তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩৫
ফারহানা নিঝুম
প্রকৃতি আজ শান্ত, অভিমান ভুলে যেন স্নিগ্ধতায় মোড়ানো।মাঝে মাঝে ছাদের ওপর দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ করে মাটি ছুঁয়ে যায়।
ফারাহ ধীরে ধীরে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা হাতে নিয়ে ব্যালকনির দিকে এগোয়। ওড়নার এক কোণা উড়ে গিয়ে কপালের সামনে এসে পড়ে। সে আলতো করে সেটা সরিয়ে দেয়, আর চায়ের কাপের কাচে জমে ওঠা বাষ্পে নিজের প্রতিচ্ছবি ম্লান হয়ে যায়।চোখ তুলে দেখে দূরের সবুজ গাছগুলো ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছে।হঠাৎ কোমরের কাছে এক কোমল, উষ্ণ স্পর্শ।ফারাহ কেঁপে ওঠে একটু। চায়ের কাপটা প্রায় হাতে থেমে যায়। আর সেই স্পর্শের মধ্যে যে অনুভব তা চেনা, তা প্রিয়।তাশফিন শেখ। তার পরম পুরুষ।
তাশফিন পিছন থেকে ফারাহকে জড়িয়ে ধরে, চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে।
❝বৃষ্টি নামছে আর তুমিও ঠিক বৃষ্টির মতোই, নিঃশব্দে এসে হৃদয় ভিজিয়ে দিলে।❞
ফারাহর মনে পড়ে যায় তাশফিনের সাথে তার প্রথম সাক্ষাতেই দিনটি। সেদিন তো বৃষ্টি ছিলো, চুপিসারে নেভি অফিসারদের দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে তাশফিনের হাতে। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো তার মুখাবয়ব।
তাশফিনের স্পর্শ একটু একটু করে গভীর হয়। তার হাতের উষ্ণতা যেন ব্যালকনির ঠান্ডা হাওয়াকেও পেছনে ফেলে দেয়। ফারাহ ধীরে ধীরে চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রাখে।
তাশফিন তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এই সন্ধ্যা শুধু আমাদের আসঙ্গ রাত্রির আহ্বানে নিজেকে তুলে দাও আমার কাছে সুখ।”
‘সুখ’ তাশফিনের ভালোবাসার নাম, শুধু সে-ই তাকে এই নামে ডাকে। এই নামে ডাকলেই যেন ফারাহর সমস্ত সত্তা গলে যায়।আলতো করে পাঁজা কোলে তুলে নেয় ফারাহকে। সে লাজুক হেসে বলে,
“আপনি তো আস্ত নির্লজ্জ। এভাবে কোলে নিতে লজ্জা করে না?”
চোখ টিপে তাশফিন। দুষ্টু হাসি খেলা করছে তার অধর কোণে।
তাশফিন মৃদু হেসে ফিসফিস করে।
“তোমার ওজন তো প্রেমেই হালকা হয়ে যায় আমার কাছে।আর লজ্জা সেটা তো আমার কোনো কালেই ছিলো না মিসেস শেখ।”
চোখ টিপে তাশফিন, ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত করে তাকালো ফারাহ।
বেডরুমের জানালায় তখনো বৃষ্টির শব্দ, বাতাসে কুয়াশার গন্ধ। ঘরের মৃদু আলোয় ফারাহর চুল ছড়িয়ে পড়ে তাশফিনের বাহুতে। ধীরে ধীরে সে যেন ফারাহর প্রতিটা শ্বাসে, প্রতিটা স্পর্শে তার প্রেমের পূর্ণতায় পৌঁছাতে চায়।
খুব ধীরে, গভীর আবেগে ফারাহকে নিজের কাছে টেনে নেয়, তার অস্থিরতা ছুঁয়ে দেয় ভালোবাসার স্থিরতায়।
কানের পিঠের চুল গুলো আলতো হাতে গুঁজে দিল। ব্যস্ত হাতে খুলে ফেলল অলংকার গুলো। ওড়না টা ছুঁড়ে ফেলে অদূরে। লজ্জায় হাঁসফাঁস করছে ফারাহ। অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠলো।
“আমার কাছে আসবেন না কমান্ডার।”
পিছলে হাসে তাশফিন,তাকে আরেক দফা চমকে দিয়ে ফারাহ বলে উঠে।
“আমার কাছে এভাবে আসলে কিন্তু আম্মুর কাছে বিচার দেব।”
এবারে তাশফিন প্রত্যুত্তরে বলল,
“উফ্ জান একটুখানি আসি। কাউকে বলতে নেই।”
নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে হাসলো ফারাহ, ফের বলে উঠে।
“আমি না ছোট মানুষ। ছোট মানুষের সামনে এসব করতে নেই।”
তাশফিন কম যায় না, ফারাহ কে বিপাকে ফেলতে বলল।
“সমস্যা কি আমি আছি না বড় ? আমার বাচ্চা বউটাকে পেলে পুষে বড় করে দেব , ছোট্ট বাচ্চা টা কে।”
চিকন নাকের ডগা ফুলে উঠে ফারাহর। তেতে উঠল সে,
“একদম আমাকে ছুঁবেন না। আমি কিন্তু পবিত্র। আমাকে ছুঁলে আমার স্বামী আপনাকে গু’লি করে দেবে!
ফিচলে হেসে উঠলো তাশফিন,তার হাসিতে নিজেও হেসে ফেললো ফারাহ।
রাত গভীর হচ্ছে ধীরে ধীরে। নিঃশ্বাসের ঘনত্ব বেড়ে চলেছে সেই সাথে।ঘড়ির টিক টিক শব্দ এবং ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ মিলেমিশে একাকার। শাড়ির আঁচলটা হাতে পেঁচানো তাশফিন, ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট। একটুখানি গভীর স্পর্শে মুচড়ে যায় ফারাহ।তাশফিন তো তাকে এভাবে আগে ছোঁয় নি, অন্তঃস্থলে তীব্র কাঁপুনি অনুভব করলো ।অবাধ্য হাতের স্পর্শে সর্বাঙ্গ অসাড় ফারাহর।পুরুষ্ট বক্ষের নিচে পিষ্ট তার তুলতুলে দেহ খানা। ভালোবাসার অতল গহ্বরে ডু বে যাচ্ছে সে। একটুখানি মুখ তুলে কানের লতিতে হাল্কা কামড়ে দিল তাশফিন।
“আমার যে সুখ গুলো পাওনা ছিল তা আজকে শোধে আসলে নিয়ে নেব ম্যাডাম।”
এক পলক দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায় ফারাহ। অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে যায় তাশফিনের।
তাশফিনের কণ্ঠে লেগে থাকা রসিকতার ছোঁয়ায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় ফারাহ। কিন্তু চোখের কোণে লুকানো যে আকা’ঙ্ক্ষা, সেটা আর কারো অজানা নয়। অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাদের শরীরে স্না’য়ুর মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
তাশফিনের আঙুলগুলো আলতোভাবে ফারাহর পিঠ বেয়ে নামছিল নিচের দিকে। তার প্রতিটি ছোঁয়াতে যেন শরীরের প্রতিটি কোষ শিহরিত হয়ে উঠছিল। শাড়ির কুচিগুলো একে একে খুলে ফেলে রাখলো তাশফিন, যত্নে, ভালোবাসায়। ফারাহর শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মিষ্টি গন্ধে তাশফিন তন্ময়।
তার ঠোঁট এবার নামতে থাকে গলার খাঁজ বেয়ে বুকের দিকে। বুকের মাঝখানে এক নরম চুমু রেখে ফারাহর চোখে তাকায় যেন বলছে,
“তুমি শুধু আমার।”
ফারাহর দেহ তখন ভালবাসার উত্তাপে গলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। একটানা সেই অনুভবে সে নিজের সবটুকু সমর্পণ করে দিলো তাশফিনের কাছে।
ঘরের বাতাস যেন থমকে আছে। শুধুই নিঃশ্বাসের ভার, ঘাম আর ভালবাসার শব্দ।
একসময় মিলনের সেই পূর্ণ মুহূর্তে, দুজনই নিঃশব্দে জড়িয়ে থাকে, যেন সারাজীবনের ক্লান্তি একে অপরের বুকে মাথা রেখে ভেসে যাচ্ছে।বাহিরে তখন রাতের শেষ প্রহর। জানালার ফাঁক গলে হালকা শীতল হাওয়া ঢুকছে, তবুও তাদের জড়ানো শরীরের মাঝে ছিল এক উষ্ণ পৃথিবী।একসময় ফারাহ ঘুমিয়ে পড়ে, তাশফিন তখনো জেগে। তার চোখে এক অদ্ভুত মায়া একজন প্রেমিক, একজন স্বামী, একজন ভালোবাসার মানুষের চোখ।
সে ফারাহর কপালে আবার একটি চুমু খায়, তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলে।
স্নেহা কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দু’দিন আগেই তো কৃষ্ণপুরে ফিরেছে। কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল এরপর কেউ একটা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বিকেল হয়ে এসেছে অথচ স্নেহা বাড়ি ফিরছে না । নবীন কলেজে গিয়ে খুঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে স্নেহা সেই সবার সাথেই ক্লাস করে বেরিয়েছে। ক্লাসমেটরা সবাই বলেছে ও তো ওদের সাথেই ছিলো, এরপর ওরা ওদের বাড়ির পথ ধরেছে। কথাটি বাড়ির সবাই জানতে পেরেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে।গত কাল থেকে এখন পর্যন্ত ঘুমান নি শায়লা আহমেদ।মেয়ের চিন্তায় রীতিমতো অস্থির তিনি। ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস করছেন।
বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা নেমে এসেছিল কৃষ্ণপুরের গায়ে এক নিস্তব্ধ নিঃশব্দতা নিয়ে। বাতাসে ছিল হালকা ঠান্ডার ছোঁয়া, আর দূর থেকে ভেসে আসছিল শীতল পল্লবধ্বনি। সেই সন্ধ্যাতেই, এলাকার উত্তরের প্রান্তে, এক নির্জন পথে যেখানে গাছের ছায়া সূর্যের শেষ রশ্মিকে চিরে ফেলে দীর্ঘ ছায়া এঁকে দেয় মাটিতে সেখানে মাটিতে নিথর পড়ে থাকতে দেখা গেল এক যুবতীকে। তার চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল ধুলোমাখা মাটির বুকে, নিস্তেজ মুখটি যেন নিদ্রিত, অথচ তাতে অজানা এক বিষণ্নতার ছাপ। কেউ জানে না সে কোথা থেকে এল, কীভাবে এল এমন অবস্থায় সবকিছুই এক অনুচ্চারিত রহস্য হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ওই ছোট্ট জনপদে। পুলিশের জানানো হয় তার কথা। পুলিশের থেকে জানা গেলো ওই যুবতী আর কেউ নয় স্নেহা।
হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে মেয়েটাকে। ইতিমধ্যেই গুঞ্জন শুরু হয়েছে কোন ছেলের সাথে কি করে এসেছে কে জানে!মেয়ের জামা কাপড়ের ঠিক ছিলো যখন তাকে পাওয়া যায়।
খবরটি শোনা মাত্রই সেখানে রওনা দিলো শেখ পরিবারের সবাই।সেই থেকে তাশফিনের বুকে গুটিসুটি মে রে চোখের পানি ফেলছে ফারাহ।তার আর স্নেহার সম্পর্ক শুধু বোনের নয়।সে তার সব কিছুর সঙ্গী।স্নেহা ছাড়া সে আজ পর্যন্ত কিচ্ছুটি করেনি।অথচ সেই মেয়েটার কি না এমন অবস্থা?এই তো তার সাথে দিব্যি কত গুলো দিন থেকে এলো।যদি ফারাহ জানতো এমন কিছু হবে তাহলে কখনোই তাকে আসতে দিতো না।
বিছানার এক কোণে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে স্নেহা। সে কথা হারিয়েছে।আজ পুরো একটি দিন সে কথা বলছে না। হসপিটাল থেকে আসার পর থেকেই কথা বন্ধ তার।শায়লা আহমেদ কত জিজ্ঞেস করেছেন কিন্তু স্নেহা?সে একটা শব্দও বলেনি । যদি জিজ্ঞেস করা হয় কে এসব করেছে বা কি হয়েছিল তার সাথে? কিন্তু উত্তরে চুপ স্নেহা।
“আমি জানি না ওর কি হয়েছে? কিন্তু আমার মেয়েটার এই অবস্থা কে করলো?”
শায়লা আহমেদের আর্তনাদ বড্ড অসহায় শোনালো রুবেনা শেখের নিকটে।তিনি শান্তনা দিতে বললেন,
“ধৈর্য ধরো আপা। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।আর কে এসব করছে সেটাও জানা যাবে।”
আরিফা আহমেদ বাকিদের চায়ের ব্যবস্থা করছেন। এত দূর থেকে এসেছে সবাই কেউ কিচ্ছু খায়নি। এর মধ্যে জয়নাল আহমেদের পুলিশের কাছে গিয়েছেন রিজুয়ান শেখ। মোটেও একা ছাড়তে চাইছেন না দূর্বল মানুষটাকে!
স্নেহার রুম থেকে ভরা আঁখি নিয়ে বাইরের বেরিয়ে আসছে ফারাহ। তৎক্ষণাৎ দেখা হলো তাশফিনের সাথে, সেও স্নেহার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল।
“সুখ!”
হাত মুঠো করে টেনে ধরে তাশফিন, ফুঁপিয়ে উঠলো ফারাহ। বক্ষঃস্থল কম্পিত হয় তাশফিনের, অস্থির কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে সুখ?স্নেহা কিছু বলেছে? তুমি কাঁদছো কেন?”
“স্নেহা একটাও কথা বলছে না লেফটেন্যান্ট সাহেব। কিছু বলছে না। আমার সাথে কথা বলছে না ও। আমার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারে, কিন্তু আজকে কথা বলছে না। কেমন মূর্তির মতো বসে আছে। আপনি কিছু করুন না..
হো হো করে কেঁদে উঠলো ফারাহ, আলগোছে তাকে বুকে টেনে নিল তাশফিন।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩৪
“হুসসস ডোন্ট ক্রাই। আমি দেখছি কি করা যায়। একটু অপেক্ষা করো।”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!”
“ইসসস কাঁদতে নেই, আমি বললাম তো সব ঠিক করে দেব।”