ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৩

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৩
অবন্তিকা তৃপ্তি

সাজেকের আকাশ থেকে মেঘ সরেছে অনেকক্ষণ। অথচ মনের মেঘটুকু, যা সিদ্দিক রমণী সাজেক থেকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সদুর ঢাকা— তা কি মুছেছে বা মুছবে কখনো? কে জানে কার ভাগ্যের লীলা!
কুহু তখন ঔষুধ খেয়ে ঘুমে বেহুশ! অথচ কতটা কষ্টে-দুঃখে মূর্ছা গেলে ঘুমের মধ্যেও কুহুর চোখের কোনটুকু বইয়ে যাচ্ছে অশ্রুর দাগ! কবিতা সেটা আঁচল দিয়ে বারবার মুছে দিতে দিতে নিজেও ফুপাচ্ছেন! কুহুকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে— তার কি হয়েছে? এই সাজেকে কে এই মেয়েটাকে কষ্ট দিল? কে দুঃখের বাণে ক্ষতবিক্ষত করে দিল তার ছোট-আদুরে মেয়েটার মনটুকু?

ওইদিনই; চঞ্চল কুহুর তীব্র জেদটুকু সাদাতকে টেনে নিয়ে গেল বড় ভাইয়ের রুমটায়! সাদাত-আনোয়ার একটা রুমে বসে আছেন। ওদের পাশটায় শাদাফ সোফাতে বসে দুই ভাইয়ের নীরবতা দেখছেন। একপর্যায়ে শাদাফই নীরবতা ভেঙ্গে কথা তুললেন———‘এটা কেমন ছেলেমানুষি মেঝো ভাইজান। হুট করে কাউকে না জানিয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন চলে যাবেন? আমাদের এমন ট্যুর বারবার দেওয়া হয়না। এবার যখন তিনভাই ব্যস্ততা ফেলে আসলাম; আপনি এমন হঠকারিতা করছেন?’
সাদাত শাদাফের দিকে চেয়ে বললেন——‘আমি নিরুপায় শাদ!’
আনোয়ার এবার কথা তুললেন এই কথার বিপরীতে——‘তোদের ছেলেমানুষী দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। একটা দিনের অর্ধেক চলে গেছে, তুমি বলছো এখন চলে যাবে? তাও একা, আমাদের রেখে? এটা কেমন কথা?তোমার কাছে মনে হচ্ছে না, বাচ্চাদের সাথে থেকে তুমিও বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাদাত এই কথার উত্তরে কি বলবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। বড় ভাইয়ের এমন প্রশ্নে এবার তাই না চাইতেও সত্য কথাটাই তুলে ধরলেন, বললেন——-‘কুহু জেদ করছে। ও চলে যাবে; এক মুহূর্ত থাকতে চাইছে না আর। ওর এই অসুস্থতায় ওর জেদটা ফেলে দিতেও পারছি না। মেয়েটা এখানে আসার পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছে; আমি ওকে এভাবে দেখতে পারছি না আর।’

সাদাতের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। তাই আনোয়ারকে হাল ছাড়তেই হলো। ভাই-ভাইজির তীব্র জেদটুকুকে বিনা প্রশ্নে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া আর উপায় খুঁজে পেলেন না। তাই হাল ছেড়েই বললেন——-‘আচ্ছা, তুমি যা ভালো ভেবেছো! আমি কাব্যকে বলে দিচ্ছি; ও তোমাদের সাথে যাক। একা অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।’
সাদাত মেনে নিলেন। কুহু সবার সাথে যেতে সমস্যা; নিশ্চয়ই শুধুমাত্র কাব্য সাথে গেলে তেমন মানা করবে না ভেবে বসলেন। আনোয়ার কল দিলেন কাব্যকে! কাব্য খানিক পর রুমে আসলো! সবেই ও গোসল সেরেছিলো; টাওয়াল খুলে কোনরকমর কাপড় পরে আনোয়ারের রুমে এসে দাঁড়াল——-‘ডেকেছিলেন আব্বু?’
বলতে বলতে আনোয়ারের পাশে সাদাতকে দেখে কাব্য অবাক হলো! সাদাতকে বসা থাকা দেখে ও আর সাতপাচ না ভেবেও জিজ্ঞেস করে বসলো——‘কুহুর জ্ঞান ফিরেছে চাচ্চু?’

সাদাত মাথা নাড়লেন——‘ফিরেছে। কিন্তু কিছুটা অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেন জানি।’
কাব্য চুপ থাকল এ কথার উত্তরে। এই একটা বিষয়; ভালোবাসা—কতটা দুরুত্ব এনে দিয়েছে কুহু-কাব্যের মধ্যে। একজন অপরজনের কথা জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হচ্ছে এখন। যে কুহু কাব্যের আশেপাশে ঘুরঘুর করত; কাব্য যাকে আদর করত; বায়না পূরণ করত অবলীলায়; এই একটা সময় এসে সে জেনে বসলো; কুহুর ওর প্রতি যা ছিলো;সব ভালোবাসার কারণে ছিলো। কাব্য ব্যাপারটা মেনে নিতেই পারছে না এখন অব্দি।
কাব্যকে আনোয়ার গম্ভীর স্বরে বলেন——‘কুহু ঢাকা যেতে চাইছে আজ এক্ষুনি। তুমি ওদের নিয়ে যাও ঢাকায়। এতটা পথ অসুস্থ কুহুকে নিয়ে সাদাত পারবে না যেতে।’

কাব্য ভ্রু কুচকে ফেলল। কুহু ঢাকা যাবে কেন? ওর উপর জেদের জন্যেই? হতাশ শ্বাস ফেলল কাব্য। কুহুর সামনে ওর যাওয়াটা এখন উচিত হবে না ভেবেই কাব্য আনোয়ারকে বললো——-‘আমি স্নিগ্ধকে বলে দিচ্ছি। ও নিয়ে যাক?’
আনোয়ার ছেলের দিকে চেয়ে বললেন——‘স্নিগ্ধ থাক আমাদের সাথে। তুমি এর আগেই সাজেক এসেছো; ঘুরেছো! তোমার আর সাজেক নতুন করে দেখার কিছু নেই। তুমি যাও সাদাতের সাথে। ব্যাগ রেডি করে ফেলো। ওরা একটু পরেই বেরুচ্ছে।’
কাব্য কি করবে আর? ওর মজার দন্ধ তো আনোয়ার জানেন না, তাই এমনটাই বলা স্বাভাবিক। কাব্য সাদাতের দিকে চেয়ে বলল——-‘আমি রেডি হয়ে আসছি। বাসের টিকিট অনলাইনে কেটে নেব।’

কুহুকে একহাতে ধরে রেখেছেন কবিতা। কুহু গায়ে তখনও প্রচন্ড গা কাপিয়ে আসা জ্বর! গায়ে একটা জ্যাকেট জড়িয়েও শীত কমছেই না, তাই তার উপরে শাল জড়িয়ে দিয়েছেন কবিতা। কুহু দূর্বলতায় চোখ বন্ধ হয়ে হেলে পড়তে চাইছে একপাশে বারবার; কবিতা ওকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন বারবার। কুহু দুর্বল হাতে মায়ের শাড়ির আঁচলটুকু খামচে ধরে রেখেছে।

কাব্য রুম ট্যাকে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। কুহু দাড়িয়ে ছিলো; সেইসময় কাব্য নিজের লাগেজ নিয়ে ওদের সামনে এলো। কুহু অযথাই সবার আগে চোখটা কেন যেন চলে জেল প কাব্যের পায়ের দিকে; এডিডাসের এই জুতোটা কুহুর ভীষণ চেনা। জুতোর মালিককে চিনতে পেরেই দুর্বল ভঙ্গিতে চোখটা তুলে তাকাল কুহু।
কাব্য একহাতে লাগেজ ওর পায়ের কাছে রেখে; মোবাইলে টিকিট বুক করছে। কুহুর ওর দিকেই অপলক চোখে কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে রইল। তীব্র জ্বরটুকু ওকে নিমিষেই ভুলিয়ে দিল— আজ কি কি ঘটে গেছে ওর ছোট জীবনটায়। ভুলে গেল নিজের হৃদয় ভাঙার কথাটুকুও কি অবলীলায়!
ও চেয়েই রইল; ভালোবেসে; যত্নে; আদুরে ভঙ্গিতে!

হঠাৎ কাব্য ফোন থেকে চোখ তুলে কুহুর চোখে চোখ কেমন করে যেন পরে গেল! কাব্য কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখে কুহু এতক্ষণ ওকেই দেখছিল। কাব্য সেটা বুঝতে পেরে আলগোছে; ওভাবেই কুহুর চোখ থেকে নিজের চোখটা নামিয়ে নিলো।একটু অপ্রস্তুত হয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে ফেলল!
এতক্ষণে; এতসময় পর কুহুর মাথায় আচমকা খেলে গেল সমস্ত ঘটনা একের পর এক! কুহুর চোখে সিনেমার স্ক্রিনের ন্যায় ভেসে উঠলো আজকের সকালের পুরোটা দৃশ্য! কুহু দেখতেই থাকলো; দেখতে দেখতে ওর জেদ তরতর করে বাড়তে থাকে! বাড়তে বাড়তে একসময় যখন আকাশচুম্বি হয়ে আসে; কুহু দুর্বল গলায় চিৎকার করে ডাকে——‘আ..আব্বু! আব্বু!’

সাদাত রিসিপশনে দাড়িয়ে সব ফরমালিটিজ পূরণ করছিলেন। কুহুর চিৎকারে কাব্য নিজেও হতবম্ব!
‘কি হয়েছে? সিক লাগ…’’——- কাব্য আগ বাড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে চাইলে হঠাৎ ওর পা আটকে গেল;কারণ কুহু অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে! সাদাতও আসছেন এদিকেই। কাব্য চুপচাপ আলগোছে নিজেকে পিছিয়ে নিলো দু কদম।
সাদাত তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে মেয়ের গরম শরীরটা নিজের বাহুতে আগলে নিলেন; উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন—-‘কি আম্মু? শরীর বেশি খারাপ লাগছে?’

কুহু অসুস্থ অবস্থাতেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল———‘আ..আমি একা ঢাকা যাব বলেছিলাম।’
সাদাত কুহুর কথা শোনে কাব্যের দিকে তাকালেন। কাব্য দুই বাপ-মেয়ের মাঝখানে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে; ও শুধু শোনে যাচ্ছে; দেখে যাচ্ছে ছোট কুহুর বিশাল এবং তীব্র জেদের কথা! সাদাত কাব্যের থেকে চোখ সরিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে বললেন——-‘কাব্য তো আমাদের পৌঁছে দিতে যাবে। বড় ভাইজান ওকে বলেছেন আমাদের সাথে যেতে। ও যাক আমাদের সাথে?’

কুহু কাব্যর দিকে ঘুরেও তাকালো না। কিন্তু কাব্য ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো! কুহু হাপাচ্ছে বারবার; ও সেভাবেই শুধুমাত্র সাদাতের দিকে চোখে চোখ রেখে বলল——‘উ…উনাকে চলে যেতে বলো আব্বু; প্লিজ!’
কবিতা হা করে কাব্যের দিকে একহার তো আরেকবার কুহুর দিকে তাকাচ্ছেন। উনার মনে কিছু একটা খটকা লাগছে। যতদূর মনে পরে— কুহু তার কাব্য ভাইয়ের জন্যে পাগল ছিলো। কাব্যকে ভীষণ মানতো ও! কাব্যের ধমকের ভয় পেত ভীষণ! আর এখন…কাব্যের সামনেই এসব শোনাচ্ছে ওকে? কবিতা কাব্যের দিকে তাকালেন; কাব্য ভীষণ স্বাভাবিকভাবে কুহুর এসব আচরণ দেখে যাচ্ছে— যেন ওর এসবে কিছুই হচ্ছে না; বরং দেখা যাচ্ছে কাব্য ভীষণ অভ্যস্ত এসবে। কবিতা দেখেই যাচ্ছে দু পক্ষের অদ্ভুত আচরণ!
সাদাত মেয়ের মাথায় হাত বুলান,বুঝিয়ে আবার কিছু বলতে যাবেন; তার আগে কুহু এবার কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে কাতর গলায় বলে বসলো———‘প…প্লিজ আব্বু।’

ব্যাস! মেয়ের কান্নায় সাদাত হার মানলেন! অসহায় চোখে কাব্যের দিকে তাকালেন উনি! কাব্য এতক্ষণ ভ্রু কুচকে কুহুকে দেখে যাচ্ছিল। চঞ্চল; আদুরে কুহুর জীবনে প্রথম করা; ওর বিপক্ষে মারাত্মক জেদ ও নির্বিকার দেখে যাচ্ছিল একফোঁটা অভিযোগ না করেই। কাব্য সাদাতকে ওর দিকে তাকাতে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই বলল——‘আমি চলে যাচ্ছি। বাসের টিকিটটা ওয়াটস্যাপে সেন্ড করে দিচ্ছি।’
সাদাত কি বলবেন? শুধু চুপ করে থাকলেন। কাব্য ওদের বাসের টিকিটটা সেন্ড করে দিল। সাদাত কুহুকে ছেড়ে কাব্যকে নিয়ে দু কদম এগিয়ে গেলেন। তারপর কাব্যের কাঁধে হাত রেখে অপরাধবোধ নিয়ে বললেন——‘কাব্য…মেয়েটার পক্ষ থেকে আমি সরি বলছি। তুমি কিছু মনে নিও না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব ঢাকা গিয়ে, ওর সমস্যা জেনে একটা সমাধান বের করব আমরা। টেনশন নিও না; হ্যাঁ?’

কাব্য শুধু শুনলো! তারপর সাদাতের দিকে চেয়েজবাবে বলল—‘আমি কিছু মনে করিনি, চাচ্চু।’
তারপর কাব্য লাগেজ হাতে যেভাবে এসেছিল; ওভাবেই চলে যাচ্ছে আবার। কুহুর মাথাটা আবার তুলে তাকাল। টলমলে চোখে কাব্যের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। কান্না উপচে আসছে ওর ভেতরটা থেকে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এইমুহূর্তে। কাব্য ভাইকে ওভাবে কুহু অপমান করতে চায়নি…কিন্তু কুহু নিরুপায়।
নিরুপায় নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কাছে। কাব্য ভাই সাথে গেলে কুহু যা চাইছে, সেটা কিছুতেই হতে দিবেন না। কিন্তু কুহু তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে…ও সেটা করেই ছাড়বে! বোকা কুহু জ্বরের ঘোরে কি ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে..সেটা ও নিজেও হয়তো তখন বুঝে উঠতে পারেনি। জ্বর কুহুকে এতটাই কাবু করে ফেলেছে; আশেপাশের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেতে শুরু করেছিল তখন কুহুর। আর সেটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল ওই ছোট;আবেগী, কাব্য ভাইয়ের ভাষায় টিনেজ মেয়েটার!

কুহু ঢাকায় ফিরেছে একদিন হয়েছে। কবিতা আজ মেয়ের রুমে শুয়েছেন। কবিতা মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও যখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলেন, কুহু তখন চুপচাপ শব্দ না করে মায়ের পাশটা থেকে উঠে দাঁড়াল!
তারপর কুহু নিজের রুমে প্রতিটা কোনা থেকে কাব্য ভাইয়ের থেকে চুরি করে আনা প্রত্যেকটা জিনিস বের করে একটা লাগেজে বন্দি করলো। কাব্য ভাইয়ের চুরি করে আনা জ্যাকেট; শার্ট; টিশার্ট; খালি পারফিউমের বোতল সব লাগেজে ঢুকিয়ে সেটা তালা মেরে টেনে এনেছে ওই দুর্বল শরীরেই স্টোররুমটায়! এটা সেই রুমে; যেখানে কেউ কখনো দরকার ছাড়া যাওয়া-আসা করে না।
কুহু লাগেজটা ছুড়ে ফেলল স্টোররুমের একপাশে! তারপর ধীরে-সুস্থে সেটার পাশে অনেকক্ষণ কেন যেন বসে রইল! তারপর কি মনে করে; লক করে ফেলা তালাটাও খুললো ধীর হাতে! লাগেজ থেকে একটা জ্যাকেট কি মনে করে নিজের হাতেও নিলো!

এটা সেই জ্যাকেট; যা দেখে কুহু সর্বপ্রথম কাব্য ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিল! একটা জ্যাকেট; একটা ডেনিম জ্যাকেট! কুহেলিকা সিদ্দিক কুহুর ভীষণ শখের জ্যাকেট!
কুহুর চোখ বেয়ে তখন আপনা-আপনি অশ্রু গড়িয়ে পড়লো! কুহু নাক টেনে জ্যাকেটটা নিজের গায়ে জড়াল উন্মাদের মতো। চোখ বেয়ে তখন ঝরছে অবিরাম অশ্রু! তারপর কুহুর হৃদয়ের অনুভূতি তুঙ্গে তুলে দিতে নাকে এসে বাড়ি খেলো কাব্য ভাইয়ের গায়ের মারাত্মক সুঘ্রাণ! কুহু জোরে একটা স্বাদ ফেলে জ্যাকেটটাতে একটা শেষবারের ন্যায় চুমু খেলো।

নাক টেনেটেনে ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে বলে গেল———-‘আমি আ..আপনাকে এতটা ভালোবেসে নিজেকে কিভাবে হারিয়ে ফেললাম? এই দুনিয়ার সবার ভালোনাস আমার কাছে এখন কেমন মিথ্যা মনে হচ্ছে। সবাই স্বার্থপর; সবাই! আপনি তো আরও বড় স্বার্থপর কাব্য ভাই।আপনি তো আমাকে ছেড়ে দিলেন পাষাণের মতো, কিন্তু আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে পারব না কাব্য ভাই! স…সজ্ঞানে আপনার সঙ্গে অন্য নারীকে দেখার মত ওতো সাহস আমার মধ্যেও নেই। বেচে থেকে মরে যাওয়ার চেয়ে…!’
কুহু নাক টানে; চোখের অশ্রু গালে মাখামখি হয়ে করুন অবস্থা। কুহু আবার বলে যায়——-‘আ…আমি চলে গেলে আপনি নিস্তার পাবেন, কা..কাব্য ভাই। তাই আমি কুহেলিকা সিদ্দিক কুহু আপনকে নিস্তার দিলাম! যান…আজ থেকে আপনি মুক্ত!’

কুহু কথাটা বলে হাউমাউ করে কেদে জ্যাকেটটা টেনে হিচড়ে খুলে ফেলল নিজের শরীর থেকে।শরীরটা আবারও হেলে পড়তে চাইলে দ্রুত একটা টেবিল ধরে নিজেকে সামলালো কুহু! জ্বরটা বোধহয় আবার বেরেছে! কেমন যেন চোখ বুজে আসতে চাইছে বারবার।
কুহু ঢোক গিলে! কোনরকমে জ্যাকেটটা আবার লাগেজে ভরে তালা লাগাল!
তারপর নিজের গা-টা কোনরকম টেনে-হিচড়ে নিয়ে আসলো স্টোররুম থেকে। নিজের রুমে এসে দেখে কবিতা এখনো ঘুমিয়ে আছেন। কুহু মৃদু হাসল! জ্বরের মধ্যে রক্তিম মুখে ওই হাসি ভীষণ ভয়ঙ্কর দেখাল। মায়াবি কুহুর চোখ-মুখ একদিনেই দেবে গেছে কুঠরিতে!

কুহু পা টেনে টেনে বিছানার পাশে মায়ের মাথার কাছটায় বসল। কবিতা কি ভীষন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। কি মিষ্টি দেখাচ্ছে মায়ের মুখটা! কুহু ভীষণ আদরে মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে ভাঙা গলায় বলল——-‘আ..আমি সরি আম্মু। আ..আমাকে তোমরা কোনদিন মা..মাফ করো না। মনে রেখো, আমি তোমাদের মনের মধ্যে সবসময় বেচে থাকব; বাস্তবে নাইবা থাকলাম—তাতে কি?’
কুহু এবারেও হাসল; কান্নার মধ্যে ওই হাসি কেমন একটা দেখালো যেন! কুহু নাক টেনে হেসে আবার বলার চেষ্টা করে——-‘এই বেচে আছি বলে কি তোমাদের মনে হয়? আমার হৃদয় তো সেই কখন মরে গেছে; বাকি যা আছে সেটুকু শুধুই একটা দেহ! ওটা না বেচে থাকলেও চলবে। চলবে না আম্মু? প্লিজ আমার জন্যে কেদো না। তোমরা ভালো থেকো! জানো আমার এখন কি মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি? এই যে আমি-বিহীন তোমরা সবাই আনন্দে থাকবে; একসাথে শপিং করবে; গানের কলি খেলবে; সাজেক থেকে শুরু করে অনেক ট্যুর দিবে—-কিন্তু আফসোস আমি ওসব দেখব না; দেখার জন্যে রইবোই না আর!’

কুহু আবার হাসলো! মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ ওর চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু কবিতার কপালে পড়তেই কবিতা ঘুমের মধ্যেই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। কুহু সঙ্গেসঙ্গে সাবধান হয়ে নিজের চোখের জল মুছে নিলো। বিছানা থেকে উঠে আলগোছে লাইটটা বন্ধ করে উঠে দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল নিজের রুম থেকে।
বাবা ওই রুমে ঘুমাচ্ছেন। কুহু এবার তার রুমেও গেল। বিছানার পাশেই একটা আধ খুলে রাখা পত্রিকা! এটা পড়তে পড়তেই ঘুমিয়েছেন সম্ভবত। কুহু জোরে একটা শ্বাস ফেললো; স্বাসকষ্ট হচ্ছে ওর ভীষণ! কুহু সাদাতের চোখ থেকে চশমা খুলে একপাশে সাবধানে রাখল। বাবা আলোতে ঘুমাচ্ছেন দেখে টেবিল লাইটটা বন্ধ করে দেওয়ার সময় হঠাৎ পত্রিকার দিকে নজর গেল। পত্রিকায় একটা পৃষ্টায় বড়বড় অক্ষরে লেখা——-

~ প্রেমিকের কাছে ধোঁকা খেয়ে প্রেমিকার আত্মহ ত্যা! ~~
কুহু স্থির চেয়ে রইল ওই হেডলাইনের দিকে। পরপর কেমন করে যেন হাসল! সাদাতের দিকে চেয়ে মাথায় হালকা কাত করে বিড়বিড় করল——-‘কাল থেকে তোমার মেয়েও ওই হেডলাইনে থাকবে। ঘুমাও আব্বু তুমি; ঘুমাও। তোমরা জেগে থাকলে আমি চলে যেতে পারব না; তোমরা আমাকে যেতে দিবে না।’
কুহু ঝুঁকে এসে সাদাতের কপালে একটা চুমু খেলো। সাদাত ঘুমে; তাই সেই চুমু অনুভব করলেন না। ভালোই হলো সেটা কুহুর জন্যে!

জ্বর এখন কত হবে? রাতে মেপেছিল, ১০৫৽ ছিলো! এখন কত হয়েছে? জানে না কুহু! ও নিজের দুর্বল শরীরটা কোনরকমে টেনে টেনে নিয়ে আসলো তৃতীয় একটা রুমে! রুমটাতে দরজা লক করার সময় পরে যেতে নিচ্ছিল; সাথেসাথে একটা টেবিল আকড়ে ধরলো কুহু! সেবার আর দরজা লক করতে পারলো না।
ও টেবিলটা ধরে রেখে পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুললক। এই ঘরটায় কালকে মাতম হবে; কুহুর মৃত্যুর মাতম! কিন্তু কুহু ওসব দেখার জন্যে থাকবে না। আগামীকাল কাব্য ভাইও নিশ্চয়ই কুহুর অনুভুতির দাম দিবেন। তখন তারও মনে হবে— যে মেয়ে ভালোবাসা না পেয়ে ম রে যেতে পারে; তার ভালোবাসা কখনো অল্প বয়সের ইনফ্যাচুয়েশন কিংবা মিথ্যা অবসেশন হতেই পারে না। কাব্য ভাই আগামীকাল বিশ্বাস করবেন—- তার ছোট-টিনেজ কুহু যাকে তিনি বোনের নজরে দেখেন; সে তার কাব্য ভাইকে অসম্ভব ভালোবেসে ম রে গেছে..!

কাব্য ভাই সেদিনও কি ঊর্মি আপুকে কল দিয়ে বলবেন—- শোনো, আপদটা গ্যাছে!
হয়তবা বলবেন। ঊর্মি আপুও ভীষন খুশি হবেন নিশ্চয়ই! তার প্রেমিক কাব্য ভাইয়ের উপর কোনো শকুনির নজর যে আর নেই; যে শকুনি কাব্য ভাই নিজের ঘরেই পেলে-পুষে বড় করেছেন।
কুহুর গা কাপছে প্রচন্ড! ও হাঁটুভেঙ্গে মেঝেতে বসে পরে আচমকা! তার ভীষন কষ্ট হচ্ছে: বুকটা কেউ যেন কামড়ে ধরে আছে। তীব্র জ্বরে মস্তিষ্কও এখন ঠিকঠাক চলছে না। কুহু আঙুলের মধ্যে বুকের বা-পাশ খামচে ধরে—- এই বেয়াদব হৃদয়…এটা আজ এত যন্ত্রণা কেন দিচ্ছে? ওর নিজের হৃদয়; ওর শরীরে বাস করেও একটা অন্য মানুষের জন্যে কষ্ট পাচ্ছে?নিমকহারাম হৃদয়!

কুহু বুকটা খামচে ধরে চোখ উল্টে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকায়! আজ কেন যেন সবদিকে কাব্য ভাইক দেখা যাচ্ছে। ওই কাব্য ভাই তাচ্ছিল্য নিয়ে যেন বলছেন — ‘ম রে যা কুহু; তুই
ম রলেই আমার শান্তি; আমার মুক্তি!’
কুহু হাত বাড়িয়ে তাকে ছুতে গেলে সে হারিয়ে যায়। ও বাম পাশে তাকালো; ওই পাশের কাব্য ভাই এবার ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলেছেন—-‘তুই এত দেরি করছিস কেন? ম রছিস না কেন?মুক্তি দিবি না আমায়?’
কুহু হাত বাড়িয়ে তাকেও ছুতে যায়; সেও হারিয়ে গেল হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো! কুহু এবার উপরের দিকে পাগলের বেশে তাকাল; সিলিংয়েও কাব্য ভাই। তিনি এইবার রাগ নিয়েই বলে যাচ্ছেন——-‘ছু ড়িটা ধারালো তো; এতে ম রবি তো? হান্ড্রেড পারসেন্ট? ‘

কুহুর প্রচণ্ড পাগল-পাগল লাগছে। ও চিৎকার করতে চাইছে; কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ আসছে না! কুহু ছু ড়ি হাতের বারবার এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে। চারদিকে; পুরোটা রুমে দাড়িয়ে আছেন শ-খানেক কাব্য ভাই।তাদের সবাই কুহুকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছেন; ——-‘বোনের মতো হয়ে আমাকে ভালোবাসিস? ছি! কুহু, তুই ম-রে যা! তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। চাচাতো ভাইকে ভালোবাসার বিনিময়ে ম রে যাওয়া ঢের কলঙ্কহীন!’
কুহু পাগলের মতো এদিক ওদিক চেয়ে বলতে শুরু করে—-‘এইতো; এইতো! রগ কা টছি আমি।কাব্য ভাই…রগটা কা টছি আমি। আমাকে এত তাড়াহুড়ো দিবেন না। আমার পাগল পাগল লাগছে। চুপ করুন আপনি; প্লিজ চুপ চুপ চুপপপপ…!’

কুহু চিৎকার করে উঠে, ওর ছু ড়ি ধরা হাতটা কাঁপছে বারবার, ভয়ঙ্করভাবে! ওদিকে শ-খানেক কাব্য ভাই কুহুর কষ্ট দেখে হাসছেন শব্দ করে। আর বলে যাচ্ছেন——-‘ছু ড়িটা হাতে লাগা কুহু; র-গটা কাট; কাট কাট কাট।’
কুহু কি করবে ভেবে পেলনা। ওর পাগলের মতো অবস্থা! মারাত্মক জ্বর, মানসিক অসুস্থতা; প্রেমের বিরহ; হাঁপানি সব মিলিয়ে অতিষ্ট হয়ে কুহু জোরে একটা চিৎকার দিল আচমকা —‘কাব্য ভাইইইইইই!’

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১২

বলেই ঘ্যাচাং করে বা-হাতের র গে ধারালো ছু ড়িটা বসিয়ে দিল কুহু। তারপরেই টগবগে র ক্ত ফিনকি মেরে বেরুতে লাগলো হাতের থেকে। কুহু নিস্তেজ হয়ে র ক্তের ধারা দেখল। শখানেকম কাব্য ভাই ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। উনাদের হাসি আর নেই; তাড়াহুড়োও আর নেই। কুহু নিস্তেজ হয়ে একসময় লুটিয়ে পড়লো মাটিতে; সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখে একটা কাব্য ভাই! কুহুর দিকে চেয়ে আছেন নিশ্চুপ! কুহু শেষবারের মতো তাকে দুর্বল গলায় শোনাল ——-‘আ..আ…আমি আ…আপনাকে মু..মূক..মুক্ত করে দিলাম কাব্য ভাই। আজ থেকে মুক্ত আ—-‘‘
বাকিটা বলা আর হয়ে উঠে না!

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৪