তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৭
ফারহানা নিঝুম
সন্ধ্যার আকাশে তখন নরম বেগুনি আর কমলা রঙের খেলা, সূর্য অস্ত যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। বাতাসে একটা মিষ্টি ঠান্ডা ভাব, হালকা দুলে যাওয়া fairy lights গুলো যেন পুরো পরিবেশকে এক মোহময় আবরণে ঢেকে দিচ্ছে।চারপাশে ছোট ছোট দীপ জ্বলছে, মোমবাতির আলোয় ঝিকমিক করছে সাজানো টেবিলগুলো। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বল করছে রঙিন লাইট, যেন তারারাও আজ এই আনন্দে যোগ দিয়েছে।একপাশে ছোট্ট এক মঞ্চ, ফুলের তোড়ায় সাজানো, যেখানে বর-কনে বসবে। অতিথিরা হাসিমুখে এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, কেউ কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, আর বাচ্চারা দৌড়ে বেড়াচ্ছে আনন্দে।হালকা মিউজিক বাজছে, রোমান্টিক কিন্তু শান্ত একটা সুর, যা পুরো পরিবেশকে আরও স্বপ্নীল করে তুলেছে। খাবারের টেবিল থেকে ভেসে আসছে সুগন্ধি, যেন সন্ধ্যার আবেশে আরেকটু উষ্ণতা যোগ করছে।
আংটি বদল অনুষ্ঠান শুরু হবে কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই।
কালো রঙের কুর্তা জড়িয়েছে তাশফিন। সৌহার্দ্য একই রকম কুর্তা পড়েছে তবে নীচের দিকটা ভিন্ন।মাহির এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে ব্যস্ত, তার পিছু ছুটে চলেছে ঝুমুর।
“মাহির দাঁড়া,এই মাহির।”
খালামনির কথা শুনতে নারাজ সে,চট করে গিয়ে কোলে উঠে গেল নবীনের।
“হেই নবাব দৌড়াচ্ছো কেন?”
নবাব ডাকটা ভালো লেগেছে তার, খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মাহির।
“খালামনি।”
আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখালো মাহির, সামনের দিকে। সেদিকে তাকালো নবীন, ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে।বাদামি রঙের লং ড্রেস পড়েছে মেয়েটা। অমায়িক লাগছে তাকে।
“এই মাহিরের বাচ্চা নেমে আয় বলছি।”
নেমে গেল মাহির,এবার ছুটে নবীনের পিছনের দিকে।হা হা করে হেসে উঠলো নবীন।কারণ ব্যতিত হাসায় বিরক্ত হলো ঝুমুর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“পাগলের মত হাসছেন কেন?”
থেমে গেল নবীন,এত বড় অপমান?
“আসলে কি বলো তো সামনে যদি এত বড় পাগলী থাকে তাহলে না হেসে উপায় আছে?”
ডিরেক্ট পাগলী বলে সম্বোধন করেছে ঝুমুর কে,অবাক নেত্রে চেয়ে রইল ক্ষণকাল ঝুমুর।তেতে উঠল সে।
“তোমার তো সাহস কম না আমাকে পাগলী বলো?”
“তোমার তো সাহস কম আমাকে পাগল বলো।”
চুপটি করে গেল ঝুমুর, মেজাজ খারাপ করতে চাচ্ছে না সে। আপাতত অনুষ্ঠানে কোনো রকম ঝামেলা করতে চায় না সে। চুপচাপ স্থান ত্যাগ করলো। নবীন মনে মনে কুটিল হাসলো। মজা পেয়েছে সে।
অপেক্ষা করছে তাশফিন, এত অপেক্ষা?হাহ্ সে অপেক্ষা করার মানুষ নয় তবে ফারাহর বেলায় সে ধৈর্যশীল।আপাতত বউ কে বাড়িতে নিতে হবে তাকে।
হালকা মেরুর রঙের লং গোল জামা পড়েছে ফারাহ,নিচের দিকটা সোনার তরী কাজ করা।বড় করে পিছন থেকে হাত গলিয়ে ঘোমটা টেনে দেওয়া কপাল পর্যন্ত। হালকা মেকআপ, হাত ভর্তি চুড়ি। পায়ে নরমাল জুতো।স্নেহা এবং নূপুর তাকে নিয়ে দুতলা থেকে নেমে এলো।বুকের ধুকধুক শব্দ শুনতে পাচ্ছে কি তাশফিন?হয়তো শুনতে পাচ্ছে তাই তো বুকের কাজটায় হাতটা চেপে ধরেছে। এলোমেলো হলো তার দৃষ্টি, মস্তিষ্ক প্রায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, ভেতর শুকিয়ে কাঠ। ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রকাশ্যে।
চোখাচোখি হয় দু’জনের, আঁখি মিলে। আচ্ছা মিলে কী অনূভুতি? তীব্র বুক ধড়ফড়িয়ে নিয়ে নিচে এলো ফারাহ।তাশফিন কে চিনে,লোকটা তার স্বামী, কিন্তু তার সহিতে ঘর হয়নি এখনো।তার রাগ অভিমান ভ’য়ংকর ,তাকে আদেও সামলাতে পারবে ফারাহ?
শুভক্ষণ ঘনিয়ে এলো অতিদ্রুত,পাশের পুরুষ টি কে আবারো পাবে ফারাহ। চাপা স্বরে বলল।
” ইউ আর লুকিং সো প্রীটি সুখ।”
চকিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায় ফারাহ,অধর কোণে ঝু’লছে তাশফিনের দুষ্টু দুর্বোধ্য হাসিটা।
“মিসেস শেখ কাল রাত থেকে আপনি তাশফিন শেখের নামে বন্দি হবেন নিশ্চিতভাবে।”
সম্পর্ক মানে অনেক গুলো দায়িত্ব।মা বাবা, ভাই বোন স্বামী নামক একজন ব্যক্তিগত পুরুষ। নতুন একটি পরিবার। একটি বিয়ের দ্বারা তৈরি হয় অনেক গুলো সম্পর্ক।
অনামিকা আঙ্গুলে কোমল স্পর্শ পেয়ে ভাবনায় ছেদ পড়ল, আঙ্গুল ছুঁয়ে তাশফিন। পড়িয়ে দিয়েছে নিজের নামের ডায়মন্ডের রিং টা। অতঃপর তার দিকে এগিয়ে দিলো আরো একটি রিং, ফারাহ নির্দ্বিধায় তা পড়িয়ে দিল তাশফিনের আঙ্গুলে। আঁখি মিললো দুজনার, অনূভুতির অদলবদল হলো কিনা তা জানা নেই।তবে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো ফারাহ, দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকালো।
আনন্দে ভরে উঠে চারি পাশ,রুবেনা শেখ আনন্দে আত্মহারা রীতিমতো। ছেলের বউ নিয়ে যেতে পারবে অবশেষে।
স্নিগ্ধ বিকেল ,সারাদিনের কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে, আর প্রকৃতি যেন এক নতুন রূপে সেজে ওঠেছে। আকাশের নরম রোদ সোনালি আভায় চারপাশ রাঙিয়ে তোলছে, লালচে-কমলা আলোয় রঙিন হয়ে ওঠে দিগন্ত। গাছের পাতাগুলো হালকা বাতাসে দুলতে লাগলো ।পাখিরা নীড়ে ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বিকেল মানেই খোলা মাঠে শিশুরা খেলায় মেতে ওঠা, নদীর ধারে জেলেদের মাছ ধরা, আর গাছতলায় বয়স্কদের গল্পের আসর।ক্লান্ত দিনের শেষে একটু স্বস্তির পরশ বয়ে আনে।
রুমে বসে আছে ফারাহ, সন্ধ্যা বেলায় গায়ে হলুদ,পর পর অনুষ্ঠান গুলোর জন্য বেগ পো’হাতে হচ্ছে তাকে।তার উপর দিয়ে যে কি যাচ্ছে একমাত্র সে-ই জানে।পরণে বাদামি রঙের সালোয়ার স্যুট,এটা দিয়ে গেছে নূপুর।রুবেনা শেখ সব কিছু ছেলের বউয়ের জন্য নিজে পছন্দ করে এনেছেন। অন্ধকারে ডু’বে আছে রুম, কারেন্ট গেলো সবে।তার উপর ওড়না খুঁজে পাচ্ছে না ফারাহ, আকস্মিক অনুভব করলো দরজা খুলে ভেতরে কেউ প্রবেশ করেছে।
“কে?”
মৃদু স্বরে জিজ্ঞাস করে ফারাহ,অবয়ব কাছাকাছি এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। আঁ’তকে উঠে ফারাহ , স্পর্শ টা বড্ড অচেনা লাগলো তার নিকটে।কই তাশফিন তো এভাব ছোঁয় না,তার স্পর্শ যে খুব করে চেনা ফারাহ।
“কে আপনি ছাড়ুন আমায়…
কারেন্ট চলে এলো, ফারাহ ঘুরে দাঁড়ালো তৎক্ষণাৎ। ফর্সা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, ফারাহ কি তাকে চেনে? না তাকে তো চিনে না।
ব্যস্ত হয়ে উঠে সাইফুল, ব্যস্ত কন্ঠে বলল।
“আমাকে ক্ষমা করে দাও ফারাহ! আমি ভেবেছিলাম তুমি… তুমি নূপুর, নূপুর কে সারপ্রাইজ দিতে এসে…
কথা আটকায় সাইফুলের। প্রত্যুত্তরে কি বলা যায় তা খুঁজে পায় না ফারাহ। শুকনো ঢোক গিললো সে, স্পর্শ টা মোটেও পছন্দ হয়নি তার,তবে সাইফুল যে বলছেন তিনি ভুল করেছেন!
“আমাকে ক্ষমা করো ফারাহ, আমি দুঃখিত…
নিচ থেকে ভেসে এলো নূপুরের কন্ঠস্বর, সাইফুল অপেক্ষা করলো না ছুটে গেল সেদিকে।
আকাশে রঙ হারানো সূর্যের শেষ আলো, হালকা সোনালি আভা মিশে গেছে ধূসর মেঘের সাথে। বাতাসে একধরনের নিস্তব্ধতা, যেন সমস্ত শহর আজ ক্লান্ত।
জানালার একপাশে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে ফারাহ।
মাথার চুল এলোমেলো, হয়তো বাতাসের ছোঁয়ায়, হয়তো দিনের ক্লান্তি জমে আছে সেখানে। দু’হাত একসাথে জড়িয়ে রেখেছে কোলে, আঙুলগুলো মাঝে মাঝে কাঁপছে অজান্তেই। চোখের কোণে শুকিয়ে আসা কান্নার দাগ, দৃষ্টি হারিয়ে গেছে দূরের কোনো শূন্যতায়।জীবন তাকে এমন এক বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে সবকিছুই অর্থহীন মনে হচ্ছে। বাতাসে একটানা শিরশিরে শব্দ, যেন প্রকৃতিও তার বিষন্নতার সাক্ষী। কেউ তাকে ডাকছে না, কেউ তার কাছে এসে বসছে না এই বিকেল, এই একাকিত্বই তার সঙ্গী হয়ে বসে আছে নিঃশব্দে।হো হো শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে, হঠাৎ করেই নিজেকে বড্ড অপবিত্র বলে মনে হচ্ছে তার।কই তাশফিন ছুঁলে তো এমন লাগে না।
স্নেহা এসে ডেকে গেছে তাকে,অথচ দরজা খুলে নি মেয়েটা।
অস্থির পায়ে এদিক সেদিক করছে স্নেহা।স্নেহা কে অস্থির দেখে দূর হতে এগিয়ে এলো তাশফিন।
“কী হয়েছে স্নেহা? অস্থির দেখাচ্ছে?”
আমতা আমতা করছে স্নেহা,সে বড্ড ভয় পায় তাশফিন কে।
“আসলে..
“তুমি কী আমাকে কোনো কারণ বশত ভয় পাচ্ছো?দেখো কিছু হয়ে থাকলে বলো আমাকে!”
“আসলে ভাইয়া ওই ফারাহ না কখন থেকে রুমে বসে আছে, দরজা খুলছেই না।”
চিন্তিত হলো তাশফিন, ব্যতিব্যস্ত হয়ে দ্রুত পায়ে দুতলায় গেল।কী হলো তার বউটার? এমনিতে তো টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, আজকে কি হয়েছে?
দরজায় কাছে এসে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল তা।
“ফারাহ।”
চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ফারাহ। দৃষ্টি তার ঝাপসা।
“লেফটেন্যান্ট সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরুন প্লিজ।”
তাশফিন থমকালো, চমকালোও বটে।ফারাহ কি বলছে তাকে জড়িয়ে ধরতে? ভাবনাটুকু সাইডে রেখে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে শীর্ণ বদন খানি। বক্ষপৃষ্ঠে মিলিয়ে নেয় মূহুর্তের মধ্যে। হো হো করে কেঁদে উঠলো ফারাহ। হেঁচকি উঠে গেল তার, জড়ানো কন্ঠে বলল।
“ভালো করে ধরুন না..এমন ভাবে ধরুন আপনার স্পর্শ ছাড়া আর কারো স্পর্শ যাতে না থাকে।”
বক্ষে ব্যথা হয় তাশফিনের, কাঁপছে কন্ঠনালি।
“সুখ!কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো।”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৬
“আমি আপনার ছোঁয়া চাইছি লেফটেন্যান্ট সাহেব।সব জায়গায় ছুঁয়ে দিন না।”
ফারাহর অভিব্যক্তি বুঝতে পারছে তাশফিন,তবে সে নিশ্চিত কিছু হয়েছে যা ফারাহর সত্তা নাড়িয়ে দিয়েছে। জড়িয়ে ধরে তাশফিন,তুলে নেয় পাঁজা কোলে। আলগোছে শুইয়ে দেয় বিছানায়,ফের এলো উপরে। নিজের বক্ষপৃষ্ঠে পিষ্ঠ করলো মেয়েটাকে। জড়িয়ে নেয় বাহু ডোরে।