তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১১

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১১
ফারহানা নিঝুম

টুকরো টুকরো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশপৃষ্ঠে। প্রকৃতি আজ ম্লান। বাতাসে ঠান্ডা ভাবটা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। সামনের নারকেল বাগানে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ।ডাব খাচ্ছে সে, সঙ্গী আছে স্নেহা।পাইপে টেনে চলেছে ফারাহ।ভাবছে সে,কী করা যায়?কী ভাবে কমান্ডার কে এখান থেকে বের করা যায়?সে আর যাই হোক এই লোকটার সাথে যাবে না। কেন-ই বা যাবে?এক বছর আগে ফেলে যাওয়ার বেলা মনে ছিল না?
হুউ! ফারাহ কম যায় না!সে মোটেও যাবে না। এই ফারাহ শেখ…
থমকে গেল ফারাহ,সে তো ফারাহ আহমেদ তাহলে শেখ শেখ জব্দ করছে কেন?নিজ ভাবনায় ধিক্কার জানাচ্ছে ফারাহ!কী যে করে সে!

“কী রে কি ভাবছিস?”
এদিক সেদিক তাকালো ফারাহ,ভাবুক হয়ে বলল।
“ভাবছি।”
ভ্রু কুঁচকে নিল স্নেহা।
“কী ভাবছিস?”
“ভাবছি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার কে কিভাবে বা’ঘে আনা যায়!”
খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল স্নেহা, ব্যা’ঙ্গো করে বলল।
“ঢঙী এত ফুটফুটে একটা জামাই পাইছোস এখন ঢঙ করছ? আমি তোর জায়গায় হলে তো..
“স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর।”
কথার পিঠে থামিয়ে দিল ফারাহ।নাক ছিটকায় স্নেহা।
“আমি ক্রাশ খাইছি জানিস?”
ডান ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয় ফারাহ।
“কার উপর রে?”
“ওই যে দুলাভাইয়ের ভাই সৌহার্দ্য উনার উপর।”
আঁখি পট হতে এই বুঝি মনি জোড়া বেরিয়ে আসবে। থমকে দাঁড়ায় ফারাহ, বিস্ময়কর কন্ঠে শুধোয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী?”
“জ্বি।”
“বারো ব্যাটারি সর।”
মুখ বাঁকালো স্নেহা। স্থান ত্যাগ করল ফারাহ। নারকেল বাগান থেকে বেরিয়ে এলো। দালানের সামনে আসা মাত্র দেখলো ভেতরে বৈঠক বসেছে।কুয়া থেকে পানি তুলে পায়ে ঢেলে নিল। জুতো জোড়া খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে তাশফিন। চোখাচোখি হয় দু’জনের।তার দেওয়া অলংকার গুলো এখনো পড়ে আছে ফারাহ। খুলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু পরক্ষণেই কী একটা ভেবে খুললো না।
খাবারের টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে সুরাইয়া।একটু পরেই খেতে বসবে সবাই। ফারাহ আসতেই রুবেনা শেখ হাত বাড়িয়ে টেনে নিলেন তার কাছে। পাশে বসিয়ে দিলেন। চঞ্চল ফারাহ মূহুর্তের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিল। দৃষ্টি এলোমেলো হচ্ছে তার,কেউ বুঝি তার দিকে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার ভাবনা টুকু সত্যি।তাশফিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফারাহর দিকে। নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে হাসলো সে,এই মেয়ের যে কি করবে?
❝কাছাকাছি এসো সুখ, তোমাকে কাঁদানোর দায়িত্ব টা না হয় আমিই নিলাম।❞

ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো তাশফিন। সামনাসামনি বসলো সোফার।রুবেনা শেখ এবং রিজুয়ান শেখ তাশফিন কে নিয়ে এখানেই আছে।বউ না নিয়ে তো তাশফিন শেখ যাবে না!আরিফা আহমেদ বেশ ঘাড় ত্যা’রা,তিনিও মেয়ে দেবেন না।চাপা এক অভিমান জামাইয়ের প্রতি।তা বেশ ভালোই ধরতে পেরেছে তাশফিন। অবশ্য ঠিকই আছে,তিনি ভুল কিছু করছেন না। এটা যদি তার বোনের ক্ষেত্রে হতো তাহলে? তাহলে তাশফিন তাহলে ডিরেক্ট শু’ট করত।
শায়লা আহমেদ বেরিয়ে এলেন, সবাই কে তাড়া দিল।
“চলে আসুন সবাই খাবার খেতে।”
একে একে সবাই টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।তাশফিনের ইচ্ছে নেই খাওয়ার, তবে আপাতত বউ যখন এখানে আছে তাকেও থাকতে হবে। ফারাহ দুতলার দিকে পা বাড়ালো,রুবেনা শেখ তৎক্ষণাৎ বলে উঠেন।

“তুই খাবি না ফারাহ?”
থামতে হলো ফারাহ কে।এক পলক দেখলো তাশফিনের দিকে।সুঁ’চালো চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। ফাঁকা ঢোক গিললো সে।
“আপনারা খেয়ে নিন, আমি পরে খাবো।”
শায়লা এগিয়ে এসে হাত ধরলো ফারাহর।
“ওমা ভদ্র কন্যা হলি কবে থেকে!আগে তো রান্না হওয়ার আগেই টেবিলে বসে বাচ্চাদের মতো চেঁচিয়ে উঠতি খাবার দাও খাবার দাও বলে।”
সহসা হেসে ফেলল তাশফিন।চিকন নাকের ডগা ফুলে উঠেছে ফারাহর। এভাবে তার প্রেস্টিজ পাংচার করে দিল চাচী? আরিফা হেসে প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন।
“চলে আয়, একসাথে খেয়ে নিবি।”
ফারাহ আর দ্বিমত করলো না। চুপচাপ গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো, তার পাশেই বসেছে স্নেহা।বাইরে থেকে এসেই খেতে বসে গেছে। তাহাকে কেউ নিমন্ত্রণ করতে হয় না ।
খেতে বসেও বিপাকে পড়েছে ফারাহ,বসেছে তো বসেছে তাশফিনের সামনাসামনি। দুজনেই দুদিকে বসেছে।তাশফিনের পাশেই বসেছে আরিফা আহমেদ, ওনার পাশে সাজ্জাদুল আহমেদ।তাশফিন চামচ নাড়াতে নাড়াতে ফিসফিসিয়ে বললো।

“বউটা কে দিয়ে দিন না আম্মু।”
প্রথম বার আম্মু বলে ডাকলো তাশফিন,আরিফা আহমেদ এক পলকের জন্য থমকে গেলেন। পরক্ষণেই কপাল ভাঁজ করে একই সুরে ফিসফিসিয়ে বললো।
“ফেলে যাওয়ার সময় মনে ছিল না?”
ডান ভ্রু কুঁচকে নিল তাশফিন।মেজাজ হারাতে চায় না সে, কিন্তু কিছু করার নেই আপাতত বউটা নিতে হবে তাকে।
“তখন কী জানতাম আমার বউটা এত ফুটফুটে?”
অধর কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল আরিফা আহমেদের। ফারাহ ফুটফুটে? মানুষ বলে তোমাদের বাচ্চা ফুটফুটে অথচ তাশফিন বলছে বউ তার ফুটফুটে।
“চুপ করে খাও বেহায়া ছে’লে।”
গাম্ভীর্য ভাব টেনে নিল মুখ পানে তাশফিন। পাক্কা হু”মকি দিয়ে বলল।
“বউ তো আমি নিয়েই যাবো থেকে নিবেন।”
অগোচরে হাসলো আরিফা আহমেদ।বেশ মজা পেয়েছেন তিনি।ছোট ছোট লোকমা মুখে পুরে নিচ্ছে ফারাহ।আপাতত ঝটপট খেয়ে উঠতে হবে তাকে।
পায়ে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে আঁতকে উঠে ফারাহ,সহসা দৃষ্টি ফেলল নিচে টেবিলের।তাশফিনের ফর্সা পা দুটো ছুঁয়ে দিচ্ছে তার পা। ক্ষণিকের জন্য থমকে যায় সে,কী করছে এই লোকটা? লোকটা তো ভারী অস’ভ্য দেখা যায়! অস্বস্তিতে পড়ে গেল ফারাহ, হাঁসফাঁস লাগছে তার।
চটজলদি খাবার শেষ করতে লাগলো ফারাহ।অথচ ওদিকে সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসছে তার।তাশফিনের স্পর্শ গুলো গভীর হচ্ছে।গলা শুকিয়ে কাঠ ফারাহর।

গৌধূলির সন্ধ্যা। অত্যন্ত সুন্দর সময়, যখন দিনের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে এবং রাতের আঁধার শুরু হচ্ছে । সূর্য যখন হালকা লাল রঙে আকাশে ডুবে যায়, তখন বাতাসে এক প্রশান্তি অনুভূত হয়। অনেক সময় মৃদু বাতাস বয়ে যায়, যা শরীরকে শীতল করে তোলে। আকাশে কিছু কিছু মেঘ থাকতে পারে, যেগুলি সূর্যের শেষ রশ্মিগুলোর সাথে মিশে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য তৈরি করতে ব্যস্ত।সন্ধ্যার আলোতে শহরের দৃশ্যও এক অন্য রকম লাগে, রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে ওঠলো। বারান্দায় বসে আছে বাকিরা। সৌহার্দ্য আজ বেরিয়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে,রুবেনা শেখের আদেশে নূপুর, ঝুমুর দু’জন কে নিয়ে আসবে। এদিকে মাহির জন্য মন টানছে তার। ছেলেটা ফোন দিয়ে নানী নানী বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল রিতিমত।মাদুর পেতে বসে আছে সবাই, আড্ডায় জমে উঠেছে সন্ধ্যে। আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ, ওখানে যাওয়া মনে বিপদ।নামাজ শেষ করে নিজের ঘরেই রইল সে।বই খাতা উল্টে পাল্টে দেখছে, এমনিতে পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না তার। অথচ পড়া ছাড়া যাবে না,এই যে দু’দিন ছুটি নিচ্ছিল কিন্তু আজ পড়তে বসতে হয়েছে জোরপূর্বক।বইয়ে মন নেই তার,বার বার তাশফিনের দৃষ্টি স্বচ্ছ পানির মতো ওঠাই ভেসে আসছে মানসপটে।

“উফ্ ফারাহ এত ভাবিস না তুই!”
বই উল্টো পাল্টা দেখতে দেখতে চোখ লেগে এলো তার, টেবিলের উপর মাথা রেখেই চোখ বুজলো। মেদহীন উদরে বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল কিঞ্চিৎ ‌। মস্তিষ্ক সজাগ হয় তৎক্ষণাৎ, উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলো কেউ একজন ঝু কে আছে তার দিকে। মানুষটা কে? লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ, নামটি স্মরণে আসতেই আঁ’তকে উঠে সে। লজ্জায় জর্জরিত হৃদয়।
“ছাড়ুন,সরুন, চিৎকার করব। আম্মু কে ডাকব।”
“ছাড়ব না,সরবো না, চিৎকার করো।ডাকো আম্মু কে।”
কথা গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে বলে দিল তাশফিন।বুলি ফুরিয়ে এলো ফারাহর।একা সে,লোকটা তাকে এবার আস্ত গিলে খাবে।

“দেখুন আল্লাহর দোহাই লাগে ছেড়ে দিন।”
নৈঃশব্দ্যে হাসলো তাশফিন।হাসিটুকু রয়ে গেল আড়ালে, পিছনে থাকার দরুন তাশফিনের স্বচ্ছ হাসিটা দেখতে পেলো না ফারাহ।
“কী যেন বলছিলে? আমার সাথে যাবে না,কী করব করে দেখাতে তাই তো?”
অলংকার পড়ানোর পর এটাই বলছিল ফারাহ। কথা গুলো মনে পড়তেই কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল।
“আল্লাহ মাফ করে দেন আমি ভুল করে বলে ফেলছি।”
এবারেও হাসলো তাশফিন, উল্টো প্রশ্ন করে বসল।
“তার মানে আমার সাথে যাবে?”
“না।”
তড়িৎ গতিতে বলে উঠে ফারাহ। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ফারাহর,উদরে চাপ তীব্র হলো।

“কী বললে?”
“উফ্!”
ব্যথাতুর কন্ঠে চিৎকার করে ফারাহ।
“একটু আগে খাবার খেয়েছি, এভাবে পেট চাপলে বমি করে দেব।”
বাচ্চা সুলভ কথা গুলো দূর্বল করছে তাশফিন কে। নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে ধরে সে।
“বয়স কত?”
অধর কম্পিত হচ্ছে ফারাহর, কষ্টে বলার প্রয়াস চালায়।
“সস,,
“সস কী?”
“সস,,সতেরো।”

নয়ন স্থির হল তাশফিনের। অর্থাৎ এক বছর পূর্বে তাদের বিয়ে হয়েছিল,তখন ফারাহর বয়স তবে ষোলো ছিল?তাশফিন কী তবে বাল্যবিবাহ করেছিল? অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল,যদি ডিপার্টমেন্টের কেউ জানতে পারে তাহলে কী হবে?তার বউ তো এখনো নাবালিকা।
কানের লতিতে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে মোচড়া যাচ্ছে ফারাহ। ফিসফিসিয়ে হাস্কিটুনে বলল।
“এত ছোট কেন?”
কম্পিত হলো ফারাহর বক্ষঃস্থল।একই টুনে পাল্টা প্রশ্ন করে।
“আ.. আপনি এত বড় কেন?”
দ্রিম দ্রিম শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে। চুলের ভাঁজে হাত আবিষ্কার করল ফারাহ, সেই হাতটি ধীরে ধীরে চুল গলিয়ে প্রবেশ করছে গলদেশে। পিছন থেকে গলা পেঁচিয়ে ধরল তাশফিন, নেত্র পল্লব কেঁপে কেঁপে উঠছে ফারাহর।
“সুখ।”

চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ডানে, সহসা তাকালো তাশফিন। চোখাচোখি হয় দু’জনের,একে অপরের দিকে চেয়ে আছে নিষ্পলক।নাক ছুঁই ছুঁই,অধরের কিঞ্চিৎ দূরত্বটুকু ঘু’চিয়ে দিলে বোধহয় বেশ হতো।
মস্তিষ্কে সুখ শব্দটি গেঁ’থে আছে,চোখে চোখ রেখে তাশফিন বলল।
“ফারাহ অর্থ কী জানো? সুখের প্রতীক।”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১০

নিদারুণ ভঙিতে ওষ্ঠাদয় কাঁপছে ফারাহর। চঞ্চল অধর ভাঁজে লেপ্টে থাকে কথাদের মেলা,অথচ আজ টু শব্দটি নেই। তাকিয়ে আছে অবাক নেত্রে।ঠোঁটের নিচে গাঢ় কালো তিলটা চুম্বকের ন্যায় টানছে তাশফিন কে। ফর্সা মেয়েদের শরীরে তিল গুলো চকচক করে চমৎকার ভাবে। বক্ষপটে জাগ্রত হলো এক অদম্য ইচ্ছে,তা কী বাস্তবায়ন করা উচিত?

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১২