ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৬
অবন্তিকা তৃপ্তি
তখন দুপুর হয়েছে সবে; সূর্য মাথার ঠিক উপরটায়! রান্নবান্না শেষ হয়েছে বাড়ির গিন্নিদের একটু আগেই। ওদিকে কুহুর এখন অব্দি কোনো খবর নেই দেখে— সকাল থেকে কবিতা এসে কয়েকবার কুহুর রুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেছেন। ডাকছেন বারবার ওকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্যে। অথচ যাকে ক্রমাগত ডাকছেন তার আদৌ কোনো খবর নেই।একটাপর্যায়ে কবিতা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন।যে মেয়ে একবার আ ত্মহ ত্যা করেছে, তার মায়ের আত্মায় আদৌ কি কখনো শান্তি থাকে?
কবিতা এবারেও ভেবেছেন— মেয়ে কি আবার কোনো উল্টাপালটা কিছু করে বসে আছে? কথাটা মাথায় যখুনি আসলো, কবিতা দৌড়াতে দৌড়াতে আলমারি থেকে কুহুর রুমের ডুপ্লিকেট চাবি এনে দরজা খুললেন রুমের। অথচ মায়ের এই চিন্তা বেহুদা প্রমাণ করলো কুহু নামক জেদি মেয়েটা।
বিছানার উপর কুহুকে আরাম করে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে এতক্ষণে আত্মায় স্বস্তি পেলেন কবিতা। ছোট একটা শ্বাস ফেলে মৃদু হেসে এগুলেন মেয়েটার বিছানার দিকে।
কুহুর পাশে বসে মেয়েটার মায়াবী; চোখের নিচে কালি বসে যাওয়া মুখটার দিকে অপলক চেয়ে রইলেন! পরপর আলগোছে কম্বলটা তুলে দিতে যাবেন ওর গায়ে, হঠাৎ কবিতার চোখ গেল ওর চুলটার দিকে। কুহুর কাধ অব্দি আব্রো-থ্যাব্রো কাটা চুল দেখে পরমুহূর্তেই একপ্রকার ধাক্কা খেলেন উনি। মাথা ঘুরিয়ে ঝটপট পেছনে তাকিয়ে এবার দেখলেন ফ্লোরে চুল কেটে ফেলে রাখা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এইমুহূর্তে কবিতার ভীষণ রাগ হচ্ছে কুহুর উপরে। জীবনের এই প্রথম আদুরে মেয়েটাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে ধরাম করে গালটায় থা প্পড় দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু নিজেকে আটকালেন কবিতা। কুহু ডিপ্রেশনে আছে..ডাক্তার ওর প্রতি এক্সট্রা কেয়ার নিতে বলেছেন। সঙ্গে বলেছেন— কুহুর মনের খবর নিতে। কবিতা তো কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন কুহুকে—কিন্ত কুহু জবাব দেয়নি। তাই আজ বিকেলে কুহুর বান্ধবী শার্লিনকে ডেকে আনবেন বলে ঠিক করেছেন কবিতা। মা-কে যেসব কথা বলা যায়না ,সেসব কথা বন্ধুকে নিশ্চয়ই বলা যাবে।
কবিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হাত বাড়িয়ে কুহুর কেটে ফেলা চুলটায় হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে দেখতে;একসময় মাথায় হাত রাখলেন। কুহু ঘুমের ঘোরে কিছুটা নড়লো তাতে। কবিতা ছোট শ্বাস ফেলে বলে গেলেন——-‘তোমার কষ্টটুকু যদি একবার জানতে পারতাম মা! মা-কে একটাবার ভরসা করে বলা গেল না কথাগুলো? মা- তো তোমারই, এই যে ছটফট করছি আমি; কবে বুঝবে তুমি এসব? বুঝবে একদিন, নিজে যখন মা হবে তখন বুঝবে! বুঝবে যখন মায়েদের সন্তানরা এত কষ্টে থাকে চোখের সামনে, তখন মায়েদের অনুভূতিটা কেমন থাকে?’
কবিতা আলগোছে নিজের চোখের জল মুছে নিলেন কথা বলার ফাঁকে! চুপচাপ এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিয়ে কুহুর দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে এলেন ও-ঘর থেকে।
কাব্য মেসেজটা পাঠিয়ে মোবাইল হাতে ক্যান্টিনের চেয়ারে অনেকক্ষণ বসে থাকলো ওভাবেই। সামনে একটা প্লেটে খিচুড়ি-মাংস দিয়ে গেছে ক্যান্টিনবয়। সেটা খেয়ালটা অব্দি করেনি কাব্য।একসময় ঠান্ডা হয়ে গেল খাবারটা, কাব্য এখনো ফোনের মেসেজ অপশনের দিকে চেয়ে আছে।
সেভাবে কাব্য অনেকক্ষণ ফোনের দিকে চেয়ে ছিলো তখন, অথচ কুহুর পক্ষ থেকে কোনো রিপ্লাই শেষঅব্দি এলোই না। কাব্যের এইবার মেজাজটা ভীষণ খারাপ হলো। ফোনটার স্ক্রিন অফ করে টেবিলে উপর রেখে খাবারের প্লেট টানলো নিজের দিকে। খেতে খেতে ভ্র-ট্রু মারাত্মক কুঁচকে রেখেছে, এখন আবার কি ভাবছে কে জানে?
‘কাব্য…এই কাব্য!’ —— তানিম কখন থেকে কাব্যকে পেছন থেকে ডাকছে।
অথচ কাব্য অন্যমনস্ক থাকায় এতগুলো ডাক শুনতেও পায়নি। ও চুপচাপ ব্যাগ কাঁধে ইউনিভার্সিটির রাস্তা ধরে হাঁটছিল। একসময় তানিম দৌড়াতে দৌড়াতে কাব্যের পাশে এসে দাড়িয়ে; কাব্যের গা ঝাকালো——-‘এই কাব্য!’
কাব্য চমকে উঠল আচমকা গা ঝাকানোতে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে তানিম অবাক হয়ে কাব্যের দিকে চেয়ে আছে। কাব্য ওকে দেখে গলা পরিষ্কার করে নিজেকে সামলে বলল——-‘ওহ; তুই! বল!’
বলে একহাতে ব্যাগ চেপে হাঁটতে লাগলো আবার। তানিমও একসাথে পাশে হাটা শুরু করেছে। তানিম এবার বলা শুরু করল——-‘আমাদের একটা ম্যাচ আছে কালকে। মনে আছে তোর সেটা?’
কাব্য আনমনে একান্তে পায়ের জুতো দিয়ে একটা খালি মিনারেল ওয়াটারের বোতল ফুটবলের মতো লাথি দিয়ে সামনে নিতে নিতে জবাব দিল———-‘হু, আছে।’
তানিম এমন হেঁয়ালি জবাবে এবার বিরক্ত হয়েই বলল——-‘তো মনে থাকলে গতকাল মাঠে প্র্যাক্টিজ করতে কেন এলি না? সবাই কত কল করলাম তোকে; একবার রিসিভ অব্দি করলি না ফোন। এইবার জাতীয় পর্যায়ের ম্যাচ মামা, এখন আর আমাদের ভার্সিটির মধ্যে না খেলা। তুই এভাবে ক্যাপ্টেন হয়ে যদি প্র্যাক্টিজ সেশন মিস করিস; এইবার কিন্তু গো হারা হারবো আমরা। পরে কোচ স্যার ধরে একেকটারে লেকচার দিবে।’
কাব্য হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নিচে সাজিয়ে রাখা সিমেন্টের বেঞ্চে এসে বসে ব্যাগটা বেঞ্চের উপর রাখলো। তানিমও বসলো পাশে। চুপচাপ কাব্যের জবাবের অপেক্ষা করছে সে।
কাব্য মাথাটা তুলে কিছুসময় মাথার উপরে গাছটার দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল। তানিম দেখে— কাব্য ঢোক গিলছে, ওর অ্যাডামস অ্যাপল অস্থির হয়ে উঠছে নামছে — আচ্ছা কাব্য কি কোনো বিষয় নিয়ে টেন্সড?
তানিম আস্তে করে জিজ্ঞেস করল——‘কাব্য? কি হয়েছে রে তোর?ঠিক আছিস তুই?’’
কাব্য মাথাটা ওভাবেই উপরের দিকে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল; একটাসময় নিজেই কেমন যেন একটা ধরা গলায় বলে গেল———-‘বাসায় শান্তি আর নেই তানিম। বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না ইদানিং আমার। বাসায় গেলেও দরজা বন্ধ করে বসে থাকি সবসময়; বেরুতে ইচ্ছে করে না বাইরে।’
তানিম ভ্রু কুচকাল। ডিপার্টমেন্ট টপার; ভদ্র এবং ভার্সিটির সকল সমস্যা যে ম্যাজিকের মতো সমাধান করতে পারে তার জীবনে কি সমস্যা চলছে? যতদূর তানিম জানে— কাব্য পুরাটাই ফ্যামিলি পারসন! ওর জীবনে ওর ফ্যামিলির ইচ্ছা; ওদের ভালো থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই কয়েকবার বাংলাদেশ ফুটবল টিম থেকে অফার লেটার পেয়েও আঙ্কেলের পছন্দ নয় বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল কাব্য।
আজ ওর বাসায় ওর জন্যে কোথাও শান্তি নেই? পুরো ব্যাপারটা মূল থেকে জানার জন্যে আগ্রহ বোধ করতে লাগল এখন হঠাৎ তানিম। সেই আগ্রহ থেকেই জিজ্ঞেস করল———-‘কি হয়েছে খুলে বল তো। দেখি আমি কোনো সল্যুশন দিতে পারি কি না।’
কাব্য জবাবে মাথা না বোধক নাড়িয়ে বলল——‘বলা যাবে না; অকওয়ার্ড ব্যাপার ভীষণ!’
তানিম তবুও জোর করল, বলল——‘কিন্তু এই যে তুই ভেতরে ভেতরে টেনশন করিস, আমাকে বললে নিজেও কিছুটা শান্তি পাবি। বাসার ব্যাপার তো। মনে হয়না আর কারোর সাথে শেয়ার করতে পেরেছিস! আমাকে বল; বললেও মনটা শান্ত হবে মামা।’
কাব্য বলবে না বলবে না করেও; একটাপর্যায়ে তানিমের অসম্ভব জোরাজোরিতে বলতে বাধ্য হলো। কাব্য ঘুরে বসে তানিমের চোখে চোখ রাখলো। যন্ত্রের মতো বললো হঠাৎ——‘কুহু আমার জন্যে সু ইসাইড এটেম্প করেছে; সি লাভস মি!’
‘হোয়াট?’—— আচমকা এই কথা শুনে তানিম রীতিমত হা করে গেল!
কাব্য আবার তানিমের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাল। একঝাঁক ফ্রেশার একসাথে হাটাহাটি করছে। তারমধ্যে রোটা-দুটো কাপল দেখা গেল রাস্তায় দাড়িয়ে বাদাম খাচ্ছে!
কাব্য শেষ দেখতে দেখতে একসময় বলে গেল——-‘কুহু ভালো নেই। ওর জন্যে আমাদের ফ্যামিলির কারোর চোখে ঘুম নেই। মেঝো চাচ্চু সেদিন আব্বুর কাছে এসে প্রায় কেদেই দিয়েছেন।আমি যতদূর জানি— কুহুকে ডিপ্রেশনের মেডিসিন দেওয়া হচ্ছে। কুহু যেমন ছিলো আগে, তেমন নেই আর। চুপচাপ হয়ে গেছে কেমন। এবং এ সবটা হচ্ছে আমার জন্যে— এই ব্যাপারটাই আমি মেনে নিতে পারছি না। ভেতরে ভেয়ারে অনেক গিলটি হচ্ছে আমার, কারোর মুখের দিকে তাকাতে অব্দি পারছি না আমি।’
তানিম কাব্যের দিকে চেয়ে রইল। কাব্যের কণ্ঠ কেমন মরা-মরা লাগছে। এমন ভঙ্গুর কাব্যকে আজ অব্দি কোনদিন দেখেইনি তানিম। ওহ..দেখেছিলি একবার, দু বছর আগে। যখন রিলেশনশিপে একটা বড় স্ট্রাগল যাচ্ছিল কাব্যের। কিন্তু এতটাও খারাপ অবস্থা হয়ে যায়নি তখন কাব্যের। এখন কেন? হয়তো বাড়ির সবচেয়ে আদুরে মেয়েটা আর ভালো নেই দেখেই কি?
তানিম কাব্যের কাঁধে হাত রাখল। কাব্য ওর দিকে তাকাল তখন; অস্থির কণ্ঠে অনর্গল বলে গেল তানিমকে———‘আমার কি দোষ বলতে পারিস তানিম। আমি ওকে আজ একসেপ্ট করলে ও হয়তো ভালো থাকত। কিন্তু আমার যার প্রতি ফিলিংস গ্রো করেনি, তাকে এখন তার ভালোর জন্যে একসেপ্ট করে নিলে— এটা তো ওকে ঠকানো হতো। আমি ওকে নানাভাবে বুঝিয়েছি। ও কেন বুঝেনি ওসব কথা? তারপর সবটা ঘেটে দিল একটা সু ইসাইড! জানিস- বাড়ির সবার ঘুম নেই চোখে: সবাই দিনরাত কুহুর জন্যে চিন্তা করে যাচ্ছে। আমি মাঝখানে ওদের চোখে চোখ মেলাতে পারছি না। ওদেরকে বলতেও পারছি না— কুহুর এই অবস্থা আজ আমার জন্যে। ফা* ম্যান!’
কাব্য নিজেই নিজেকে গালি দিয়ে পায়ের কাছে ফেলে রাখা খালি বোতলটা লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। মেজাজ খারাপ হচ্ছে ধীরে ধীরে ওর! তানিম জিজ্ঞেস করে——‘কুহু বলেনি তোর ব্যাপারে কাউকে?’
‘মেবি না। বললে আমাকে সবাই কিছু একটা জিজ্ঞেস করতো; আমার প্রতি ওদের একটা রিঅ্যাকশন থাকতো। কিন্তু ওসব কিছু হয়নি।’ —— কাব্য মাথাটা নামিয়ে রেখে তেজি গলায় জবাব দিল!
তানিম কাব্যের দিকে এবার অপলক তাকিয়ে রইল। জহুরি চোখে কাব্যকে আগাগোড়া দেখে হঠাৎ বলে ফেলল——‘আচ্ছা কাব্য। তুই সত্যি কুহুকে ভালোবাসিস না তো?’
কাব্য সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু কুচকে ফিরে তাকাল তানিমের দিকে। ভ্রু কুচকে ধমক দিয়ে বললো—-‘আর ইউ ম্যাড? ও আমার বোন হয়। আর চাচ্চু-চাচী এগুলা শুনলে বাসায় যা শান্তি বেচে ছিলো সেটাও চলে যাবে।’
তানিম ভ্রু কুচকালো; কাব্যের ব্যবহার তো ওর চোখে একটুও ভালো ঠেকছে না। কাব্য এমন অদ্ভুত ব্যবহার; অদ্ভুত কথা-বার্তা জেস বলছে— ওসব কি….
তানিম ঠান্ডা মাথায়; শীতল গলায় বলল——‘তো? বোন হলে কি হয়? আপন বোন তো না আর, চাচাতো বোন। যে তোকে ভালোবেসে পাগলামি করছে। তুই এমনিতেও বিয়ে করবি কয়েক বছর পর। ওকে করতে সমস্যা কি? আর তোর চাচ্চুর সমস্যা কি এতে? তুই ভালো ছেলে; যোগ্য ছেলে। আমার মাথায় তো এটাই ঢুকছে না।’
তানিমের বাজে কথাবার্তা কাব্যের মেজাজ যা খারাপ ছিলো, আরও খারাপ করে দিচ্ছে। এমনিতেই কুহু মেসেজ সিন করেনি; রিপ্লাই দেয়নি— ওকে ইগনোর করছে; আর এখন এ আসছে বাণী নিয়ে।
কাব্য মেজাজ ঠিক না রেখে রাগী চোখে তাকাল তানিমের দিকে-‘আমার মনে হচ্ছে কি? এবার তুই নিজে পাগল হয়ে গেছিস। মানে— যা তা বকছিস। আমার ভালো ছেলে হওয়া এটা এখানে কেমন করে আসছে?’
তানিম কাব্যের কাঁধে হাত রাখল; বোঝাল একে একে——‘দেখ। তোর মনে কুহুর জন্যে একটা সফ্ট কর্ণার আছে? আছে তো? মিথ্যা বলবি না কাব্য।’
কাব্য জবাবে ঠান্ডা স্বরে বলল——‘হ্যাঁ আছে: কিন্তু সেটা বোন হিসেবে।’
তানিম কাব্যকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলে যায়——‘না, শুধু বোন হিসেবে না সেটা। ভাই শোন তুই নিজেও কনফিউজড।তোকে কুহু ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে এটাতে বড়জোর তোর সহমর্মিতা আসতে পারে। কিন্তু ওর কষ্টে তুই নিজেও একই কষ্ট পাচ্ছিস— এমনটা কেন হবে? আমাকে এটার উত্তর আগে তুই দে তো।’
তানিম কাব্যের দিকে চেয়ে চেয়ে ভ্রু নাচালো কৌতুক ভঙ্গিতে, ওর ঠোঁটে বাকা হাসি!
তানিমের ওই হাসি দেখে কাব্যের গা-পিত্তে জ্বলে গেল মনে হচ্ছে। ও অতিষ্ট হয়ে ওর কাঁধ থেকে তানিমের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে বলল———‘আমি কষ্ট পাচ্ছি কারণ ও আমার ফ্যামিলি মেম্বার। ও আগে এমন ছিলো না; এখন এমন হয়ে গেছে। যা আমার ভালো লাগছে না। আমার কেন শুধু, আমাদের কারোরই এটা ভালো লাগছে না। তুই অযথা এসবের ভেতরে উল্টাপালটা ব্যাপার ঢুকাচ্ছিস কেন?’
তানিম এবার ঠোঁট টেনে অমায়িক, বিজয়ী হাসলো—-—-‘আমি ঢুকাচ্ছি? ভাই তুই নিজেই সব নিজের ভেতরে ঢুকিয়ে বসে আছিস; ঢুকিয়ে পচিয়েও ফেলেছিস অলরেডি। চিন্তা কর কাব্য, ভালো করে চিন্তা কর। তোদের ফ্যামিলিতে কায়া আছে; মহু আছে। অন্যান্য ফ্যামিলি মেয়ে মেম্বারদের প্রতি তোর সফ্ট কর্ণার, আর কুহুর প্রতি তোর এই পরিবর্তন; তোর কষ্ট— দুটোকে কম্পেয়ার কর। টাইম নে; ভাব। আপনা-আপনি সমাধান পেয়ে যাবি!’
তানিম হাসতে হাসতে বলল কথাগুলো! কাব্য রাগী চোখে তানিমের দিকে চেয়ে অতিষ্ট গলায় চোখ সরিয়ে বললো—-‘পাগল হয়ে গেছিস তুই। গিলসস নাকি কিছু?’
তানিমকে এখন কাব্যের অসহ্য লাগছে।ওর পাশে বসতে আর ইচ্ছে করছে না। তাই কাব্য রাগে ব্যাগ নিয়ে উঠে যাবে; তার আগেই কোথা থেকে একটা স্যুট-বুট পড়া লম্বা করে ছেলে কাব্যের সামনে এসে দাড়িয়ে গেল। কাব্যও সবে ব্যাগ হাতে নিয়েছে কাঁধে তুলনে বলে। কাব্য ব্যাগ হাতেই রেখে ছেলেটার দিকে তাকালো!
ওই ছেলেটার ঠোঁটে হালকা হাসি, কাব্যকে আগাগোড়া একবার দেখে জিজ্ঞেস করল——-‘আপনি শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য না?’
কাব্য ভ্রু কুচকালো——‘হ্যাঁ আমিই কাব্য। কিন্তু আপনি কে?’
শার্লিন- কায়া দুজনেই কুহুর দুপাশটায় বসা। ওদের দুজনের মাঝখানে অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাড়িয়ে কুহু চুপচাপ মাথাটা নিচু করে বসে আছে বিছানার মাঝখানে। কুহুর কেটে ফেলা আব্রো-থ্যাব্রো চুলের দিকে রীতিমত হা করে শার্লিন তাকিয়ে আছে। একটাসময় শার্লিন ভয়াবহ রেগে গেল; চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে দাঁত পিসে বলল——-‘আমার এই মুহূর্তে তোকে খু ন করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহু। এই কায়া আমাকে একটা নাইফ এনে দাও তো, যাও। ওর মাথার কটা ভূত আছে আমি কেটে কেটে দেখবো আজ সবকটা।’
কায়া হতাশ চোখে শার্লিনের দিকে চেয়ে জবাবে বলল——-‘কুহুপুর জন্যে বাসায় সব না ইফ আলমারিতে তালা দিয়ে রেখেছে ফুপু।’
শার্লিন এবার কড়া চোখে কুহুর দিকে তাকাল।যেন এক্ষুনি কাচা খেয়ে ফেলবে এই পাগল-উন্মাদ মেয়েটাকে। শার্লিন ভীষণ মারাত্মক ঠান্ডা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল——‘চুলটা কাটলি কেন? উত্তর দে আমারে।’
কুহু জবাবে আস্তে করে বলল——‘জেদ করে।’
‘কার জন্যে?’ ——— শার্লিনের স্বর ঠান্ডা ভীষণ।
কুহু অসহায় গলায় শার্লিনের দিকে তাকিয়ে বলল——‘তুই জানিস কার জন্যে?’
শার্লিন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো—-‘না। আমি জানিনা আপনি এসব ভূতের পাগলামি কার জন্যে করছেন? তাই আমাকে জানান আপনি। কারণ একটা সুস্থ মানুষ তো এসব পাগলামি করতে পারে না; আপনি করেছেন। মেরে তোকে এখন আমার তক্তা বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে কুহু।’
কুহু ঢোক গিললো। শার্লিনের এত রাগ কখনও দেখিনি কুহু। ওর এসব অসুস্থতায় কেউ এখন অব্দি রাগ করেনি ওর সাথে; উঁচু গলায় কথাও বলেনি একবারের জন্যে, শার্লিন বলছে। সেই শার্লিন যে কুহুর সমস্ত পাগলামিতে বিনা বাক্যে তাল দিয়েছে। আজ সেই শার্লিনকে কুহু রাগিয়ে দিয়েছে।
কুহু শার্লিনের ওই রাগী চোখে চোখ মেলাতে পারলো না। এদিক ওদিক চেয়ে চেয়ে মিনমিন করে বলল——-‘কাব্য ভাইয়ের উপর জেদ উঠেছিল। তারউপর ওই ঊর্মি আপু আমাকে বারবার উল্টোপাল্টা মেসেজ করেছে।’
‘কি উল্টোপাল্টা মেসেজ?’ —- শার্লিন জিজ্ঞেস করল!
কুহু ওর ফোন থেকে মেসেজ সব বের করে শার্লিনকে দেখাল। নিজে একবারের জন্যেও ছবিটার দিকে ভুলেও তাকাল না—তাকালেই ও নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারবে না।
শার্লিন একে একে সব মেসেজ, ছবি দেখলো। তারপর কুহুর দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে ভীষণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল——-‘ঘুরতে গেছে ওরা। তো? যেতেই পারে। গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড ঘুরতে যায়না? আমি যাইনা তুহিনের সাথে?’
কুহু জবাব দিল না এবার; অবাক হয়ে শার্লিনের দিকে তাকিয়ে রইল! শার্লিন কুহুর মায়বু মুখটার দিকে তাকাল। কেন যেন মেয়েটাকে আর ধমকাতে ইচ্ছে হলো না।
তাই শার্লিন এবার কিছুটা এগিয়ে আসলো। কুহুর মুখোমুখি বসে ওর মুখটা দুহাতে নিজের হাতের আজলায় তুলে বলে যায়——‘দেখ কুহু। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন, ওকে? এক কাব্য ভাইয়ের জন্যে তোর নিজের দুনিয়া; তার আশেপাশের মানুষকে এতটা কষ্ট দেবার রাইটস তোর নেই। আন্টির দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছিস? তোর জন্যে উনার নিজের কি অবস্থা হয়ে গেছে, দেখেছিস? আংকেলকে এখনো দেখিনি; আমার মতে উনার অবস্থাও খারাপ করে দিয়েছিস তুই। কেন করছিস তুই এসব? বল আমাকে? তুই ফেলনা? এক কাব্য ভাইয়ের ভালোবাসা তোর জীবনের সবকিছু? উত্তর দে?’
কুহু তাকিয়ে রইল শার্লিনের দিকে। ওর চোখ টলমল করছে স্রেফ। শার্লিন আবার বলল——-‘কাব্য ভাই ভালো আছেন। তুই কেন ভালো থাকবি না বল আমাকে। তোর ভালো থাকার জন্যে আপন কেউ নেই? আন্টি আঙ্কেল নেই? এই দুনিয়ার একজনের ভালোবাসা না পেলে তুই ফকির হয়ে যাবি না নিশ্চয়ই? কি ফকির হবি?’
শার্লিন আবার জিজ্ঞেস করল। কুহু চুপচাপ শার্লিনের দিকে তাকিয়ে; একসময় কুহুর চোখের তারায় ভেসে উঠে কবিতা-সাদাতের কান্নামাখা মুখ! কুহু হঠাৎ কেমন যেন বুকটা মুচড়ে উঠে! ওর এসবের মধ্যে কখনো এই মুখ-দুটোর দিকে ভালো করে তাকানো হয়নি। একবারের জন্যে কুহুর মনে হয়নি— কুহুর কিছু হয়ে গেলে; ওর প্রতি অবসেসড এই মানুষ-দুটোকে আর বাঁচানো যাবে না।
কুহুর কেমন যেন একটা লাগছে! অস্থির ভীষণ! ও দুপাশে মাথা নাড়ল——‘অর্থাৎ ফকির হবে না ও।’
শার্লিন আবার বলে——‘ একজন মানুষ তোকে ভালোনাই বাসতে পারে কুহু। তার জীবনে এমন একটা ঊর্মি থাকতেই পারে। মনে আছে যখন আমরা টেনে পড়তাম; একটা ছেলে তোকে প্রপোজ করেছিল? তুই তখন কাব্য ভাইকে ভালোবাসতি। এটা কি তোর দোষ যে তুই ওকে কাব্য ভাইয়ের জন্যে ফিরিয়ে দিয়েছিস?’
কুহু চুপ করে শুনছে। শার্লিন আবার বলে———‘তাহলে ভাব? ঊর্মি গার্লফ্রেন্ড হিসেবে তোর উপর রাগ ঝাড়তেই পারে। কাব্য ভাই সামনা-সামনি তোকে কিছু বলতে না পেরে ঊর্মি আপুকে পাঠাতেই পারেন। অবশ্য ঊর্মি অপুর এভাবে তোকে বলা উচিত হয়নি; ওই মেয়েটা উগ্র সাইকো একটা। তারজন্যে তুই কেন এভাবে তোর ভালোবাসার আরো মানুষদের কষ্ট দিবি? ডিপ্রেশনে থাকবি? তোর পুরোটা জীবনে পরে আছে কুহু। সবে তো শুরু। এমন একটা কাব্য ভাই চলে গেলে লাইফ থেকে, তোর লাইফ পুরুষ শূন্য হয়ে যাবে না নিশ্চয়ই!’
কুহু এবার ধরা গলায় বললো—‘আমি তো হাজারটা পুরুষ চাইনি। ওই একটা কাব্য ভাইকেই চেয়েছিলাম।’
শার্লিন ছোট একটা শ্বাস ফেলল, জবাবে বলল——-‘আসবে কুহু। আল্লাহ সবাইকেই জোড়া দিয়েই পাঠান। হয়তো তোর ভাগ্যেও কেউ আছে; যে তোকে এতটা ভালবাসবে যে তুই কাব্য ভাইকেই ভুলে যাবি। সময়টা হোক! নিজের প্রতি ফোকাস কর কুহু। নিজের জন্যে বেচে থাক; তোর মা-বাবার জন্যে নিজেকে বেটার অপশন বানা। পাগলকে কেউ মূল্যায়ব করে না কুহু। সব ছেলেরাই বিয়ের জন্যে ম্যাচিউর মেয়ে খুঁজে। তুই এমন করলে হবে এখন বল?’
কুহু সবকিছু শুনে শার্লিনের। কায়া ওদের পাশে বসে হা করে নিজেও শুনতে থাকে শার্লিনের একেকটা কথা।
ওর হঠাৎ স্নিগ্ধের কথা মনে পড়ে গেল। স্নিগ্ধের সাথে কদিন ধরে মন কষাকষি চলছে কায়ার। স্নিগ্ধ তাই মিস্টে গিয়েই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ওর সাথে। কায়া রীতিমত কত কি করেছে ওই পাষাণ মানুষের সাথে একটাবার কথা বলার জন্যে— পারেনি। আজ এসব কথা শুনে ওর নিজেরই জেদ বোধ হচ্ছে। একটা ছেলের পাত্তা পাওয়ার জন্যে শার্লিন আপুর মতে মরিয়া হয়ে যাওয়ার কিছু নেই।
কায়া তাই নিজেকে সামলায়; ওদের অগোচরে মোবাইল বের করে স্নিগ্ধকে মেসেজ করে বসে———‘ওকে তাহলে! আমার থেকে এতটা মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছটফট করছিলেন যে যোগাযোগটাই বন্ধ করে দিলেন; তাই তো? যান দিলাম আমি আপনাকে মুক্তি। আর কক্ষনো আপনি আমাকে কল বা মেসেজ করবেন না স্নিগ্ধ। আপনার লাইফ; আপনার রাগ; আপনার সবকিছু আপনাকে মোবারক। আমাকে আর ডিস্ট্রাব করবেন না কোনদিন। বাই!’
বলে কায়া সোজা স্নিগ্ধকে ব্লক করে দিল ফোনের সবকিছু থেকে। ওদিকে কায়ার এমন একটা মেসেজ পেয়ে স্নিগ্ধ নিজে চুড়ান্ত হতবম্ব; ধপ করে চেয়ারে বসে মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগল—- তার নরম মাটি এতটা শক্ত কথা কি করে বলে ফেলল? স্নিগ্ধ তো একটু রাগ দেখাতে চেয়েছিল। কায়াকে একবার বাইরে খেতে যাবে বলে কয় রিকুয়েস্ট করল; মেয়েটা মানল না। স্নিগ্ধের রাগ হবে না এতে?
স্নিগ্ধ রাগে আবার পাল্টা মেসেজ করতে গেলে বুঝতে পারে— কায়া ওকে ব্লক করে ফেলেছে! ব্যাপারটা বোঝামাত্রই চোখ-দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবার উপক্রম হলো স্নিগ্ধের!
এটা কি হলো? কায়া ওকে ব্লক করে দিল?
শার্লিনের কথাই কুহুর জন্যে কাজে লেগেছে। কুহু সব বুঝেছে, ওর চোখে আগুনসম জেদ টলটল করছে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে।
শার্লিন এবার কুহুর থেকে ওর ফোনটা চাইল—-‘ফোনটা দে। কাব্য ভাইকে ব্লক করে দিব আমি। উনার সামনে আর তোর যাওয়ার দরকার নেই। যেদিন মনে হবে তুই নিজেকে সামলে ফেলতে পেরেছিস তারপর সব ব্লক খুলে তার সামনে যাবি। বুঝিয়ে দিবি তাকে তোর মূল্য; কি পারবি না?’
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৫
‘পারব আমি!’ —— কুহু মাথা নেড়ে ফোনটা এগিয়ে দিল। কুহু তখনো কাব্যের দেওয়া সেই মেসেজ লক্ষ করেনি।
কিন্তু ফোন হাতে নেওয়ার পর শার্লিন ঠিকই পড়েছে কাব্যের দেখা করতে বলার সেই মেসেজ! শার্লিন একবার আড়চোখে কুহুর দিকে তাকাল। কুহু মন খারাপ করে আয়নায় ওর ছোট চুল হাতিয়ে হাতিয়ে দেখছিলো।
শার্লিন টু শব্দ করলো না আর। চুপচাপ কাব্যের ওই মেসেজ ডিলিট করে কাব্যকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিল।