ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৪

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৪
অবন্তিকা তৃপ্তি

‘ভাইজান, এভাবে এত তাড়াহুড়ো..? পরশু যেখানে বিয়ে হচ্ছেই তাহলে এত দ্রুত..’
বড্ড বেশি অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল সাদাত। কাব্যকে উনার মেয়ে জামাই হিসেবে ভীষণ পছন্দ। তাই বড় ভাইয়ের এক কথাতেই মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এখন আবার আনোয়ারের এত তাড়াহুড়ো বাবা হিসেবে ভালো ঠেকছে না উনার কাছে।

সাদাত যখন বিয়ে দিতে হেজিটেশন করছেন, ঠিক তখন স্নিগ্ধ এগিয়ে এলো। সাদাতের পাশে বসে ভীষণ শান্ত কণ্ঠেবুঝিয়ে বললো———‘চাচ্চু, ভাই আর কুহু, দুজনের মধ্যে কিছু ইন্টারনাল প্রবলেম ক্রিয়েট হয়েছে। ভাইয়ের মতে বিয়েটা যেহেতু পরশু হবে বলে ঠিক করা হয়েছে, তাহলে আজই হোক।’
‘ইন্টারনাল প্রবলেম মানে?’ — সাদাত হকচকিয়ে উঠলেন যেমন।
স্নিগ্ধ সঙ্গে সঙ্গেই তাকে শান্ত করতে বলে উঠল———‘বাচ্চাদের ব্যাপার চাচ্চু, নিতান্তই বাচ্চামো প্রবলেম। ভাই সেটা সলভ করতে চাইছে বলেই তাড়াহুড়ো করে আব্বুকে পাঠিয়েছে।’
সাদাত আনোয়ারের দিকে তাকালেন। পাশ থেকে শাদাফ ভীষণ রসিক কণ্ঠে বলে উঠলেন——‘আরে ভাইয়া, কিসের এত দুশ্চিন্তা তোমার? উপরের ফ্ল্যাটেই তো থাকবে কুহু। আর কাব্য তো নিজের ছেলে আমাদের, বিয়েটা যেহেতু করে ফেলতে চাইছে,নিশ্চয়ই ও বুঝেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আমার মনে হয়। আর কুহুকে তো তুমি ভালো চেনো। আমার মতে কুহুর আবার কোনো ক্ষতি হবে বলেই কাব্য এত তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছে। তুমি অযথা টেনশন করো না। বিয়েটা দিয়েই দাও; কি বলেন বড়ভাবী?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাদাত মাথাটা নিচু করে শুনলেন স্রেফ। কাব্যের মা শামিমা এবার কথা বললেন, নরম কণ্ঠে সাদাতের দিকে চেয়ে বললেন———‘ছেলের বিয়ের জন্যে তেমন কেনাকাটা করা তো হয়নি ভাই। রিসেপশনে আমার মেয়েকে আমি সুন্দর করে সাজিয়ে আবার নাহয় ঘরে তুলব। আপাতত আমার বিয়ের বেনারসি দিয়ে কুহুকে সাজিয়ে বিয়েটা পড়িয়ে ফেলি। আর সোনার হিসেব চাইলে ভাইয়া, তোমার মেয়ের জন্যে কতটুকু সোনা চাও তুমি আর মেঝো বলো। আমি আর কাব্যের বাবা কিনে আনছি।’
শামিমার এই কথাতে সঙ্গে সঙ্গেই কুণ্ঠিত হয়ে গেলেন সাদাত——‘ছিঃ, ছিঃ! ভাবি, দেনাপাওনার কথা এখানে কেন আনছেন টেনে?’

শামিমা হকচকালেন না। বুদ্ধিমতির ন্যায় সবটা সামলে নিতে বললেন——‘আরে, লজ্জা পাচ্ছো কেন? কুহু তোমাদের একমাত্র মেয়ে। কেমন আদরে ওকে বড় করেছো তোমরা দুজন, সেসব আমাদের তো চোখেই দেখা।তোমাদেরও নিশ্চয়ই ওর বিয়ে নিয়ে শখ আহ্লাদ আছে।’’
কবিতা এবার পাশ থেকে উত্তর দিলেন, নম্র কণ্ঠে শোধালেন ——‘আছে আপা। কিন্তু এও বিশ্বাস আছে সাথে— কুহু আপনাদের ঘরে যাচ্ছে যেখানে ও রাজরানীর মতো থাকবে। আর নিজেদের মধ্যে বিয়েতে দেনাপাওনা কীসের? তোমাদের মেয়ে বউ হয়ে তোমাদের ঘরেই যাচ্ছে, আমাদের এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই।’
শামিমা মৃদু হাসলেন। পরপর সঙ্গে সঙ্গে নিজের গলা থেকে তিন ভরির সোনার চেইন খুলে এগিয়ে এসে কবিতার হাতে ধরিয়ে দিলেন, কবিতা তো সম্পূর্ণ নির্বাক।

শামিমা সোনার চেইনটা দিয়ে বললেন———‘বৌমা যেহেতু, তাই বৌমার ফরজ আদায় করি শাশুড়ি হিসেবে। মুখ দেখে সোনা দেবার রেওয়াজ আছে আমাদের বাড়িতে। এ বাড়ি নেই অবশ্য সেটা। আমি আমাদের বাড়ির পুরনো রেওয়াজ পূরণ করলাম, মানা করিস না।’
কবিতা ছলছল চোখে তাকালেন শামিমার দিকে, পাওয়ার চেয়ে বেশি পেয়েছেন মেয়ের জন্যে- এটুকুও যে সুখের সাদাত-কবিতা দম্পত্তির জন্যে।
সাদাত এবার কথা তুললেন——‘কুহুকে রাজি করানোটা কষ্টের হবে। তবুও চেষ্টা করি আমরা।’
তারপর কবিতার দিকে চেয়ে বললেন——‘মেয়েকে নিয়ে আসো।’
ঠিক এইবার কবিতার মুখটা পাংশু হয়ে গেল। দুপুরেই কুহু প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে কবিতাকে বলেছিল— সে এই বিয়ে করবে না। অনেক কষ্টে মেয়েকে বুঝিয়ে রেখে এসেছেন তখন। এখন আবার এসব শুনলে কুহু কুরুক্ষেত্র করে ফেলবে।
কবিতা একবার অসহায় চোখে তাকালেন সাদাতের দিকে। হয়তো সাদাতও বুঝলেন সেটা। চোখের ইশারায় স্রেফ আশ্বাস দিয়ে পাঠালেন মেয়ের ঘরে। এরই মধ্যে সবাই কাজী আর বাকিসব কিছুর আয়োজন করে ফেলবেন।

তারপর ভীষণ এক যুদ্ধ হলো কুহুদের ফ্ল্যাটে। কুহু এসব শুনেই রেগেমেগে সোজা বাথরুমে ঢুকে বসে রইলো। কবিতা তো কথায়হাত। মেয়ে এসব পাগলামি করছে শুনলে শামিমা আর বড় ভাই কষ্ট পাবেন। হায়, এই পাগল মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন কবিতা? কিছু বুঝে না, এতটা অবুঝ নাদান কেন এই পাগল মেয়ে?
কবিতা বাথরুমে ধাক্কা দিলেন। কুহু ওপাশ থেকে চিৎকার করে বলে উঠল———‘মগের মুল্লুক পেয়েছো আম্মু তোমরা আমার লাইফকে? বিয়ে করব একবার বললাম না? এত তাড়াহুড়ো কেন এখন? কাব্য ভাইকে বলে দাও— আমি বিয়ে এখন কিছুতেই করছি না। না মানে না , না- এর আর অন্য কোনো মানে নেই।’
কবিতা চুপচাপ শুনলেন সেসব। তারপর বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন চুপচাপ; অনেকটাক্ষণ। দুপাশে দুজন মা-মেয়ে একইসাথে চুপ। একসময় কবিতা হঠাৎ বলে উঠলেন———‘যাকে এত ভালোবাসো, তার কাছে কিসের এত রাগ কুহু?’

কুহু চমকে উঠল যেমন। মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল, চূড়ান্ত বিস্ময়ে ও হকচকিয়ে গেছে সম্ভবত।
কবিতা মৃদু হাসলেন, অতঃপর বললেন———‘মা হই তোমার। এটুকু বুঝবার সাধ্য আমার আছে। আমি জানতে চাই না কাব্য আর তোমার মধ্যে কেন ফাটল ধরেছে। ওসব তোমাদের ব্যাপার, আশা রাখি নিজেরাই মিটিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু আম্মু, বিয়ে ছেলেখেলা না। এভাবে আবেগে তুমি আরেকবার ভুল করে বসো, সেটা আমি বা তোমার বাবা কেউই সহ‍্য করতে পারব না। আমরা দুজনেই চাই— তোমাদের মধ্যে সবটা ঠিক হোক। যদি তুমি দোষী থাকো; নিজে থেকে নিচু হয়ে সরি বলতে কিসের লজ্জা? আর যদি কাব্য দোষী থাকে, তবে ও বুঝদার বলেই তোমাকে বিয়ে করে সবটা মিটিয়ে নিতেই চাইছে।’

কবিতা গলাটা কাঁপলো বোধহয় এবার——‘তুমি সুখী হবে, এটুকু বিশ্বাস আমাদের আছে বলেই এই বিয়েতে রাজি হয়েছি আমরা। কখনো ভেবো না, আমরা শুধুমাত্র আত্মীয়তার মান রাখতেই কাব্যকে মেনে তোমাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি। তুমি এখন যেমন আমাদের মেয়ে, বিয়ের পর আমাদেরই মেয়েই থাকবে। বিয়ে করো, তারপর একসাথে থাকতে থাকতে দুজনের সমস্যা দেখবে সহজে মিটে যাচ্ছে। বিয়েতে জাদু আছে আম্মু,এখনকার তোমার সমস্যাগুলো হয়তো একসময় নিজের কাছেই ছেলেমানুষি লাগবে।’
কবিতা থামলেন, কুহু নিশ্চুপে শুনে গেল স্রেফ। একটু থেমে কবিতা আবার বললেন——‘বিয়ে করে তোমাদের যার যেটুকু রাগ-গোঁসা আছে মেটাও। তবে আপাতত আমাকে আর তোমার বাবাকে এত বড় লজ্জায় প্লিজ ফেলো না। আম্মুর কথাটা একবার রাখো? হু?’
কুহু চুপচাপ শুনে গেল শুধু। ওর বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল যেমন। তারপর বেশ অনেকক্ষণ পর— বাথরুমের সিটকিনি খোলার শব্দ হলো, পরপর কবিতার মুখেও ছড়িয়ে গেল অমায়িক এক মিষ্টি হাসি।

অতঃপর এক মহা সন্ধিক্ষণে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা গেল। প্রচণ্ড ইগোয়িস্টিক, নাছোড়বান্দা কুহেলিকা সিদ্দিক কুহু শেষপর্যন্ত বহু যু দ্ধের পর রাজি হলো তার একসময়ের শখের কাব্য ভাইকে বিয়ে করার জন্যে। একসময় শখের হলেও; এই কাব্য ভাইয়ের প্রতি কুহুর সময়ের সাথেসাথে প্রচুর বিরক্তি জন্মেছে, আছে অনেক বোঝাপড়া।
সবটাই মিটিয়ে নিবে কুহু। আজ একটা হিসাবনিকাশ হবে সেসবের। যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তবে সেটার জন্যেও আছে একটা প্ল্যান বি। দেখা যাক— জল কতদূর গড়াতে পারে।

কিন্তু বিয়ে তো বিয়েই। কুহু ওর জীবনের এতবড় দিন বিরক্তিকর কাব্য ভাইয়ের জন্যে নষ্ট করতে পারে না। ও এনজয় করবে, পুরোটাই উপভোগ করবে নিজের বিয়েকে। এতটাও বোকা না কুহু, নিজের বিয়েকে পন্ড করবে না ও।
কুহু একটা সাদা-লালের মিশেলে রঙের বেনারসি পরেছে, সুন্দর করে টম বয় চুলগুলো স্টাইল করে পিন আটকে খোলা ছেড়ে দিয়ে তার উপর ছড়িয়ে দিয়েছে একটা টকটকে লাল দোপাট্টা। মুখে সামান্য সাজ, চোখে বেশ গাঢ় করে কাজল এঁকে দেওয়া। কানের একটা ফোঁটা কানের পেছনে ছেপে দেওয়া হয়েছে, বোধহয় নজরফোঁটা হিসেবে।
কাব্য পরেছে সাদা রঙের সাধারণ একটা আরং-এর পাঞ্জাবি। দুজন মুখোমুখি বসা। কাজী ওদের সামনে কাগজপত্র তৈরি করছেন। কুহুর পাশে কবিতা, আর আরেক পাশে শামিমা বসেছে। সবাই এই অল্পসময়েই যতটুকু পারে ঘরদোর সাজিয়েছে, নিজেরাও অল্পস্বল্প সাজগোজ করেছেন।

কাব্যের পাশে স্নিগ্ধ। আরেক পাশে মুবিন। কাব্যের কোলে মহু, কাব্যের মোবাইলে গেইম খেলতে ব্যস্ত ও। কাব্য মহুকে কোলে নিয়ে স্নিগ্ধের সাথে কিসব খুসুরফুস করে যাচ্ছে, ওর ধ্যান কুহুর দিকে একটুও নেই— যেন কুহু এখন অদৃশ্য। কুহুর মেজাজটা গেল আরও বিগড়ে।
আজ কুহু কাব্যের উপর সমস্ত রাগ-বিরক্তি ছাপিয়ে বেশ হাসিখুশি। মাত্রই কায়ার সাথে বেশ কিউট ব্রাইডাল লুকে ছবিও তুলেছে। দেখে মনে হচ্ছে না— এত সুন্দর একটা মুখের ভেতরে ভেতরে রিভেঞ্জ ধরনের প্ল্যান কষছে কুহু। যত দিন যাচ্ছে, কি দারুণ ধূর্ত হয়ে যাচ্ছে এই কুহু মেয়েটা।

ওদিকে কায়া সবকিছুর ভিডিও করছে, একটা নিকাহ রিল বানাবে বলে, রিলটা ফেসবুক স্টোরিতেও দেবে ও।
কুহু আড়চোখে একবার কাব্যের দিকে তাকাল। কাব্য তখনো স্নিগ্ধর সাথে কথা বলছে। স্নিগ্ধ ফোনে কাউকে মেসেজ করছে, কাব্য ওকে গাইড করছে মেসেজের ব্যাপারে। কুহুর এতক্ষণ ধরে এদের এসব ফুসুরফুসুর দেখে ভ্রু কুঁচকে যায়। এই দুই ধূর্ত ভাই কিসব করছে একসাথে? কাকে মেসেজ করছে দুটো মাইলা? ওই ঊর্মি আপুকে?
ফালতু মেয়ের ফালতু নামটা আবার মাথায় আসতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল কুহুর। পরপর বিড়বিড় করে কয়েকবার পড়লো—-‘আস্তগফিরুল্লাহ!’

আপদটার কথা এই শুভদিনে মাথায় না আনাই ভালো।
কাজী কাগজপত্র রেডি করা হয়ে গেলে গলা খাঁকারি দিলেন। সবাই পরপর গল্প-গুজব থামিয়ে যে যার মতো সোজা হয়ে বসলো। কাব্যের কোল থেকে মহুকে টেনে নিয়ে গেলেন ছোট চাচী প্রেমা। মহু ছোটাছোটি করছে তার জন্যে, ও বসে থাকবে কাব্য ভাইয়ের কোলে— মা বসতে কেন দিচ্ছে না। প্রেমা কোনমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেয়েকে নিয়ে বসলেন আরেকটা সোফাতে- স্বামীর পাশে।

কাব্যও এইবার নিজের গায়ের সাদা পাঞ্জাবি ঠিকঠাক করতে করতে কুহুর দিকে তাকাল। কুহু হেসে কায়ার সাথে কিছু একটা বলছে। কাব্য কিছুটা অবাক হলো এবার- এই মেয়ে হাসছে কেন? তাও এই বিয়েতে? মাথা থেকে কি সবটা আউল-ফাউল চিন্তা চলে গেছে? অবশ্য কাব্যের খুশিও লাগলো একইসাথে, নাহলে কবুল বলার সময় কুহুর মুখের ফোলা, রাগী ভাবটুকু ধরে রাখলে কাব্যের নিজেরই হয়তো সেটা ভালো লাগতো না।
দোয়া-দরুদ পড়া শেষে কাজী নিকাহনামা দেখে বলা শুরু করলেন,
———‘আল্লাহর নাম পড়িয়া, কালেমাকে সাক্ষী রাখিয়া আনোয়ার সিদ্দিকের বড়পুত্র শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্যের সাথে সাদাত সিদ্দিকের মেয়ে কুহেলিকা সিদ্দিক কুহুর দশ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া বিবাহের জন্যে প্রস্তাব দেওয়া হইয়াছে,কন্যা রাজি থাকিলে বলুন কবুল।’

কুহু কাব্যের দিকে তাকাল, কেন যেন কাব্যের মুখটা বড্ড শুকনো শুকনো লাগছে। বোধহয় বেচারা ভয় পাচ্ছে— কবুল বলার সময় না আবার এই তারছেড়া মেয়ে বেঁকে বসে।
তবে কাব্যকে অবাক করে দিয়ে কুহু স্রেফ বাকা একটা ভিলেন হাসি ছুঁড়লো কাব্যের দিকে। সাথে সাথেই কাব্য ভ্রুটা কুঁচকে তাকাল কুহুর ওই হাসিটার দিকে। কুহু মুখটা বাঁকাল, ভিলেনি হাসি ঠোঁটে রেখে কাজীর দিকে ফিরে কাব্যকে শুনিয়ে শুনিয়ে ভাব নিয়ে বলল———‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল।’

কোনো জড়তা নেই, কণ্ঠে কাঁপাকাঁপিও নেই—-ভীষণ আত্মবিশ্বাস নিয়েই কবুলটা বললো কুহু। কাব্য রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে এখন। মেয়েদের কবুল বলার সময় এদের নাটক দেখেই অভ্যস্ত ও। কুহুর এই রূপ বড্ড আশ্চর্য লাগলো। কুহু এবার বাকা একটা হাসি ছুঁড়লো কাব্যের দিকে— অর্থাৎ, বাছাধন তুমি তো এইবার কুকড!
এবার পালা এলো কাব্যের। কাব্যও গলা খাকারি দিয়ে কুহুর দিকে আড়চোখে তাকালো একবার। কুহু তখনো ভিলেন চেহারা বানিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কাব্য ও এইবার কম যায়না। ও একইভাবে কুহুর মতোই ভিলেনি চাউনি নিক্ষেপ করে নিজেও কোনোরূপ জড়তা ছাড়াই বলল———‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল।’

‘আলহামদুলিল্লাহ।’ — ঘরময় বড়রা উচ্চস্বরে পড়লেন।
দুজন দুজনের দিকে তখনো চেয়ে আছে। কুহুর চোখে রিভেঞ্জ; কাব্যের চোখের হাসিই বলে দিচ্ছে একটা কথা—-‘সম্পর্কের এই এই যু দ্ধে কুহুর রিভেঞ্জ ভীষণ বাজেভাবে ফেইল করবে।’
কাজী বিয়ে পড়ানো শেষে সবাইকে নিয়ে দোয়া করলেন। অতঃপর খেজুর বিলিয়ে দেওয়া হলো সবার মধ্যে। কুহুকে যখন খেজুর দেওয়া হলো, ও নাক-মুখ কুঁচকে বলল———‘খেজুর খাই না আমি, আম্মু।’
কবিতা চোখ রাঙিয়ে বললেন———‘খাও বলছি, রহমতের খেজুর এটা।’
কুহু কি আর করবে, মুখ কুচকে খেজুর মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলো। কাব্য ওদিকে খেজুর খেতে খেতে হাসছে কুহুর নাক কুঁচকানো দেখে।

বিয়ের দিনের সমস্ত নিয়ম মেনে কাব্যের ফ্ল্যাটে কুহুকে নিয়ে বসানো হলো কাব্যের রুমের বিছানায়।
গায়ের ভারি বেনারসি সামলে ক্লান্ত কুহু বসেছে বিছানার একপাশটাই কোনঠাসা হয়ে। কারণ পুরো বিছানায় গোলাপের পাপড়ি, সাদা বেলিফুলে সাজানো হয়েছে। বাসর ঘরটায় সাদা-লালের মিশ্রণে সাজানো হয়েছে। মনে হচ্ছে কাব্য ভাই ইচ্ছে করেই সাদা-লালে ঘর সাজিয়েছেন, যেহেতু ওদের দুজনের বিয়ের কাপড় সাদা-লালের মধ্যে।
তারমধ্যে আবার বিছানার চাদরের উপর ঠিক মধ্যখানে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে বর্ডার করে, বেলি ফুল দিয়ে ভেতরে লেখা লেখা—

‘KABBO’S BED IS BELONGS TO HIS LOVELY WIFE’
এই ফালতু কথাগুলোর মানে কি? রুমের সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে— জনাব বেশ প্রস্তুতি নিয়েই বিয়ে করতে বসেছিলেন। মেজাজটাই কেমন কুঁচকে গেল কুহুর।
ও সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো— কাব্য ভাই নিজেকে যতদিন নির্দোষ প্রমাণ না করতে পারবেন, ততদিন পর্যন্ত কুহুকে স্পর্শ করতে এলেই তার গ র্দান নিয়ে নেবে ও। এতে কুহুকে বাংলা সিনেমার নায়িকা মনে হলে- হোক।
বিয়ের এই সাজসজ্জাও এখন বিরক্ত লাগছে কুহুর। গরম বোধ হচ্ছে ভীষণ, এসি রুমেও ঘামছিল ও। সেভাবেই চোখ-মুখ কুচকে মাথার উপরের লাল দোপাট্টাটা টেনে খুলে ফেলতেই দেখে দরজা দিয়ে সবে কাব্য রুমে ঢুকছে।
কুহু একবার কাব্যের দিকে তাকালো। কাব্য সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে, বুকের দিকে বেশ সুন্দর সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবিতে। হাতাটা কনুই অব্দি ফোল্ড করা, পুরুষালি লোম-ভেইন্স যেন তাকিয়ে আছে কুহুর দুই চোখে। পুরোটাসময়ে এই প্রথম কুহু মুগ্ধ হয়ে যেন কাব্যকে দেখলো।

অথচ সিটকিনি লাগিয়ে যেই কাব্য ওর দিকে ফিরলো, কুহু সাথেসাথেই আবার চোখ-মুখ কুচকে ফেলল- যেন এতক্ষণ কুহু কাউকেই লোভনীয় মুগ্ধ চোখে দেখেইনি।
কাব্য দরজা সিটকিনি আটকে কুহুর দিকে ফিরে নিজের মতো নিতান্তই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে বলল———‘ফাইনালি, ওয়েলকাম টু দিস রুম, মিসেস কাব্য।’
বলে এগিয়ে গিয়ে নিজের হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ ফুরফুরে একটা মেজাজ নিয়ে বেচারা রুমে ঢুকেছে।
উহু, এই ফুরফুরে মেজাজ তো কুহুর সহ্য হচ্ছে না। কুহু দাঁত চিবিয়ে জবাবে ত্যাড়া উত্তরটাই ছুড়লো——‘তাতো বটে, আমার তো আসতেই হলো এই রুমে। মুখ থেকে হাসিই সরছে না। সরবে কেন, দারুণ একটা প্ল্যান করেছেন না? হাসিখুশি তো থাকবেনই।’

কাব্য টেবিলের উপর ঘড়ি রাখতে রাখতে কুহুর দিকে তাকিয়ে রসিক কণ্ঠে বলল———‘মানে? কাঁদতে হবে নাকি এখন?’
কুহু চেতে উঠল যেমন, শাসিয়ে উঠে বললো——‘এই এই দাঁত কেলাবেন না বলছি। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে আমার রাগে; আর আপনি নির্লজ্জের মতো হাসছেন আমার সামনে?’
কাব্য অসহায় ভঙ্গিতে হাসি থামিয়ে দিল, বেচারা কি করবে ভেবে না পেয়ে মুখ-চোখ গোমরা করে বলল———‘হাসছি না আর। একটু পর হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদবও, ওকে! আপাতত তো কান্না আসছে না, সরি।’
বলে কাব্য হেঁটে এসে বিছানার একপাশে বসলো। কুহু অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দোপাটটা খুলতে ব্যস্ত হলো। সমস্ত রাগ এবার গিয়ে পড়ল সহজ-সরল দোপাটটার উপর। কাব্য মুখ টিপে হাসতে হাসতে সেসব দেখলো শুধু। সেভাবেই কুহুর দিকে চেয়ে বলল———‘বাসর রুম কেমন লেগেছে? দশ হাজার টাকা দিয়ে করিয়েছি। ওভিইয়েসলি আমার নিজের জমানো টাকা এসব। আব্বুর কাছ থেকে নেইনি।’

কুহু বিরক্ত হলো এইবার। দোপাটটা খুলে ফেলে কাব্যের দিকে ফিরে দাঁত চিবিয়ে হেসে হেসে বলল———‘খুব না? বাসর রাত নিয়ে খুব এক্সাইটেড মনে হচ্ছে?’
কাব্য মুখটা মাসুম বানিয়ে বেচারাদের ন্যায় বললো——‘সব পুরুষই এক্সসাইটেড থাকে। আর আমি কি পুরুষ নই, বল?’

কাব্যের গোবেচারার ন্যায় মুখটা কুহুর রাগ আরো তুঙ্গে করে দিল্ল। কুহু এবার উঠে গেল বিছানা থেকে। তেড়ে গেল কাব্যের দিকে। কাব্যের দিকে আঙুল তুলতেই কাব্য ভয় পাওয়ার ভান করে পিছু সরাল মাথাটা, অবাক হয়ে তাকাল কুহুর রাগান্বিত চোখের দিকে।
কুহু আঙুল উঁচিয়ে, দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল———‘এত্ত খুশি হওয়ার কিছু নেই, হু? বিয়েটা আমি চাপে পড়ে করেছি। নাহলে আপনাকে শাস্তি দেওয়ার আগে বিয়ে? নেভার।’

কাব্য বুঝদারের ন্যায় মাথা নাড়ল— কুহুর এ যাত্রায় মনে হলো কাব্য ওর মজা তুলছে। কুহু রেগেমেগে বলল———‘আমার ডিভোর্স চাই, বুঝেছেন আপনি? আপনি মুখে তালাক দিবেন এক্ষুনি।’
কাব্য সাথেসাথেই কুহুর দিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল—— ‘তালাক? লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।’
কুহুর ভ্রু কুচকে গেল, কাব্য স্বাভাবিকস্বরে কুহুর কথা উড়িয়ে দিয়ে বললো———‘বাসর রাতে ডিভোর্সে? আই থিঙ্ক উই লাভ ইচ আদার। এখানে ডিভোর্স কেন দেব আমি?’
কুহুর মেজাজ গেল আরও গরম হয়ে—— ‘লাভ? উই? আমি না। কোনো লাভ-টাভ আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। দেখুন——’

বলে আরো কিছু বলতে যাবে, তার আগেই কাব্য আচমকা বসা থাকা অবস্থাতেই দাড়িয়ে থাকা কুহুর কোমরটা হঠাৎ টেনে বিছানায় শুইয়ে ফেলে নিজে উঠে গেল কুহুর শরীরের উপর।
ব্যাস! কুহুর বলতে থাকা মুখটা টুপ করে বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো সেই বহু পরিচিত বুকের ধুকপুক শব্দ। কুহু ঢোক গিলল, মুখ দিয়ে রেগে কিছু বলতে যাবে— যেন কথাই বেরোচ্ছে না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখছে কাব্যের ওই নেশালো চোখ দুটো।

জীবনের প্রথম আজ ওরা দুজন এতটা কাছাকাছি। কাব্য কুহুর চোখে চেয়ে আছে, কুহু কাব্যের বুকে দুই হাত ঠেসে রেখেছে, চেয়ে আছে ভয়ার্ত চোখে কাব্যের মুগ্ধ চোখের দিকে। দুজনের বুকেই ধুপধুপ শব্দ হচ্ছে— যা এরা দুজনেই খুব ভালো করেই শুনতে পাচ্ছে।
কাব্য কুহুর চুল গুছিয়ে দিতে দিতে শান্ত স্বরে বলল—— ‘এখন চুপ কেন? কথা বন্ধ হয়ে গেছে আমার তোতাপাখির? এত কথা কবে শিখলি তুই? বউরা হবে মিনমিনে, আদর দিলে আদর নেবে, রাগ করলে মুখ ফুলিয়ে চুপ হয়ে থাকবে— আমরা স্বামীরা খুঁজে বের করবো তোদের রাগের কারণ। তা না করে এসব চিল্লাচিল্লি?’

কুহু কথাই বলতে পারছে না। কাব্যের হাতটা এখনো ওর কোমরে। কোমর থেকে ইতিমধ্যে সেফটিপিন খুলে নিয়েছে কাব্য। কাব্যের গরম হাতটা ক্রমশ ছুয়ে দিচ্ছে কুহুর কোমরের আশপাশের অংশ বেলাজে, অবলীলায়।
সামান্য ওই এক স্পর্শে কুহুর গা শক্ত হয়ে আছে, হরমোনের জ্বালাতনে আত্মাটা লাফাচ্ছে।
কাব্য কোমরের দিকে ছুয়ে দিতে দিতে নিচে নামবে তার আগেই কুহু সাথেসাথেই চমকে উঠে খামচে ধরলো ওর সেই বেহায়া-চঞ্চল হাতটা,রীতিমত ভয়ে হাপাচ্ছে কুহু।কুহুর থামিয়ে দেওয়াতে কাব্যও থেমে গেল ভদ্র ছেলের ন্যায়। তারপর আবার লেগে গেল কুহুর কানের দুল খোলে দেওয়াতে। কুহুর ঠোঁট কাপছে, কাব্যের ছুয়ে দেওয়া কানটাও হরম হয়ে যাচ্ছে। কাব্য ওদিকে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে ওপর কানের দুল খুলে দিচ্ছে। কুহু কাব্যের মনোযোগী চোখের দিকে চেয়ে ভীষণ কষ্টে থেমে থেমে বলল—— ‘কি… কি করছেন?’

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৩

কাব্যও কুহুর কানের দুল খুলে বিছানার একপাশে ফেলে দিল। তারপর আবার বাম হাতটা কুহুর উন্মুক্ত কোমরে রেখে সেখানটায় ছুয়ে দিতে দিতে ডান হাতে গলার চেইন খোলায় মনোযোগী হয়ে ভীষণ ধৈর্য‍্য নিয়ে শান্ত স্বরে জবাব দিল—— ‘বাসর করছি, সিম্পল। গুরুত্বপূর্ণ কাজে গয়নাগাটি ডিস্টার্ব করলে প্রবলেম হবে।’
ব্যাস, কুহুর বেচে থাকা শ্বাস-প্রশ্বাস এইবার বোধহয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here