ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৭
অবন্তিকা তৃপ্তি
‘ড্রিম স্কোয়ার রিসোর্ট’, দুপুর ৩:৩২. . .!
মেয়েদের এক দল কানামাছি খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের মেয়েরা সবাই যে যার ওড়না গিট্ দিচ্ছে, সবার মধ্যেই একটা তেজি-দীপ্ত ভাব— ভীষন হই-হল্লোর করে খেলতে নেমেছে এরা।
অবশ্য মনমরা হয়ে বসে থাকা এক চরিত্র কুহু এসবে থাকতে চায়নি।ওদিকে শার্লিন তো ভীষণ এক্সসাইটেড। ও জোর করেই টেনে খেলায় আনল কুহুকে। কুহু ওতো করে মানা করলো, রাগ দেখালো কিচ্ছুটি শুনলো না শার্লিন। কুহুকে টেনে এনে তারপর নিজেই কুহুর ওড়না সুন্দর করে কোমরের দিকে গিট্ দিয়ে সাথে নিজেরটাও দিল। কুহু ওদিকে চুপচাপ ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে আছে শার্লিনের পাশে। সবার সামনে সিনক্রিয়েটও করতে পারছে না, নাহলে এই শার্লিন আজ ওর হাতে অবশ্যই-অবশ্যই একটা চড় খেত।
মেয়েরা কাব্যের ঢাকা থেকে বাসে করে বয়ে আনা স্পিকারে লাউড ভলিউমে গান চালিয়ে দিয়েছে; গানের তালে খেলাটা ভালো জমবে এইবার।
গান চলছে স্পিকারে—
‘ওরে বাংলাদেশের মেয়েরে তুই
হেইলা দুইলা নাচে~
চোর হয়েছে সবার আগে দীপ্তি, রোল ১০১! ওর চোখ ওড়নায় বেঁধে দেওয়া হলো। দীপ্তি খুঁজছে হাতিয়ে হাতিয়ে বাইকে; সবাই এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে— কেউ-কেউ দীপ্তিকে ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দিচ্ছে, চেতিয়ে দিচ্ছে ওকে! দীপ্তি রেগেমেগে তখন আবার ওদিকেই ছুটে যাচ্ছে।
খেলতে খেলতে কুহুও কেমন যেন মিশে গেল ওদের সঙ্গে; ও হেসে হেসে দীপ্তির থেকে দূরে দূরে দৌড়াচ্ছে। ওর খোলা চুল উড়ছে দমকা হাওয়াতে! ঠোঁটে বহুদিন পর মিষ্টি এক হাসি ঝুলছে। ঠিক কতদিন পর হাসল কুহু? কুহু হয়তোবা নিজেও জানে না। শার্লিন খেলতে খেলতে অপলক কুহুকেই সেই কখন থেকে দেখছে; বহুদিন পর; যেন বহু বছর পরে ওর ঠোঁটের হাসি দেখছে— এতে যেন শার্লিনের বুকের ভার অনেকাংশেই কমে গেছে। কুহুর ঠোঁটের হাসি- ছড়িয়ে পড়েছে স্বভাবসুলভ শার্লিনের ঠোঁটেও। শার্লিন মৃদু হেসে এবার চেঁচিয়ে দীপ্তিকে বলে উঠলো——— ‘দীপ্তি; তোর ডান পাশেই কুহু; ধর ওরে, ধর ধর!’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কুহু সেটা শুনেই চমকে উঠলো যেন। শার্লিনের বলার সাথেসাথে সতর্ক হয়ে দৌড়ে পালাতে যাবে; তার আগেই দীপ্তি ছুটে এসে ওকে ধরে ফেলল। কুহুকে দীপ্তি ঝাপটে ধরে রেখেছে, কুহু ওদিকে হতবাক। দীপ্তি ওকে ধরেই চোখ থেকে ওড়না খুলে কুহুর দিকে চেয়ে জোরে লাফিয়ে লাফিয়ে বলল———‘চোর, চোর। কুহু চোর এবার।’
কুহু ভোঁতা মুখ নিয়ে শার্লিনের দিকে তাকালো; শার্লিনের ওসবে পাত্তাও পেল না। শার্লিন রাক্ষসের মতো হাসতে ব্যস্ত তখন। কুহু ওর হাসি দেখে গা পিত্তি অব্দি যেন জ্বলে উঠল। নিজে টেনে এনে এই কাণ্ড করলো তো শার্লিন. .!
কুহু শার্লিনের দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল——— ‘আমার নেক্সট টার্গেট তুই শার্লিনের বাচ্চা। মনে রাখিস। এক মাঘে শীত যায়না।’
শার্লিন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হেসে বলল——— ‘দেখা যাবে। আগে তো ধর।’
কাব্য এদিক থেকেই যাচ্ছিল তখন। রাতের বারবিকিউ পার্টি করা হবে, সেই উপলক্ষে সব ম্যানেজমেন্টের হেড হচ্ছে কাব্য। তাই ও বলে দিচ্ছিল কিভাবে কি করতে হবে। ভীষণ ব্যস্ত মানব শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্যের পা হঠাৎই, আচমকা থেমে গেল কারোর ‘শার্লিনের বাচ্চা’ বলে গালি দেওয়াতে। কাব্য থামলো, কথা বলতে বলতে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। কুহু মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে আছে; ওর চোখে কাপড় বাধা হচ্ছে। কুহুর ওই গোলগাল, রাগী মুখটা দেখে কেন যেন কাব্য নিঃশব্দে হেসে উঠল কপাল চুলকে। ওর পাশে একজন জুনিয়র কথা বলছিল; কাব্যকে হাসতে দেখে অবাক হলো হয়তবা———‘ভাইয়া? আর ইউ ওকে?’
কাব্য চোখ সরালো; ঠোঁটে ওভাবেই চাপা হাসি ঝুলিয়ে জুনিয়রকে বললো———‘ওদিকটা ম্যানেজ করো, আ’ম কামিং।’
জুনিয়র মাথা দুলিয়ে চলে গেল, যাবার আগে নিজেও একবার কুহুদের কানামাছি খেলার দিকে তাকালো। এই মেয়েদের দলের মধ্যেই নিশ্চয়ই বড় ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে—- তাই বোধহয় ওভাবে দেখছিল। ব্যাপারটা তো খতিয়ে দেখতে হবে। কাব্য ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড অর্থাৎ ভার্সিটির টপ নোচ নিউজ— এই নিউজ ও সবার আগে খুঁজে বের করবেই করবে।
কুহুকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। এবার শুরু করলো হাতড়ে হাতড়ে চোর ধরার পালা। শার্লিন ওদিকে-এদিকে দৌড়ে কুহুকে চেঁচিয়ে ডাকছে: পরপর কুহুকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে, দ্রুত আবার সরে যাচ্ছে— তার জন্য কুহুর মেজাজ আরো খারাপ হচ্ছে। কুহু ইচ্ছে করেই সবাইকে ছেড়ে শার্লিনের ডাকের দিকে ছুটছে— শার্লিনও এতে ভীষণ মজা নিচ্ছে। কুহু হাপিয়ে যাচ্ছে— তবুও ছুটছেই। বাকিরাও কুহুকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে চিয়ার্স করছে।
কাব্য ওদের থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে কুহুর কানামাছি খেলা দেখছিল। কুহুকে পুরোপুরি এক বাচ্চা মেয়ে দেখাচ্ছে এখন, ঠিক এই খেলাতে। কুহু বহুদিন পর, আজ একটা বছর পর হাসছে সদ্য ষোড়শী সেই কিশোরী কুহুর ন্যায়; কী সুন্দর করে হাসিখুশি খেলছে। কাব্য তাকিয়েই রইল অপলক— কেন যেন দু কদম এগিয়েও পিছিয়ে গেল— এগুতে পারলো না। বরফকুণ্ডের ন্যায় জমে উঠে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাড়ালো।
কুহুর অবাধ্য চুল বারবার চোখে-নাকে পড়ছে। কুহু বিরক্ত হয়ে বারবার ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে ওর চুল— কাব্য মাথা নিচু করে নিশব্দে হেসে উঠল সেটা দেখে।হাতের বদলে ফুঁ? দৃশ্যটা ইন্টারেষ্টিং!
কাব্য আরাম করে এবার একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বুকে আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে কুহুর খেলা দেখায় মন দিয়েছে। আশপাশের খবর ওর আর মাথাতেও নেই। পুরো মাথাটা জুড়ে, মস্তিস্ক; হৃদয়-তন-মনে শুধু কুহুই থেকে গেছে, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ওকে যেন।
তানিম পাশ দিয়েই যাচ্ছিল তখন। কাব্যকে এভাবে মৃদু হেসে; আরাম করে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তানিম কিছুক্ষণের জন্যে থামলো। কাব্য ওমন মেয়েদের গ্রুপের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে তানিম হঠাৎই ভ্রু কুঁচকালো তানিম। কী দেখছে কাব্য এত?
ও কাব্যের চোখের ইশারা অনুযায়ী তাকাল সামনে। তারপরেই তানিমও বাকা হেসে উঠল। ওহ, কুহু এখানে। এইজন্যেই জনাব এমন করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন, বাহ!
তানিম হাসল; এবার পালা কাব্যকে নিয়ে মজা উড়ানোর। তানিম এই সুযোগ কি কোনদিন মিস করতে পারে?
তানিম ধীরে ধীরে কাব্যের পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিজেও গাছের সাথে হেলান দিয়ে কুহুর খেলা দেখতে লাগলো। কাব্যের চোখের দিকেও একবার তাকালো; এর পলক অব্দি পড়ছে না। হায়রে প্রেম; হায়রে দহন! দীর্ঘশ্বাস ফেলল তানিম।
তারপর আবার সোজা হয়ে দাড়িয়ে কাব্যের কানের কাছে ফিসফিস করে শুনিয়ে বলতে লাগল———— ‘কুহুকে অনেক সুইট লাগছে, তাই না?’
কাব্য কিছু বলল না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চুড়ান্ত আবেগে, দিশেহারার ন্যায় শোনাল ওর গলা———-‘ইয়া-হ! লাইক এ র-স-গো-ল্লা!’
তানিম উত্তরের ধরন শোনেই কেশে উঠল। পরপর কাশতে কাশতে নিজেকে সামলে নিলো। ভ্রু কুচকে বিরক্ত হয়ে একবার কাব্যকে দেখে বললোও———‘কে বলবে এ নিরামিষ! আমার সামনেই কুহুজে নিয়ে এমন কমেন্ট! কিয়ামত আসার আলামত। যাকগে।’
পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে তানিম কাব্যের কানের কাছে আবারও ফিসফিস করে বললো ———— ‘কুহুর হাসি!’
কাব্য এবার কুহুর দিকে স্থির চেয়ে থাকতে থাকতে দিন-দুনিয়া ভুলে বিড়বিড় করল——— ‘মা-রা—ত্ম-ক!’
তানিম এবার পেট ফেটে হাসি আসছে। ও হাসি চেপে রেখে কাব্যের কানের কাছে এবার একটু জোরেই আওয়াজ করে বলল——— ‘এই মায়াবী মুখের হাজবেন্ড যে হবে— সেই ছেলেটা ভীষণ লাকি হবে। যেমন সিয়াম।’
ব্যাস! কাব্যের ধ্যান সম্পূর্ণ মুছে গেল। ও হঠাৎ, আচমকা তীক্ষ্ণ চোখে তানিমের দিকে তাকাল। তানিম ভীষণ স্বাভাবিক চোখে কাব্যের সকে চেয়ে আছে। কাব্য মহা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে বেহাল দশা। ও তানিমের দিকে খেয়ে ফেলার মতো লুক দিয়ে বলল——— ‘সিরিয়াসলি? সিয়াম?’
তানিম অবাক হবার ভান করে বলল——— ‘কি সিরিয়াসলি? সত্যিটাই তো বললাম। সিয়াম না কুহুর বয়ফ্রেন্ড; কুহুর হাজবেন্ডই তো তাহলে ওই হবে- সাইন্স তো তাই বলে।’
কাব্য তানিমের কাঁধে এবার হঠাৎ জোরে ওর হাতটা রাখল; তানিমের মনে হলো ওর ঘাড়টাই বোধহয় ভেঙে যাবে। তানিম শুকনো হেসে ব্যথাতুর ভঙ্গিতে সরে যাবার চেষ্টা করতেই, কাব্য আরও শক্ত করে চেপে ধরে ওর ঘাড়টুকু দুহাতে শক্ত একেকটা চাপ দিতে দিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল——— ‘সাইন্স না? নেক্সট… নেক্সট টাইম সিয়ামের নাম মুখে আনলে——ফিজিক্স; কেমেস্ট্রি, বায়োলজির স্পেশাল একটা ক্লাস নিবো তোর উপর— হু? মনে থাকবে?’
তানিম সবটাই বুঝে দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল——‘আর বলব না ভাই।’
কাব্য ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিতে নিতে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে শাসিয়ে বলল——— ‘গুড! মনে না রাখলে—- তুই আর ওই তোর সিয়াম— দুটোকেই মেরে এই হাওরে ফেলে রেখে যাব। হু?’
বলে কাব্য ঠোঁট টেনে হেসে তানিমকে ছুড়ে ফেলার মতো ধাক্কা দিল। তানিম পিছিয়ে গিয়ে হতাশ চোখে কাব্যের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের কথার মধ্যে হঠাৎ একটা সিনিয়র ভলান্টিয়ার আপু খেলার মধ্যে ডেকে উঠলেন——— ‘এই কাব্য; তোর স্পটিফাই প্লেলিস্টটা দিয়ে যা ভাই।’
তানিমকে আরেকবার চোখের ইশারায় শাসিয়ে কাব্য হনহনিয়ে এগিয়ে চলে গেল। কুহু তখন শার্লিনের পেছনে ছুটছে। কাব্য কুহুর দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছিল অর্থাৎ স্পিকারের দিকে। হঠাৎ শার্লিন কাব্যের এদিক থেকে যেতেই কুহু হঠাৎ ছুটতে ছুটতে কাব্যের সাথে জোরে একটা ধাক্কা খেল। ধাক্কা খেয়ে কুহু ঠাস করে পড়ে যেতে নিলে নিচে কাব্য আচমকা সচকিত হয়ে তাড়াহুড়ো করে কুহুর কোমরখানা চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে মিশিয়ে নিল।
কুহু ভয়ে কাব্যের শার্টের আস্তিন খামচে ধরে ওর বাহুতে মুখ লুকিয়ে জোরে শ্বাস ফেলছে। কাব্য মাথা নিচু করে দেখল— ওর পুরো বুকে কুহুর চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কুহু মিষ্টি একটা চোরের মতো কাব্যের বিশাল বাহুতে মুখটা লুকিয়ে আছে ভয়ার্তের ন্যায়। কুহুর গায়ের মিষ্টি এক সুঘ্রাণ কাব্যের নাকে এসে ধাক্কা খেল কেমন যেন, কাব্য চোখ বন্ধ করে ও ঘ্রাণটাও টেনে নিল নিজের নাকে।
কুহুর কাছাকাছি এলে ইদানিং কাব্য আর নিজেকে সামলাতে পারে না একদম— কেমন যেন এলোমেলো-উলোট-পালোট হয়ে যায় ওর সমস্ত সত্তা!
ঠিক, আজও তাই হলো।
নিজেকে সামলে কুহু যখন বুঝতে পারলো, এটা একটা পুরুষের শরীর। ও চোখ বাধা থাকায় আতকে উঠেছে এই ভেবে যে—— এটা কি সিয়াম। কুহু সাথেসাথেই সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বিড়বিড়ালো—-—‘সি সিয়া——’
কুহু এতটা অনুভব করে সিয়ামকে? কাব্যের ভীষণ রাগ হলো।জেলাসিতে দগ্ন কাব্য এবার রেগে কুহুর কোমর শক্ত হাতে টেনে ধরতেই, কুহু মিশে গেল কাব্যের গায়ের সাথে আবারও। কাব্য ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে নিতে গমগমে স্বরে জানাল———‘ইট’স কাব্য! k A ডাবল B O, কাব্য!’
কুহুর বুক ধুকপুক করে উঠলো ওমন গম্ভীর; অথচ শাসনেই স্বর শুনে। ও আলগোছে মাথা তুলে কাব্যের দিকে তাকিয়ে ওকে অনুবব করার চেষ্টা করলো। চোখজোড়া বাঁধা ওর; ঠোঁটটা তিরতির করে কাঁপছে। কাব্য নাকের ডগায় রক্তিম—রাগ তখনও লেগে আছে; ও আলগোছে কুহুর চোখ থেকে কাপড় খুলে দিল। কুহু ধীরে ধীরে কাজল-রাঙ্গানো মায়াবী চোখ-দুটো মেলে চাইল কাব্যের ঠিক চোখের দিকে। দুজনের চোখে চোখ মিললো।
চোখ কি মনের কথা বলে? প্রেম কি জানে, প্রেমিকার চোখ প্রেমিককে ঠিক কতটা আহত করতে পারে? কিভাবে মন্ত্রপুতের ন্যায় বশীভূত করতে পারে? প্রেম কি জানে এসব বাণীকথা?
প্রেম বোধহয় জানে। তবে কুহু জানেনা এসব। কুহু ভুলে গেল সবটাই, ওর ঘৃণা, ওর ডিপ্রেশন, ওর সেই ছয় মাসের পুরনো একেকটা নিষ্ঠুর স্মৃতি। সবটাই ভুলে গেল। ও তাকিয়েই রইলো কাব্যের চোখের দিকে, যে চোখ— যেখানে কুহু একটাসময় ভালোবাসা নিয়ে তাকাত, সেই চোখে কুহু নিজের জন্যে দেখতে চেয়েছিলো অঢেল ভালোবাসার সাগর।
কুহুর ওই চোখ-দুটো কাব্যকে আবারও এলোমেলো করে দিল। হঠাৎ কি যে হলো?
শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য, এ গুড বয়—— ও আলগোছে কুহুর কানের পেছনে চুল গুঁজে দিয়ে—— একদম আচমকা মোহিত হয়ে; নেশাগ্রস্তের ন্যায় কুহুর কপালের ঠিক মধ্যখানে চরম আবেগে চুমু খেলো।
একটা চুমুই তো মাত্র। কেন যেন সঙ্গেসঙ্গে কুহু আঁতকে উঠল। চোখ বড়বড় করে তাকাল ওর কপালে ঠোঁট ছুয়ে রাখা কাব্যের ঠিক বন্ধ চোখের দিকে। কাব্য যেন নিজের মধ্যেই নেই। ওর সমস্ত ধ্যান ওই এক চুমুতেই যেন নিবদ্ধ হয়ে গেছে— একটা চুমু, বড্ড আশ্লেষের একটা চুমু— কাব্যের খা খাঁ করা বুকটার একটা ঠান্ডা চুমু— কুহুর ভেতরটাই নারিয়ে দিল যেন।
কাব্য এখনো কুহুর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আছে—— ওর হুশ নেই ও কি করছে। আকৃষ্ট হয়ে গেছে ও আপনা-আপনি কুহুর প্রতি! কাব্য বুঝে গেছে—- সর্বনাশ তখুনি ঘটে গেছে।
শেষ, ফিরে আসবার সমস্ত পথ তখুনি বন্ধ হয়ে গেল। প্রেমের দরজা খুকে গেল, ভালোবাসার টই-টম্বুর করে ঢেউয়ের ন্যায় কাব্যের দিকে এগিয়ে এলো। কাব্যও চরম আবেগে লুফে নিলো ওদের।
কিন্তু কুহু? ও? বড্ড দেরি হয়ে গেল শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য, বড্ড দেরি!
কুহু আচমকা অস্থির হয়ে, চুমুরত কাব্যকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল নিজের থেকে। কাব্য দু’পা পিছিয়ে যেতে যেতে কুহুর দিকে অবাক হয়ে এবার তাকালো।
কুহুর চোখে জল, কাব্য ওটা দেখল! কুহু কি কাঁদছে? কাব্য চুমু খেয়ে ফেলেছে দেখেই কি কাদল? এটা .. এটা কি করে ফেলল কাব্য?
কুহু টলমলে চোখে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে কাব্যের চোখের দিকেই একবার তাকালো না। মাথাটা নিচু করে কাব্যের হাত থেকে ওড়না জোর করে টেনে নিয়ে নিজের হাতে নিয়ে হঠাৎ দৌড়ে চলে গেল কাব্যের সামনে থেকে।
কাব্য কুহুর যাওয়ার দিকে তখনও অবাক চোখে চেয়ে; কুহু ওকে ধাক্কা দিয়েছে! কাব্য তো এটাই ভেবে পাচ্ছে না— ওর আচমকা হয়েছিলটা কি?
কুহু ওকে জড়িয়ে ধরার পর ওর এত অস্থির লেগেছিল কেন? কিসের কারণে? কুহু এতটা কাছে ছিল ওর, এতটা কাছে— ওর হার্ট? সেটা আজও এত ফাস্ট বিট করেছিলো, এখনো করে যাচ্ছে।
কাব্য জোরে একটা শ্বাস ফেলে নিজের বুকের বাঁ পাশ সেদিনের মতো খামচে ধরে মাথা নিচু করে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বারবার বলতে থাকে———‘স্টপ বিটিং সো ফাস্ট; ড্যাম! স্টপ দিস ননসেন্স! আই সে স্টপ।’
অদূরে শার্লিন দূর থেকে কাব্যের এসব দেখছিল। কাব্যের আজকের কুহুর প্রতি নজর: আজকে চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা ওর একটুও সুবিধার লাগে না। কাব্য ভাই… কাব্য ভাই কি কুহুকে ভালোবেসে ফেলেছেন? এটা কি ওর ভ্রম? নাকি সত্যি? কাব্য ভাই এতটা অস্থির…এটা কি প্রেমই? নাকি সবটাই শার্লিনের বোঝার ভুল।
কুহু কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে গেল হাওড়ের পাড়ে। সেখানে একটা গাছের নিচে হঠাৎ অসুস্থের ন্যায় বসে পড়ল। কুহু নিজের মধ্যেই নেই। ওর চোখে বারবার, বারবার ভেসে উঠছে কাব্য ভাইয়ের চুমু খাওয়া।
ও ওড়নাটা শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে সরে থম ভঙ্গিতে বসে থাকল অনেকক্ষণ। হাওড়ের পানির দিকে অপলক চোখে চেয়ে হঠাৎ কপালে ধীরে ধীরে কেন যেন নিজের আঙুলগুলো স্পর্শ করল। কাব্য ভাই ওকে সত্যি চুমু খেয়েছেন আজ! ওর কপালে কাব্য ভাইয়ের ঠোঁটের স্প….—.—
আর ভাবতে পারলো না কুহু। চোখ খিছে নিলো——-‘না; না। সবটাই স্বপ্ন ছিলো আমার। এসব…এজেব কিছুই হয়নি—- কিছু না।’
পরপর কুহু বিড়বিড় করে বলে———‘না, এ…এটা সত্যি! কিন্তু কে…কেন?’
কেন খেলেন ওই চুমু কাব্য ভাই? কুহু আবার কেন দুর্বল করে দিচ্ছেন সে? উনি ইচ্ছে করে কুহুকে শাস্তি দিচ্ছেন, তাইনা? তারপর দুজন মিলে আবারও কুহুকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে হাসি পাত্র বানিয়ে হাসবেন একে অন্যের সাথে।
এই একটা চুমু—— কাব্য ভাইয়ের কাছে সামান্য একটা শরীরী স্পর্শ হতে পারে। কিন্তু কুহুর কাছে তা নয়; তা নয় একদমই। কিন্তু কুহুর মন জানে, এই একটা চুমু—— কুহু এক জীবনে কখনো ভুলতেই পারবে না। কিভাবে নিষ্ঠুরভাবে কোনো অধিকারবিহীন গেথে দিলেন কাব্য ভাই একটা বিষের স্মৃতি ওর হৃদয়ে? এতটা নিষ্ঠুর, এতটা স্বার্থপর উনি।
কুহু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কেমন যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো। ওড়নার অগ্রভাগ দিয়ে কপালের ওই অংশ ঘষতে শুরু করল; সাথে পাগলের মতো বিড়বিড় করতে লাগল———‘লাগবে না এই চুমু আমার। মুছে যা, প্লিজ মুছে যা। কাব্য ভাই এভাবে তোকে দুর্বল করে আবার ভাঙতে চাইছেন কুহু—— তুই দিবি না সেটা করতে। মুছে ফেল সব স্পর্শের দাগ! কিছু হয়নি, একটা ছুঁটে কারোর হৃদয় ভাঙ্গে না কুহু—- তুই…কিছু হয়নু, কিচ্ছু না…কিছু…!’
কুহু কপাল ডলতে ডলতে হঠাৎ হুহু করে কেঁদে উঠলো। অসহায়ের মতো সম্পূর্ণ শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘাড় হালকা কাত করে চুড়ান্ত ভঙ্গুর গলায় বলে উঠল————‘এটা…এটা আপনি কি ক…করে ফেললেন কাব্য ভাই?’
কুহু হাঁটুর মধ্যে মুখটা গুঁজে কাঁদছিলো পাগলের মতো। হঠাৎ একটা হাত কুহুর কাঁধ স্পর্শ করতেই কুহু ধীরে ধীরে কান্নাভেজা মুখটা তুলে তাকালো পাশে। শার্লিন ভীষণ স্বাভাবিক মুখভঙ্গি নিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুহু শার্লিনকে দেখেই ঠিক এতক্ষণে ভাঙতে পারল বুঝি ভালো করে। ও আচমকা দুহাতে শার্লিনকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজলো। তারপরেই জোরে কেঁদে উঠলো, শার্লিনও সাথেসাথেই দ্রুত আগলে নিল কুহুকে। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে কিছু একটা ভাবছে শার্লিন।
কুহু কাঁদতে কাঁদতে বলল————‘কাব্য ভাইকে আমি কোনদিন ভুলতেই পারছি না শার্লিন, উনি…উনিও জানেন সেটা। তারপরেও…তারপ্পীও জেনেও কেন আমার এতটা কাছে আসেন? আমি সামলাতে পারি না বারবার নিজেকে। কেন করেন উনি এসব শার্লিন। কেন? কিসের অন্যায় শাস্তি উনি আমাকে দিচ্ছেন শার্লিন? আমি…আমি একটু ভালো থাকতে চাই শার্লিন, কেন পারছি না আমি ভালো থাকতে, কেন কেন?’
কুহু কেদে কেদে কেপে উঠছে। ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে শার্লিন হঠাৎ বলে উঠল———‘কাব্য ভাই বোধহয় তোকে ভালোবাসেন কুহু।’
এই একটা কথাতেই কুহুর কান্না থেমে গেল আচমকা! ও মাথা তুলে শার্লিনকে ছেড়ে মুখের দিকে দিকে তাকাল, কিছু বুঝতে বা পেড়ে অবাক হয়ে বললো——‘মানে?’
শার্লিন কিছুটা ভাবুক গলায় বলল———‘জানি না; তবে আমার এই মুহূর্তে ফিলিংস হচ্ছে যে কাব্য ভাই লাভস ইউ। জানি না এটা কতটুকু সত্য, যতক্ষণ না উনি মুখে স্বীকার করছেন।’
কুহু তাকিয়ে রইল চূড়ান্ত হতবাক হয়ে; পরপর ও চুড়ান্ত বিতৃষ্ণায় মুখটা ঘুরিয়ে বলল———‘কখনও সম্ভব না এটা। উনি নিজে বলেছিলেন——’
‘মানুষ বদলায় কুহু; তার ফিলিংসও বদলায়!’ —— শার্লিন কুহুকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো।
কুহু আবারো তাকাল শার্লিনের দিকে; ওর চোখে এখনও অবিশ্বাস!
শার্লিন বোধহয় বুঝতে পারলো সেটা। ও এবার কুহুর পাশে গাছের নিচে বসলো। তারপর আরাম করে একটা করে পাথর হাওড়ে ফেলতে ফেলতে বলে গেল———‘তুই ঐখানে কাব্য ভাইয়ের সাথে ছিলি—— আমিও ছিলাম তোর ওইপাশে। আমি দেখেছি কুহু—— জানি না বিশ্বাস করবি কি না—— কাব্য ভাইয়ের তাকানো ইট ওয়াজ ডিফারেন্ট ইয়ার। কেমন যেন… অন্যরকম চোখে তোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তোর মুখ; তোর চুল হাত দিয়ে ধরা; তোর সবকিছু—— উনি কেমনভাবে যেন সব মনে হচ্ছিল ফিল করছিলেন। সামথিং ইজ রিয়েলি ফিশি কুহু।’
কুহু অবাক হয়ে শার্লিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর সাথেসাথেই নাকচ করে বললো——‘সম্ভবই না। এবার তুই আমাকে ইনফ্লুয়েন্স করছিস। তোর দেখার ভুল হবে। কারণ আমি জানি উনি কেমন। এটা…আমাদের মধ্যে এসব পসিবল না আর। আর ঊর্মি আপু——’
শার্লিন নিজেও এবার চিন্তিত হয়ে উত্তর দিল———‘এটাই তো আমারও মাথায় ঢুকছে না। ঊর্মি আপু কাব্য ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। তারপরেও যদি উনি তোকে ভালোবেসে ফেলেন—— আমি বলব উনি তোর যোগ্য না। কয়টা মেয়ে বদলানো লাগে উনার? যদি এখন ঊর্মি আপুকে ছেড়ে তোর কাছে; তোর জন্য উনার ফিল আসতে পারে—— একসময় তুই পুরনো হয়ে গেলে উনার অন্য কারো জন্য ফিলিংস যদি চলে আসে?’
কুহু শুনলো চুপচাপ।
আসলে কুহু এক বছর আগের কাব্য; আর এখনের কাব্যের সাথে কোনো মিল খুঁজে পায়না। এক বছর আগের কাব্যের প্রতি ছিলো কুহুর অগাধ বিশ্বাস, ভরসা। শার্লিন একথা তখন বললে কুহু বলতো—- কাব্য ভাই এতটাও খারাপ নয়। কিন্তু এখন?
যে মানুষটা কুহুর সাথে ঘটা ছোট থেকে ছোট বিষয় নিজের সাইকো-টক্সক গার্লফ্রেন্ডকে বলে দিতে পারে, তারপর দুজন মিলে কিনা নিজেরই আপন চাচাতো বোনের মানসিক সমস্যা, ওর অনুভূতি নিয়ে মজা নিয়ে হাসতে পারে— আর যাই হোক- সেই কাব্যকে এখন কুহু এক ফোটাও বিশ্বাস করেনা।
কুহুর তাই না চাইতেও শার্লিনের কথা মাথায় নিয়ে নিলো।
কুহুকে চুপ করে থাকতে দেখে শার্লিন কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল; কুহু তাকাল শার্লিনের দিকে। শার্লিন বলল———‘একবার মরা ভালো কুহু; সামলানো যায় নিজেকে। একই মানুষের হাতে বারবার মরা যায় না কুহু। তখনকার জখম কখনও কোনও কিছু দিয়ে আর ভরাট করা যায় না। আমি কাব্য ভাইকে অবজার্ভ করব— দেখি কি রেজাল্ট আসে। তুই আপাতত ট্যুর এনজয় কর, হু?’
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৬
কুহু শার্লিনের দিকে তাকিয়ে রইল; তারপর আবার হাওড়ের দিকে তাকালো।
বিকেল হয়ে যাচ্ছে। মাগরিবের আজান পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। শার্লিন এবার গাছের নিচ থেকে উঠলো। কুহুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল———‘উঠে আয়; মাগরিবের সময় বাইরে থাকা ঠিক হবে না।’
কুহু চুপচাপ শার্লিনের হাতটা চাপল; উঠে এলো গাছের নিচ থেকে। চলে যেতে পা বাড়াতেই শুনতে পেল—- কেউ যেন পেছন থেকে ওকে ডাকলো। কুহু পেছনে ফিরে একবার তাকিয়ে দেখলোও, কেউই নেই। আবে সামনে তাকিয়ে চলে যাবে: মনে হলো আবারও কেউ যেন ডাকলো।
কে সে?