ডার্কসাইড পর্ব ৬৩
জাবিন ফোরকান
– হবু স্ত্রী?
চারুলতার কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠস্বরে হনহন করে এগোতে থাকা নিহাদ থমকালো,মাথা কাত করে পিছন ফিরে তাকালো।বক্ষে দুবাহু ভাঁজ করে ধীর পদক্ষেপে সামনে এসে চারু পুনরায় বললো,
– একটু বেশি অধিকার ফলানো হয়ে গেলোনা?
তীর্যক হাসি প্রস্ফুটিত হলো নিহাদের বিস্তৃত অধরপল্লবে।পিছন ঘুরে পরিধানকৃত বাইক স্যুটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সামান্য ঝুঁকলো সে।রমণীর দৃষ্টিতে তীব্র আবেদন মিশিয়ে বিড়বিড় করলো,
– মিথ্যা কিছু বলেছি বলে মনে হয়না।
বিনোদন পেলো চারু।দুবাহু নামিয়ে এক হাতে নিহাদের বাইক স্যুটের জিপার নিয়ে খুনসুঁটি খেলায় মেতে জানালো,
– রাত দুপুরে ডাহা মিথ্যাচার কেউ তোমার থেকে শিখুক!
নিহাদের সুদর্শন চন্দনসুলভ চেহারায় সামান্য বিহ্বলতা ফুটলো।তার দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে হাসলো চারুলতা।জিপার ছেড়ে কাঁধে হাত ঝেড়ে সরে দাঁড়িয়ে ব্যক্ত করলো,
– আমি তোমার হবু স্ত্রী নই।ইন কেইস ইউ ফরগট…. তুমি এখনো কোনো উত্তর করোনি।সেক্ষেত্রে আমি তোমার সঙ্গে কোনো বন্ধনে আবদ্ধ নই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের প্রকাশ ঘটলো চট্টলার বান্দার দৃষ্টিতে। অধরজোড়া ফাঁক হলো,কিন্তু কোনো শব্দ উচ্চারিত হলোনা।চারুলতা কথাটি মজার ছলে বলেছে তা স্পষ্ট।কিন্তু সেই বক্তব্যের সঙ্গে মিশ্রিত অভিমান এবং হতাশাটুকু নিহাদের অনুধাবন এড়াতে পারেনি।আপন মস্তিষ্কে ভাবলো দেবভক্ত।আদতেই, সে চারুলতাকে এখনো পর্যন্ত কোনো উত্তর দেয়নি।অতর্কিতে তাকে বিয়ে করতে চায় এটুকু আবেদন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ সবকিছু,আসমান এবং বিলাল রেমানের সঙ্গে কথোপকথন হলেও উভয়ে তাকে সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে উৎসাহিত করেছে।কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে চারুর সঙ্গে এই নিয়ে তার কথা হয়নি খুব একটা।হবে কিভাবে?লেপ্টে থাকাকালীন সময়ের ৯০ ভাগ তারা শুধুমাত্র ঝগড়া করেই কাটায়।জীবন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ সেখানে বড়ই অস্বস্তিজনক।তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে তার অব্যক্ত প্রেয়সী অভিমান করতে পারে তা তার বোধগম্য হয়নি কোনোদিন।
“ তোর অনেক কিছু শেখা বাকি….নিহাদ।”
অন্তরে ধ্বনিত হলো মস্তিষ্কের হতাশাজনক বাণী।একটি নিঃশ্বাস ফেলে চুলে আঙুল চালিয়ে মৃদু হাসলো নিহাদ।তারপর সহজাত দুষ্টুমিমাখা কন্ঠে বলে বসলো,
– তোমার শখের কোনো কমতি নেই দেখছি, ডাইনী! আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছ?ঠিক যেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো ময়লার ডাস্টবিন।
মুষ্টিবদ্ধ হলো চারুলতার উভয় হাত, তিরতির করে কাপলো ওষ্ঠ,তীব্র ক্রোধে।তবুও হাসি ধরে রেখে বিপদজনক কন্ঠে উত্তর করলো,
– আর তোমাকে দেখলে মনে হয় রাস্তার বাঙ্গু মাস্তান!
– ঠিক ঠিক,এই বাঙ্গু মাস্তানকেই বিয়ে করবে বলে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছিলে তাইনা?
দীর্ঘ কয়েক প্রশ্বাস গ্রহণ করতে হলো চারুকে, নিজেকে শান্ত রাখতে।দৃশ্যটি লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসলো নিহাদ,কিছুতেই মেয়েটিকে জ্বালাতন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেনা সে।অবশেষে দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকালো প্রেয়সী,স্থির কন্ঠে বললো,
– কি জানো নিহাদ?তোমার মস্তিষ্কে গোবরের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেছে।খুব দ্রুতই মানসিক চিকিৎসা করাও,নাহলে আজীবন পাবনা মেন্টাল হাসপাতালেই কাটাতে হবে।
– হ্যাঁ কাটাবো।আমি পাগলু,তুমি পাগলী।দুইজন মিলে হাসপাতালের সেলে ফুলটোক্কা খেলবো।আর রাত হলেই দেবের মুভি দেখতে বসবো।দেখবে দুই সেকেন্ডের মধ্যে তুমি আমার গুরুর ভক্ত হয়ে যাবে।
খিলখিল করে হাসতে থাকলো নিহাদ,চারুলতার ঘু*ষি তৎক্ষণাৎ আছড়ে পড়লো তার শক্ত বুকে।
– আউচ….হাহাহা…
– ভিকি তোমার থেকে হাজার গুণ ভালো!কেনো যে ম*র*তে তোমার মতন একটা গাইগরুর সঙ্গে ফাঁ*সতে গিয়েছি!
সটান উল্টো ঘুরলো চারুলতা। হিলজোড়ায় ঝংকার তুলে হনহনিয়ে এগোলো করিডোর ধরে,উদ্দেশ্য কক্ষে ফিরে যাওয়া।কিন্তু অতর্কিতে তার একটি হাত পাকড়াও করলো নিহাদ।ফিরে তাকাতেই চন্দনরাঙা চেহারায় কৌতুকের বদলে এক অব্যক্ত আবেশের ছায়া দেখা গেলো।সামান্য ভড়কালো চারু,নিহাদের দৃষ্টির হঠাৎ পরিবর্তন তাকে ভাবাচ্ছে।তার আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে নিজের শিরা উপশিরাপূর্ণ লম্বাটে শক্তিশালী আঙুলসমূহ গুঁজে নিহাদ সন্নিকটে সরলো।কন্ঠস্বর তার খাদে নেমে এলো,
– ইয হি…. বেটার দ্যান মি?
প্রিয়তমর প্রভাবশালী অস্তিত্ব চারুলতার অন্তর আন্দোলিত করে তুললো মুহূর্তেই।আনমনে একটি শক্ত ঢোক গিললো সে।জবাব দেয়া সম্ভব হলোনা।নিহাদ ঝুঁকলো,তার দৃষ্টিতে প্রগাঢ় দৃষ্টি মিলিয়ে ফিসফিস করলো,
– ইয হি?
মাথা কাত করে চারু উত্তর করলো,
– আর ইউ জেলাস?
থমকে গেলো নিহাদ, অধরে অধর চাপলো,কোনো শব্দ উচ্চারিত হলোনা তার পক্ষ থেকে।তাতে হাসলো চারুলতা,হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ চাপড়ে জানালো,
– ঈর্ষান্বিত হওয়া দূর্বলতার লক্ষণ।
– ঈর্ষা?
মাথা নেড়ে হাসলো নিহাদ,ভ্রুজোড়া কুঁচকে তীর্যক দৃষ্টিতে প্রেয়সীর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করলো,
– ঈর্ষান্বিত হওয়ার কি কিছু রয়েছে?এই রগচটা দুর্ধর্ষ চুন্নি তো আমারই!
নিহাদের কন্ঠে অস্বাভাবিক ধরণের প্রগাঢ়তা ছিল,যার দরুণ না চাইতেও শিউরে উঠলো চারুলতা।তার শিহরণ লক্ষ্য করে বান্দার হাসি বিস্তৃত হলো।কিন্তু তাকে জিত হাসিল করতে দিতে রাজী নয় রমণী।মাথা উঁচু করে চেয়ে নিজের বাম হাতখানি তুলে চারুলতা মিষ্টি হেসে জানালো,
– অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে লাভ নেই মিস্টার রোডসাইড রোমিও।আমার অনামিকা এখনো উন্মুক্ত।
হাসির মাঝেই এক তীব্র সাবধানবাণী মিশ্রিত।নিহাদের দৃষ্টি চকিতে ঠেকলো চারুলতার কোমল ত্বকে আবৃত হাতে।আঙুলসমূহে কোনো আংটির বাঁধন নেই।
– আই ডিড নট গিভ ইউ এনি রিং ইয়েট…. ডিড আই?
চারুলতা কোনো উত্তর দিলোনা।শুধুমাত্র নিজের দীঘল কেশরাশিতে আঙুল চালিয়ে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে উল্টো ঘুরলো।
– তোমার মতন একটা মোটা চাম*ড়ার গন্ডারের কাছ থেকে আমি ওসব আশাও করিনা। হোয়াটএভার!
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অগ্রসর হতে যেতেই তার বাম হাতটি চেপে ধরলো নিহাদ,সামান্য জোরের সঙ্গেই।তাতে হিসিয়ে উঠে পিছন ফিরে চারু তাকে একচোট দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু তড়িৎ গতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি তাকে সম্পূর্ণ নির্বাক করে দিলো।
প্রেয়সীর হাতটি উত্তোলন করে তার অনামিকা আঙুলটি দাঁতের পাটিতে আঁকড়ে ফেললো নিহাদ।তার অধরের স্পর্শে এক শীতল শিহরণ বয়ে গেলো চারুর শিরদাঁড়া বেয়ে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরো একটু গভীরে ঠেকিয়ে তার আঙুলের মাঝে জোরালো এক কা*ম*ড় বসালো নিহাদ।
– ইউ স্টুপিড!
চিৎকার করতে চাইলেও চারুর কন্ঠস্বর শোনালো অত্যন্ত ক্ষীণ।তাতে তীর্যক হাসলো নিহাদ,দাঁতের চাপ বাড়ালো।য*ন্ত্রণার তরঙ্গ খেলে গেলো সর্বাঙ্গে,এক মধুর যন্ত্রণা যেনো।অবশেষে ঠিক যেমন হঠাৎ করে কাম*ড়ে ধরেছিল,তেমন হঠাৎ করেই তার আঙুল ছেড়ে দিলো নিহাদ।তৎক্ষণাৎ নিজের হাত বুকে চেপে ধরে খেঁকিয়ে উঠলো চারুলতা,
– ভাইয়া একদম ঠিক বলে!তুমি আসলেই পরীর তিন নম্বর বাচ্চা!আমার হা*ড় যদি ভে*ঙেছে তবে তোমাকে আমি ম্যানহোলের পানিতে চো*বা*বো!
ক্রোধের উদগীরণ সমাপ্ত হতেই থমকে গেলো চারু।নিরীক্ষণের জন্য হাতটি দেখতেই অনামিকায় দৃষ্টি আটকে গেলো তার। আঙ্গুলের চারিপাশে কিঞ্চিৎ গভীর এক দাগ হয়ে গিয়েছে,দাঁতের ছাপ স্পষ্ট,তাতে লালচে বহিঃপ্রকাশ।মিটমিট করে তাকালো চারু।ঠিক যেন এক আংটি খচিত তার অনামিকার মাঝে। উপলব্ধিটি তার হৃদয়জুড়ে আবেগের ঢেউ তুললো। চট করে তাকালো সে নিহাদের দিকে।সন্তুষ্টিপূর্ণ দৃষ্টিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে নিজের ঠোঁটের কোণ মুছে নিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলো তার অব্যক্ত প্রিয়তম।গভীর এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল চারুলতা,অন্তরে ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা।
সামনে ঝুঁকলো নিহাদ,তার হাতটি মুঠোয় নিয়ে আঙুলের দাগে নিজের উষ্ণ স্পর্শ বুলিয়ে অনুভূতিপূর্ণ কন্ঠে জানালো,
– সবকিছুর ইতি ঘটুক, রোযাকে উদ্ধার করি,আসমান ভাইয়ের জীবন সুখে ভরে উঠুক, মেঘতীর আবারো জমজমাট হোক।সেই সুখময় সমাপ্তিতে…..
সামান্য বিরতি। চারুলতাকে আবেগের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে ঠেকালো নিহাদের পরবর্তী বক্তব্য।
– এই আঙুলকে হীরকখচিত আংটিতে সজ্জিত করবো।ততদিন হয়ত এই দাগ থাকবেনা,কিন্তু এতে জড়ানো হৃদয় নিংড়ানো আবেদনটুকু সত্যিকার বন্ধনে প্রজ্জ্বলিত হবে।কথা দিচ্ছি…..আমার তেঁতুল গাছের পেত্নী!
টলটলে হলো চারুলতার দৃষ্টি,শেষ শব্দগুচ্ছ তার ধরে ফোটালো হাসির ফোঁয়ারা।সর্বশক্তিতে সে জড়িয়ে ধরলো নিহাদকে।পাল্টা তাকে নিজের সুরক্ষিত বাহুডোরে আড়াল করে নিলো নিহাদ।শক্ত মাং*সপেশী সম্বলিত বুকের মাঝে মুখ গুঁজে চারুলতা বিড়বিড় করলো,
– তুমি কথা দিয়েছ,ভুলে যেওনা।
– বাপের জন্মে কেউ কোনো পেত্নীকে দেয়া কথা ভোলে নাকি? ঘা*ড় ম*ট*কে দেবেনা?
নিহাদকে ঠেলে দূরে সরাতে গেলে হেসে তাকে আরো কাছে টেনে নিলো প্রিয়তম।আলতো করে চুমু খেলো কপালে। নীরবতায় মোড়ানো অত্যন্ত আবেগঘন কিছু মুহূর্ত।তারপর আলিঙ্গন ছেড়ে তার হাত ধরলো নিহাদ।নিঃশব্দে হেসে উভয়ে হেঁটে গেলো সামনে।ফিরে এলো বেশ কিছুক্ষণ আগে ত্যাগ করা কক্ষের ভেতর।প্রবেশ করেই সামনে এগিয়ে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে তাকালো নিহাদ।তার কোমল দৃষ্টি বদলে তাতে স্থান নিয়েছে অগ্নিখচিত এক তুখোড় অনুভব।টেবিল থেকে একজোড়া গ্লাভস এবং হেলমেটখানি তুলে নিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্যে তাকালো সে।দলের নেতা হিসাবে প্রভাবশালী কন্ঠে শুধালো,
– আর ইউ রেডি বয়ে’জ?
তৎক্ষণাৎ সকলে উঠে দাঁড়ালো।সম্মতিসূচক মাথা দোলালো।পিছনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি লক্ষ্য করতে করতে একই সঙ্গে প্রচণ্ড উত্তেজনা এবং আতঙ্ক অনুভব করলো চারুলতা।
পিনপতন নীরবতা।শুধুমাত্র দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের অনুভব।রোযা নিজের হাঁটুজোড়ায় জোর পাচ্ছেনা।এই বুঝি হুড়মুড় করে লুটিয়ে পড়ে। নিজের দৃষ্টিকে বিশ্বাস করে উঠতে বেগ পোহাতে হচ্ছে তাকে।ভারসাম্যহীন কয়েক পদক্ষেপ এগোলো সে,দুবাহু তুললো ভগ্ন ভঙ্গিতে।
– আসমান…..
অমানিশার নয়নের কৃষ্ণগহ্বর কম্পিত হলো।সহসাই এগোলো,রীতিমত দৌঁড়ে। সহধর্মিনীকে নিজের উষ্ণ বাহুডোরে আগলে নিলো,যেন সমস্ত পৃথিবীর কদর্যতা থেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে ফেললো।
– আসমান….আমার চাঁদ…তুমি…তুমি সত্যিই এসেছ?
ক্রন্দনের দমকে প্রকম্পিত হচ্ছে রোযার সর্বাঙ্গ।নিজের সবটুকু উষ্ণতা বিলিয়েও তাকে প্রশান্ত করা সম্ভব হচ্ছেনা আসমানের পক্ষে।দুহাতে তার মুখ তুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো আসমান,আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো প্রিয়তমাকে।
– তুমি ঠিক আছো রোযা?
নিগূঢ় পর্যবেক্ষণ চালালো সে সামান্যতম ক্ষ*তের আশায়। অপরপক্ষকে ধুলিস্যাৎ করতে বিন্দুমাত্র সময় নেবেনা যদি ভালোবাসার শরীরে কিঞ্চিৎ আঁচড়ও নজরে আসে তার।কিন্তু তেমন কিছুই দেখা গেলোনা।তাতে একইসঙ্গে স্বস্তি এবং কৌতূহল অনুভব করলো আসমান।নিজেকে সামলানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে রোযা বললো,
– আম…আমি ঠিক আছি।ওরা আমাকে কিছুই করেনি।শুধুমাত্র একটা জাহাজের ভেতর আটকে রেখেছিলো।
তার সামনে এক হাঁটু গেড়ে নত হলো আসমান। উদরে ঠেকলো ভাবী পিতার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি।দুবাহু দিয়ে জড়িয়ে কান স্পর্শ করলো সে প্রেয়সীর গর্ভে,হৃদস্পন্দন শুনবার তীব্র বাসনা অন্তরজুড়ে।রোযা আলতো করে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করলো,
– ও সুস্থ আছে আসমান।তোমার আমার ভালোবাসার চিহ্ন নিরাপদে রয়েছে।
দৃশ্যমানভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আসমান।তারপর মাথা তুলে তাকালো।অমানিশার অস্তিত্বজুড়ে এক গ্লানির ছোঁয়া স্পষ্ট খেয়াল করলো রোযা।
– আমাকে ক্ষমা করে দাও জ্যোৎস্না।আমি এবারেও তোমাদেরকে রক্ষায় ব্যার্থ হয়েছি।
পুনরায় অশ্রুতে সিক্ত হলো রোযার নয়ন। জোরে জোরে মাথা নাড়লো সে,ক্রুব্ধ কন্ঠে প্রতিবাদ করলো,
– একদম না আসমান।খবরদার বলছি!নিজেকে দোষারোপ করবে না।যদি তুমি ব্যর্থই হতে তবে বর্তমানে তুমি এখানে কেনো বলো?এইযে আমি তোমাকে দেখতে পারছি,ছুঁয়ে দিতে পারছি।আমার হৃদয়ে আর কোনো অনিরাপত্তা নেই,জানি তুমি আমাকে রক্ষা করবে।
চোখ বুজে নিলো আসমান,অতঃপর আবার খুললো।
– আঁধারের চাইতেও আঁধারমাঝেও তুমি ঠিকই পরিত্রাণের রশ্মিটুকু খুঁজে নাও,তাইনা রোযা?
রোযার দুহাত কাঁপতে থাকলো,আসমানের চমৎকার বিভীষিকা খচিত চেহারা স্পর্শ করে অধর কামড়ে ধরলো সে।কম্পিত ক্ষীণ এক কন্ঠে বললো,
– তুম…তুমি কেমন ছিলে আসমান?
– জাহা*ন্নামে ছিলাম।
সোজাসাপ্টা উত্তর অমানিশার,তাতে ব্যথিত হলো দীপ্তির অন্তর।অশ্রুমাখা ঝাপসা দৃষ্টিতে বিড়বিড় করলো,
– আই মিসড ইউ….
ছলছলে স্রোতধারায় পূর্ণ হলো যন্ত্রমানবের নয়ন, উঠে দাঁড়ালো, ফিসফিসে কন্ঠস্বরে বললো,
– প্রতিটা দিন,প্রতিটা মিনিট,প্রতিটা সেকেন্ড আমার অস্তিত্ব শুধু তোমার অভাবের অনলে দ*গ্ধ হয়েছে।আমার অংশের উদ্বিগ্নতা শরীরের প্রতিটি রোমকূপে বেদনাসূচরূপে বি*দ্ধ হয়েছে।এই অসহনীয় যাতনার চাইতে মৃ*ত্যুও শ্রেয়!
অসহ্য বেদনা হলো অন্তরে।আসমানের বুকে নিজেকে এলিয়ে দিলো রোযা। ক্রন্দন তার সীমা ছাড়িয়েছে।স্তব্ধ হয়ে গেলো অমানিশা,অপরাধবোধ হলো তার।এই মুহূর্তে নিজের যন্ত্রণাটুকু প্রকাশ করা উচিত হয়নি।
– রোযা….আমার কথা শোনো…
ভ্রুক্ষেপ নেই রোযার।যেন সে হারিয়েছে আপন দুনিয়ায়।
বক্ষমাঝে ক্রন্দনরত অর্ধাঙ্গিনীকে কোনোপ্রকারেই শান্তনা দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা আসমানের পক্ষে।আজ তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচলেও ঘোচেনি এই দুরত্বকালীন দুর্বিষহ বিরহজ্বালা।রোযার আবেগ উত্তাল সমুদ্রের ঊর্মীমালা হয়ে আছড়ে পড়ছে আসমানের তপ্ত হৃদয় বালুচরে। প্রিয়তমার মাথায় ক্রমাগত হাত বুলিয়ে যাওয়া সত্বেও ফলাফল শূন্য।আসমানকে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে কেঁদে চলেছে রোযা।
– রোযা,আমার জ্যোৎস্না,প্লীজ…
– চাঁদ….
উত্তরে দ্বিগুণ শক্তিতে আসমানকে বাহুডোরে বেঁধে রোযা ফোঁপাতে থাকলো।তার অনুভূতির জলোচ্ছ্বাসে টলটলে অনুভব ফুটলো হিমালয়ের নয়নেও।চিনচিনে যন্ত্রণা হচ্ছে অন্তরে,স্ত্রীর অশ্রু সহ্য করা যে দায়!কি করবে সে?সময় যে ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে!যেকোনো মুহূর্তে…..আচমকা মস্তিষ্কে এক পরিকল্পনা খেলে গেলো।মুহূর্তের জন্য অনুপযোগী,কিন্তু প্রশান্তিতে প্রয়োজনীয়।দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে আসমান আলতো করে রোযার পিঠে হাত ছোঁয়ালো,একটি ঢোক গলাধঃকরণ করে ঝুঁকলো। অর্ধাঙ্গিনীর কানের কাছে ফিসফিস কন্ঠস্বরে বললো,
– তোমার মনে আছে?সেদিন তোমার জন্মদিন ছিল,এবং আমরা দুজন মেঘতীরের ছাদে…..
ক্রন্দনের গুঞ্জন থামলো।কিঞ্চিৎ ফুলে ওঠা চোখে রোযা আসমানের দিকে তাকালো।মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হলো অমানিশার অধর,বৃদ্ধাঙ্গুলি বাড়িয়ে রোযার সিক্ত চেহারার অশ্রুকণা মুছে নিলো অতি সাবধানে।অতঃপর….
” বেইবি ~আ’ ম, ড্যান্সিং ইন দ্যা ডার্ক
উইথ ইউ বিটউইন মাই আর্মস ”
কন্ঠস্বরটির ফিসফিসে আবেদনজুড়ে কোমলতা, ভালোবাসা এবং মুগ্ধতা। শব্দগুচ্ছ সঙ্গীতের সুরে মিশ্রিত হয়ে একাকার,অতি নিম্ন স্বরে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আবহের প্রকাশ।সম্মোহিত হয়ে পড়ল রোযা।কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনুভব করলো তার কোমরজুড়ে আসমানের দুবাহু জড়িয়ে গিয়েছে,ক্ষীণ লয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুলছে তাকে নিয়ে। আনমনে রোযাও তার সঙ্গ দিলো, পায়ে পায়ে উভয়ে রেস্টরুমের বিস্তৃত টাইলসের মেঝেজুড়ে যেন আবেগময় নৃত্যশৈলী খচিত করে গেলো।এক মুহূর্তের জন্যও একে অপরের নয়ন থেকে কারো দৃষ্টি সরলোনা।অন্তিম লগ্নে আরো নিকটে ঝুঁকলো আসমান,রোযার কানের লতিতে অধর ছুঁয়ে গেলো তার, জারি রাখলো ক্ষীণ সুরের আবেদন।যেন ঘুমন্তপুরীর রাজপুত্র।ঘুম পাড়ানি সুরে বিলিয়ে দিচ্ছে নির্মলতার আবেশ।
– ডার্লিং ইউ লুক….পারফেক্ট টুনাইট….
কন্ঠস্বর মিইয়ে এলো তার, তবুও যেন মুহূর্তটির আবেশ কাটলোনা।হাত দিয়ে রোযার কপালে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে থাকা কেশগুচ্ছ কানে গুঁজে দিলো আসমান,হাসলো মৃদু,ঝুঁকে স্নেহের চুমু আঁকলো।
– আমার নির্মল জ্যোৎস্না…..
জড়ানো মোহনীয় কন্ঠে ফিসফিস করলো আসমান।একফোঁটা অশ্রু গড়ালো রোযার নয়ন বেয়ে,তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।আসমানের কাঁধে মাথা ঠেকালো, তাকে নিজ বাহুডোরে সুরক্ষিত করে নিলো প্রিয়তম। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাসি ফুটলো প্রেয়সীর ঠোঁটে,
– তুমি সবসময়ই জানো কিভাবে আমাকে প্রশান্ত করতে হয়,তাইনা?
তার মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে আসমান উত্তরস্বরুপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
– আর কখনো এভাবে কেঁদোনা জ্যোৎস্না,আমার কষ্ট হয়।
মাথা দুলিয়ে আসমানের মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিলো রোযা, প্রাণভরে গ্রহণ করলো নিজ স্বামীর অস্তিত্বের সুবাস।এই যেন পূর্ণতা। অবশেষে একটুখানি আশার দেখা।ঠিক তখনি অতর্কিতে রেস্টরুমের বাইরের করিডোর বেয়ে পদক্ষেপের আওয়াজ ভেসে এলো।প্রতিধ্বনিত হলো অশুভ মন্ত্রের ন্যায়।
সাবধান হয়ে গেলো আসমান।চটজলদি আলিঙ্গন ছেড়ে ফিরে তাকালো,দৃষ্টিতে তার ফুটলো উদ্বিগ্নতা।
– দিমিত্রীর গার্ড।
কিঞ্চিৎ আঁতকে উঠে রোযা যুক্ত করলো,
– তোমাকে দেখে ফেললে?
চকিতে পাশের টয়লেটের দরজার দিকে তাকালো আসমান।নীরবে দৃষ্টি বিনিময় হলো রোযার সঙ্গে।মাথা দুলিয়ে দরজা খুলে যেই না অভ্যন্তরে সে পা বাড়িয়েছে ঠিক ওই মুহূর্তেই হাট করে খুলে গেলো রেস্টরুমের মূল দরজা।সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো রোযা।সামনের গার্ড আসমানকে ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছে!সময়ের হিসাবে সামান্য গড়বড় হয়ে গিয়েছে।রোযা স্পষ্টত দেখলো আসমানের হাত নিজের পকেটে প্রবেশ করেছে,এক সরু ধাতব বস্তু চিকচিক করছে।হিডেন ব্লে*ড!র*ক্তপাত ঘটাতে পিছপা হবেনা আসমান তা পরিষ্কার।কিন্তু এই মুহূর্তে কি আদও তা সঠিক হবে?
– হেই..!
গার্ডের কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতেই ত*ড়িৎ খেলে গেলো রোযার শরীরে।তার একটা হাত তখনো আসমানের হাতের মুঠোয়,উভয়ে কাছাকাছি দাঁড়ানো।আসমানকে পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছে গার্ড,এখনো চেহারা অবলোকন সম্ভব নয়।মস্তিষ্ক ন্যানো সেকেন্ডের মাথায় আজগুবি এক সংকেত প্রদান করলো।কোনোপ্রকার ভাবনাচিন্তা না করেই রোযা হঠাৎ আসমানের হাত টেনে তাকে নিজের কাছে আনলো।হ্যাঁচকা টানে ভারসাম্যহীন আসমান অপরিকল্পিত পদক্ষেপে এগোলো,রেস্টরুমের কোনায় দেয়ালে ঠেকলো রোযার পিঠ।উত্তেজনা এবং বিস্ময়ে প্রসারিত হয়ে গেলো আসমানের নয়নজোড়া,সে বুঝতে পারছেনা রোযা কি করতে চাইছে।মস্তিষ্ক বিশ্লেষণের সময়লাভ করলোনা তার।এর পূর্বেই রোযার অধরযুগল প্রগাঢ় এক আবেদনে আছড়ে পড়ল তার ওষ্ঠমাঝে।এক শীতল অনুভূতি খেলে গেলো আসমানের সর্বাঙ্গজুড়ে।দৃষ্টি প্রসারণ লাভ করলো দ্বিগুণ।
আবেশিত মুহূর্তে রোযা আসমানকে আরো নিকটে টেনে নিলো,চোখজোড়া শক্তভাবে বুজে আপন ক্রিয়ায় জোর প্রদান করলো।দরজার সামনে গার্ড থমকে গেলো, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে।কারণ আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যটিকে মনে হচ্ছে একযুগল কপোত কপোতীর অন্তরঙ্গ মুহূর্ত।পিছনের গার্ডরা ঢুকে হতবাক হয়ে রইলো।একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করলো।
রোযার হাত নিজের কার্যক্রম জারি রাখলো,ভালোবাসা বিনিময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আসমানের পিঠ বেয়ে উপরে উঠে এলো তা।খুব সাবলীল ভঙ্গিতেই যেন অনুভবের তাড়নায় তার হাতজোড়া আসমানের হুডির টুপি পুনরায় মাথায় তুলে দিলো।একেবারে সামনে এসে দর্শন ব্যতিত বর্তমানে কিছু উপলব্ধি অসম্ভব।কয়েক মুহূর্তের প্রগাঢ় নীরবতা,শুধুমাত্র নিগূঢ় অনুভবের বিনিময়।অতঃপর দৃষ্টি মেললো রোযা।সামান্য মাথা কাত করে তাকালো দ্বিধান্বিত গার্ডদের উদ্দেশ্যে।ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে চেহারায় লালিমা ছেয়েছে তার। চিকচিকে অধরে তীর্যক হেসে এক মোহনীয় কন্ঠে রোযা বিড়বিড় করলো,
– এই মুহূর্তে বিরক্ত করার পরিণাম মোটেও ভালো হবেনা।
গার্ডদের চেহারাজুড়ে বিব্রতবোধ স্পষ্ট।উল্টো ঘুরে গেলো তারা সটান।
– ইউ বেটার স্টপ দিস ননসেন্স সুন,ম্যাম!
এটুকুই।হনহন করে হেঁটে বাইরে চলে গেলো গার্ডদের দল।পিছনে ফেলে গেলো এক অদ্ভুতুড়ে আবেশময় উপাখ্যানকে।দীর্ঘ এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রোযা। অভাবনীয়ভাবে রক্ষা পেয়েছে একটুর জন্য!
– ভাগ্যিস আম…..
আসমানের দিকে তাকাতেই রোযার বক্তব্য অসমাপ্ত রয়ে গেলো।সহনীয় আভার প্রতিফলনে অমানিশার অতিরিক্ত শুভ্র ত্বকজুড়ে টকটকে লালিমার আবহ তাকে বাকরুদ্ধ করে দিলো।আসমানের উভয় কান লালচে বর্ণ ধারণ করেছে,কপোল জুড়ে এক অদ্ভুত প্রকাশ,যেন র*ক্ত উঠে এসেছে চেহারায়।তাকে এতটা জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে এর আগে কোনোদিন দেখেনি রোযা।দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই আসমান সটান নিজের চোখ সরিয়ে নিলো,অ্যাডামস অ্যাপেলে ঢেউ খেলিয়ে তার কন্ঠতালু বেয়ে এক শক্ত ঢোক নেমে গেলো।দৃশ্যটি বিস্মিত হয়ে পর্যবেক্ষণ করলো রোযা।এক অভূতপূর্ব অনুভব তার হৃদয়কে আন্দোলিত করে তুললো মুহূর্তেই।
আসমান লজ্জা পেয়েছে!
বিস্তৃত হাসি হেসে হেসে রোযা সোজা হয়ে দাঁড়ালো।সামান্য ঝুঁকে আসমানের অবয়ব লক্ষ্য করে বলে বসলো,
– তুমি লজ্জা পাচ্ছো আসমান?
– আমি লজ্জা পাচ্ছি না।
উত্তর এলো তৎক্ষণাৎ।খানিকটা তাড়াহুড়ো করেই।তাতে বিনোদিত হলো রোযা।
– তাহলে আমার দিকে তাকাও।বাথরুমের টাইলস কি আমার থেকেও সুন্দর যে ওদিকে তাকিয়ে আছো?
– বললাম না লজ্জা পাচ্ছিনা?
– হাহা,আমি জিজ্ঞেসও করিনি….
– একদম লজ্জা পাচ্ছিনা।
– আমার দিকে তাকাও অন্তত?
– আমি লজ্জা পাইনা।
– আসমান….
– মোটেও লজ্জা পাওয়ার মতন ব্যাপার হয়নি।
– আসমান!
ঝাঁকুনিতে আসমানের সম্মোহন ভাঙলো,ফ্যালফ্যাল করে তাকালো রোযার দিকে।প্রেয়সী তার বিস্তর হাসি নিয়ে চেয়ে আছে।
– লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছ।আফসোস,তুমি মুখে এক কথা বললেও তোমার শরীর ঠিক ভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ফেলে।
ভ্রু কুঁচকে ফেললো আসমান,কিছু বলতে গিয়েও বললোনা।মাথা ঝাঁকিয়ে কি যেনো ভাবলো।রোযা এমন বিরাট মাপের সুযোগ ছাড়তে নারাজ।
– আসমান দ্যা কি*লিং মেশিন,একদম নতুন বউয়ের মতন লজ্জা পাচ্ছে।এ তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য!
– রোযা….
শীতল শোনালো আসমানের কন্ঠস্বর,তাতে সতর্কবার্তা স্পষ্ট।
– তুমি এই মুহূর্তে এই জ্বালাতন বন্ধ না করলে যা হবে তার জন্য আমি দায়ী থাকবোনা।
– কিউটি পাই!
আসমানের দুই গাল চেপে ধরে টেনে দিলো রোযা,ঠিক যেন ক্ষেপে যাওয়া কোনো শিশুকে আদর করছে।ফ্যাকাশে ত্বকের কারণে লালচে বর্ণের শোভাটা ক্রমেই আরো উজ্জ্বল হচ্ছে।তাতে রোযার বিনোদন দ্বিগুণ আকৃতি ধারণ করলো।
– ইশ,একটা ছবি যদি তুলতে পারতাম!একদম স্বর্ণে বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতাম।
আসমানের অশুভ অভিব্যক্তি যেন দৃষ্টিগোচরই হচ্ছেনা রোযার।নিজের বকবকে জাহির সে।আর সম্ভব নয়।অতর্কিতে দুহাতে রমণীর মুখ চেপে ধরলো আসমান।
– হিহি,আমার লাজেরাঙা চাঁদ… মফ্….
সম্পূর্ণ উচ্চারণ সম্ভব হলোনা রোযার পক্ষে।আসমানের অধর তাকে টেনে নিলো নিজ আবেদনের গভীরে।স্থবির রোযা কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় ভুগলো,পরক্ষণে তার অসহায় আত্মসমর্পণ ঘটলো চাঁদের দুয়ারে।ক্ষীণ কিছু মুহূর্ত,কিন্তু অনুভূতি প্রগাঢ়।নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো ক্রমশ।হাঁটুতে কম্পন ধরলো।
মুক্তি মিললো অবশেষে।দৃষ্টি মেলার দুঃসাহস করতে সক্ষম হলোনা রোযা।নিজের নয়নপল্লবে আসমানের স্নেহের স্পর্শ অনুভব করলো সে, তা পরিবাহিত হলো কপোল পর্যন্ত।
– আমি আছি।তোমাকে আর আমার অংশকে যেকোনো মূল্যে উদ্ধার করে নিয়ে যাবো।
বিরতি।তারপর ধ্বনিত হলো,
– আমাকে বিশ্বাস করতে বলবোনা,সেই মর্যাদা আমি হাজার চাইতেও কোনোদিন রাখতে পারিনি।শুধু স্মরণে রেখো,বাজি থাকলে তুমি,লড়ে যাবো গোটা পৃথিবী বনাম আমি,স্মরণে রেখো আমার জ্যোৎস্না।
নিজের উদরে এক গভীর অনুভূতিপূর্ণ স্পর্শ অনুভব করলো রোযা।এরপরই সবটুকু উষ্ণতা মিলিয়ে গেলো।রোযা যখন দৃষ্টি মেলে তাকালো,তখন আসমান রেস্টরুমের দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছে।একবার শুধু ফিরে তাকালো অমানিশা,চিরস্থায়ী দাগপূর্ণ চোয়ালজুড়ে এক চিলতে দূর্লভ হাসির দেখা পাওয়া গেলো।এরপরই তা ঢেকে গেলো কালো মাস্কের অন্তরালে।দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো আসমান।তার চলার পথে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলো রোযা।
দিমিত্রীর গার্ডগণ করিডোরের সামনে দাঁড়িয়ে হাসফাঁস করছে।সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে তারা।আবারো ভেতরে যাবে কিনা।ঠিক যখনি সতর্ক হয়ে একজন এগোলো, তখনি পা চালিয়ে ফিরে আসতে দেখা গেলো রোযাকে।তাকে দেখে বর্তমানে ভিন্ন একজন মানুষ মনে হচ্ছে।পূর্বের দূর্বলতা বিদায় নিয়েছে।এক অপ্রতিরোধ্য বা*রুদে পূর্ণ অস্তিত্ব যেন।তাদের কাছে পৌঁছতেই একজন গার্ড ক্রুব্ধ স্বরে বললো,
– আপনি একজন পাকা খেলোয়াড় তা আগে জানা ছিলোনা।
তীর্যক হাসলো রোযা,মাথা কাত করে তাকালো গার্ডের দিকে।আপাদমস্তক নিরীক্ষণ চালিয়ে তার দৃষ্টি এসে থামলো গার্ডের চেহারায়।তার এমন পর্যবেক্ষণে বিব্রত হয়ে যাওয়া গার্ডকে দ্বিগুণ মাত্রায় হতবিহ্বল করে রোযা আঙুল বাড়িয়ে তার চিবুক স্পর্শ করলো।মিষ্টি হেসে জানালো,
– মগডালে ঝুলে থাকা ফলে আসক্ত থেকে কি লাভ যখন আমার সামনে গোটা ফলের ঝুড়ি আছে?
নির্বাক চেয়ে থাকলো সকলে।রোযা একটু ঝুঁকলো, গার্ডের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– আপনার রস মন্দ নয়।বলা যায়না,ঝুড়িতে স্থান পেলেও পেতে পারেন।
ডার্কসাইড পর্ব ৬২
ধ্বক করে উঠলো গার্ডের বুক।আনমনে পাশের জনের হাত খা*মচে ধরলো সে।খিলখিল করে হাসলো রোযা।তারপর বুকে হাত রেখে তাদের সামনে থেকে সরিয়ে একাকী দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো,তার জুতোর সোলের টকটক ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো দারুণভাবে। গার্ডরা শুধু হতবিহ্বল হয়ে একে অপরের মাঝে চাওয়া চাওয়ি করলো।এমন দৃঢ়চেতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রমণী তারা এর পূর্বে একজনকেই দেখেছে,তাদের বসের স্ত্রী,রাফা কায়সার।তখন কল্পনাও করেনি কেউ সেই অশুভ ক্ষমতাসম্পন্ন মহারাণীকে টক্কর দেয়ার ক্ষমতা রাখতে পারে।
