তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৪
ফারহানা নিঝুম
নিস্তব্ধ কালো মেঘে ঢাকা রাত।আকাশজুড়ে ভারী মেঘের চাদর, চাঁদ-তারার আলো ঢেকে গেছে গভীর অন্ধকারে। বাতাসে এক ধরনের চাপা নিস্তব্ধতা, যেন প্রকৃতিও নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে। দূর কোথাও বাজ পড়ার আবছা আলো অন্ধকার আকাশকে মুহূর্তের জন্য ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।তারপর আবার সব কিছু গাঢ় কালোতে মিশে যায়।
কেবল মাঝেমধ্যে কোনো কুকুরের ডেকে ওঠা এবং হালকা বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ কানে আসছে ।মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি, তার সঙ্গে মেঘের গম্ভীর গর্জন।এমন রাতের সুনসান নীরবতা মন আঙিনায় শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছে।
আঙুলের ভাঁজে আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছে, নাকের ডগায় সুড়সুড়ি লাগছে ফারাহর।এ কেমন অনূভুতি?আজ প্রথম সেই নি’ষিদ্ধ অনূভুতির সঙ্গে পরিচয় হলো তার।
“আমার অস’হ্য লাগছে, আল্লাহর দোহাই ছাড়ুন আমায়।”
নৈঃশব্দ্যে হাসলো সেই পুরুষ। অনূভুতি টা নতুন এই রমণীর জন্যে,তবে ওর আদল পানে চাইলে যে এই নি’ষিদ্ধ অনূভুতি গুলো মস্তিষ্কে ঝে কে বসে!
টুকরো টুকরো চুমু এঁকে দিচ্ছে কাঁধের উপর। আবেশে আঁখিদয় বুঁজে এলো ফারাহর। কাঁপছে সে থরথর করে, কন্ঠনালি কেঁপে কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।ঢোক গিলছে বারে বারে।
“ছাড়ুন না প্লিজ।”
“সে এগেইন।”
“প্লিজ।”
“সে এগেইন বেইব।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অস্তিত্ব মিশে যাওয়া এক পুরুষ যাকে চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না ফারাহ।সরে গেল সেই অস্তিত্ব।চোখ মেলে তাকাল ফারাহ, নতুন আরো একটি মুখাবয়ব নজরে এলো তার।এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছে তার দিকে,পিছুতে লাগল ফারাহ কদমে কদম মিলিয়ে। বুকশেলফের সহিতে ঠেকলো পিঠ,নত হলো মস্তক। কম্পিত হলো ওষ্ঠ যোগল।
“দেখুন আপনি যান না এখান থেকে!”
সে কি শুনলো?হয়তো বা না।হাত ছুঁয়েছে তার বুক শেলফ, চমৎকার হেসে বলে।
“এখন ভয় পাচ্ছ কেন? এমনিতে তো চ্যা’টাং চ্যা’টাং কথা বলো!”
লজ্জায় ফের নত হলো মস্তক, নির্দ্বিধায় আওড়ালো।
“তখন আপনি দূরে থাকেন। এখন এত…
“কাছে বলে ভয় লাগে?”
কথার পিঠে থামিয়ে বলে উঠে তাশফিন।
বাইরের পরিবেশ তুলনামূলক বেশি অন্ধকার। যদি রাত , তবে হয়তো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে, দূরে রাস্তার ধারে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। ঝড়ো বৃষ্টির শেষে মাটির গন্ধ আর ভিজে পাতার সোঁদা গন্ধ বাতাসে মিশে আছে। হালকা হাওয়া বইতে লাগলো,গাছের পাতাগুলো দোল খায়, মাঝে মাঝে জানালার কাঁচে টোকা দেয় কোনো ডাল। সব মিলিয়ে হারিকেনের আলোয় ভেতরের নরম উষ্ণতা আর বাইরের রহস্যময় অন্ধকার এক রকমের বিপরীত অনুভূতি তৈরি করে একটি ঘরোয়া, শান্তিময় অনুভূতি তৈরি করে।
হারিকেনের কমলা রঙা মৃদু আলোতে আলোকিত হয়ে উঠছে কক্ষ। জানালার কাছে ঝু’লানো সফেদ পর্দা ভোঁ শব্দ করে দুলছে।কমলা রঙা আলো মুখশ্রী জুড়ে ফুটে উঠছে ফারাহর আদলে। পায়ের নীচে শীতলতা অনুভব করছে ফারাহ,বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে। আচ্ছা এই যে বেগতিক হৃদয় স্পন্দন কী শুনতে পাচ্ছে তাশফিন? হয়তো বা না আবার হতে পারে হ্যাঁ।যদি শুনে থাকে তাহলে এর থেকে লজ্জার বোধহয় আর কিছু হবে না।কিশোরী বদনে অনূভুতির নতুন দোলা লেগেছে।
হাতের ভাঁজে হাত মিশালো,অন্য হাত কানের পিঠের গলিয়ে স্পর্শ করল গলদেশ। কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ, অসাড় হয়ে এলো দেহ মন আ’ত্মা।
কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল।
❝আমার হবে?❞
আমার হবে বাক্যটি তীব্র ভাবে কর্ণ স্পর্শ করলো ফারাহর।আর কিভাবে তার হবে?সে তো সেই কবেই তার হয়েছিল, কিন্তু তিনি কি করলেন?তাকে ফেলে চলে গেল অস’ভ্য লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। অভিমানের পাল্লা ভারী হলো, সেই সাথে আঁখিপুটে জমা হলো নোনা জল। গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে, ফুঁপিয়ে উঠলো ফারাহ।
“হবো না।আর হতেও চাই না, আপনি আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। ভুলিনি আমি,সব মনে আছে।বড় বলে সাত খু’ন মাফ হবে ভাববেন না।”
বক্ষে আলগোছে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিক এগিয়ে যেতে লাগলো ফারাহ।পিছন হতে বলিষ্ঠ দুটো হাতের বাঁধনে আটকা পড়ে যায়। মেদহীন উদরে স্পর্শ করে সেই হাত দুটো,মুখ ডো’বায় কাঁধে।
“এই ছোট্ট শরীরে এত রাগ? উফ্ ঝ’লসে যাবো তো!”
“ছাড়ুন আমায়।ইয়া আল্লাহ এত নির্লজ্জ আপনি!ছাড়েন আমাকে।”
সশব্দে হাসলো তাশফিন। ব্যা’ঙ্গো করে বলল।
“নির্লজ্জ তো এখনো হলাম না তার আগেই বলে ফেললে?”
“আমি কিন্তু মা কে ডাকব।”
“ডাকো সুন্দরী।”
ধস্তাধস্তি করছে ফারাহ অথচ নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যর্থ সে।
❝তোমার চোখের গভীর নীলিমায় ডুবে যেতে চাই এক অনন্ত বিস্মরণে।❞
নিজেকে শূন্যে অনুভব করে ফারাহ, দৃষ্টি ফেরায় ডান দিকে।এক জোড়া গভীর আঁখিদয় মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি ।ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে নরম তুলতুলে বিছানার দিকে । চোখাচোখি হয় দু’জনের,চোখে চোখে আদান-প্রদান হচ্ছে প্রেমের অব্যক্ত কথা গুলো।
এক বিশাল সমুদ্রের বুকে ভেসে চলেছে একটি জাহাজ। গভীর নীল জলরাশি চারদিকে যতদূর চোখ যায়, কেবল তরঙ্গের খেলা। হঠাৎই দিগন্তরেখায় একগুচ্ছ উঁচু ঢেউ দেখা যায়।সেই ঢেউগুলো ক্রমশ উঁচু হতে থাকে, দানবের মতো তেড়ে আসছে জাহাজের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে সাগরের বুক চিরে বিশাল জলরাশি আছড়ে পড়ে জাহাজের গায়ে। প্রচণ্ড শব্দে পানি ছিটকে ওঠে, ঝাঁ’কি খায় জাহাজের কাঠামো, যেন দুলে ওঠে পুরো জাহাজটাই। ঢেউগুলো একের পর এক আ’ঘা’ত হানছে, কখনো জাহাজের গা বেয়ে উঠে যাচ্ছে, কখনো আবার নিচে নেমে গিয়ে পরের ঢেউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।সমুদ্রপথে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ও বৈধ পণ্য পাচার করা হয় । অ’বৈধ পণ্য আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের মাধ্যমে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাঠানো হয়।
অদূরে দাঁড়িয়ে আছে একটি জাহাজ ,ধীরে ধীরে তা এগিয়ে আসছে সামনের দিকে।এই প্রান্তে টহল দেওয়া জাহাজ টা আপাতত দু একজন কমান্ডারের দায়িত্বে রয়েছে।জাহাজ টা কাছাকাছি আসা মাত্র থামানো হলো সেটা। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দু’জন লোক, একজন লেফটেন্যান্ট এগিয়ে গেলেন, ডকুমেন্টস দেখালো তারা।চোখ বুলিয়ে নিলেন তারা। ওদিকে জাহাজ থেকে বেরিয়ে আসা।চোখ বুলিয়ে নিলেন লেফটেন্যান্ট,হাতের ইশারায় যেতে বললেন তাদের। সামনাসামনি যাওয়া মাত্র আরেকটি জাহাজের সম্মুখীন হলো তারা।লোক দু’টো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।বসের কথা মতো এখানে একটাই টহলদারি জাহাজ থাকার কথা।অথচ এখন আরো একটি জাহাজ এসেছে?
লেফটেন্যান্ট নাইম ইসলাম তার নির্দেশে আবারো জাহাজে প্রবেশ করলো কমান্ডরা। ভয়ে পিছিয়ে যেতে লাগলো লোক দুটো, পালানোর বৃথা চেষ্টা চালায়,তার পূর্বেই সপাটে চ’ড় খেলো লেফটেন্যান্ট নাইম ইসলামের হাতে।
“এই ওদের কে ধরো।”
ভেতর থেকে একজন কমান্ডার নাকাবন্দি করলো দু’জন কে। ভেতরে চেকিং চলছে।বড় জাহাজের কন্টেইনারের মধ্যে অবৈধ পণ্য লুকিয়ে পাচার করা হচ্ছে।
কন্টেইনারে বৈধ পণ্য দেখানো হয়েছে উপরের দিকে, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য অবৈধ পণ্য পরিবহন করা। কন্টেইনার ভেতরে খুলতেই নজরে এলো কিছু অবৈধ অ’স্ত্র।অবাক নেত্রে চেয়ে রইল নাইম ইসলাম।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ আজকে ভীষণ কড়া ভাবেই কমান্ড করেছেন যে এদিকটায় টহলদারি বাড়িয়ে দিতে।হয়তো তিনি প্রথম থেকেই আন্দাজ করেছিলেন কিছু একটা। আপাতত এই অস্ত্র গুলো সঠিক স্থানে পৌঁছে দিতে হবে,আর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ কে সব ইনফরমেশন পাঠাতে হবে।
টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোঁটা মাটি স্পর্শ করছে। টিনের চালে ছলাৎ ছলাৎ শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে।বাইরের পর্দা গুলো বাতাসে উড়ছে এদিক সেদিক। দালানে থাকার দরুন বৃষ্টি টা অনুভব করা যাচ্ছে না। চিলেকোঠার ঘরটায় থাকলে বৃষ্টির এই সুন্দর মূহুর্ত টা অনুভব করা যেতো। আঁধার রাত, অন্ধকারে তলিয়ে আছে কক্ষ।
ছোটখাটো দেহের উপর শক্তপোক্ত দেহের পুরুষ আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে।মুখ গুঁজে রেখেছে বক্ষে। জোরপূর্বক হাত টেনে নিজের চুলের ভাঁজে গুঁজিয়ে দিয়েছে।আদেশের সহিতে বলল।
“হাত বুলিয়ে দাও।”
আদেশ অনুযায়ী তাই করলো তাশফিন।নাক ঘষে গলদেশে, অস্তিত্ব নেই ফারাহর। সমস্তটা জুড়ে রয়েছে তাশফিনের অস্তিত্বের মাঝে বিলিন হয়েছে।
“আ.. আপনি রুমে যান না। আপনার বিছানা আছে তো।”
“তোমার মতো নরম বিছানা নেই।”
আশ্চর্যের ন্যায় তাকালো ফারাহ,মুখ উঠিয়ে তাকালো তাশফিন।
“ছিহ্!”
ডান ভ্রু কুঁচকে নিল তাশফিন।
“কী বুঝে ছিহ্ বললে?”
চুপ মে রে গেল ফারাহ। বাঁকা হাসলো তাশফিন।
“বলো বলো কী বুঝলে?”
“কিছু না।”
“তাহলে ঘুমাতে দাও।”
নাক মুখ কুঁচকে নিল ফারাহ, ছোট্ট করে বলল।
“আপনি কত ভারী! আমি তো চ্যা’প্টা হয়ে যাবো।”
“ওজন নিতে শিখো মিসেস শেখ,সামনে যে আমার সমস্ত ভার তোমাকে বইতে হবে।”
চোখ টিপলো তাশফিন,অবাক নেত্রে চেয়ে রইল ফারাহ।
উঠে বসলো তাশফিন,সহসা উঠে গেল ফারাহ। সন্ধানী দৃষ্টিতে নিজের ওড়না খুঁজে চলেছে, অথচ তা যে তাশফিনের হাতের মুঠোয় বন্দি।
“ওইটা দিন।”
“কোন টা?”
“ও.. ওড়না।”
“না দিলে?”
নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে হাসলো তাশফিন, কড়া চোখে তাকাল ফারাহ।
“না দিলে মা কে ডাকবো।”
“ডাকো,তবে হ্যাঁ আমার কিন্তু লজ্জা নেই। কিন্তু তুমি যদি পরে লজ্জা পাও তাহলে আমাকে কিন্তু দোষ দিতে আসবে না বলে দিলাম।”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৩
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফারাহ। প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না,চুপ রইল ক্ষণকাল।
“দিয়ে দিন না!”
“সে এগেইন।”
এবারেও চুপ করে গেল ফারাহ।
“ফাজিল আপনি।”
গা দুলিয়ে হেসে উঠলো তাশফিন। সুদর্শন পুরুষ, ফারাহ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে তার পানে। পুরুষ মানুষ বুঝি এত সুন্দর? ক্লিন শেভ করা গাল,চওড়া বক্ষ। শক্তপোক্ত পুরুষ।সব দিক দিয়ে পারফেক্ট, এই সুদর্শন পুরুষ তার স্বামী।অকস্মাৎ নিজ ভাবনায় লজ্জায় নিমজ্জিত হয় তার অঙ্গ।