তীর্যক হাসির প্রস্ফুটন ঘটলো।নিকটে ঝুঁকলো সে রোযার,ফিসফিস কন্ঠস্বরে জানালো,

– অফকোর্স নট। আই লাইক গুড কম্পানি। অ্যান্ড ইউ আর নট গুড…. বাট গর্জিয়াস!
মুচকি হাসলো রোযা,কুলকুল করে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী যেন তার অভিব্যক্তিতে।চুমুক দিল জুসের গ্লাসে।অভিজ্ঞ নজরে স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো লোকটির তার ওষ্ঠাধরে নির্লজ্জ দৃষ্টিপাত।কাজ হয়েছে!মনে মনে ভাবলো এককালে জীবনের তরে আকর্ষণকে জীবিকা বানাতে যাওয়া রোযা।এক চুমুকে সম্পূর্ণ গ্লাস নিঃশেষ করে হেলান দিলো সে লোকটির বাহুতে।তাতে যারপরনাই খুশি মনে হলো লোকটিকে।হায়রে পুরুষ!আপনমনে পরিহাসের হাসি হাসলো অমানিশার অর্ধাঙ্গিনী।

– কার পার্টনার তুমি,মায়াবিনী?
নিজেকে দূর্লভ সুযোগ প্রদান করে লোকটি রোযার চিবুক ছুঁয়ে দিলো,আঙুলের অপবিত্র স্পর্শ বয়ে চললো অধরপল্লব পর্যন্ত।ইচ্ছা হলো তৎক্ষণাৎ নিজেকে গুটিয়ে নিতে,সর্বস্ব প্রয়োজন হলো দীপ্তির নিজেকে নিয়ন্ত্রণে।হাতটি মোলায়েম ভঙ্গিতে পাকড়াও করে রোযা বিড়বিড় করলো,
– ধরে নিন,আপনার?
সন্তুষ্টির হাসি হাসলো লোকটি। ঝুঁকলো আরো সন্নিকটে।উদ্দেশ্য রোযার গ্রীবাদেশ।কিন্তু বাসনা পূরণের পূর্বেই এক হাত বুকে ঠেকিয়ে তাকে আটকে রোযা উৎফুল্ল এক ঝিলিকমাখা দৃষ্টিতে টেবিলের উপর রাখা ফোনের দিকে চেয়ে বললো,

– আপনার ওয়ালপেপার তো দারুণ সুন্দর!
অতর্কিতে এমন বেফাঁস মন্তব্যে লোকটি টেবিল থেকে নিজের ফোন তুলে নিলো,মেসেজ আসার কারণে স্ক্রীন ভেসে উঠেছে।ওয়ালপেপার হিসাবে রয়েছে তার পালিত পুডল প্রজাতির কুকুরের ছবি।সেটি লক্ষ্য করে সে বললো,
– ভালোমত দেখতে চাও?
ন্যাকামি মিশ্রিত এক ভঙ্গিতে রোযা সম্মতি জানালো, যেন সে খুবই উৎসাহী।তাতে হেসে লক খুলে তার হাতে ফোন তুলে দিলো লোকটি।সেটি গ্রহণের সময় মুহূর্তের জন্য নিজের হৃদস্পন্দন থমকে যেতে অনুভব করলেও অভিব্যক্তিতে সেই অনুভূতির প্রকাশ ঘটতে দিলোনা রোযা।
অবশেষে!

ফোনটি হাতে নিয়ে লোকটির পুডল কুকুর দেখার বাহানায় সে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষা করতে আরম্ভ করলো।লোকটি ওয়াইনের গ্লাসে মনোযোগ দিয়েছে, তার গার্ডরাও খুব বেশি আগ্রহী নয় মনিবের একান্ত দৃশ্য অবলোকনে।অতি সন্তপর্নে চেহারায় প্রফুল্লতা ধরে রেখে রোযা দ্রুত মেইল অপশনে গেলো।উত্তেজনায় থরথর করে কম্পিত হলো আঙুল তার।যেই না নিজের মেইল আইডি সে ওপেন করতে যাবে অমনি এক হ্যাঁচকা টান।তবে অপ্রস্তুত হয়ে আসেনি রোযা।শক্তভাবে ধরে রেখে কোলের মাঝে লুকিয়ে অতি দ্রুত এলোমেলো আঙুল ছুঁয়ে পুনরায় পুডলের ছবিতে ফিরলো সে।দূর্বার হৃদস্পন্দন নিয়ে ফিরে তাকিয়ে আবিষ্কার করলো নীলরঙা পোশাক পরিহিত দিমিত্রীর গার্ডদের।ফোনটি কেড়ে নেয়ার চেষ্টায় রয়েছে।

– কি ব্যাপার?কি হচ্ছে এখানে?
লোকটি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রোযার হাত থেকে ফোন টেনে নিয়ে সেটি নিরীক্ষণ করে তার কোলে ছুঁড়ে দিলো গার্ড।তারপর বললো,
– দুঃখিত স্যার। ম্যামের এখন যাওয়ার সময় হয়েছে।
তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টি ব্যতিত ভিন্ন কিছু প্রয়োজন হলোনা রোযাকে সাবধান করতে।তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে অগ্রসর হলো রোযা।অনুসরণ করলো তাকে গার্ডরা।অপরদিকে লোকটি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো নিজ আসনে।এইমাত্র কি হয়ে গেলো বুঝে উঠতে বেগ পোহাতে হচ্ছে তাকে।
গ্যালারি পেরিয়ে নিজের আসনের দিকে ফিরে আসতে আসতে রোযা হঠাৎ থমকে পড়লো,সঙ্গে তাকে পাহারারত গার্ডরাও। হিং*স্র ভঙ্গিতে ফিরে তাকালো রোযা,তার দৃষ্টির ক্রোধাগ্নি লক্ষ্য করে সকলে এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত হতে বাধ্য হলো।কিন্তু তাদের বিহ্বল করে রোযা খেঁকিয়ে উঠলো,

– বাথরুমে যাবো!
গার্ডরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করলো।দলের নেতা মাথা হেলিয়ে এক অবোধ্য ইশারা করতেই একজন এগিয়ে হাত তুলে আহ্বান করলো,
– এদিকে আসুন।
অনুসরণ করলো তাকে রোযা,দুপাশে শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখলো হাতজোড়া।গ্যালারি অতিক্রম করে স্থাপনায় প্রবেশ করলো সে এবং তাকে ঘিরে থাকা চারজনের দলটি।কয়েকটি করিডোর পেরিয়ে গার্ড সামনে দেখিয়ে জানালো,

– লেডিস ওয়াশরুম এদিকে।
ধন্যবাদের বালাই এড়িয়ে রোযা তক্ষুণি এগোলো,তাকে সকলে অনুসরণ করতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে নিজের উচ্চ কণ্ঠের প্রতিধ্বনি তুলে হুংকার ছুড়লো,
– খবরদার বলছি!আমাকে বাথরুম পর্যন্ত অনুসরণ করলে এই দুই ইঞ্চির হিল দিয়ে পি*টি*য়ে একেকটাকে মাওয়াঘাটের ইলিশের লেজ ভর্তা বানিয়ে ছাড়বো!বমি করতে যাচ্ছি, এক্কেবারে গায়ের উপর করে দেবো,মনে থাকে যেন!

দ্রুত পা ফেলে মুহূর্তেই করিডোরের ওপ্রান্তে আড়াল হয়ে গেলো রোযা।চারজন গার্ড বি*দ্যুৎস্পৃ*ষ্ট হয়েছে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো তার চলে যাওয়া পথের দিকে।
করিডোরের এপাশেই রেস্টরুমে প্রবেশ করলো রোযা।একপাশে টয়লেটের দরজা, অপর পাশে বেসিন।দেয়ালে সংযুক্ত আয়না।কয়েকটি ভেন্টিলেটর রয়েছে উপরের দিকে। টয়লেট সিটে দাঁড়িয়েও নাগাল পাওয়া অসম্ভবপ্রায়।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো রোযার বক্ষ হতে।উবু হয়ে বসে পড়ল সে,মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল পরিধানের গাউন।পরোয়া করলোনা কোনোপ্রকার।দুবাহু তার জড়িয়ে গেলো উদরজুড়ে।কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।তারপরই নয়ন উপচে বইতে থাকলো অশ্রুধারা।সিক্ত হলো কপোল,অধর কাপলো তিরতির করে।মাথা নত করে হাঁটুতে মুখ গুঁজলো রোযা,প্রবল চেষ্টা চালালো কান্নার দমককে রোখার।

– আসমান….
ভগ্ন কন্ঠস্বরের অবোধ্য আর্তনাদ।আজ কতদিন?কতটা সময়?একটিবারের জন্যও নিজের চাঁদের অনুভবটুকু লাভ করার ভাগ্য হয়নি জ্যোৎস্নার।ভেঙে আসতে চাইছে সমস্ত অস্তিত্ব তার।গুঁড়িয়ে গিয়েছে চিত্ত।চারিপাশে শুধুই আঁধার।যে আঁধারের কোনো সমাপ্তি নেই।

কতক্ষন সময় ওভাবে বসেছিল রোযা টের পেলোনা।অবশেষে একটা সময় হাতের উল্টোপিঠে অশ্রু মুছে নিতে নিতে উঠে দাঁড়ালো সে।দ্রুত নজর বোলালো প্রত্যেক কোণায়,একটিমাত্র সুযোগের আশায়।কিন্তু নেই, কিছু নেই।জালিকাকৃতির ধাতব পাতে আবদ্ধ ভেন্টিলেটর বেয়ে বেরোনো অসম্ভব।তাছাড়া বিরাট ঝুঁকির হয়ে যাবে উচ্চতার সঙ্গে পাঙ্গা নেয়ার ব্যাপারটা।সে একা নয়,তার গর্ভে ভালোবাসার চিহ্ন বহন করছে।এই অংশের নিরাপত্তা অতীব জরুরী।হতাশায় নিজের চিবুক ঘষলো রোযা। হারার আগে হার মেনে নেয়া কোনোদিন শেখেনি সে।লড়াই করে যাবে অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত,তাতে জিত আসুক কিংবা না আসুক,তবু সে তৃপ্তি পাবে এই ভেবে যে চেষ্টার কোনো কমতি ছিলোনা।মস্তিষ্কে নতুন পরিকল্পনায় ফাঁদ বুনতে বুনতে বেসিনের নিকট এলো।আয়নায় নিজের অবয়ব লক্ষ্য করলো। অশ্রুপাতের কারণে চেহারায় কিছুটা মলিনতা ছেয়েছে, কিন্তু অভিজাত পোশাক এবং অপ্রতিরোধ্য চাহুনি তার অস্তিত্বকে আত্মবিশ্বাসী করেছে।

” অমানিশার দীপ্তি তুই, চাঁদের জ্যোৎস্না।পরাজয়?তোর অভিধানে এমন শব্দের কোনো স্থান নেই…..”
দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করলো রোযা,বুজলো নয়ন।অতঃপর পুনরায় খুললো তা।ঝুঁকে বেসিনের কল খুলে মুখে পানির ঝাপ্টা দিলো।যেন ধুয়েমুছে সাফ করলো সকল গ্লানি এবং দূর্বলতা।হাত বাড়িয়ে পাশের বক্স থেকে টিস্যু সংগ্রহ করলো।মুখে আলতো আঁচে চেপে ধরে পানিটুকু শুষে নিতে থাকলো।
ক্লিক!
দরজা খোলার মৃদু আওয়াজে চট করে ফিরে তাকালো রোযা। রেস্টরুমের প্রবেশ পথে তৎক্ষণাৎ আবিষ্কৃত হলো এক বলিষ্ঠ পুরুষালী অস্তিত্ব।সম্পূর্ণ অবয়ব তার কালো হুডি এবং গাবার্ডিনে আবৃত।পায়ে বিশালাকৃতির কেডস্।তার পিছনদিক প্রদর্শিত হচ্ছে।সহসাই ঘাবড়ে গেল রোযা।বেসিনের প্রান্ত আঁকড়ে ধরলো।সাবধানী ভঙ্গিতে বলে বসলো,

– এক্সকিউজ মি মিস্টার,এটা লেডিস ওয়াশরুম।
নীরবতা।ক্রমশ হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলো রোযার।মুষ্টিবদ্ধ হাতের মাঝে আঁকড়ে ধরলো টিস্যু,আশেপাশে চাইলো কোনো ব্যবহারযোগ্য বস্তুর আশায়।কিছু না পেয়ে আয়নার দিকে তাকালো।ঠিক কতটা জোরে আ*ঘা*ত হা*নলে এই আয়না ভা*ঙা সম্ভব হবে?টুকরোগুলো অ*স্ত্র হিসাবে দারুণ হবে।কনুই তুললো রোযা,প্রস্তুত সে প্রতিক্রিয়ায়।
– জানি।

একটিমাত্র শব্দ,তার বজ্রকন্ঠস্বর।উপলব্ধিতে যথেষ্টর তুলনায়ও অধিক।সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো রোযা।এক অনুভবের শিহরণে কাপলো তার সর্বাঙ্গ।অতি ধীরে পিছন ফিরে দাঁড়ালো মানুষটি। হুডির টুপি সরালো, এক টানে খুললো মুখের মাস্কটি।টলটলে প্রগাঢ় কৃষ্ণগহ্বরে চাইলো সম্মুখে। শুভ্রতার অস্তিত্ব অবলোকন করে রোযার অধরজোড়া ফাঁক হলো কিঞ্চিৎ,সেই ফাঁক গলে ধ্বনিত হলো,
– আহ… আস…মান!
ছেড়ে আসতে চাইলো শরীর,কিন্তু নিজেকে জোরপূর্বক দন্ডায়মান রাখলো রোযা।আজ তার ভাগ্যাকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে।এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন না করলে যেন তার আজীবন বৃথা যাবে।

ডার্কসাইড পর্ব ৬১

– জ্যোৎস্না….
কম্পিত কন্ঠস্বরের সম্বোধনে রোযার হৃদয়ে এক সমুদ্রসম প্রশান্তি অনুভূত হলো,যার আবেগীয় অনুভব কোনো ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

ডার্কসাইড পর্ব ৬৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here