ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৭

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৭
অবন্তিকা তৃপ্তি

সিদ্দিক বাড়ির বড় ছেলে শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য সেদিন সন্ধ‍্যাতে ঠিকই বাড়ির ছাদে এসেছিলো! ভেবেছিল— একটিবার কুহুর সঙ্গে দেখা করে ঊর্মির ব্যাপারটা জেনে নিবে; সঙ্গে মেয়েটার পাগলামি-ডিপ্রেশন কিছুটা কাটানোর চেষ্টা করবে, বোঝাবে ওকে যেভাবেই পারে।
কিন্তু কুহু এলোই না। কাব্যকে অবাক করে দিয়ে সেদিন রাত সন্ধ‍্যা ৯টা অব্দি ছাদে সিদ্দিক বাড়ির সবচেয়ে চঞ্চল রমণীর দেখা মিলেনি। কুহু আসেনি ওইদিন ছাদটায়; শান্ত করলো না কাব্যের উত্তপ্ত-দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা হৃদয়কে।

কাব্য সেদিন রাত ৯টা অব্দি অপেক্ষা করেও যখন কুহুর দেখা পেল না; ও ভেবেই বসলো — কুহু হয়তবা মেসেজ সিন করেনি। হয়তো দেখেইনি কাব্যের মেসেজটুকু? কাব্য কিছুটা ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ নিয়ে ওর ফোনটা বের করলো।ঠিক ভেবেছে— হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ সিন হয়নি দেখাচ্ছে। কাব্য এইবার আরো একটা মেসেজ করল———‘ashbi tui? I’m waiting!’
(আসবি তুই? আমি অপেক্ষা করছি)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও ওপাশে মেসেজের অপশনে ডাবল মার্ক টিক এলো না। কুহু কি অনলাইনেই নেই? এমনটা তো হবার কথা না। অধৈর্য‍্য কাব্য এইবার কল লাগালো। কলের দু সেকেন্ডের মাথায় ওপাশে মিষ্টি কণ্ঠী এক নারী জানালেন- কুহুর নাম্বার ব্যস্ত আছে।
একে একে সব কমিউনিকেশন সাইট থেকে এমন একটা অদ্ভুত ফিরতি ব্যবহার পাওয়ার পর কাব্যের এইবার কিছুটা সন্দেহ হলো। ও সাতপাঁচ ভাবামাত্রই সরাসরি মেসেঞ্জারে গেল। কুহুর আইডিতে ঢুকামাত্রই কাব্য একটা মারাত্মক ধাক্কা খেলো।

‘You cant reply to this conversation’
লেখাটা দেখামাত্রই কাব্য চোখ বড়বড় করে তাকাল ফোনের স্ক্রিনের দিকে। কুহু…কুহু ওকে ব্লক করে দিল? কাব্যকে ব্লক করে দিল তার ওই মাথামোটা, অবুঝ, টিনেজ কাজিনটা? কাব্যের বিশ্বাসই হলো না শুরুতে।
কাব্য দেয়াল ধরে কিছুক্ষণ ফোন হাতে হা করে দেখে গেল শুধু ওই লেখাটুকু।যখন পুরো ব্যাপারটা মাথায় ঢুকে গেল, ধীরে ধীরে কাব্যের চোখের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। কপালের রগ ফুলে উঠে একসময়। ফোন ধরে থাকা হাতের পেশি শক্ত হয়ে আসে। কাব্য ফুসতে লাগলো রীতিমত! কুহু ওকে ব্লক করে কিভাবে দিল? এটা কেমন বেয়াদবি! ওর সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি মনে করল না একবারের জন্যেও? কাব্য কি ঠিক করতে চায়নি সব? চেয়েছিলো তো আজ। নিজে মেসেজ অব্দি করেছে। অথচ ওই মেসেজটা দেখার পরেও কুহু এমন একটা কান্ড কি করে করে ফেলল? মেয়েটার বুক কাপলো না?

কাব্য রাগের মাথায় ফোনটা আছাড় মারতে যাবে; হাত উঠায় উপরে। পরমুহূর্তে ফোনে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট এর কথা ভেবে আবার হাত নামিয়ে আনে।রাগে ফুসতে ফুসতে ওভাবেই নিচে নেমে আসে।
কুহুদের ফ্ল্যাট যাবে বলে দু তলায় এসে থামলেও; কি মনে করে থেমে গেল কাব্য।
আচ্ছা. . কাব্য কেন এত রাগছে? ও তো এটাই চেয়েছিলো, তাইনা? ও তো চেয়েছিলো কুহু ওকে ভুলে যাক; মুভ অন করুন। এখন যখন কুহু সেটাই করছে— ওর কেন এত রাগ লাগছে? পরমুহূর্তে কাব্যের ব্রেইন কাব্যকে উত্তর দিল— কারণ আমি চাইনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে কুহু মুভ অন করুন। আমি তো চেয়েছিলাম— কুহু ভালো থাকুক; কিন্তু আমাকে ছুড়ে ফেলে নয় সেটা।

কাব্য মাথাটা নিচু করে কপালের দুপাশ আঙুলের মধ্যে চেপে ফ্ল্যাটের দরজা সামনে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে রইল। কলিং বেল বাজাবে করে কেন যেন বাজাতে পারছে না। কুহুর প্রতি রাগটুকু তরতর করে বাড়তে পাগল ক্রমশ! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে— ও কিছুতেই এসবে কেন যেন কুহুকে দোষ দিতে পারছে না। অথচ নিজে ঠিকই জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, এমনকি এখন তো কুহুর উপর রাগটাও কমাতে পারছে না, আবার ওকে দোষও দিতে পারছে না। দোটানায় ডুবে আছে কাব্য।

হঠাৎ ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে কুহুর গলা শোনা গেল। কবিতার কাছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে টিভির রিমোট চাইছে। কাব্য মাথাটা তুলল; মন দিয়ে শুনলো ওসব! ঠিকই তো! কুহু মুভ অন করছে; ভালো থাকার চেষ্টা করছে। ওর প্রতি যা মোহ বেচে ছিলো; সেটাও একসময় কেটে যাবে। কাব্য পাগল; তাই এসব নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করে যাচ্ছে। ভালোই তো আছে কুহু! ওকে ছুড়ে ফেলে যদি কুহুর ভালো থাকাটা হয়; থাকুক না।
কাব্য আর একমুহূর্তে দাঁড়াল না ওই ফ্ল্যাটের সামনে। তারপরেও কেন যেন প্রচন্ড রেগেমেগে কুহুদের ফ্ল্যাট থেকে নিজেদের ফ্ল্যাটে এলো। শামিমা দরজা খুলে ছেলের এই রাগী-রাগী মুখ দেখে হতবম্ব গলায় জিজ্ঞেস করলেন——-‘কি রে? এত রেগে কোত্থেকে এলি?’
কাব্য নিজের ঘরে যেতে যেতে রাগী কণ্ঠে বলে গেল———‘জাহান্নাম থেকে!’
বলে ঠাস করে নিজের রুমের দরজা আটকে দিল! শামিমা হা করে ছেলের ওই রাগটুকু দেখে গেলেন! এটার আবার কি হয়ে গেল?

কাব্য ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ পায়চারী করল পুরো রুমটাজুড়ে। কি করবে; কি করা উচিত— যেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রুমের মধ্যে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করতে করতে।
তারপর যা হওয়ার তাই হয়ে গেল। কাব্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো! রুমের একটাপাশে স্থির হয়ে দাঁড়াল এইবার, ফোনটা বের করে কল লাগলো কাউকে। ওপাশের মানুষ কল রিসিভ করলে কাব্য গমগমে স্বরে বলল——
‘আমি রাজি তোমাদের শর্তে! আজকে থেকেই জয়েন করছি আমি।’
ওপাশে কি বলা হলো— শোনা গেল না। কাব্য কল কেটে ফোনটা এইবার আছাড় দেবার মিটও ছুড়ে ফেলল একপ্রকার বিছানার উপর। রাগের মাথার ভেতরটা ধপধপ করছে স্রেফ। কাব্য টাওয়াল নিয়ে শাওয়ারে চলে গেল। মাথাটা এইমুহূর্তে ঠান্ডা করতে হবে।

রাতে যখন কাব্য-শামিমা-আনোয়ার খাবার খেতে বসলেন; কাব্য তখন ওদের সামনে হুট করে প্রস্তাব তুলল——-‘আব্বু-আম্মু! তোমাদের আমার কিছু বলার আছে।’
শামিমা ছেলের পাতে তখন আহ্লাদি ভঙ্গিতে সবচেয়ে বড় গলদা চিংড়ি তুলে দিতে দিতে বললেন——-‘এটা একবার খেয়ে দেখ; মাখোমাখো করে করেছি তোর জন্যে।’
কাব্য গলদা চিংড়ি প্লেটে রেখে অযথাই খাবার নড়াছড়া করতে করতে তাকালো একবার আনোয়ারের দিকে।
আনোয়ার খেতে খেতে বললেন——‘কি বলবে বলছিলে; বলো!’
কাব্য এইবার শান্ত; ঠান্ডা কণ্ঠে ডাইনিং রুমে সবচেয়ে বড় ব্লা স্ট করে বলে বসল——-‘আমি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফুটবল টিমে জয়েন হচ্ছি।’
আনোয়ারের খেতে থাকা হাত এই একটা কথায় আচমকা থেমে গেল, তিনি হা করে তাকালেন ছেলের দিকে। শামিমা তখনো খুব রসিক মনে ছেলের পাতে গলদা চিংড়ির ঝোল দিচ্ছেন। কাব্য তখন তাকে আটকে দিল—-‘ঝোল দিয়ো না আম্মু!’

শামিমা তবুও দিলেন। কাব্য শামিমার থেকে চোখ সরিয়ে আবার তাকাল আনোয়ারের দিকে। আনোয়ার ভীষণ শান্ত স্বরে কথা বলা শুরু করলেন——‘ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করে এখন ফুটবল খেলবে? খাবার টেবিলে বসে রসিকতা করবে না আমার সাথে কাব্য।’
আনোয়ার আবার খেতে মন দিলেন। কাব্য উনার এমন একটা রিঅ্যাকশন দেখে বিরক্ত হলো কেন যেন। নিজের বিরক্তি চেপে রেখে ঠান্ডা গলায় পাল্টা জবাব দিল——-‘আমি এইবার সিরিয়াস আব্বু!’
আনোয়ার ভ্রু কুচকে প্লেট থেকে চোখ সরিয়ে তাকালেন ছেলের দিলে। ছেলের উপর কড়া কণ্ঠে কথা বলেন না আজ প্রায় বহু বছর। কাব্য এমন একটা ছেলে— যাকে কখনো অযথা শাসন করতে হয়নি তার। সবসময় বুঝেশুনে চলে এসেছে; ফ্যামিলিকে আলাদাভাবে ট্রিট করে এসেছে।

কিন্তু কাব্যের এইবারের ছেলেমানুষি সিদ্ধান্তে রাগটুকু ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে আনোয়ারের। কিন্তু নিজের চুড়ান্ত রাগ কষ্ট করে সংবরণ করে চিবিয়ে ছিনিয়ে শুধু বললেন——‘তুমি সিরিয়াস হলে আমার জবাব হবে, না। শুনেছো তুমি? এরপরেও তোমার আর কিছু বলার আছে?’
কাব্য স্রেফ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আনোয়ারের দিকে। চোখের ইশারায় যেন কাব্যের উত্তর বুঝিয়ে দিতে চাইল বাবাকে।

কাব্যের জেদের উপর আনোয়ারের নিজের চোখেও জেদ দেখলেন। বাপ-ছেলের মাঝে শামিমা পিষে; তিনি কিছু বলতে চাইলেন। অথচ উনি কিছু বলার আগে কাব্যও এইবার পাল্টা জেদ দেখিয়ে আনোয়ারের চোখে চোখ রেখে জবাব দিল————‘আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আব্বু অলরেডি। তোমাদের জাস্ট জানালাম আমি; দ্যাটস ইট। আজকে রাতে আমি ছয়মাসের ট্রেনিংয়ে ফুটবল ন্যাশনাল ক্যাম্পে উঠছি। ওখান থেকেই আমি আমার পড়াশোনা বাকি ছয়মাস কন্টিনিউ করবো।’

আনোয়ার ভ্রু কুচকে তাকালেন; ছেলেকে এখন চোখের সামনেই সহ‍্য করতে পারছেন না আনোয়ার। একজন রিটায়ার্ড আর্মির ছেলে কিনা ফুটবলার হবে। লোকে কি বলবে? পাড়ায় তো মুখটুকু দেখাতে পারবেন না লজ্জায়।
আনোয়ার এতবড় ছেলের উপর রাগ দেকজাতে ব্যর্থ হলেন।ফলস্বরূপ চুপচাপ নিজের প্লেটে ভাত রেখেই সেটাতে পানি ঢেলে উঠে পড়লেন টেবিল থেকে। শামিমা হতবম্ব হয়ে ডাকলেন———‘ওকি করলেন? খাবারের উপর রাগ দেখাতে নেই। বসুন; শুনুন আগে ছেলেটা কি বলতে চাইছে।’

আনোয়ার জবাবে কাব্যের দিকে না তাকিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন——‘ওর জীবনে আমাদের ডিসিশনের দরকার নেই শামিমা। আমি মেনে নিচ্ছি এটা; তুমিও নাও। হ্যাঁ; এরপর যখন আত্মীয়-স্বজন জিজ্ঞেস করবে, ছেলে কি করে? ওদের বলে দিয়ো—ছেলে ইঞ্জিয়ানরিং ছেড়ে মাঠে খেলাধুলা করে!’
কাব্য শুধু শুনলো। আনোয়ার এইবার কাব্যের দিকে চেয়ে দাঁত পিসে স্রেফ বললেন——-‘এটা একটা রাবিশ ডিসিশন ছিলো তোমার। তোমার কাছে এ ধরনের ডিসিশন আমি আশা করিনি। পস্তাবে তুমি এরজন্যে, মনে রেখো আমার কথাটা।’

আনোয়ার লুঙ্গি সামলে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন। কাব্য উনার যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকলো, তারপর স্বাভাবিকভঙ্গিতে আবার খেতে লাগলো। উনি যেতেই শামিমা ছেলের দিকে তাকালেন। কাব্য মাথাটা নিচু করে আনমনে শুধু খেয়ে যাচ্ছে। বলা যায়- খাচ্ছে কম; নড়ছে বেশি!
শামিমা বুঝেন— ছেলে কোনো একটা বিষয় নিয়ে অস্থির। কদিন ধরেই তো খেয়াল করছে এটা। শামিমার ভীষণ মায়া হলো তার এই বড় ছেলেটার জন্যে। কাব্যের কাঁধে উনি মমতার হাত রাখেন——‘এই কাব্য!’
কাব্য মাথা তুলএল না। খাবার নিয়ে নড়াচড়া করছে চুপচাপ। শামিমা বললেন——-‘তুই মন থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তো আব্বু?’

কাব্য তখন তাকাল মায়ের দিকে; মায়ের মিষ্টি-মায়াবী মুখটার দিকে চেয়ে থেকে জবাবে ঘাড় নাড়ালো—-—‘হু!’
‘তাহলে যাহ। আমার পক্ষ থেকে বাধা নেই! তোর বাবাকে আমি বুঝিয়ে বলব। ট্রেনিং কোথায়?’ ——- শামিমা জিজ্ঞেস করলেন।
কাব্য উত্তর দিল——-‘ঢাকায়, সাভারে!’
শামিমা অবাক হয়ে বললেন——‘তাহলে তো বাসা থেকেই যাওয়া আসা করতে পারিস। গাড়ি আছে আমাদের; খুব একটা তো অসুবিধাও হবে না তোর।’

কাব্য জবাবে মায়ের চোখে চোখ রেখে কেন যেন মিথ্যা বলতে পারলো না। কখনো পারবেও না সেটা অবশ্য। কাব্য চোখ লুকিয়ে অযথাই খাবার নাড়তে নাড়তে জবাবে বলল——-‘আমি ট্রেনিংয়ে ফোকাস করতে চাইছি আম্মু। বাসায় থাকলে সেটা সম্ভব না। আর ছয়মাসের ব্যাপার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’
শামিমা ছেলের জন্যে মনটা কেমন যেন বড্ড খচখচ করছে তবুও। কেমন ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে বসলেন বাচ্চাদের মতো——‘আমাদের এই ছয় মাসে দেখতে আসবি না আব্বু?’
কাব্য মায়ের দিকে তাকালো এইবার। শামিমা আহ্লাদি চোখে ছেলের দিকে বড্ড আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন। কাব্য এইবার হালকা হাসল! মায়ের চোখে চোখটা এবারেও রাখলো না, না রেখে জবাবে স্রেফ বলল——‘আসব: তবে ঘনঘন পারব না।’

শামিমা হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন——‘আজকেই যাবি?’
কাব্য এইবার কেমন যেন অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিল——‘হু! আজকেই।’
‘তোর চাচ্চু-চাচিদের জানিয়েছিস?’ —- শামিমা সবার খেয়ে রেখে যাওয়া প্লেট-গ্লাস গোছাতে গোছাতে বললেন।
কাব্য এইবার মুখ শক্ত করল। ও কুহুদের ফ্ল্যাটে আর যাবে না। কাব্য খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে টিস‍্যু দিয়ে মুখটা মুছে বলল——‘ফোনে জানিয়ে দেব আম্মু সবাইকে।’
বলেই কাব্য হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেল! শামিমা হাতে নোংরা প্লেটদুটো নিয়ে ছেলের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন অবাক হয়ে।

সেবার কাব্য বলে গেল যদিও— সে এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসবে। কিন্তু কেন যেন— কাব্য আর এলো না। সবাই ওকে কত কল করলো: মেসেজ করলো, ওর ক্যাম্পে গিয়েও দেখা করলো— ওকে বাসায় একবার হলেও আনার জন্যে। তবুও কাব্যের সেই এক জেদ; এক কথাই— ও ট্রেনিং শেষ করে একবারেই বাড়ি যাবে।
শামিমা তো ছেলের এমন একটা কাজে শুধু মুখে আঁচল চেপে কাঁদেন। ছেলে দূরে সরে গেল এভাবে— কতটা দূরে গেল কে জানে?

শামিমা ঘরে একা থাকেন: আগে কুহু আসতো এ ফ্লাটে। মেয়েটার সঙ্গে গল্প করে সময় যেত ভীষণ ভালো। ইদানিং কুহুও ব্যস্ত নিজের জীবনে। সারাদিন প্রাইভেট, টিউশন; কলেজ আর পড়াশোন করতে করতেই ওর এদিকটায় আসার সময়টা অব্দি নেই। শামিমার ইদানিং অনেক একা-একা লাগছে ভীষণ। কেউ নেই উনার আশেপাশে, দুটো সন্তান দু-দিকে। এইমুহূর্তে কেন যেন শামিমার একটা মেয়ের ভীষণ অভাববোধ হচ্ছে। একটা মেয়ে সন্তান থাককে নিশ্চয়ই শামিমার আজ দিন ভালো কাটত। মায়ের কষ্টটাও ছেলেদের থেকে ভালো বুঝতে পারত নিশ্চয়ই!
সেদিন রাতে আনোয়ারের বুকে মুখ গুঁজে নিজের জীবনের সেসব অভিযোগগুলোই বলছিলেন একের পর এক তার স্ত্রী। আনোয়ার শুধু স্ত্রীর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চুপচাপ শুনে যান সেসব অভিযোগ। মাঝে একবার বলতে চেয়েছিলেন— কেন দিলে তোমার বড় ছেলেকে যেতে? তুমি একবার আটকালে তো থেকে যেত; যেতে পারত না।
কিন্তু বলা হলো না। এই নারী এমনিতেই অনেক অপরাধবোধে ভুগে। তাকে আর যন্ত্রণা দিয়ে কাজ নেই। আনোয়ার একসময় জিজ্ঞেস করলেন——-‘কাব্যের ভার্সিটি শেষ হবে কবে?’

শামিমা ফুপাতে ফুপাতে বললেন——‘আর তো ছয় মাস পরেই ফাইনাল এক্সাম।’
আনোয়ার এবার গম্ভীর হয়ে বললেব——‘মেয়ে দেখা শুরু করো। ওর ভার্সিটি শেষ হলেই বিয়ে দেব ওকে। ঘরে বউ আনলে এমন হঠকারিতা; বাহিরমুখ হতে পারবে না আর। তোমারও আর বুক খালি খালি লাগবে না।’
শামিমা অবাক হয়ে তাকালেন আনোয়ারের দিকে——‘কাব্য কি মানবে?’
আনোয়ার এইবার মুখ-চোখ শক্ত করে ফিরতি জবাব দিলেন——-‘আমরা ওর ফুটবল খেলার মতো অদ্ভুত সিদ্ধান্ত মানতে পারলে ওরও আমাদের এই সিদ্ধান্ত মানতে হবে।আমি যদি শুনি— ছেলেকে এই ব্যাপারে তুমি লাই দিয়েছো তাহলে আমি—-‘
‘দিবো না আমি লাই। আমিও চাই কাব্যের বউ আসুক এ ঘরে! একটা মেয়ের দরকার এ ঘরে আমার।’———- শামিমা কথাটা বলে আবার স্বামীর বুকে আবার মুখ গুজেন।

কুহুর আজ এইচএসসি রেজাল্ট দিয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে— বংশের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ মেয়েটাই এবার সব সাবজেক্টে ভীষণ ভালো মার্কস পেয়ে পাশ করেছে। এমনকি শুধু পাশ নয়— কুহুর জিপিএ এসেছে — ৪.৯২।
অল্পের জন্যে এ প্লাস আসেনি! এতে অবশ্য সিদ্দিক বাড়ির সদস্যদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। কুহু যেমন পরিস্থিতিতে দিনকাল চালাচ্ছিল; তাতে ওর এমন একটা রেজাল্টেই সবার তাক লেগে গেছে রীতিমত। এখন, এইমুহূর্তে সিদ্দিক বাড়িতে তো কুহুর রেজল্টে রীতিমত হইচই লেগে গেছে। সব চাচ্ছুরা কুহুকে গিফট দিয়েছেন: সাদাত মিষ্টি বিলিয়ে দিয়েছেন সম্পূর্ণ পাড়াতে, ঢাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে। এইমুহূর্তে সিদ্দিক বাড়ির সবাই ভীষন খুশি; একমাত্র কুহু ছাড়া! ওর মধ্যে রেজাল্ট নিয়ে তেমন কোনো হেলদুল নেই। ড্রইং রুমে এত হইচই; এত আড্ডা— সবকিছু এখনকার বদলে যাওয়া কুহুর কাছে কেমন যেন পানসে ঠেকছে।

ও নিজের রুমের জানালার পাশটায় আনমনে দাড়িয়ে আছে। অদূরে একটা আমগাছে দুটো শালিক পাখি বসে আছে; সেটাই দেখছে এখন। দুটো শালিক পাখি একে ওপরের গায়ের সঙ্গে মিশে, একসঙ্গে বসে রোদ পোহাচ্ছে, মেয়ে শালিক ছেলে শালিকের গায়ের ভেতর মিশে উম নেবার চেষ্টায় রত! কুহুর হাসি আসছে ওসব দেখে, কিন্তু কেমন যেন হাসতেও পারছে না। ও চুপচাপ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে সেভাবেই দাড়িয়ে রইল।

আজ প্রায় ছ-ছয়টা মাস কেটে গেছে কি অবলীলায়! এই ছয় মাসে কাব্য ভাইয়ের সঙ্গে একবারের জন্যে কুহুর দেখা হয়নি। কাব্য ভাই হয়তবা ওর থেকে মুক্তি পেতেই ট্রেনিংয়ের নাম করে বাড়ি থেকে দূরে থাকছেন। এ বাড়ি থাকলেই তো কুহুর সঙ্গে দেখা হবে, ওর পাগলামি দেখা লাগবে, ওর প্রতি আবারও বিরক্তি আসবে; সেটা নিজে প্রকাশ না করতে পেরে ঊর্মিকে পাঠানো লাগবে। কত কত চিন্তা ছিলো কাব্য ভাইয়ের। আজ এসব কিছু নেই। কারণ— কুহু নিজেকে সামলে নিয়েছে। কাব্য ভাইয়ের প্রতি ওর ভেতরে আর কিছু নেই, কিচ্ছু না। যা ছিলো; সব ছয় মাস আগে কুহু মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে। এখন কাব্য ভাইকে কুহু মন থেকে ঘৃ….!
কুহু বাকিটা ভাবতে পারে না; হঠাৎ কোথা থেকে কায়া দৌড়ে এসে একটা মিষ্টি জোর করে কুহুর মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল——-‘কংগ্রাচুলেশন কুহুপু!’

কুহু এতবড় মিষ্টি মুখে ঢুকানো অবস্থাতে কায়ার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে কোনরকমে মিষ্টি চিবিয়ে বলল——-‘এত চেচানোর কি আছে এখানে?’
কায়া অবাক হয়ে বলল—-‘আরে, চেচালাম কই? আমি তো খুশি প্রকাশ করছি শুধু। তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছো কুহুপু। একেই বলে— ইনতেকাম, অর্থাৎ রিভেঞ্জ! দেখিয়ে দিয়েছো তুমি— প্রেমে ছ্যাকা খেলে মানুষ কি না করতে পারে। ব্রাভো কুহুপু!’
কুহু মিষ্টি কোনরকমে গিলে নিলো। তারপর গিয়ে সকালের এলোমেলো বিছানা গোছাতে শুরু করে কাঠকাঠ গলায় জবাব দিল কায়াকে———‘আমি কারোর উপর রিভেঞ্জ নেইনি; ভুল ধারণা এটা তোর।’
কায়া হাত ধুয়ে একটা চেয়ারে বসে কুহুর দিকে চেয়ে বলল———‘মায়ের কাছে মামা বাড়ির গল্প কেন শোনাচ্ছো কুহুপু? আমি জানি তুমি এসব কেন করছো!’

কুহু জবাব দিল না। চুপচাপ বিছানা গোছাতে মন দিল।এই যে কুহু এলোমেলো বিছানা গোছাচ্ছে, এসব দেখে কেন যেন কায়া অবাক হয়না এখন আর। কারণ এই ছয় মাসে অনেককিছু পাল্টে গেছে।
কুহু আর আগের মতো হাসিখুশি নেই: আগের মতো অযথা বায়না ধরে এ-ওর কানের পোকা বের করে দেয়না: আগের মতো লাফায় না; টিভিতে নিয়ম করে সিরিয়াল দেখে না।
বরং কুহু গম্ভীর হয়েছে, বুঝদার ব্যবহার করে আজকাল, সিরিয়ালের বদলে টিভিতে জায়গা করেছে বিভিন্ন ডকুমেনটারি মুভিজ; ইংলিশ সাইন্স ফিকশন মুভিজ, বায়না করে না; বরং ওর যা চাই তা গোপনে চেপে রাখে সর্বদা। আগের মতো কুহু কেমন যেন আর খোলামেলা নেই; হয়ে গেছে কোনো গোপন এক ডায়েরি— যা কুহু কখনো খুলতে চায়না, মেলতে চায়না কারোর সামনেই।

কুহু এখন রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছিয়ে নিয়ম করতে পড়তে বসে: কলেজ যায়; আবার প্রাইভেট; সন্ধ্যার সময় আবার চা খেয়ে পড়তে বসা, আশপাশের এলোমেলো জিনিস গুছিয়ে রাখা— সবটাই এখন কুহু নিজে করে, কাউকে বলে দিতে হয়না। এত বছরের কুহুর সঙ্গে এখনের কুহু কেমন যেন একটা অমিল!
কুহু আগের মতো আর নেই দেখে, সাদাত-কবিতা অনেকবার ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেছেন। মেহেদী নামের একটা ছেলেকে কাব্য পাঠিয়েছিলো শুরুর দিকে। সেও কুহুকে ঠিক করতে পারেনি। এসব কিছু হচ্ছিল— সবটাই কুহুকে না জানিয়ে। তারপর একদিন— কুহু এসব বুঝতে পেরে গেল!

সেদিন কি ঝড়টাই না বইয়ে গেল বাড়িতে। কুহু সেদিন হাতের কাছে যা পাচ্ছিলো; তাই ছুড়ে ফেলেছে। রাগে কাপতে কাপতে সাদাত-কবিতার দিকে চেয়ে শুধু বলেছিল————-‘আমি ভালো থাকার চেষ্টা করলে তোমরা কেন এটাকে পাগলের রোগ ভাবো আব্বু-আম্মু? প্লিজ; দয়া করে; আল্লাহর দোহাই লাগে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। যদি আমাকে এইরকম মেনে নিতে না পারো— তাহলে বলো, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি বাড়ি থেকে। তবুও রোজ রোজ তোমাদের এসব আমার মস্তিস্ক আর নিতে পারছে না। এইবার অন্তত সবাই একটুখানি আমাকে দয়া দেখাও; আল্লাহর ওয়াস্তে প্লিজ।’

কুহু সেবারের চুড়ান্ত রাগারাগীর পর তাই এখন ও আর কেউ এ বাড়িতে ডক্টরের কথা তুলেন না।
কুহু যেমন আছে: ওকে এখন তেমনটাই মেনে নিয়েছে সবাই!
কায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ও এখনো অনেক মিস করে ওই আগের কুহুকে। কেন যে; কোন যন্ত্রণার দিনে কাব্য ভাই কুহুর জীবনে আসতে গেলেন। ভালোই তো ছিলেন ওরা ভাই-বোন হিসেবে।
মাঝখানে একটা মনের অনুভূতি; হৃদয় ভাঙার আর্তনাদ— সবকিছু দুজনের জীবনটা কেমন এলোমেলো করে দিল।
কাব্য ভাই তো ঠিকই ভালো আছেন; মাঝখানে কুহুর জীবনটা এলোমেলো; পথ হারা পথিকের ন্যায় হয়ে গেল।
কুহু বিছানা সুন্দর করে গুছিয়ে সোফাতে বসলো। ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো। এই ফেসবুক একাউন্ট যে দেখবে— সে ভাববে কুহু কত সুখী জীবনে। প্রতিদিনের ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে ঘুরাফেরা; রোজ মিমস শেয়ার করা; একেকটা পার্টির আপডেট লোকেদের দেওয়া—- সব কেমন সাজানো এই একাউন্টে। অথচ একমাত্র কুহু আর ওর খোদা জানেন— বুকের ভেতরটা আজও কেমন পুড়ে, মাঝরাতে আজও কুহুর আকাশ-বাতাস মিথ্যা করে কান্না পায়; বুকের ভেতরটা কামড়ে কেউ যেন ক্ষতবিক্ষত করে রোজ।

কুহু ফেসবুক একাউন্ট ওপেন করে নিয়ম মতো এবারেই ওর জীবনের আরেকটা খুশির বিষয় হিসেবে পোস্ট করলো ওর এইচএসসি রেজাল্ট নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যেই কুহুর স্ট্যাটাসে রিঅ্যাক্ট; কমেন্টে ভরপুর হয়ে গেল। সবাই গণহারে কংগ্রাচুলেশন জানাচ্ছে কুহুকে কমেন্ট সেকশনে। কুহু এইবার সোফাতে পায়ের উপর পা টুকে বসলো; তারপর বেশ সময় নিয়ে সবাইকে সুন্দর করে রিপ্লাই করতে লাগলো একের পর এক!
আজ আর্লি মর্নিং ট্রেনিং ছিলো কাব্যের। সারারাত না ঘুমিয়ে সকাল থেকে মাঠে এক নাগারে ফুটবল প্রেকটিজ করেছে। এইমাত্র ট্রেনিং থেকে ফিরে সবেই ভার্সিটি ঢুকেছিলো কাব্য। তারমধ্যে তানিম কোথা থেকে দৌড়ে এসে কাব্যর সামনে এসে দাঁড়ালো। কাব্য থামল; ভ্রু কুচকে তানিমকে দেখে ও।
তানিম কাব্যের সামনে এবার সরাসরি নিজের ফোন তুলে ধরলো,; হাপাতে হাপাতে বলল——-‘কুহুর রেজাল্ট দিয়েছে আজ। এই দেখ ওর স্ট্যাটাস!’

কাব্য ভ্রু কুচকে একনজর তানিমকে দেখলো; তানিম হাপাচ্ছে। মনে হচ্ছে— ও আজ ভার্সিটি এসেছে শুধুমাত্র কাব্যকে এই একটা খবর শোনানোর জন্যে। কাব্য ফোনের দিকে একনার শুধুমাত্র তাকালো; কুহুর স্ট্যাটাসের রিঅ্যাক্ট কেন যেন সবার আগে চোখে পড়ে গেল। এক ঘণ্টায় ২২১ রিঅ্যাকশন। ফ্রেন্ডলিস্টে ভালোই মানুষ জুটিয়েছে কুহু। এত এত শুভাকাঙ্ক্ষি তার, বেশ ভালো।

কাব্য তারপরেই চোখ সরিয়ে ফেলল। তানিম ওদিকে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে কাব্যের দিকে তাকিয়ে আছে ওর রিঅ্যাকশন দেখার জন্যে। অথচ কাব্য তেমন কোনো রিঅ্যাকশনই দেখালোই না।
যেন ও কিছুই দেখেনি; কিছুই জানে না— এমন একটা ভাব করে গা ছাড়া ভঙ্গিতে জবাব দিল——‘হু, দেখলাম। তো?’
বলে কাব্য তানিমকে পাশ কাটিয়ে হাটা শুরু করেছে। কাব্যকে এমন একটা ব্ল্যান্ড রিঅ্যাকশন দিতে দেখে তানিম ভীষণ আশ্চর্য হলো। এ ব্যাডা কাব্য পাথর নাকি কি? এত রোবটিক টাইপস কেন ও?
তানিম আবার দৌড়ে এসে কাব্যের পাশে এসে হাঁটা শুরু করল, হাটতে হাটতে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল——-‘তুই খুশি নস? অনেক দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে কিন্তু কুহু।’
কাব্য জবাবে একহাতে কাঁধের ব্যাগের বেল্ট ধরে; হাটতে হাটতে ভাবলেশহীনভাবে বলল——‘এখানে খুশি না হওয়ার কি আছে?’

কাব্যের মুখের ভাবভঙ্গি সুবিধার নয় একদমই। তাই তানিম এইবার সন্দেহ নিয়ে বলে উঠলো—‘কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে না সেটা। আমার মনে হচ্ছে— তুই ভেতরে ভেতরে ফুলছিস।’
কাব্য জবাব দিল না এমন ফালতু প্রশ্নের। ও ক্যাম ফুলবে? ও তো এটাই চেয়েছিলো। কুহু ভালো করছে; ভালো আছে— কে যা চেয়েছিলো তাই করছে জীবনে। কাব্যের এখানে রাগ বা ফুলার কি আছে? তানিম এটারে মুখের মধ্যে একটা ভয়ানক ঘুসি মারতে ইচ্ছে করছে এখন কাব্যের।
আবার আরেকটা ফালতু প্রশ্ন করলে আজ নির্ঘাত তানিমের কপালে দুঃখ আছে।
তানিম এবার নিজে থেকেই কুহুর কমেন্ট সেকশন ঘুরে দেখতে দেখতে কাব্যকে শুনিয়ে শুনিয়ে একের পর এক বলতে থাকে——-‘কুহু রিপ্লাই দিচ্ছে কমেন্টের: দেখে তো মনে হচ্ছে খুব খুশি আছে ও। দেখ— একজনকে বলল, ট্যুরে যাবে এবার ও। আরেকজনকে বলেছে— আজ নাকি ঘুরতে যাচ্ছে ফ্রেন্ডদের সাথে, ট্রিট দিবে ওদের। ভীষণ এনজয় করছে কিন্তু মেয়েটা ওর লাইফে!’

কাব্য হাটা থামালো হঠাৎ। মাথার ভেতর পুরনো সেই ছয় মাসের রাগ ধপধপ করতে লাগছে আবার। কাব্য শীতল চোখে তানিমের দিকে তাকাতেই, ওই তাকানো দেখে তানিম ভয়ে একটা ঢোক গিলে কোনরকমে সাফাই গাইবার চেষ্টা করতে লাগলো—-—‘আসলে..আমি চেক করছি——‘
‘তুই কি ওর স্পাই? ওর প্রতিটা খবর আমি তোকে দিতে বলেছি আমাকে? বলেছি আমি?’—— কাব্য ভয়ানকভাবে ধমকে বলতে লাগল।

কাব্যের একেকটা রাম-ধমকে তানিমের গলায় যা কথা ছিলো বেচে; সন হারিয়ে যাচ্ছে। ও কোনরকমে মিনমিন করে বলল——‘বলিসনি। আমি ভাবলাম তোকে বললে——‘
‘আমাকে বললে কি? আমি ওর খুশি দেখে জেলাস হবো? ওসব দিন গেছে তানিম। এখন আমি আমার লাইফ নিয়ে ব্যস্তও ওর লাইফ নিয়ে। লেট আস মুভ অন; প্লিজ! ———কাব্য কথাটা বলে তানিমের কাঁধের কাছটায় জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে।

এবারের হাঁটার ভঙ্গিমা পাল্টে গেছে ওর। দূর থেকে তানিম বুঝে— কাব্য রেগেই আছে; ও জেলাসই হচ্ছে; ওর ভেতর ফুসছে! স্বীকার করে না দেখে কি তানিম অবুঝ নাকি— ঠিক বুঝে গেছে।
কাব্যের হাঁটার মধ্যে পাশ থেকে হঠাৎ কজন জুনিয়র এসে কাব্যকে ঘিরে ধরলো। ওরা মূলত ফুটবল ক্লাবে জয়েন হতে চাচ্ছে। সেটাই নিয়েই কাব্যের কাছে সাজেশন চাইতে এসেছে। কাব্য গম্ভীর মুখে ওদের বলে দিচ্ছে ফুটবল সম্বন্ধে সন ডিটেইলস.! বোঝা যাচ্ছে— এইমুহূর্তে জুনিয়রের সঙ্গে কথা বলার মুড ওর নেই। শুধুমাত্র তানিমের কাছে নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতেই এমনটা করে যাচ্ছে।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৬

তানিম দূর থেকে বাকা হেসে শুধু দেখে গেলো কাব্যকে। মনেমনে হাসে তানিম, বিড়বিড় করে বলে যায় ——‘তুই অলরেডি ফেসে গেছিস কাব্য! এখন শুধু তোর এটা রিয়ালাইজ করা বাকি। এই গুরুদায়িত্বটা নাহয় আমি তানিম নিজ দায়িত্বে করে দিবে! জাস্ট ওয়েট এন্ড সি তানিম’স প্ল্যান, সিদ্দিক ব্যাডা!’

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৮