তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩৬

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩৬
ফারহানা নিঝুম

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তো!”
ফারাহর কান্না দেখে হাঁসফাঁস করছে তাশফিন। ছোট্ট পাখিটাকে বুকে টেনে নিলো সে। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো।
“তোমার কান্নায় আমার কষ্ট হচ্ছে, সুখ। তুমি বুঝো না?”
নিশ্চুপ ফারাহ জড়িয়ে আছে তাশফিন কে। এই মানুষটা থাকলে সব কষ্ট স’হ্য করতে পারবে ফারাহ।
নিস্তব্ধ রুমে একাকী বসে আছে স্নেহা, টিপটিপ বুকে দুরু দুরু কম্পন খেলে যাচ্ছে।মুখে টু শব্দটি নেই তার। দৃষ্টি কোলে পড়ে থাকা হাত দুটোর দিকে। বিছানার সামনেই টান টান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তাশফিন। তীক্ষ্ণ কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল সে। না এভাবে হবে না। নিজেকে কিছুটা শান্ত কন্ঠে বলল,
“স্নেহা আমাকে বলবে কি হয়েছে?”

প্রত্যুত্তরে এখনো চুপ স্নেহা। মুখখানি মলিন হয়ে আছে তার। ব্যথার ছাপ যেন স্পষ্ট।তাশফিন এবারে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বিছানায় সামনাসামনি বসলো স্নেহার। কোলের উপর পড়ে থাকা হাত দুটো আলতো করে টেনে ধরে। শান্ত সমুদ্রের ন্যায় বলল,
“আমি তোমার দুলাভাই না,ভাই হয়ে জিজ্ঞেস করছি।কি হয়েছে বলো আমাকে!আই প্রমিজ যেটা তুমি বলবে সেটা শুধু তোমার আর আমার মধ্যেই থাকবে। আচ্ছা তোমার কি ভালো লাগছে স্নেহা সবাই কে টেনশনে দেখে? সবাই তোমাকে কতটা ভালোবাসে!সেই তুমি এভাবে চুপ করে যাওয়ায় কতটা মানসিক চাপ পড়ছে সবার উপর। কাউকে বলতে না পারলেও ফারাহ কে অন্তত বলতে।আর ওকেও যদি বলতে না পারো তাহলে আমাকে বলো! এরপর দেখো আমি ফিরে কি করি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অঝোরে কেঁদে ফেলল স্নেহা, হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে তার।
“ভাইয়া আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন। আমার প্রচুর ভয় করছে।”
তাশফিন এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো না, স্নেহা কে আলগোছে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে।এখানে যদি নূপুর বা ঝুমুর থাকতো তাহলে সে এটাই করতো। কম্পিত স্বরে বলতে লাগল।
“সায়র মোটেও ভালো নয় ভাইয়া।সে ইচ্ছে করে আমার সাথে ওরকম করেছে!”
কলেজ থেকে ফেরার পথে সায়রের সাথে দেখা হয় স্নেহার।সে বরাবরের মতো ইগনোর করে তাকে। কিন্তু আচমকা সামনে চলে আসে সায়র। বিরক্ত হয়ে বলে উঠে স্নেহা।
“এই সায়রের বাচ্চা তুই সামনে আসলি কেন?পথ ছাড় তো।”
রাগে রীতিমতো ফুঁসছে সায়র।
“ওই মুখ সামলে কথা বলবি স্নেহা,তোর কারণে এখন কলেজের সবাই আমাকে অপমান করে কথা বলে।বারো বা’তার বলে।”

হা হা করে হেসে উঠলো স্নেহা।
“ঠিকই বলে, সিনিয়র জুনিয়র সবাই লাইন মা’রলে আর কি বলব?সর তো সামনে থেকে খচ্চ’র একটা।”
রাগে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না সায়র,চুল টেনে ধরে স্নেহার। ব্যথিত কন্ঠে চেঁচায় স্নেহা।
“সায়র কি করছিস এটা?ছাড় বলছি!সায়র ভালো হবে না কিন্তু।”
সায়র শুনে না তার কথা, হঠাৎ করেই সেখান থেকে ধরে নিয়ে গেল উত্তরের দিকে। উত্তরের দিকটা বরাবরই নিরিবিলি জায়গা।সায়র জোরপূর্বক নিজের পুরুষত্ব জাহির করে স্নেহার উপর। নিজেকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো স্নেহা। শেষমেষ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলো ওখানেই।
ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে চোয়াল শক্ত হচ্ছে তাশফিন। চোখের কার্নিশ লাল হয়ে উঠেছে তার।এক মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছে ঐখানে যদি নূপুর, ঝুমুর কিংবা ফারাহ থাকতো তাহলে?সে কি করতো?সায়র কে এর আগেও বলেছে ফারাহ কে বিরক্ত না করতে।এখন স্নেহা কে?

নিস্তব্ধ রাত্রি, উত্তর দিকে কেউ নেই।আধম’রা হয়ে পড়ে আছে সায়র।এক পাশে রড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাশফিন।তাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। হবেই বা না কেন? ইচ্ছে মতো পিটি’য়েছে তাকে। একটা মেয়ের সব চঞ্চলতা কেড়ে চলেছে এই জা’নোয়ার। এদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।সে চাইলেই পারতো আইনের সাহায্য নিতে, কিন্তু করেনি। অস্পষ্ট গো’ঙানির আওয়াজ আসছে। অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ালো তাশফিন। হুট করে রড দিয়ে সজোরে আ’ঘা’ত করলো তার মস্তকে।
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে সায়র তার ব্যবসায়ী বাবা আহাজারি করছেন। নিজের ছেলেকে সময় থাকতে শাসন করেন নি। তাহলে আজকে এরকম হতো না।

সূর্যটা যেন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে দিনের ভার বইতে বইতে। আলো ফিকে হয়ে এসেছে, আকাশের রং একধরণের ধূসর কমলার মতো চিৎকার না করে কাঁদা কান্নার মতো মৃদু, নিঃশব্দ। চারদিকটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ,গাছের পাতায় হালকা বাতাস ছুঁয়ে যায়, কিন্তু তাতে প্রাণ নেই শুধু স্পর্শ আছে। দূরে কোথাও একটা কাক ডাকছে ধীরে, সেটাও যেন ক্লান্ত কণ্ঠে। রোদের আঁচ ছায়া হয়ে মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। ঠিক তেমনি নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে বসার ঘরে। রিজুয়ান শেখ এমন একটি প্রস্তাব রেখেছেন যা শুনে সবাই স্তম্ভ রীতিমতো।
জয়নাল আহমেদ কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে বললেন,

“এটা কি করে সম্ভব রিজুয়ান?”
সাজ্জাদুল আহমেদ একই স্বরে বললেন,
“একই বাড়িতে দুই মেয়ে কিভাবে কি?আর সৌহার্দ্য কি মেনে নেবে?”
সৌহার্দ্যের সঙ্গে বিয়ের কথাটি রাখলেন রিজুয়ান শেখ।যেটা শুনে সবাই স্তম্ভ!স্নেহা কে নিয়ে খারাপ খারাপ কথা শোনা যাচ্ছে আশেপাশে ‌। আগে যারা চোখ নিচু করে কথা বলতো আজকে তারা আঙ্গুল উঁচিয়ে দোষ দিচ্ছে। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া টা কি খুব বড় অন্যায়? সমাজে পুরুষ জাতি কে সবাই এভাবে হেয়া করার বদলে মেয়েদের দিকে আঙ্গুল তুলছে। আহমেদ পরিবারের প্রতিটা সদস্য কেমন তা কারো জানতে বাকি নেই তার পরেও এরকম একটা সময়ে এসব বলবে তা ভাবা যায় না।

রুবেনা শেখ বলে উঠেন।
“এতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয় ভাইজান। জয়নাল ভাই আপনি তো কখনো না কখনো স্নেহা কে বিয়ে দিতেন, তাহলে আমাদের সৌহার্দ্যের সঙ্গে দিলে কি হবে?”
জয়নাল আহমেদ মলিন হাসলেন,
“সমস্যার কথা নয় রুবেনা, কথা হচ্ছে সৌহার্দ্যের মতামত।সে কি আদেও রাজি হবে?”
রুবেনা শেখ তড়িঘড়ি করে বললেন,
“ওর সাথে আমি কথা বলব ভাইজান। একটু সময় দেন।”
জয়নাল আহমেদ আর না করলেন না,সময় টুকু দিলেন।

নৌঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে সৌহার্দ্য।
চারপাশটা যেন হঠাৎ করে থেমে গেছে, শব্দহীন এক স্থবিরতায় ঢেকে গেছে সবকিছু।আকাশের রঙ হালকা ধূসর, কোথাও কোথাও সোনালি বিকেলের ছায়া লেগে আছে পানির গায়ে। দূরের কোনো জাহাজ থেকে হালকা ধোঁয়া উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে।সৌহার্দ্যের চোখ সামনের জলরাশির দিকে ।
সৌহার্দ্যের পিঠ সোজা, কিন্তু চোখে অস্থিরতা। দু’হাত পকেটে গুঁজে রাখা, সামনের পানির দিকে তাকিয়ে থেকেও সে আসলে দেখছে না মনে মনে হিসেব কষছে। বড় একটা ডিল, যার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু ক্যারিয়ার, প্রতিশ্রুতি, ক্ষমতা।

তার নিঃশ্বাস ভারী, কপালের শিরাগুলো একটু টানটান।
প্রতিটি মুহূর্ত যেন গায়ে এসে লাগছে চাপ নিয়ে।
তবুও সে দাঁড়িয়ে থাকে কারণ সে জানে, পেছনে ফেরা এখন আর কোনো অপশন না।কর্কশ শব্দে মুঠোফোনটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো শান্ত, নিস্তব্ধ বিকেলটা যেন চমকে উঠলো সেই শব্দে। সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলো, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললো। বিরক্তি ফুটে উঠলো তার চোয়ালের রেখায়, চোখের কোণে জমে থাকা চাপা রাগটুকু এবার মুখে উঠে এলো।
মুঠোফোনের স্ক্রিনে ঝলসে উঠলো পরিচিত এক নাম।
সে জানে, কী বলবে তারা।সে জানে, কেন এই সময়েই ফোন করতে হবে তাদের।আর সে এটাও জানে এই মানুষগুলো তার শান্তি বোঝে না, বোঝে না একটুখানি নিঃসঙ্গ হতে চাওয়ার অধিকারটুকু।অভ্যস্ত আঙুলে ফোনটা সাইলেন্টে দিলো সে।

“ধরলো না ফোনটা!”
মুখ বাঁকিয়ে বলল রাইমা শেখ,কি করবেন উনি? চাপা রাগ হচ্ছে রিজুয়ান শেখ এবং রুবেনা শেখের উপর।তাদের মতামত পর্যন্ত নিলো না একবার,ছেলের বিয়ে ঠিক করে দিচ্ছে।
রুবেনা শেখ আরো একবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ফোন ধরেনি সৌহার্দ্য।
“দেখেছিস রাইমা তোর ছেলে ফোন ধরছে না।”
রাইমা শেখ কাট কাট কন্ঠে বললেন,
“তো কি করবে? আচ্ছা আপা আর ভাইজান কি আমার ছেলেকেই পেয়েছো জ’বাই করতে?”
রাইমার‌ কথার মর্মার্থ কেউই বুঝল না। রিজুয়ান শেখ প্রশ্ন করেন,
“মানে কি বলতে চাইছোস তুমি রিজুয়ান শেখ?”

“আমি এটাই বলছি ওরকম মেয়ে কে কেন আমার ছেলে বিয়ে করবে শুনি? আপনারা সবসময় আমার ছেলের উপর এরকম মতামত চাপিয়ে দিতে পারেন না ভাইজান!”
রাইমার ব্যবহারে স্তম্ভ আলাফ শেখ।ধমক দিয়ে বললেন।
“আহ রাইমা!কি হচ্ছে এসব? তুমি কি রকম ভাবে কথা বলছো ভাইয়া ভাবির সাথে?”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেল রাইমা শেখ। তিনি মোটেও স্নেহা কে মেনে নিবেন না।তার এতো সুন্দর ছেলের সাথে ধ’র্ষি’তা একটা মেয়ের বিয়ে দেবেন না তিনি।

রুমে বিছানায় এক কোণে শোয়ে আছে তাশফিন,তার বুকে কবুতরের বাচ্চার মতো গুটিসুটি মে রে শুয়ে আছে ফারাহ ‌। মেয়েটা দিনদিন অসুস্থ হচ্ছে এসব দেখে।মাথা ব্যথা, চিন্তা সব কিছু তাকে চেপে ধরেছে।তাশফিন তো একটুখানি রিফ্রেশ করানোর জন্য তাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল, কিন্তু এরকম একটা বিশ্রী ব্যাপারের জন্য ফিরে আসতে হয়েছে। পরপর কপালে অধর চুম্বন করে তাশফিন। ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমার বোকা সুখ, আমার অস্তিত্ব, আমার সব কিছু। বুকের মাংসপিণ্ড টা তুমি ছাড়া আর কাউকে বুঝে না সুখ। তোমাকে যদি আমি দেখাতে পারতাম ঠিক কতখানি ভালোবাসি?”

“তাহলে দেখিয়ে দিন।”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল ফারাহ, চোখ নিচু করে তাকালো তাশফিন।
“ঘুমাও নি?”
ফারাহ চোখ খুলতে পারছে না,তবে তাশফিনের ভালোবাসার ছোঁয়া গুলো অনুভব করতে পারছে সে।
“লেফটেন্যান্ট সাহেব আপনি বই আমার হৃদয় টা শূন্যতায় ডুবে যায়। আপনি আমাকে প্রমিজ করুন কখনো যাবেন না আমাকে ছেড়ে।”
ফের একই কাজ করলো তাশফিন, কপালে সুগভীর চুমু এঁকে দেয়।
“আমার জানাটা তোমার মাঝে আটকে আছে সুখ, ফেলে যাওয়ার চিন্তা করলেও তো জানটার জন্য ফিরে আসতে হবে।”

অধর প্রশস্ত হয় ফারাহর, দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কমান্ডার কে। চাদর টেনে নিজেদের ঢেকে নিল তাশফিন। সেদিনের আসঙ্গ রাত্রির একটুকরো স্মৃতি ভেসে উঠে মানসপটে। কাঁধের দিকের কামিজটা নামিয়ে গ্রীবা দেশে তার এঁকে দেওয়া টকটকে লাল চিহ্নে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিল সে। ঠোঁটে ঝু’লছে প্রশান্তির হাসি।ফের অনুভব করলো বক্ষ ভাঁজে ব্যথা। কামড়ে দিয়েছে ফারাহ।
“শোধবোধ।”
“তাই?”

ভ্রু কুঁচকে শুধোয় তাশফিন। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল ফারাহ। আচমকা তাকে টেনে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো তাশফিন। শরীরে তীব্র শিরশিরানি বয়ে যাচ্ছে ফারাহর। সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসে তার। মিনিট খানেক পরেই ছেড়ে দিলো তাশফিন। ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে ফারাহ।
“এবার?”
নাক ফোলায় ফারাহ, মুখ নামিয়ে ক্লিন শেভ করা গালে কামড় বসিয়ে দিলো তাশফিনের। তাতে বাধা দিলো না তাশফিন বরং আবেশে চোখ বুজে নিল।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩৫

“এবার ঠিক আছে।”
হেসে ফেলল তাশফিন, ফারাহ ফের মুখ গুজে বুকে।আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয় ফারাহর চুলের ভাঁজে। নিজের অতি নিকটে টেনে ভালোবাসার চাদরে আড়াল করে নেয়।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩৭