তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১২
ফারহানা নিঝুম
মিটিমিটি তারা জ্বলছে আকাশের বুকে। চাঁদটা মাঝে মধ্যে দেখা দিয়ে আবারো আড়াল হচ্ছে কালো মেঘের পিছনে।বাইরের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলোর পাতা দুলছে বাতাসে। পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ দূর ভেসে আসছে, সঙ্গে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর করে তোলছে। নদীর জলের মৃদু প্রবাহ তরঙ্গের শব্দটি বাদ যায় কেন?এই নীরব রাত্রি শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষের মনকেও স্পর্শ করে। একাকী রাতের নরম পরশে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভাবনাগুলো জেগে ওঠেছে, স্মৃতিগুলো হাতছানি দেয় মানসপটে।
দরজার কপাট ঠাস করে বন্ধ করে দিল ফারাহ। দরজার ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ফারাহ।
“আরেকবার আমার রুমে আসলে আপনার পা ভেঙ্গে দেব।”
ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা চোয়াল শক্ত করে নিল। গম্ভীর কন্ঠে বলল।
“ওই বাইরে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলো।”
“এহ শখ কত,আসবো না বাইরে।”
চুপটি করে বসে রইল ফারাহ।ক্লিন সেভ করা গালে হাত বুলায় তাশফিন।মনে জাগ্রত অদ’ম্য ইচ্ছে টা চাপা পড়ে গেল।তিলের উপর ঠোঁট ছোঁয়ানোর পূর্বেই মেয়েলি কন্ঠস্বর কর্ণ স্পর্শ করলো।আরিফা আহমেদ ডাকছে ফারাহ কে।তাশফিন অপেক্ষা করলো না, ছেড়ে দিল তৎক্ষণাৎ।উঠে বাইরের দিকে পা বাড়ায়, দৌড়ে এসে দরজাটা তখনই বন্ধ করে সাহসীকতা দেখায় ফারাহ। শব্দ বিহিন হাসলো তাশফিন।অধর কোণে ঝুলছে দুষ্টু দুর্বো’ধ্য হাসিটা। শাসানোর সহিতে দরজায় হাত রেখে বলল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“পরের বার ধরলে কাঁচা চি’বিয়ে খাবো মনে থাকে যেনো।”
অপেক্ষা করলো না তাশফিন, চলে গেল নিজ বরাদ্দকৃত কক্ষে। ফাঁকা ঢোক গিললো ফারাহ, পরের বার কী করবে?
দরজায় টের টোকা পড়ল। আঁতকে উঠে ফারাহ,তাশফিন কি ফিরে এসেছে?
“ফারাহ?এই ফারাহ!”
মায়ের কন্ঠস্বর,হাফ ছেড়ে বাঁচল ফারাহ।উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল, হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো আরিফা আহমেদ।
“কী হয়েছে মা? হঠাৎ আমার ঘরে এলে যে?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আরিফা আহমেদ।উপর নিচ পরখ করে বললেন।
“তোকে এই গয়না গুলো কে দিয়েছে?”
নিশ্চুপ ফারাহ, এগুলো খুলেনি অথচ এখন না খোলায় জবাব’দিহি করতে হচ্ছে। এখন সে করবে তো করবে কি? অস্থির কন্ঠে বলল।
“মা এগুলো তো..
“তাশফিন দিয়েছে তাই তো?”
উপর নিচে মাথা দোলায় ফারাহ, অর্থাৎ তাশফিন দিয়েছে এগুলো।তেতে উঠল আরিফা আহমেদ, ব্যস্ত হাতে খুলতে নিলেন গয়না গুলো।
“পড়তে হবে না এগুলো খুলে ফেল।”
ফারাহ তাকিয়ে আছে,কী করবে এখনো? ব্যস্ত পায়ে ভেতরে এলেন শায়লা আহমেদ।
“কী রে তুই?শুধু শুধু এরকম অপদস্থ করছিস কেন মেয়েটাকে? ফারাহ এদিকে আয় তো।”ফারাহ কে নিজের দিকে টেনে নিল শায়লা আহমেদ। শাসানোর সহিতে আওড়ালো।
“ওর স্বামী ওকে এগুলো দিয়েছে তাতে তুই শ্বাশুড়ি হয়ে এত নাক গলাতে আসছিস কেন?”
মুখখানি চুপসে গেল আরিফা আহমেদের। তিনি এখনো রেগে আছে তাশফিনের উপর।
দু’জনের মধ্যে কথোপকথন শুরু হয়েছে, ফাঁক বুঝে কে টে পড়লো ফারাহ। আপাতত উদ্দেশ্য হচ্ছে কলেজে যাওয়া। বাড়িতে থাকলে একদিকে বা’ঘ তো অন্য দিকে ভাল্লু’ক। অবশ্য ভাল্লুক হিসেবে মা কে ভয় লাগছে না, কিন্তু বা’ঘ?তাশফিন তো কাঁ’চা খাবে তাকে।
মেঘাচ্ছন্ন দুপুর,আকাশজুড়ে ঘন মেঘের চাদর। সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসছে। চারপাশে একটা ধূসর ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। বাতাস ভারী, যেন বৃষ্টি নামার অপেক্ষায়। পাখিরা নীরব, গাছের পাতা স্থির, আর দূর কোথাও বাজ পড়ার ক্ষী’ণ শব্দ শোনা যায়।সুখের একটা মিশ্র আবেশ ছড়িয়ে থাকে হৃদয়ে।
জিপ গাড়িতে বসে আছে নূপুর, ঝুমুর আর মাহির।সামনে ড্রাইভ করছে সৌহার্দ্য।এই তো আর কিছুটা পথ গেলেই তারা পৌঁছে যাবে আহমেদ মঞ্জিলে।
মুখ ভার করে বসে আছে ঝুমুর,তার আসার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। ওদিকে তার পড়া এখনো শেষ হয়নি, সামনে পরীক্ষা অথচ এখন বুঝকা বয়ে এখানে আসতে হয়েছে। এসব নিরিবিলি শহর থেকে দূরে গ্রামীণ পরিবেশ মোটেও পছন্দ নয় তার। ভাগ্যক্রমে আসতে হলো, কত বার না করলো সে আসবে না অথচ রুবেনা শেখ ফোন করে কড়া ভাবেই বলেছে আসতে।ওরা নাকি তাশফিনের বউ নিয়ে ফিরবে। প্রথমে অবাক হয়েছিল ঝুমুর,ওই বাচ্চা মেয়েটাকে আবার বাড়ি বয়ে নিয়ে যেতে হবে?
মাহির কে চাদরে ভালো করে মুড়িয়ে দিয়েছে নূপুর। সাইফুল আসেনি ওদের সঙ্গে ,সে বরাবরই ব্যস্ত মানুষ।আজকেও তাই হলো, কাপড়চোপড় গুছিয়ে ছুটতে হয়েছে রাজশাহী। লোকটা তাদের খুব কম সময় দেয়, ভালো হয়েছে সে বাপের বাড়ি আছে না হলে একা একা কোমড়ে ম’রতে হতো তাকে।
শেষ একবছর আগে এসেছিল তারা হ, এরপর আর আসা হয়নি। ফলস্বরূপ জায়গাটা ভুলে গিয়েছে নূপুর।
“কী রে সৌহার্দ্য আর কত দূর?”
স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বলল সৌহার্দ্য।
“এই তো চলে এসেছি।”
মঞ্জিলের কাছাকাছি আসতেই গাড়ি পিছনে পার্ক করল সৌহার্দ্য। নেমে এলো সবাই, গাড়ির শব্দ শুনে বেরিয়ে এলো স্নেহা। সৌহার্দ্য কে দেখেই মনটা নেচে উঠল তার।
দালানের ভেতরে প্রবেশ করা রুবেনা শেখ এগিয়ে এসে মাহির কে কোলে তুলে নিলেন।
“নানু ভাই।”
“নানী।”
মাহিরের আধো আধো কন্ঠস্বর শুনে হৃদয় শীতল হয়ে গেল রুবেনা শেখের।নাক মুখ কুঁচকে ভেতরে এসেছে ঝুমুর।কত দিন এখানে থাকতে হবে? সিঁড়ি বেয়ে নিচে এলো নবীন আহমেদ।
আরিফা আহমেদ বেরিয়ে এলেন, নূপুর স্বভাব সুলভ তাদের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে কথা বলল।
“আন্টি নূপুর কোথায়?”
আরিফা আহমেদ চায়ের ট্রে সাজিয়ে বললেন।
“ও তো কলেজে গেছে।”
পাশে দাঁড়িয়ে কু’টকু’ট করে বিস্কুট খেতে ব্যস্ত স্নেহা।স্নেহা কে উদ্দেশ্য করে বলল নূপুর।
“তুমি যাওনি?”
হাত থেমে গেল স্নেহার।আজকেও সে বাহানা দেখিয়ে কলেজে যায়নি।
“আসলে আপু আমি..
“ও তো এক নাম্বার পড়া চো’র।
রান্না ঘরে প্রবেশ করেই কথাটা বললেন শায়লা আহমেদ। নূপুর ঠোঁট টিপে হাসলো। স্নেহা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।সে পড়া চো’র নাকি ফারাহ?
“মা আমি কিন্তু যাই কলেজে, আজকে আমার শরীর টা খারাপ এই জন্য?”
সহসা চোখ পা’কিয়ে তাকালো শায়লা আহমেদ।
“আজকে না তোদের টেষ্টের রেজাল্ট দেওয়ার কথা!ও রেজাল্টের কথা শুনতেই তোর শরীর খারাপ হয়ে গেল তাই না?”
রাগে দুঃখে ব্যথিত হয়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো স্নেহা। নূপুর দুঃখ প্রকাশ করে বলল।
“থাক না শায়লা আন্টি মেয়েটাকে শুধু শুধু ওরকম করে বললেন।”
কাঁচের প্লেট গুলো মুছে নিচ্ছেন শায়লা, হাত চালাতে চালাতেই আওড়ালো।
“ওর কথা ধরো না তো।পড়তেই চায় না!”
আবারো রান্না ঘরে আগমন ঘটে স্নেহার,রেখে যাওয়া বিস্কুট টা তুলে নিল ফের গঢগঢ করে বেরিয়ে গেল।
হতাশ হলেন শায়লা আহমেদ।
“দেখলে গায়েও মাখেনি।”
আরিফা আহমেদ চিন্তিত কন্ঠে বললেন।
“আজকে তো রেজাল্ট দিব। আল্লাহ জানে ফারাহ কী করছে?”
শায়লা আহমেদ হাসলেন উনি।যাই হবে ভালোই হবে।
অনেক দিন ধরে টানা বৃষ্টি শেষে আকাশ যেন নতুন রূপে ধরা দিল। সূর্যের সোনালি আলো ধীরে ধীরে মেঘের আবরণ সরিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভেজা গাছের পাতা রোদের স্পর্শে চকচক করে উঠছে, ঠিক যেন টলমল সোনার ফোঁটা।নীল আকাশে এখনো কিছু তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন প্রকৃতি তার ছুঁয়ে যাওয়া শেষ স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে চায়। বাতাসে এক ধরনের নির্মলতা, যেন ধোয়া-মোছা স্বপ্নের মতো। রোদে শুকাতে দেওয়া বৃষ্টিস্নাত পথঘাট থেকে একধরনের উষ্ণ বাষ্প উড়ছে, যার সাথে মিশে আছে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ।
কলেজ থেকে বের হয়েছে ফারাহ,এক রাশ বিরক্তি নিয়ে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। মন্টুর চায়ের দোকানে এসে বেঞ্চে বসে রইল চুপচাপ।
“ম্যাডাম।”
পরিচিত কন্ঠস্বর,ঘাবড়ে গেল ফারাহ।ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ডান দিকে। বুকে হাত গুজে টান টান হয়ে দাঁড়ালো তাশফিন।তাশফিন কে দেখে পিলে চমকে উঠে ফারাহর।
“আপনি? আপনি আমার পিছু করছেন?”
নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে হাসলো তাশফিন। ফিসফিসিয়ে বললো।
“বউয়ের থেকে কিছু চাই তাই এসেছি।”
আহাম্মক বনে গেল ফারাহ, লজ্জায় আড়ষ্ট হলো মূহুর্তে।
“ছিহ্ বেশরম একটুও লজ্জা নেই আপনার? এরকম ভাবে ছোট মেয়েদের সামনে এসব বলছেন?”
গা দুলিয়ে হেসে ফেলল তাশফিন।গা পিত্তি জ্ব’লে উঠলো ফারাহর। উঠে দাঁড়ালো তৎক্ষণাৎ, হাঁটা ধরে সামনের দিকে। এমনিতেই মন খারাপ তার, পরীক্ষায় ডাব্বা খেয়েছে সে।হবেই তো জেদ করে ইতিহাস পরীক্ষা টা দিলোই না।আর দিলেই বা কী হতো?সালের মধ্যে তো তিনটা সাল মুখস্থ, উনিশশো একাত্তর, একুশে ফেব্রুয়ারি আর ষোলোই ডিসেম্বর।আর তো কিছুই জানে না!
রাগে দুঃখে কষ্টে ফুঁসছে ফারাহ।
“আজকে তোমার রেজাল্ট কার্ড দিয়েছে না?”
আরেক দফা চমকে উঠে ফারাহ।এই লোকটা কী করে জানালো রেজাল্টের কথা?এমা সে তো ফেল্টুস কুমারী,এবার মুখ কোথায় লুকাবে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফারাহ,ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয় তাশফিন।
“কী হলো দাও রেজাল্ট কার্ড!”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১১
হাত কাঁপছে থরথর করে, পালাতে পারলে বোধহয় ভালো হতো।এই লজ্জা নিয়ে কোথায় যাবে সে? শেষমেষ স্বামী নামক আ’সামীর সামনে প্রেস্টিজ পাং’চার হয়ে যাবে তার?