ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৫

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৫
অবন্তিকা তৃপ্তি

—-‘আই লাভ ইউ কুহু। আই লাভ ইউ; আই লাভ ইউ; আই লাভ ইউ সো মাচ ম্যাই লাকি কয়েন। ইউ আর ম্যাই লাক; ইউ আর ম্যাই ইন্সপিরেশন ফর দিস ট্রফি, গার্ল। আই লাভ ইউ মোর দ্যান এনি…এনিথিং!’
পুরো গ্রাউন্ডে সিয়ামের চিৎকার করে বলা প্রপোজ ভেসে বেড়াচ্ছে। পুরো ভার্সিটির যারাই এই প্রপোজ শুনেছে সবাই এসে ভিড় জমিয়েছে দর্শক সারিতে। সবাই মিলে কুহুকে একজোটে বলে যাচ্ছে— প্রপোজ একসেপ্ট করার জন্যে।
কাব্য এতসব দেখে ওর মাথাই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

ও স্রেফ শ্বাস আটকে কুহুর দিকে চেয়ে রয়েছে একবুক আশা নিয়ে।কুহু মানবে না সিয়ামকে; কুহু এখনো কাব্যকে ভালোবাসে। সিয়ামকে নিশ্চয়ই না। সিয়াম এত ক্রিঞ্জভাবে প্রপোজ করেছে; কুহু ওকে কি করে একসেপ্ট করবে? এটা কোনো ধরন হলো প্রপোজ করার?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কাব্য শ্বাস আটকে রেখে দিয়েছে। বুক ধুকপুক করছে শুধু। হাত কাপছিলো। ঠিক তখন বিস্ময়ে ফেটে পরা কুহুর নজর গেল কাব্যের দিকে। কাব্য কেমন একটা চোখে যেন কুহুর দিকেই তখন তাকিয়ে ছিলো।
কুহু কাব্যকে দেখলো। কাব্যের নজরে নিজেকে দেখলো। দুজনের চোখে চোখে মিললো স্রেফ!
কাব্যের চোখে কিছু একটা ছিল, কি সেটা? অনুনয়; নাকি কাতরতা অথবা মানা করতে না পারার, বাধা দিতে না পারার অসহায়ত্ব!

কুহু বুঝেনা; জেদে-রাগে উন্মাদ কুহু তখন শান্ত দৃষ্টিতে কাব্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সবকিছু ছাপিয়ে কুহুর চোখ গেল কাব্যের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ঊর্মির দিকে। ঊর্মি কাব্যের একটু পেছনে দাড়িয়ে বাকা হেসে কুহুর দিকে চেয়ে আছে। ওর ঠিক সামনেই কাব্য চোখে-মুখে অনুনয়, অসহায়ত্ব ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কুহু অবুঝ; নাদান! ফের জড়িয়ে গেল ঊর্মির পাতানো ফাঁদে। কাব্যকে প্রথমবারের মতো; ভেঙেচুরে দিল; একদম গোড়া থেকেই। কাব্যের দিকে চোয়াল-মুখ শক্ত করে তাকালো কুহু; প্রতিশোধে ওই তাকানোতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কুহুর ওই এক তাকানোতে কাব্যের চোখ বদলে গেল। কাব্য একদৃষ্টিতে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইল, ওর বুকটা হঠাৎ বুঝি কাপলো একটুখানি: কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের জন্যে?

কুহু চোখ সরিয়ে ফেললো; অন্যদিকে চেয়ে মুখ লুকিয়ে একটা ঢোক গিললো; কান্না আটকে ফেলল সাথেসাথেই। ও ওই মানুষকে দেখে দুর্বল হবে না আর; ও দেখিয়ে দেবে ওদের— কুহু ফেলনা না; অসুন্দর নয়; কুৎসিত নয়। কাব্যের মতোই ভার্সিটির সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে কুহুকে চায়। কাব্য ভাইও দেখুক—- কুহুর মর্যাদা কতখানি.. .! তার জন্যে যদি কুহুর আরো একবার হৃদয় ভেঙ্গে ফেলতে হয়— তাই করবে কুহু।
একটা হৃদয় তো হাজারবার ভাঙা যায়না। ওই ভাঙা টুকরোগুলো; যা কুহু এতটা মাসে জোড়া দেবার চেষ্টা চালাচ্ছিল; সেটুকুও নাহয় কুহু নিজের হাতেই আবার ভাঙবে। কিচ্ছু হবে না এতে; কিচ্ছু না। শুধু কুহুর হৃদয় থেকে বদদোয়া আসবে কত!

কুহু শেষবারের মতো লম্বা একটা শ্বাস ফেললো। মাথা তুলে মরা; প্রাণহীন দৃষ্টিতে সিয়ামের দিকে তাকাল। সিয়াম ট্রফি হাতে হালকা হেসে দৌড়ে দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে কুহুর দিকেই এগিয়ে আসছে। কুহু ব্যাগটা খামচে ধরে শক্ত করে সিয়ামের দিকে চেয়ে রইলো ওমনি।
সিয়াম কুহুর সামনে এসে, ঠিক ওর সামনে নায়কদের মতো হাঁটু গেড়ে বসে গেল। দুহাত দিয়ে ট্রফিটা ধরে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিল, বড্ড অনুরাগ নিয়ে বললো————-‘উইল ইউ অ্যাকসেপ্ট মি; কুহেলিকা সিদ্দিক কুহু? প্রমিজ; লাইফের সমস্ত জয়; উইন তোমার সঙ্গেই সেলিব্রেট করবো।আল বি দ্য ট্রফি হোল্ডার; এন্ড ইউ উইল বি দ্য রিজন ফর দিস! সো, মে আই?’

কাব্য এবার কেন যেন মেজাজ হারাল। ক্যাম্পাসটাকে কি সিয়াম জোকস পেয়েছে? কত বড় সাহস ওর। ভরা ক্যাম্পাসে সিনক্রিয়েট করছে, তাও কিনা ওরই ফ্যামিলি মেম্বার কুহুকে নিয়ে। কাব্য ওকে আজ রক্তাক্ত করে ফেলবে; কুহু অপ্রস্তুত হচ্ছে— বাস্টার্ডটা কি সেটাও দেখছে না?
অথচ কাব্য দু’কদম এগুতেই; হঠাৎ কুহু সিয়ামের থেকে ট্রফিটা নিয়ে নিল নিজের হাতে। কাব্য থমকে গেল; ওর পা দুটো থেমে গেল আচমকা। ও অদূরে দাঁড়িয়ে পড়ল; কুহুর দিকে অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে। ক. . . কুহু ওটা নিলো? সিয়ামের হাত থেকে ট্রফিটা সত্যি নিয়ে নিলো কুহু?

কাব্য অবিশ্বাস্য নজরে কুহুর দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলে উঠল———‘কু… . কুহু… না…!’
কুহু সিয়ামের থেকে ট্রফিটা নিয়ে; শুকনো মুখে হাসার চেষ্টা করে বলল———‘আই অ্যাকসেপ্ট ইউ!’
কুহু ‘ভালোবাসি’ না বলে ‘অ্যাকসেপ্ট ইউ’—- বলার কারণ বোকা কাব্য ধরতেও পারলো না। ওর মাথায় ঘুরতে লাগল— কুহু সিয়ামের প্রপোজাল গ্রহণ করে ফেলেছে; এক্ষুনি, ওর সামনেই। কাব্যের বলা কথা; কাব্যকে কুহু মনেও রাখেনি।
সাতটা মাসে কুহুর ভালোবাসা, অবসেশন সবটাই নিমিষেই শেষ হয়ে গেল? কুহু অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলল; এত ইজিলি? তাহলে কাব্য? ও কেন সেদিনের পর মুভ অন করতে পারছে না। কুহুর সামান্য কষ্টেও ওর কেন এখনো বুক পুড়ে?

কাব্যের বুকটা কোনো এক অদ্ভুত কারণে জ্বলছে; স্ফুলিঙ্গের ন্যায়! কাব্য জানে না— কেন হচ্ছে ওর সাথে এসব? কুহু মুভ অন করে ফেলেছে— এটাতে তো কাব্যের খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু ও খুশি কেন হতে পারলো না? কেন মনে হচ্ছে—- কাব্য একটা পুতুলের মতো মেয়েকে হারিয়ে ফেললো মাত্রই, কি বিচ্ছিরিভাবে।
কাব্যের জীবনে কোনো গ্ল্যামার ছিলো না কখনোই, হাসির কোনো কারণও ছিলো না। বন্ধু-বান্ধবও গুটিকয়েক। এতদিন কাব্যের জীবনে একমাত্র কুহুই ছিল ধামাকার ন্যায়। রসকষহীন কাব্যের জীবনে, কুহুই একমাত্র কারণ যার কারণে কাব্য হাসতো।

কুহু এমন একটা মেয়ে, যাকে কাব্য সবসময়ই অ্যাডমেয়ার করতো। কুহুর বায়নাগুলো কাব্য পূরণ করতো; ছোট বাচ্চার মতো কুহুকে আগলে রেখেছিলো। আর আজ? আজ থেকে কুহু সম্পূর্ণ রূপে সরে গেল ওর জীবন থেকে। অন্য কারোর নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে গেল। এখন থেকে কুহু আরো দূরে, আরো দূরে সরে যাবে— এতটা দূরে যে কাব্য ওকে ছুঁতেও পারবে না; আদর-আবদার ভঙ্গিতে ওর কাছে কেউ বায়না করবে না।
কাব্য আজ থেকে একলা হয়ে গেল; সম্পূর্ণ একা। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতো অন্ধকারে ছেয়ে গেল ওর পুরো দুনিয়া।
কেন হলো এসব? কেন? কাব্য তো এসব চায়নি? এসব… এসব কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? কিসের জন্য হচ্ছে? আর কেনইবা কাব্যের এত বুকটা পুড়ছে?

কুহু সিয়ামের ট্রফিটা হাতে কাব্যের দিকে একবার তাকাল। কাব্যের চোখ-মুখে যেন কোনো উদ্বেগ নেই— কুহু আবার ভুল বুঝে মলিন হাসলো সেটা দেখে। বাহ, কাব্য ভাই কত স্বাভাবিক!
কুহুকে অন্যের সাথে দেখে এখন নিশ্চয়ই কাব্য ভাই স্বস্তির শ্বাস ফেলবেন। কুহুর থেকে উনার পিছু ছুটে গেছে— আজ নিশ্চয়ই ঊর্মি আপুকে ট্রিট দেবেন কাব্য ভাই। যে ভাবে কুহুর সু ইসাইডের পর ঊর্মি আপুর করা অপমানের পর কাব্য ভাই খুশি হয়ে উনাকে ট্রিট দিয়েছিলেন।

কুহু আবার তাকাল; ওপাশে ঊর্মি ভ্রু কুঁচকে কুহুর দিকে চেয়ে আছে। কুহু বুঝলো— কেন ওই তাকানো। ঊর্মি আপু হয়তো বিশ্বাস করেননি— কুহুর জীবনেও কাব্যের মতো সুদর্শন কেউ আসতে পারে। যার জীববে কুহুর ভালোবাসার এক পয়সাও মূল্য নেই; সেই কুহুর ভালোবাসাকেও কেউ একজন সোনার দাম দেয়।
সিয়াম. . .! এমন একজন— যাকে কুহু কখনো ভালোবাসতে পারবে কিনা জানে না। কুহুর হৃদয় এখনো ওই একজনের জন্যই চলে— সেটা আর কেউ না জানুক কুহু তো জানে।
সিয়াম কুহুকে ডাকছে কখন থেকে, অথচ কুহু তখন স্থির চোখে কাব্যের দিকে চেয়ে রয়েছে। দুজনের চোখে-চোখ মিলে আছে অনেকক্ষণ। চোখে চোখে কি কথা বলা যায়? রাগ-অনুরাগ, অসহায়ত্ব বলা যায় অপরমানুষযে? হয়তো বলা যায়।

সিয়ামের খটকা লাগে; ও কুহুর চোখ অনুসরণ করে কাব্যের দিকে তাকাল। ওরা দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে রয়েছে; আজন্ম তৃষ্ণার্তের ন্যায়!
সহ‍্য হলো না সেটা সিয়ামের একটুকুও। সিয়ামের হঠাৎ কি হলো? ও আচমকা কুহুকে টেনে ওকে জড়িয়ে ধরে ফেললো। দুহাতে কুহুকে জড়িয়ে ধরতেই; কুহু রীতিমত হতবাক হয়ে পরলো যেন একদম।
সিয়াম কুহুকে জড়িয়ে খুশিতে ইচ্ছে করেই শুনিয়ে শুনিয়ে উল্লাস করছে———-‘থ্যাংক ইউ কুহু: আই রিয়েলি লাভ ইউ ড্যাম। থ্যাংক ইউ সো মাচ এই অধমকে একটা চান্স দেওয়ার জন্য। থ্যাংক ইউ মাই লাভ!’
সিয়াম নিজের খুশিতে উল্লাস করছে; অথচ কুহুর হতবাক দৃষ্টিসীমা সেসব ছুঁতেও পারছে না। ও চোখ সরিয়ে কাব্যের দিকে তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টিতে!

কাব্যের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে এখন। ওর হাতের ফুটবল হাত থেকে পড়ে গেল; কাব্য অ্যাডম’স অ্যাপল নামছে-উঠছে। হয়তো নিজেকে সামলানোর চেষ্টাটাই করছে।
কাব্যের লম্বা করে শ্বাস টেনে হঠাৎ চোখ নামিয়ে নিলো। দেখল না কুহুকে অন্য কারোর সাথে।
হয়তবা ওর দেখাটুকু সহ‍্য হচ্ছিল না। কামড়ে ধরেছিল বুকটা ওর কেউ। কাব্য চোখ নামিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে; কুহু যে ওকে দেখছে সেটা কাব্য ভুলক্রমেও তাকিয়ে দেখলো না।
কুহু তাকিয়ে ছিলো একদৃষ্টিতে! এবার ঊর্মি এসে হঠাৎ কাব্যের হাত জড়িয়ে ধরতেই; কাব্য তাকালো ঊর্মির দিকে। কাব্য কিছু বলার আগেই; কুহুর মধ্যে হঠাৎ ওদের দেখে জেদ চাপল। এইবার ও আস্তে করে সিয়ামের টিশার্টের এক কোনা কোনোরকম ছুয়ে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে চোখ বুজে ফেলল খিচে, শক্ত করে। যেন ও ভুলতে চাইছে— ওর গায়ে অন্য কারোর স্পর্শটুকু!

কাব্য ঊর্মিকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে রক্ত-লাল চোখে তাকালো ওর দিকে। ঊর্মি ঠোঁট উল্টে সরি বলে আলগোছে চলে গেল একপাশে।
কাব্য এবার তাকিয়ে ফেলল কুহুর দিকে। কুহু….কুহু সিয়ামকে জড়িয়ে ধরেছে? ব্যাস! যা আশা: যা ভরসা ছিল— সব ওই কুহুর এক জড়িয়ে ধরতেই চুরমার হয়ে গেল। কাব্য একটা ঢোক গিলে; জোরে একটা শ্বাস ফেলে হনহনিয়ে চলে গেল মাঠ থেকে। আর এক মুহূর্ত কাব্য থাকল না ঐখানে।
কাব্য চলে যেতেই কুহু চোখ খুলে তাকালো। আশেপাশে কাব্য নেই; দেখতেই ও দ্রুত সিয়ামকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিল।

সিয়াম খানিক পিছিয়ে গিয়ে; কুহুর দিকে ভ্রু বাকিয়ে তাকাতেই কুহু স্বাভাবিক কণ্ঠে সিয়ামের দিকে চেয়ে বলল———‘নেক্সট টাইম জড়িয়ে ধরার আগে পারমিশন নেবেন। ফার্স্ট টাইম তাই কিছু বললাম না।’
সিয়াম বুঝতে পারলো ওর ভুল; এবার মাথার পেছনটা চুলকে; নিচু কণ্ঠে হেসে বলল——-‘সরি! আবেগে মনে ছিল না। নেক্সট টাইম পাক্কা পারমিশন নেব।’
কুহু এবার আর এক মুহূর্ত দেরি করল না; ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে চলে যাবে সিয়াম হঠাৎ ওর হাত চেপে ধরল পেছন থেকে। কুহু থেমে গেল। পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সিয়াম বলল——-‘ফার্স্ট প্রপোজের পরে এভাবে কীভাবে চলে যাচ্ছো? আমার পক্ষ থেকে ট্রিট নেবে না? এজ এ বয়ফ্রেন্ড?’

বলে চোখ টিপলো সিয়াম। কুহু দেখলো ওসব। আস্তে করে সিয়ামের হাত নিজের হাতের থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল——-‘অন্য একদিন; বাসায় বলে আসিনি, আম্মু টেনশন করবে। বাই!’
কুহু আর এক মুহূর্ত দেরি করল না, চলে গেল। কুহু চলে যেতেই ঊর্মি এসে সিয়ামের পাশে এসে দাঁড়াল। সিয়াম কুহুর যাওয়ার দিকে চেয়ে ঊর্মিকে বলল———‘তোমার মনে হয় ও আমার প্রেমে পড়বে? দেখেছো কিভাবে ইগনোর করলো আমাকে!’
ঊর্মি হাসলো; নিজের কুহুর হাঁটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে জবাবে বলল———-‘হবে হবে; সব হবে। ওয়েট করো; কাব্য এখন মাঝপথে বাগড়া না দিলে ওই কুহু তোমারই।’

তীব্র রোদ; ঝাঝালো বাতাস! রাস্তার একপাশ ধরে হাটতে হাটতে কুহুর মনে হচ্ছে ও আর হাঁটতেই পারছে না। পা দুটো ভেঙে আসছে,শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে, দুর্বল লাগছে শরীর।
হেলেদুলে একপাশে পরে যেতে নিলে কুহু দুর্বল ভঙ্গিতে একটা পিলার চেপে ধরলো। তারপর আস্তে করে হেঁটে একটা রাস্তার বেঞ্চে এসে বসলো। শ্বাস ফেলাটা যেন দুরহ হয়ে উঠছে।
এই স্বাসকষ্ট কুহুর সুইসাইডের পর থেকে যেন পিছুই ছাড়ছে না। ডাক্তার বলেছে— মানসিক দুর্বলতা থেকেই এই রোগের উৎপত্তি। তাই স্ট্রেস নিতে মানা করেছে কুহু সাইকিয়াট্রিক!

কুহু দুর্বল ভঙ্গিতে ব্যাগ থেকে ইনহেলার বের করে সেটা টেনে নিজের ভেতর পুরে নিতে লাগল অপ্রকৃতিস্থের ন্যায়। নেওয়া শেষ হোক ইনহেলারটা বেঞ্চের একপাশে ফেলে রেখে মাথাটা নিচু করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। ওর ভালো লাগছে না; বড্ড অস্থির লাগছে। শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। বুকটা এত ভার-ভার লাগসে; যেন বুকের উপর কয়েকশ কেজি বোঝাই করে রেখেছে কেউ।
কুহু এবার ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি নিয়ে মাথায় অল্প করে ঢালতে লাগল; মুহূর্তের মধ্যে মাথাটা ঠান্ডা করা দরকার। মনে হচ্ছে- মাথা থেকে গরম ধোয়া বের হচ্ছে শুধু।

পানি দিয়ে পুরো চুল ভিজিয়ে ফেলেছে— তবুও মনে হচ্ছে গায়ে এখনো কোনো জোরটুকু নেই। সবটাই শেষ।
কুহু কি করবে? বাসায় তো যেতে হবে। তাই ও দুর্বল ভঙ্গিতে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে এবার ফোন লাগাল কাউকে। ওপাশে শার্লিন কল ধরল; কুহু অসুস্থের ন্যায় ভাঙা স্বরে থেমে-থেমে বলল———‘আম…আমাকে বাসায় নি…নিয়ে যা। আমি…আমি মনে …মনে হচ্ছে মা…মারা যাচ্ছি; শা..শার্লিন!’
শার্লিন অবাক; ও মূলত এতক্ষণ কুহুকেই খুঁজছিল। ভার্সিটিতে আসার পর এত কিছু দেখে, শোনে শার্লিন রীতিমত হতবাক হয়ে আছে। পাগলের মতো এদিক-ওদিক কুহুকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

তারপর এখন কুহুর কল পেতেই শার্লিন একপ্রকার দৌড়ে ছুটে ওই রোডে এলো। একটা বেঞ্চে কুহুকে দেখে শার্লিন দ্রুত এসে কুহুর সামনে এসে হাঁটুগেড়ে বসে আচমকা কুহুকে জড়িয়ে ধরে বসে গেলো। কুহু শার্লিনের ঘাড়ে মুখ রেখে হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাস নিতে লাগলো। শার্লিন কুহুর পিঠে অস্থির ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে কুহুকে শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ওর হাসিখুশি কুহুর এমন একটা অবস্থা দেখে শার্লিন কুহুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদেই দিল; ও বলছে———‘কেন করলি এটা তুই কুহু? কেন নিজেকে শাস্তি দিচ্ছিস? কুহু…জান আমার! প্লিজ তুই এমনটা কেন করলি? নিজেকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছিস জান?’
কুহুর হাত ঝুলে আছে অজ্ঞান মানুষের মতো। ও স্রেফ শার্লিনের ঘাড়ে মুখটা রেখে চোখ বুজে দুর্বল গলায় হাপাতে হাপাতে বলল———‘এ…এটার দ…দরকার ছিল শার্লিন; দর..দরকার ছিল। তুই বু…বুঝবি না: এটার সত্যি দ…দরকা….!’

শার্লিন কুহুকে ছেড়ে দুহাতে ওকে ভালো করে আগলে ধরে, ওর গোলগাল মুখের দিকে চেয়ে রইল। কুহু কাঁদছে না; কান্না আটকে রাখার কারণে মুখটা লাল হয়ে আছে— যেন ফোঁটা দিয়েই রক্ত পড়বে। কুহু চোখ বুজে এদিক-ওদিক হেলেদুলে যাচ্ছে শুধু। চোখটা খুলে অব্দি তাকাতে পারছে না।
শার্লিন কুহুর মায়ের থেকে শুনেছে— ইদানিং কুহুর মাঝেমধ্যে এমন অবস্থা হচ্ছে। অতিরিক্ত স্ট্রেস নিলে কুহুর শরীরে শক্তি চলে যায়: শরীর ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞানের মতো হয়ে যায়। এটাই বোধহয় এখন হচ্ছে কুহুর। এতদিন শার্লিন শুধু শুনে এসেছে; আজ চোখে দেখলো।
শার্লিন চুপচাপ; কাতর ভঙ্গিতে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইল। ওর বুকটা ফেটে কান্না আসছে। শার্লিন দুহাতে কুহুর গালটা ধরে কুহুর চোখ-মুখ ছুয়ে দিতে দিতে বললো———‘এক কাব্য ভাই তোকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কুহু, দেখ একবার। জান, কেন তুই প্রেমে পড়লি; ভালোবাসলি? কেন করলি? তোর জীবন তো ওভাবেই ভালো ছিলো।’

কুহু ওসব শুনছে না। ওর চোখ বুজে আসছে বারবার। কুহুর অবস্থা খারাপ হচ্ছে দেখে শার্লিন দ্রুত সিএনজি নিল। কুহু শার্লিনের কাঁধটা ধরল; ভরসা করে। শার্লিন অনেক কষ্টে কুহুজে সিএনজিতে তুললো। সিএনজিতে উঠেই কুহু শার্লিনের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
শার্লিন কুহুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে টলমলে চোখে কাঠকাঠ গলায় বলল———‘আমার হাতে যদি ব্রেইন থেকে মেমোরি ডিলিট করার অপশন থাকত; আমি সবার আগে তোর ব্রেইন থেকে কাব্য ভাইয়ের সমস্ত স্মৃতি মুছে দিতাম কুহু। আফসোস, আমার হাতে কেন এই ক্ষমতা নেই! কুহু; তুই আগে কত ভালো ছিলি। আর এখন দেখ— কি অবস্থা করে ফেলেছিস নিজের। একবার ভাব; অন্তত একবার কুহু।’

সিদ্দিক মহল; দুপুর ১২টা!
শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য নামক এক অসহায় পুরুষ সেই যে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসেছে— আর খোলার নাম নেই।
ওদিকে কাব্যের দরজায় অনবরত ধাক্কাচ্ছেন শামিমা। কাব্য ঘরে ঢুকেই এত জোরে দরজা বন্ধ করেছে পুরো ফ্ল্যাটটাই যেন কেপে উঠেছিল। শামিমা বুঝতে পারলেন— গণ্ডগোল তো একটা হয়েছেই।
এতবার ধাক্কাছেন দরজা, অথচ কাব্যের একদম সাড়া নেই। ওর ঘরের ভেতরে ভাঙচুরের আওয়াজ হলো হঠাৎ। শামিমা এবার রীতিমত আঁতকে উঠলেন। কাব্য তো এমন না!

শামিমার ছোট ছেলে স্নিগ্ধ দুরন্তপনায় ঘেরা থাকলেও কাব্য বরাবর ছিল শান্ত-শিষ্ট। কখনো অযথা কোনো বেয়াদবি; বায়না; মারপিঠে কাব্য কখনোই ছিলো না। তাহলে আজ? আজ কি হয়ে গেল?
শামিমা এবার অস্থির হয়ে দু’হাতে দরজায় ধাক্কালেন——-‘কাব্য; বাবা: আব্বু। দরজা খোল; কী করছিস তুই? জিনিসপত্র ভাঙছিস কেন? ও কাব্য? আব্বু? দরজাটা খোল বাবা।’
কাব্য পাগলের মতো হয়ে গেছে রীতিমত। দু’হাতে আর্তনাদ করে ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা সমস্ত পারফিউম এক হাতে ঠেলে ফেলে দিল। কাব্যের শখ করেদুবাই ইম্পোর্ট পারফিউম ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেল। পুরো ফ্লোরে পারফিউমের তরল গড়িয়ে যেতে লাগলো। ঘ্রাণে মো-মো করে উঠলো কাব্যের ঘরটা ওই ঘর; যা সাজিয়েছিল স্বয়ং কুহু; শামিমার সাহায্য নিয়ে।

কাব্য এবার হাতের কাছে যা পেল তাই ছুড়ে ফেলল। রাগটা এখনো কমছে না একদমই। হঠাৎ কাব্যের চোখ গেল দেয়ালে টাঙ্গানো ওদের একটা ফ্যামিলি ফটোর দিকে; যেটাতে কুহু-কাব্য একপাশে দাড়িয়ে আছে। কাব্য প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে শামিমার পাশে দাড়িয়ে রয়েছে; আর কুহু মিষ্টি হেসে কাব্যের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
কাব্য চোখ বুজে জোরে একটা শ্বাস নিল, তারপর আবার তাকালো চোখটা খুলে। গাঢ় করে কাব্য ওই ছবিটা হাত দিয়ে এবার ছুয়ে ছুয়ে দেখলো বড্ড কাতর ভঙ্গিতে।
ওই চাওনি; ওই তাকানো; ও মুগ্ধতা—- সবটা কুহু ভালোবাসতো বলে করতো। কাব্য একটা গাধা— তাই ও বুঝেনি এসব। কুহু এবার সিয়ামের দিকে ওই চোখে তাকিয়েছে। কেন? কাব্যের দিকে যে চোখ ওই নজরে তাকাতো; সেই একই চোখ সিয়ামের দিকে ওই নজরে কেন তাকাবে।

কাব্য হাত সরিয়ে ফেলল ফটোটা থেকে। চোখ বুজে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলতে লাগলো। চোখের তারায় আবার ভেসে উঠল সকালের দৃশ্য! কুহুকে জড়িয়ে ধরে সিয়ামের উল্লাস!
কেন যেন কাব্যের আর সহ‍্য হলো না! ও চোখ খুলে আচমকা ফোটোটা দেয়াল থেকে টেনে এনে মাথায় তুলে ছুড়ে ফেলল মাটিতে। কাচের ফটো ফ্রেম ভেঙে টুকরো টুকরো হলো। যেভাবে আজ টুকরো টুকরো হয়েছে কাব্যের ভারি হৃদয়খানা।
শামিমা কাচ ভাঙার শব্দে আতকে উঠে দরজায় আবার ধাককালে ——‘কাব্য কি ভাঙলি তুই এখন? দরজা খুলছিস না কেন?’

তানিম অনবরত কল করেই যাচ্ছে। কাব্যের ওই ফোনের আওয়াজ অব্দি শুনতে ইচ্ছে করছে না, অস্থির লাগছে। ও খপ করে ফোনটা ধরে রিসিভ করে সরাসরি চেঁচিয়ে উঠলো——-‘হোয়াট? কল দিচ্ছিস কেন। মরে গেছি আমি? কি মনে হয় তোদের?’
তানিম থমকে গেল। কাব্যের রাগের কারণ ওর মাথায় ঢুকলো না। তানিম এ যাত্রায় মিনমিন করে বলল——-‘আসলে কুহু….! তুই..তুই ঠিক আছিস তো কাব্য?’

কাব্য এবার মেজাজ হারিয়ে, হিংস্রের ন্যায় চেঁচিয়ে বললো——‘ফর গড সেক তানিম; কুহুর ব্যাপারে তুই আমাকে এভাবে আর জ্বালাবি না। যদি এটা মেনে থাকিস তবেই তুই তোর মুখ আমার সামনে আনবি, নাহলে আর কোনদিন আমার সামনে আসবি না। বোঝা গেছে? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হিয়ে কুহুর গুনকীর্তন করবি না কানের কাছে। কুহু ভালো আছে, ইনফ্যাক্ট খুব বেশি ভালো আছে। আমিই খারাপ তো; তাই খোদা আমাকেই খারাপ রেখেছে; ওকে ভালো রেখে। আর তুই, আমাকে আর কক্ষনো কল করবি না। তোকে আমার বিরক্ত লাগছে।’
কাব্য কথাটা বলে ঠাস করে কল কেটে ফোনটা বন্ধ করে ছুড়ে ফেলল বিছানার উপর।
ফোনটা কেটে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে কাব্য দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে বিছানার পাশে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে গেল।

ওর ভালো লাগছে না কিছুই— কিছু না। বেঁচে থাকাটাই এখন কেন যেন বিভীষিকাস্বরূপ লাগছে। কেন হবে ওর সাথে এমন? কিসের এত দ্বন্দ্ব ওর মনে? ও কি তাহলে সত্যি কুহুকে.. . .!
এটাকেই কি ভালোবাসা বলে? কিভাবে? যদি এই অস্থিরতাকে তানিমের ভাষ্যমতে ভালোবাসা বলে— তবে চাই না কাব্যের এমন অস্থিরতা। যে অস্থিরতা ওর জীবনের সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়ে ওকে মরা মাছের মতো করে ফেলে— চাই না এসব কাব্যের জীবনে।

কাব্য আগে ভালো ছিলো; ভীষণ ভালো ছিলো। কেন কুহু ওকে সেদিন প্রপোজ করলো? কেন কুহু এভাবে ওর জীবনের সবটা ঘেটে দিল? কুহু কেন ওকে ভালোবাসলো? কে বলেছে কুহুকে ভালবাসতে? কেন কুহু এতটা ভালোবেসে এখন মুখ ফিরিয়ে নিলো? কুহু এতটা স্বার্থপর! এতটা…! কাব্যের জীবন থেকে স্বার্থপরের মতো চলে গেল; সাথে নিয়ে গেল কাব্যের সমস্ত সুখ; দিয়ে গেল এই পাগল করা, বি ষের মতো অস্থিরতা!
কাব্য দুহাতে মাথার চুল খামচে মেঝেতে পাগলের মতো অস্থির আচরণ করতে থাকে। ওর কেমন বোধ হচ্ছে— সেটা ও কাউকে বলতে পারবে না। কেউ বুঝবে না ওর এত অস্থিরতার কারণ। কেউ বুঝবে না— কেন ও এই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এটা কি স্রেফ কুহুকে হারিয়ে ফেলার জন্যে? কেন? ও তো তাই চাইত! তাহলে কেন; কেন কেন?
কুহু চলে যাক: কুহুর স্মৃতি কাব্যের মাথা থেকে মুছে যাক। সঙ্গে মুছে যাক— সিয়ামের কুহুকে জড়িয়ে ধরার উল্লাসের স্মৃতিটুকুও।

শামিমার অস্থির লাগছে। ছেলেটার কি হলো হঠাৎ? কাউকে তো কাব্য কোনদিন বলবে না; প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট ছেলে ও। শামিমার হুট করে মনে পড়ল কিছু। উনি দরজায় আর ধাক্কালেন না। দৌড়ে গেলেন নিজের ঘরে।
কাব্যের রুমের এক্সট্রা চাবি এনে দরজা খুলে দেখলেন— কাব্যের ঘর আর ঘর নেই, ইতিমধ্যে ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে।আর কাব্য মেঝেতে পাগলের মতো মাথার চুল খামচে ধরে মাথাটা নিচু করে স্থির বসে আছে।
শামিমা ঘরের এহেন করুন অবস্থা দেখে আতকে উঠেন—— ‘আল্লাহ! এসব কি করেছিস কাব্য?’
কাব্য মেঝেতে বসা; ও শামিমার গলা শুনে এইবার মাথা তুলে টলমলে, পাগলাটে চোখে তাকাল মায়ের দিকে। ও কি করুণ দৃষ্টি!

শামিমার বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠলো? উনি দৌড়ে কাচ ডিঙিয়ে কাব্যের পাশে এসে বসলেন। কাব্যের মুখটা ধরে আগলে বললেন —— ‘এই আব্বু? আব্বু? কি হয়েছে তোর? এমন পাগলামি কেন করছিস? ভার্সিটিতে কিছু হয়েছে? বল মা-কে!’
কাব্য নিজের মুখ হাতের আঁচল থেকে সরিয়ে নিয়ে ধীর গলায় জবাবে বলল —— ‘কিচ্ছু হয়নি; তুমি এ রুম থেকে যাও প্লিজ। আমাকে একা থাকতে দাও একটু; প্লিজ আম্মু।’
শামিমা নাছোরবান্দার ন্যায় বললেন——-‘না; আমি যাব না। তুই আমাকে বল এসব হচ্ছেটা কি? আমার ছেলে তো এমন না।’

কাব্য এইবার রেগে গেল; শামিমার দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বললি———‘প্লিজ গো আম্মু। লিভ মি অ্যালোন। তুমি অন্তত আমার উপর একটু রহম করো; একটু দয়া করো। আমাকে একটু একা ছাড়ো; প্লিজ।’
কাব্য কথাটা বলে রাগ নিয়ে মাথাটা নিচু করে স্থির বসে রইলো।
কাব্যের এত কাতরটা দেখে শামিমার চোখে এবার জল চলে এলো। উনি হঠাৎ কাব্যের হাত দেখতে পেলেন। রক্ত পড়ছে কাব্যের হাত থেকে। সেদিন মাত্র এত বড় একটা চোট পেল হাতে, আর এন আবার!
শামিমা অস্থির হয়ে পুরো রুমে ফার্স্ট এইড খুঁজতে খুঁজতে বললেন —— ‘দু’দিন হয়নি হাত কেটেছিস; আজ আবার এসব পাগলামি করে হাতের উপরে জুলুম করে যাচ্ছিস। কি যে হয়েছে তোর।’
শামিমা ফার্স্ট এইড বক্স এনে কাব্যের পাশে বসলেন। কাব্যের হাত টান দিতেই কাব্য ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল —— ‘লাগবে না, আমি ফাইন। তুমি প্লিজ রুম থেকে যাও আম্মু, আমার ভালো লাগছে না এসব।’

শামিমা এবার কঠোর গলায় বললেন —— ‘ভালো না লাগলেও আমাকে এই রুমে থাকতে হবে। কারণ আমি তোমার মা, আমি তোমাকে কষ্টে দেখতে পারি না।’
শামিমা কথাটা বলে কাব্যের আগের ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। এতক্ষণ কাব্য চুপচাপ বসে থাকল। শামিমা কাব্যের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতেই সাথেসাথেই কাব্য এবার কথা বলল —— ‘শেষ? এবার যাও প্লিজ।’
শামিমা কঠোর গলায় বললেন —— ‘না আমি যাব না। তোমার কি হয়েছে আমাকে বলবে তুমি। আমার ছেলে কষ্ট পাবে, আর আমি মা হয়ে সেটা দরজার বাইরে থেকে দেখতে পারবো না। তুমি আমাকে বলবে— তোমার হয়েছেটা কি? আমার কাব্য আগে এতটা শান্ত ছিলো:সে এখন এমন কেন করছে? সেটা নিয়ে আমার কি সন্দেহ করা উচিত না?’

কাব্য কিছু বলল না। এখানে বলার কিইবা আছে। কাব্য তাই জেদ দেখিয়ে চুপ করে বসে রইল। শামিমা এবার কঠোর মুখটা নরম করেন। আলগোছে কাব্যের চুলটায় হাত বুলিয়ে দরদী গলায় বললেন —— ‘এমন পাগলামি কেন করছিস কাব্য? বাচ্চা, আম্মুকে বল? আমি চেষ্টা করি তোর জন্যে কিছু। আমি আমার কাব্যকে এভাবে দেখতে পারছি না। মায়ের কষ্ট হচ্ছে আব্বু।’
কাব্য তাকালো মায়ের দিকে। পরক্ষণে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। একদৃষ্টিতে অন্যদিকে চেয়ে রইল চুপচাপ। শামিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের ঘন, ব্ল্যাকিশ ব্রাউন চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কাব্য মায়ের কোলটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে থাকল।

একপর্যায়ে শামিমার কোলে মাথা রেখেই, কাব্য জোরে একটা শ্বাস টেনে বলে——‘আজকে; এই ঘরে যা হয়েছে— একটা কথাও যেন উপরতলায় না যায় আম্মু! যদি আমি শুনি যে তোমার আদরের ভাইজি কিচ্ছু জেনেছে—আমি তাহলে চলে যাব বাড়ি ছেড়ে। প্লিজ আম্মু আজকের ঘটনা সিক্রেট রেখো; প্লিজ আমার কথাটা একটু রেখো।’
কাব্যের ওই এক কথায় শামিমা মুখে কুলুপ এটে ফেললেন। তাকে ভুলে যেতে হলো— এই বাড়িতে; তাদের ফ্ল্যাটে আজ কি ঘটেছে? সবটাই; মুহূর্তের মধ্যে— একমাত্র ছেলের জন্যে।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৪

শামিমা কাব্যের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কাব্যও চুপচাপ মায়ের কোলে মাথা রেখে বসে আছে মেঝেতে। ওর দৃষ্টি শান্ত; এক দৃষ্টিতে মাটিতে পরে থাকা ফ্যামিলি ফটোটার দিকে চেয়ে আছে তখন থেকে।
হঠাৎ শামিমা কাব্যের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে বসলেন———‘মেয়েটা কে কাব্য?’
কাব্য অবাক হয়ে গেল;আচমকা মাথা তুলে তাকালো শামিমার দিকে। শামিমা ভীষণ স্বাভাবিক গলায় বললেন——-‘কাকে ভালোবাসিস? কে ওই লাকি মেয়েটা, যে আমার কাব্যকে এতটা পাগল করে ছেড়েছে? কে, মেয়েটার নাম বল আম্মুকে।’

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৬