ডার্কসাইড পর্ব ৮

ডার্কসাইড পর্ব ৮
জাবিন ফোরকান

ভবনটির নাম দেখেই কিছুদিন আগের সেই স্মৃতি রোযার মনের কোণে তাজা হয়ে উঠলো।এইখানেই ডেলিভারি দিতে এসেছিল সে।কি জিনিস তা অবশ্য জানা নেই।ভালো কিছু নয় নিশ্চিত। আসমান তাকে এখানে কেনো নিয়ে এলো?তবে কি….!
ভাববার পর্যাপ্ত সময় রোযা পেলোনা।পাশের সিট থেকে আসমান তার দিকে কিছু একটা বাড়িয়ে দিতেই সে নজর ঘোরাতে বাধ্য হলো।একটা ফাইল।দ্বিধান্বিত হয়ে ফাইলটি হাতে নিয়ে খুলতেই রোযার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে উঠলো।

– ক… কাবিননামা…?
– ফেইক…. কাবিননামা।
রোযাকে শুধরে দিলো আসমান।হতবিহ্বল হয়ে রোযা তাকিয়ে রইলো ছেলেটির দিকে।একটা নিঃশ্বাস ফেলে আসমান প্রথমবারের মতন কোনকিছু বিশ্লেষণ করলো রোযার নিকট।
– এটা রেসিডেনশিয়াল এলাকা।এখানে হুটহাট ঢুকে পড়ে বসবাস অসম্ভব।কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমতি গ্রহণ করতে হয়, কে থাকছে, কোন সম্পর্কে থাকছে সবকিছু। আমার ভাইবোনের তথ্য রয়েছে আগে থেকেই, তাই আপনাকে নতুনভাবে আমার বোন বানানো সম্ভব নয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ তাই বলে বউ বানিয়ে নিয়ে যাবেন?”— প্রশ্নটা রোযা চাইলেও উচ্চারণ করতে সক্ষম হলোনা। হুট করেই তার মনে পড়ল, ঠিক গতকাল রাতেই সকলের সামনে আসমান নিজেকে তার স্বামী বলে পরিচয় দিয়েছিল। রোযা বুঝতে পেরেছে সবটাই পরিস্থিতির প্রয়োজনে।তবুও…. নিজের হৃদয়ে জাগ্রত হওয়ার অনুভূতির নব্য প্রস্ফুটিত ফুলটিকে সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছেনা।
হাতের কাবিননামার কাগজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল রোযা।আসমান কখন এর ব্যবস্থা করেছে সে জানেনা।ইতোমধ্যে সে সাক্ষর করে ফেলেছে।তবে নাম আসমান নয়।
নীলাদ্রি রেমান নীল।
রোযা আড়চোখে আসমানকে দেখলো, সে তার দিকে তাকিয়ে নেই। এই ব্যক্তির ঠিক কতগুলি পরিচয় রয়েছে?একটি, দুটি…নাকি অসংখ্য?তার মাঝে নীলাদ্রি রেমান বুঝি একটি?

– আজ থেকে আপনি আরিয়া রেমান।সাইন করুন আরিয়া সুলতানা নামে।
হুট করেই বলে উঠলো আসমান, যদিও রোযার দিকে ফিরে তাকায়নি। রোযা কলমের ক্যাপ খুলে কাগজটির দিকে বেশ দীর্ঘ একটা সময় চেয়ে রইলো।সবকিছুই মিথ্যা।মিথ্যা কাগজ, মিথ্যা পরিচয় , মিথ্যা এক বন্ধন।তবুও তার হৃদয়ে এমন ঘূর্ণিপাকের অর্থ কি?মিথ্যার বন্ধন কখনো চিরস্থায়ী হয়না, সেই কামনাও সে করেনা।তদুপরি এমন অনুভূতির টানাপোড়েনের মর্ম কি? কলমের নিব কাগজে ছুঁইয়ে রোযা আনমনে প্রশ্ন করে বসলো,
– সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরে?
– ডিভোর্স।
বিন্দুমাত্র সময়ও নিলোনা আসমান উত্তর করতে। ক্যাবের দরজা খুলে সে বেরিয়ে গেলো বাইরে।ক্যাবের ড্রাইভার ভবনের দারোয়ানের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে বোধ হয়। রোযা খুব বেশি চিন্তা করার সুযোগ পেলোনা।খুব দ্রুত সাইন করে দিলো।
আরিয়া সুলতানা।
নীলাদ্রি রেমান নীলের স্ত্রী আরিয়া রেমান।

লিফটে করে ত্রিশতম তলায় পৌঁছানোর পর যে ফ্ল্যাটে রোযা ঢুকলো সেটাকে ফ্ল্যাট কম বরং ডুপ্লেক্স বাড়ি বলে বেশি অনুভূত হলো তার।
দরজায় কার্ড পাঞ্চ করে ভেতরে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম তেমন কিছুই নজরে এলোনা।কারণ ভারী কালো পর্দায় আবৃত সম্পূর্ণ কক্ষ। তা ভেদ করে সূর্যরশ্মি অনুপ্রবেশে সমর্থ নয়।যেন এখানে বসবাসকারী জীব অন্ধকারের বাসিন্দা।ভেতরে মানুষের উপস্থিতির কারণে অটোমেটিক সেন্সর বাতি জ্বালিয়ে দিলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।তাতে ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হলো সম্পূর্ণ স্থানটি।

সম্পূর্ণ ইন্টেরিয়র শুধুমাত্র দুইটি রঙের উপর ভিত্তি করে সজ্জিত।সাদা এবং কালো।এরই হালকা কিংবা গাঢ় শেড ব্যবহার করে দেয়াল থেকে আসবাব পর্যন্ত সবকিছু ডিজাইন করা হয়েছে।ঢুকতেই প্রথমে একটি উন্মুক্ত ময়দানের মতন হলঘর।নরম গদির কাউচ রয়েছে কয়েকটি, মাঝখানে একটি নিচু কাচের তৈরি টেবিল। ঠিক তার পিছনেই লাগোয়া সুবিস্তৃত কিচেন।একটি স্বচ্ছ কাচের দরজার সাহায্যে পৃথক করা জায়গাটি।কক্ষের এক কোণায় রয়েছে সর্পিলাকৃতির একটি সিঁড়ি,যা উঠে গেছে দুইতলা পর্যন্ত। উপরে কি রয়েছে তা পরিদর্শনের সুযোগ আপাতত রোযার নেই।সে বর্তমানে তার সামনের আভিজাত্য অবলোকনে ব্যাস্ত।শুধুমাত্র কিচেনটিই রোযার ফেলে আসা চিলেকোঠার ঘরের দ্বিগুণের সমান হবে।বাকি কোনকিছুকেই তার তুলনা করতেও বাঁধলো।
– আপনি নিচতলায় থাকবেন।

আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো আসমান।হলঘরের একপাশে কিছুটা সরু গলির মতন জায়গা রয়েছে।ওটা সম্ভবত ড্রেসিং রুম।তার ওপাশে কোনো কক্ষ থাকলেও থাকতে পারে। আর কিছুই বললোনা আসমান।চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।এটা কেমন ধরণের আচরণ হলো?নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে শুধুমাত্র একটা বাক্য বলেই খালাস?অবশ্য সে আর কিই বা আশা করছিল এই পিশাচের থেকে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোযা এগোলো। আসমান যেদিকে দেখিয়ে দিয়েছে সেখানে যাওয়া প্রয়োজন। যাওয়ার পথে সরু গলির পাশের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে রোযা দেখল ভেতরে তার সুটকেস।রুমটি শুধুমাত্র বিভিন্ন তাক এবং আলমারির মতন ড্রয়ার সম্পন্ন।একপাশের দেয়ালজুড়ে পোশাক রাখার জায়গা, অপর পাশের দেয়ালে বিশালাকৃতির আয়না এবং প্রসাধনী সামগ্রী।ঠিকই ধরেছিল রোযা, এটা ড্রেসিং রুমই।বাব্বাহ!বড়লোকদের কি চাহিদা!শুধুমাত্র পোশাক পরিবর্তনের জন্যও পৃথক কক্ষের প্রয়োজন হয়!

নিজের বাইরের পোশাক বদলে রোযা একটি সালোয়ার কামিজ পরিধান করে নিলো।তারপর নিজের কক্ষে গিয়ে একবার দেখে এলো।কক্ষটি… চমৎকার।খুব বেশি বড়োও নয় আবার ছোটও নয়।ছিমছাম এবং পরিপাটি।পরিচ্ছন্ন বিছানা, ক্লোজেট, অ্যাটাচড বাথরুমসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে।রোযার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হলো একপাশের কাচের দেয়াল, যার অর্ধেকটা অস্বচ্ছ এবং বাকিটা স্বচ্ছ কাচে তৈরী।চাইলে স্লাইড করে জানালার মতন খুলে রাখা যায়।এই দেয়ালের সামনে দাঁড়ালে ত্রিশ তলার উপর থেকে নিচের গোটা এলাকাসহ শহরের একাংশও বেশ চোখে পড়ে।বিশেষ করে আকাশের দৃশ্যটি অতুলনীয়।শুধুমাত্র এখানে দাঁড়িয়েই রোযা অনায়াসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করতে পারবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ঠিক কতক্ষন বিছানায় বসে বাইরের দৃশ্যের দিকে চেয়ে রোযা নিজের বর্তমান অবস্থান নিয়ে ভাবতে ভাবতে কাটিয়েছে টের পেলোনা।তার পেট ক্ষুধায় কাতর হয়ে গুমড়ে উঠতেই রোযার মনে পড়ল সে গতকাল রাতে কিছু খায়নি, আর সকালেও মাত্র এক পিস ব্রেড এবং একটি মিষ্টি খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। রুমের একমাত্র দেয়ালঘড়িটি সময়ের জানান দিচ্ছে দুপুর একটা চব্বিশ বলে।আসমানের কোনো সাড়াশব্দ নেই।ঘুমিয়েই পড়লো নাকি নিজের রুমে?দুপুরের খাবারের কি হবে?কিছু তো বললোনা।

এত ভেবে লাভ নেই।সংকোচ করে বসে থাকলে তো আর খাবার মিলবেনা।ভেবে রোযা উঠে দাঁড়ালো।ওড়না গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরোলো।হলকক্ষে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম জায়গাটির আঁধার তার ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো।দ্রুত হেঁটে টেনেটুনে ভারী পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই কাচের দেয়াল ভেদ করে প্রবেশ করতে শুরু করলো দিবাকরের মৃদু আলোকরশ্মি।তাতে নির্মল বর্ণে মুহূর্তেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কক্ষটি। স্লাইড করে কয়েকটি জানালা খুলে দিতেই বাইরের শীতল বাতাস ভেতরের গুমোট ভাবকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে এক প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতায় রাঙিয়ে তুললো।
নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে রোযা যেই না কিচেনের দিকে এগোবে ঠিক সেই মুহূর্তেই কলিংবেলের মিষ্টি সঙ্গীতের সুরে সে থমকে পড়লো।কেউ এসেছে।কিন্তু কে?সে কি খুলবে দরজা?নাকি আসমানের অপেক্ষা করবে?বেশ কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আসমানের কোনো অস্তিত্ব চোখে না পড়ায় রোযা নিজেই এগোলো।সাবধানে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলো এক রমণী।

– ভাইয়া তুই….
যেন নিজের বাসায় এসেছে এমন ভঙ্গিতে সে চলে গেলো একদম কক্ষের মাঝখানে, কিন্তু যখন হতভম্ব রোযাকে চোখে পড়ল তখন সে নিজের জায়গায় জমে গেলো রীতিমত।অপরদিকে রোযাও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো রমণীর দিকে। নিজের দৃষ্টিকেই মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করে উঠতে পারলোনা সে।
সেই মেয়েটি!যার কাছে আসাদ উদ্দীনের প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিতে এসেছিল রোযা!তাকে শরবত খেতে দিয়ে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল যে সুদর্শনা রমণী!
– আপনি!
রমণীর ভ্রু কুঁচকে গেলো, ঈষৎ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে সে দেখতে থাকলো রোযাকে।তার দৃষ্টির গভীরতায় রোযা না চাইতেও সংকুচিত হয়ে পড়লো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো নির্বোধের মতন।

– আপনি এখানে কি করছেন? ডেলিভারি দিতে এসেছেন নতুন কিছু?
রমণীর হাতে রয়েছে দুইটি বড়সড় হটপট। তা টি টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে পুনরায় রোযার মুখোমুখি হলো সে। সেদিনের মতন আজও পরনে রয়েছে একটা ঢোলা টি শার্ট, যা নেমে গিয়েছে তার কোমরের নিচ পর্যন্ত। ধুতিপ্যান্টের উপরে টি শার্টের খানিকটা অংশ গোঁজা রয়েছে, স্টাইল হিসাবে নাকি অনিচ্ছাকৃত তা রোযা বুঝতে পারলোনা। পনিটেইলের বদলে আজ চুলগুলো সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, তাতে চুলের মাঝে মাঝে লাল রঙের গুচ্ছ চোখে পড়ছে।অদ্ভুত কালার করিয়েছে।তবু মেয়েটিকে খারাপ লাগছেনা বরং ভীষন মানিয়েছে।
– কি ব্যাপার?
রমণী নিজের হাত নেড়ে ইশারা করতেই রোযার ভাবনার ঘোর কাটলো।কন্ঠ পরিষ্কার করে বুকে হাত দিয়ে মিষ্টি কন্ঠে সে জানালো,

– আমি রো…আরিয়া রেমান। নীলের স্ত্রী।
রমণী নিষ্পলক নয়নে রোযার দিকে চেয়ে রইল, তার চেহারার অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হয়নি।রোযা নিজের এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের আঙুলের ফাঁকে গলিয়ে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো।ঠান্ডা পরিবেশেও সে ঘেমে উঠছে, হৃদযন্ত্র বুকের ভেতর ঢোলক বাজিয়ে আসর জমাচ্ছে। রমণী চেয়েই রইলো….নির্বাক হয়ে।পিনপতন নীরবতার মাঝে দেয়ালঘড়ির টিকটিক শব্দ ভেসে এলো। তা ক্রমশই অসহ্য হয়ে উঠতে থাকলো।তারপর একটা সময়….
– ভাইয়া!
রমণীর কন্ঠস্বর উচ্চ তরঙ্গ প্রবাহিত করে দিলো সম্পূর্ণ কক্ষে।রোযার উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ হারিয়ে সে সিঁড়ির কাছে গিয়ে রেলিংয়ে হাত রেখে ডাকতে থাকলো,
– অ্যাই ভাইয়া!…. নীল ভাইয়া…!

ভাইয়া?এ কি আসমানের বোন?কিন্তু তাহলে নীল কে?আসমান কে? এত রহস্য কেনো ওই পিশাচকে ঘিরে?
রমণী পাক্কা দুই মিনিট ডাকাডাকির পর যে মুহূর্তে উপরে উঠতে উদ্যত হচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই সিঁড়ির মুখে দর্শন পাওয়া গেলো আসমানের।একটি হাতছাড়া গেঞ্জি পরনে, চুলগুলো উস্কোখুস্কো এবং দৃষ্টি কিছুটা বিভ্রান্ত।সত্যিই বোধ হয় ঘুমিয়েছিল।অনাবৃত থাকার দরুণ তার বাহুর শক্তিশালী পেশী নজরে পড়ছে। রোযা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো।আসমানের ত্বক এতটা ফর্সা বর্ণের সেটা সে পূর্বে লক্ষ্য করার সুযোগ পায়নি।তার সামনে যতবার আসমান এসেছে সম্পূর্ণ আবৃত অবস্থায়, এমনকি হাতেও ছিল গ্লাভস।যার দরুণ তার বাহ্যিক গঠনে খুব একটা মনোযোগ পড়েনি।কিন্তু বর্তমানে তা দেখার সুযোগ হচ্ছে। একটু অস্বাভাবিক রকমের শুভ্র ত্বকের অধিকারী আসমান।তাতে তার বাহুর শিরা উপশিরাসমূহও নীলচে বর্ণ প্রকাশ করে দৃশ্যমান হচ্ছে।রোযা অবশ্য বেশিক্ষণ অবলোকনের সুযোগ লাভ করলোনা।আসমান সাথে নিয়ে আসা একটা কালো শার্ট মুহূর্তেই গায়ে চড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো।এতকিছুর মাঝেও সে মাস্ক পড়তে ভোলেনি।
আসমান নিচে পৌঁছে কোনোকিছু বললোনা।শুধু চেয়ে থাকলো রমণীর দিকে।এমন এক অভিব্যক্তি তার চোখজোড়ায় যেন সে খুবই বিরক্ত হয়েছে।

– এই মেয়ে কে ভাইয়া?
সরাসরি রোযাকে দেখিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো সে।এক সেকেন্ডও সময় নিলোনা আসমান উত্তর করতে।
– মাই ওয়াইফ।
– ইওর হোয়াট…!
রমণী স্তব্ধ হয়ে রইলো।তার ঠোঁটজোড়া বিস্ময়ে আধ ইঞ্চি ফাঁক হয়ে রয়েছে।আর কিছুই সে উচ্চারণে সক্ষম নয়।এমনকি রোযাও কিছুটা হতচকিত হয়ে আছে।“ মাই ওয়াইফ”— কি অবলীলায়ই না উচ্চারণ করলো আসমান।সে কি আদও এই সম্পর্কের মর্ম বোঝে?বুঝলে কি কোনোদিন পারতো এমন অবিচলিত আচরণ করতে?
রোযা ভেবেছিল রমণী হয়ত এখন সেদিনের কাহিনী নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবে।কিন্ত তা না করে সে নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে জিজ্ঞেস করলো,
– আর ইউ শিওর?
জবাব হিসাবে মাথা দোলালো আসমান।দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমণী নিজের ডান হাতে মুখ ঘষে শান্ত কন্ঠে শুধালো,
– বাবা জানে?
– না।
– ওয়েল… ইউ বেটার কন্ট্যাক্ট হিম সুন।

বলেই রমণী উল্টো ঘুরে গেলো।আসমানের সঙ্গে কোনোপ্রকার বাকবিতণ্ডার লক্ষণ প্রদর্শন করলোনা।
– তোর জন্য খাবার রেঁধেছিলাম।দুপুর আর রাতের হিসাবে নিয়ে এসেছি, আশা করি দুইজনের হয়ে যাবে।
রমণীর কন্ঠ ঈষৎ অভিমানী শোনালো,কিন্তু তাতে আসমানের কোনো ভ্রুক্ষেপ রয়েছে বলে মনে হলোনা। ছাব্বিশ তলার অভিজাত রমণী হনহন করে হেঁটে এগোলো দরজার দিকে।বাইরে বের হওয়ার আগে সে একবার ঘুরে তাকালো পিছনে।তার দৃষ্টি আপতিত হলো রোযার উপর।অকারনেই ভিরমি খেলো রোযা।
– বায় দ্যা ওয়ে….

রোযা ঢোক গিলে তাকালো রমণীর দিকে।একটি অদ্ভুতুড়ে হাসি ফুটে উঠল সুদর্শনার মসৃণ অধরজুড়ে।
– মাইসেলফ আফসানা রেমান চারুলতা…. ইওর হাসব্যান্ডস সিস্টার।
ক্লিক শব্দে দরজা আটকে গেলো, আড়াল হয়ে গেলো চারুলতা।রোযা অবাক হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।বাড়ির ছেলে কাউকে না জানিয়ে যদি বিয়ে করে বউ ঘরে তোলে সেক্ষেত্রে তার পারিবারিক সদস্যদের আচরণ এতটা শান্তিপূর্ণ হতে পারে এমন কোনো ধারণাই রোযার ছিলোনা এতদিন।
– খেয়ে নিন।

আসমানের কন্ঠে রোযার মনোযোগ ভাঙলো।ঘুরে তাকালো সে।প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই।তার সামনের বান্দা কোনোদিনও তাকে এইসব রহস্যের সমাধানে সহযোগিতা করবেনা।
– আজ রাতে অনেক কাজ।
এটুকু বলেই একটি হটপট তুলে নিয়ে আসমান পুনরায় দোতলায় আড়াল হয়ে গেলো।একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করে রোযা ধপ করে কাউচে বসে পড়লো।তার জীবনে রঙ্গতামাশার এই যেন সূত্রপাত।

ঈষৎ হলদেটে তরলজুড়ে ভাসছে ছোটছোট বুদবুদ।গ্লাসের মধ্যে আটলান্টিকে ভাসমান হিমবাহের ন্যায় ভাসছে বরফখন্ড। ঝাঁকি দিলেই ঢেউয়ের তোড়ে সৃষ্টি হচ্ছে বুদবুদে ফেনা।এক চুমুকে সম্পূর্ণ গ্লাস নিঃশেষ করে দিয়ে পুনরায় আরেক গ্লাস পূর্ণ করতে লাগলো নিহাদ।তার বিপরীত প্রান্তে বসে থাকা ব্যক্তিটি অবশ্য এক্ষেত্রে ধীরস্থির। একটু একটু করে সে আস্বাদন করছে অতি মূল্যবান ইমপোর্টেড পানীয়।
– আপনার অ্যালকোহল লিমিট এতটা কম হবে ভাবিনি আকাশ সাহেব।
কিঞ্চিৎ জড়ানো কন্ঠে হাসলো নিহাদ, তারপর চুমুক দিলো নতুন গ্লাসে।আকাশ তার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করেছে বলে মনে হলোনা।সে ওই একইভাবে স্থির দৃষ্টিতে দেখছে নিহাদকে।চোখ বুজে সমস্ত তরল গলায় ঢেলে ঠাস করে টেবিলে গ্লাসটি রেখে দিলো নিহাদ, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে তাকালো আকাশের দিকে।

– তুমি কোনো মিশনে ব্যর্থ হবে ভাবিনি নিহাদ।
আকাশের বক্তব্যে নিহাদ কাধ তুলে ঠোঁট উল্টালো।
– ব্যর্থ হলাম কোথায়?আমাকে যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল তা নিশ্চয়ই ভুল ছিলো।
– আমাদের এক্সপার্ট টিম কখনো ভুল করেনা।
এবার আকাশের যান্ত্রিক দৃষ্টিতে নিজের জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলালো নিহাদ।ঠোঁট বাকিয়ে সামনে ঝুঁকে বললো,
– আপনি বোধ হয় স্বীকার করতে নারাজ যে কে বি গ্রুপের মাধ্যমেও কোনো ভুল হতে পারে!
আকাশ জবাব দিলোনা, স্থির দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে গেলো নিহাদের প্রতিক্রিয়া।তার কেনো যেন মনে হচ্ছে এই ছেলেটা কোনকিছু ইশারা করছে।কিন্তু সেই ইশারা আপাতত সে ধরতে পারছেনা।পুনরায় চেয়ারে হেলান দিয়ে নিহাদ উদাসী ভঙ্গিতে তৃতীয় গ্লাসে কিছু বরফকুচি তুলে নিলো।তারপর ঢালতে থাকলো পানীয়, যতক্ষণ না উপচে পরে তা।
– ওই মেয়ে সেইদিন বাড়িতেই আসেনি।হয়ত আগেই টের পেয়ে কোথাও সটকে পেরেছে নয়ত যথারীতি নিজের কাস্টমারের সঙ্গে বাইরে রাত কাটিয়েছে।

গ্লাসে চুমুক দিল নিহাদ।এবার তাড়াহুড়ো করলোনা।ধীরে ধীরে উপভোগ করতে থাকলো পানীয়ের উত্তেজনাকর স্বাদ।
– তাহলে আজ সকালেই সে বাড়ি থেকে উধাও হলো কিভাবে?
আকাশের প্রশ্নে এই প্রথম বিরক্তি প্রকাশ করলো নিহাদ।গ্লাস নামিয়ে রেখে একটা হেঁচকি তুলে জানালো,
– আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন আকাশ সাহেব, আমি ডিটেকটিভ নই হিটম্যান।আমার কাজ গোয়েন্দাগিরি করা নয় বরং যাওয়া এবং খতম করা।
আর কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা আকাশ।নিজের গ্লাস নিঃশেষ করে উঠলো।পরিধানের সুটের কলার ঠিকঠাক করে নিতে নিতে বিড়বিড় করলো,
– সে যাই হোক, ওই মেয়েকে তো পাকড়াও করা হবেই।যদি সে দোষী না হতো তাহলে নিশ্চয়ই এভাবে পালিয়ে বেড়াতো না।কিন্তু পালিয়েও বা আর যাবে কোথায়?
– হুম। অল দ্যা বেস্ট।
বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে নিহাদ নিজের ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসলো।তাতে আকাশের কপালে কয়েক সারি ভাঁজ পড়ল।এই ছেলেটা বড়ই বেপরোয়া।কোনকিছুতেই এর প্রফুল্লতা কমানো যায়না।জটিল থেকে মারাত্মক সব কাজই সে হাসতে হাসতে করে,যেন এসব তার জন্য ছেলেখেলা।তাই কে বি গ্রুপের হিটটিমে নেতার স্থানটি বর্তমানে তার দখলে। আগে ছিল…..

নামটি মনে করতে চাইলোনা আকাশ।ওই নামটির সঙ্গে তার নিজের নামের অস্বাভাবিক এক মিল রয়েছে।যার দরুণ তাকে স্মরণে আসলেও কেমন অশুভ এক অনুভূতি অনুভূত হয়। মাথা ঝাকিয়ে পুরোনো চিন্তা দূর করে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে এগোলো আকাশ,পথিমধ্যে বললো,
– হোয়াটএভার ইউ সে নিহাদ।তবে কুকুর হয়ে মালিকের পায়ে কাম*ড় বসাতে চাওয়ার পরিণাম কি হতে পারে তা কখনোই ভুলে যেওনা।
থমকে গেলো নিহাদ।এই প্রথম তার অধর থেকে সর্বদা লেগে থাকা প্রফুল্ল হাসিটি উধাও হলো।মাথা কাত করে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকালো আকাশ।
– ইউ হ্যাভ আ গ্রেট এক্সাম্পল বিফোর ইউ, ডোন্ট ইউ?
এটুকুই।বার থেকে বেরিয়ে গেলো আকাশ।অপরদিকে তখনো নিঃশব্দে বসমান নিহাদ।গ্লাসে তার হাত ক্রমশ চেপে বসেছে।কিন্তু পরক্ষণেই আবার তার ঠোঁট ভাসিয়ে উঠলো হাসির জোয়ার।
– হেহ…এক্সাম্পল?
নিজের ফোন চালু করলো নিহাদ। গ্যালারিতে ঢুকলো।তার সামনে ভেসে উঠল একটা ছবি। চারতলা বিল্ডিংয়ের সামনে একটি ক্যাব দাঁড়িয়ে, তার সঙ্গে মাস্ক ক্যাপ পরিহিত এক যুবক এবং সালোয়ার কামিজ পরিহিতা যুবতী।উভয়ই ক্যাবে প্রবেশ করছে।ছবিটির দিকে চেয়ে গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালো নিহাদ।হাসতে হাসতে বিড়বিড় করলো,
– ইয়েস, হি ইজ আ গ্রেট এক্সাম্পল অব আ ওয়ারিঅর!

ক্লাবটির নাম “ পাতাল ” যার অর্থ ইংরেজি করলে দাঁড়ায় “ আন্ডারগ্রাউন্ড ” এবং ইটালিয়ানে “ ইল মন্দো সত্যেররানেও ”। এই তৃতীয় বিশ্বের দেশটিতে অজস্র না পাওয়ার মাঝে এমন এক স্বর্গীয় স্থানের অস্তিত্ব থাকবে তা গত সফরে উপভোগের সুযোগ পায়নি সান্দ্রো। এবার অন্তত কিছুটা হলেও তার শখ পূরণ হচ্ছে।
উফ!কি এক যন্ত্রণা! তার বাবা যে কেনো শুধু তাকেই পায় এই অশিক্ষিত মানুষগুলোর সাথে ডিল করতে!বাঙালি মানেই একেকটা অ্যা*টম ব*ম্ব।কাজের বালাই নেই শুধু মুখেই যত বড় বড় কথা। উঠতে বসতে পা চাটতে প্রস্তুত থাকে।অপমান করলেও নীরবে হজম করে নেয়, হাসিমুখ ধরে রেখে।এসব সান্দ্রোর জন্য অতিথিপরায়ণতা নয়, বরং চারিত্রিক দুর্বলতা।

ক্লাবের পরিবেশ বর্তমানে উন্মত্ত হয়ে রয়েছে।এই জায়গায় কিছুটা হলেও ইতালির ভাইব পাওয়া যাচ্ছে যেন।সব অভিজাত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানেরা স্ফূর্তি উদযাপনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এখানে।ঠিক উন্মাদনা বললে ভুল হবে,রীতিমত অ*শ্লী*লতা।এখানে নামধারী কোনো সুশীলের উপস্থিতি নেই, তাই সকলে মুক্ত বাঁধনহারা পাখির ন্যায় মত্ত উপভোগে।তীব্র মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে অবাধ মেলামেশা।ছেলেতে মেয়েতে কোনো পার্থক্যই যেন নেই।
তবে আজ কেনো যেন এসবে অংশ নিতে ভালো লাগছেনা। সান্দ্রো তাই সোফায় বসে চুমুক দিচ্ছে বিয়ারে।কিছুক্ষণ আগেই পাঁচ কি ছয়টি মেয়ে এসে তার আশেপাশে ঘুরে গিয়েছে,কাউকেই আলাদাভাবে চোখে পড়েনি।এইসব বাঙালি মেয়েগুলোও পাশ্চাত্য সাজে নিজেদের মেলে ধরেছে, কোনো পার্থক্য বোঝা দায়।তাই কেনো যেন রুচি আসছেনা তার।যদিও তার সেক্রেটারি কিছুটা দূরেই বিহ্বল একজন সঙ্গিনীর সনে।

অলস ভঙ্গিতে সোফায় হেলান দিয়ে বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ সান্দ্রোর সর্পের ন্যায় তীক্ষ্ণ নয়নজোড়া আবদ্ধ হলো এক রমণীতে।তাকে আলাদাভাবে নজরে পড়ার কারণ, তার পরিধানের বস্ত্র।এমন এক জায়গায় শাড়ী পরে আসা মেয়েকে শুধু সান্দ্রোর নয়, বরং বাকি সকলেরই চোখে পড়েছে।
গাঢ় খয়েরী রঙের ঝকঝকে দ্যুতি ছড়ানো শাড়িটির সঙ্গে কালো হাতবিহীন টপ বেশ মানিয়েছে।মেয়েটি আহামরি সুন্দরী নয়,তবুও তার চেহারা এবং অবয়ব এতটাই আকর্ষণীয় ঠেকছে যে সান্দ্রো নিজের দৃষ্টি ফেরাতে পারছেনা।বাঙালি রমণীর চলনই ভিন্নরকম।নির্লজ্জের মতন তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে গেলো সান্দ্রো।
রমণীও তার দৃষ্টি ঠিকই লক্ষ্য করলো।টকটকে খয়েরী লিপস্টিক দেয়া ঠোঁটে বিস্তর হেসে সে আঙুল তুলে ইশারা করলো, প্রাইভেট রুমের দিকে।অতঃপর….

ডার্কসাইড পর্ব ৭

লাস্যময়ী রমণীর পিছু নিলো সান্দ্রো।মায়াবিনীর সৌন্দর্যে এতটাই মোহিত সে যে ক্লাবের বারে এতক্ষণ ঠিক তার থেকে কয়েক হাত দূরে বসে থাকা মাস্ক পরিহিত বান্দাকে সে খেয়ালই করলোনা। সান্দ্রো এবং রমণী উধাও হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই সেও উঠলো, ধীরে ধীরে অনুসরণ করল নিজ পথ।

ডার্কসাইড পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here