ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১০
অবন্তিকা তৃপ্তি
একসময় কাব্যও সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুম লাগালো। কুহুও কখন যেন সরতে সরতে কাব্যের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল! অবচেতন মনে কখন যে কাব্য তার হাতটা,সিট থেকে পরে যাবে সেজন্যে কুহুকে একপাশে করে ধরে রেখেছে — সেটা ও নিজেও জানলো না। কুহুর হাতটা কাব্যর ওই হাতটা ছুয়ে রেখেছে নিজের হাতে! দুজন ছেলে-মেয়ে নিজের অজান্তেই কখন যে এতটা কাছাকাছি এসেছে একে অপরের; সেটা ওরা টের পেল না একবিন্দুও!
খাগড়াছড়িতে পৌঁছবেই কাব্যদের বাস! স্নিগ্ধ কায়ার হাত চেপে ধরে নিজের কোলের উপর রেখে কথা বলছিল কায়ার সঙ্গে। কায়ার মাথাটা স্নিগ্ধের ঘাড়ে ঠেকিয়ে রাখা; ও আরাম করে শুনছে প্রেমিকের একেকটা মুখনিসৃত বাণী! বাসের কন্ডাক্টর যখন বলল বাস খাগড়াছড়ি স্টেশনে পৌঁছবে দু মিনিটের মধ্যেই; কায়া ভরকে গেল এইবার। ও স্নিগ্ধের কাঁধ থেকে মাথাটা তুলে দ্রুত স্নিগ্ধর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। স্নিগ্ধ বোধহয় এতে ভীষণ বিরক্তও হলো। ও ভ্রু কুচকে তাকিয়ে; হতাশ গলায় বলল;———-‘কি হলো তোর আবার?
কায়া ওকে ঠেলতে ঠেলতে অস্থির কণ্ঠে বললো;———‘উঠুন; বাস পৌঁছে যাবে। ফুপু আমাকে-আপনাকে এই অবস্থায় দেখলে খবর করে দিবেন আমার।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্নিগ্ধ উঠে না তবুও। কায়ার মনের ভয় ওকে এটুকুও কাবু করতে পারেনি; ও ওভাবেই কায়ার সঙ্গে ঠেসে বসে বললো;——-‘তো? আমি কাউকে ভয় পাইনা। যার দেখার দেখুক! যে বিয়ে তিন বছর পর হবার কথা সেটা এক্ষুনি হয়ে যাবে। তিন বছর পর আমাদের একটা সুইট-লিটল বেইবি থাকবে; বেস্ট না?’
স্নিগ্ধের চোখ-মুখ চকচক করে উঠে যেমন। কায়া ওর হাসিহাসি মুখটা দেখে ভ্রু কুচকে; রেগে চোখ পাকিয়ে তাকায়! স্নিগ্ধ ওর চোখ পাকানো দেখে ভ্রু উঁচায়;——-‘কি? ডিল পছন্দ হয়নাই? এর চেয়েও বেটার ডিল আছে আমার কাছে, বলব? তুই শুনতে চাইলে; এন্ড লজ্জা না পেলে বলতেই পারি। তো শোন. . ডিলটা হচ্ছে গিয়ে…’
স্নিগ্ধের চোখে-মুখে ভীষণ দুষ্টুমি খেলা করছে এই মুহূর্তে। কায়া হা করে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলের মুখ দেখে মনে হচ্ছে নির্ঘাত অশ্লীল কিছুই চিন্তা করছে। কায়া নিজেকে সামলে দুহাতে থাপ্পড় বসালো স্নিগ্ধের বাহুতে——-‘ধুর; সবসময় এমন কেন করেন আপনি? অসভ্য একটা লোক! খালি মাথায় এসব ঘুরে; ছি!’
স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে কায়ার হাত ধরে থামাতে থামাতে বলছে—-‘আরে মারিস ক্যান? ভালো কথাই তো বলেছি। মারিস না ভাই; থা..ম!’
স্নিগ্ধ নিজের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে কায়ার মাথা থেকে নিজের ক্যাপ খুলে ওর মাথায় লাগাল। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বাবু বনে গেল ভাইয়ের সিটের দিকে। ওখানে গিয়ে তো ওর নিজের চোখ-ই ছানাবড়া!
কুহু কাব্যের কোলে মাথা রেখে তার একহাত নিজের হাতে মুষ্টি করে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ওর গায়ে কাব্যের জ্যাকেট জড়ানো। কাব্যের একহাত কুহুর চুলে! স্নিগ্ধ কি বলবে; এমন একটা সিনে কি রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারলো না যেমন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে কুহুকে কি বোন হিসেবে দেখে রিয়েকশন দেওয়া উচিত? কিন্তু কুহু তো বড় হয়েছে। ওর আচরণ দেখে কি তেমন ভাবা উচিত? স্নিগ্ধ নিজেকে সতর্ক করলো! তারপর কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ডাকল কাব্যকে;——-‘ভাইয়া? ভাইয়া? উঠো! আমরা পৌঁছে গেছি। ভাইয়া?’
কাব্যের চোখ-দুটো নড়ে উঠল! কুহু ততক্ষণে উঠে গেছে; ওর চোখ-দুটো নড়েচড়ে উঠেছে। কাব্য চোখ কুচকে তাকালো। সবার আগে স্নিগ্ধের দিকে নজর গেল; স্নিগ্ধের চোখ-মুখ দেখে কেমন একটা যেন লাগলো সম্ভবত। কাব্য চমকে নিজের কোলের দিকে তাকাল। কুহু নড়ছে; চোখ ডলছে ঘুমিয়ে। কাব্যর নিজের চোখই এইবার ছানাবড়া হয়ে গেল; ও কিছুটা অবাক গলায় বলল——‘কুহু…’
কুহু কাব্যের গলা শোনে চোখ খুলে তাকাল। কাব্যের হা হওয়া মুখ দেখে নিজের অবস্থান লক্ষ করে যেমন এখন। পরমুহূর্তে নিজেকে কাব্যের কোলে দেখে আতকে উঠে দ্রুত; তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল। ওড়না ঠিক করতে করতে অস্থির গলায়; দ্রুত বলে ফেলে——‘সরি। আমি…কখন! এভাবে …আমি আসলেই বুঝি…’
বাকিটা বলার আগে কাব্য স্নিগ্ধের দিকে তাকালো; স্নিগ্ধ মুখে আঙুল চেপে ধরল তাৎক্ষণিক। বলল——‘আমি চুপ; কিছু দেখেনি আমি। রেডি হয়ে আসো। আমি সামনে যাই।’
বলে স্নিগ্ধ দ্রুত নিজের সিটের দিকে গেল। কাব্য চোখ উল্টে হতাশ চোখে স্নিগ্ধের যাওয়ার দিকে তাকাল। এই ছেলেটা কি ভাবছে কে জানে..যা পাজি! এইবার হাত মিলেছে; সারাক্ষণ টিজ করবে!
কাব্য এবার ভ্রু কুঁচকে এইবার কুহুর দিকে তাকালো। কুহুর চোখ-মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেই না; বেচারি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়েছে। কাব্য ওসব ধারলো না; ভ্রু নাচিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল———‘জ্যাকেটটা…’
কুহু অবাক হয়ে তাকাল; কাব্য এইবার চোখের ইশারায় ওর গায়ের জ্যাকেটের দিকে ইশারা করে দিল। কুহু লজ্জা পেল; দ্রুত জ্যাকেট খুলে কাব্যের দিকে এগিয়ে দিল। কাব্য সেটা গায়ে জড়াতে জড়াতে এতসবে না গিয়ে সোজা বলল——-‘ব্যাগ বের কর; পৌঁছে গেছি আমরা।’
কাব্য কথাটা বলে সিট থেকে উঠে ব্যাগ কাঁধে ঝুলাল। কুহু হা করে কাব্যের দিকে চেয়ে পরপর মৃদু হেসে মুখটা অন্যপাশে সরিয়ে ফেলল।
সাজেকে আজ ভীষন বৃষ্টি। টুপুর-টাপুর বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা যখন ভ্যালির টিন বইয়ে ঝুমঝুমিয়ে পরছিলো; দারুণ নান্দনিক শব্দ বুনছিল। কুহু বারান্দায় চুপচাপ দাড়িয়ে আছে এই মুহূর্তে। মনটা ওর বড্ড খারাপ; ভারি! তার কারণ হচ্ছেন বড় চাচ্চু!
সিদ্দিক পরিবারের আন্ডা-বাচ্চাদের অল্পতেই সর্দি-জ্বর শুরু হয়ে যায়। ছোট থেকেই এরা আদরে-আরামে বড় হওয়া সিদ্দিক ভাইদের একেকটা ছাও-ছানা! তাই ভীষণ ছোঁয়াচে এরা। এদের মধ্যে বলা যায়; কাব্য একটু ভালো এদিক থেকে। খুব একটা অসুখ-বিসুখ হয়না ওর। অথবা হলেও কেউ জানে না। ছেলেটা অসুখ-বিসুখ হলেও ঠিক নিজের প্রতিদিনের কাজ স্বাভাবিকভাবেই করে। কেউ ওর চোখ-মুখ দেখে হয়তবা আন্দাজ করতে পারে – কাব্য অসুস্থ হয়েছে। তখন কাব্যকে ধরেবেঁধে শামিমা ঘরে বন্দি করে রেখে দেন। এইজন্যেই হয়তো কাব্য কাউকে নিজের অসুখের কথা শোনায় না।
আজ বড় চাচ্চু পৃথিবীর বিশ্রীতম এক ঘোষণা দিয়েছেন। খাবার টেবিলে গম্ভীর কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বলেছেন- আজ এখন একটা ছেলেমেয়েও যদি বাইরে বেরিয়ে বৃষ্টি মাখে; তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। বৃষ্টি বন্ধ না হওয়া অব্দি বাচ্চারা ঘরে বসে আরাম করো!
বড় চাচ্চু কথাটা বলে টেবিল থেকে উঠে চলে গেলেন। অথচ এই আদেশে সবার মনটাই খারাপ হয়ে গেল! কায়া-কুহু দুজনেই সবে তৈরি হয়ে এসেছে বাইরে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে বলে। তাছাড়া আজ স্নিগ্ধ-কায়ারবাইরে ঘুরতে বেরুবার কথা; একসঙ্গে দুজন রেইনি ডেট করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। স্নিগ্ধের মুখটাই এইবার দেখার মতো হয়ে গেল। বেচারা যতবার একটা ডেটের প্ল্যান করে ততবার ঠিক একটা না একটা ঝামেলা এসে হাজির হয়ে যায়; শালা তার ভাগ্যতেই এত কুফা কে লাগালো?
স্নিগ্ধ নিজের রুমে ঢুকে লক করে বসে রইলো! কায়া কি করবে; চুপ করে জানালার পাশটায় বসে বৃষ্টি দেখছে। কুহুর এসবে খুব একটা মন নেই। ওহ; ওর তো এসবে মন খারাপ করার মতো প্রেমিকই নেই! ও আরাম করে মেঝেতে বসে লাগেজে কি একটা গোছগাছ করছিল
কায়া আগ্রহ নিয়ে একবার উকি দিয়ে দেখতে গেলে; কুহু লুকিয়ে ফেলেছিল সঙ্গেসঙ্গে। কায়ার এমনিতেও মন খারাপ ছিলো: তাই কুহুকে আর বিরক্ত না করে চুপচাপ বসে বৃষ্টি দেখছে।
কায়ার ফোনের মেসেজ টোন হঠাৎ বাজলো; স্মিগ্ধের মেসেজ এসেছে———‘ বের হো; আমি বাইরে।’
কায়া কুহুকে একবার দেখে নিলো; ও তখনো এসব হাবিজাবি কাজে ব্যস্ত।
কায়া রিপ্লাই করলো; ———‘কিভাবে যাব? বড় চাচ্চু তো মানা করেছেন।’
স্নিগ্ধের পাল্টা মেসেজ সঙ্গেসঙ্গেই এলো; ——‘তুই বের হো, বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।’
কায়া মোবাইল রেখে কুহুর দিকে তাকালো। কুহু লাগেজ হাত দিয়ে বন্ধ করে দুহাত ঝেটে উঠে দাঁড়ালো। কায়ার চোখ-মুখ দেখল ও আরাম করে; তারপর দায়সারাভাবে বললো; ——-‘ কি? বেরুবি নাকি?’
কায়া কিছুটা ভরকাল অবশ্য! কুহু কি জানে ওর আর স্মিগ্ধের কথা? জানেই হয়তবা। নাহলে এমন হেঁয়ালি করে কথা বলবেই বা কেন?
কায়া ওড়না ঠিকঠাক করে মাথায় ভালো করে তুলে নিলো। কুহুর দিকে চেয়ে কিছুটা দোনামোনা করে বলল———‘ওই; হ্যাঁ একটু বেরুচ্ছি আরকি। চলে আসব; এক্ষুনি। তুমি একটু এদিকটা ম্যানেজ করো প্লিজ!’
কুহুর হাতে একটা লাল ফ্লোরাল গাউন। সেটা আরাম করে বিছানার উপর রাখতে রাখতে বলল;——-‘পারব না।’
‘কেন? অল্প সময়ের তো ব্যাপারই তো! একটু বুঝো; প্লিজ!’ —- কায়া অনুরোধ করলো যেমন।
‘আরে? পুরো কথা তো শুনবি আগে। পারব না কারণ আমিও বেরুচ্ছি। আই হ্যাভ সাম প্ল্যানস!’—-—-কুহু গাউন রেখে এবার জুয়েলারি সিলেক্ট করতে মন দিয়েছে!
কায়া এইবার; মাত্র সন্দেহের চোখে কুহুকে দেখলো! কুহুর হাবভাব ওর ভালো ঠেকছে না একটুও। কুহুপু এত সেজেগুজে বৃষ্টির মধ্যে যাবেটা কোথায়? ওর নাহয় বয়ফ্রেন্ড আছে; তাই বেরুচ্ছে। কুহুপুর তো তেমন কেউই নেই। কাব্য ভাই তো এখন নিজের রু…ওহ মাই গড! কিছু একটা মনে পড়তেই চমকে উঠলো কায়া! ও দৌড়ে এসে কুহুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ঝুমকো হাতে আচমকা কায়ার জড়িয়ে ধরতে সামনে ঝুঁকে গেল কুহু। কায়া কুহুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্থির কণ্ঠে চেচালো;——-‘ও মাই গড, অল দ্য বেস্ট কুহুপু! আমি খুব, খুব খুশি! প্লিজ জয়ী হয়ে ফেরো!’
কুহু অবাক হয়ে কায়ার দিকে তাকাল। কায়া বুঝে গেছে তবে! লাজুক আভা খেলে গেল কুহুর স্নিগ্ধ-মায়াবী মুখটুকুতে! কুহু তবুও হেঁয়ালি করে লাজুক কণ্ঠে বললো;——-‘কীসের জন্যে এত খুশি হয়ে উইশটা করলি?’
কায়া কুহুকে পিঞ্চ মেরে বললো;——-‘ক্রাশ কে প্রপোজ করতে যাচ্ছো! তাও আবার যে-সে ক্রাশ না।একদম বাঘের ন্যায় গর্জন করা ক্রাশ! দেখ আবার ধমক-টমক খেয়ে দমে যেও না। যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াই তোমাদের সিদ্দিক রমণীদের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত!’
কুহু লজ্জা পেয়ে হেসে ফেললো! কায়া এখনো কুহুজে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। কুহু ওর দিকে দিকে আয়নায় তাকিয়ে হঠাৎ নিজেও পিঞ্চ মেরে বললো;——-‘যাবি না বাইরে? এখন দেরি হচ্ছে না?’
কায়ার হঠাৎ মনে পড়লো ওর তো বাইরে যাবার কথা; স্নিগ্ধের সাথে! কায়া জিহ্বা দাঁত দিয়ে কেটে ফোনটা দেখলো। স্নিগ্ধের অলরেডি ১০ টা মিসকল জমেছে। এই ব্যাডা আজ কায়ারে ধরে পেটাবে শিউর! কায়া দৌড়ে জুতো পরে বেরিয়ে যাচ্ছে। কুহু পেছন থেকে চেচালো;
— এনজয়!
কায়া শোনে না; ও তখন প্রেমিকের ভয়ে পগার-পা!
কুহু লাগেজ থেকে ফেইরি লাইট; ফ্লাওয়ার বুকে বের করে একে একে সাজিয়ে রাখলো! হাত কোমরের দুপাশে ঠেসে সেসবের দিকে চেয়ে ভেতর থেকে দলা-পাকিয়ে দীর্ঘশ্বাসগুলো বেরিয়ে এলো! এতক্ষণ ভয় না হলেও এখন হচ্ছে! কুহুর মজার অনুভূতি শোনার পর কাব্য ভাই কি বলবেন; কি করবেন? ধমক দিলে কুহু নীরবে তা সয়ে নিবে; কিন্তু রিজেক্ট করলে কি করবে?
পরপর মনকে বোঝাল; রিজেক্ট করতেই পারেন..কুহুর কাজ ওর মনের কথা জানানোর! বাকিটা কাব্য ভাই কি করবেন সেটা তার ব্যাপার! কুহু তাকে ফোর্স করবে না অবশ্যই! তবে সময় দিবে! বিয়ে করা অব্দি অপেক্ষা করবে কুহু। কাব্য ভাই রাজি না হয়ে যাবেন কোথায়? তার সাত জন্মে কি এতটা ভালো কেউ তাকে বাসতে পারবে কোনদিন; যেমন করে কুহু ভালবেসেছে!
কুহু রেড গাউন পতে বাথরুম থেকে বের হয়েছে! এতক্ষণ গাউনটা দুহাতে তুলে রেখেছিলো বাথরুম থেকে বের হতেই সেটা নামালো!
আয়নার সামনে দাড়িয়ে সাজতে বসলো! ঠোঁটে দিয়েছে রেড লিপস্টিক; চুল সামনের দিকে কার্ল করে ছেড়ে দিয়েছে; পেছনে খোলা রেখেছে চুল। আইলাইনার দিয়েছে চিকন করে; সাথে হালকা হাতের কাজল লাগিয়েছে। সেজেগুজে আয়নায় একবার দেখে নিল ও নিজেকে। ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল কুহুজে আজ! লেখকের মতে; আজ যদি শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য না পটে কুহুর এই রূপে; তাকে বিতারিত করা উচিত এই তামাম পৃথিবী হতে।
রেডি-টেডি হয়ে কুহু ভীষণ নার্ভাস অনুভব করছিল হঠাৎ করেই। ঘাম হতে শুরু করলো এইবার। কান্নাও পাচ্ছে হঠাৎ করে। কাব্যকে প্রপোজ করা যতটা সহজ মনে হচ্ছিল আপাত-দৃষ্টিতে; এটা তেমন সহজও নয়। কুহু এখনই রুমের ভেতরেই এই হাল; কাব্যের সামনে গেলে কুহু অজ্ঞান না হয়ে যায় কিছু মুখ ফুটে বলার আগেই! খোদা রহম করো!
নার্ভাসনেস ও ভয় কাটাতে কুহু ভিডিও কল দিল শার্লিনকে। শার্লিন ঘুমে ছিলো! কুহুর কল অনবরত কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে বাজতেই আছে। আধ ঘুমে উন্মাদ অবস্থাতে শার্লিন সেভাবেই কলটা রিসিভ করল! কল ধরামাত্রই সামনে-পেছনে কিছু না বলে কুহু কাপা-কাপা কণ্ঠে বলে বসলো;
—আ..আমি কাব্য ভাইকে প..প্রপোজ করছি আজ।
শার্লিন ভ্রু কুচকে ফেললো! চমকে উঠে আধ ঘুম থেকে উঠে বসে শার্লিন চেঁচিয়ে উঠল——‘ হোয়াট? ঘুম থেকে উঠিয়ে ফাজলামো করছিস?
কুহুর চোখের পাপড়ি বারবার নড়ছিল! দমটুকু বন্ধ করে এক শ্বাসে কুহু বলে উঠল;———‘ফাজলামো না, এটা সত্যি!’
শার্লিন তবুও বিশ্বাস করছিল না। তাই কুহু ক্যামেরায় ওর নিজেকে আয়নায় দেখাল; ওর প্রপোজের সব প্রিপারেশন দেখালো! শার্লিন অবাক! কুহু ফাজলামো করছে না এটা নিয়ে ভাবতেই ওর মাথা খালি হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ! ও অবাক হলায় বললো————‘সত্যি! বাট কুহু আই থিঙ্ক তোর টাইম নেওয়া উচিত আরো! আর তাছাড়া কাব্য ভাই তোকে কেমন চোখে দেখেন সেটাও তো তুই এখনো জানিস না। আগে সেটা খোঁজ নে!’
কুহু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো! শার্লিন কুহুর দিকে অপলক চেয়ে রইলো! ভীষণ সুন্দর সাজে এই প্রথম যেন শার্লিন কুহুজে দেখলো! কুহুকে এই বিষয়ে ভীষণ এক্সাইটেড দেখাচ্ছিল, আবার ভয়ে নাকের উপর ঘাম জমেছে সেটাও শার্লিন লক্ষ করলো!
কুহু একসময় চুপ না থেকে বলে উঠল——-‘আমি তো শুধু আমার অনুভূতি তাকে বলবো। জবাব আমার এক্ষুনি তো চাইনা। আমি শুধু তাকে জানতে চাই; পুরো পৃথিবীকে একপাশে রেকজে আমি ঠিক কতটা চাই তাকে, ব্যাস এটুকুই! তার জন্যে আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব। আমার কথা থাকবে— সে যেন একটু ভাবে এই প্রপোজ নিয়ে। যেহেতু গার্লফ্রেন্ড নেই তার, আমাকে বউ বানাতে তার সমস্যা কোথায়? আমি তো তাকে সময় দেবই ভাববার জন্যে! তাড়াহুড়ো নেই আমার।’
শার্লিন মাথায় হাত দিয়ে বসলো! কুহুকে এখন যাই বোঝাবে কুহু তার বিপক্ষে হাজার যুক্তি বসাবে। শার্লিন তবুও বোঝালো———-‘ তবুও কুহু। আমার মনে হয় তুই বড্ড তাড়াহুড়ো করছিস। আমার এখুনি এসব সুবিধার লাগছে না। কাব্য ভাই মানবে না।’
কুহু মৃদু হাসলো শুধু উত্তরে। ওই হাসি দেখে শার্লিন চুপ করে থাকে। শার্লিন হয়তোবা বুঝেও গেছে এতক্ষণে- যেই বিষয়টা নিয়ে কনফিডেন্ট আছে এই মুহূর্তে: সেই ভাবনা শুধুমাত্র কুহুর নিজেই নিজেজে সান্ত্বনা দিচ্ছে! কুহু জানে— কাব্য ভাই আদৌ ওকে খুব একটা ইঙ্গিত দেননি। তবুও কুহুর তর সইছে না দেখে শার্লিনকে আজেবাজে বোঝাচ্ছে নিজের দোষ ঢাকার জন্যে। কুহু যেভাবে অস্থির: সেখানে শার্লিন হাজার মানা করলেও ও শুনবে না। বরং দেখা যাবে একসময় শার্লিনকে লুকিয়েই প্রপোজ করবে কাব্যকে; ওর শত মানা করার পরেও।
তাই শার্লিন আর বোঝাল না কিছু; মানাও করলো না। নিজের বুদ্ধিতে ধনী থেকে রাস্তার ফকির হওয়াও ঢের ভালো। শার্লিন একদৃষ্টিতে কুহুর মায়াবি মুখটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর আবেগপূর্ণ গলায় শোধালো স্রেফ কটা কথা——-‘কুহু; বেস্ট অফ লাক! বিজয়ী হয়ে ফির দোস্ত! আর আমাকে আপডেট জানাস।যাই হোক না কেন; আমি তোর সাথে আছি। তোর সকল অ্যাপস- এন্ড ডাউনস; সবসময়েই!’
কুহু এবার হালকা হাসলো! মাথাটা নামিয়ে দোয়া নেওয়ার ভঙ্গিমা করে বলল———‘যথা আজ্ঞা মেরি জান!’
শার্লিন হেসে ফেলল। মনেমনে বারবার দোয়া করে দিল— কুহু মেয়েটার যেন মনটা এইবার না ভাঙে। এমনটা হলে; এই কোমল-নরম মনের মেয়ের হৃদয়টা মরে যাবে: আর মাথা তুলে তাহলে দাঁড়াতে পারবেই না কোনদিন।
বৃষ্টি কমেছে প্রায় রাতের দিকে। কুহু একটা রেইনকোট পরে পুরোটা বিকেল পাহাড়ের চূড়ায় ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের জন্যে সাজসজ্জা করেছে..সবটাই কাব্যের জন্যে! একটা ছোটখাটো তাবুর ন্যায় ছাউনি; তার মধ্যে ফেইরি লাইট সিয়ে সাজানো! একটা টেবিলে মোমবাতি জ্বলিয়ে রাখা কয়েকটা; টেবিলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া গোলাপের পাপড়ি। টেবিলের দুপাশে দুটো সুন্দর সাদা রঙের চেয়ার। টেবিলের মধ্যে একটা ফ্লাওয়ার বুকে! সেটা দিয়ে কুহু কাব্যকে আজ; এই পাহাড়ের চুড়াতে প্রপোজ করবে।
আজ কুহু কাব্যকে বলেছে; ওরা আন্ডা-বাচ্চা সবাই পাহাড়ের চূড়ায় পার্টি করবে। বাকিরাও আসবে এই পার্টিতে। কাব্য যেন ঠিক ছয়টায় পৌঁছে যায়। কাব্য আসবে বলেছে।
কুহু সব রেডি করে রেইনকোট খুলে ছাউনির নিচে এসে দাঁড়াল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখন! কুহু মৃদু হেসে হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুয়ে দেখে; ওর ঠোঁটে প্রাণখোলা হাসি তখনো লেপটে। কাব্য কল করল এইবার; কুহু দৌড়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে কলটা রিসিভ করল। ওপাশের লোকটা জলদগম্ভীর স্বর বলল;———‘আছিস তোরা?’
কুহু নিজেদের ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের সাজসজ্জার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল——-‘হ্যাঁ। দ্রুত আসবেন; সবাই অপেক্ষা করছে আপনার!
‘হু!’——-কাব্য কলটা কাটল। কুহু ফোনট রেখে আবার বৃষ্টি ছুতে মন দিল।
কাব্য যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছেছে কুহু তখন কোথাও নেই। কাব্য অবাক চোখে ধীর পায়ে এগুতে এগুতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের সাজসজ্জা দেখে যাচ্ছে। ওর চোখ আশেপাশে এইবার কাউকে খুঁজতে লাগলো। কুহু; বাকিরা কেউই নেই। তাহলে এসব কে করেছে? কাব্য ডাকে এইবার——‘ কুহু…স্নিগ্ধ? কায়া! আছিস তোরা?’
কেউই জবাব দিল না। হঠাৎ একটা আতশবাজি ফোটার শব্দ হলো! কাব্য চমকে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে পরপর কয়েকটা আতসবাজি ফোটানো হলো। কাব্য ভ্রু নাচিয়ে; মনেমনে হেসে আশেপাশে কাউকে খুঁজছে যেমন। কে করছে এসব? ওর তো বার্থডে নয় এখন। তাহলে?
হঠাৎ আকাশে আরও একটা আতশবাজি ফোটানো হলো! কাব্য এইবার তাকাল; পরমুহূর্তে অবাক হয় ওখানে লাল নিল আতশবাজি আলো দিয়ে লেখা হয়েছে;
~ KABBO VAI~
কাব্য ভাই..এটা তো একজনেই ওকে ডাকে! কাব্যর ভ্রু কুচকে গেল সঙ্গেসঙ্গে। ও দ্রুত আশেপাশে কাউকে খুঁজে ডাকে—-‘কুহু…’
কেউ জবাব দিল না। পরপর আকাশে আরো একটা আতশবাজি ফুটে। কাব্যের বুক ঢিপঢিপ করছে। ও আবার উপরে তাকাল; এইবার লেখা—-
~ “In the story of my life, you’re the chapter I never want to end’
কাব্য ভ্রু কুচকে ফেলে সঙ্গেসঙ্গেই! ও আশেপাশে কাউকে খুঁজে যাচ্ছে অনবরত; পাগলের ন্যায়! কেউ নেই ওর পাশে! কুহু করেছে এইসব? কুহু? কোথায় ও তাহলে?
কাব্য ডাকে আবার—-‘কুহু? বেরিয়ে আয় সামনে। আমি খুঁজে পেলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।’
কুহু বেরোয় না। পরপর আরেকবার আতসবাজি ফোটার শব্দ হলো! কাব্য আইজার কম্পিত হাতে মাথাটা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। কাব্যকে অবাক করে দিয়ে; হতবম্ভ করে দিয়ে আকাশে এইবার চুড়ান্ত কথাটা লেখা হয়েছে;
~ Will you write the rest of your life with me; kabbo vai— kuhu~
কাব্য অবাক হয়ে স্থির চেয়ে রইলো আকাশের ওই লেখাটার দিকে। পরপর পেছন থেকে একটা মিষ্টি; মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসলো;
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৯
~ আই লাভ ইউ, কাব্য ভাই!’~
কাব্য ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকালো। কুহু মিষ্টি হেসে ওর দিকে ফ্লাওয়ার বুকে বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে। কাব্য অবাক; চুড়ান্ত অবাক হয়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে নিজের জায়গাটায়! কি বলবে এখন ও? কি উত্তর দেওয়া যায় ওর প্রেমে পাগল মেয়েটাকে?