ডার্কসাইড পর্ব ৬৮

ডার্কসাইড পর্ব ৬৮
জাবিন ফোরকান

– কি হয়েছে হাবিব?
কন্ঠস্বরটি কর্ণগোচর হতেই ধাতব দরজার অপর পাশে দন্ডায়মান হাবিব এবং হিটটিমের দুইজন ছেলে ঘুরে তাকালো।করিডোরের প্রান্ত ধরে এগিয়ে আসছে নিহাদ, তার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ চারুলতার হাত।রমণীর শরীরে জড়ানো নিহাদের পূর্বে পরিধানকৃত জ্যাকেটখানি, মুখমন্ডল মলিন,খানিক লালচে হয়ে রয়েছে ক্ষতে।অতি যত্নে তা পরিষ্কার করে নেয়া হয়েছে সন্দেহ।হাবিব একটি ঢোক গিলে নিহাদের মুখোমুখি হলো,

– নিহাদ ভাই।এই দরজাটা হুট করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।ভেতরে আসমান ভাই আর ম্যাম রয়েছে,সঙ্গে রাফা কায়সারও।কিছুই বুঝতে পারছিনা আমরা ভেতরে কি হচ্ছে বর্তমানে।ঢোকার কোনো উপায় নেই।
নিহাদের ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হলো।চারুর হাত ছেড়ে অতি দ্রুত দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ঠেললো জোরেশোরে।বাহু ব্যবহার করে জোর ধাক্কা প্রয়োগ করলো। কিন্তু কোনোপ্রকার লাভ হলোনা।
– শিট!
হতাশায় চুলে আঙুল বুলিয়ে কোমরে অপর হাত রেখে সরে এলো সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– সবকিছু ওই রাফার প্ল্যান সন্দেহ নেই।
– এখন আমরা কি করবো?খুব বেশি দেরী করা যাবেনা।যদি উল্টোপাল্টা কিছু হয়ে থাকে?আমরা তো আসমান ভাইকে সাহায্যও করতে পারবোনা।
হাবিবের কথায় দ্বিধায় পড়ে গেলো নিহাদ। হিটটিমের অপর এক ছেলে বলে বসলো,
– এক্স*প্লোসিভ ব্যবহার করবো?দরজাটা উড়িয়ে দেই?
– না!
চারুলতার কঠোর কন্ঠস্বরে সবাই ফিরে তাকালো।সুদর্শনা দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে। মিনিটখানেক পর্যবেক্ষণ করলো।

– আমরা এত কম রেঞ্জে এক্স*প্লোসিভ ব্যবহার করলে রুমের ক্ষতি হবে,সঙ্গে ভেতরে থাকা মানুষদেরও।তাছাড়া তাতে যে আ*গুন ধরে যাবেনা তার গ্যারান্টি কতটুকু?এত বড় রিস্ক নেয়া সম্ভব নয়।
– তবে কি করবো?অপেক্ষা?যতক্ষণ না আসমান ভাই নিজে থেকে বেরিয়ে আসে?
– আমার মনে হয়না ওই রাফা কোনো কাঁচা খেলোয়াড়।সে যদি প্ল্যান করেই এসব করে থাকে,তবে ভাইয়া আর রোযা চাইলেও নিজেদের মুক্ত করতে পারবেনা।হয়ত ভেতর থেকে দরজা খোলার কোনো উপায় নেই।আমি এই ধরণের কিছু প্রযুক্তি ইতালিতে থাকাকালীন দেখেছি।আমার এক বান্ধবী কাজ করতো ল্যাবরেটরিতে।গুরুত্বপূর্ণ ল্যাবে এমন লক সিস্টেম থাকতো।যা চালু করার পর নির্দিষ্ট কোড ছাড়া দরজা খোলা মুশকিল হয়ে যেতো।ওখানকার দরজাগুলোও এক্স*প্লোসিভ প্রোটেক্টেড হতো।

– তবে কি বলতে চাইছো?নির্দিষ্ট কোড ছাড়া এই দরজা খুলবেনা?
নিহাদের দিকে তাকালো চারুলতা।দৃঢ় কন্ঠে জানালো,
– আমি শুধু আমার ধারণা ব্যক্ত করেছি।নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমার এই ভবনের ব্লুপ্রিন্টের দরকার হবে।
– ব্লুপ্রিন্ট!
নিহাদ হাবিবের দিকে তাকাতেই ইশারা বুঝতে কোনো সময় প্রয়োজন হলোনা তার।দ্রুত হিটটিমের ছেলে দুটোর দিকে ফিরলো,অতঃপর একজনকে সাথে নিয়ে অতি দ্রুত করিডোর ধরে রীতিমত দৌঁড়ে গেলো।নিহাদ দৃষ্টি ফিরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকালো।হৃদযন্ত্র তার অত্যধিক গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে।এই মুহূর্তে ঠিক কি হচ্ছে অভ্যন্তরে?

– রাফা?
রমণীর শরীরজুড়ে তড়িৎ খেলে গেলো।বিশ্বাস হলোনা নিজের শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে।আহত শরীরে কি এসব কল্পনা করে চলেছে সে?চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকা আসমানের দিকে তাকালো রাফা। দৃষ্টিজুড়ে ফুটে উঠল অবিশ্বাস।শুভ্রতা স্থির চেয়ে আছে তার নয়ন বরাবর।ওই কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে কোনো ঘৃণা, ক্রোধ কিংবা উৎকণ্ঠার অনুভূতি নেই।শুধুমাত্র একরাশ শূন্যতা।এইমাত্র কি সে রাফার নাম উচ্চারণ করলো?
– রাফা কায়সার….

রাফাকে হতভম্ব হয়ে দিয়ে আসমান আবারো উচ্চারণ করলো নামটি।বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো কায়সার কন্যার।আজ কতদিন পর?উহু,কত বছর পর?আসমান তাকে কোনোদিনও তার নাম ধরে সম্বোধন করে একটি ঘটনার পর থেকে।শুধু “ম্যাম” শব্দটিই উচ্চারিত হতো তার গভীর কন্ঠজুড়ে।কিন্তু আজ?এ বাস্তব নাকি কল্পনা?নির্বিকার আসমান আলতোভাবে তার পা ছুঁয়ে দিয়ে নিজের চিবুক সরিয়ে নিলো।অতঃপর মেঝেতে নতজানু হওয়ার পরিবর্তে আসুন করে বসলো।তার দৃষ্টি রাফার হতবিহ্বল অবয়বজুড়ে।

– আপনার মনে আছে যেদিন আপনি আমাকে প্রথমবারের মতন লুকোচুরি খেলা শিখিয়েছিলেন?আপনি জিমের ক্লোজেটের ভেতরে লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।এদিকে আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।আতঙ্কিত হয়ে শেষমেশ মাস্টারের দ্বারস্থ হয়েছিলাম।সেদিন উনি আমাকে একটা চড় দিয়েছিল। পরে আপনি রাতের বেলা লুকিয়ে আমাকে অয়েন্টমেন্ট আর আইসপ্যাক দিতে এসেছিলেন।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো রাফা।অপরদিকে হতবাক রোযা।আকাশ পর্যন্ত নির্বিকারতা পরিহার করতে বাধ্য।আসমান বলে গেলো,

– তারপর যেদিন কায়সার এম্পায়ারের সবাই পিকনিকে গিয়েছিল?আমি বডিগার্ডদের সঙ্গে ছিলাম।আপনারা সবাই ফুটবল খেলছিলেন,আমি শুধু দূর থেকে নির্বিকার চেয়েছিলাম।আমারও খুব ইচ্ছা হয়েছিল,আপনাদের সঙ্গে খেলতে।কিন্তু পারিনি।হঠাৎ করেই আপনি দৌঁড়ে এলেন,আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন খেলার জন্য।যখন মাস্টার মানা করলেন,তখন আপনি জেদ দেখিয়ে সবাইকে রাজী করালেন।আমরা সবাই সেদিন খুব মজা করেছিলাম।ফুটবলে আমাদের টিম জিতেছিল।

রাফার নয়নজুড়ে অব্যক্ত কিছুর প্রস্ফুটন দেখা গেলো।আর কেউ না বুঝলেও রোযা বর্তমানে যেনো উপলব্ধিতে কিছুটা হলেও সক্ষম।তাই কোনোপ্রকার বাঁধা প্রদান করছেনা আসমানের বক্তব্যে।শুধু স্থির চেয়ে আছে, তীক্ষ্ণ নজরে আকাশের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে।প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্র ঝুঁকি নেবে সে।

আসমান দৃষ্টি নামিয়ে আনলো নিজের কোলে গুটিয়ে রাখা হাতে,আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে বিড়বিড় করলো,
– কায়সার এম্পায়ারের দিনগুলো আমার জন্য ছিলো কারারুদ্ধ এক জীবন।নিজেকে মনে হতো ক্রীতদাস।আমি জানতাম,আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওই অভিজাত র*ক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।কিন্তু মুখফুটে বলার মতন কিছুই ছিলোনা।সকলে আমাকে দেখতো বাদশাহ কায়সারের এক নতুন হাতিয়ার হিসাবে,কিংবা চাকর হয়তো?আমি শুধু অন্তরাল থেকে চেয়ে দেখতাম।মাস্টার আপনাদের কত আদর করতেন,মুক্ত বিহঙ্গের মতন আপনারা ছুটে বেড়াতেন,জীবন উপভোগ করতেন।এবং আমি এক যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়েছিলাম।ক্ষমতার ইশারায় নৃত্যরত এক কাঠের পুতুল।আমার সেই সাদাকালো জীবনে এক মুঠো রং নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আপনি।আমার আজও মনে আছে,প্রথম খু*ন করে যেদিন একাকী বসেছিলাম,আপনিই প্রথম আমাকে একটি স্যান্ডউইচ দিয়ে বলছিলেন, ” ভাইয়া”!

– তুমি…
কিছু উচ্চারণ করতে গেলো রাফা।তবে সম্ভবপর হলোনা।সমস্ত শরীর তার অবশ হয়ে আসছে। সিগারেটে কোনো মনোযোগ নেই।দুহাত চেপে বসেছে চেয়ারের হাতলে একদৃষ্টে সে চেয়ে আছে আসমানের দিকে।মাথা তুলে তাকালো অমানিশা,দৃষ্টিতে নিগূঢ় জ্বলজ্বলে কৃষ্ণগহ্বর মিলিয়ে বললো,
– যে হৃদয়ে কখনো কোনোপ্রকার অনুভূতি হতনা,সেই হৃদয়ে সেদিন একটিমাত্র অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল।স্নেহের অনুভূতি!এক মমত্ববোধ।পরিবারহীন জীবনে এক মায়াবী বোন লাভের আনন্দ হয়েছিল।আমি সত্যিই আপনার ভাই ছিলাম,আপনি হয়ত তখনো জানতেন না।এরপর যখনি আপনাকে দেখতাম,অন্তরে টান অনুভব করতাম।আপনাকে গোটা জগতের কাছ থেকে রক্ষা করার এক দূর্বোধ্য প্রতিজ্ঞা ধ্বনিত হয়েছিল বারংবার।নিজেকে প্রথমবারের মতন কারো বন্ধনে আবদ্ধ মনে হয়েছিল।আই ফেল্ট,ফাইনালি আই বিলং সামহোয়্যার!

– চুপ করো!
অস্ফুট উচ্চারণ করলো রাফা।কিন্তু আসমান তার আদেশ অনুসরণে অনিচ্ছুক।যে অস্তিত্ব অনুভূতি প্রকাশে সর্বদাই পিছপা হয়,আজ সেই যেনো নিজের অভ্যন্তরের সবটুকু উগড়ে দিতে চাইছে।আসমানের কন্ঠ সামান্য ধরে এলো।
– আই লাভড ইউ,ট্রুলি লাভড ইউ অ্যায মাই লিটল সিস্টার!ইউ ওয়্যার মাই লিটল অ্যাঞ্জেল, দ্যা সানশাইন।যার ভাইয়া ডাক শুনলে আমার সহস্র অপরাধের গ্লানি দূরীভূত হয়ে যেতো।আমরা একসাথে খেলতাম,খেতাম, ব্যায়াম করতাম,ঘুমাতাম।যদি সবকিছু এভাবেই থাকতো তাহলে কি ক্ষতি হতো রাফা?কেনো বদলে গেলেন আপনি?কেনো আপনি আমাকে ভাইয়া বলে ডাকা বন্ধ করে দিলেন হঠাৎ করেই?কত্ত প্রশ্ন করেছিলাম, কতবার আদর করে বলেছিলাম যে আমাকে বিশ্বাস করে একটাবার শুধু জানাতে যে ভুল কোথায় হয়েছে!সেদিন যদি আপনি আমাকে একটু সাহস করে জানাতেন যে আপনার সঙ্গে ওই বড় কায়সার কি কি করেছে….আই সোয়্যার আমি তার ম*স্ত*ক ছি*ন্ন করে আপনার পায়ে সমর্পণ করতাম আর শরী*রটা কায়সার এম্পায়ারের দেয়ালে ঝু*লিয়ে রাখতাম!
নিস্তব্ধ চারিপাশ।কেউই কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া করবার অবস্থায় নেই।হৃদয়ে এক ভারী চাপ জেঁকে বসেছে যেনো, মস্তিষ্ক দপদপ করছে।ভাগ্যের খেলা কতটা জটিল!কিভাবে পরতে পরতে ঘটে পরিবর্তন!

– আপনি কেনো বদলে গেলেন রাফা?রাতের পর রাত আমি ঘুমাতে পারিনি, হন্ন হয়ে খুঁজেছি আমার ভুলটা কোথায় ছিলো। একটা গুরুত্বপূর্ন মিশনে দেশের বাইরে গেলাম।যখন ফিরে এলাম,আমার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর হিডেন ক্যামেরা পেলাম।সব শেষ হয়ে গেলো ঐদিন!সব!আপনার বুকে একটুও বাঁধেনি এইভাবে আমাদের পবিত্র সম্পর্ককে ধ্বংস করতে?তাকে নিষিদ্ধ উপাখ্যানের বাসনায় কলঙ্কিত করতে?যদি আপনি না জানতেন, তবেও আমি মেনে নিতাম,আপনার শত অপরাধ ক্ষমা করে দিতাম।কিন্তু আপনি জানতেন!আপনি জানতেন আমি আয়েশা তালুকদার এবং বাদশাহ কায়সারের গোপন সন্তান….আপনার সৎ ভাই ছিলাম,আমার রন্ধ্রে আপনার বংশের র*ক্ত বইছে!এইখানেই আপনি অপরাধী হয়ে গেলেন রাফা, আজীবনের জন্য।

রাফার রীতিমত নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালাতে কষ্ট হচ্ছে।দুহাতে বুক চেপে ধরলো রমণী।প্রসারিত নয়ন মেলে চেয়ে রইলো শুভ্রতার উদ্দেশ্যে।যার হৃদয়ে আজ থামবার কোনো ইচ্ছা নেই।
– আমাদের মাঝে সবকিছু শেষ হয়ে গেলো।আপনার বাবা,বাদশাহ কায়সার আমার মাকে হ*ত্যা করেছিলেন।কেনো জানেন?কারণ আমার মা তার জন্য ছিল এক বিরাট হুমকি।আমাকে লালন পালনের পাশাপাশি তিনি কায়সার পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন।সেই সময়কার সরকারদলীয় সদস্যদের সঙ্গে সখ্যতা পাতিয়ে তিনি মাত দেয়ার চেষ্টায় ছিলেন।অবশ্যই আপনার বাবা সেটি হতে দেননি।পরিকল্পিত এক ট্রাক দূ*র্ঘটনার নাটক সাজিয়ে আমার মাকে সরিয়ে দেন দুনিয়া থেকে।আর আমাকে নিজের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়ে আসেন অশুভ দুনিয়ায়।ছোট ছিলাম তো,এসব কিছুই বুঝতে পারিনি।যখন বুঝেছি, তখন আমার হাতে করার মতন কিছুই ছিলোনা।তবুও ভাগ্য ওই বাদশাহকে ছাড় দেয়নি রাফা।আমি জন্মদাতাকে হ*ত্যা ক*রার কদর্য দণ্ডে কলুষিত হয়েছি, বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে অতৃপ্ত ন্যায়ের মুক্তি।আপনিও আপন পিতার পথই অনুসরণ করতে চলেছেন।

পরিহাসের হাসি হাসলো আসমান।মাথা কাত করে রাফার সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবয়বমাঝে চেয়ে জানালো,
– আমি আপনাকে বারংবার সুযোগ দিয়েছি এই কারণে নয় যে আপনি একজন নারী।নারী হোক কিংবা পুরুষ, সকলেরই অধঃপতনের একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকে।সেই সীমানা পেরিয়ে গেলে সে আর নারী কিংবা পুরুষ থাকেনা,পরিণত হয় অমানুষে!আপনি অমানুষ হওয়ার গণ্ডি বহু পূর্বেই পেরিয়েছেন।নারী বলে আপনাকে ছাড় দেয়ার কোনো প্রশ্নই উত্থাপিত হয়না।তবে কি আমি ভয় পেয়েছি?আপনি আমাকে কলঙ্কিত করে আজীবনের ট্রমায় পরিণত হয়েছেন,আপনার সামান্য স্পর্শেও আমার শরীর কম্পিত হয়। ভয় পাওয়া হয়ত স্বাভাবিক।কিন্তু না,আমি ভয়ও পাইনি।যতবার এই অন্তর আপনাকে ধ্বংসের বাসনায় মেতেছে,ততবার আমার সামনে ওই নিষ্পাপ ছোট্ট রাফার মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছে, যে আমার বোন ছিল!যখন আমার কেউ ছিলনা,তখন একমাত্র সে ছিল।পারিনি আমি।নিজের জন্মদাতাকে হ*ত্যা করলেও বোনকে কন্টকের আ*ঘা*তও করতে পারিনি!

– শাট আপ!
চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালো রাফা।ধাক্কায় চেয়ারখানি উল্টে পড়লো মেঝেতে। ফুঁসতে ফুঁসতে তাকালো সে আসমানের দিকে, আঁধাররাণীর নয়নে প্রথমবারের মতন প্রদর্শিত হলো টলটলে অভিব্যক্তি!উভয় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাফা হুংকার ছুড়লো,
– আমি তোমার বোন না!
– ইউ আর!
প্রশান্ত কন্ঠে জবাব দিলো অমানিশাও।এক হাঁটু তুলে তাতে ভর দিয়ে দৃপ্ত দৃষ্টিতে মোকাবেলা করলো রাফার ভয়ংকরী চাহুনিকে।

– রাফা,আমি এখনো বলছি।চলে যাও।বহু দূরে চলে যাও।তোমার ভাই হিসাবে আমি তোমায় অন্তিম সুযোগ দিচ্ছি রাফা।আমি তোমাকে ভালো হয়ে যেতে বলছিনা। যতটা পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়েছ তার গভীর থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব।তোমার এই মন্দত্ব নিয়েই চলে যাও,এমন কোনো স্থানে যেখানে তুমি নিজের মতন সুখী থাকতে পারবে।আমাকে আমার মতন বাঁচতে দাও।একটিবারের জন্য নিজের পরিবারকে নিয়ে সুখে থাকতে দাও।অনুরোধ করছি,তোমার কাছে তোমার ভাইয়ের প্রথম এবং শেষ অনুরোধ।

আসমান রাফাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছে,তার কন্ঠস্বরের আকুতি উদ্ভাসিত করেছে আবেগকে।কেমন অনুভব করা উচিত রাফার?সবকিছু যে শূণ্য লাগছে!অজান্তেই ধপ করে আসমানের মুখোমুখি মেঝেতে বসে পড়ল রাফা,মুখমন্ডল সিক্ত হয়ে তার অশ্রু গড়াতে থাকলো।উভয় হাত চেপে ধরলো একে অপরের সঙ্গে, তীব্রভাবে কাপলো তার শরীর কান্নার দমকে।রুদ্ধশ্বাস এক মুহুর্ত।অতঃপর জবাব এলো,
– পারবোনা।এই আসক্তি পরিত্যাগ করা বড়ই দুষ্কর!

যে দূর্বল দেয়াল এতক্ষণ ধরে আসমান একটু একটু করে সজ্জিত করেছে, তা এক লহমায় গুঁড়িয়ে গেলো।নিজেকে পরাজিত অনুভূত হলো তার। একটি কোমল প্রাণকে সে রক্ষা করতে ব্যার্থ হয়েছে শেষমেষ।কারণ ওই প্রাণের মাঝে জাগতিক পতনের ধূসর প্রলেপ পড়েছে,এতটাই গভীর সেই আঁধারের প্রলেপ যে স্বয়ং দিবাকরের রশ্মিও হার মানবে তার সম্মুখে।একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো আসমান,এক তীর্যক হাসি প্রস্ফুটিত হলো তার অধরে,ম্রিয়মাণ এক বেদনার হাসি। মাস্কটি খুলে একটানে দূরে ছুঁড়ে ফেললো।
– তবে কি চাও?আমার শরীর?এই চন্দ্রকে গ্রাস করাই তো তোমার অভিলাষ।যদি তা করে ফেলো,তবে কি নিস্তার দেবে?

রাফার একটি হাত চেপে ধরে আসমান নিজের বুকে ছোঁয়ালো,রমণী কুঁকড়ে গেলো সামান্য,হাতের আঙুলসমূহ তার গুটিয়ে এলো শুভ্র ত্বকের মাঝে।দৃঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আসমান জানালো,
– তবে তাই হোক!গ্রাস করো আমায়,রেহাই দাও ধরিত্রীকে নিজের পঙ্কিলতা থেকে!প্রমাণ করে দাও যে নিষিদ্ধ আসক্তির পরিণাম কতটা বিধ্বংসী হতে পারে।
কাপতে থাকলো রাফা,তার আঙুলসমূহ খুললো।বুলিয়ে আনলো হাতটি সে আসমানের উন্মুক্ত বুকজুড়ে।একচুল নড়লোনা অমানিশা।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুধু পর্যবেক্ষণ করে গেলো,শূন্যতা ঘিরে ধরলো তাকে,অন্তরে অনুভব করলো তীব্র বেদনা।অস্বীকার করতে পারলোনা রাফা, জিত হাসিল হয়েছে তার, শুভ্রতাকে এইভাবে স্পর্শ করতে দারুণ লাগছে তার!অন্তর চেঁচিয়ে বলছে,

” অবশেষে!গ্রাস করো!আপন অভিলাষ পূর্ণ করো কায়সার!তোমারই জিত,তোমারই প্রতিষ্ঠা!”
” শুভ্রতা আমার,আসমান আমার, চাঁদ আমার,শুধুমাত্র আমার!”
– আক্ব!
গুঞ্জনধ্বনিতে আপন আবেশ থেকে বেরিয়ে রাফা ঝট করে ঘুরে তাকালো।একপাশে দন্ডায়মান রোযা আকাশের পি*স্ত*ল সম্বলিত বাহু চে*পে ধরেছে।উভয়ের মাঝে বর্তমানে ধস্তাধস্তি হচ্ছে।তার মাঝেও চাঁদের জ্যোৎস্না তার দিকে প্রলয়ংকরী এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।যদি ঐ নয়নজোড়া কোনো কা*মান হতো,তার গো*লার আ*ঘাতে ওই মুহূর্তেই রাফা চূ*র্ণ বিচূ*র্ণ হয়ে যেতো!তৎক্ষণাৎ যেনো ধূসরিত জগৎ তাকে বাস্তবের স্মৃতিচারণ করালো,অমোঘ একটি বাণী ধ্বনিত হলো ইন্দ্রিয়জুড়ে।

” এই পৃথিবী আপনাকে নির্বাচনে বাধ্য করেনা,আপনি আপন ইচ্ছায় নির্বাচন করেন।সেই নির্বাচন বেঠিক হলে তার দায় আপনার!”
রাফা নির্বাচনের সুযোগ পেয়েছে।আসমান তাকে সুযোগ দিয়েছে।কিন্তু আসক্তি এবং মানব মস্তিষ্কের ধূসরিত জগৎ তাকে ঠেলে দিয়েছে নিশ্চিত ধ্বং*সের দুয়ারে।এর দায় পৃথিবীর নয়।স্বয়ং রাফার।
আসমান এক লাফে উঠে দাঁড়ালো।পি*স্ত*ল নিয়ে ধস্তাধস্তিরত প্রেয়সীর দিকে ছুটে গেলো।মুহূর্তের মাঝে পিছন থেকে বাহুর শক্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরলো আকাশকে,একটি জোরালো ঝটকায় আছড়ে ফেললো তাকে টেবিলের উপর। পি*স্ত*লটি ছিটকে গিয়ে পড়ল দূরে।রোযার দিকে তাকালো সে,

– তুমি ঠিক আছো?
জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো অর্ধাঙ্গিনী।
– আর আমার অংশ?
আসমানের চিন্তিত কণ্ঠের বিপরীতে নিজের উদরে হাত বুলিয়ে আনলো রোযা,
– চিন্তা করোনা।আমাদের অংশ এতটা দূর্বল নয় যে অশুভের নজরে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে।ও লড়াই করতে জানে!
আত্মবিশ্বাসী উত্তরে সন্তুষ্ট হলো আসমান।গর্বিত অনুভব করলো নিজের জ্যোৎস্নার উপর।পরক্ষণে দৃষ্টি ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো।রোযা থেমে নেই।তীব্র ক্রোধাগ্নিতে দ*গ্ধ হচ্ছে তার সমস্ত অস্তিত্ব।মেঝে থেকে নিজের লুটায়িত ছু*রি*টি তুলে সে এগিয়ে গেলো রাফা কায়সারের উদ্দেশ্যে।
আসমান আকাশের গ্রীবা চে*পে ধরে জোর ঝটকায় তাকে টেবিলে ঠু*কলো।মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে আরম্ভ করলো তৎক্ষণাৎ।

– আলফার চামচা!
তীর্যক হাসলো আকাশ,মাথা হেলিয়ে বিড়বিড় করলো,
– অবশ্যই।আমি তোমার মতন বিশ্বাস*ঘাতক নই।যে গাছের খেয়ে বড় হয়েছি তার গোড়া উগড়ে ফেলার মতন কৃতঘ্ন আমি নই।
পাল্টা হাসলো আসমানও।
– আর সেই গাছ যদি হয় কোনো বি*ষাক্ত গাছ?যদি তার ফল ধীরে ধীরে আপনার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তথা গোটা অস্তিত্বকে গ্রাস করতে আরম্ভ করে তখনো কি আপনি সেই গাছের ভক্তি করবেন?

স্তব্ধ আকাশ।আজকের এই পরিকল্পনায় সাহায্যকারী হিসাবে আলফা তাকে পাঠিয়েছিল আসমানের পতন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে।কে বি গ্রুপের প্রতি অনুগত হওয়ার দরুণ রাফার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সবকিছুর বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে সে।কিন্তু বরাবরের মতই অন্তিম লগ্নে হারের স্বাদ গ্রহণ করতে হচ্ছে তাকে।সামান্য একটু অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল সে রাফা এবং আসমানের বক্তব্য বিনিময়ে।ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল রোযার জন্য।ক্ষণিকের জন্য আকাশ ভুলে গিয়েছিল যে অতীতের দূর্বল,নির্মল,স্নিগ্ধ নিষ্পাপ রমণী রোযা নয়, অমানিশার হৃদয়রাজ্যের সিংহাসনের অধিকারী মহারাণী সে,যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গোটা একটি প্রজন্ম সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছে ন্যায়বিচার।

ঝুঁকলো আসমান আকাশের নিকটে,সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয় সে।দাঁতে দাঁত চেপে বজ্রকন্ঠে সে ঘোষণা করলো,
– বিফোর ইউ গো টু হেল, রিমেম্বার দিস….পাপ বাপকেও ছাড় দেয়না!
আকাশের ঘা*ড়ে দুহাত জড়িয়ে একবার বামদিক, অতঃপর ডানদিকে মো*চড় দিলো আসমান। কটকট করে হা*ড় ভাঙার শব্দ।র*ক্তপা*ত হলোনা।১৮০ ডিগ্রি কোণে বেঁ*কে গিয়ে আজীবনের জন্য স্থির হয়ে গেলো আকাশের প্রসারিত বেদনাখচিত ম*স্ত*ক।
অপরদিকে রোযা ততক্ষণে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছে রাফার দিকে। কোনোপ্রকার কথা উচ্চারণ না করেই এক ঝটকায় রমণীকে দেয়ালে আছড়ে ফেললো সে।পরক্ষণেই চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে এনে হিলজোড়ার আ*ঘা*ত হা*নলো নাক বরাবর।গ*লগল করে উদগিরিত হলো র*ক্ত।হিসিয়ে উঠল রাফা।

– আমার চাঁদকে অপবিত্র করার দুঃসাহস যে হাত করেছে সেই হাতকে আমি মাটির সঙ্গে পি*ষে ফেলবো!
চিৎকার করে উঠে রাফার হাতখানি পা দিয়ে মেঝের সঙ্গে চে*পে ধ*রলো রোযা।ককিয়ে গেলো রাফা।কটমট করে ভে*ঙে গে*লো তার তর্জনী। তবুও ক্রোধে উন্মত্ত সে।কিছুতেই সমর্পণ করা সম্ভব নয়।অপর হাতের ধারালো নখ সে গেঁথে দিলো রোযার হাঁটুতে।সামান্য শিথিল হতেই সামান্য ফুলে ওঠা উদর বরাবর সর্বশক্তি দিয়ে আ*ঘাত হা*নলো।তবে রোযার হাতের ছু*রিখানি গেঁ*থে গেলো তার বাহু বরাবর। থমকাতে বাধ্য হলো সে।চেপে ধরলো নিজের র*ক্তগ*ঙ্গায় সিক্ত বাহুখানি।

– আপনি সৃষ্টির সবথেকে নিকৃষ্টতম জীব রাফা কায়সার। সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব থেকে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হওয়ার দায় আপনার এবং আপনার ধূসরিত মস্তিষ্কের সিদ্ধান্তের!
রোযার দিকে তাকালো রাফা,কাপতে থাকলো তীব্রভাবে।কি করবে ধারণায় আসছেনা।ঠিক তখনি রোযা এবং তার মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালো আসমান।নিজের বলিষ্ঠ অবয়বের অন্তরালে প্রেয়সীকে আড়াল করে নিয়ে তাকালো পদতলে নতজানু রাফার উদ্দেশ্যে।নিশানা করলো আকাশের পি*স্ত*লটি। রাফার পরাজিত অস্তিত্বকে অবলোকন করে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো তার।জ্যোৎস্না নিজের কথা রেখেছে।ওই অসীম ক্ষমতাধর অশুভরানীকে টেনে তার পদক্ষেপে নামিয়ে এনেছে!

– হয়ত জাহান্নামের দুয়ারও আপনাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে।তবুও প্রার্থনা করব,যেনো একটুখানি স্থান আপনি ওই অগ্নিগর্ভে পান!গুডবাই কায়সার!
ট্রিগারে আঙুল চাপলো আসমানের।রুদ্ধশ্বাস চেয়ে রইলো রোযা।অবশেষে সবকিছুর ইতি ঘটতে চলেছে।কিন্তু তার পরিতৃপ্তিকে চুরমার করে দিয়ে অতর্কিতে ধ্বনিত হলো,
– ভাইয়া!
রাফা কায়সারের ভগ্ন,নমনীয় এবং অশ্রুসিক্ত কণ্ঠের আবেদন আসমানকে স্থবির করে দিলো।কেঁপে উঠল তার হাত,পি*স্ত*লের ট্রি*গা*রে স্থাপিত আঙুল জমে গেলো সম্পূর্ণ।

– আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাইয়া!
দ্বিতীয় বাক্যটি অসহনীয় ঠেকলো আসমানের অন্তরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পি*স্ত*লটি ধপাস করে পরে গেলো তার হাত থেকে। রাফার অশ্রু নিমজ্জিত নয়নে যেনো সে সম্মোহিত হয়ে গিয়েছে।এক নারীর কি অতুলনীয় ক্ষমতা!মা,স্ত্রী কিংবা বোনরূপে পুরুষকে কি নিদারুণ আবেগেই না বশ করবার ক্ষমতা তারা রাখে!
আসমানের ভ্রাতৃ অন্তর বোধে অক্ষম হলেও অপর এক নারী রোযার অনুধাবনে কিছুই বাকি রইলোনা।রাফা কায়সারের সবথেকে শক্তিশালী অ*স্ত্র….

ম্যানিউপুলেশন!
তৎক্ষণাৎ আসমানকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে পি*স্ত*ল তুলতে উদ্যত হলো রোযা।তবে ততক্ষণে দেরী হয়ে গিয়েছে।নিজের পা দিয়ে অ*স্ত্র*টি এক লা*থিতে দূরে সরিয়ে দিয়েছে রাফা।রোযা বিহ্বল হয়ে চারিদিকে তাকালো,একপাশের চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নজরে এলোনা। সেটিই বাগড়ে ধরতে চাইলো।কিন্তু তার কোমর জড়িয়ে ধরলো রাফা।
– নট সো ফাস্ট, কিটেন!

নিজের বাহুতে বি*দ্ধ ছু*রি*টি একটানে বে*র করলো রাফা,র*ক্তের ফি*নকিতে যন্ত্রণাটুকুও ফুটলোনা চেহারায়।তাতে শুধুমাত্র আসক্তি।নতুন এক আসক্তি। জ্যোৎস্নাকে বধের আসক্তি!ক্ষীপ্র গতিতে উত্তোলিত হলো তার হাত,তবে ভা*ঙা আঙুলে তা নমিত হয়ে গেলো খানিক।অতঃপর সব সংঘটিত হলো রীতিমত বি*দ্যুৎ গতিতে।
ক্লাথ!
ধা*রালো ছু*রি*তে মাং*সপি*ন্ড ক্ষ*তবিক্ষ*ত হওয়ার মৃদু শব্দ।
রোযা অনুভব করলো সে একপাশে হেলে পড়েছে, বলিষ্ঠ এক বাহু তাকে ধরে রেখেছে যেনো সে পড়ে না যায়।হৃদযন্ত্র স্থবির হয়ে পড়লো তার। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালো সে,তার পাশে আসমান দন্ডায়মান।একদম সুস্থির তার অবয়ব,শুধুমাত্র নয়নজোড়া আর্দ্র এক অজানা অনুভবে।চেপে এলো বিভীষিকাখচিত পুষ্ট অধরজোড়া,লালচে হয়ে উঠল চেহারা।অস্ফুট স্বরে রোযা বিড়বিড় করলো,

– আস… মান?
তার দিকে ফিরে তাকালো আসমান।তার অধরের দুই কোণ বেয়ে নেমে এলো অতি ক্ষীণ র*ক্তধা*রা।বি*দ্যুৎস্পৃষ্ট হলো যেনো রোযা।তৎক্ষণাৎ ঘুরে তাকিয়ে দেখলো, রাফার ছু*রি আসমানের তলপেট বরাবর গেঁ*থে রয়েছে।র*ক্ত গড়িয়ে নামছে তার কোমর বেয়ে আরো নিচে।

এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিল রাফা।শুভ্রতার র*ক্তসি*ক্ত দুহাতের দিকে চাইলো আতঙ্কিত হয়ে।এক দণ্ড স্থির হয়ে থাকলো আসমান,টান দিয়ে ছু*রিখা*নি বের করতে চাইলেও সম্ভবপর হলোনা। র*ক্তসিক্ত হাত পিছলে গেলো। আর শক্তি পাওয়া সম্ভব হলোনা।আসমানের বলিষ্ঠ শ*রীরখানি এলিয়ে পড়ল মেঝেতে।কুঁকড়ে এলো য*ন্ত্রণায়।হতবিহ্বল রোযা যেনো নিজের সামনে গোটা পৃথিবীর পতন দেখলো।তারপর ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।নিঃশব্দে কাঁপতে কাঁপতে আসমানের মাথা নিজের কোলে তুলে নিলো।

দৃশ্যটির দিকে প্রকম্পমান অবস্থায় চেয়ে রইলো রাফা কায়সার।লুটায়িত চাঁদ এবং তার শিয়রে জ্যোৎস্না।র*ক্তা*ক্ত তাদের উপাখ্যান,যেনো অমোঘ বিরহের সমাপ্তির অপেক্ষায়।কেমন অনুভব করছে আঁধারের অশুভ রাণী?
আফসোস!
ঠিক একই সময়ে এই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড অপারেটিং রুমে একটি ইলেকট্রিক ডিভাইস তুলে হতাশায় মেঝেতে আছড়ে ফেললো চারুলতা।তার সারা শরীর কাপছে প্রচণ্ড ক্রোধ এবং উৎকণ্ঠায়।চেঁচিয়ে উঠলো সে তীব্র আফসোসে,
– আই… আই কান্ট!আমি কোডটা ব্রেক করতে পারছি না! আই শুড ফা*কিং ডা*ই!
নিহাদের দৃষ্টি আবদ্ধ রইলো মেঝেতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া ডিভাইসটির দিকে। হৃদযন্ত্র তার সঙ্গে নেই বললেই চলে।অন্তর তার পরে আছে বন্ধ দরজার ওপাশে।যা সতর্ক করছে বারংবার,জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটি সে হারিয়ে ফেলছে।

কে বি গ্রুপের ল্যাবরেটরি ভবনের ব্লুপ্রিন্ট উদ্ধার করতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি।সমস্ত নকশা পর্যবেক্ষণ করে চারুলতা আন্ডারগ্রাউন্ড অপারেটিং রুম আবিষ্কার করে,যেখান থেকে অতীতে এই ভবনের নিরাপত্তা সম্পর্কিত সকল ব্যবস্থা পরিচালিত করা হতো।সময় নষ্ট না করে দ্রুতই তারা পৌঁছায় সেখানে।যে কক্ষে বর্তমানে রাফা,রোযা এবং আসমান আবদ্ধ রয়েছে সেটি এই সম্পূর্ণ ভবনের সবথেকে সুরক্ষিত কক্ষ।এর সিস্টেম লক সক্রিয় হলে গোপনীয় কোড ব্যতিত দরজা খোলার কোনো পদ্ধতি বলতে গেলে নেই।সেই কোড একমাত্র রাফার নিকটই রয়েছে।তার ঘা*তক দলের সদস্যদের জেরা করেও কোনোকিছু উদঘাটন সম্ভব হয়নি।অগত্যা দ্রুততম সময়ে সিস্টেম হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোড ব্রেক করার সিদ্ধান্ত নেয় চারু।

আধ ঘন্টা যাবৎ সেই চেষ্টায়ই লিপ্ত রয়েছে সে।চারিপাশে দাঁড়ানো হাবিব,নিহাদ এবং অন্যান্যরা অতি আগ্রহে চেয়ে আছে সুবিশাল মনিটরসমূহ জুড়ে ভেসে বেড়ানো নানাবিধ সংখ্যার পানে।সম্পূর্ণ কালো পর্দায় ভাসমান প্রজ্জ্বলিত সবুজাভ,বেগুনি,লালচে অদ্ভুত সব অক্ষর এবং চিহ্ন।পেশায় একজন ফ্রিল্যান্সার এবং প্রোগ্রামিং ও হ্যাকিং সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকায় চারুলতা কাজটি করতে সক্ষম।কিন্তু সহস্র চেষ্টা সত্ত্বেও সে কিছুতেই নিরাপত্তা প্রোগ্রামের দূর্বল স্থানটি খুঁজে পাচ্ছেনা।ওইদিকে সময় ক্রমশই অতিবাহিত হয়ে চলেছে।কক্ষের ভেতরে কি হচ্ছে সেই সম্পর্কে জানার কোনো উপায় নেই।রোযা এবং আসমান কারো সঙ্গেই যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছেনা, শুধুমাত্র মাইক্রোট্র্যাকার তাদের অবস্থান নির্দেশ করছে।ওই কক্ষেই রয়েছে তারা, অত্যন্ত উদ্ভ্রান্ত অবস্থায়।নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।অন্যথায় এত বিশাল ঝুঁকি নেয়ার মতন মহাবোকা আসমান নয়।

ক্রমশই অধৈর্য্য হয়ে উঠল চারু।অভ্যন্তরে তার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে,সঙ্গে তীব্র এক আশঙ্কা।এমন এক মহা অস্থির অনুভূতি সে অনুভব করেছিলো একবারই।
চিত্রলেখার মৃ*ত্যুর সময়!
উপলব্ধিটি অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে সংঘ*র্ষ ঘটালো দারুণভাবে।সেই দিনটির বিভীষিকা এবং তার সামনে আপন অসহায়ত্ব স্মরণে আসতেই থরথর করে কাঁপতে থাকলো চারুলতার সর্বাঙ্গ।নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো।কি বোর্ডের উপর তার আঙুলসমূহ স্থির হয়ে পড়লো।দৃষ্টিসম্মুখে সংখ্যাগুলো কেমন যেনো ঝাপসা প্রতিবাদ তুললো।কোথাও যেন এক নারকীয় উপাখ্যান রচিত হচ্ছে আরও একবার, তারই প্রগাঢ় সতর্কবার্তা।সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেলো চারুর।হতাশায় চিৎকার করে উঠে ছিঁড়ে ফেললো একপাশে অবহেলায় পরে থাকা ইলেকট্রিক ডিভাইস।ভেঙে চুরমার হয়ে পরে থাকলো সেটি।যার পানে শক্ত দৃষ্টি আবদ্ধ হলো নিহাদের।

প্রেয়সীর চেহারার আতঙ্ক লক্ষ্য করে তার বোধগম্য হতে কিছুই নাকি রইলোনা।উভয়ই একই অনুভব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।ইচ্ছা হলো চারুকে শান্তনা প্রদান করতে,কিন্তু নিহাদ অবগত,সবকিছুই নিষ্ফল।শুধু একটি দীর্ঘ প্রশ্বাস টানলো সে,চারুর উদ্দেশ্যে চেয়ে অপ্রত্যাশিত শান্ত কন্ঠে অনুরোধ জানালো,
– হাল ছেড়োনা চারুলতা।
অশ্রুসিক্ত টলটলে নয়নে তার উদ্দেশ্যে চেয়ে রইলো প্রিয়তমা।তৎক্ষণাৎ নিহাদ তাকে সন্নিকটে টেনে নিজের উষ্ণ বাহুডোরে আগলে নিলো।ক্ষীণ এক মুহুর্ত,অথচ অব্যক্ত সকল অনুভূতির বিনিময়।দ্রুতই রমণীর কপালে গাঢ় এক স্নেহের চুম্বন এঁকে নিহাদ সরে দাঁড়ালো,

– আমার সাথে আয় হাবিব।
এটুকুই।নিহাদের অনুসরণে হাবিব দ্রুত পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো অপারেটিং রুম থেকে।অপরদিকে ধপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়ল চারুলতা।প্রচণ্ড চাপ অনুভূত হচ্ছে তার বুকের মাঝে,নিজেকে সুস্থির রাখা দায়।কম্পমান শরীর কার্যে সাই দিচ্ছেনা।উৎকণ্ঠা চরম থেকে চরমে উঠছে।তবুও ভুলে যাওয়া দায় মাত্র কিছুক্ষণ আগেই উচ্চারিত বাক্যটি,

” হাল ছেড়োনা চারুলতা।”
তৎক্ষণাৎ অভূতপূর্ব এক জোর উৎকণ্ঠাকে রূপান্তর করলো ইচ্ছাশক্তিতে।পুনরায় কি বোর্ডে স্থাপিত হলো উভয় হাতের আঙ্গুল তার নব্য উদ্যমে।শিয়রে রাখা চশমাখানি তুলে স্থাপন করলো নয়নে।স্ক্রীনের দিকে মনোযোগী দৃষ্টিপাতে তীব্র কুঞ্চনে আবর্তিত হলো ভ্রুজোড়া।হিটটিমের দুইজন উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে রইলো।ঠিক কতক্ষন পেরিয়েছে চারুলতা ঠাওরও করতে পারলোনা,এতটাই বুদ হয়ে ছিল সে প্রচেষ্টায়।অতর্কিতে নিজের কাঁধে স্থাপিত ভরসার স্পর্শ থাকে শিহরিত করে তুললো।

– বেইবি?
এক ঝটকায় ঘুরে তাকালো চারু।বিলাল রেমান ঝুঁকে রয়েছেন।আবেগের তাড়না অনুভব করলো সে প্রচন্ড।ইচ্ছা হলো তক্ষুণি পিতার বক্ষমাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয়।তবুও বহু সাধনায় দমন করলো সে নিজের আত্মবাসনাকে।
– তুমি ঠিক আছো?
পিতার উদ্বেগের বিপরীতে এক স্বস্তিদায়ক নিঃশ্বাস ফেলে চারু মাথা দোলালো দ্রুত।
– হ্যাঁ ড্যাড আমি ঠিক আছি।
বিলাল রেমান ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে কখনো এসেছেন, কিভাবে সবকিছুর নাগাল পেয়েছে তা জিজ্ঞেস করবার মতন সময় আপাতত নেই।তবে তিনি একা উপস্থিত হননি।তার সঙ্গে রয়েছে অনির্বাণ।একটি লেদার ব্যাগ ছেলেটির হাতে ঝুলছে।

– নিহাদ কিছুক্ষণ আগেই আমাদের সব জানিয়েছে।
বিলাল বলতে বলতে অনির্বাণ দ্রুত নিজের ব্যাগটি টেবিলে রাখলো। অভ্যন্তর থেকে বের করে নিলো বেশ কয়েকটি ডিভাইস এবং একটি ল্যাপটপ।ক্ষীপ্র গতিতে রীতিমত চোখের পলকে সব যন্ত্রগুলো ইনপুট করলো সে অপারেটিং সিস্টেমে।অতঃপর একটি চেয়ার টেনে চারুলতার পাশে বসলো।নিজের ল্যাপটপ খুলে কি বোর্ডে আঙুল খেলিয়ে এনে জানালো,

– আমি সিস্টেম দূর্বল করছি আপনি ব্রেক থ্রু করার চেষ্টা করুন।
সম্মতি জানালো চারুলতা।সে একা নয়,বর্তমানে অনির্বাণও যোগদান করেছে।তারা নিশ্চয়ই সিস্টেম হ্যাক করতে সক্ষম হবে দ্রুততম সময়ে,পারতেই হবে।উভয় বান্দার কাজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন বিলাল রেমান এবং বাকি সকলে।পিতার অন্তরে বারংবার শুধু একটি প্রার্থনাই ধ্বনিত হচ্ছে।সৃষ্টিকর্তা যেনো তার সন্তানদের রক্ষা করেন।
অপরদিকে নিহাদ হাবিবকে নিয়ে পৌঁছেছে ধাতব দরজাটির সামনে।হাত গুটিয়ে বসে থাকা অসম্ভব তার পক্ষে।একবার হারিয়েছে।দ্বিতীয়বার হারালে তার গ্লানির তোড়ে সে সর্বশান্ত হয়ে যাবে।দরজায় প্রথমবার কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে চেষ্টা করলো সে।লাভ না হওয়ায় হাঁটু মুড়ে বসলো।সঙ্গে নিয়ে আসা ওয়েল্ডিং মেশিন প্রস্তুত করে মুখে ধাতব মাস্ক জড়ালো। হাবিবকে ইশারা করতেই অত্যন্ত দ্রুত সে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিলো মেশিনটিতে।উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় উভয়ের শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার।নিহাদের টানা টানা উভয় নয়ন মনোযোগে শক্ত হয়ে এলো,হাতের মেশিনটির প্রান্ত থেকে নির্গত হওয়া আ*গু*নের ফুলকির উদ্দেশ্যে তাকালো সে কয়েক পলক।পরক্ষণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে দরজায় ছোঁয়ালো।যেভাবেই হোক এই বাঁধা ভাঙতেই হবে তাদের!

রোযা রহমান চড়ুই কিংবা বর্তমানে রোযা রেমান।জীবন তাকে বারংবার পরীক্ষায় ফেলেছে। জন্মগ্রহণের পর থেকেই সে শুধুমাত্র হারিয়ে গিয়েছে।নিজের বাবা,মা, না হওয়া ভাই কিংবা বোনকে।অতঃপর নিজের বাবার মতন চাচাকে।সংগ্রামের দিন ফুরোতে না ফুরোতেই প্রাণাধিক প্রিয় দাদুও পরপারের যাত্রী হলেন।ভালোবাসাও দূরে ঠেলে দিলো তাকে।একটা সময় মনে হয়েছিল,এই পৃথিবীর মাঝে একাকীত্ব তার কোনোদিন ঘুচবে না।অতঃপর তার জীবন যেনো সৃষ্টিকর্তার মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল।সকল না পাওয়ারা ফিরে এলো।বাবা,ভাই, বোন,বন্ধু আপন বলে পরিচয় দেয়ার মতন একটি পরিবার।এবং….নিজের ভালোবাসা।আজ সেই ভালোবাসাকেও সে হারাতে বসেছে।দ্বিধায় ভুগছে অনুভূতিশূণ্য অন্তর তার।এই পরিণতির দায় কার? প্রিয়তমের অভিশাপ নাকি তার আপন অভিশপ্ত ভাগ্য?

আসমানের মাথা কোলের মাঝে নিয়ে এর থেকে অধিক কোনো উপলব্ধি হলোনা রোযার।তিক্ত হয়ে গিয়েছে তার সমস্ত অস্তিত্ব।কোনো অনুভূতি অনুভব করা যে দায়!আসমান কিভাবে এক অনুভূতিহীন মেশিনে পরিণত হয়েছিল তা আজ উপলব্ধি করতে পারছে রোযা। কান্নাও আসছেনা তার।শুধু এক আক্ষেপ।এ আক্ষেপ ম*র*ণ যন্ত্রণার চাইতেও ভয়ং*কর।প্রকম্পমান হাত অতি প্রচেষ্টায় আসমানের তলপেট পর্যন্ত পৌঁছলো রোযা,র*ক্তা*ক্ত ছু*রি*র প্রান্তখানি সজোরে চেপে ধরলো।জানে তার চাঁদের প্রচন্ড কষ্ট হবে,তবুও নিজের উপর দায়ভারটুকু গ্রহণে প্রস্তুত সে।জোরালো একটি টানে গেঁ*থে থাকা ছু*রিটি উগ*ড়ে আ*নলো রোযা, গল*গল করে ফি*নকি দিয়ে ঝরতে আরম্ভ করলো র*ক্তধারা,সেটি উভয় হাতে চেপে ধরলো সজোরে।শিউরে উঠলো আসমানের সমস্ত শরীর,মৃদু এক গোঙানি নির্গত হলো কন্ঠ বেয়ে।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস তার ভারী হয়ে উঠেছে,ক্রমশ বুজে আসতে চাইছে নয়নপল্লব।তবুও নিজের চিত্তের সঙ্গে অদেখা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে সে।

এতক্ষণ যাবৎ পাথর হয়ে থাকা রোযার নয়ন বেয়ে একের পর এক অবাধ্য অশ্রুফোঁটা গড়িয়ে টপটপ করে পড়তে থাকলো আসমানের চেহারায়।মিটমিট করে তাকালো সে, প্রিয়তমার মুখচ্ছবি ঠেকলো কিঞ্চিৎ ঝাপসা।দূর্বল হয়ে আসছে শরীর র*ক্তক্ষ*রণে,বুঝতে বাকি রইলোনা।
– জ্যোৎস্না….
ক্ষীণ ভগ্ন কন্ঠে উচ্চারিত শব্দটি আবেগহীনতাকে চুরমার করে দিলো।বিদ্ধস্ত অর্ধাঙ্গিনী তার কপালে আপন কপাল ঠেকিয়ে অশ্রুসিক্ত আর্দ্র কন্ঠে বিড়বিড় করলো,

– কেনো চাঁদ?কেনো করলে এমনটা?
উত্তরে কম্পিত র*ক্তা*ক্ত হাত তুলে তার কপোল ছুঁয়ে দিলো আসমান।সেই স্পর্শে নিজের বিলীন ঘটালো রোযা,থকথকে র*ক্তফোঁটা লেপ্টে গেলো তার অঙ্গজুড়ে,রচনা করলো এক বিভীষিকার উপাখ্যানের।তবুও পরোয়া নেই।এই র*ক্ত অশুভ নয়,পবিত্র।
– যদি আমার বিনাশে তোমার মুক্তি মেলে,তবে ধ্বংস হোক এই অস্তিত্ব,ঘটুক নবজাগরণ।
স্তব্ধ হয়ে রইলো রোযা,তিরতির করে কাঁপতে থাকলো অধরজোড়া তার।আসমানের দৃষ্টি ঠেকলো তার উদরে।দূর্বল কন্ঠে সামান্য হেসে জানালো,

– একবার হারিয়েছি,দ্বিতীয়বার হারানোর চাইতে আমার ম*রণ শ্রেয়।
দুর্বোধ্য এক অশ্রুফোঁটা আসমানের নয়ন বেয়ে গড়িয়ে নামলো,র*ক্তের সঙ্গে মিশ্রিত আবেদনটুকু দৃশ্যমান হলোনা।তার বক্তব্যে নিজের মাঝে এক অপূরণীয় শূন্যতা অনুভব করলো রোযা।তার সঙ্গে এক তৃষ্ণা।
প্রতিশোধের তীব্র তৃষ্ণা!

ঝট করে মাথা উঁচিয়ে তাকালো সে কক্ষের স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকা রাফার উদ্দেশ্যে।এতক্ষণ যাবৎ তাদের নিঃশব্দ পর্যবেক্ষণ করছিলো সে।মিলিত হলো উভয় রমণীর দৃষ্টি।এক প্রান্তে অশনিসংকেত,অপর প্রান্তে আতঙ্ক।আসমানকে টেবিলের প্রান্তের সঙ্গে ঠেকিয়ে রেখে উঠলো রোযা।মাত্র টেনে বের করা ছু*রি*টি এখনো হাতে রয়েছে তার।জোর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো সে রাফার উদ্দেশ্যে।বিন্দুমাত্র সুযোগ লাভ করলোনা রমণী প্রতিক্রিয়ার।এর পূর্বেই জোর চালনায় ছু*রি*র প্রান্ত ঢু*কে গে*লো তার পে*টে, পরপর দুইবার!তৃতীয়বার চালনার উদ্দেশ্যে সেটি পুনরায় টেনে বের করে আনলো রোযা,তখনি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রাফা।ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল রোযা,অন্তিম মুহূর্তে এক হাতে সে নিজের উদর চেপে ধরেছে।তবুও এক অদ্ভুত বেদনাদায়ক পীড়া খেলে গেলো শরীরজুড়ে।অন্তিম সতর্কবাণী।আর সামান্যতম আ*ঘা*ত তার সন্তানের জন্য সহ্যকর হবেনা।উদর আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলাতে চাইলো সে,দৃশ্যটি অদূর থেকে পর্যবেক্ষণ করলো আসমান।দুহাতে ভর দিয়ে সুগঠিত শরীরকে টেনে তুলতে চাইলেও সম্ভব হলোনা,পিছলে গেলো, আবারও আছড়ে পড়ল মেঝেতে।অসহায়ত্বের আবেশ তাকে গ্রাস করে ফেললো।তবুও আরো একবার নিজের হাঁটুতে ভর দিয়ে টেনে তুললো শরীরকে,

– রোযা…রোযা প্লীজ…
বিড়বিড় করলো সে আপনমনে।নয়ন তুলে তাকাতেই দৃষ্টি বিনিময় হলো তার রাফার সঙ্গে।ওই আঁধাররাণীর আসক্ত নয়নজুড়ে প্রথমবারের মতন এক অনুভূতির রেখা দেখা গেলো।
অনুশোচনা।
এ যেন ঠিক মৃ*ত্যুর পূর্বে বাদশাহ কায়সারের মুখায়বের প্রতিচ্ছবি।
– দুঃখিত আসমান।কিন্তু আমার পক্ষে পরাজয়ের গ্লানি বরণ করার তুলনায় আ*ত্মাহু*তি শ্রেয়।
হাসলো সে,যেনো অন্তিম বারের মতন। পেটে বিশাল ক্ষত তাকে এমনিতেও বাঁ*চতে দেবে বলে মনে হয়না যদি না যথাযথ চিকিৎসালাভ হয়,তবুও রমণীর মাঝে সামান্যতম সমর্পণের অনুভূতি নেই।ভারসাম্যহীন শরীরে টলতে টলতে সে পৌঁছলো একপাশের টেবিলের কাছে।হাতের ঝটকায় অ্যালকোহলপূর্ণ কাচের পাত্রগুলো সব মেঝেতে গড়িয়ে তরল ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।মুহূর্তের তার পরিকল্পনা টের পেয়ে চিৎকার করতে চাইলো আসমান,

– রো…..
কিন্তু সম্ভব হলোনা।র*ক্ত উঠে এলো মুখে। কাশতে আরম্ভ করলো নিঃশ্বাস রুদ্ধ হওয়ার তাড়নায়। রাফার হাতে উঠে এলো লাইটার,সেটি জ্বালিয়ে দৃষ্টি মেলালো সে অমানিশার সঙ্গে।
– যে রাজ্যে আমার শাসনের ক্ষমতা নেই,সেই রাজ্যের এই ধরিত্রীতে অস্তিত্বলাভের অধিকার নেই!
হাতের লাইটারটি ধপ করে পড়লো মেঝেতে।দা*হ্য অ্যালকোহলে মুহূর্তেই দাউদাউ করে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা ছড়িয়ে গেলো কক্ষজুড়ে।ছিটকে গেলো রোযা, উভয় হাতে ভর দিয়ে পিছিয়ে এলো।তাদের এবং রাফার মাঝে বর্তমানে অ*গ্নিদেয়াল।রমণী তখনো উচ্চশিরে দন্ডায়মান।তার উদ্দেশ্যে আপতিত রোযা এবং আসমানের দৃষ্টি।
– আপনি বদ্ধ উন্মাদ!

হতাশায় চেঁচিয়ে উঠলো রোযা।বিপরীতে রাফার প্রলয়ংকরী হাসি।নিজেদের কবর রচতেও দ্বিধান্বিত হচ্ছেনা সে! আঁধাররাণী পাশ থেকে চেয়ারটি তুলে নিলো।তারপর স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালজুড়ে আ*ঘা*ত করলো মুহুর্মুহু।যেন অমানবিক শক্তি ভর করেছে তার উপর।সুদূর মেঝে থেকে পি*স্ত*লটি কুড়িয়ে আসমানের নিকট হামাগুড়ি দিয়ে এলো রোযা।আ*গুনের উত্তাপ এড়িয়ে তাকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে কম্পমান হাতে পি*স্ত*লটি তুলে নিশানা করলো। চেয়ারটি ফেলে ফিরে তাকিয়েছে রাফা ততক্ষণে,তার পিছনের দেয়ালজুড়ে গাঢ় চির ধরেছে।উপলব্ধি করলো রোযা,ভ্রু জোড়া উঁচু হলো তার।ট্রি*গারে আঙুল চেপেও চাপলোনা।
এক পলক রোযা এবং পরক্ষণেই তার বুকের মাঝে বিলীন হওয়া আসমানের অবয়বে তাকালো রাফা।অনুভব করলো তার উভয় নয়ন বেয়ে বহু পূর্বেই অশ্রু গড়াতে আরম্ভ করেছে।ওই কৃষ্ণগহ্বরে অন্তিম বারের মতন আপন দৃষ্টি মেলাতেই বুক ভারী হয়ে এলো। অধরজোড়া ফাঁক হলো,

” আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাইয়া…”
কিন্তু ধূসর মস্তিষ্ক তার কথাটিকে রূপান্তরিত করলো অন্যভাবে,
– ইউ শুড নট এক্সিস্ট…. আসমান কায়সার!
এটুকুই।নিস্তব্ধ চেয়ে রইলো আসমান প্রজ্জ্বলিত অ*গ্নির অপর প্রান্তে। রাফার শরীরটি ঠেকলো দেয়ালে।তাতে অবশিষ্ট কঠিনত্ব গুঁড়িয়ে গেলো।চড়চড় ধ্বনির সঙ্গে ঝরঝর করে ভেঙে গেলো কাঁচের দেয়াল।তাতে ঠেস দিয়ে থাকা রাফার দে*হ ভারসাম্য হারালো সম্পূর্ণ।সতেরো তলার উপর থেকে একটি ফিনফিনে কাগজের ন্যায় ওজনহীন বস্তুর মতন পতন ঘটল তার।বায়ুর ঝটকায় শরীর হিমশীতল হয়ে এলো।চোখ বুজলো রাফা।অদ্ভুত এক শান্তি অনুভূত হচ্ছে তার অন্তরে।অবশেষে এই কলুষিত ধরিত্রী থেকে মুক্তি মিলেছে তার।গ্লানি সে বরণ করেনি, উচ্চশিরে আ*ত্মা*হুতি দিয়েছে।পরাজয় তার আসক্তির,পরাজয় চাঁদের এবং জ্যোৎস্নার।

শক্ত পাথুরে সড়কের উপর ছি*টকে পড়লো তার শরীর।এককালের পুরুষমাত্র আকর্ষণীয় লাস্যময়ী,ক্ষমতাধর দে*হ*টি থেঁ*তলে গেলো মাটির মাঝে,কিছু উচ্ছিষ্ট ব্যাতিত নারীত্বের অসামান্য সৌন্দর্যের আর কিছুই অবশিষ্ট রইলোনা।শুধুই এক অশুভ বিভীষিকা।
প্রজ্জ্বলিত কক্ষের এক প্রান্তে আসমান এবং রোযা বেশ দীর্ঘ সময় জুড়ে ভাঙা দেয়ালের পানে চেয়ে রইলো।একটি কম্পিত নিঃশ্বাস নির্গত করে রোযা নিজের পি*স্ত*ল সম্বলিত হাতটি নামিয়ে নিলো।অবশেষে সত্যিই সবকিছুর সমাপ্তি ঘটেছে।
– তুমি ট্রি*গার টানোনি।
আসমানের দূর্বলতম কণ্ঠের আবেদনে রোযা তার দিকে তাকালো,না চাইতেও এক চিলতে হাসির প্রস্ফুটন ঘটলো অধরে।

– কেনো?তুমি কি চেয়েছিলে আমি রাফাকে নিজ হাতে হ*ত্যা করি?
নিঃশব্দ রইলো আসমান।আদতেই।কি চেয়েছিল সে?রোযা রাফা কায়সারের বিনাশকারী হোক?নাকি দীপ্তিকে সে আজীবন পবিত্রতর রাখতে চেয়েছিল?বোধগম্য হলোনা।শরীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে তার।কক্ষের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া লেলিহান শিখা এবং কালচে ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালানো কষ্টকর হয়ে উঠছে।তবুও কেউই একে অপরের সঙ্গে সেসব নিয়ে আলোচনা করলোনা।রোযা ছু*রিটি দিয়ে নিজের বস্ত্রের খানিকটা অংশ কে*টে আসমানের তলপেটে শক্তভাবে বেঁধে দিলো।জমাটবদ্ধ রক্ত লে*প্টে রয়েছে ক্ষ*তজুড়ে।দেখলেই কেমন গা শিহরিত হয়ে উঠে।রাফা কায়সার নিজের জীবনের অন্তিম লগ্নেও এই চাঁদের শরীর আরো একবার কলঙ্কিত করে গিয়েছে।

– খোদা পরম দয়ালু।যদি বান্দা শুদ্ধ অন্তরে প্রার্থনা করে,অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধও তিনি ক্ষমা করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আসমানের ক্ষ*ত বাঁধতে বাঁধতে বিড়বিড় করলো রোযা।তার টলটলে নয়নজুড়ে প্রতিফলিত হয়ে চললো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
– কিন্তু আ*ত্মাহুতির কোনো ক্ষমা নেই।

সমাপ্ত করলো রোযা।একটি ঢোক গিললো আসমান, মুখে র*ক্তে*র স্বাদ পেলো। বক্ষমাঝে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি হচ্ছে।সে কি খুশি হয়েছে?রাফা কায়সারের করুণ পরিণতি কি তাকে সন্তুষ্ট করেছে?অদ্ভুত হলেও সত্য,তেমনটা মনে হচ্ছেনা।সবকিছু ভিন্ন হলেও পারতো।রাফা একটিবার আপন ধূসর জগতের আবরণ হটিয়ে বাস্তব পৃথিবীতে পদার্পণ করলে ফলাফল ভিন্ন হতো। রাফার বিনাশ ঘটিয়েছে স্বয়ং রাফা,এই তার সকল অশুভ পাপের যথোপযুক্ত শাস্তি।
আসমানকে নিজের আলিঙ্গনে সম্পূর্ণ আবদ্ধ করে ফেললো রোযা।কারো মাঝেই বাক্য বিনিময়ের কোনো উৎসাহ নেই।উভয়েই চেয়ে আছে শূন্যতাঘেরা এক দৃষ্টি নিয়ে,ওই দাউদাউ অগ্নির পানে।এ যেনো মৃ*ত্যু*র অপেক্ষা।তবুও শান্তনা,একে অপরের পাশে আছে তারা।নিজের জ্ঞান লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে, টের পেলো আসমান।চকিতে রোযার উদ্দেশ্যে তাকালো,ক্ষীণ শক্তিটুকু কাজে লাগিয়ে বিড়বিড় করলো,

– আমায় ক্ষমা করে দিও জ্যোৎস্না….আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারলাম না।
– তুমি আমাদের রক্ষা করেছ চাঁদ,অবশ্যই রক্ষা করেছ।
দূর্বল চিত্তে হাসলো আসমান,উদরে স্পর্শ করলো রোযার।তাতে কম্পিত হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করলো,
– এবারেও ব্যার্থ হলাম আমি।বাবাকে ক্ষমা করে দিও, অংশ আমার।
– না!
আসমানকে জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরলো রোযা নিজের মাঝে।ফিসফিস করে তার কানের নিকট ক্রমাগত বলে গেলো,

– তোমার কিছু হবেনা আসমান,আমার আর আমাদের অংশেরও কিছু হবেনা।সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে সমাপ্তির দোরগোড়ায় আমরা।যাতনার সমুদ্র পেরিয়ে এসে সুখের সমাপ্তিটুকু অর্জন করবেনা,এতটাও নির্দয় নন খোদা।আমরা বেঁচে থাকবো,দীর্ঘকাল।কারণ, তোমার জীবন উপন্যাসের শুভ সমাপ্তি হওয়া যে এখনো বাকি!
কোনো জবাব এলোনা।রোযা অনুভব করলো,আসমান জ্ঞান হারিয়েছে।তবুও সে ছাড়লোনা প্রিয়তমকে।ধোঁয়ার প্রলেপ যত বাড়তে আরম্ভ করলো,ততই শ্বাস নেয়া কষ্টকর হলো।অচেতন আসমানকে নিজের আলিঙ্গনের মাঝে সুরক্ষিত করে রাখলো রোযা,যেনো সামান্যতম উত্তাপের আঁচটুকুও না আসে।কতক্ষন পেরিয়েছে?হিসাবে নেই।আ*গুনের উত্তাপ ক্রমশ ত্বকে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করছে।

ক্রিং!
শব্দটি রোযার স্থবির মস্তিষ্কে গোত্তা খেলো যেনো।ঝট করে পিছন ফিরে তাকালো।ধাতব দরজাটির উপরের বাতি লাল বর্ণ থেকে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।ঠিক যেভাবে বন্ধ হয়েছিল,সেভাবেই স্লাইড করে সেটি খুলে গেলো।ওপাশে দেখা মিললো বেশ কতক ছায়ামূর্তির।দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই আবেগের তাড়নায় রোযার নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।
ধোঁয়ার আবরণ ভেদ করে অভ্যন্তরে সর্বপ্রথম পা রাখলো নিহাদ।বি*স্ফারিত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো চারপাশ।ক্রোধে কুঞ্চন ফুটলো তার সুদর্শন মুখশ্রীজুড়ে।এক নজর তাকালো ভাঙা স্বচ্ছ দেয়ালের দিকে।

– রোযা!ভাইয়া!
চারুলতার হন্তদন্ত প্রবেশ যেনো সম্মোহন ভাঙলো।পিছনে পরিচিত মুখ দেখা গেলো আরও।বিলাল রেমান, হাবিব এবং অনির্বাণ।
– আব্বু!আসমানের কি হয়েছে?
পিতার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরের বিপরীতে নিহাদ এক হাত তুলে দৃপ্ত কন্ঠে আদেশ ছুড়লো,
– প্লীজ আপনারা কেউ ভেতরে আসবেন না। চারু তুমি রোযাকে ধরো,কুইক।

দ্রুত নিকটে পৌঁছে রোযার আলিঙ্গন থেকে আসমানকে ধরলো নিহাদ।নিজের কাঁধে তুলে নিলো গুরুর অচৈতন্য শরীর।অপরদিকে চারুলতা রোযাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো,সাবধানে নিয়ে গেলো কক্ষের বাইরে।কারো প্রতি কোনোপ্রকার দৃষ্টিপাত না করে হন্তদন্ত হয়ে এগোলো নিহাদ,রীতিমত ছুটতে লাগলো করিডোর ধরে, কাঁধে আসমানের শরীর।আদেশের অপেক্ষাও করলোনা কেউ।গাড়ি বের করার উদ্দেশ্যে ছুটলো হাবিব।সকলে যখন ভবনটির নিচে পৌঁছলো তখন সড়কের দৃশ্যটি নজরে এলো।
কিছুক্ষণ পূর্বেও নির্জন থাকা স্থানটি বর্তমানে লোকে লোকারণ্য।কয়েকটি গাড়ি থেমে রয়েছে।গোলাকৃতির বলয়ে দাঁড়িয়ে কিছু আড়াল করে রেখেছে।অদূর হতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সাইরেনের আওয়াজ ভেসে আসছে।সকলেই স্তব্ধ।

– রাফা কায়সারের মৃ*তদে*হ।
রোযার নির্বিকার কণ্ঠের উচ্চারণ প্রত্যেকের অন্তরে এক অব্যক্ত অনুভূতির সঞ্চার ঘটালো।তবুও যেনো বিশ্বাস হলোনা। হিটটিমের একটি ছেলে উঁকি দিয়ে ঘটনা নিশ্চিত করে ফিরে এলো।
– হ্যাঁ,রাফা কায়সার, থেঁ*তলে গিয়েছে সম্পূর্ণ শ*রীর, বোঝার উপায় নেই।শুধুমাত্র পরনের কাপড় এক।
যেনো নিশ্চিত হওয়াটা বহুল দরকার ছিলো।এর অধিক কেউই আর ভ্রুক্ষেপ করার প্রচেষ্টা চালালো না।হাবিব গাড়ি নিয়ে আসতেই সবাই ভেতরে চেপে বসলো।বর্তমানে তাদের প্রথম চিন্তা আসমান।

সকাল থেকে থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে।একেবারে ঝমঝমিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি।বর্ষার বার্তায় মুখরিত যেনো চারিপাশ।উন্মাতাল হাওয়ায় দীর্ঘদেহী বৃক্ষের শাখা প্রশাখা দুলে চলেছে।কদমের থোকা ভেজা সড়কে নব্য আখ্যানের সূত্রপাত ঘটিয়েছে।সিক্ত ধরিত্রী।যেনো সকল পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে এই পবিত্র বর্ষণের বারিধারায়।মেঘলা আকাশ অন্তরের বিষন্নতা নয়,বরং এক ভিন্ন আনন্দের জাহির ঘটাচ্ছে অকপটে।
কানে সর্বপ্রথম মুষলধারে বর্ষণধ্বনিই শোনা গেলো।শ্রবণ ইন্দ্রিয় সক্রিয় হয়ে যেনো জাগিয়ে তুললো সকলকে। সচল হলো মস্তিষ্ক,অতঃপর নিউরনের মাধ্যমে নির্দেশ প্রদান করলো নয়নপল্লব খোলার।চোখ মেললো আসমান।মিটমিট করে ঝাপসা দৃষ্টি স্বচ্ছ করে নিলো।দর্শনে এলো ধবধবে সিলিং। সমীরণের শো শো আওয়াজ এবং তার সঙ্গে লয় সৃষ্টিকারী বৃষ্টিপাত।

বিপ! বিপ!
যান্ত্রিক শব্দটি ঘোষণা করলো স্থানটি একটি হাসপাতালের কেবিন।মুখে অক্সিজেন মাস্কের উপস্থিতি টের পেলো আসমান।দূর্বল হাতে সেটি খুলে নিলো, প্রাণভরে প্রশ্বাস গ্রহণ করলো ধরিত্রীর আর্দ্র বায়ুর।কৃত্রিম সহযোগিতার প্রয়োজন নেই আর।নজর তার ঘুরে এলো সমস্ত কেবিনজুড়ে।বিছানায় শুয়ে আছে সে।বাম হাতের কব্জিতে সংযুক্ত ক্যানোলা।একপাশের জানালার প্রান্ত সামান্য খুলে রাখা।তাতে শীতল সমীরণ অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে।বারিধারার ঝরঝর আওয়াজ তাল মিলিয়েছে তার সঙ্গে।উন্মাতাল স্রোতের ন্যায় দুলছে পর্দা।একপাশের সোফাসেট ফাঁকা।সেখানে একটি কম্বল এবং কয়েক গাদা বই রাখা।তবে আপাতত দ্বিতীয় কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই।

আসমান উঠে বসার চেষ্টা করলো।তাতে তলপেটের দিকটায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো।ভ্রু কুঁচকে সহ্য করে নিজেকে উত্তোলন করলো অমানিশা।একটি নিঃশ্বাস ফেলে ক্যানোলা সংযুক্ত হাতেই আনমনে কেশমাঝে আঙুল বুলিয়ে আনলো।হাসপাতালের শুভ্র পোশাক পরিধানে তার।বেশ আরামদায়ক এক উষ্ণতাসম্পন্ন।নিজের মস্তিষ্কে জোর দিয়ে স্মরণে আনতে চাইলো সে সবকিছু।কতদিন পেরিয়েছে?কি কি ঘটনা ঘটেছিল সেদিন?টুকরো টুকরো স্মৃতির ন্যায় স্মরণে এলো সবকিছু।রাফা কায়সার!সতেরো তলা থেকে প*ড়ে গিয়েছিল।সম্পূর্ণ কক্ষে দাউদাউ করে আ*গুন জ্বলছিল।এবং….

” তোমার জীবন উপন্যাসের শুভ সমাপ্তি হওয়া যে এখনো বাকি! ”
রোযা!তার অংশ!চকিতে স্থবির হয়ে পড়লো আসমান।হৃদযন্ত্র তার গতির সীমা ছাড়িয়ে গেলো।তার জ্যোৎস্না এবং তাদের অভূমিষ্ঠ সন্তান ঠিক আছে?উদ্ভ্রান্ত হয়ে চারিদিকে তাকালো আসমান,না,কোথাও নেই কেউ।এক অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরলো তাকে।সবকিছু হারানোর আতঙ্ক! বেপরোয়াভাবে উঠলো সে। বিছানা থেকে পা নামিয়ে ক্যানোলার বাঁধন এক টানে রীতিমত ছিঁড়ে নিলো।সামান্য র*ক্তপা*ত হলো তাতে,চিনচিনে ব্যথার পরোয়াই করলোনা।কেবিনের দরজা খুলে ট্রে নিয়ে ঢুকলো একজন নার্স।হতভম্ব হয়ে গেলো বেচারী এমন অবস্থা লক্ষ্য করে।

– আপনার জ্ঞান ফিরেছে!একি একি!কি করছেন কি আপনি?
নার্স ধরতে এগোলেও তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আসমান ছুটে গেলো দরজার দিকে।তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ল সে।
– আসমান ভাই!
একটি প্যাকেট হাতে দাঁড়ানো নিহাদ একইসঙ্গে অসামান্য আনন্দ এবং উদ্বিগ্নতা নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।প্যাকেটটি সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে নিহাদ বললো,

– তুমি….তুমি ঠিক আছো?এখন কেমন লাগছে?
নিহাদকে কোনো জবাব দিলোনা আসমান।উল্টো ঘুরে সোজা কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলো।কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সে।নার্সের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলো।পরক্ষণেই দ্রুত আসমানকে অনুসরণ করলো।
– আসমান ভাই, দাঁড়াও!তুমি অসুস্থ!
কে শোনে কার কথা?আসমান নিজের ভিন্ন জগতেই রয়েছে। করিডোরজুড়ে এক লহমায় হম্বিতম্বি বেঁধে গেলো।নিহাদ এবং নার্সদের সহস্র প্রচেষ্টায়ও কিছুতেই আসমানকে থমকানো সম্ভব হচ্ছেনা।কাউকে কিছু বলছেও না সে,শুধু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছে।

– দাঁড়াও ভাই…
– প্লীজ!আপনার সেলাই খুলে আবার ব্লি*ডিং আরম্ভ হবে।ডাক্তার বলেছেন বেডরেস্ট আপাতত।
– আপনি ক্যানোলা,অক্সিজেন মাস্ক দুটোই খুলে ফেলেছেন কেনো?কি আশ্চর্য!থামুন!
নিহাদ কিংবা নার্সগণের শত বাঁধা টপকে এগোলো আসমান।ফিরেও তাকাচ্ছেনা কারো দিকে।দুজন কেবিনবয় তার পথ রোধ করে দাঁড়াতেই উভয়ের দ্বিধার সুবিধা গ্রহণ করে মাঝখানের ফাঁক গলে খুব সহজেই বেরিয়ে এলো সে।উদ্দেশ্য করিডোরের শেষ প্রান্তে পৌঁছানো।আশেপাশের কেবিনের কয়েকজন রোগী এবং অন্যান্যরা হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। যতখানি না আসমানের আচরণ,তার চেয়েও তার চেহারার প্রতি সকলের আকর্ষণ অধিক।এখানে হচ্ছেটা কি?

করিডোরের অপর প্রান্তে সহসাই দেখা মিললো দুই রমণীর।একে অপরের সঙ্গে মৃদু কণ্ঠে আলাপ সারতে সারতে এগিয়ে আসছে।বিপরীত প্রান্তে আসমান তৎক্ষণাৎ থমকে দাঁড়ালো। নার্সরা তাকে ধরতে ছোট দিলেও নিহাদ হাত তুলে ইশারায় সকলকে থামিয়ে দিলো।অপর দিকের রমণীযুগল সহসাই ঘুরে তাকালো।মাথায় ওড়নার ঘোমটা জড়ানো রমণী এগোলো এক পা, নয়নজুড়ে তার অবিশ্বাস্য দৃষ্টি।
– আসমান!
– রোযা!
দীর্ঘ কয়েক পদক্ষেপে রোযার সামনে এসে থমকালো আসমান।উভয়ের নয়ন টলটলে।একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তারা একে অপরের পানে। দৃশ্যমানভাবে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আসমান,আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো সে অর্ধাঙ্গিনীকে।একই কাজ সম্পাদন করলো রোযাও,আসমানকে দেখলো সম্পূর্ণ।যেনো এ তার স্বপ্ন।

– তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
মৃদু কণ্ঠের প্রশ্নে রোযা বিড়বিড় করলো,
– হাসপাতালের নামাজঘরে,প্রার্থনা করতে।
করিডোরের ম্রিয়মাণ আভার প্রতিফলন ঘটিয়ে আসমানের ডান নয়ন বেয়ে গড়িয়ে নামলো এক অশ্রুফোঁটা।এগোলো সে,নিজেদের মাঝের অন্তিম দূরত্বটুকুও ঘুচিয়ে দুবাহুর অভ্যন্তরে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো সহধর্মিনীকে।পাল্টা প্রতিক্রিয়া করলো রোযাও, আসমানকে আলিঙ্গন করলো।তবুও সাবধানের অভাব নেই। তলপেটজুড়ে ব্যান্ডেজের ক্ষ*ত এড়িয়ে গেলো অতি সতর্কে,পিঠে বুলিয়ে আনলো শান্তনার হাত।অজান্তেই সিক্ত হলো নয়ন তার।অনুভব করলো, আসমানের নিঃশব্দ অশ্রুতে ক্রমশ ভিজে উঠছে তার বস্ত্রের কাঁধের অংশ।

– তুমি ঠিক আছো?
ভগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো অমানিশা,যেনো আপন দৃষ্টিকেও বিশ্বাস করতে নারাজ।রোযা ক্রন্দনের মাঝেও দূর্বল হাসলো,তার মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে এনে জবাব দিলো,
– আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি আসমান,এবং আমাদের অংশও।
আসমানের একটি হাত ভ্রমণ করে এসে থামলো রোযার উদরে।অনুভব করলো নিজের সবটা দিয়ে।তার অর্ধাঙ্গিনীর উদরের কিঞ্চিৎ ফোলাভাব টের পাওয়া যাচ্ছে,ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে আসছে নতুন প্রাণের সঞ্চারে।কিছুতেই নিজের অশ্রুকে দমন করা সম্ভব হলোনা।দুহাত কোমরে নামিয়ে রোযার মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিলো আসমান,জ্যোৎস্না তাকে মুড়িয়ে নিলো নিজের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে।

ডার্কসাইড পর্ব ৬৭

পিছনে দাঁড়ানো চারুলতা,নিহাদ,হাসপাতালের নার্স এবং অন্যান্যরা দৃশ্যটির দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো।এক মুগ্ধকর আবাহন,নজর ফিরিয়ে নেয়া দায়।অদ্ভুত এক প্রশান্তি ভর করেছে যেন প্রত্যেকের অন্তরে।
অবশেষে!
আনমনে চোখের কোণে জমা অশ্রুফোঁটা বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে নিলো নিহাদ।অপর পাশে দাঁড়ানো চারুলতার সঙ্গে দৃষ্টি মিলতেই আপনমনে হাসির ধারায় উদ্ভাসিত হলো উভয়ের অধর।

ডার্কসাইড পর্ব ৬৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here